কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

শিবাংশু দে




জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি - 



"-ঘর তখন ছোট্ট ছিলো, অনেকটা  ঠিক তোমার মতন
মলিন ছেঁড়া জামার মতন, দু-একটি পা নামার মতন
ছোট্ট ছিলো, এখন অনেক বদলে গেছে
কাঁঠালকাঠের চৌকি বদলে হয়েছে খাট
কুঁড়েঘরের দরজা সরে জোড়া কপাট
এখন অনেক বড়ো হয়েছে, -ঘর এখন বড়ো হয়েছে
এখন অনেক বুড়ো হয়েছে, অনেকটা ঠিক তোমার মতন..."

সদর বাজার থেকে যে রাস্তাটা বড়ি বাজারের দিকে গিয়েছে, তার বাঁদিকে স্টেডিয়ম রেখে ডানদিকে ঘুরলেই মাটির রাস্তা চলে গেছে সেনটোলা, সাহেববাঁধ  সেইপথের শুরুতেই একটা প্রায় খন্ডহরমার্কা বিশাল বাড়িতে থাকতো আমার বন্ধু কৌশিক দু'টো ঘর ভাড়া নিয়ে  কৌশিক ছিলো একটি টিপিক্যাল ক্যালকেশিয়ানউচ্চিংড়ে  পৃথিবীতে কিছুই তার অজানা নেই  মহানগরের লোকেরা জন্ম ইস্তক একটা প্রতিজ্ঞা করে ফেলে ; তারা কিছুতেই বিস্মিত হবেনা। ' আর নতুন কী?' সর্বক্ষেত্রে তাদের প্রথম প্রতিক্রিয়া।  নেহাত ব্যাংকের চাকরি করতে এই অজ গ্রামে তাকে থাকতে হচ্ছে, নয়তো কা'কে সে চেনেনা ? অথবা কে তা'কে চেনেনা? কলকাতায় তার ঠিকানা ছিলো বাঙ্গুর  নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী নাকি ওদের প্রতিবেশী ছিলেন  ওর গপ্পোগুলো- ছিলো সেরকম। যেমন, বাঙ্গুরে বানভাসি হওয়ায়নীরেনদার কবিতা ' হ্যালো কলকাতা' প্রথম শ্রোতা নাকি সে নিজে  আমাদের কাছে গাঁট্টা-ফাঁট্টা খেয়ে বললো তার প্রভাব সে একদিন প্রমাণ করেই ছাড়বে।কিছুদিন পরে সে একটা বেশ পুরোনো মতন দেখতে বই নিয়ে আমার বাড়িতে এসে হাজির।  আমার সামনে সগৌরবে রেখে সে বলে, দ্যাখ এটা  আমি দেখি  বইটিনীরেনদার প্রথম কাব্যগ্রন্থ "নীরক্ত করবী' প্রথম সংস্করণ। আমার জন্মের ঢের আগে প্রকাশিত হয়েছিলো  খুঁজতে গিয়ে শুনেছিলুম, ছাপা নেই  তা সেই বই ওরকাছে? এখানেই শেষ নয়, সে প্রথম পাতা খুলে দেখায়, " কৌশিকের জন্য", নীরেনদার নিজের হাতে লেখা। ওঁর অপূর্ব হাতের লেখা আমি চিনি, একেবারে জেনুইন।মৌনতা ছাড়া আমার কোনও উত্তর নেই  তখন সে বলে, আমাদের কাছে সম্মান রাখতে নীরেনদার বাড়ি থেকে বইটা হাইজ্যাক করে নিয়ে এসেছে, ওঁর নিজেরসংগ্রহ থেকে। খুব উদারভাবে আমাকে বলে, তুই যতোদিন ইচ্ছে বইটা নিজের কাছে রাখতে পারিস, শুধু মেরে দিসনা।



সে হেন কৌশিক একদিন ভোর আটটায় আমার বাড়িতে এসে হাজির  বলে, আরে দ্যাখ সকাল সকাল পুরো কিচাইন। বলি, হলোটা কী?
-আরে বুড়ো এসে হাজির সক্কালবেলায়, সঙ্গে একটা চ্যালাও রয়েছে। টিট্লাগড়ে এসে ভোরবেলা চক্রধরপুরে নেমে খুঁজতে খুঁজতে চাইবাসায় সোজা আমার বাড়ি।রাতভর মাল না খেয়ে শরীর আনচান করছিলো দুজনের  তেষ্টা মিটিয়ে এখন ঘুমোতে গেছে।
বুঝতে পারি, 'বুড়ো'টি কে 
-তো, কী করবি, ছুটি নিবি আজ ?
-মাইরি আর কী, আজ আমাকে ক্যাশ রেমিট্যান্স নিয়ে যেতে হবে বাইরে...
-তবে..?
- জন্যই তো তোর কাছে এলাম, এসব কবি-টবিদের কেস। আজকের দিনটা সামলে দে বাবা...
-দ্যাখ, দু'জনকে সামলানো মুশকিল ; চ্যালাটা কে?
- আরে ওটা বেকার, ফুলটুশ টাইপ। ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে নাকি কী সব আত্মীয়তা আছে। বেশি ঝামেলা করলে দাবড়ে দিবি...



চিন্তায় পড়ে যাই। আমার স্বপ্নের কবি, কিন্তু সামলে রাখা একটা চ্যালেঞ্জ  তাঁর 'অভিনীত অপ্রকৃতিস্থতা' মর্ম বোঝা 'মুশকিল নহি, নামুমকিন হ্যাঁয়' চাইবাসারমতো একটা মধ্যযুগীয় গ্রামে চারদিকে জনতা হাবিলদার, জগতের চরিত্রপ্রহরী  ব্যাংকের ছেলেগুলো এমনিতেই সবসময় হাই স্ক্রুটিনিতে থাকে  তার উপরআমার প্রতি তারা আবার একটু বেশিই দয়াশীল  যাকগে দেখা যাবে...

বলি, ঠিক আছে, সাড়ে 'টার মধ্যে আমি চলে আসবো। একটা মহার্ঘ সি এল গেলো।
---------------------------------------
".... তুমি ছেঁড়া জামা দিয়েছো ফেলে
ভাঙা লন্ঠন, পুরোনো কাগজ, চিঠিপত্র, গাছের পাতা-
সবই কুড়িয়ে নেবার জন্য আছে কেউ
তোমাদের সেই হারানো দিনগুলি কুড়িয়ে পাবেনা তোমরা আর "
সুকান্ত আমার অনেকদিনের বন্ধু  সেই হাফপ্যান্টের আগে থেকেই  ডাকনাম সুকু  আমাদের মতো জামশেদপুরেই ওদেরও সব কিছু  ওর কাকা থাকতেনকদমায়। সুকুর সঙ্গে ছোটোবেলা থেকেই যাতায়াত ওঁদের বাড়ি  রিমা, মানে মধুরিমা সুকুর খুড়তুতো বোন  বছর তিনেকের ছোটো হবে আমাদের থেকে   ওকেযে দেখতে কেমন বা  যে একটা মেয়েএমন কোনও অনুভূতিই আলাদাভাবে গড়ে ওঠেনি কখনও। ছেলেরা বড়ো হই মাথায়মেয়েরা বড়ো হয় মনে। যখনকলেজে পড়ি , তখন মনে হতো রিমা বোধ হয় একটু অন্যভাবে কথা বলে আজকাল  খুব তাড়াতাড়বড়ো হয়ে যাচ্ছিলো সে পুজোর সময় তাকে যে অনেকেঘুরে দেখছেসেটা বোঝা যেতো  নিয়মিত দেখাশোনাতবু ব্যক্তিগতভাবে সে আমার ঘনিষ্ট বন্ধুর বোনআমার কাছে সেটাই ছিলো তার পরিচয়। কলেজ ছেড়েইপ্রায় সঙ্গে সঙ্গে চাকরিতে ঢুকে পড়া  জামশেদপুর ছেড়ে বাইরে চলে যাওয়া  নিত্য যোগাযোগ এভাবেই কম হয়ে যেতে থাকে  এর মধ্যে পর্ণা আসে মঞ্চে  আমিজামশেদপুরে ফিরে আসার পরেও বেশ কিছুদিন  রিমার সঙ্গে দেখা হয়নি। হঠাৎ একদিন বিষ্টুপুর বাজারে মেঘানির দোকানের সামনে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।চিনতে পারিকিন্তু তাকে এখন দেখতে হয়েছে যেন সোয়ানলেকের হংসপরী। আমি দেখছিলুম তাকে। আমার সেই বিস্মিত চাওয়া দেখে মৃদুস্বরে বলেছিলো,শিবাজিদাচিনতে পারছোনা নাকি?
-পারছি তোকিন্তু তুই তো দেখছি একেবারে হিরোয়িন হয়ে গেছিস....!!
-বাজে কথা রাখো  তুমি ফিরে এসেছো খবর পেয়েছিকিন্তু একবারও বাড়িতে আসোনি  মা জিগ্যেস করছিলো...
হ্যাঁরেএতো ব্যস্ত হয়ে পড়েছি ... সত্যি...
-কাকে নিয়ে ব্যস্ত হলেপর্ণা....?
-আরে তুই এসব পাকা পাকা কথা শিখলি কবে ?
-অনেকদিন...
-তুই চিনিস ? পর্ণাকে...
-চিনি তোসাকচিতে থাকে  রবীন্দ্রভবনে গান শেখে...
-হমমঅনেক কিছুই জানিস দেখছি...দাঁড়া আসবে একটু পরে ... পরিচয় করিয়ে দেবো...
-থ্যাংক ইউপরিচয় করাতে হবেনাআমিই করে নেবো... আজ আসি। বাড়িতে এসো , কথা হবে...
-আয়....

 যেন এক অন্য রিমা  এতোদিন ধরে যাকে চিনিসে নয়...



সেদিন পর্ণা আর আসেনি। কামানি সেন্টারের সামনে থেকে দেখতে পেয়েছিলো রাস্তার ওপারে আমি আর মধুরিমা গপ্পো করছি  দেখা করার প্রয়োজন বোধকরেনি আরফিরে গিয়েছিলো উত্তপ্ত উষ্মায়।
(ক্রমশ)

(সৌজন্য-গুরুচণ্ডালি)

0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন