জীবনানন্দ দাশের সাহিত্য সম্ভার :
সমকালীনতার স্বর ও স্বরান্তর
রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কাব্য-কবিতা তথা বাংলা
সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল একজন নক্ষত্র জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪)। মূলত কাব্য-কবিতার কারণে পাঠকের
কাছে তিনি সমাদৃত হলেও একাধারে তিনি ছিলেন গল্পকার, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক।
সব্যসাচীর ন্যায়ই জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেছেন স্বভঙ্গিমায়।
তাঁর সমকালীন কিংবা পূর্ববর্তী সাহিত্যকারদের সঙ্গে তুল্যমূল্য বিচার বিশ্লেষণ
করলেই শ্রীদাশের অন্যোন্যতা চোখে পড়ে। কবির জীবদ্দশা মাত্র পঞ্চান্নটি বসন্তে
সীমায়িত। ইতিহাসের
পাতায় চোখ রাখলে দেখা যায় বঙ্গভঙ্গের প্রতিরোধে সংঘটিত প্রতিবাদ, ঔপনিবেশিক
শাসনতন্ত্রের শোষণ, দুই বিশ্বযুদ্ধ ও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং শেষে
ধর্মকেন্দ্রিক রাষ্ট্রবিভাজন ভারতীয় জনসমাজকে এক তীব্র সঙ্কটের সম্মুখীন করে তোলে।
কবির ‘মহাপৃথিবী’ ও ‘বেলা অবেলা কালবেলা’ কাব্যগ্রন্থে এই সময়পট যথার্থভাবে
চিত্রিত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশের বিবরণী অনুসারে, ‘মহাপৃথিবী’র “...কবিতাগুলো ১৩৩৬ থেকে ১৩৪৫-৪৮ এর ভিতর রচিত।
বিভিন্ন সাময়িকপত্রে বেরিয়েছে ১৩৪২ থেকে ১৩৫০-এ।’’১
আবার ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘সাতটি তারার তিমির’
কাব্যে ধ্বংসের ভগ্নস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর পথান্বেষণে নিয়োজিত হয়েছেন কবি।
যুদ্ধের অন্ধকার তাঁর চেতনায় প্রসারিত হয়েছে এমনভাবে যে তিনি বারংবার পথ-ভ্রমের
আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। আসলে
এই কাব্যের কবিতাগুলির রচনাকাল ১৩৩৫ থেকে ১৩৫০ বঙ্গাব্দের মধ্যে। ফলত সেই
মেঘাচ্ছন্নকালে দৃঢ় প্রত্যয়ের বদলে দ্বিধাগ্রস্ত সুরটিই প্রধান হয়ে উঠেছে। এই
প্রসঙ্গে ‘তিমিরহননের গান’ কবিতা উল্লেখযোগ্য—
“কোনো হ্রদে
কোথাও নদীর ঢেউয়ে
কোনো এক সমুদ্রের জলে
পরস্পরের সাথে দু-দন্ড জলের মতো মিশে
সেই এক ভোরবেলা শতাব্দীর সূর্যের নিকটে
আমাদের জীবনের আলোড়নে—
হয়তো বা জীবনকে শিখে নিতে চেয়েছিলো।
অন্য এক আকাশের মতো চোখ নিয়ে
আমরা হেসেছি,
আমরা খেলেছি;
স্মরণীয় উওরাধিকারে কোনো গ্লানি নেই ভেবে
একদিন ভালোবেসে গেছি।
সেইসব রীতি আজ মৃতের চোখের মতো তবু—
তারার আলোর দিকে চেয়ে নিরালোক।’’২
মানবমনের আশা-প্রত্যাশার সমান্তরালে থাকা যাওয়া
দ্বিধা কবির কলমে তাই অর্থবহ হয়ে ওঠে। বর্হিবিশ্বের দুর্বিপাক মানুষের জীবন-যাপনের
স্বাভাবিক নিয়ম-কানুনগুলিকে ব্যঙ্গ করেছে আরো একবার। জীবনের সব দীপ্তি যেন কুয়াশাচ্ছন্ন
হয়ে প্রত্যাবর্তন করেছে। সমালোচক মহল তাই বলেছেন, “ ‘বনলতা সেন’ জীবনানন্দের ভূগোল
ও ইতিহাসচেতনার শ্রেষ্ঠ কাব্য, ‘সাতটি তারার তিমির’ সমকালচেতনার শ্রেষ্ঠ কাব্য।
‘সাতটি তারার তিমির’ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পটভূমিতে লেখা। স্বপ্নক্লান্ত, কল্পনাক্লান্ত কবি
সময়ের অন্ধাকারে পথ খুঁজছেন। শেষ পর্যন্ত বিশ্বাস রেখেছেন মৃত্যুত্তর মানবত্বে।’’৩
‘স্বভাবভীরু’ এই কবি সমকালীন প্রগাঢ় বিষণ্ণতার
বেড়াজাল কাটিয়ে সময়ের থেকে দূরবর্তী বিশ্বকে নিরীক্ষণ করেছেন তিনি। প্রসঙ্গত ব্যক্তিগত জীবনে সম্পর্কের
টানাপোড়েনও প্রতিবিম্বিত হয়েছে জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যে। বর্তমান সময়ের নিরীখে এই
বিষণ্ণতা, বিচ্ছিন্নতা কিংবা একাকীত্বের বোধ সামাজিক জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ
হয়ে উঠেছে। সমাজের সকল স্তরেই যার প্রতিফলন প্রায়শই দেখা যায়। আসলে এই বিচ্ছিন্নতা
হল আত্মসংযোগ বিনাশের একটি বোধ, যার সূত্রে ধীরে ধীরে বিষণ্ণতা এবং একাকীত্বের
উদ্রেক হয়। ‘বোধ’ কবিতায় কবির কলমে তাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে;
“সব কাছ তুচ্ছ হয়, -পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়।’’৪
আসলে একজন মানুষ তার জীবদ্দশায় কখনো নির্জন
দ্বীপান্তরে নির্বাসিত হয়ে একাকী হয় অথবা সকলের মধ্যে বিরাজমান থেকেও একাকীত্ব
অনুভব করে। পরিবার কিংবা প্রিয় মানুষদের সান্নিধ্যে থেকেও একজন ব্যক্তি একাকী জগতে
ক্রমশ অবগাহন করে চলে; অথচ তার আশে-পাশে থাকা কেউই তার খবর রাখে না। উল্লেখ্য
রবীন্দ্রনাথের ‘মৃণাল’ চরিত্রটি, সংসারের মধ্যে থেকে একাকী যাপনের চিত্র যেন
ভবিষ্যতের সময়ের পদার্পণকেই যেন সূচিত করেছিল। কল্লোল-কালের সাহিত্যিক মানিক
বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ উপন্যাসে ‘শশী’ চরিত্রটির মধ্যেও এই
বিষন্নতা বা একাকীত্বের স্বর শোনা যায়। আসলে রবীন্দ্র পরবর্তী সাহিত্যে এই একাকী মনের
যাপনচিত্র ক্রমশ দীর্ঘায়িত হয়েছে। জীবনানন্দ দাশের ‘বোধ’ কবিতায় সেই দিকটি আরো
প্রকটিত হয়ে ওঠে;
“সকল লোকের মাঝে বসে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাঁধা?’’৫
অধ্যাপক সুমিতা চক্রবর্তী এই সমাজ প্রতীয়মানতা সম্পর্কে
মন্তব্য করেছেন; “সত্যিই ১৯৪০ থেকে ১৯৫০ এর মধ্যবর্তী যে দলিত ও বিপন্ন, জটিল ও
নিষ্ঠুর দশক—তার ভেতর দিয়ে এতখানি আর কোনো কবি হেঁটে গিয়েছিলেন কিনা জানি না।’’৬ শুধু কবিতায় নয়
উপন্যাসের প্রেক্ষাপটেও এই রক্তাক্ত সময়ের উপাখ্যান উঠে এসেছে। কবি যেন তাঁর সমকালীন
রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের ক্ষতচিহ্ন সহ সময়ের দোদুল্যমানতাকে পাঠকের সামনে উপস্থাপন
করলেন। রক্তপাতের এই কালো ইতিহাস স্মরণ
করিয়ে দেয় কবির ‘বাসমতীর উপাখ্যান’ উপন্যাসের কথা। জাহাজের বাটলার ও প্রভাসবাবুর
কথা-বার্তায় উঠে এসেছে দেশভাগের সুর। সাম্প্রদায়িকতার উস্কাকানিতে গগন, শশীরা
নিজেদের মিথ্যা পরিচয়ে ভর করে ইয়াসিন, হানিফদের সঙ্গে লড়াইয়ে মেতে উঠেছে। আবার
দেখা যায় বাসমতীর সমাজে একটি গরুর নিখোঁজ হওয়াকে ঘিরে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে চাপা
উত্তেজনাও।
আবার, পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে একদিকে বেকারত্ব
অন্যদিকে দাম্পত্যের মায়াজালের নানান প্রতিকূলতার সন্নিবেশ দেখা যায় ছোটোগল্প সহ
কথাসাহিত্যের পরিসরে। সেই সঙ্গে এম এ পাশ রুজি-রোজগারহীন বেকার জীবনের ধারাপাতও
তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলির অন্যতম উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। কবির ব্যক্তিজীবনের
প্রতিফলন এই ঘটনার সামিল একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশ্বব্যাপী মন্দা, নিত্য
প্রয়োজনীয় জিনিসের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধি ফলে সারা দেশে চাকরি দুর্লভ হয়ে ওঠে।
উচ্চ শিক্ষিত এম এ পাশ করা বাঙালি যুবক চাকরির জন্য হন্যে হয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়।
গ্রাম ছেড়ে এসে তারা আশ্রয় নেয় মেসবাড়ির অন্দরে। এই সূত্রেই জীবনানন্দ শহর কলকাতার
প্রসঙ্গ এনেছেন। ঔপনিবেশিক ভারতের রাজধানী হওয়ায় নগর কলকাতা উপার্জনের একামাত্র
ঠিকানা হয়ে ওঠে।
ফলত “বাংলার লক্ষ্যগ্রাম নিরাশারা আলোহীনতায় ডুবে
নিস্তদ্ধ, নিস্তেল’’৭ হয়েই পড়ে রইল আর কলকাতার অলিগলি, ফুটপাত থেকে
স্টেশনে স্রোতের শ্যাওলার মত ভেসে বেড়ালো শিক্ষিত বেকার যুবকের দল। উদাহরণ
প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘লোভ’ শীর্ষক গল্পের কথা। নায়ক নৃপেনের মনোজগতের দিকটি পরিস্ফুট
করে ‘রূপসী বাংলা’-র কবি বলেছেন; “মস্তবড় সংসারের এক কিনারে সে পড়ে থাকে। কেউ বা
কেরানিগিরি করে ত্রিশ টাকা পায়, সাতাশ-আটাশ বছরের বেকার যুবকটি পড়ে থাকে।...তার
কোলাহল এখন অনেক দূরে। প্রতিধ্বনির মত, এই ক্ষীণ শব্দটুকুও যেন শিগ্গিরই মিলিয়ে
যাবার মুখে স্রোত তাকে বড় প্রবঞ্চিত করে চলে যাচ্ছে।’’৮
আবার ‘মৃগয়া’ গল্পে শিকারী চরিত্রটির মধ্যে একাধারে
একাকীত্ব যাপনের সঙ্গে নায়কের প্রকৃতি প্রতি বিমুগ্ধতাও লক্ষ্য করা যায়। ‘বেশি
বয়সের ভালোবাসা’ গল্পের ঘটনাক্রমে দেখা যায় আভা পেশায় স্কুল শিক্ষিকা হলেও তার
শিল্পীসত্ত্বা বা কবিসত্ত্বা বারংবার প্রকটিত হয়ে ওঠে। আভার কাছে ‘ভালোবাসার কাজ’
লেখা-লিখি। গল্পকারের কলমে, “যে মুহূর্তে আবেগ আসে, ঠিক তখনই কাজ করতে হয়, আবেগ
উৎরে গেলে আর্টিস্টের পক্ষে লিখতে বসা
যেমন ভুল কারু পক্ষে কোনো সঙ্কল্প খাটাতে যাওয়াও তেমনি নিরর্থক।’’৯
কবিতা লিখে আভার আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরে আসেনি
বরং বিহ্বলতার সমুদ্রে অবগাহন করেছে সে। এখানেই জীবনানন্দ দাশের ব্যক্তিজীবনের
প্রতিফলন লক্ষ্য করা যায়। ‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে হেম চরিত্রটির মধ্যে এই দ্বিধা
বিভক্ত মনোভাবটি বারংবার প্রতিবিম্বিত হয়েছে। সে তাই বলেছে, “কারুবাসনা আমাকে
নষ্ট করে দিয়েছে। আমার সংসারকে ভরে দিয়েছে ছাই-কালি-শূন্যতায়।’’১০
‘কারুবাসনা’-র হেম-কল্যাণী কিংবা ‘মাল্যবান’-এর মাল্যবান-উৎপলার দাম্পত্য-শিথিলতা
চিত্রণ জীবনানন্দ কৃত গদ্যের বহুল পরিচিত
দিক। এই প্রসঙ্গে লাবণ্য দাশের ‘মানুষ জীবনানন্দ’ উল্লেখ্য। সেখানে তিনি একটি
নিটোল দাম্পত্যের ছবি তুলে ধরেছেন। সাংসারিক জীবনের প্রেক্ষিতে কবির উক্তি লাবণ্য
দেবীর বক্তব্যের বিপরীত সাক্ষ্য দেয়। তাঁর লেখা অনুসারে, “তোমার কেবল সংসার আর
সংসার। তুমি কি কিছুতেই তার ওপরে উঠতে পার না ? কোনোদিন দেখলাম না যে তুমি কবিতার
আলোচনায়, মুহুর্তের জন্য যোগ দিয়েছ।’’১১
অথচ ‘হাতের তাস’ ছোটগল্পে এই ধরনের দাম্পত্য-শৈত্যের
চিত্র লক্ষ্য করা যায়। সেখানে বছর পঁয়ত্রিশের প্রমথ বেকার। তিনবছর আগে তার বিয়ে হয়
সুমিত্রা সঙ্গে। এম এ পাশ করে কলকাতার একটি কলেজে টেম্পোরারি হিসাবে কর্মরত
থাকাকালীন সে জার্মান ভাষা আয়ত্ত করে। লেখালিখিতে সে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে অথচ
ব্যক্তিগত জীবনে অস্বচ্ছলতার ছবিই উঠে আসে। প্রমথ ওকালতি পাশ করলেও পসার তার নেই।
ব্যক্তিজীবনের এই দূরত্ব কথকের জবানীতে—
“নিজের জীবনকে প্রমথর স্ত্রী অত্যন্ত অসাড় মনে করে।
একটা বেকার উকিলের বউ, একটা উচ্ছন্নে যাওয়া কেরানির একটা দজ্জাল শাশুড়ির পুত্রবধূ—
নিজের জীবনটাকে সুমিত্রা একটা পোড়ো ভিটের মরা ধুধুলে লতার মত পণ্ড মনে করে।’’১২
আবার কবির জন্মশতবর্ষে ‘বিভাব’ পত্রিকায় প্রকাশিত
(ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত) ১৯৩১ সালের জুলাই ও সেপ্টেম্বর মাসে লেখা তাঁর ডায়েরির
অংশে কবি লিখেছেন—
“— I wish I would be 1 bachelor again—aghast when i think of
the
Future domestic life—’’
“—Re : Wife : the bleak future…No way wriggling out.’’১৩
এছাড়া ১৯৩১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জীবনানন্দ লিখছেন—
“…By my having a wife & child
(apology for things) I have forfeited my claims to romance, love even
sympathy.’’১৪
জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যকথা আসলে ব্যর্থ প্রেমের বা
‘নষ্ট দাম্পত্যের’ প্রতিবিম্বন। ‘কারুবাসনা’র সম্মোহনে তাঁর কেন্দ্রীয় চরিত্ররা
মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাড়িত। বস্তুনিষ্ঠ জগতের মাঝে তাদের মনের চিলেকোঠায় প্রছন্ন
শিল্পীসত্তা থেকে যায়। তারা যেন যুগান্তরের পথ নির্দেশক।
প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ
গল্প’ সংকলনে জানিয়েছেন, “সাহিত্যকে শুধু ভাষা, শৈলি, আঙ্গিক নিরিখে বিচার করার
মানদণ্ডটি ভুল। সাহিত্যের বিচারে ইতিহাস প্রেক্ষিত হওয়া দরকার। লেখকের লেখার সময় ও
ইতিহাসের প্রেক্ষিত মাথায় না রাখলে কোনো লেখকেরই মূল্যায়ন করা যায় না।’’১৫
শ্রী দাশের সাহিত্যসম্ভার তার ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। বরং তাঁর ‘উত্তর রৈবিক বাংলা
কাব্য’ প্রবন্ধাংশে কবি তাই বলেছেন, “কবির পক্ষে সমাজকে বোঝা দরকার, কবিতায়
অস্থি-র ভিতরে থাকবে ইতিহাসচেতনা ও মর্মে থাকবে পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান। কাল বা সময়
বৈনাশিক; কিন্তু সে সেই সমস্ত কুয়াশাগুলিকে কেটে-কেটে চলেছে যা পরিপ্রেক্ষিতের
ব্যাপ্তি বাড়াবার পক্ষে অন্তরায়।’’১৬
কবিতাকে তিনি শিক্ষিত মানুষের বৈঠকখানার আসর থেকে
সরিয়ে খেটে খাওয়া জনগোষ্ঠীর আঙিনায় পৌঁছে দিতে চেয়েছেন। ‘কবিতার কথা’য় তিনি এ
প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমি বলতে চাই না যে কাব্যের সঙ্গে জীবনের কোনো সম্পর্ক নেই;
সম্বন্ধ রয়েছে কিন্তু প্রসিদ্ধ প্রকটভাবে নেই। কবিতা ও জীবন একই জিনিসের দুই রকম
উৎসারণ।’’১৭ জীবনানন্দ দাশ আদ্যোপান্ত কবি। পূর্বসূরী রবীন্দ্রনাথের
মতোই তিনিও কবিতার পাশাপাশি উপন্যাস-প্রবন্ধ-ছোটোগল্পে স্বচ্ছন্দে বিচরণ করেছেন। তাঁর প্রায় সকল সাহিত্য সম্ভার বিশেষত
কবিতাগুলি মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হয়। তাই উত্তরকালের সাহিত্যিক রূপে তাঁকে বিবেচনা
করা অসঙ্গত হবে না। তাঁর রচনার প্রেক্ষাপটে ছিল কালের এক জটিল আবর্ত। অথচ অনাগত
অবশ্যম্ভাবীকালের আভাষ গল্পে লক্ষ করা যায়। দুই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা বর্তমান সময়ে
নেই; কিন্তু তার বিষবৃক্ষ এই সময়েও বিদ্যমান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময় জাপানের দুটো শহর প্রযুক্তির করালগ্রাসে বিলীন হয়ে যায়। সেই ধ্বংসের বীজ-রোপিত
হয়ে প্রযুক্তির অগ্রগতিকে তরান্বিত করেছে। মানব সভ্যতা ক্রমশ কৃত্রিমতায়
পরিবেষ্টিত হয়ে উঠেছে। ঘনীভূত হয়েছে প্রাণ ও প্রকৃতির সঙ্কট।
জীবনানন্দ দাশের সাহিত্যবিশ্ব নতুন জীবনবোধের
পরিচায়ক। ছেলেবেলার পাঠ্যক্রমে জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে প্রথম পরিচয় হয়। অপরিণত বুদ্ধি-বিবেচনার মারফত বোঝা
ও না বোঝার ইন্দ্রজালে তাঁর কবিতার সঙ্গে সখ্যতা বাড়ে। পরবর্তীতে কবির গদ্যরচনার
সুবিন্যস্ত ভুবন আমায় মোহিত করে। সময়ের পর্বান্তর থেকে সমাজ-পরিবর্তিতকালে মানুষের
ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে কোন্ কোন্ সঙ্কটের সম্মুখীন হয় এবং কীভাবে মানুষের
অস্তিত্বে তা মিশে যায়; সেই যুগচিহ্ন কবির কথাসাহিত্যে অন্যতম অনুসন্ধানী বিষয় হয়ে
উঠেছে। তাঁর গল্প কিংবা উপন্যাস অথবা কবিতা বারংবার জানান দেয় কালপ্রবাহের কথা;
সেই সঙ্গেই মানবমনের অন্তরালে জমে থাকা যন্ত্রণা- ক্ষতের ইতিবৃত্ত প্রতিবিম্বিত
হয়ে সাধারণের সম্মুখে। আজ ‘মহাপৃথিবী’-র কবির ১২৬ তম জন্মবার্ষিকীতে তাঁর অতুলনীয়
সৃষ্টি আমাদের বারংবার স্মরণ করায় মানবজীবন সুখদুঃখের সমন্বয়ে অতিবাহিত হয়। অথচ
মানুষ কেবলমাত্র হৃদয়ের আলোকে সকল প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে সম্ভবপর হয়। তাই পরিশেষে বলা যায়, জীবনানন্দ
দাশের সাহিত্যকীর্তি কেবলমাত্র বাংলা সাহিত্যের জ্বাজল্যমান সৃজন শুধু তাই নয়; তা
মানবজীবনের নিগূঢ় দলিল।
তথ্যসূত্র
1. দাশ,
জীবনানন্দ, ‘মহাপৃথিবী’, নবপর্যায় সিগনেট,
কলকাতা, পৃ ৭
2. দাশ,
জীবনানন্দ, (সৈয়দ আবদুল মান্নান সং ও সম্পা.), ‘জীবনানন্দ দাশ : প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতাসমগ্র’, অবসর, ঢাকা, পৃ ২৩১
3. চক্রবর্তী,
সুমিতা, ‘জীবনানন্দ : সমাজ ও সমকাল’, সাহিত্যলোক,
কলকাতা, পৃ ৩২
4. দাশ,
জীবনানন্দ, ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’, নাভানা, কলকাতা, পৃ ৫
5. তদেব,
পৃ ৬
6. চক্রবর্তী,
সুমিতা, ‘জীবনানন্দ : সমাজ ও সমকাল’, সাহিত্যলোক,
কলকাতা, পৃ ২৬
7. দাশ,
জীবনানন্দ, (সৈয়দআবদুল মান্নান সং ও
সম্পা.), ‘প্রকাশিত-অপ্রকাশিত
কবিতাসমগ্র’, অবসর, ঢাকা, পৃ ৩১৮
8. দাশ,
জীবনানন্দ, ‘৩০টি গল্প’, (দেবেশ রায় সম্পা.),
প্রতিক্ষণ, কলকাতা, পৃ ১৯৪
9. তদেব
পৃ ৩৫
10. দাশ,
জীবনানন্দ, (দেবেশ রায় সম্পা.), ‘জীবনানন্দ সমগ্র জন্মশতবর্ষ সংস্করণ উপন্যাস ১’,
প্রতিক্ষণ, কলকাতা, পৃ ২৩৫
11. দাশ,
লাবণ্য, ‘মানুষ জীবনানন্দ’, ভাষাচিত্র, ঢাকা, পৃ ৪৩
12. দাশ,
জীবনানন্দ, ‘জীবনানন্দ দাশ ৩০টি গল্প’, প্রতিক্ষণ, কলকাতা, পৃ ৪৬
13. গুহ,
ভূমেন্দ্র (সম্পা.), ‘বিভাব : জীবনানন্দ দাশ
স্মরণসংখ্যা’, কলকাতা, পৃ ৪০৫
14. তদেব,
পৃ ৪০৮
15. দেবী,
মহাশ্বেতা, ‘মহাশ্বেতা দেবীর ছোটোগল্প সংকলন’ (শমীক বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পা.), ন্যাশানাল বুক ট্রাস্ট ইন্ডিয়া, নতুন দিল্লি, পৃ vii
16. দাশ,
জীবনানন্দ, ‘জীবনানন্দ দাশ : প্রবন্ধ সমগ্র,
(ভূমেন্দ্র গুহ সম্পা.), প্রতিক্ষণ, কলকাতা, পৃ ৩৮
17. দাশ,
জীবনানন্দ, ‘ জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা’, নাভানা, কলকাতা, পৃ ৫