কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

অভিজিৎ মিত্র

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১৩০


পার্ক সার্কাস

ট্রেনটা ঝাঁকুনি দিয়ে দাঁড়াতেই রাজার চোখ খুলে গেল। হাল্কা তন্দ্রা কেটে ও আশেপাশের জায়গাটা বোঝার চেষ্টা করল। দুপুর তিনটে একের লোকাল, দমদম ক্যান্টনমেন্ট থেকে মাঝেরহাট, ভায়া প্রিন্সেপ ঘাট। ঠিক সময়ে ক্যান্টনমেন্ট থেকে ট্রেন পেয়ে ফাঁকা জানলার ধারে বসে ওর চোখ লেগে এসেছিল। ভেবেছিল উঠে হয়ত দেখবে পাতিপুকুর পেরিয়ে ট্রেন এখন কলকাতা বা টালা স্টেশনের আশেপাশে। কিন্তু ভাল করে চেয়ে ও বুঝতে পারল একদিকে ক্যানেল সাউথ রোড, আরেকদিকে ধাপা রোড, মাঝে সেই দুর্গন্ধময় ক্যানেল। অর্থাৎ ট্রেন এখন বিধাননগর পেরিয়ে গুরুদাস ব্যানার্জী হল্ট পেরিয়ে পার্ক সার্কাসের দিকে। কিন্তু হঠাৎ এই ডাইভার্সন কেন? কোন নোটিস ছিল আগে থেকে?

কালীপুজোর পর আজ কি একটা কারণে সরকারি ছুটি বলে রাজার অফিস বন্ধ। খেয়ে উঠে ওর মনে হল অনেকদিন গঙ্গার পাড় ধরে প্রিন্সেপঘাট গার্ডেনরিচ হয়ে প্রকৃতির শোভা দেখা হয়নি। যেই ভাবা, ওমনি কাজ। জামা প্যান্ট গলিয়ে সিধে ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন। কিন্তু আজ ট্রেন যে এইভাবে ডাইভার্টেড হবে, সেই খবর কি আগে থেকে ছিল?

ও চারদিকে তাকিয়ে দেখল ট্রেন প্রায় ফাঁকা, কয়েকজন ইতস্তত এদিক ওদিক। এক বয়স্ক লোককে উল্টোদিকে বসে থাকতে দেখে ও এগিয়ে গেল। আপনি জানতেন? সেও খুব অবাক। কিছুই জানে না।

পার্ক সার্কাস রাজার অপছন্দের স্টেশনগুলোর ভেতর একদম ওপর দিকে। চারদিক পূতিগন্ধময়, শুধু নোংরা আবর্জনা, শয়ে শয়ে নোংরা বস্তা, আর তার মাঝে শুয়োরের খোঁয়ারের মত ছোট ছোট ঘুপচি ঘর, লাইনের প্রায় ওপরেই, খাটা পায়খানা, এর মাঝে অগুনতি লোকের বাস। কি করে থাকে, কে জানে! অক্টাভিও পাজের কবিতা মনে পড়ে। অবশ্য ওর অপছন্দের আরো এক কারণ ওর অতীত জীবনের এক ঘটনা। ওপরের  প্লাটফর্মে একজনকে অপেক্ষা করিয়ে ও ঝালমুড়ি আনতে যাবার বাহানায় নিচের প্লাটফর্মে নেমে এসে ট্রেন ধরে সোজা শিয়ালদা। প্রায় বারো বছর হয়ে গেল। একযুগ। সেই শেষ দেখা।

ট্রেন পার্ক সার্কাস ওপরের প্লাটফর্মে ঢুকতেই রাজা একটু নড়েচড়ে বসল। ওর চোখ নোংরা প্লাটফর্মে কিছু একটা খুঁজতে চাইছে। ডাইভার্টেড ট্রেন, দশ সেকেন্ডের বেশি দাঁড়াল না। তারপর বালিগঞ্জ, লেক গার্ডেন্স, টালিগঞ্জ, নিউ আলিপুর হয়ে সোজা মাঝেরহাট। নেমে ও জানতে পারল কালীপুজোর বিসর্জন উপলক্ষ্যে তিনদিন ধরে ট্রেন এখন ডাইভার্টেড। চুম্বকের মত ও আবার ট্রেনে বসে পড়ল। ওটাই বারাসাত লোকাল হয়ে ফিরবে। অথবা দুটো আবছা ছায়া খোঁজার জন্য।

বালিগঞ্জ পেরিয়ে আবার পার্ক সার্কাস। রাজা দরজার একদম সামনে। এদিক ওদিক দুর্গন্ধ, বস্তা। বারো বছর আগের একটা ভুল, যে কারণে ও এই স্টেশনে আর আসে না। ট্রেন থামছে। ও লাফ মারতে চায়। কিন্তু  কোন্‌দিকে? যে স্মৃতিকে ও একযুগ ডাইভার্ট করে রেখেছে, একটা লাফ মেরে আজ তার কোন সমাধান হবে? ঠিক তখনই হঠাৎ লাল সিগনালটাকে টুকরো করে স্টেশন জুড়ে নামাজ ছড়িয়ে পড়ল।


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন