কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর, ২০২৪

সুমন্ত চ্যাটার্জী

 

সমকালীন ছোটগল্প


দাঁড়িপাল্লা

-"কতদিন হল টোটো চালাচ্ছিস?"

-"বছর পাঁচ-সাত... "

-"এত রাতে বহরমপুরে তোর সাথে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি!"

-"আমিও..."

পঞ্চায়েত ভোটের ডিউটি সেরে বাড়ি ফেরার পথে নিখিলের দেখা হয়ে গেল বিলু'র সাথে। মাঝে পেরিয়ে গেছে তেইশটা বছর! দু'জনের মনে অনেক কথা জমে রইলেও রাতের আলো আঁধারিতে, শুষ্ক বাতাসের স্রোতে, চেপে যেতে হল অনেককিছুই! গুমোট নীরবতায় দুজনেই যেন ডুব দেয় সোনালী অতীতে আর হাতড়ে বেড়ায় সবথেকে রঙীন মুহূর্তগুলো! তখন কলেজের ফার্স্ট ইয়ার, পাস কোর্সের উষসী স্যান্যালের প্রেমে পড়েছিল গ্রামের ছেলে বিল্বেশ্বর ঘোষ ওরফে বিলু। সরস্বতী পুজোর দিন কলেজের মাঠে উষসীকে হাঁটুমুড়ে বসে, গোলাপ দিয়ে প্রোপোজ করেছিল নিখিল! তারপর থেকেই শুরু হয় অশান্তি! সেই অশান্তি গড়িয়েছিল থানা-পুলিশ, কোর্ট-কাছারি অবধি!

টোটোতেই একটা দামী সিগারেট ধরায় নিখিল, ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে, "তোর শরীরটা অনেক খারাপ হয়ে গেছে"। বিলু হাসে, ওপর দিকে তাকিয়ে বলে, "জীবন!"

-"তোর ঘুষির দাগটা মেলাতে সময় লেগেছিল প্রায় মাসখানেক।"

-"ওহ, না মানে আসলে...

-"নাহ ঠিক আছে বিলু, আমিও তো গুন্ডা পাঠিয়েছিলাম তোর বাড়িতে!"

বিলু চুপ করে যায়, মন দেয় টোটো চালানোয়। অসময়ে বাবা মারা যাওয়াতে কলেজের পড়াশোনাটাও শেষ করতে পারেনি ও। অগত্যা কলেজ ছেড়ে নেমে পড়তে হয় জীবনের যুদ্ধে। নিখিলের প্রতিশোধের আগুন তখনও শেষ হয়নি! নিজে উষসীর সাথে রেস্তোরা, পার্ক, শপিং মল কিংবা সিনেমা হলে ঘুরে বেড়ালেও বিলু'কে অকারণ থানার লক আপে তিনরাত কাটাতে বাধ্য করেছিল নিখিল, তারপর চারবছর ধরে কোর্টে করা নিখিলের মিথ্যা কেসের খরচও গুনতে হয়েছিল বিলু'কে! কলকাতা ছাড়ার পর কেমন যেন ধোঁয়ার মত পেরিয়ে গেল বছরগুলো!

 সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে সেটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নিখিল বলে, "বিয়ে করেছিস?"

-"হুম, মেয়ে আছে দুটো।"

-"বাহ! তা টোটো চালিয়ে সংসার চলে?"

-"সকালে এ.টি.এম.-এ পাহারা দিই, রাতে টোটো চালাই। বৌ অঙ্গনওয়াড়ি'তে কাজ করে, বড়ো মেয়েটা টিউশন ধরেছে অল্পস্বল্প। চলে যাচ্ছে। তোর...?"

-"ব্যাঙ্কে সার্ভিস, ডিভিশনাল ব্রাঞ্চ ম্যানেজার! ভোটের ডিউটি'তে এসেছিলাম বহরমপুর। হ্যাঁ, আমিও বিবাহিত। পুত্রসন্তান একটি।"

-"আচ্ছা। দুটো পঞ্চাশের এক্সপ্রেসটা ধরবি?"

-"ইচ্ছা তো আছে। পাবো?"

-"সময় আছে।"

আবার কিছুক্ষণ এক অযাচিত নীরবতা! বিলু কিছু একটা বলতে গিয়েও উসখুস করে চুপ করে গেলে নিখিল বলে, "আর কারোর খবর জানতে চাইছিস?" বিলু দু'দিকে ঘাড় নাড়িয়ে ঘুমহীন চোখ রাখে রাতের রাস্তায়। নিখিল বুঝতে পেরে হাসে, বলে, "উষসী'র খবর জানতে চাইছিস, তাই তো?"

-"নাহ!"

-"বেশ, তাহলে শোন, উষসী এক এন.আর.আই. ভদ্রলোক'কে বিয়ে করে সুইজারল্যান্ড চলে গেছে বছর আঠারো হল"

-"আমি জানতে চাইনি..."

-"এখন মনে হয়, তুই-ই সত্যিকারের ভালোবেসেছিলি ওকে! তোরই প্রাপ্য ছিল ও! কিন্তু তাতেই বা কি হতো? সমস্ত ভালোবাসার নীট রেজাল্ট তো সেই জিরো-ই!"

উদাস হয়ে পড়ে নিখিল, সিগারেট বার করে আরেকটা। কিন্তু সেটা ধরানোর আগে টোটোর গতি কমিয়ে দিয়ে বিলু বলে, "স্টেশন চলে এসেছি"। নিখিলের ঘোর ভাঙে, টোটো থামতেই সীটের ভারী ব্যাগটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এসে কাঁধে নেয় সেটাকে। কথামত চারটে একশো টাকার নোট বার করে ধরিয়ে দেয় বিলু'র হাতে। ট্রেন এসে থামতেই সেটাতে উঠে গিয়ে বসে ফাঁকা কামরার একটা উইন্ডো সীটে। টোটোর চাবি খুলে বিলু এগিয়ে আসে জানালার বাইরের দিকে, তারপর নরম কন্ঠে বলে, "সাবধানে যাস, দুনিয়াটা ভালো নয় একদম! সে কারণেই একটা মিথ্যা খবর রটিয়ে বছর আঠারো আগে উষসী বিয়ে করেছিল আমায়!"

ট্রেনটা চলতে শুরু করলে নিখিলের বিদ্যুৎপিষ্ট চোখের সামনে আস্তে আস্তে প্লাটফর্মের আলো থেকে অন্ধকারে মিলিয়ে যায় বিলু।

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন