সমকালীন ছোটগল্প |
দাম্পত্য
“আসিফ তোমাকে কেমন করে কিস করে বলো না? তুমি দেখবা আমি জীবনেও কাউকে বলব না। ব্যাপারটা নিয়া কখনোই হৈচৈ করব না। রিতা, বিশ্বাস করো, ব্যাপারটা আমি মেনে নিছি।”
আমার স্বামী বলে যাচ্ছে ঘোর লাগা স্বরে, যেন আসিফের প্রতি তার কোনো বিদ্বেষ নাই। যেন
সে তার নিকট আত্মীয়জন। আমি মরা মাছের মতো পড়ে আছি। বুঝতে পারছি সে আমাকে আর আসিফকে
কল্পনা করে উত্তপ্ত হচ্ছে।
“সে তোমাকে কেমন
করে পাগল রাখে?”
আরও ঘন কন্ঠস্বর,
কিস্-কিস্
মন্ত্র আওড়াচ্ছে যেন। মন্ত্রই তো। এ মন্ত্র তাকে দ্রুত উদ্দীপ্ত করে। একটু আগে
লোকটা আমার গভীর ঘুম ভাঙিয়েছে। আমি মরা মাছের মতো পড়ে থাকি। মেজাজটা খারাপ হয়ে যায়
আস্তে আস্তে।
“জোর করে এই পশুর
মতো আচরণ তুমি কেন কর? আমার পক্ষে তো
আর সম্ভব না। অসহ্য লাগে।”
আসলেই অসহ্য লাগে। তার স্পর্শ আর সহ্যই হয় না। অথচ এই আমার
নিয়তি। বন্ধু হিসাবে তাকে মানা যায়,
গল্প
করা যায়, আড্ডা মারা যায়, পাশাপাশি দীর্ঘসময় কাটানো যায়, বন্ধুর মতো করে-কিন্তু বিছানায় সে অসহ্য।
তাছাড়া, এভাবে জোর করে কতদিন ? মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়ে এমন করলে মনে হয় মুখের
উপর বমি করে দিই।
ইতিমধ্যে নিস্তেজ হয়ে লোকটা আমার পাশে শুয়ে থাকে।
“আমি ছুঁইলেই পাপ, জোর করতে হয়, কিন্তু ঐ শালা প্রতিমন্ত্রীর বাচ্চা, ঐ শুয়োরের বাচ্চার তো জোর করা লাগে না।
নিজেই তো গিয়া কাপড় খুলতে শুরু করো।”
মাথার নীচে একটা আর উপরে আরেকটা বালিশ চেপে শুয়ে থাকি, কানে শব্দ না ঢোকে যাতে। কিছুক্ষণ পর চিৎকার
আপনিই থেমে যাবে।
আমার স্বামী নাজিম চৌধুরী আমার ভালো বন্ধু ছিল। আর সে আমার প্রেমিকও ছিল বেশ কিছুদিন, বিয়ের আগে ও পরে। তবে তার প্রতি ভালবাসা এখন এক অষ্পষ্ট স্মৃতিমাত্র। তাকে নিয়ে আটপৌরে সংসার জীবন কেটে যাচ্ছিল ছয় সাত বছর। মাঝেমধ্যে নানা ব্যাপারে নটখট হত, আর তার ফলে ঘরের টুকটাক জিনিসপত্র নিক্ষিপ্ত ও চুরমারও হত। তবে আমার স্বামী বোধ হয় আমাকে বেশ ভালোই বাসে। কিন্তু তার ভালবাসায় সাড়া দেওয়ার মতো ভালবাসা তার প্রতি আমার আর নাই।
আসিফুর রহমানকে চোখে দেখার অনেক আগে থেকেই তাঁর গল্প শুনে
শুনে তিনি আমার কাছে অতিপরিচিত হয়ে পড়েছিলেন। আমার স্বামী ছিল তাঁর একজন অন্ধ
ভক্ত। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শে যতটা বিশ্বাস তার ছিল, তারও চেয়ে বেশি অবিচল ছিল ব্যক্তি আসিফুর রহমানের প্রতি তার
ভক্তি ও ভালবাসা। যখনই সে শুনত আসিফুর রহমান বাড়ি যাবেন, সরকারি বড় কেরানি আমার স্বামীও ছুটি নিয়ে
রওয়ানা দিত সেখানে। নির্বাচনের আগে,
এল.এ.পি
ছুটি নিয়ে তো দীর্ঘকাল। ঢাকা শহরের ভাড়াবাসায় তার স্ত্রী, আমি,
যে
একা পড়ে থাকব, কোনো বিপদ্ যে
আমার হতে পারে, এটা তার মাথায়
আসত না। আসিফুর রহমানের কোনো অনুরোধ তার কাছে ঐশী বাণীর চাইতে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল
না। প্রথম যেদিন আসিফুর রহমানের বাসায় সে আমাকে নিয়ে গেল, আমার গায়ে সেদিন বেশ জ্বর। কিন্তু যেহেতু
আসিফ সাহেবের অনুরোধ, আমার স্বামী
আমার কোনো আপত্তি শুনতে রাজি হয়নি। নিজের পছন্দের শাড়ি বের করে, চুল বাঁধার স্টাইল ঠিক করে দিয়ে, কপালে একটা ছোট টিপ দিইয়ে সে আমাকে বের করে
নেয়। আসিফ সাহেব বেশ যতœআত্তি করেন, কিন্তু আমার জ্বর বাড়তে থাকায় কোনোকিছুই
ভালো লাগে নাই। লোকটাকেও খুব ভালোভাবে লক্ষ্যও করা হয় নাই তখন।
গত সংসদ্ নির্বাচনের সময় ও মেডিকেল লিভ নিয়ে গাঁয়ে চলে যায় আসিফ সাহেবের নির্বাচনী প্রচারণায়। ঘরে ফিরে কী উল্লাস। এবার তার নেতা জিতবেই। আসিফের জ্ঞান, তাঁর কথা বলা, খাওয়া, হাঁটা, সবকিছু নিয়ে প্রবল মোহগ্রস্ত লোকটার, মানে আমার স্বামীর, বর্ণনা শুনে মনে হত পৃথিবীর মহত্তম মানুষগুলোর একজন এই আসিফুর রহমান। দেশের বাড়ি থেকে ফিরে এক সন্ধ্যায় স্বামী আমাকে ধরল আমিও যেন গ্রামে গিয়ে মহিলাদের মধ্যে প্রচারণা চালাই। আসিফুর রহমানকে জিততেই হবে, নইলে গ্রামে তাঁর সমর্থকেরা মানসম্মান নিয়ে থাকতে পারবে না। আমি প্রথমে অনিচ্ছুক ছিলাম, কিন্তু সারারাত বুঝিয়ে, আদর করে একসময় সে আমাকে রাজি করিয়ে ফ্যালে। গ্রামে পুনরায় পরিচয় করিয়ে দিলে আমার নিজেরও খুব ভালো লাগে লোকটাকে, সুপুরুষ, ব্যক্তিত্ববান, মার্জিত রুচির লোকটাকে দেখে মনে হয় আমার স্বামীর পছন্দ ঠিকই আছে। এত বড় একজন মানুষ, অথচ সবার সাথে কী অমায়িক, আন্তরিক। জনে জনে প্রত্যেকের খবর নিচ্ছে। আমাকে প্রথম দিনই ডেকে তার পাশের সোফায় বসতে বললেন। নরম কার্পেটে পা ডুবিয়ে আমার জীবন ধন্য হয়ে যায়। খাবার টেবিলে ‘ভাবি, এটা নেন, সেটা নেন,’ কী আপ্যায়ন! কোনো সাহায্যপ্রত্যাশী তাঁর কাছে এলে খালি হাতে ফিরে যায় না। এমন লোকের জন্য কাজ করতে ভালো লাগছে। সারাদিন বাড়ি বাড়ি ভোট ভিক্ষা করে ফিরে এলে সন্ধ্যায় তিনি বসে রিভিউ করতেন সবকিছু। আমার যে কোনো মতামতকেই বিশেষ মূল্য দিতেন, সবাই চলে গেলেও আমাকে বসতে বলতেন, এটাসেটা নানা বিষয়ে আলাপ করতেন।
আমার স্বামী আমাকে এখানে রেখেই ঢাকা চলে যায়। একসাথে কাজ করতে গিয়ে, আর আলাপ আলোচনায়, আমার সাথে তাঁর দূরত্ব কমে আসে। ঢাকায় সারাদিন একাকী কাটানোর চাইতে এখানে থাকাটা অনেক বেশি উপভোগ করি। আমি সামান্য এক কেরানির স্ত্রী। এত বড় একজন মানুষের সাথে মতবিনিময় করতে পারছি, তিনি আমাকে মূল্যায়ন করছেন, সবার সামনে আমার প্রশংসা করছেন, এসবকে জীবনের চরম অর্জন বলে মনে হতে থাকে। নারী কর্মীদের দেখাশোনা ও সে বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা তিনি আমার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। মঞ্চে ছোটখাট বক্তৃতা করার সুযোগও দেন আমাকে। আর আমার বক্তৃতার খুব প্রশংসাও করেন। স্থানীয় রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ একটা পদও লাভ করি একসময়। আমার স্বামী তো শুনে বেজায় খুশি। ঢাকা থেকে খবর পাঠাল, নির্বাচনের আগে যেন ঢাকায় না ফিরি।
এর মাঝে খবর আসে স্বামী ঢাকায় অসুস্থ। আসিফ সাহেবের সাথে
দেখা করি। ততদিনে তিনি আমাকে তুমি বলেন। বললেন, তোমার স্বামী আমার খুব কাছের লোক। তুমি এখন তার চাইতেও
কাছের। তুমি চলে গেলে আমি তো ইলেকশনে হেরে যাব। “দেরি করব না,” আমি হেসে বলি।
বেরিয়ে আসছি,
তখন
বললেন, “তুমি শিগগির ফিরে না এলে
আমি লোক পাঠিয়ে তোমাকে নিয়ে আসব।”
আমি ঢাকায় চলে আসি। আমার স্বামীর গায়ে ১০১/১০২ ডিগ্রির মতো জ্বর। ঢাকায় দু’দিন থাকার পর নাজিমের জ্বর কমে আসে, আর আমার মধ্যে এক অদ্ভুত অস্থিরতার জন্ম হয়, গ্রামে ফিরে যাওয়ার জন্য। অস্থিরতা বাড়তেই থাকে। একসময় নাজিমকে বলেই ফেলি, “তোমার জ্বর তো কমে আসছে, আমি বরং গ্রামে ফিরে যাই, আসিফ ভাই বারবার বলতেছিল যেন তাড়াতাড়ি ফিরি। সে তো আশেপাশের সবাইরে বলে, ‘এই মেয়েটা আসার পর আমার ভোট অনেক বেড়ে গেছে।’” শুনে আমার স্বামীর চেহারাটা ঝলমলিয়ে ওঠে। তারপর, যেন মস্ত এক অন্যায় করে ফেলেছে, সে বলে, “আমার এই সামান্য জ্বরের খবর পেয়ে তোমার এখানে আসবার কী দরকার ছিল ? আমার তো খুবএকটা কষ্ট হচ্ছিল না।”
গায়ে প্রায় একশ ডিগ্রি জ্বর নিয়ে আমাকে সে ট্রেনে তুলে দিল।
ট্রেনে বসে চারপাশের রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, আকাশ,
বাতাস
পার হয়ে যেতে যেতে মনে হয় এক ভয়ঙ্কর সর্বনাশের দিকে ধাবিত হচ্ছি আমি। ঢাকায় এই
দু’তিনদিন সবকিছু বিরক্তিকর মনে হয়েছে। সর্বগ্রাসী সর্বনাশ আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে
বেঁধে ফেলছে। দুনিয়ার আর কারুরই মনে হয় ক্ষমতা নাই আমাকে উদ্ধার করে। মাথার উপর
উঠতে থাকা সূর্যটা যেন মুখ টিপে হাসছে শিগগিরই তার মতোই আমি নিজের তাপে নিজে পুড়ব
অনন্তকাল, এ কথা ভেবে। আসিফকে
বললাম, “নাজিমের গায়ে জ্বর রেখেই
আমি ফিরে আসছি আপনার জন্য।”
“আমি তো ভাবছিলাম
তুমি আরও দেরি করলে আমি নিজেই গিয়ে নিয়ে আসব,”আসিফ বলে, আর কোটি কোটি নক্ষত্রের আলোআধাঁর মাথার
ভিতরে ঢুকে গিয়ে তীব্র নাচ শুরু করে দেয়,
তারপর
তরঙ্গায়িত ছড়িয়ে পড়ে আমার শিরায় শিরায়। সর্বনাশ ঠেকানোর আর কোনো উপায় নাই। আমার
ভালোমানুষ স্বামীটার কথা মনে হয় বার বার। আবার ভুলেও যাই দ্রুত। চারপাশের সবাইকে
দেবদূত মনে হয়। এত আনন্দ এই পৃথিবীতেই ছিল,
আগে
তা বুঝিনি কোনোদিন। কী উৎসাহে যে দিনরাত আসিফের জন্য ভোট চেয়েছি দুয়ারে দুয়ারে, হররোজ। মাঝে একবার সে কোনো কাজে ঢাকা যায়।
আমিও বাসায় যাচ্ছি বলে চলে আসি। এই সময়টা আমি আসিফের কাছেই থাকি ঢাকার অদূরে এক
রিজর্টে। তার প্রশংসা কেউ করলে গর্বে ভরে উঠতাম আমি, অহঙ্কারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতাম, যেন এই সবকিছুর অংশিদার এখন থেকে আমিও।
ভোটের কিছুদিন আগে আমেরিকা থেকে এসেছিল তার স্ত্রী। ভদ্রমহিলার মনে হল এই দেশ, সংস্কৃতি, আবহাওয়া কোনোকিছুই বড়একটা ভালো লাগে না। শুনেছি সে আমেরিকাতেই বড় হয়েছে, ওখানেই বরাবর থাকে। আমি পছন্দই করতে পারলাম না মহিলাকে। অপ্রয়োজনে একশ’টা খুঁত বের করেছি তার, আশেপাশের লোকজনকে বলেছি, আসিফ ভাইয়ের সাথে ঐ মহিলাকে কি মানায় ! ঈর্ষায়, অনুশোচনায়, বিরহে কতভাবে যে পুড়ে ছাই হয়েছি তার ইয়ত্তা নাই।
ইলেকশনের ঠিক আগে আগে নাজিমও ছুটি নিয়ে গ্রামে চলে আসে।
দিনরাত খাটছে আসিফের জন্য। আসিফও আগের চাইতেও ঘন ঘন প্রশংসা করছে আমার স্বামীর।
আসিফের প্রশংসায় আমার স্বামীর চেহারা দেখে মনে হয় জীবন সার্থক হল তার। ইলেকশনে
আসিফ সাংসদ নির্বাচিত হল। এরপর কিছুদিন আর নিজেকে কেরানির স্ত্রী মনে হয়নি। আমার
স্বামীও উল্লসিত। বার বার বলে কি,
“দ্যাখো, এই রকম মানুষ না জিতলে কে জিতব ? আমগো সারাদেশে এইরকম নেতা কয়জন আছে?”
এদিকে আসিফের সাথে আমার সম্পর্ক নিয়ে কিছু কানাঘুষাও শুরু হয়ে যায়। আসিফকে তো কিছু বলার সাহস নেই, আমাকে আকারে আভাসে কেউকেউ ইঙ্গিত দেয়, কেউ বা বাড়তি তোয়াজ করে। তদ্বিরটদ্বিরও নিয়ে আসে কেউকেউ। লোকমুখে কিছুদিন জোর গুজব, আসিফ মন্ত্রী হচ্ছে। আর তাকে সত্য প্রমাণ করে আসিফ প্রতিমন্ত্রী হয়েও যায় একদিন। তারপর দিনরাত ব্যস্ততা। আমার প্রতি তার আগ্রহ এষনও আছে, তবে আমি বুঝি যে দিনে দিনে সেটা করুণাতে বদলে যাচ্ছে। আমার স্বামী এক-দুইদিন জিজ্ঞাসা কওে, “লোকজন তোমারে নিয়া এইসব কী বলে ? আমারে জিগায় তোমার বউয়ের কোনো খোঁজ খবর জানো ? দুইচারজন ইঙ্গিতে আমার পুরুষত্ব নিয়াও খোঁচা দেয়।” আমি বলি, “এইসব ফালতু কথা পাত্তা দিয়ো না।”
তবে এখন বিছানায় তাকে আমার একদম সহ্য হয় না। তার স্পর্শকে মনে হয় বেগানা কারোর। সে বার বার জানতে চায় আমি কেন বদলে যাচ্ছি, সে স্পর্শ করলে কেন কুঁকড়ে যাচ্ছি ? আমি চুপ করে থাকি। একদিন সে আমাকে জিজ্ঞাসা করে, “তুমি আমাকে ভালবাসো না আর ?” কী মনে হল, আমি সত্যি কথাই বলে ফেললাম, “না।” বুঝতে পারি তার হৃৎপিণ্ড এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে গেছে, কিন্তু আমার অপরাধবোধ আসে না, হয় না কোনো অনুতাপ। ইদানীং টের পাই আসিফও আর আগের মতো ভালবাসে না আমাকে। আমার জন্য যেটুকু তার আছে তা করুণামাত্র। কিন্তু আসিফ যদি এসব আমাকে সরাসরি বলত, আমি ভেঙে খান খান হয়ে যেতাম। অথচ কী অনায়াস অবলীলায় আমার আমি নিজেই তা বলছি আমার স্বামীকে, যখন আমারই সহানুভূতি বেশি থাকবার কথা। আমি দেখছি সে কাঁদছে, একটা দু’টা হিরার টুকরা তার চোখ গড়িয়ে গাল বেয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটা মনোহারী, কিন্তু মমতাজাগানিয়া নয়। অন্তত আমার তা জাগছে না, এ মুহূর্তে। মানুষের মৃত্যুও একটা দৃশ্যমাত্র আমার কাছে, এখন। আগে কারোর সামান্য কষ্টেই কান্না পেত। কোনো অপরিচিত জনের মৃত্যুসংবাদেও বিষণœ থাকতাম বহুকাল। কারো চোখে পানি দেখলে চোখ ভিজে উঠত আমার, আসিফ আমাকে সামান্য কম গুরুত্ব দিলেও কান্নাকাটি করে বালিশ ভাসাতাম। এখন আর হয় না সেরকম। এই যে আসিফ করুণা কওে, টের পাই। মেনে নিয়েছি প্রতিক্রিয়াহীন। কাউকে কাঁদতে দেখলে হাল্কা অস্থির লাগে, কী করা উচিত ভেবে সামান্য অসহায় বোধ করি। ঐ পর্যন্তই। কান্নাটান্না, মৃত্যু, সব একটা বিলীয়মান প্রেক্ষাপটের একেকটা অংশ শুধু। আমার স্বামীর চোখে প্লাবন, আর আমার মনে হাল্কা অস্বস্তি শুধু, আর কিছু নয়।
সেটুকুও কাটিয়ে স্পষ্টই বলি, “সত্যি, আমি আর ভালবাসি
না তোমাকে।” আসিফ এভাবে আমাকে বললে মরেই যেতাম হয়তো। সে বারবার জানতে চাইছে তার
জন্য আমার কষ্ট হয় কিনা, আমি বুঝতে পারছি
কিনা কী ভয়াবহ কষ্ট তার হচ্ছে, চাতক চোখে চেয়ে
আছ আমার চোখে-আমিও আসিফের মুখে এইভাবেই চেয়েছি কুবার। একটাবার যদি সে বলত... বেঁচে
উঠতাম আমি, চিরজীবনের জন্য
বেঁচে উঠতাম।।
“না, একটুও কষ্ট হচ্ছে না।”
হায় ! আমিও এইভাবে বলতে পারি ? অথচ আসিফ প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর দিনের পর
দিন তিতিক্ষায় থেকেছি, আসিফ অন্তত বলুক
কিছুটা সময় আমাকে নিয়ে একা কাটাবে। বলত,
“চল
বাইরে কোথাও বেড়াতে যাই।”
বেচারা! আমার স্বামী! তার জন্য করুণা হচ্ছে। আসিফেরও নিশ্চয়ই হয়, আমার জন্য। আসিফ ব্যস্ত হয়ে গেল। পাত্তা কম দিতে শুরু করল। সেই দিনগুলো, হায়! ঘুম ভাঙা আবার ঘুমানো পর্যন্ত হুহুতেই কেটে যেত সারাদিন।
আমি বলি,
“এসব
ফালতু ব্যাপারে মন খারাপ করার কী আছে!” আসিফও একদিন বলেছিল, এইকথাগুলোই, আমার মধ্যে কাউকে আঘাত করতে। জেদ করতে করতে জেদের নেশায় পড়ে
গেছিলাম তখন। আমার স্বামীও পাগলামি করছে। জেদ করছে আমার ভালবাসা পেতে, সেও নেশায় পড়েছে, আর আমাকে পেয়েছে প্রত্যাখ্যানের উল্লাস।
প্রত্যাখ্যান করতে যে অহঙ্কার লাগে,
তা
তৈরি হয়েছে আমার এতদিনে। যত তুমি অনুনয় করো,
অহঙ্কার
তত তীব্র হয় আমার। এখন আমার স্বামী আমার মতোই একজন আর আমি আসিফের মতো কেউ। সে
কাঁদছে আর আমার শুধু মনে হচ্ছে আমিও কাঁদতাম আসিফের জন্য। সে যেন আয়নায় দেখা আমারই
প্রতিবিম্ব। করুণা যেটুকু হয় সে যেন নিজের ধূসারিম অতীতেরই একটা ভগ্নাংশের জন্য
শুধু। রক্তমাংসের আমার স্বামীর জন্য নয়। আবেগ, আনন্দ, কষ্টে ঝক্ঝকে
একটা মানুষকে দিনে দিনে নিস্তরঙ্গ করে ফেলেছে আসিফ। আমি আমার স্বামীকে।
আসিফকে কী যে ভাগ্যবান মনে হয়! আমরা সবাই ভাগ্যবান কষনও কখনও, একেকটি ত্রিভুজ অথবা বহুভুজের একেকটি বিন্দু যেন আমরা সবাই। পরিপ্রেক্ষিতভেদে স্থান বদলাই, রূপ বদলাই। একই মানুষ কখনও শোষিত, কখনও শোষক।
আমার স্বামীকে কষ্ট দিচ্ছি আর আসিফের উপর রাগ কমে যাচ্ছে
একটু একটু। নাজিম চোখ মুছছে আমার সামনে অথচ আমার কোনো মায়া হয় না, শুধু মনে হয় লোকটা এমন ইম্যাচির্য়োড্ আচরণ
করছে কেন ?
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আসিফের কথা সে জানতে চায়, “তোমার সাথে আসিফ সাহেবের সম্পর্ক কী, সত্যি করে বল?” আমি চুপ থাকি। সে বার বার চাপ দেয়, “আমি তোমাকে কিছু বলব না, তুমি শুধু স্বীকার করো।” আমি বলি, “ফালতু কথা বন্ধ করো, এসব শুনতে ভাল্লাগে না।”
রাতে বিছানায় বলে,
“আমার
যা কপাল ! কেরানি ঘুমায় প্রতিমন্ত্রীর প্রেমিকার সাথে!” আবার কখনও জানতে চায়, “বলো না, তার সাথে কোথায় তোমার দেখাসাক্ষাৎ হয় ? তার বাড়িতে, নাকি অন্য কোথাও?”
আসিফকে আগে যতই সম্মান দেখিয়ে থাকুক, সে এখন রাজনীতি, গ্রামের বাড়ি যাওয়া, সব ছেড়ে দিয়েছে। অফিস আর বাসা-এটাই নিত্যকার রুটিন এখন তার। বাসায় ফিরে যদি শোনে আমি শপিং করতে বা কোনো আত্মীয়ের বাসায়, অর্থাৎ বাসার বাইওে, গেছি তখনই মাথা খারাপ হয়ে যায় তার। “খানকির আজকে নাঙ্গের কথা মনে হইছে, হের মধু ছাড়া অন্যকিছু মাথায় নাই !” আমার স্বামী চিৎকার করে, আমি চুপ থাকি, তার ক্ষান্ত হবার অপেক্ষা করি।
তবে আসিফের সাথে সম্পর্ক আছে। লোকজন আসে, তোয়াজ করে এটা সেটা তদ্বির নিয়ে। আমি আসিফের
কাছে কোনো কাজ নিয়ে গেলে সে করে দেয়,
যদিও
আমার সাথে দু’তিন মিনিটের বেশি কথা বলে না,
কারণ
প্রচুর দর্শনার্থী, সারাদিন ভিড়
লেগে আছে। তাছাড়া নিজের মানসম্মান সম্পর্কেও সে ভীষণ সজাগ ইদানীং। যাইহোক আমি
যতবার তার কাছ থেকে আসি, আমার ভারি মন
খারাপ হয়। কিন্তু এলাকার লোকজন যে বাড়তি সম্মান দেখায় তার লোভও ছাড়তে পারি না।
বিছানায় আমার স্বামী বিচিত্র সব জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করায়। আমি বুঝি, পর্নোগ্রাফি দেখে মানুষ যেভাবে উত্তেজিত হয়
তেমনি আমাকে আর আসিফকে কল্পনা করে উদ্দীপিত হয় সে। আমাকে স্পর্শ করেই জিজ্ঞাসা কওে, “প্লিজ বলো সে তোমাকে কেমন করে আদর করে, সে কি আমার চাইতে অনেক বেশি সুখী করে তোমাকে
?” লাগাতার এমনিকিছু সে
বলেই যেতে থাকে। আর আমি নীরব থাকি। আর আমার হৃদয় থাকে শীতল। একটা কবরের মতো।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন