কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২১

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ৯৭


বয়স নিয়ে সেদিন বন্ধুমহলে নিছকই আড্ডা হচ্ছিল। বয়স সম্পর্কে এক একজন এক একরকম অভিমত পেশ করছিল। যেমন একজন বন্ধু বলল, ইদানীং আমার বয়সটা আমাকে খুব জ্বালাতন করছে। কেন? কেন? বাকি বন্ধুরা রীতিমতো ব্যস্ত হয়ে পড়ল। জ্বালাতন করছে কেন? কীভাবে জ্বালাতন করছে? বন্ধুটি এবার রীতিমতো বিরক্ত হলো যেন। বলল, আরে বাবা বয়সটা যে বেড়ে গেল! সত্তরের গন্ডি অতিক্রম করলাম! কেন তোদের বয়সও তো বসে নেই! সবাই কম বেশি সত্তর। এই বয়সেও তোরা সবাই কি খুব ভালো আছিস? বাকি বন্ধুদের এবার চট করে কোনো উত্তর আর যোগালো না। আসলে প্রথম বন্ধুটি বয়সের প্রসঙ্গে ভালো থাকা বা না থাকার যে ব্যাপারটা বোঝাতে চাইছে, তা  সবার বোধগম্য হচ্ছে না। ভালো থাকা বা না থাকার সঙ্গে বয়সের কী সম্পর্ক? যে কোনো বয়সেই তো ভালো থাকা যায় অথবা যায় না! তাহলে? এবার বন্ধুটিকে তার বক্তব্য নিতান্তই সরল করে বলতে হলো, আরে বাবা, এটা কেন তোদের মাথায় ঢুকছে না যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরটা যে পুরনো হয়ে যাচ্ছে, শরীরের কলকব্জাগুলো অকেজো হয়ে যাচ্ছে, মেরামতের চেষ্টা করেও কোনো কাজের কাজ হচ্ছে না! বাকি বন্ধুরা এবার যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলল, ও এই কথা! তা শরীরের আর দোষ কী বল! সব কিছুরই তো একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে! শরীরেরও আছে। তাছাড়া শরীরের কোনো ওয়ারেন্টি পিরিয়ডও নেই। তাই ওসব ভেবে লাভ নেই। শরীরকে তার নিজের মতো চলতে দে। খবরদারি করতে গেলে সে আরও বিগড়ে যাবে, বেগরবাঁই করবে। কেন, মধুকবির সেই কবিতার লাইন মনে নেই, ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে’! আসলে কি জানিস, বেশি বয়সের যে সব রোগ, প্রকৃত বিচারে সেই সব রোগ বেশি বয়সের অলঙ্করণ। রক্তচাপ, সুগার, থাইরয়েড, হার্টের গন্ডগোল, অস্টিও বা রিউমেটিক আর্থারাইটিস, ঘন ঘন পেচ্ছাপ, চোখে ছানি, মাথায় টাক – মানে যতরকমের উটকো ব্যাপার-স্যাপার আছে, তা সবই তুই যে সিনিয়র সিটিজেন পদমর্যাদায় উন্নীত হয়েছিস (যদিও এখন আর রেলের রিজার্ভেশনে ছাড় বন্ধ করে দিয়েছে মহামান্য কেন্দ্রীয় সরকার) তারই সদম্ভ ঘোষণা। তাই বলি কী, শরীরের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরের যাবতীয় উৎপাতকে পাত্তা না দিয়ে, মনকে নিয়ে চিন্তাভাবনা কর, মনের বয়স যেন না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখ, মনটাকে সেই কৈশোর তথা যুবাবয়সের মনের মতো তাজা রাখার চেষ্টা কর।  প্রথম বন্ধুটি এবার রীতিমতো তেড়েমেড়ে উঠে বলল, ওসব লেকচার মারা বন্ধ কর তো! যত্তসব জ্ঞান দেবার চেষ্টা! এবার আর একজন বন্ধু, দ্বিতীয় বন্ধু, মৌনতা ভেঙে  বলল, আসলে যেটা শুনতে আমাদের ভালো লাগে না, সেটাকেই আমরা ফালতু লেকচার বলে মনে করি। কিন্তু ভেবে দেখ, এটাই হচ্ছে জীবনের সার কথা। আমাদের জন্মের আগে আমাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। আমাদের মৃত্যুর পরেও আমাদের কোনো অস্তিত্ব থাকবে না। সুতরাং এই জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তী যে সময়টুকু আমরা অতিবাহিত করি, তাকেই আমরা জীবন বলি। আর এই জীবনকালের মধ্যেই আমাদের যাবতীয় কাজকর্ম, দায়-দায়িত্ব, কর্তব্য, বিভিন্ন রকম প্রতিকূল ঘটনাপ্রবাহ ও সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াই, মানবসমাজকে উন্নততর পর্যায়ে উত্তীর্ণ করার জন্য সংগ্রাম, সবকিছুই করে যেতে হয়। এবং তার জন্য শরীর ও মনের বিরাট ভূমিকা আছে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, প্রকৃতির নিয়মে শরীরের বয়স বেড়ে যায়, তার কার্যক্ষমতাও হ্রাস পায়, আর তাই একান্ত জরুরি মনের বয়সকে বৃদ্ধ হতে না দেওয়া। এবং সেটা পুরোপুরি নির্ভর করে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত ও সমাজগত জীবন ও পৃথিবী সম্পর্কে সঠিক ধ্যান-ধারণা, যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিকোণ, বৃহত্তর মানবসমাজের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং জীবনকালের প্রতিটি মুহূর্তে আনন্দসন্ধানের ওপর।  বলা বাহুল্য, সেদিনের  বন্ধুমহলের নিছক আড্ডাটা কিন্তু দারুণ জমে উঠেছিল। আরও অনেক বন্ধুর আরও অনেক অভিমত ও বক্তব্যও আমাদের সবাইকে সমৃদ্ধ করেছিল। আর আড্ডাটি ছিল পরম উপভোগ্য।

২০২১ সালের এটাই শেষ সংখ্যা। বড়দিন ও খৃষ্টমাসের শুভেচ্ছা জানাই সবাইকে।   

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 

কথনবিশ্ব


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১৫




ফ্রান্সের পর ব্রিটেন। গ্রেট ব্রিটেন। আজ এই আলোচনা শুরুর আগে দুটো ছোট ফুটনোট দিয়ে রাখি। এক, ইউরোপের মূল ভূখন্ডের ওপরে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েল্‌স নিয়ে গড়া দ্বীপপুঞ্জকে গ্রেট ব্রিটেন বলা হয়। সেই কারণেই এই সিরিজে  আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই কখনো ইংল্যান্ড লিখিনি, ব্রিটেন লিখেছি। কারণ সব  সময়েই এই পুরো দ্বীপপুঞ্জের সিনেমা একত্রিতভাবে দেখতে চেয়েছি। এবং আজ কিন্তু আমি গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে আয়ারল্যান্ড নামক দ্বীপকেও জুড়ে নেব, যাতে আলোচনা পূর্ণতা পায়। লঘুচ্ছলে বলতে পারি, আজ স্কচ হুইস্কি আর আইরিশ হুইস্কির মল্টেড বার্লি একসঙ্গে পরিবেশন করব। দুই, আপনারা অনেকেই জানেন যে ব্রিটিশ পরিচালক আলফ্রেড হিচকক্‌ এক সময় ব্রিটেন ছেড়ে হলিউড পাড়ি দেন। উল্টোদিকে স্ট্যানলি কিউব্রিক আবার হলিউডের সঙ্গে মতানৈক্যের জন্য এক সময় হলিউড ছেড়ে ব্রিটেন পাড়ি দেন। তো, এরা যে সময়ে ব্রিটেনে ছবি বানিয়েছিলেন, আমি সেই সময়ের ছবিই আলোচনায় নেব, অন্য সময়ের নয়।

তাহলে বেশ বড়সড় এক লিস্ট দিয়ে শুরু করা যাক। ব্রিটেন ও আয়ারল্যান্ডের সেরা কুড়ি। হিচককের ‘দ্য 39 স্টেপ্‌স’ (১৯৩৫), লিনের ‘ব্রিফ এনকাউন্টার’ (১৯৪৫), ‘গ্রেট এক্সপেক্টেশনস’ (১৯৪৬), ‘ব্রিজ অন দ্য রিভার কোয়াই’ (১৯৫৭) ও ‘লরেন্স অব আরাবিয়া’ (১৯৬২), আর্চার্সের ‘দ্য রেড শুজ’ (১৯৪৮), রিডের ‘দ্য থার্ড ম্যান’ (১৯৪৯), কিউব্রিকের ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’ (১৯৬৮) ও ‘ব্যারি লিন্ডন’ (১৯৭৫), অ্যান্ডারসনের ‘ইফ...’ (১৯৬৮), কেন লোচের ‘কেস’ (১৯৬৯), জোনসের ‘মন্টি পাইথনস্‌ লাইফ অব ব্রায়ান’ (১৯৭৯), হাডসনের ‘চ্যারিয়টস্‌ অব ফায়ার’ (১৯৮১), বয়েলের ‘ট্রেনস্পটিং’ (১৯৯৬), জো রাইটের ‘অ্যাটোনমেন্ট’ (২০০৭) এবং ম্যাককুইনের ‘হাঙ্গার’ (২০০৮)। এরসঙ্গে স্কটল্যান্ডের দুটো ছবি আলাদা করে নেবঃ হার্ডির ‘দ্য উইকার ম্যান’ (১৯৭৩) ও রামসে-র ‘র‍্যাটক্যাচার’ (১৯৯৯), এবং আয়ারল্যান্ডের-ও দুটো নেবঃ শেরিডানের ‘মাই লেফট্‌ ফুট’ (১৯৮৯) ও লোচের ‘দ্য উইন্ড দ্যাট শেক্‌স দ্য বার্লি’ (২০০৬)।

এর ভেতর মাত্র ছ’খানা ছবি নিয়ে আজ বিশদে আলোচনা করব -- ‘দ্য থার্ড ম্যান’ (১৯৪৯), ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’(১৯৬৮), ‘কেস’ (১৯৬৯), ‘ট্রেনস্পটিং’ (১৯৯৬), ‘র‍্যাটক্যাচার’ (১৯৯৯) এবং ‘দ্য উইন্ড দ্যাট শেক্‌স দ্য বার্লি’ (২০০৬)।

ক্যারল রিডের ‘দ্য থার্ড ম্যান' দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্ত্তী সময়ের সাসপেন্স ছবি। স্থান অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা। জোসেফ কটন এসে যুদ্ধ পরবর্ত্তী ভিয়েনায় উপস্থিত হয়। উদ্দেশ্য, তার পুরনো বন্ধু অরসন ওয়েলেস-এর (সিটিজেন কেন-এর সেই  বিখ্যাত ওয়েলেস) চাকরির প্রস্তাবে সাড়া দেওয়া। কিন্তু সেখানে এসে সে দেখে তার বন্ধু আর নেই, পথ দুর্ঘটনায় মারা গেছে। এরপর বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দিয়ে কটনের মনে হয়, ওয়েলেসের দুর্ঘটনা নিছক দুর্ঘটনা নয়। সে ভিয়েনায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ঘটনার অনুসন্ধান চলার সময় আবার হঠাৎ ওয়েলেস উদয় হয় এবং এবার সে সত্যিকারের খুন হয়। ছবি জুড়ে টানটান উত্তেজনা। 

কিন্তু এই সিনেমার থিম নয়, একে খ্যাতি দিয়েছিল এর লেন্সের কাজ। এই সাদা-কালো ছবির সিনেমাটোগ্রাফি এতই বিখ্যাত যে তা আলোচনা না করলে এই ছবির কথা সম্পূর্ণ হবে না। প্রথমত, প্রায় সময়েই কোন সাবজেক্টকে ফ্রেমের সামনে রেখে জার্মান এক্সপ্রেসনিজম ফুটিয়ে তোলার অন্যতম উদাহরণ এই ছবি। চোখ ধাঁধাঁনো আলো, চমকে দেবার মত আলো এবং ক্যামেরার ডাচ অ্যাঙ্গল (খানিকটা বাঁকা, যেটা এর আগেও বার্তোলুচির ‘দ্য কনফর্মিস্ট’ নিয়ে বলেছিলাম) অনবদ্য। সাধারণত ডাচ অ্যাঙ্গল মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা বা সাসপেন্স  বোঝানোর জন্য কেউ কেউ ব্যবহার করেন, যা এই সিনেমার প্রতি ছত্রে। এর ওপর আছে শুটিং-এর জায়গাগুলো। প্রতি শটে বেছে বেছে এমন পারিপার্শ্বিক  ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শ্রান্ত ক্লান্ত অবসন্ন ব্যাপারটা দুর্দান্ত ফুটে উঠেছে। এবং তার ওপরে রয়েছে সাউন্ডট্র্যাক। অসাধারণ থিম মিউজিক, যা থেকে পরবর্ত্তীকালে ‘লা ডোলচে ভিটা’র মিউজিক পর্যন্ত প্রভাবিত  হয়েছিল। এমনি এমনি কি এই সিনেমাকে ব্রিটেনের সর্বকালের সেরা ছবি ধরে নেওয়া হয়!

স্ট্যানলি কিউব্রিকের ‘2001: এ স্পেস ওডেসি’ (১৯৬৮) সেই ছবি যা আমি পৃথিবীর প্রথম বারোখানা ক্লাসিক মাস্টারপিস সিনেমার লিস্টে রেখেছি। সুতরাং আজ একে নিয়ে বিশদ আলোচনা করব। এই ছবির স্ক্রিনপ্লে লেখক, পরিচালক ও প্রযোজক কিউব্রিক। অবশ্য কল্পবিজ্ঞান লেখক আর্থার সি ক্লার্ক-ও কিউব্রিকের সঙ্গে এই ছবির স্ক্রিনপ্লে লিখেছিলেন, তারই এক গল্প ‘দ্য সেন্টিনেল’  (১৯৫১)–এর ছায়া অবলম্বনে। এই ছবির ভেতর আমি অনেক কিছু খুঁজে পাই। অস্তিত্ববাদ, মানুষের বিবর্তন, মনস্তত্ব, প্রযুক্তিবিদ্যা, বিশ্বাসযোগ্য স্পেশাল এফেক্ট, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং অন্য গ্রহে প্রাণের সম্ভাবনা। ভুললে চলবে না, আর দশটা ছবির তুলনায় এই সিনেমা আলাদা।

মনোলিথ নিয়ে 2001-এর গল্প শুরু। সভ্যতা শুরুর আগেই কে বা কারা পৃথিবীতে এক মনোলিথ রেখে গেছে, যা বিজ্ঞানের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। এরপর  মানুষ চাঁদে পাড়ি দেয় এবং সেখানে এইরকম আরেক মনোলিথ পায়। কোন্‌ অ্যালিয়েনরা এইসব মনোলিথ রেখে গেছে এবং তারা কী বোঝাতে চায়, সেই নিয়ে মানুষ আর কম্পিউটারে টানাটানি শুরু হয়। যে জিতবে, সে বিবর্তনের আরো কাছাকাছি পৌঁছে যাবে।

আমি ঠিক এখান থেকে 2001–এর আলোচনা শুরু করব। কীভাবে একটা সিনেমা গ্রেট হয়ে ওঠে? কীভাবে গ্রেট তকমা পেরিয়ে টাইমলেস মাস্টারপিসে  তার স্থান হয়? সিনেমাটোগ্রাফি? এডিটিং? অভিনয়? ডায়লগ? নাকি এসব ছাড়িয়ে আরো ওপরে পরিচালকের অন্য কোন মুন্সিয়ানা যা ছবিকে দর্শকের মনে গেঁথে রাখে? আমার মতে, সিনেমায় এক অনন্য ও স্বতন্ত্র ব্যাপার থাকা দরকার, যা দর্শক আগে অন্য কোন ছবি থেকে পায়নি। তবেই সেই অদৃশ্য সূতো তৈরি  হয়। 2001 সিনেমায় ক্যামেরার কাজ আর স্পেশাল এফেক্ট বাদ দিয়ে যদি শুধুমাত্র থিম নিয়ে কথা বলি, তাহলে দর্শক হিসেবে ‘বাঃ’ বলতে বাধ্য হব এর  শেষ দৃশ্যের জন্য। আবার সমালোচক হিসেবে যদি দেখি, তাহলে কোথাও যেন একটা খটকা থাকবে কারণ ‘ডঃ স্ট্রেঞ্জলাভ’-এর পর এই ছবিতেও যেন  সূক্ষ্মভাবে কিউব্রিক মানবসভ্যতা নিয়ে হতাশ মনে হয়েছে। যদিও এই সিনেমার ছত্রে ছত্রে বুদ্ধি লুকিয়ে আছে, কিন্তু কিউব্রিক নিজে দর্শকের অবচেতন মন নিয়ে বেশি ভাবিত ছিলেন। ফলে উনি এই ছবি নিয়ে কিছুই চাপাতে চাননি। এক ইন্টারভিউতে কিউব্রিক বলেছিলেন ‘you’re free to speculate as you wish about the philosophical and allegorical meaning of the film – and such speculation is one indication that it has succeeded in gripping the audience at a deep level – but I don’t want to spell out a verbal road map for 2001 that every viewer will feel obligated to pursue or else fear he’s missed the point’.

সায়েন্স ফিকসন হিসেবে এই ছবি আমার তালিকায় সর্বকালের সেরা হিসেবে থাকবে। এবং যদি ভুল না করি, তাহলে মানতে হবে যে এই সিনেমাই সেই পথিকৃত ছবি যা পরবর্ত্তীকালে আরো অনেক পরিচালক ও সিনেমাকে পথ দেখিয়েছে বক্স অফিস হিট কল্পবিজ্ঞান ছবি বানানোর। এবং কিউব্রিককে কুর্নিশ জানাব এই সিনেমার কোন সিকোয়েল তৈরি না করার জন্য। তবে হ্যাঁ, আবারো অস্কার কমিটিকে ‘কানা’ বলতে বাধ্য হচ্ছি।       

১৯৬৮ সালের উপন্যাস ‘এ কেস্ট্রেল ফর এ নেভ’ অবলম্বনে ১৯৬৯ সালে কেন লোচের তৈরি ‘কেস’ (কেসট্রেল বা চিলের সংক্ষিপ্ত রূপ) ইংল্যান্ডের নিম্নবর্গের  শ্রমিক শ্রেণীর কথা ও খুঁতযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার কথা ফুটিয়ে তুলেছে। বিলি একজন  টিনেজার, যার পরিবারে তার মা আর দাদা। বিলি স্কুল বা লেখাপড়া ভালবাসে না। অবাধ্য। মায়ের কাছে বা দাদার কাছে বকুনি, মার খায়। সে একদিন গাছে চিলের বাসা থেকে এক চিলের বাচ্চা চুরি করে। তারপর তাকে বাজের মত শিকারী পাখি হবার জন্য ট্রেনিং দিতে শুরু করে। সেই ট্রেনিং দেবার জন্য সে একটা বই চুরি করে। কিন্তু বিলির দাদা রেগে গিয়ে শেষ দৃশ্যে সেই চিলকে মেরে ফেলে।

এই সিনেমার প্রথম আকর্ষণ বিলির ভূমিকায় কিশোর ডেভিড ব্র্যাডলি-র  অভিনয়, যে আগে কোনদিন অভিনয় করেনি। কিন্তু তারও ওপরে লোচের ক্যামেরার প্যানোরামিক চোখ আর সিনেমার থিম। শ্রমিকশ্রেণীর প্রতি লোচের  সহমর্মিতা এবং নিম্নবর্গের জনগণের জন্য খুব কম শিক্ষার সুযোগ, যা নিয়ে  বারবার ইংল্যান্ডে সমালোচনার ঢেউ উঠেছে, তা লোচ অনায়াসে এই সিনেমায় দেখিয়েছেন। আরো এক সহজ ভুল উনি অভিভাবকদের চোখে আঙুল দিয়ে এই ছবিতে দেখিয়েছেন। যখন বাচ্চা বড় হয়ে উঠতে থাকে, সে চায় তার পরিবারের সবার ভালবাসা। তা না করে তাকে বারবার সমালোচনা করলে বা দূরে ঠেলে দিলে সে কিন্তু আস্তে আস্তে বিলির মত হয়ে উঠতে পারে। বিলি যা চেয়েছিল কিন্তু পায়নি, সেই সবকিছুর প্রতীক এখানে ‘কেস’ বা পোষা চিল। স্বাধীনতা,  গর্ব, সন্মান ও নিজস্বতা। বিলি আর কেস এখানে কনট্রাস্ট। একজন একজন উড়ন্ত ও স্বাধীন। অন্যজন পরাধীন, বন্দী। আর এই কনট্রাস্টের মাঝে লোচের ক্যামেরা ফ্রেম থেকে ফ্রেমে ঘুরে বেড়িয়েছে, দর্শকের ইচ্ছের মত।  

ব্রিটেনে অর্থনৈতিক সঙ্কটে ভুগতে থাকা এডিনবারা অঞ্চল আর তার কিছু হেরোইন আসক্ত তরুণ, এদের নিয়ে তৈরি ড্যানি বয়েলের ‘ট্রেনস্পটিং’ (১৯৯৬),  মনে হয় যেন আজো আমাদের সমাজের এক জ্বলন্ত সমস্যা। ব্রিটেনের সর্বকালের সেরা ১০টা ছবির ভেতর এই ছবি আসবেই।

এডিনবারার রাস্তায় রাস্তায় হেরোইন আসক্ত মার্ক রেন্টন আর তার নেশাখোর বন্ধুদের দৌরাত্ম। রেন্টন ড্রাগ ছাড়তে চেষ্টা করলেও সে পারছে না। এদিকে  রেন্টনের পরিবার পরিজনদের সঙ্গে দিনে দিনে তার সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে। এমনকি তার ১৪ বছরের প্রেমিকার সঙ্গেও। এই সিনেমার প্রতি সিন খুব শক্তিশালী। পেছনে ‘পটভূমি সঙ্গীত’ ব্যাপারটা আরো জোরালো করেছে। পপ কালচার বলুন, হিপি কালচার বা পাঙ্ক কালচার... এই ছবির সঙ্গে আপনি মিল পাবেনই।

ভাল অভিনয়, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, যথাযথ এডিটিং, নিজস্ব স্ক্রিপ্ট। আর হ্যাঁ, যেটা বলতেই হয়, সেটা হল এই সিনেমার মন্তাজের কাজ। পরপর তিনখানা সিন ব্যবহার করে মন্তাজ। কেউ সহজে এই সাহস দেখাবেন বলে মনে হয় না। সব মিলিয়ে এই সিনেমা সত্যি ব্রিটিশ ক্লাসিক।

লিন রামসে-র ১৯৯৯ সালের সিনেমা ‘র‍্যাটক্যাচার’ আরেক অদ্ভুত সিনেমা। মনে  রাখার মত থিম, যার মাঝে কৈশোরের পরাবাস্তব মনোস্তত্ত্ব ঢুকে ছবি আরো জমাট করে তুলেছে। ‘কে’ ছবির সার্থক উত্তরসূরী।

পটভূমিকায় ১৯৭৩ সালের গ্লাসগো। পুরনো আমলের স্ট্রাকচার, যেখানে কোন বাড়িতেই গরম জলের লাইন নেই, ঘরের ভেতর স্নান করার বা টয়লেটের কোন সুবিধে নেই। এইসমস্ত বাড়ি ভেঙে নতুন করে তৈরি হচ্ছে। এইসব বাড়ির লোকজনকে অন্যত্র সরানো হচ্ছে। এর মাঝে ডাস্টবিন ফেলার শ্রমিকরা হরতাল করায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে। শহরতলীর মাঝে পাহাড়প্রমাণ নোংরা  জমছে এবং বেড়ে চলেছে ইঁদুরের উৎপাত। এইরকম এক পরিবার, যার সদস্য  কিশোর জেমস, অপেক্ষা করছে কবে তাদের নতুন হাউজিং-এ সরানো হবে। জেমস অন্যদের থেকে একটু আলাদা। তার কল্পনার জগৎ আছে, সে সবকিছু মুখ ফুটে বলতে পারে না। তার সামনে তার বন্ধু খালের জলে ডুবে মারা যাবার পর সে আরো চুপ হয়ে যায়। জেমসের থেকে সামান্য বড় মার্গারেট অ্যান একদিন স্থানীয় ছেলেদের অত্যাচার থেকে ছাড়া পাবার পর জেমস তার চশমা খুঁজে দেয়। তারপর তাদের বন্ধুত্ব হয় ও দুজন মিলে পরাবাস্তব এক জগতে ঢুকে যায়। সেই জগৎ যেখানে সমস্ত ইঁদুরেরা উড়ে চাঁদে পৌঁছে যাচ্ছে। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় জেমস খালে ঝাঁপ মারছে, এবং স্বপ্নে দেখছে তারা নতুন বাড়িতে ঢুকছে।

থিম ছাড়াও এই ছবিতে ক্যামেরার কাজ ভাল। ক্লোজ-আপ শট, ডিসট্যান্ট শট, মুভিং শট, মোটামুটি সবই আছে। শুরুর দৃশ্যে জানালার পর্দা নিয়ে জেমসের স্লো মোশনে খেলা আর তার মায়ের থাপ্পড় বুঝিয়ে দেয় বাস্তব আর কবিতার  মাঝামাঝি কোথায় এই সিনেমার দ্বন্দ্ব। জেমসের বড় হবার ভয়। জেমসের মুখে  ফড়িং-এর মত ঘাস লেগে থাকা বা জানালা দিয়ে বিস্তীর্ণ গমের ক্ষেত দেখা –  এগুলো ক্যামেরাকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। কিন্তু কোথাও কোথাও লিন  ক্যামেরার এফেক্ট ধরে রাখতে পারেননি। যেমন জানালা দিয়ে আদিগন্ত গমের  ক্ষেত দেখা। জেমস একসময় সেই ক্ষেতে লাফ মারে। ক্যামেরাও জেমসকে ধরে রাখতে গিয়ে ফোকাস করে সেই ক্ষেতেই। ফলে জানালা ও ফ্রেম হারিয়ে যায়। এরকম কয়েকটা জায়গা বাদ দিলে সার্বিকভাবে ক্যামেরার কাজ মনে রাখার মত। 

কেন লোচের ‘দ্য উইন্ড দ্যাট শেক্‌স দ্য বার্লি’ (২০০৬) আয়ারল্যান্ডের   স্বাধীনতা সংগ্রাম ও আইরিশ গৃহযুদ্ধ, মোটামুটি ১৯১৯ থেকে ১৯২৩ অব্ধি - এই পটভূমিকায় তৈরি। এই ছবি নিয়ে কিছু না বললে লোচের ছবি ও তাঁর দর্শন  বুঝতে অসুবিধে হবে। তাই এই ছবি বাছলাম। প্রথমেই বলি, ড্যামিয়েন ও’ ডোনোভানের চরিত্রে সিলিয়ান মার্ফি অনবদ্য। এই ছবিতে ড্যামিয়েন একজন ডাক্তার, যে গ্রাম্য আয়ারল্যান্ডের পটভূমি ছেড়ে লন্ডনে গিয়ে চাকরি করবে বলে তৈরি হচ্ছে। ঠিক সেই সময় ব্রিটিশ সৈন্য তাদের গ্রাম আক্রমণ করে। ড্যামিয়েন এই বীভৎসতা দেখে তার ভাইয়ের সঙ্গে আয়ারল্যান্ডের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ মুক্তিযুদ্ধের পর ব্রিটিশ সৈন্য আয়ারল্যান্ডকে স্বতন্ত্র প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করতে রাজি হয়ে যায়। ড্যামিয়েনের ভাই টেডি এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু ড্যামিয়েন ও আরো প্রচুর আইরিশ যোদ্ধা এই প্রস্তাবে রাজি হয় না। তারা আয়ারল্যান্ডকে স্বাধীন দেশ হিসেবেই চায়, অন্য কোন শর্তে তারা রাজি নয়। ফলে আবার শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। দু’দলের ভেতর।

আইরিশ যুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল। বেশিরভাগ অভিনেতা আইরিশ। লোচ শ্রদ্ধার  সঙ্গে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে আইরিশ বিপ্লব শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল না, শুধু পতাকার পরিবর্তন নয়, বিপ্লবীরা চেয়েছিল আমূল সামাজিক পরিবর্তন। দীর্ঘ রক্তপাত। ফলে এই সিনেমা দেখতে দেখতে আপনার ইরাক বা ভিয়েতনামের কথা মাথায় আসবেই। এবং তখন আপনি বুঝতে পারবেন লোচের সিনেমায় সামাজিক সচেতনতা কোন পর্যায়ে। কিন্তু সবার ওপরে লোচের সেই মুগ্ধকর প্যানোরামিক ক্যামেরা। প্যানপাইপের মত আইরিশ উপত্যকায় যা ফ্রেম থেকে ফ্রেমে ভেসে চলে। তাই বলে ভাববেন না এটা আয়ারল্যান্ড পর্যটনের অ্যাড। লোচ মাঝে মাঝেই হাল্কা ডার্ক রং, ভরন্ত রং বা ধূসর আলো – এইসব ব্যবহার করে মেঘলা আইরিশ জলবায়ু ফুটিয়েছেন। এবং পুরো সিনেমা লোচ এমনভাবে বানিয়েছেন যে কখনো গতি খর্ব হয়েছে মনে হয়নি।    

একদম শেষে বলি, জন ফোর্ডের ‘দ্য কোয়াইট ম্যান’ (১৯৫২) আয়ারল্যান্ডের  গ্রাম্য জীবনের এক ক্লাসিক রোমান্টিক দলিল। কিন্তু এই সিনেমাকে আইরিশ সিনেমা হিসেবে লিস্টে রাখতে পারলাম না যেহেতু জন ফোর্ড নিজে হলিউডের পরিচালক। কিন্তু সিনেমাটা বেশ ভাল – দেখতে ভুলবেন না।

 

 

 

 

 

 


মধুবাণী ঘোষ


ভালোবাসার কথা বলতে এলাম: প্রাণের মানুষ ৩




অতলান্ত-প্রশান্ত সফরের সব ব্যবস্থা পাকাপাকি হয়ে গেল জুন মাসের গোড়ার দিকে। জুলাই পড়লেই আমরা বেরিয়ে পড়ব। কলকাতায় সব খবর ঠিকঠাক। পামেলা জোরকদমে আপিস করছে। এদিকে আমার তো ততক্ষণে কলেজের গরমের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। আকবর বাদশার পায়ের তলার সর্ষেগুলো কুড়কুড় শব্দ করে ঘুরে ফিরে বেড়ায়, কুটুস কুটুস করে চিমটি কাটে, পা বেয়ে বেয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে ওঠে! একটু যে চুপ করে স্থিতু হব তার কি আর উপায় আছে?

ঠিক করলাম আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিটোনো যে ভাইবোনগুলো আছে তাদের একটু দেখে আসি। তা আমার বাপু ভাবনা আর কর্মে তেমন বিলম্ব  সয় না। ঠিক করলাম প্রথমে ট্রেনে করে যাব নিউ জার্সি। সেখানে জয়, সংহিতা আর তাদের ছানারা থাকে। ওদের সঙ্গে থাকবো দিন কয়েক। সেখানে দেখা হবে শুভদেব, অপরাজিতার সঙ্গে। তখন পরনে থাকবে কলাপাতা রঙের শাড়ি। দেখা  হবে প্রিয়া, মার্কাস আর নিখিলের সঙ্গে।  তারপর সেখান থেকে ট্যাক্সি চেপে যাবো পেনসিলভ্যানিয়া। রানা  আর সীমন্তির বাড়ি যাওয়া হয়নি বহু বছর। আর আশ্চর্য্যের ব্যাপার, সেখানে আচমকা  দেখা হয়ে যাবে ক্যালিফোর্নিয়া থেকে  আসা সুজাতা আর বিজয়ের সঙ্গে। সেদিন রাতে পরব ফুলছাপ সিল্ক। কখন যে কার জন্য কোন চমক অপেক্ষা করে আছে তা কেবল জানেন সেই অদৃশ্য নাট্যকার। তারপর রানার গাড়ি চেপে ওদের সঙ্গে যাব সেনান্দোয়া ন্যাশনাল পার্ক। সেখানে আমরা সকলে মিলে থাকবো একটা ছবির মতো সুন্দর বাড়িতে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষা কাঠের বাড়ির বারান্দায় ছায়া দেবে পাইনের জঙ্গল। খুব কাছ দিয়ে বয়ে যাবে ঝর্ণা। হঠাৎ দেখে ফেলবো এক কালো ভালুক আর তার ছানাকে... দেখে ফেলবো সোনার হরিণ। সেখানে দেখা হবে শম্পা তুষার আর তুলির সঙ্গে। বিকেলে চায়ের সঙ্গে মাখা হবে ঝালমুড়ি। তারপরে শম্পাদের গাড়িতে চেপে চলে যাব নর্থ ক্যারোলিনা। সেখানে ওদের বাগানের ফুল দিয়ে সাজাবো ওদের বসবার ঘর। বাগানের সবজি দিয়ে তৈরী হবে দুপুরের খাবার।  আমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে বিশাখা। বিশাখার সঙ্গে পূর্ণিমার রাতে এক বিশাল হ্রদের জলে দেখতে পাব চন্দ্রালোক। সেদিন পরব চাঁদের আলোর মতো নরম সাদা রেশমের কাপড়, তাতে বসানো থাকবে হালকা সোনালি পাড়। এইসব  স্বপ্নের মতো  দিন, ভালোবাসার মতো মুহূর্ত আর মায়ার মতো একটা ফেলে আসার বিষণ্ণতা সুটকেস বোঝাই করে পড়ন্ত বিকেলে বোস্টনের প্লেন ধরব। সুসময় বালির মতো আঙুলের ফাঁক  দিয়ে গলে যায় যে...

‘অথচ সেই আগের মতোই ফুটছে শিউলি,

আগের মতোই বাতাস ছুটছে।

তবে কেন এই মাটি-জল আমার কি না

স্পষ্ট করে বুঝে নিতে আর পারি না,

তবে কেন হাজার প্রশ্ন জেগে উঠছে?

আগের মতোই ফুটছে যখন শান্ত শিউলি,

আগের মতোই বাতাস ছুটছে?

মাঝে মাঝেই বুকের মধ্যে ঝনকে ওঠে

এখন এই পড়ন্ত বেলায়।

দিনের দীপ্তি মিলিয়ে যাবার খানিক আগে

বন্ধুদেরও মুখ দেখে আজ ধাঁধা লাগে,

মন বসে না কোনো কাজে, কোনো খেলায়।

বুকের মধ্যে বিষণ্ণতা ঝনকে ওঠে

এখন এই পড়ন্ত বেলায়’।

পামেলার মায়ের অসুস্থতার খবর ইতিমধ্যে পেয়েছি। এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পথে ওর মুখ চোখ দেখে আর কথাবার্তা শুনে আন্দাজ করলাম যে ওকে কলকাতা চলে যেতে হবে দিন দশেকের ভেতরে। পরের কয়েকটা দিন কাটল ‘একা যাব’ হৃদয়ঙ্গম করতে। ঋজুকে  জানালাম আমার সিদ্ধান্তের কথা। টেলিফোনে কথা হলো :

‘মা, তোমাকে একা যেতেই হবে? তুমি তো কখনো এতটা গাড়ি চালাওনি। আমার তো এখন আর কোনো ছুটি নেই। তুমি কি ওই বুকিং-এর টাকা দেওয়া হয়ে গ্যাছে বলে যাচ্ছ? তুমি ওই টাকার জন্য চিন্তা কোরো না। তোমার সেফটি হল সবচেয়ে আগে’।

ছেলেটা কত বড় হয়ে গেল! কেমন প্রাজ্ঞ অভিভাবকের মতো কথা কইছে!  আমার চোখ ফেটে জল আসে।

‘না রে ঋজু। টাকার জন্য নয়। এই পথটা আমাকে যেতেই হবে। The road is calling me. I have to go.’

ঋজু  চুপ করে যায়। আমরা  এখন পরস্পরকে অনেকখানি জায়গা দিতে অভ্যস্ত। একটা সময় ছিল যখন আমি বোস্টন থেকে নিউ জার্সি, নিউ ইয়র্ক গিয়ে ওর ঘর দুয়ার গুছিয়ে দিতাম। স্তূপীকৃত জামাকাপড়ের পাহাড়ের তলা থেকে হাম্বা ডেকে বাছুর বেরিয়ে আসত । মাস খানেকের মতো রান্না করে ওর ফ্রিজার বোঝাই করে রেখে আসতাম। আমার সন্তান যেন থাকে দুধে  ভাতে। চিরুনির পাশে হলদে  Post-it-এ লিখে রাখতাম ‘Use Me!’

ঋজুর বছর তিনেক আগে বিয়ে হয়েছে। সমীক্ষা একজন অসাধারণ বিদুষী মেয়ে। ওরা  পরস্পরকে খুব ভালোবাসে, যত্ন করে। ঋজু এখন ওর জামাকাপড় সুন্দর করে ভাঁজ করে দেরাজে রাখে, চমৎকার মুরগির ঝোল রাঁধে, পরিপাটি করে চুল আঁচড়ায়। ঋজুর জীবনে আমার ভূমিকা পাল্টেছে আর আমিও সেটি ক্রমে ক্রমে  হৃদয়ঙ্গম করে ফেলেছি। এখন আমার সুতো ছাড়ার সময়। ওদেরকে একান্ত সময় দেবার সময়। এইটেই আসল খেলা। পরিবর্তিত অবস্থানের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া, গুছিয়ে নেওয়া। পরবর্তী পরিবর্তনের জন্য প্রস্তুত হওয়া।

‘সকালবেলা তাই আমাদের কোনও কাজ হয়নি করা

আমরা অনন্তকাল এমনি চুপচাপ হারানো দিনের গল্প শুনছিলাম

পুলিশের মতো

আমরা আমাদের কর্তব্য স্থির করছিলাম পুলিশের মতো

আমরা ভাবছিলাম সেইসব হারানো দিনগুলি ফিরে পাবার জন্য

লাকি মিতাকে পাঠিয়ে দেখবো একবার

আমরা বসে বসে এলোমেলো উত্তাল সম্ভাবনার স্বপ্নে এমনি করে

ব্যস্ত রাখছিলাম আমাদের

আমরা এমনি করে সময়ের একের পর এক চড়াই-উৎরাই হচ্ছিলাম পার

এমন সময় তারা বললো, ‘গাড়ি এসে গেছে, উঠে পড়ো উঠে পড়ো –

এখানে থাকলে বাঘে খাবে তোমাদের’

আমরা তখনই লাফিয়ে লাফিয়ে অনেকে হামাগুড়ি দিয়ে, হেঁটে

ভবিষ্যৎ-গাড়ির দিকে চলে গেলাম

আমরা সকলেই এখানে বাঘের জিহ্বা এড়িয়ে গিয়ে ওখানের বাঘের

জিহ্বার দিকে চলে গেলাম’।

আগে কথা ছিল যে আমরা ৩ জুলাই লেক-শোর ট্রেন ধরে শিকাগো পৌঁছবো। এদিকে এখন পামেলা যাবে না, আর খবর পেলাম যে ঋজু আর সমীক্ষা ওই  সময়টা আমার বেয়াইবাড়ি আসছে সিরাকিউস শহরে। সেই প্রাগৈতিহাসিক ম্যাপ মুখস্থ করা এতক্ষণে কাজে দিলো। মনে পড়ল লেক-শোর ট্রেন সিরাকিউসে মিনিট পাঁচেকের জন্য থামে। ছেলেটাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো। Nissan Rogue SUVর চক্করে পরবর্তী দেখা হওয়াটা একটু অনিশ্চিত  বটে! আমি রেল কোম্পানিকে ফোন করলাম। ‘আচ্ছা আমার অমুক তারিখে লেক-শোর ট্রেনা শিকাগো যাবার কথা। আমি কি দুদিন আগে রওনা হয়ে সিরাকিউসে নেমে যেতে পারি? দুদিন পরে আবার একই ট্রেনে বাকি রাস্তাটুকু যাব। এটা কি সম্ভব? লেক-শোর তো রোজই ছাড়ে!’

‘আপনার কপাল ভালো। টিকিট আছে বটে’।

‘ধন্যবাদ’।

ব্যাস! বেয়াইবাড়িতে জানিয়ে দিলাম যে আমি পরশুদিন দুদিনের জন্য ওদের সকলের সঙ্গে দেখা করতে আসবো। তারপর ৩ তারিখ লেক-শোর ধরে চলে যাবো শিকাগো। আমেরিকায় দেখেছি লোকেরা অনেক আগে থেকে সব প্ল্যান করে তবে লোকের বাড়ি যায়। সকলের সপ্তাহান্তের প্ল্যান ক্যালেন্ডারে দাগানো থাকে বহু মাস আগে। এখানে  বলে 'Save the date.' তা আমার কুটুমবাড়ি এমনিতেই খুবই ভদ্রজন। তার ওপর ঋজুর কাছে আমার ‘একা  যাব’ প্ল্যান শুনে খানিকটা সন্ত্রস্ত ও বটে।

তারা আমাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালো। আমিও ঝটপট বাক্স গুছিয়ে ট্রেন  ধরলাম। এবার বাক্সে কলাপাতা রঙের শাড়ি, ফুলছাপ সিল্ক, চাঁদের আলোর মতো নরম সাদা রেশমের কাপড়... কিছুই নেই। এবার রয়েছে পাখি দেখার দূরবীন, ইলেকট্রিক কেটলি, চা-পাতা, ফ্লাস্ক-মগ, ফার্স্ট এড বাক্স, জিনস, শার্ট, জ্যাকেট ইত্যাদি প্রভৃতি। আর  রয়েছে ফোনে ডাউনলোড করা আমার প্রিয় সব গানগুলি।

মাথার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজনা। আজকে ঋজুর সঙ্গে, সমীক্ষার সঙ্গে দেখা হবে। দেখা হবে কুটুমবাড়ির সকলের সঙ্গে। তারপর দুদিন পরেই লেক-শোর চেপে শিকাগো। সেখানে অপেক্ষা করে রয়েছে  Nissan Rogue SUV যাকে  কিনা আমি এক্কেবারেই চিনি না। তার সঙ্গে যেতে হবে দু’হাজার মাইল। পথে পড়বে কত না রাজপথ, জনপথ... আমি সেই সব দেখতে দেখতে গাড়ি চালাবো অবলীলায়। মাথার চুল এলোমেলো করে যাবে দমকা বাতাস। কিশোরকুমার গাইবেন…

चला जाता हूँ, किसी की धुन में

धड़कते दिल के, तराने लिये

मिलन की मस्ती, भरी आँखों में

हज़ारों सपने, सुहाने लिये, चला जाता हूँ...

আর আমার পাশে... আমার পাশে… একদম আমার পাশে থাকবেন রাজেশ খান্না!

(ক্রমশ) 



প্রদোষ ভট্টাচার্য্য

 

প্রসঙ্গঃ তরুণ মজুমদার



আগমন

দেশে ফিরে প্রথম বড় পর্দায় বাংলা ছবি দেখলাম সেই লেক টাউনের জয়ায় আমার অতি প্রিয় পরিচালক তরুণ মজুমদারের আগমন। আপনাদের মনে করিয়ে দিই যে ১৯৮৪-তে বিদেশ যাত্রার আগে এই প্রেক্ষাগৃহেই দেখেছিলাম তরুণবাবুর সে বছরের নতুন ছবি অমর গীতি। ২রা ডিসেম্বরে ১৯৮৮-তে মুক্তি পাওয়া আগমন ১৯৮৮-তেই দেখেছি না ১৯৮৯-এর গোড়ায়, তা সঠিক মনে নেই। তরুণবাবুর শ্রেষ্ঠ ছবির মধ্যে আগমনকে ফেলব না ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘ চার বছর প্রবাসের পর এর চেয়ে তৃপ্তিকর নতুন বাংলা ছবি কি হতে পারত জানি না! তাঁর অনেকগুলি আগের ছবির স্মৃতি যে জাগিয়ে দিল তাঁর এই নতুন উপহারটি! প্রথমেই গান ‘শুনুন শুনুন বাবুমশাই’ (কণ্ঠে শিবাজী চট্টোপাধ্যায় ও অন্যান্য) মনে করায় ফুলেশ্বরীর শীর্ষসঙ্গীত, যাতে মূল কণ্ঠ ছিল মান্না দে’র। চরিত্রগুলির নাম ভুলে গেছি, তাই অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম ব্যবহার করেই বলছি, দামাল ছেলে (মাঃ স্বর্ণেন্দু) তার সাগরেদদ্বয় গোবিন্দ আর ভোলা (এই দুটি চরিত্রের নাম মনে আছে) মনে পড়ালো শ্রীমান পৃথ্বীরাজ-এর রসিক আর তার বন্ধুদের। তবে রসিকও তার বদমেজাজী মাস্টারমশাইকে রসগোল্লার সঙ্গে কড়া জোলাপ মিশিয়ে খাওয়ায়নি যা আমাদের খুদে নায়ক করেছে! তার পোষা ব্যাঙকে নিয়ে সে ভাব জমায় জমিদার  বাড়ির ছোট্ট মেয়ের সঙ্গে। দুজনে একদিন গিয়ে পড়ে জঙ্গলের মধ্যে মন্দিরে। সেই মন্দিরের পুরোহিত হাস্যোচ্ছলে তাদের অভিহিত করেন ‘ভৈরব’ আর ‘ভৈরবী’ বলে। জমিদার বাড়িতে ততক্ষণে হৈচৈ পড়ে গেছে – মেয়ে কোথায়? ঠিক যেমন বিনিকে নিয়ে তুলকালাম হয়েছিল দাদার কীর্তিতে। সেবারে মধুরেণ সমাপয়েৎ হয়েছিল, বিনি যে গিয়েছিল তার হবু-বরের সঙ্গে! এখানে কিন্তু সাক্ষাৎ জমিদার বাড়ির খুকী ফিরল সিঁথিতে সিঁদুর নিয়ে, তাও আবার গ্রামের মধ্যবিত্ত ডাক্তারের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) বিচ্ছু ছোট ভাইয়ের! অসহায় খুকীর প্রাণপণ প্রতিবাদ সত্বেও রুমাল  দিয়ে মুছিয়ে দেওয়া হলো তার সিঁদুর – যে রুমাল সে বড় (দেবশ্রী রায়) হয়েও সযত্নে রেখে দেবে নিজের কাছে। এদিকে ধৈর্যচ্যূত দাদা হাতে তুলে নেবেন বড় জমিদারবাবুর (উৎপল দত্ত) চাবুক! মারে অর্ধমৃত কিশোরটিকে গ্রামের রাস্তার ধার থেকে কুড়িয়ে আশ্রয় দেবে এক যাত্রাদল। সেই দলের সঙ্গেই গ্রামে-গ্রামে ঘুরবে আমাদের নায়ক, আর তার স্নেহময়ী অভিভাবিকা হবেন সেই দলের মুখ্য নাচিয়ে (সন্ধ্যা রায়)। দু’জনের মধ্যে গড়ে উঠবে ভাই-বোনের সম্পর্ক। যখন পাতানো দিদি (বাড়িতে যে ভুমিকা পালন করতেন ছেলেটির বৌদি – সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়) নেচে- নেচে গাইছেন ‘প্রেমের পিপাসা নিয়া ছাড়িলাম কূল / বুঝিনি তো এ সাগর অতল-অকূল’ (কণ্ঠে আশা ভোঁসলে ও অন্যান্য), তখন কিশোর হঠাৎ গলা মেলায় আস্থায়ীতে (সৈকত মিত্র)। চশমখোর অধিকারী (অনুপকুমার) ভেবে ফেলেন যে এই বসে-বসে খাওয়া গলগ্রহটিকে এবার দলের কাজে লাগানো যাবে। নতুন পালা লেখা হয়, দিদি-ভাইকে নিয়েঃ ‘যশোদা-দুলাল’। এরই মধ্যে কিশোর পরিণত হয় যুবকে (তাপস পাল)। দলের ময়না (পাপিয়া অধিকারী) তার ওপর হামলে পড়লেও নায়ক তাকে প্রত্যাখ্যান করে; নায়িকা যেমন সেই সিঁদুর-মাখা রুমাল নিয়ে বিভোর, নায়কও স্মৃতিতে ডুবে থাকে সেই সিঁদুর-কৌটো নিয়ে, যার থেকে সে নায়িকাকে সিঁদুর পরিয়েছিল।

এরপর কাহিনী এগিয়ে চলে যাত্রাদলের সঙ্গে। এক গ্রামে সন্ধ্যা রায়-অভিনীত চরিত্র দেখে গাছতলায় বসে এক দৃষ্টিহীন বৃদ্ধ গাইছেন, “ভালোবাসার এই কিরে খাজনা! /  দিয়ে ফাঁকি ওড়ে পাখি, / যতই ডাকি, আর ফেরে না!” (কণ্ঠে মান্না দে)। এ যে তারই বাবা! সম্পূর্ণ গানটির মধ্যে দিয়ে আমরা দেখি সন্ধ্যা রায়ের চরিত্রটির দুর্ভাগ্যের ইতিহাস। প্রেমে পড়ে বাড়ি থেকে পালানো, তারপর মদ্যপ প্রেমিকের তাকে অন্যের হাতে বেচে দিয়ে অর্থোপার্জনের কু-চেষ্টা, আর সেখান থেকে কোনমতে নিজেকে রক্ষা করে যাত্রাদলে যোগদান। ভাবাবেগ-তাড়িত মেয়ে তার বাবার পায়ের কাছে রেখে আসে তার গলার সোনার হার। অবশেষে যখন সে ভাই আর ভাই-বৌয়ের মুখোমুখি হয়, ভাই দিদির মুখে থুতু দিয়ে তাকে তাড়িয়ে দেয় – অবশ্য বাবাকে দিদির দেওয়া সোনার হারটি সে সযত্নে তার স্ত্রীকে হস্তান্তর করে দিয়েছে! উদভ্রান্ত দিদি ছুটতে-ছুটতে সম্ভবত ঝাঁপ দেয় নদীতে। দিদির খোঁজে পাতানো ভাইও যাত্রাদল ছাড়ে। এরপর ঘটনাচক্রে পাতানো ভাই ট্রেনে গান-গেয়ে ভিক্ষা করা এক বৈরাগীর সঙ্গ পায়। ‘বিধি, তোর খেলা তো বুঝি ন রে, এ কেমন খেলা’ গাইতে গাইতে (দ্বৈতকণ্ঠে মান্না দে ও শিবাজী চট্টোপাধ্যায়) গেয়ে তারা ভিক্ষা করছে, এমন সময় ঘটে ট্রেন-দুর্ঘটনা! সন্ধ্যা রায় ইতিমধ্যে আশ্রয় পেয়েছেন সেই গ্রামের জমিদার-বাড়িতে যেখান থেকে আমাদের কাহিনি শুরু হয়েছিল। আর  যাত্রাদল আহত পাতানো-ভাইকে পথে খুঁজে পেয়ে তাকে শুশ্রূষা করে সারিয়ে তুলে এসে হাজির হয় সেই একই গ্রামে!

ইতিমধ্যে, নায়িকা বড় হওয়ায় তার সম্বন্ধ করা হয় এক ধনী, পোশাকে-আচারে পশ্চিমী (অতএব খারাপ!) ছেলের সঙ্গে। পাত্রপক্ষ মেয়ে দেখতে এলে, নায়িকা (দেবশ্রী রায়)-কে তার বাবা আদেশ করেন গান গাইতে – ঠিক যেমন ‘দাদার  কীর্তি’-তে সরস্বতীর বাবা করেছিলেন। সরস্বতীর কণ্ঠে তরুণবাবু চমকে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত দিয়ে। ‘আগমনে’র নায়িকা তার ছোটবেলার সাথীকে মনে করে অত্যন্ত সময়োপযোগী গান গেয়ে ওঠেন, আমার অভিজ্ঞতায় তরুণবাবুর ছবিতে এই প্রথম নজরুলগীতি, ‘শূন্য এ বুকে পাখী মোর আয়, ফিরে আয়, ফিরে আয়’ (হৈমন্তী শুক্লা)!

এবার জমিদার-বাড়িতে বসে যাত্রাগানের আসর। ‘পলাতক’ (১৯৬৩) ছবিতে প্রথম  দিকে গোলাপ (অনুভা গুপ্তা) ও অন্যান্যদের মুখে শোনা গিয়েছিল ‘সখী, মন যে আমার কেমন-কেমন করে’। ছবির পরমক্ষণের ঠিক আগে এই গান আবার শুনি রুমা গুহঠাকুরতা এবং অন্যান্যদের মুখে। ‘আগমনে’ও শুরুর দিকের গান ‘প্রেমের পিয়াসা নিয়া’ আবার চক্রাকারে-আবর্তিত হয়ে ফিরে আসে, এবার মূল গায়িকা ময়না (পাপিয়া অধিকারী, কণ্ঠে অরুন্ধতী হোম চৌধুরী)। তারপরই আমাদের নায়ক আসরে নামেঃ ‘যদি কেহ কৃষ্ণ চায়, কোন বাধা বাধা নয়! / সুখ কৃষ্ণ, দুখ কৃষ্ণ, তবে রাধা রাধা হয়!’ অবশ্যই গান গাইতে-গাইতে ‘পলাতক’-এর নায়কের মতো নায়ক মূর্ছা যায় (‘পলাতক’-এ অনুপকুমার অভিনীত চরিত্রটি ঠিক অজ্ঞান হয়নি, কাশির দমক ওঠায় গান বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল), আর অবশেষে কাহিনির রাধাকৃষ্ণের মিলন হয়।

ছবির বাড়তি প্রাপ্তি ছিল এক আসরে, যখন অর্ধোন্মত্ত, স্থূলরুচির শ্রোতারা খেউড়-গানের দাবি তোলে তখন ময়না আর নায়ক মিলে তাদের শান্ত করতে আসরে নেমে গায়, ‘ঢাক-গুড়গুড়, ঢাক-গুড়গুড়, গোপন কথা বলি, / আজ এখানে হবে বধূ ভালোবাসার বলি!’ এর পরেই নায়ক শ্রোতাদের লজ্জা দিয়ে একক কণ্ঠে গায়, ‘এতো ভালোবাসা নয়, ভালোবাসা নয়, কামনা-জড়ানো চাওয়া! / আঁধার পেরিয়ে, আঁধারের সাথে, আঁধারেতে ডুবে যাওয়া!’ দুটি গানেই নায়কের কণ্ঠ ছবির সুরকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়!

মনে পড়ে, ‘আগমন’ দেখার কিছুদিন পরে ট্যাংরার চীনে রেস্তোরাঁয় হঠাৎ তরুণবাবুর দেখা পাই, আর বিদেশে মানসিকভাবে তৃষিত থাকার পর তাঁর ছবি যে কতখানি তৃপ্তি দিয়েছিল তা জানিয়ে পরিচালকের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করি।

আপন আমার আপন

১৯৯০-তে দেখা প্রথম বাংলা ছবি, আমার হবু-স্ত্রীর সঙ্গে শ্যামবাজারের মিনারে তরুণ মজুমদার পরিচালিত ‘আপন আমার আপন’। আমার কাছে ছবির মুখ্য  আকর্ষণ ছিল, ১৯৮৯-তে মনপ্রাণ হাহাকারে ভরিয়ে দিয়ে প্রয়াত, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের একটি দৃশ্যে উপস্থিতি। ঐ দৃশ্যে তিনটি বাক্য তিনি উচ্চারণ করেছিলেনঃ “আমি... এর প্রস্তাব সর্বান্তকরণে সমর্থন করছি,” আর নায়ক (তাপস পাল) তার গান শেষ করার পর, “বেশ গেয়েছো, বাবা! দেখো, এ কণ্ঠ যেন হারিয়ে না যায়!” মনে হয়, ছবির যে প্রিন্টটি এখন পাওয়া যায়, তাতে এই তৃতীয় বাক্যটি নেই!

ছবিটির সপক্ষে বলব যে তরুণবাবুর অন্যান্য ছবিতে যেভাবে শহুরে বিত্তবানদের নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখা হয়, এখানে দীপঙ্কর দে-সঙ্ঘমিত্রা বন্দ্যোপাধ্যায়-শতাব্দী রায়-ইন্দ্রাণী দত্ত-দের পরিবারের ক্ষেত্রে তা হয়নি। এমনকি আপাতদৃষ্টিতে বিত্তের দম্ভে এবং প্রেমে ব্যর্থ হবার তাড়নায় সাময়িকভাবে বিপথগামী প্রসেনজিতের চরিত্রটিও শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত অনুমানযোগ্য পদ্ধতিতে আত্মত্যাগ করে নিজেকে উদ্ধার করেছে।

ছবির বড় খামতি তার মুখ্য গানটির সুর, যে গানের ওপর পুরো কাহিনিই নির্ভর করছেঃ ‘আঁধারে কখন এসে জ্বালবে প্রদীপ তুমি! / পথের খোঁজে, পথের মাঝে হারিয়ে গেছি আমি!’ সুরকার রাহুল দেব বর্মণ এবং গায়ক অমিতকুমার, দুজনেই হতাশ করেছেন! একেই বলে, বিসমিল্লায় গলদ! যাঁর সুরের স্পর্শে চিরকাল প্রাণ পেয়ে এসেছে তরুণ মজুমদারের ছবি (এই ছবি অবধি সম্ভবত একমাত্র ব্যতিক্রম হিন্দি ‘বালিকা বধূ’; বাংলা ‘নিমন্ত্রণ’ ও ‘অমর গীতি’ ছবিদুটিতে সুর সৃষ্টিতে যোগ দিয়েছিলেন যথাক্রমে নির্মলেন্দু চৌধুরী এবং রামকুমার চট্টোপাধ্যায়), তিনি এই ছবিতে শুধুই পার্শ্বচরিত্র! অন্য গানগুলি অবশ্য মন্দ নয়।

চাওয়া-পাওয়া

১৯৫৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠীর নামে তরুণবাবুর প্রথম পরিচালনার কাজ উত্তম-সুচিত্রা অভিনীত এই ছবিটি। ১৯৮০-র শেষে ‘দাদার কীর্তি’ মুক্তি পেয়ে প্রভূত সাফল্য লাভ করার পর আকাশবাণীতে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে তরুণবাবু এটিকে ‘অত্যন্ত দুর্বল ছবি’ বলেন। তখন এ ছবিটি দেখিনি। আশির দশকের শেষে বা নব্বই-এর গোড়ায় নন্দনে ‘চাওয়া-পাওয়া’ দেখে পরিচালকের এই উক্তির কারণ খুঁজে পাইনি। যেসব বিদেশী কাহিনী, এবং সেইসব কাহিনী-আধারিত বিদেশী ছবি থেকে এদেশে একাধিক ছবি হয়েছে, ‘চাওয়া-পাওয়া’ সেই গোত্রের একটি। স্যামুয়েল হপকিনস অ্যাডামস রচিত ছোট গল্প ‘Night Bus’ (১৯৩৩) অবলম্বনে ক্লার্ক গেবল ও ক্লোদেত কলবের অভিনীত ১৯৩৪ সালের ‘It Happened One Night’ চলচ্চিত্র থেকে ১৯৫৬-তে তৈরী হয় রাজ কাপুর-নার্গিস অভিনীত ‘চোরি-চোরি’, ১৯৫৭-তে দেব আনন্দ-কল্পনা কার্ত্তিক অভিনীত ‘নও দো গ্যারা’, আর ১৯৫৮-তে দেব আনন্দ-ওয়াহিদা রেহমান অভিনীত ‘সোলভা সাল’ ছবির গল্পেও ‘It Happened One Night’-এর প্রভাব আছে। অবশেষে ১৯৫৯-এ আসে ‘চাওয়া-পাওয়া’। হয়তো এই কারণেই তরুণবাবু তাঁর প্রথম-পরিচালিত ছবির প্রতি একটু বীতশ্রদ্ধ। যাইহোক, একজন উত্তম-সুচিত্রা ভক্ত হিসেবে আমার কাছে ছবিটি খুবই মার্জিত এবং উপভোগ্য। বিশেষ করে ছবির গানকে যে সংলাপের মতো ব্যবহার করা যায় তা’ দেখা গেছে সুচিত্রার মুখে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘খেলা নয়, নয় / এই যে কাছে ডাকা’ আর তার উত্তরে উত্তমের মুখে হেমন্তকণ্ঠে ‘যদি ভাবো এ তো খেলা নয়’ গান দুটিতে। তবে লক্ষ্যণীয় যে এরপর এই জুটিকে নিয়ে তরুণ মজুমদার আর ছবি করেননি, যদিও তাঁর স্মৃতিকথা ‘সিনেমাপাড়া দিয়ে’-তে দুজনের প্রতিই কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করা আছে।

আলো

‘চাওয়া-পাওয়া’-র পর এক দশকেরও বেশি বড় পর্দায় তরুণবাবুর সঙ্গে দেখা  হয়নি। আবার দেখলাম এবং মুগ্ধ হলাম ২০০৩ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটগল্প ‘কিন্নরদল’ অবলম্বনে চিত্রিত ‘আলো’ দেখে (প্রেক্ষাগৃহ শ্যামবাজারের মিনার)। আটখানি রবীন্দ্রসঙ্গীতে সমৃদ্ধ এই ছবিটির অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তরুণবাবুর চিত্রবিশ্বে নতুনঃ নাম-ভূমিকায় ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, তাঁর স্বামীর চরিত্রে কুণাল মিত্র, পার্শ্ব চরিত্রে ভাস্বর চট্টোপাধ্যায়, আলোর একাধিক বোনেদের একজনের ভূমিকায় সৌমিলি বিশ্বাস, এবং অভিষেক চট্টোপাধ্যায়, যাঁর অভিনীত চরিত্রটি অনুপকুমারকে মনে করাচ্ছিল। তরুণবাবু তাঁর বেশির ভাগ ছবিতে যেভাবে  ‘God made the country, and man-made the town’-এর দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে চলেন, এ ছবিতে তার খানিক ব্যতিক্রম ঘটেছে। গ্রামের অভাব, সংকীর্ণমনস্কতা, কিছু ব্যক্তির – বিশেষ করে ঋতা দত্ত-চক্রবর্তী অভিনীত নারীচরিত্রটির ক্রুরতা, কিছুই আড়াল করা হয়নি। বরং শহর থেকে আসা আলোর স্বতঃস্ফূর্ত ভালোবাসা আর মানুষকে আপন করে নেওয়ার মানসিকতায় শেষ অবধি আপ্লুত হয়েছে সবাই। আর এই কাজে অবিস্মরণীয় হয়ে উঠেছে আলোর মুখে ‘শ্রাবণের ধারার  মতো পড়ুক ঝরে’ গানটি (কণ্ঠে অরুন্ধতী হোম চৌধুরী), বিশেষ করে তার সঞ্চারী এবং আভোগ অংশ, আর ঠিক তার আগে গানের যন্ত্রানুসঙ্গঃ

‘যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে,

তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখা রে!

যা কিছু জীর্ণ আমার, দীর্ণ আমার, জীবনহারা,

তাহারই স্তরে-স্তরে পড়ুক ঝরে সুরের ধারা।

নিশিদিন এই জীবনের তৃষার ‘পরে, ভুখের ‘পরে –

শ্রাবণের ধারার মতো পড়ুক ঝরে, পড়ুক ঝরে!’

কাহিনী যে বিয়োগান্ত দিকে মোড় নেবে, তার পূর্বাভাস এসেছে আলো তার কিন্নরদলকে নিয়ে গ্রামে নৃত্য-গীতানুষ্ঠান করার সময়ে নাচের সঙ্গে যে গানটি পরিবেশন করেঃ

‘আমার রাত পোহাল শারদপ্রাতে –

বাঁশি, তোমায় দিয়ে যাব কাহার হাতে?’

সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে আলোর মৃত্যুর সংবাদে সারা গ্রাম যখন মুহ্যমান, তখন হঠাৎ এক রাতে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে তারই কণ্ঠেঃ

‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে,

আমি বাইব না মোর খেয়াতরী এই ঘাটে।

….

তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি?

সকল খেলায় করবে খেলা এই আমি!

নতুন নামে ডাকবে মোরে, বাঁধবে নতুন বাহুর ডোরে,

আসব-যাব চিরদিনের সেই আমি!’

উদভ্রান্ত হয়ে গ্রামের মানুষ আলোর বাড়িতে ছুটে গিয়ে দেখে অন্ধকারে বসে এক  ছায়ামূর্তি! না, প্রেতাত্মা নয়, আলোর স্বামী। গ্রামোফোনে সে বাজাচ্ছে স্ত্রীর প্রয়াণের আগে রেকর্ড করা শেষ গান। আর তার প্রতিভূ সে রেখে গেছে তার কন্যাসন্তানের মাধ্যমে!

রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রয়োগে তরুণবাবুর জুড়ি মেলা যে ভার, সেই আশির দশকের গোড়ায় ‘দাদার কীর্তি’ দেখেই বুঝেছিলাম। এবারেও তিনি হতাশ করেননি।

ভালোবাসার অনেক নাম

 

‘আলো’-র তিন বছর পর (২০০৬) সেই মিনারেই স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে দেখি, আবার বিভূতিভূষণের ছোটগল্প অবলম্বনে ‘ভালোবাসার অনেক নাম’। ছবির অন্যতম আকর্ষণ ছিল মুখ্য চরিত্রে উত্তমকুমারের নাতি গৌরব চট্টোপাধ্যায় আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ছোট নাতনী মেঘা। এছাড়া ‘বালিকা বধূ’-র (১৯৬৭) পর এই প্রথম তরুণ মজুমদারের ছবিতে এলেন মৌসুমী চট্টোপাধ্যায়! তবে, কাহিনীতে নিজের কনিষ্ঠা কন্যাকে বোনের ভূমিকায় অভিনয় করাবার সিদ্ধান্ত কার ছিল, কে জানে! অন্যান্য ভূমিকায় যথাযথ রূপদান করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মনোজ মিত্র, তাপস পাল প্রমুখ। মনোজ মিত্র অভিনীত কন্যাদায়গ্রস্ত স্টেশনমাস্টারের মেয়ে বুলবুলির ভূমিকায় (সম্ভবত) মৌলি ভট্টাচার্য খুবই উপভোগ্য, কারণ বিমলকে (গৌরব) আকর্ষণ করতে – এই নবাগত গ্রামের ইস্কুলমাস্টারের গলাতেই বাবা মেয়েকে ঝোলাতে চান – বুলবুলি পুরনো দিনের বাংলা ও হিন্দী ছবির গানের সুরে তার প্রেম নিবেদন করে! বিমলের চরিত্র ‘ফুলেশ্বরী’-র কেদারকে (শমিত ভঞ্জ) মনে করায়। এছাড়া তার মুখে প্রাঞ্জলের কণ্ঠে ‘আমি অল্প নিয়েই থাকতে পারি, যদি পাই একটু ভালোবাসা’, পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে শিবাজী চট্টোপাধ্যায়ের গলায় ‘ও নিঠুর দয়াল, এ কী তব খেলা’ (যা হেমন্তকণ্ঠে শোনা একাধিক গানের সুর মনে জাগিয়ে তোলে), আর একটি রবীন্দ্রসঙ্গীতের মন-ছোঁয়া প্রয়োগ (‘নয়, নয়, নয় এ মধুর খেলা) হৃদয়ে দোলা দেয়। তবে, ‘আলো’-র পর ‘ভালোবাসার অনেক নাম’ একটু নিস্তেজ লাগে।

(ক্রমশ)

 

 


পৃথা কুণ্ডু

 

বাঙালির জীবনে যিশুখৃস্ট




বাঙালির জীবনে যিশুখ্রিস্ট এসেছিলেন ঔপনিবেশিক সভ্যতার হাত ধরে। খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারকরা তাঁর বাণী প্রচার শুরু করেন প্রাথমিকভাবে শ্রীরামপুর প্রেসের মাধ্যমে। রামরাম বসু পাদ্রিসাহেব-মনিবদের খুশি করার তাগিদে লেখেন খ্রিস্টসংগীত। মিশনারি ‘ক্যাটেকিস্ট’রা যীশুর ছবি নিয়ে ধর্মপ্রচারে বের হতেন মেলা-উৎসব ইত্যাদি লোক সমাগমের জায়গায় হুতোম তাদের ব্যঙ্গ করে বলেছেন ‘ক্যাটিকৃষ্ট’। প্রথমদিকে বিদেশি শাসকদের ঈশ্বর বলে যীশুকে দূরে সরিয়ে রাখার প্রবণতা ছিল সমাজে; ‘নেটিভ’দের প্রতি ইংরেজদের বিরূপতাও তার অন্যতম কারণ। কিন্তু আস্তে আস্তে জাতিবিদ্বেষ আর শাসক-শাসিত সম্পর্কের বাইরে গিয়ে যিশুখ্রিস্টকে বাঙালি যে অনেকখানি আপন করে নিল, তার মূলে বাঙালির অতি প্রিয় দুই ‘ঠাকুর’-- একদিকে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ। নব ব্রাহ্মসমাজের উপাসনা-অনুষ্ঠানেও খ্রিস্টীয় প্রার্থনার  ভাব ও আঙ্গিক কিছুটা গ্রহণ করা হয়েছিল; কেশবচন্দ্র সেন ও তাঁর অনুগামীরা খ্রিস্টধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা রাখতেন, আবার ঠাকুরের কাছেও তাঁদের আনাগোনা ছিল। এই সব কিছু মিলিয়ে, ১৯শতকের বাংলায় সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক নবচেতনার প্রেক্ষিতে, শ্রীরামকৃষ্ণের ‘যত মত, তত পথ’-এর ভাবনায় যিশুখ্রিস্ট বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছেন।

 

শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন মাস্টারমশাই, অর্থাৎ শ্রীম। ঠাকুর একবার ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছেন এক ভক্ত মহিলা (গোলাপ মা)-র বাড়ি। ঠাকুরকে দেখে তিনি আনন্দে এমনই আত্মহারা হয়ে পড়েছেন যে অতিথিদের জলখাবারের ব্যবস্থা করতেও ভুলে গেছেন। এদিকে তাঁর বোন একা রান্নাঘর সামলাতে পারছেন না, বিরক্ত হয়ে এসে দিদিকে ডাকছেন। মাস্টারমশাই ইংরেজি পড়া, বাইবেল-পড়া মানুষ, তাঁর মাথায় এল — ঠিক এরকমই ঘটেছিল, যখন খ্রিস্ট গিয়েছিলেন মার্থা ও মেরির বাড়িতে। এক বোন খ্রিস্টের সামনে ভাবে বিভোর হয়ে বসে ঈশ্বরকথা শুনছিলেন, অন্য বোন এসে অনুযোগ করলেন, তিনি একা সব আয়োজন করে উঠতে পারছেন না। যীশু তখন বলেন— ‘তোমার দিদিই ধন্য, কারণ ঈশ্বরের প্রতি তাঁর প্রেম জেগেছে।’ সেকথা ফিরে এসে ঠাকুরকে বলেওছিলেন মাস্টারমশাই। প্রভু যিশু আর ঠাকুরের বাণীর মধ্যে মিল খুঁজে খুঁজে বের করার এমন চেষ্টা শ্রীম অনেকবারই করেছেন— “আপনি ভক্তদের উপবাস করতে কি অন্য কোন কঠোর করতে বলেন না— খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধেও কোন কঠিন নাই। যীশুখ্রিস্টের শিষ্যরা রবিবারে নিয়ম না করে খেয়েছিল, তাই যারা শাস্ত্র  মেনে চলত তারা তিরস্কার করেছিল। যীশু বললেন, ‘ওরা খাবে, খুব করবে; যতদিন বরের সঙ্গে আছে, বরযাত্রীরা আনন্দই করবে।’... অর্থাৎ যতদিন অবতারের সঙ্গে আছে, সাঙ্গোপাঙ্গোগণ কেবল আনন্দই করবে।”

আবার এক জায়গায় মাস্টারমশাই দেখিয়েছেন, যিশু বলেছিলেন— ব্যাকুল হয়ে দোরে ঘা মারো, দোর খোলা পাবে। ঠাকুরও বলতেন, ব্যাকুল হয়ে ডাকলে তিনি শুনবেনই শুনবেন। দেখা গেছে, ঠাকুরও বারবার বাইবেলের গল্প শুনতে আগ্রহ দেখাতেন। খ্রিস্টমতে সাধনা করার সময় তিনি এক অদ্ভুত আকর্ষণ অনুভব করতেন মা মেরি আর শিশু খ্রিস্টের ছবির প্রতি— যদু মল্লিকের বাগানবাড়িতে সে ছবি দেখেছিলেন তিনি। তাঁর ঘরে অন্যান্য দেবদেবীর পাশাপাশি খ্রিস্টের ছবিও থাকত। আর এক ভারতীয় খ্রিস্টান ভক্ত তাঁকে দেখতে এসেছিলেন কাশীপুরে— তাঁর গভীর বিশ্বাস ছিল, যিশু এবং শ্রীরামকৃষ্ণ এক।

 

২৫ ডিসেম্বর দিনটি শ্রীরামকৃষ্ণ-ভাবধারায় বিশ্বাসী মানুষজনের কাছে বিশেষভাবে স্মরণীয়। ঠাকুরের দেহত্যাগের পর স্বামীজি (তখন নরেন্দ্রনাথ)-সহ তাঁর বারোজন শিষ্য আঁটপুরে এসেছিলেন। ধুনি জ্বালিয়ে তাঁরা নিজেরাই সন্ন্যাস নিয়েছিলেন বড়দিনের আগের রাতে। শ্রীরামকৃষ্ণের বারো জন সন্ন্যাসী সন্তানের সঙ্গে তুলনা করা হয় যিশুর ‘twelve apostles’-এর। স্বামী বিবেকানন্দ খ্রিস্টধর্মের পাপ ও নরকের তত্ত্ব মানতে পারতেন না— এসব আসলে মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য পাদ্রিদের সৃষ্টি। কিন্তু ঈশ্বরপ্রেরিত, করুণা ও ত্যাগের প্রতিমূর্তি রূপে খ্রিস্টের প্রতি  তাঁর গভীর শ্রদ্ধার কথা জানিয়েছেন বিভিন্ন বক্তৃতায়-- বলেছেন, যিশুর সমকালে তিনি উপস্থিত থাকলে চোখের  জল দিয়ে নয়, বুকের রক্ত দিয়ে তাঁর পা ধুইয়ে দিতেন।

 

ভগিনী নিবেদিতা শ্রীমা সারদার মধ্যে মা মেরির রূপ দেখেছেন।  শ্রীরামকৃষ্ণ-বৃত্তের সূত্র ধরে যিশুর এক প্রেমময়, উদার ভাবমূর্তি বাঙালি সমাজে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।


অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে যিশু ধরা দিয়েছেন মানবধর্মের অন্যতম দিশারী এক মহাপুরুষ হিসেবে। তাঁর কথায়, যিশু চরিত্র আলোচনা করিলে দেখিতে পাইব, যাহারা মহাত্মা, তাহারা সত্যকে অত্যন্ত সরল করিয়া সমস্ত জীবনের সামগ্রী করিয়া দেখেন, তাহারা কোনো নতুন পন্থা, কোনো বাহ্য প্রণালী, কোনো অদ্ভুত মত প্রচার করেন না। তাহারা অত্যন্ত সহজ কথা বলিবার জন্য আসেন।” বাহ্যিক আচারে নয়, ধন-সম্পদের উপচারে, আড়ম্বরের পূজায় নয়, মানুষের অন্তরের পবিত্রতায় ঈশ্বরকে খোঁজার কথা যীশু বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল এই বাণী, ‘এইভাবে স্বর্গরাজ্যকে যিশু মানুষের অন্তরের মধ্যে নির্দেশ করিয়া মানুষকেই বড়ো করিয়া দেখাইয়াছেন। তাহাকে বাহিরের উপকরণের মধ্যে স্থাপিত করিয়া দেখাইলে মানুষের বিশুদ্ধ গৌরব খর্ব হইত। তিনি আপনাকে  বলিয়াছেন মানুষের পুত্র। মানবসন্তান যে কে তাহাই তিনি প্রকাশ করিতে আসিয়াছেন।’ (খৃস্ট: যিশুচরিত)

যিশুখ্রিস্টের নিঃস্বার্থ প্রেমের বাণীও রবীন্দ্রনাথের প্রেমভাবনার খুব কাছাকাছি।  বাইবেলে বলা হয়েছে, “প্রেম চির সহিষ্ণু, প্রেম মধুর, ঈর্ষা করে না, প্রেম আত্মশ্লাঘা করে না, গর্ব করে না, অশিষ্টাচরণ করে না, স্বার্থচেষ্টা করে না, রাগিয়া ওঠে না, অপকার গণনা করে না, অধার্মিকতায় আনন্দ করে না, সত্যের সহিত আনন্দ করে— প্রেম কখনো শেষ হয় না।  (নিউ টেস্টামেন্ট: ১, করিন্থিয়ান্স-১৩: ১-৮)।  

রবীন্দ্রনাথও বলেছেন প্রায় একই ধরনের কথা— মিলনের মধ্যে যে সত্য, তাহা কেবল বিজ্ঞান নহে। তাহা আনন্দ, তাহা রস স্বরূপ, তাহা প্রেম। তাহা আংশিক নহে তাহা সমগ্র কারণ তাহা কেবল বুদ্ধি নহে, তাহা হৃদয়কেও পূর্ণ করে।…  মিলনের যে শক্তি, প্রেমের যে প্রবল সত্যতা, তাহার পরিচয় আমরা পৃথিবীতে পদে পদে পাইয়াছি। পৃথিবীতে ভয়কে যদি কেহ সম্পূর্ণ অতিক্রম করতে পারে, বিপদকে তুচ্ছ করিতে পারে, ক্ষতিকে অগ্রাহ্য করিতে পারে, মৃত্যুকে উপেক্ষা করিতে পারে, তবে তাহা প্রেম। স্বার্থপরতাকে আমরা জগতের একটা সুকঠিন সত্য বলিয়া জানিয়াছি, সেই স্বার্থপরতার সুদৃঢ় জালকে অনায়াসে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করিয়া দেয় প্রেম। (ধর্ম/ উৎসব,৭-৮)।

 

শান্তিনিকেতনের পৌষমেলার সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছিলেন বড়দিনের উৎসবকে। যিশুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা থেকেই লিখেছিলেন ‘মানবপুত্র’, ‘শিশুতীর্থ’-এর মত কবিতা। ‘একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে’ গানটি তিনি রচনা করেন খ্রিস্ট-উৎসব উপলক্ষে, ১৯৩৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর। পরের দিন শান্তিনিকেতনে বড়দিনের উৎসবে গানটি গাওয়া হয়, অনুষ্ঠানে পৌরোহিত্য করেছিলেন অ্যান্ডরুজ সাহেব। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকায় কবির মন  ভারাক্রান্ত হয়ে থাকত প্রায়ই। যারা যীশুকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল, তারাই এ যুগে ক্ষমতালোভী যুদ্ধবাজ হয়ে দেখা দিয়েছে— এই বক্তব্য নিছক বড়দিনের আনুষ্ঠানিক মেজাজ ছাপিয়ে গানটিকে এক অন্য মাত্রা দিয়েছে। ‘আজি  শুভদিনে’ বা ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে’ গানগুলি খ্রিস্টসংগীত নয়, ব্রহ্মসংগীত হিসেবেই লেখা, কিন্তু পরম ঈশ্বরের উদ্দেশে নিবেদিত এই পূজা পর্যায়ের গানগুলিতেও অনেকখানি খ্রিস্টীয় ভাবনার আভাস মেলে।

রবীন্দ্রনাথের জীবনে একটি বিশেষ ঘটনার কথা এই প্রসঙ্গে না বললেই নয়। কবি তখন লন্ডনে। এক সন্ধ্যায় রোটেনস্টাইনের বাড়ি থেকে ফেরার পথে ‘গুরুদেব’কে  নিয়ে তপনমোহন চট্টোপাধ্যায় চললেন ‘জন’ নামে এক স্থানীয় দোকানির স্টলে কফি খাওয়াতে। রাত তখন অনেক। স্টল, রাস্তা প্রায় জনহীন। দূর থেকে ‘গুরুদেব’কে আসতে দেখে “জন হাঁটু গেড়ে মাটিতে নিল ডাউন হয়ে বসল। তার দুখানা হাত একত্র জোড় করা।” অস্বস্তিতে পড়ে কবি দ্রুত সরে গেলেন সেখান থেকে। পরে সেই জন বলেছিল তপনমোহনকে, “চ্যাটার্জি আমার জীবন ধন্য। করুণাময় লর্ড জীজস ক্রাইস্ট দূর থেকে আজ আমায় দর্শন দিয়ে গেছেন।” ('স্মৃতিরঙ্গ')      

   

রবীন্দ্র-উত্তর কালেও বাংলা সাহিত্যে, গানে, চলচ্চিত্রে বারবার এসেছেন যিশু নজরুল তাঁর একাধিক কবিতায়  যিশুর উল্লেখ করেছেন। বিশেষ করে ‘বড়দিন’ কবিতায় উঠে এসেছে তাঁর প্রতিবাদী, সাম্যবাদী চেতনা— পরাধীন  ভারতে ব্রিটিশ শাসক গোষ্ঠী যেভাবে দেশের দরিদ্র মানুষকে শোষণ করে ‘বড়দিন’-এর উৎসবে মেতেছে—তা দেখে স্বয়ং খ্রিস্ট কেঁদে ওঠেন! তারাশঙ্করের ‘সপ্তপদী’, ‘কান্না’র মত উপন্যাসে মানবপ্রেমিক খ্রিস্টের প্রতীক হয়ে ওঠেন কখনও সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া কৃষ্ণেন্দু, কখনও অনাথ শিশুদের আশ্রয়দাতা বাঙালি খ্রিস্টান ফাদার। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কিশোর-উপন্যাসেও এ জাতীয় চরিত্রের আনাগোনা। সুবোধ ঘোষের ‘চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ’ গল্পে খ্রিস্ট হয়ে ওঠেন নিপীড়িত প্রান্তিক মানুষদের ভরসা-- রুননু হোরো বলে, তাদের ‘বিরসা ভগবান’-এর চেহারা ছিল “যিশুখ্রিস্টের মত”। লীলা মজুমদারের গল্পে অবিবাহিতা, মাঝবয়সী খ্রিস্টান নার্স মাতৃত্বের স্বাদ পান হিন্দু পরিবারের পরিত্যক্ত এক শিশুকে কোলে তুলে নিয়ে, বলেন- “আজ যিশু আমাদের ঘরে এসেছেন!” নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কবিতায় উদ্যত ট্রাফিক থামিয়ে দিয়ে রাজপথ পেরিয়ে যায় পথশিশু-- ‘কলকাতার যিশু’। ‘সপ্তপদী’র চলচ্চিত্রায়নে মন্দিরের ঘণ্টায় মিলে যায় গির্জার বেল, সন্ন্যাসী কৃষ্ণস্বামী-রূপী উত্তমকুমারের মুখে ফুটে ওঠে খ্রিস্টের আদল। ‘সিস্টার’  ছবিটি বাঙালি দর্শক ভুলতে পারবে না, বিশেষ করে সলিল চৌধুরীর সুরে ‘বিশ্বপিতা তুমি হে প্রভু’ গানটি। বাংলায় ক্রিসমাস ক্যারলের ধাঁচে গান বললে আরও মনে পড়ে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘শোন শোন গল্প শোন’(ছায়াছবি ‘চেনা অচেনা’), ‘সূর্যের রক্ত’ (ছায়াছবি ‘অসাধারণ’)। আবার ভোলা ময়রা যখন অ্যান্টনিকে বলেন, “তোর কি ইষ্ট কালীকৃষ্ট, ভজ গে তুই যিশুখ্রিস্ট”, অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি জবাব দেন তাঁর গানে-- ‘ঐহিকে সব ভিন্ন ভিন্ন অন্তিমে সব একাঙ্গী”। এভাবেই, কলকাতার দীর্ঘদিনের বাসিন্দা অ্যাংলো-বাঙালি খ্রিস্টানদের মতই যিশু আমাদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠেন, মাদার টেরেসা আপন হয়ে ওঠেন, বাঙালির বড়দিনের সঙ্গে জড়িয়ে যান নাহুম সাহেব আর বো ব্যারাকের সান্তা ক্লজ-সাজা প্রবীণ, পার্ক স্ট্রিটের বেহালাবাদক।  বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণের তালিকায় অনায়াসে জায়গা করে নেয় বড়দিনের উৎসবও।