কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০২০

<<<< সম্পাদকীয় >>>>


কালিমাটি অনলাইন / ৭৪  


সদ্য বিগত বছরের ডিসেম্বরে অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা বিশাল লৌহ আকরিকের ভান্ডার ঝাড়খন্ড রাজ্যের নোয়ামুন্ডি শহরে আয়োজিত হয়েছিল নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের আঞ্চলিক সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উৎসবের (ঝাড়খন্ড, বিহার ও ওড়িষ্যা) মনোরম অনুষ্ঠান। এই তিনটি রাজ্য থেকে সমবেত হয়েছিলেন সংস্থার সদস্য ও শিল্পীরা। দু’দিন ব্যাপী আনন্দ-উৎসবে একদিকে যেমন গুণী শিল্পীদের সঙ্গীত ও নৃত্য পরিবেশনে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়েছেন, অন্যদিকে তেমনি বিভিন্ন চিন্তাশীল ব্যক্তিত্বের সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক ভাষণ ও বক্তব্যে ঋদ্ধ হয়েছেন প্রত্যেকেই। সেইসঙ্গে সংস্থার কর্মকর্তাদের আপ্যায়ণ ও আতিথেয়তায় বিহ্বল হয়েছেন সকলেই।

এই সম্মেলনে আলোচনার জন্য মূলত তিনটি বিষয় নির্দিষ্ট ছিল – শিক্ষা ও সমাজ সংস্কারে বিদ্যাসাগর, বহির্বঙ্গে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বর্তমান পরিস্থিতি এবং বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে অন্যান্য (ক্ষেত্রীয় ভাষা ও সাহিত্যের মেলবন্ধন - এই তিনটি বিষয়ে বক্তব্য রাখার জন্য যাঁরা আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন, বলা বাহুল্য, তাঁরা অত্যন্ত গভীর ও সুচিন্তিত বক্তব্য উপস্থাপিত করেছিলেন। তবে আজ কালিমাটি অনলাইন ব্লগজিনের চুয়াত্তর তম সংখ্যার সম্পাদকীয় লিখতে বসে, শুধুমাত্র একটি বিষয়ের ওপর সামান্য আলোকপাত করা প্রয়োজন মনে করছি, যদিও প্রাসঙ্গিকতার বিচারে সম্মেলনের নির্দিষ্ট প্রত্যেকটি বিষয়ই অত্যন্ত জরুরি।

রবীন্দ্রনাথ বিদ্যাসাগরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কিত আলোচনায়, তৎকালীন বঙ্গদেশে বিদ্যাসাগরের জন্মগ্রহণকে উপমিত করেছিলেন কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার ঘটনার প্রেক্ষিতে। বলা বাহুল্য, এখানে কোকিলের নিজের বাসা না বাঁধার অক্ষমতার প্রসঙ্গটি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। কিন্তু চতুর কাক যথেষ্ট বুদ্ধিমান না হওয়ার দরুন সে সাধারণ বিবেচনায় নিজের ডিমের পাশাপাশি কোকিলের ডিমে তা দিয়ে উভয়ের সন্তানের জন্মদান ও শৈশব থেকে কৈশোর পর্যন্ত যে লালন পালন করে থাকে, তাও খুব একটা জরুরি ব্যাপার নয় আমাদের আলোচনার প্রাসঙ্গিকতায়। বরং এটা বলা ঠিক হবে যে, কাকের সঙ্গে কোকিলের যে গুণগত এবং চরিত্রগত পার্থক্য আছে, রবীন্দ্রনাথ তাঁর লেখায় সেদিকেই আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। আসলে বিদ্যাসাগরের পূর্ববর্তী ও সমকালীন বাংলার যে সমাজব্যবস্থা ও কাঠামো ছিল, তার সঙ্গে নিতান্তই বেমানান ছিলেন বিদ্যাসাগর। রবীন্দ্রনাথের পর্যবেক্ষণে বিদ্যাসাগরের বহিরঙ্গ ছিল নিতান্তই বাঙালিসুলভ, কিন্তু অন্তরঙ্গে তিনি ছিলেন ইউরোপীয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। আর এই গুণগত কারণেই তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল, প্রচলিত শিক্ষা ও সমাজব্যবস্থার ঘুণধরা ও পরিবর্তিত সময়ের প্রেক্ষিতি পুরনো কাঠামোকে ভেঙে ফেলে নতুন কাঠামো নির্মাণ করা। এবং তিনি তাই করার জন্য তাঁর জীবন পণও করেছিলেন। প্রতিকূল আঘাতে আঘাতে ক্ষত বিক্ষত হয়েছিলেন। কিন্তু এখানে একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, কোমল বাংলাদেশে জন্মগ্রহণ করে তিনি কোন জাদুবলে এই ধরনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েছিলেন? বলা বাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ এই সম্ভাব্য প্রশ্নের উত্তরও আমাদের জানিয়েছেন। আসলে বিদ্যাসাগরের জন্মগত ও স্থানগত ছাঁচটি ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ। একদিকে যে চারটি গ্রাম বিদ্যাসাগরের জন্ম ও পরিবারের সঙ্গে নানাভাবে সম্পর্কিত ছিল – বনমালিপুর, বীরসিংহ, পাতুল ও গোঘাট – এই চারটি গ্রামেই ছিল বিখ্যাত পন্ডিত ও গুণীজনদের বাস। বিদ্যাসাগরের জীবনে ও চরিত্রে তাঁদের সেই বিদ্যা ও তেজস্বীতার গৌরব প্রবাহিত হয়েছিল। সেইসঙ্গে পারিবারিক সূত্রে তাঁর পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ, পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মাতা ভগবতী দেবী এবং একইসঙ্গে পাঠশালার শিক্ষক কালীকান্ত চট্টোপাধ্যায়, সংস্কৃত কলেজের শিক্ষক জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ও প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ প্রত্যক্ষভাবে,  আর পরোক্ষভাবে রাজা রামমোহন রায়, স্বয়ং ডিরোজিও ও ডিরোজিওর অসামান্য  ছাত্রদের প্রভাব সামগ্রীকভাবে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গঠনে সাহায্য করেছিল। এছাড়াও আরও অনেকের নাম উল্লেখ করা যায়, যাঁদের মধ্যে মাতৃসমা বাল্যবিধবা রাইমণির স্নেহ, দয়া ও সৌজন্য লাভ করে বিদ্যাসাগর পরবর্তী সময়ে স্ত্রীশিক্ষা ও বিধবা বিবাহের আন্দোলনের জন্য অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।

সম্পাদকীয় লিখতে বসে লেখাটি আর দীর্ঘ করা ঠিক নয়। শুধুমাত্র আজকের পরিপ্রেক্ষিতে এই কথাই উল্লেখ করা যায়, চারিদিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ও পরিবেশে কিছু কিছু নদী-নালা দৃষ্টিগোচর হলেও সাগরের দেখা আর পাওয়া যায় না। অথচ আমাদের জীবনে ও সমাজে সাগরের সত্যিই প্রয়োজন। সাগরের জল মেঘ-বৃষ্টি হয়ে ঝরে না পড়লে নদী-নালাও যে জলশূন্য হয়ে পড়বে!  

শুরু হলো ইংরেজি নতুন বছর ২০২০। নতুন বছর সবার শুভ হোক, এই কামনা করি।    


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা : 
kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com 

দূরভাষ যোগাযোগ :           
08789040217 / 09835544675 

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :
Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002,  Jharkhand, India.


<<<< কথনবিশ্ব >>>>


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়


‘মানেবই’-এর মানে ও সম্মানে




বউয়ের টিভির সামনে সন্ধেবেলায় ব্যায়াম করি ব’লে কিছু টিভি মাঝে মাঝে শোনা হয়েই যায়। বেশিটাই বিজ্ঞাপনে!আর তাতে রায় ও মার্টিনের, ছায়া প্রকাশনীর, পারুল প্রকাশনীর হাইলাইটেড বা আন্-হাইলাইটেড সব সহায়িকা্র নাম শুনে মনে পড়ে যায় ছোটবেলার নামপাতাপাতি খেলা। সেই যে একজনার চোখ টিপে ‘আয় তো রে আমার … বলা’ হবে, আর তার মাথা ছুঁয়ে উদ্দিষ্ট বা উদ্দিষ্টা চলে গেলে চোখ খুলে দেওয়ার পর তাকে সনাক্ত করতে হবে ছোঁয়া ধ’রে! আমাকেও যেন আমার বিধুর অতীত চোখ টিপে ধরে বলে — ‘‘আয় তো রে আমার মানেবই!” তখন অবশ্য সহায়িকা্র চেয়ে বোধিনী বলার চল ছিল বেশি, আর মুখের ভাষায় মানে-বই। মাস্টার মশাইদের গভীর আপত্তি ছিল মানে-বইয়ের প্রতি (‘টেক্সট বই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়বি’। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা অধিকারের নামমাত্র দামের বই (তখন ক্লাস শুরু হওয়ার আগেই পাওয়া যেতো), মানে-বই ছাড়া বইয়ের দোকানি দেবেই না। দামও-তো মুদ্রিত মূল্যের প্রায় হাপ! আর পড়বো নাই বা কেন? প্রাইমারির বাংলা, ইংরিজি (তখন ফাইভ থেকে ছিল), ইতিহাস, প্রকৃতিবিজ্ঞান কেনার সাতদিনের মধ্যে পড়া শেষ (ভূগোল বাদে)! শুকতারা, শিশুসাথী, মৌমাছির যে যেটা নিতো, তাদের কাছ থেকে এনে পড়া শেষ! লাইব্রেরির বই সপ্তায় তিনটের বেশি দেবেই না! গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকার পাতায় পাতায় বৃহৎ বাঁধাকপি, ফুলকপি, মূলা, বশীকরণের সুগন্ধি রুমাল, প্রায় মিনি পয়সার মতো দামে রেডিও (সব ভিপিপি যোগে প্রেরিতব্য, বিফলে মূল্য ফেরত), আরো শতেক বিজ্ঞাপন দেখা শেষ। ম্যায় সংক্রান্তি ব্রাহ্মণের ছবি, প্রতি মাসেই প্রায় এক, মানে ‘মস্তকে ফললাভ … থেকে গুহ্যে মৃত্যু’ পড়া শেষ!বশীকরণের মানে আন্দাজ ক’রে নিতে হচ্ছে;ব্রাহ্মণের গুহ্যে মৃত্যু কেন, বা তার মানে কী বোঝা যাচ্ছে না। রামের সুমতি প’ড়ে তাতে বার বার ‘রাম হাত ছুঁড়িল’ কিভাবে, তার পরেও হাত কী ক’রে বাহুসন্ধিতে ফিরে আসে, তা বোঝা যাচ্ছে না। বেতাল পঞ্চবিংশতি প’ড়ে ফেলেও প্রতি কাহিনীর বা ধাঁধার শেষে বিক্রমাদিত্য ঠিক উত্তর দেওয়ার পরেও ‘ইহার পর বেতাল ইত্যাদি …’ কেন লেখা হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে না। এমনকি মানেবইতে ব্যাখ্যাগুলির ব্যাখ্যানের শুরুতে ‘ভুমিকালিপি পূর্ববৎ’ বলতে কী বোঝায় তাও বোঝা যাচ্ছে না। কারুকে জিজ্ঞাসা ক’রে নেওয়ার অভ্যেস নেই! এই অবস্থায় নিজের বাংলা-ইংরিজি বইয়ের, পরে ক্লাস সেভেনে হিন্দি বইয়ের মানে, ক্লাস এইট থেকে সংস্কৃত বইয়ের মানে ছাড়াও, মেজদার উপরের চার ক্লাসের বইয়ের মানের জন্যে মানে-বই, দিদিদের ছআটদশবারোক্লাস উপরের বইয়ের কত কিছুর মানের জন্যে মানে-বই না প’ড়ে উপায় কী? তখনও তো কোয়ার্টার্স বাড়িতে আলাদা ক’রে কৃত্তিবাসী রামায়ণ আর কাশীদাসী মহাভারত কেনা হয়নি। সেই বইয়ের আকালের যুগে বইয়ের  খিদে তেষ্টা সামলাতো মানে-বই।

মানে-বই যে কেবল যে বইয়ের খিদে তেষ্টা মেটাতো তাই নয়! মানে বই ছিল উঁচুতে ওঠার মই। মানে-বই না থাকলে ক্লাস ফোরেই কী করে জানা যেতো যে সেজদি/নদির ক্লাস টেনের ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’ আসলে জগদীশ চন্দ্র বসুর অব্যক্ত থেকে নেওয়া; কিম্বা ক্লাস টেনের সংস্কৃত বইয়ের থেকে ‘সূক্তিরত্নাবলী’ প’ড়ে কী ক’রে জানতাম অঞ্জন মানে কাজল, বল্মীক মানে উই পোকা, আর সঞ্চয় মানে তাদের ঢিবির নির্মাণ। কিম্বা ‘भोदारिद्र्यनमस्तुभ्यंसिद्धोऽहम्त्वत्प्रसादतः। पश्याम्यहंजगत्सर्वम्नमांपश्यतिकश्चन॥’-এর মানে কেবল এই নয় যে গরিবকে কেউ দেখতে পায় না, গরিব সবাইকে দেখতে পায়, আসলে এখানে একটি যোগের কথা বলা হচ্ছে যে যোগে সিদ্ধ যোগী সকলকে দেখতে পারবে, কিন্তু তাকে কেউ দেখতে পারবে না। মানে-বইতে অবশ্য যোগের নামটা ভুল দেওয়া ছিল, ‘চিন্তামণিযোগ। আসলে পতঞ্জলির যোগসূত্রে যে সংযম (संयम) যোগের কথা আছে, তার সঙ্গে যুক্ত অদৃশ্যমানতা। তাতে বলে সংযম যোগে যোগীর তিনপ্রকার পরিবর্তন হয়। প্রাক্তন চিন্তাতরঙ্গের উপর সংযম প্রয়োগ করলে কেউ নিজের এজন্মে বা অন্যজন্মে অতীত জীবনসমূহের সম্বন্ধে জ্ঞানলাভ করে। অন্যের শরীরের প্রভেদকারী চিহ্নসমূহের উপর সংযম প্রয়োগ করলে কেউ তার  মন ও চেতনার জ্ঞানলাভ করে। আর নিজের শরীরের অবয়বের উপর সংযম প্রয়োগ ক’রে তার অনুভবনীয়তা আর প্রকাশ ক্ষমতাকে পরদ্রষ্টার চোখ থেকে আলাদা ক’রে নিতে পারলে অদৃশ্যতা আসে। কিন্ত মানে-বই না থাকলে এসবও কি জানা যেত? কিম্বা জানা যেতো যে এটারও অনেক রূপ আছে, যেমন, ‘দারিদ্র্যায়নমস্তুভ্যংসিদ্ধোহহংত্বৎপ্ৰসাদতঃ।। বিশ্বস্তো হি জনঃ কশ্চিৎ না মাং পশ্যতি সর্ব্বদা।। উক্তঞ্চ-- মৃতোদরিদ্রপুরুষোমৃতংমৈথুনমপ্রজম। মৃতমশ্রোত্রিয়ং দানং যাগস্ত্বদক্ষিণঃ।।’? অথবা, ‘भोदारिद्रयंनमस्तुभ्यंतत्प्रसादात्मयाच्चुतः।पश्याम्यहंजगताःसर्वनमांपश्यतिकश्र्चन।।’?
আবার, কেবল বোধ হয় জে. এল. ব্যানার্জির মানে বইয়ের কল্যাণেই আরো বড়ো মেজদির আই.এ. ক্লাসের পাঠ্য শেক্সপীয়রের অ্যাজ ইউ লাইক ইট, বঙ্গানুবাদে প’ড়ে ফেলা গেল। তাঁর বিয়ে ক্লাসে পড়ার সময়ে জর্জ বারনার্ড শ’র আর্মস অ্যাণ্ড দ্য ম্যান পড়ে ফেলা গেল! সেখানে রায়না, পেটকফ আর ব্লুন্টশলির কথোপকথন, আর চকোলেট ক্রিম সোলজারের কথা প’ড়ে সার্গিয়াসের বাক্‌দত্তা হওয়া সত্ত্বেও চকোলেট ক্রিমভক্ত ব্লুন্ট্‌শ্‌লির প্রতি রায়নার প্রেমের কথা প’ড়ে প্রথম যুদ্ধবিরোধিতার আদর্শের কথা জানতে পারা গেল ক্লাস ফাইভ সিক্সেই।
মানে-বইগুলো হাতের কাছে নেই, কারুর লেখকের নামও মনে নেই, অনেক সময়ে নাম থাকতোও না! হাইলাইটেড-তো দূর অস্ত! কিন্তু কী ইনফরমেটিভ! ক্লাস ফোরের বাংলা কিশলয়ে বিদ্যাসাগর-জননী ভগবতী দেবীর কাহিনীতে যে ‘কাপড়ের অভাব’ কথাটা ছিল তার মানে যে ‘বস্ত্রের অনটন’ তা মানে-বই ছাড়া কি চট ক’রে বলতে পারতাম? ইংরিজি, বাংলা, সংস্কৃত মানে-বই-এর লেখক অনেক সময়ে বেশ পুরনোগন্ধী রসিকও হতেন। একই সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের চরিত্রগঠনেও তাঁদের উৎসাহ ছিল জেনুইন! ব্যাপারটা কেমন বুঝিয়ে বলি! ক্লাস এইটের ইংরিজি বইয়ের মানে-বইতে শেক্সপীয়ারের অ্যাজ ইউ লাইক ইট থেকে এই কবিতাটি উদ্ধৃত ছিল।

                      Under the greenwood tree
                      Who loves to lie with me,
And turn his merry note 
Unto the sweet bird's throat,
Come hither, come hither, come hither:
Here shall he see
No enemy
But winter and rough weather.
Who doth ambition shun
And loves to live i' the sun,
Seeking the food he eats,
And pleased with what he gets,
Come hither, come hither, come hither:
Here shall he see
No enemy
But winter and rough weather.

তার এ’রকম অনুবাদ ক’রে দিয়েছিলেন এক মানে-বই লেখক, শেক্সপীয়ারের মূলের চেয়ে বেশি খারাপ নয়! একটু বেশি হেথা, আর হেথাতে-র সঙ্গে বাদের মিল-এর কথা বাদ দিলে। অর্ল্যান্ডোকেও বেশ অর্ধেন্দু মতো ক’রে দেওয়া গেছে এই অনুবাদে —

                       বনতরুর তলে আমার পাশে
শুয়ে শুয়ে মিঠে পাখির সুরে
হরষভরে সুর মিলাতে যে জন ভালবাসে
এসো হেথা, এসো হেথা, হেথায় এসো চলে,
বনতরুর তলে,
শত্রু তাহার দেখতে সেতো পাবে না হেথাতে,
শুধু এক ওই শীত আর হিমেল হাওয়াটুকু বাদে।
যে দিয়েছে উচ্চাকাঙ্ক্ষা হেলায় বিসর্জন,
ভালোবাসে রোদের আলোয় বাস,
চেষ্টা তাহার খাদ্যটুকু শুধুই অন্বেষণ,
যা জোটে তার তাইতে মেটে আশ,
এসো হেথা, এসো হেথা, হেথায় এসো চলে,
বনতরুর তলে,
শত্রু তাহার দেখতে সেতো পাবে না হেথাতে,
শুধু এক ওই শীত আর হিমেল হাওয়াটুকু বাদে।

অবশ্য ইংরিজি টেক্সট বইতে আর একটি কবিতাও ছিল, এই ওইখান থেকেই, ‘It was a lover and his lass,/With a hey, and a ho,/and a hey nonino,/ That o’er the green cornfield did pass’।  মানে-বই লেখক তার অনুবাদ করতে রাজি হন নি, কারণ তাঁর মতে ‘এদেশে তেরো চোদ্দ বছরের সুকুমারমতিবালক বালিকাদের পাঠ্য বইতে এই কবিতা দেওয়াই উচিৎ হয় নাই’। ওই যে মানে-বই লেখকের চরিত্রগঠনের ব্রত!

তো, এই চরিত্রগঠনের ব্রত-র একটা দিক হলো পাঠক-পাঠিকাদের জ্ঞানদান। মানে-বই লেখকরা তাতেও পিছপা হননি। ক্লাস নাইনের বাংলা বই পাঠ্যসঞ্চয়নে বঙ্কিমচন্দ্রের কপালকুণ্ডলা থেকে একটু অংশ দেওয়া ছিল, ‘সাগর সঙ্গমে নবকুমার’ নামে। সেখানে সমুদ্রদর্শনে আপ্লুত নবকুমারের মুখে কালিদাসের রঘুবংশম-এর বিখ্যাত শ্লোক, ‘দূরাদয়শ্চক্রনিভস্যতন্বীতমালতালীবনরাজিনীলা। আভাতিবেলালবণাম্বুরাশের্ধারানিবদ্ধেবকলঙ্করেখা।।’- তার মানে বোঝাতে মানে-বই লেখক শ্যামাচরণ কবিরত্ন-র “বঙ্গানুবাদ” দিয়ে দিলেন। সেটি হলো, ‘লৌহচক্রসম সিন্ধু লবণসলিল।/ঘেরিয়া তাহার ধারে বনরাজি নীল।।/তন্বঙ্গী সৈকতভূমি দূরে যায় দেখা।// ধারায় গ্রথিত যেন কজ্জ্বলের রেখা।।’ আহা, কী প্রাঞ্জল বাংলা অনুবাদ!‘কাপড়ের অভাব’-এর মানে যে ‘বস্ত্রের অনটন’, কোথায় লাগে এর কাছে!

এগারো ক্লাসে উঠে দেখলাম সংস্কৃত মানে-বইয়ের লেখকরা অন্য ভাবে চরিত্রগঠনের চেষ্টা করছেন! আমাদের পাঠ্য বইতে মহাভারতের প্রথম পর্বের প্রথম খণ্ডে মূল বেদব্যাসীয় সংস্কৃতে ধৃতরাষ্ট্রবিলাপঃ নামে একটি উদ্ধৃত অংশ ছিল, খুব ট্রাজিক,তাতে ধৃতরাষ্ট্র সঞ্জয়কে কেঁদে কেঁদে বলছেন কেন তিনি বিজয়ের আশা করেন নি। এতে তিনবার তিনটি শ্লোকে ‘উপস্থে’ কথাটি ছিল: ১২৪ নম্বরে ছিল ধৃতরাষ্ট্র যখন শুনলেন অবসাদগ্রস্ত অর্জুনকে কৃষ্ণ নিজ শরীরে বিশ্বরূপ দেখিয়ে যুদ্ধে পুনর্প্রবৃত্ত করেছেন ‘তখন হে সঞ্জয়, বিজয়ের আশা করি নাই’ (‘यदाश्रौषंकश्मलेनाभिपन्ने; रथॊपस्थेसीदमानेऽरजुनेवै/कृष्णंलॊकानदर्शयानंशरीरे; तदानाशंसेविजयायसंजय’, ‘যখন শুনিলাম, অর্জ্জুন বিষণ্ণ ও মোহাচ্ছন্ন হইলে কৃষ্ণ স্বশরীরে চতুর্দ্দশ ভুবন দর্শন করাইয়াছেন, তখন আর জয় আশা করি নাই।’)। আবার ১৩৭ নম্বরে ছিল ‘यदाश्रौषंवाहनेष्वआश्वसत्सु; रथॊपस्थेतिष्ठतागाण्डिवेन/ सर्वानयॊधानवारितानअर्जुनेन; तदानाशंसेविजयायसंजय’, ‘যখন শুনিলাম, অর্জ্জুনের অশ্বচতুষ্টয় একান্ত ক্লান্ত হইলে বাসুদেব বন্ধন উন্মোচন করিয়া তাহাদিগকে জলপান করাইয়া পুনর্ব্বার রথে যোজনা করেন, তখন আর জয় আশা করি নাই’। ১৪৩ নম্বরে ছিল, ‘यदाश्रौषंदरॊणमआचार्यमएकं; धृष्टद्युम्नेनाभ्यतिक्रम्यधर्मम/ रथॊपस्थेपरायगतंविशस्तं; तदानाशंसेविजयायसंजय’, ‘যখন শুনিলাম, ধৃষ্টদ্যুম্ন যুদ্ধ-ধর্ম্মের বিরুদ্ধ আচরণ করিয়া মরণে স্থির নিশ্চয়, বিশস্ত্রও রথস্থিত দ্রোণাচর্য্যের শিরশ্ছেদ করিয়াছে, তখন আর জয় আশা করি নাই।’

কিন্তু এই শ্লোকগুলি ব্যাখ্যা করার ফাঁকে মানে-বই স্যার আমাদের জানিয়ে দিলেন যে উপস্থ মানে উপর/উপরে ছাড়াও পুংচিহ্ন/শিশ্ন, স্ত্রীচিহ্ন/যোনি, পায়ুদ্বারও হয়। এখানে থামলেই হতো। কিন্তু মানে-বই স্যারের চরিত্রগঠন তাহলে হবে কী ক’রে! জানাতে হবে না, যে উপস্থর দুই অর্থেই স্ত্রীর উপস্থর উপর একমাত্র স্বামীরই অধিকার!

মানে-বই স্যারদের কাছে আমার অনেক ঋণ! তাঁরা অনেক শেখানোর মধ্যে চরিত্র গঠনের চেষ্টাও  গেছেন। তাঁদের মানে-বইয়ের পাশে আজকালকার এই চটিচটি সহায়িকা, কোনোটা কোনোটা আবার হাইলাইটেড, দেখে জে এল ব্যানার্জির লেখা আমাদের বিএ ক্লাসের শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজারের  ত্রিভাষিক (ইংরিজি, বাংলা, হিন্দি) মানে-বইতে ফ্লেভিয়াসের মুখে প্রথম ডায়ালগটার (Hence! Home, you idle creatures, get you home!) হিন্দি ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে, ‘ভাগো হিঁয়াসে, বেকার কে লোগ’।

ফারহানা রহমান


দ্য বাইসাইকেল থিভস




নিউ-রিয়্যালিজম ও ডি সিকা



মঞ্চের সার্থক কমেডিয়ান ভিত্তরিও ডি সিকার চলচ্চিত্রের প্রথম হাতেখড়ি হয় ১৯৪০ সালে। বহু সফল চিত্রনাট্যের রচয়িতা জাভাত্তিলিনের সাথে ডি সিকার বন্ধুত্বই বদলে দেয় ইতালির চলচ্চিত্রের ধারাকে। জন্ম নেয় চলচ্চিত্রের নতুন এক ধারা নিও-রিয়্যালিজমসস্তা সেন্টিমেন্টের ভেজাল গল্প বা বাস্তবতার বস্তাপচা গল্পের বদলে এমন ছবি বানানো হলো যেখানে আছে মানবতায় মণ্ডিত বাস্তবের প্রতিচ্ছবি। ছবির মাধ্যমে ফুটে উঠলো বুর্জোয়া সমাজের আপাত ঝলমলে পর্দার আড়ালে লুকানো জীবনের দুর্বল ক্ষত, অবক্ষয় আর পতনের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইতালির প্রতিকুল অর্থনৈতিক এবং নতুন ভাবাদর্শের প্রেক্ষাপটে মূলত সৃষ্টি হয় নিও-রিয়্যালিস্টিক চলচ্চিত্র। নিও-রিয়ালিজমের আদর্শ হচ্ছে স্টুডিওর মেকি এবং কৃত্রিম পরিবেশ ছেড়ে ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে জীবন যেমন তাকে তেমন করেই তুলে ধরা হয় রুপালি পর্দায়। ডি সিকাও নতুন কিছু সৃষ্টির আশায় স্টুডিওর সাজানো বাগান ছেড়ে নেমে এসেছিলেন পথের ধুলায়। নানারকম ঝড়ঝঞ্ছা পেরিয়ে ১৯৪৮ সালে সৃষ্টি হলো ডি সিকার জীবনের অদ্বিতীয় সৃষ্টি দ্য বাইসাইকেল থিভস্কোন প্রযোজকই পয়সা  জোগাতে রাজি ছিলেন না এ ছবিতে। এটাই ছিল নিয়তির নির্মম পরিহাস। নিও-রিয়ালিজম নিয়ে সারা পৃথিবী যখন আলোচনায় মুখর, খোদ ইতালিতেই সে তখনও অনাদৃত, অপাংক্তেয়। প্রযোজকরা যে এগিয়ে আসতে গররাজি, তার পিছনে ছিল ইতালীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের হুমকি মেশানো নির্দেশ। রোজেলিনি, জাভাত্তিনি এবং ডি সিকার উপর তখন চলছে কড়া সরকারি নজরদারি। কারণ হিসেবে বলা হলো এই পরিচালকদের সিনেমাগুলো হচ্ছে ইম্মরাল বা অনৈতিক।  রাষ্ট্রীয় ভাবাদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আর এরই অজুহাতে সু-সাইন সিনেমাটি  ১৯৪৬ সালের কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠানো হলো না। ডি সিকাকে সে-সময় টাকা জোগাতে রাজি হলেন আমেরিকার পরিচালক ডেভিড ও সেলজোনিক। তবে শর্ত দেওয়া হলো প্রধান চরিত্রে একজন নামডাকওয়ালা অভিনেতাকে নিতে হবে। প্রস্তাব করা হলো ক্যারি গ্রান্টের নাম। ডি সিকা পরিচালকসুলভ  আত্মবিশ্বাসে অগ্রাহ্য করলেন সেই প্রস্তাব। অবশেষে তিনি মঞ্চে ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে জোগাড় করলেন ছবি তৈরির টাকা। এভাবেই একদিন তৈরি হলো ভুবন-বিখ্যাত ছবি ‘বাইসাইকেল থিভস’। চিত্রতারকাহীন ছবিটির প্রধান চরিত্রে  অভিনয় করলেন একজন সাধারণ শ্রমিক। আর তার শিশু সন্তান ব্রুনো রিকির ভূমিকায় অভিনয় করলো ফুটপাতে কাগজ বিক্রি করা একটি ছেলে। কিন্তু রিলিজ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চারিদিকে সাড়া পড়ে গেল। কান ফেস্টিভ্যালে পুরস্কৃত হলো ছবিটি।

বাইসাইকেল থিভস কেন অনন্য


ছবিটি দেখলেই যে ব্যাপারটি প্রথমেই মন কেড়ে নেয় সেটা হচ্ছে এর অ্যাডাল্ট অ্যাপ্রোচ বা পরিপক্ক মানসিকতার স্পষ্ট ছাপ। সমস্ত ছবিময় ছড়িয়ে আছে একটা সূক্ষ্ণ প্রাজ্ঞ সংযম। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাস্তবের যথাযথ জীবনকে পরিণতির কোন স্তরে নিয়ে যাওয়া যায়, সেটা বোঝা যায় ছবিটি দেখলে। এর কোথাও নেই এতোটুকু অতিরঞ্জন। পরিমিতি বোধ, গল্পের সহজ প্রবহমানতা, সারল্য, স্বাভাবিকতা সমগ্র ছবিটিতেই ছড়ানো। জীবনের একটা খণ্ড ঘটনা তার মুহূর্তগত খুঁটিনাটি সমেত চোখের সামনে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। এটি যেন কোন সিনেমা নয়, বাস্তব কোন ঘটনার রূপায়ণ। এখানেই ডি সিকার মুন্সিয়ানা। নান্দনিক অভিজ্ঞানে নির্মিত এই ছবি।

থিভস-এর পটভূমি ও সমকালীন ইতালি


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী একটি শহরের সমস্যাসংকুল নিন্মবিত্ত জীবন ও তার সমগ্র বাস্তবতা নিয়ে তৈরি ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস্’ ছবিটি। এখানে আমরা দেখি  একটি মহানগরের জীবন চলছে তার নির্বিকার উদাসীনতা নিয়ে। নিস্তরঙ্গ বিবর্ণ এই শহরে হতাশায় নিমজ্জিত বহু বেকারের মধ্যে আন্তোনিও রিকিও একজন। সৌভাগ্যক্রমে সে বিভিন্ন জায়গায় পোস্টার তোলা ও লাগানোর একটি চাকরি পেয়ে যায়। তবে এই চাকরি পাওয়ার আবশ্যিক শর্ত হচ্ছে তার নিজের একটা সাইকেল থাকতে হবে। কিন্তু সাইকেল কোথায় পাবে দরিদ্র রিকি? এরকম বিপদের মুহূর্তে তার স্ত্রী মারিয়া সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। বিয়েতে পাওয়া ছয়টি চাদর সে বিক্রি করে স্বামীকে সাইকেল কিনতে সাহায্য করে।

ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রিকি প্রথম দিন কাজে বেরোয়। সাইকেলটি পাশে রেখে সে নিশ্চিন্তে দেয়ালে পোস্টার লাগাতে থাকে। ভাগ্যের এমনই নির্মম পরিহাস, তার চোখের সামনেই এক চোর দৌড়ে এসে সাইকেলটি নিয়ে মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যায়। এরপর ছবিটির কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে সাইকেলটি খুঁজে পাওয়া অথবা না পাওয়ার দোলাচলের মধ্য দিয়ে।

দুঃখভারাক্রান্ত মনে রিকি ছেলেকে নিয়ে বের হয় সাইকেলটির অনুসন্ধানে।  শেষাবধি সেটি খুঁজে না পেয়ে ভীষণ অসহায়ত্ব নিয়ে, অনেকটা নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় আরেকজনের সাইকেল চুরি করার। ছেলেকে বাসে করে ফিরে যেতে বলে সে একটি রাস্তার পাশে রাখা সাইকেল চুরি করে পালাতে যায়। কিন্তু সফল হলো না তার সেই চৌর্রকর্ম। এভাবেই নিষ্ফল একটা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার করুণ  পরিণতি সমস্ত অসহায়ত্ব নিয়ে ফুটে উঠেছে সম্পূর্ণ ছবিটিতে।

বোঝাই যায়, গল্পটি একটি উপলক্ষ মাত্র। বিরাট জীবনের স্রোতোধারাকে তার তরঙ্গের পর তরঙ্গের ভিতর দিয়ে স্বাভাবিক গতিসহ ধরে ফেলা হয়েছে ছবিটিতে। একটি ভাবনারই যেন পল্লবিত সম্প্রসারণ ঘটেছে এতে। রিকির প্রথম দিনের চাকরির স্থলে দেখি পোস্টার লাগানো লোকটি রাস্তার অ্যাকরডিয়ানবাদক ভিখারিকে পেছন থেকে লাথি দিচ্ছে। ডি সিকার ক্যামেরাও যেন এই সহজ সরলতার খাতিরেই অকৃত্রিম ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সেই দিকে। দৃশ্যটির সরলতা এতোটাই মনোমুগ্ধকর যে মনে হয় আমাদের চোখের সামনেই ঘটনাটি ঘটছে। ছয়টি বিছানার চাদর বাঁধা দিয়ে যখন বন্ধক রাখা সাইকেলটি রিকি ছাড়িয়ে আনলো, সাইকেল ডেলিভারি নেওয়ার সময় একজন কর্মচারি চাদরগুলো নিয়ে চলে গেল। গল্পের নায়ক রিকি মাত্র একবার সেই দৃশ্য দেখে নিয়ে নিজের কাজেই ব্যস্ত হয়ে পড়লো। কিন্তু আমরা দর্শকরা থেমে থাকলাম মাঝপথে। গুদামঘরের ছাদের উঁচু তাকে সেই চাদরগুলো না রাখা পর্যন্ত আমাদের দৃষ্টি সেই কর্মচারিকেই অনুসরণ করে চলল। এই যে উঁচুতে ওঠার দৃশ্যরূপ তা কি কিছুটা হলেও প্রতীকের আভাস দেয় না? নিজের জীবনের নীচু অবস্থান থেকে রিকি কি ওই উচ্চতারই আকাঙ্ক্ষা লালন করছে না? দর্শক হিসেবে জীবনের আরেক অবধারিত বাস্তবতার মুখোমুখি হলাম আমরা যখন রিকি সাইকেল হারানোর জন্য পুলিশের সাহায্য প্রার্থনা করল আর পুলিসটি বললো,  একটা তুচ্ছ সাইকেল খোঁজার জন্য এতো খরচ করে পুলিশ পোষা হয় না।সাইকেলটা যেন রিকি নিজেই খুঁজে নেয়। আর সাইকেলটা খুঁজে পেলে যেন পুলিশকে জানায় যাতে তারা ঘটনাটা ডাইরিতে টুকে রাখতে পারে। এর পরমুহূর্তেই আবার দারোগা হুকুম দেয়, মজুরদের মিছিল দমনের জন্য ট্রাক বোঝাই পুলিশ পাঠাতে। একইভাবে বৃদ্ধা গণৎকার যখন নিরাসক্তভাবে বলতে থাকে, “সাইকেলটি পেতে পারো আবার নাও পেতে পারো!ব্যাপারটার মধ্যে এতটাই স্বাভাবিকতা ছিল যে মনেই হয়নি গণৎকার অতিরঞ্জিত কিছু বলছে। এদিকে সাইকেল খুঁজতে খুঁজতে এক বৃদ্ধলোকের পিছু পিছু গির্জার ভিতরে প্রবেশ করে রিকি। ভান করে উপাসনায় অংশ নেওয়ার। তখনই চোরের বন্ধুকে চেপে ধরা, তার পাশে জোর করে বসা ও নায়কের কথা বলার স্বাভাবিক উত্তেজনা এর সবই সম্পূর্ণ ছবি জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র সহজ ভঙ্গির দৃশ্যরূপ। এইসব টুকরো টুকরা ঘটনা, বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সর্বহারা মানুষের জীবনের সহজ সরল গল্প। ডি সিকা এই গল্প বলার জন্যই ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন।

ডি সিকা ও তাঁর নন্দনশৈলী


কম্পোজিশন যে ডি সিকার সম্পূর্ণ আয়ত্তের মধ্যেই থেকে গিয়েছিল, তার অনেক দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই ছবির একের পর এক সিকোয়েন্সে। আমরা দেখতে পাই প্রতিটি খণ্ড কাহিনি যেন তার নিজস্ব সহজতায় একের পর এক চোখের সামনে ঘটে চলেছে। মন্তাজরীতির অনবদ্য প্রকাশ ঘটেছে পরপর ছয়টি শটে, বৃষ্টিভেজা পথ দিয়ে বাপ-ছেলের দৌড়ানো থেকে শুরু করে খটখটে পথে  তাদের দাঁড়ানো অব্দি। কখনই চোখে পড়ে না কোন কৃত্রিমতা অথবা জোর করে বাড়তি রঙচং মাখিয়ে অভিনয় করানো বা সাজানো ভঙ্গি। এই ছবির পরতে পরতে কী অপরূপ সংযম আর সংহতি। গল্পের নায়ক হতদরিদ্র রিকি যখন রিটা হেওয়ার্থের পীনোদ্ধত আবক্ষ ছবির পোস্টার দেয়ালে লাগাচ্ছিলেন, ডি সিকা এমনভাবে ক্যামারা ব্যবহার করলেন যাতে পোস্টারটি হয়ে পড়লো অনুল্লেখযোগ্য আর পোস্টার লাগানোর কাজটি হয়ে উঠলো উল্লেখযোগ্য। ক্যামেরার এই যে ফোকাস, নিঃসন্দেহে ডি সিকার সৃজনশীল নান্দনিকতারই অনবদ্য প্রকাশ। এরকমই সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ আবেগ আর ঘটনার অতিসাধারণ প্রকাশ দিয়েই ডি সিকা চমকে দেন দর্শকের। জয় করে নেন তাদের মন। এক অপরূপ মাধুর্যে উদ্ভাসিত হয় তাদের সত্তা।

আরেকটা দৃশ্যের কথা বলি। রিকি ছেলে ব্রুনোকে নিয়ে সাইকেল খুঁজতে খুঁজতে চলেছে ক্লান্ত পায়ে। ছেলে ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত। বাবার কর্মকাণ্ডে কিছুটা বিরক্ত। এদিকে বাবাও হতাশায় নিমজ্জিত হতে হতে ছেলের উপর কিছুটা ক্ষিপ্ত। চড়াও হয় হয় এমন অবস্থা। এতে ছেলে গেল রেগে। মাকে গিয়ে নালিশ করবে বলে বাবাকে হুমকি দিল। এরপর বাবা-ছেলে দুজনেই পাশাপাশি হাঁটছে, মাঝখানে অনেকটা ফাঁক। ছেলেকে পিছনে ফেলে বাবা একাই নদীর ধারে সাইকেল খুঁজতে চললো। হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো কোলাহল। একটি ছোটছেলে নাকি পানিতে ডুবে গেছে। বাবার মন বলে কথা। অজানা আশঙ্কায় আঁতকে উঠলো। ব্রুনো ব্রুনো করে বাবার সেকি চিৎকার! কিন্তু পরমুহূর্তেই নদীর ঘাটের উপর ছেলেকে গালে  হাত দিয়ে বিজ্ঞের মতো বসে থাকতে দেখে বাবার মনে স্বস্তি ফিরে এলো। ব্রুনো তখন চুপ করে বসে আছে সিঁড়ির উপর। তার মাথার উপর দিয়ে আমরা দেখতে পাই এক বিরাট উদার আকাশ, ধীরমন্থর গতিতে পরম উদাসীন কিছু মেঘ ভেসে চলেছে। একদিকে সহজ স্বাভাবিক প্রাকৃতিক দৃশ্য অন্যদিকে মধুরতা। এও কি কিছুটা প্রতীকি নয়? তবে এই দৃশ্য কখনই প্রকৃতিকে ছাপিয়ে প্রতীকি প্রকটতায় আমাদের দেখার আনন্দকে নষ্ট করে না।

বাবা-ছেলে এবার সব ভুলে ঢুকে পড়লো একটা রেস্তোরাঁয়। খাওয়া দাওয়া চলছে। চলছে মিউজিক। কিন্তু বাবার মনে শান্তি নেই। ঘুরে ফিরে তার চাকরির কথা মনে হয়ে যায়। মনে পড়ে সাইকেলের কথাও। এভাবেই চলে আসি ছবির শেষের দিকে। সারাদিনের ক্লান্ত পরিশ্রান্ত রিকি অন্য এক যুবককে চোর ভেবে নানাভাবে জেরা করতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই চোরটিকে ধরতে পারে না। শেষে নিজেই চোর হয়ে অপরের সাইকেল চুরি করার মতলব আঁটে। কিন্তু পালাতে গিয়ে লোকজনের হাতে ধরা পড়ে বেদম মার খায়। ব্রুনো ভিড়ের বাইরে থেকে বাবার জন্য বৃথা আহাজারি করতে থাকে আর ছবির দর্শকদেরকে এক চরম হতাশার মধ্যে ঠেলে দেয়। একসময় লোকের হাত থেকে মুক্ত রিকি ছেলের হাত ধরে পথ চলতে থাকে। পিছন থেকে ভেসে আসতে থাকে লোকজনের বিদ্রূপ। আমাদের কানেও সেসব পৌঁছায়। নাকে মুখে প্রহারের চিহ্ন নিয়ে ছেলের জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে আর সামাল দিতে পারে না গল্পের নায়ক রিকি। শহরের দূরের আকাশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। অক্ষম ক্ষোভের কান্না আর একাকী জীবন সংগ্রামের ধিক্কারসহ ছেলের হাত ধরে রিকি পথ চলতে থাকে। তার গন্তব্য যেন এক অনিশ্চিত আগামীর দিকে। জীবন হয়তো এরকমই প্রসারিত, অনন্ত।

অভিনয় ও অন্যান্য


ছবিতে সবার অভিনয় এতটাই স্বাভাবিক ও বাস্তব যে বিশেষ কিছু বলার নেই। ডি সিকার কাছে ছোট্ট একটা চরিত্রও খুবই গুরুত্ব পায়। চরিত্রের প্রত্যেকটি মানুষই যেন আমাদের চিরচেনা চারপাশের আপন মানুষ। দেশকালের গণ্ডিতে তাদের বাঁধা যায় না। চরিত্রগুলি যেন ইতালীয় নয়, আমাদের এই ঢাকা শহরেরই। ছোট্ট ছেলে ব্রুনোর বারবার করে বাবার দিকে তাকানোর মধ্যে যে বিস্ময় ফুটে উঠেছে, অথবা সাইকেলটি পেয়ে তার যে উচ্ছ্বাস দেখা যায়, তার কোনো তুলনা হয় না। সাইকেল হারানোর পর বাবাকে বারবার করে সাইকেলটির কী হয়েছে সে সম্পর্কে জানতে চাওয়ার চিরচেনা ভঙ্গি আমাদের  মনে করিয়ে দেয় শিশুদের স্বাভাবিক আচরণের কথা। শিশু মনস্তত্ত্বের এও আরেক দিক। সব চরিত্রই এই ছবিতে সহজ অনাড়ম্বরভাবে অনবদ্য অভিনয় করে গেছে। অতিরঞ্জনের ছিটেফোঁটাও আমাদের বিব্রত করে না। সম্পূর্ণ সিনেমা  জুড়ে যে এক অনাড়ম্বর সংযত কথন আমরা দেখতে পাই, সেই রসটিই হচ্ছে এই ছবির প্রাণবস্তু। বলা বাহুল্য, শুধু এই লেখা পড়ে ছবিটি সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়া এককথায় অসম্ভব। ডি সিকার ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস্’ ছবিটি  সম্পর্কে জানতে হলে অবশ্যই ছবিটি দেখতে হবে। একবার দেখতে বসলে যে কোনো দর্শক তার আসন ছেড়ে উঠে যেতে পারবেন বলে মনে হয় না।

চলচ্চিত্রের ভবিষ্যৎ ও ডি সিকা


মনে পড়ছে সত্যজিৎই কথাটা বলেছিলেন, ‘দ্য বাইসাইকেল থিভস’ সহ এই  পর্বের ইতালীয় ছবিই ভবিষ্যতের বিশ্ব-চলচ্চিত্রের গতিপথ তৈরি করে দিয়েছিল, “ইতালীয় ফিল্মের এই বহুখ্যাত বাস্তবিকতা (নিও-রিয়্যালিজম), সারল্য আর মানবতাই এ যুগের চলচ্চিত্র-শিল্পের যথার্থ সুরের সন্ধান দিয়েছে।অভিনয়ের জন্য বড় কোনো তারকার প্রয়োজন হয়, জাঁক করে হৈ চৈ ফেলে দিলেই ছবি করা হয়ে যায় না। ইতালীয়রাই সবার আগে এটা বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, ডি সিকা ছিলেন যাদের পুরোভাগে। পথের পাঁচালী-খ্যাত সত্যজিৎ রায়েরও যে গুরু ছিলেন ডি সিকা, তাও অকপটে বলেছেন সত্যজিৎ। আমি এখানে তাঁর কথা পুনরুল্লেখ করে আমার বাইসাইকেল থিভস দর্শনের মহিমার কথা শেষ করছি, “ইতালীয়  ফিল্ম এত আলোড়ন তুলেছে কেন ভেবে দেখতে গেলে কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। হলিউড এতকাল ধরে তিলে তিলে যে সমস্ত অবাস্তব রীতির প্রতিষ্ঠা করেছে, একমাত্র ইতালি পেরেছে সেই আজগুবি রীতিকে ফুঁ দিয়ে সম্পূর্ণ উড়িয়ে দিতে। অভিনয়ের জন্য তারকারাজি সম্মেলন করার রীতি যে কত বড় বিরাট মূর্খতা, ইতালীয়রা তা হাতে হাতে প্রমাণ করে দিয়েছেন। তাঁরা দেখিয়েছেন যে  ছবি তুলতে কুবের ভাণ্ডার উজাড় করার, কিংবা চটুল চাকচিক্যের জৌলুস দেওয়ার এবং সেই ছবি কাটতির জন্য বিশ্বব্যাপী হই হই রই রই আওয়াজ তোলার কোনওই প্রয়োজন নেই। বলতে গেলে প্রায় সূচনা থেকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে হয়েছে বলে ইতালীয়রা চলচ্চিত্রের মূল ভিত্তির সন্ধান রাখেন। ব্যাপারটা বড় সহজ হয়নি। চলচ্চিত্র নির্মাণের পদ্ধতিটাই তো জটিল, কিন্তু তার মধ্যেই  ইতালীয়রা সারল্যে, সততায়, বাস্তবিকতায় সিদ্ধিলাভের চেষ্টা করে এসেছেন। নতুন পদ্ধতির এই নতুন পাঠশালায় রসেলিনি, ডি সিকা, ভিসকন্তি, লাতুয়াদা এরাই হচ্ছেন গুরু।” (সত্যজিৎ রায়, প্রবন্ধ সংগ্রহ)




শিবাংশু দে


জরাসন্ধ আর গণেশ পাইনের রানি - ৬








‘...পুরাতন বইগুলি রেখেছো কি ঘরে
আজো কি আমাকে মনে পড়ে
নির্দ্বিধায়?
হেমন্ত-সন্ধ্যায়
গাছের শিথিল পাতা ওড়ে ঘূর্ণিঝড়ে
আজো কি আমাকে মনে পড়ে?
তোমার সমস্ত গান ভোরবেলাকার রেলওয়ে-বিলে মাছরাঙা
তোমার সমস্ত ছবি পাগল-ঝোরার...’

দোল পূর্ণিমায় আমাদের  ছুটি নেই। সারাদিন যাচ্ছেতাই রকম সরকারি কাজকম্মো সারা হলো। শীতলধারা জলে সারাগায়ের পাপ ধুয়ে গেস্টহাউসের লাউঞ্জে এসে বসেছি, পার্থ হাজির। কুন্তলবাবুর বাড়িটি কাছেই, মেঘা অতিথশালা থেকে যে রাস্তাটা ডানদিকে নেমে চলে যাচ্ছে, তার পাশে। অন্য সব বাড়ির মতো-ই সবুজ, সবুজ-ঘেরা পরিকীর্ণ বাগান পেরিয়ে। বাগানে দাঁড়িয়ে আছে একটি আকাশছোঁয়া প্রাংশু শালবৃক্ষ। ঘাসজমি আর সাজানো ফুলের বিছানা। সন্ধে নামার একটু আগেই দোল পূর্ণিমার চাঁদ থেকে তখন পাতলা সরের মতো জ্যোৎস্নার স্বাদ মাটিতে নেমে আসছিলো। পার্থ আর আমি হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই একটি শাদারং কাঠের গেটের কাছে। নাহ, ওঁর বাড়িতে কোনও কুকুর নেই। ভিতরে গৃহস্বামী শাদা লখনউয়ে সেজে আদর্শ মেহমান নওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।
ওঁর বাড়িটি বেশ সাজানো। রুচির আঙ্গিকটি স্পষ্ট ও অভিরাম। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় পিলু বাজাচ্ছিলেন, তাঁর গান্ধর্বী আঙুলের স্পর্শে ঘর ও বাহিরে বসন্ত থৈ থৈ সুরে ভেসে যাচ্ছিলো। এটি তাঁর স্টকহোমে বাজানো ১৯৭৫ সালের রেকর্ডিংটি। বেশ দীর্ঘ, ঘোর জাগানো কোলোন ভেজা রেশমি কাপড়ের মতো মায়া তার সুরসঞ্চারে। এদেশে তখনও পাওয়া যেতো না রেকর্ডটি। নিশ্চয় কেউ বিদেশ থেকে এনে দিয়েছেন। কুন্তল কিছু বলে স্বাগত জানাতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আমার মুখ দেখে মৌনতায় স্থির। তারপরেও বাজনাটি বেজেছিলো অনেকক্ষণ, আমি নিমীল আশ্লেষে ডুবে শুনে যাচ্ছিলুম তার সব প্ররোচনা। চোখ খুলে দেখি সামনে রিমা বসে আছে। বলে, আমি তো ভাবলাম তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো। আমি হাসি,
-হ্যাঁরে, না ঘুমিয়ে এসব কি আর শোনা যায়...?
গৃহকর্তা বিকল্প দেন, কালো কুকুর নাশিবের শৃগাল। পার্থ বলে, শেয়াল থাকতে কুকুর কেন ?
-বেশ...


নিবিড় চুমুকের সঙ্গে নিবিড়তর জীবনচর্যার গল্প চলে, চলতে থাকে প্রত্যাশিত শব্দকথার আলাপ আমাদের। কিন্তু সবার চেয়ে প্রগাঢ় যে নেশা সুরের হাত ধরে আসে, তার কাছে বাকি সব কিছু তো ছেলেখেলা। কুন্তল কলকাতায় উত্তম গুরু'র কাছে তবলা বাজাতে শিখেছিলেন। যন্ত্রটি এখন আর ততো প্রশ্রয়ে নেই, কিন্তু নেশাটি রয়েছে। দম্পতির আত্মজ, দশ বছরের বালক একটি, দার্জিলিঙে হস্টেলে থাকে। ফ্রেমের ভিতর থেকে উজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে আছে সে সবার দিকে। কথায় কথায় কথামালা। পার্থ বলে, যাবে নাকি আরেকবার থলকোবাদ? আমার প্রথম দেখা থলকোবাদ তো আর নেই। শুনেছি সেই জঙ্গল এখন ধু ধু মাঠ। যাবে? শুনলে 'না' বলতে পারি না। বলি, হাতের কাজকম্মো শেষ হোক। পার্থ বলে, তোমার কাজকম্মো মানে আমার বাঁশ, যাও তো, একদিন আমাকে ফুরসত দাও। কুন্তল সাগ্রহে বলেন, আমরা ওঁকে নিয়ে যাবো। দেখছি, ডাকবাংলাটার বুকিং কবে পাওয়া যায়। মনে হচ্ছে, ব্যাপারটা আমার নিয়ন্ত্রণে আর থাকছে না।

-রাত হলো, আজ উঠি…
-শিবাজিদা, ওঠার আগে 'চিরসখা' একবার শোনাবে?
-দ্যাখ, সুরা পান করে গীতবিতান গাই না, তবে অন্যকিছু গাওয়া যেতে পারে, হয়তো...
- তবে ‘আমি নিরালায় বসে’, তোমার পেটেন্ট...
-মনে আছে ? বেশ...

"...বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার, যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সালমা-চুমকি-জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটে নক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি..."

-----------------------------------

"বড় দীর্ঘতম বৃক্ষের সে আছো, দেবতা আমার়
শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন
সম্ভ্রমের মূল
সেইখানে শুয়ে আছি মনে পড়ে, তার মনেপড়ে?
যেখানে শুইয়ে গেলে ধীরে-ধীরে কতদূরে আজ!
স্মারক বাগানখানি গাছ হ'য়ে আমার ভিতরে
শুধু স্বপ্ন দীর্ঘকায়, তার ফুল-পাতা-ফল-শাখা
তোমাদের খোঁজা-বাসা শূন্য ক'রে পলাতক হলো়
আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার
পুরানো স্পর্শের মগ্ন কোথা আছো? বুঝি ভুলে গেলে
নীলিমা ঔদাস্যে মনে পড়ে নাকো গোষ্ঠের সংকেত;
দেবতা সুদূর বৃক্ষে, পাবো প্রেম কান পেতে রেখে।।



শক্তি'র কবিতা পড়ার অনেক আগে থেকেই শক্তি'র নামের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ছিলো, বাবার দৌলতে। শৈশব স্মৃতিতে মনে পড়ে কোনও এক শারদীয় দেশ বা আবাপ'তে প্রকাশিত হয়েছিলো, অবনীর পদ্য। বাংলা ভাষায় যেসব কবিতা কালো অক্ষরের শরীর পেরিয়ে মানুষের সার্বিক অবচেতনায় সংক্রমিত হয়ে গেছে, অবনীর পদ্যতার একটি। সেই বয়সে "বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস, এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে'এর ঝাপসা ছবিটিই স্পষ্ট লেগে ছিলো, বাকি পাওয়াটা পরে এসেছে। হিজলিতে এক বন্ধুর বাড়ি বেড়াতে গিয়ে শক্তি এই পদ্যটি শব্দে বেঁধেছিলেন। কখনও ভাবেননি এই পদ্যটি তাঁর পাঞ্জার ছাপ হয়ে যাবে।

চার বছর বয়সে পিতৃহীন শিশু দাদামশায়ের সংসারে যুদ্ধ করে বেড়ে উঠছিলেন। কমার্স পড়তেন, মামার ব্যবসায়ে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। হলো না। প্রেসিডেন্সিতে বাংলা অনার্স, তাও হলো না। যাদবপুরে বুদ্ধদেব বসুর স্নেহ চ্ছায়ায় 'তুলনামূলক', তাও না। অসহ্য বস্তিবাস, এদিক ওদিক কেরানিগিরি থেকে গুদাম সামলানো। ১৯৫১ থেকে ১৯৫৮ কম্যুনিস্ট পার্টির কার্ডধারী সদস্য, আবার ১৯৬১তে সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হাংগ্রিদলের অগ্রণী সহযোগী। কোনও কিছুই করা হয়ে উঠলো না তাঁর। লিখতেন শুধু গদ্য। কিন্তু প্রেমে পড়ে কবি হয়ে উঠলেন, এই চাইবাসাতেই। প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'হে প্রেম, হে নৈঃশব্দ্য'এর কবিতা চাইবাসাতে বসেই লেখা হয়েছিলো। থাকতেন সমীর রায়চৌধুরির বাড়ি। প্রেম করতেন তাঁর শ্যালিকার সঙ্গে। এই সম্পর্কটি শেষ পর্যন্ত পরিণতি পায়নি, কিন্তু অনেক গবেষকের চিরন্তন খোরাক হয়ে থেকে গেলো। সম্প্রতি বেলা রায়চৌধুরি একটি কাগজে এই ইতিকথাটি তাঁর স্মৃতি থেকে লিখে রেখেছেন। শক্তির হলেও হতে পারতেন শ্যালকের সঙ্গে আমার চাইবাসা থাকাকালীন সৌহার্দ্য গড়ে উঠেছিলো।
বুদ্ধদেবের 'কবিতা' পত্রিকায় তাঁর প্রথম পদ্যপ্রকাশ, 'যম"। তৃতীয় প্রকাশিত কবিতা, 'জরাসন্ধ', "আমায় তুই আনলি কেন, ফিরিয়ে নে", তারপর থেকে সেই যাত্রা, যেখানে মৃত্যুর পরেও মাথা উঁচু হেঁটে যাওয়া, দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া রুটমার্চ।

যাঁদের সঙ্গে কবিতার সম্পর্ক নেই, তাঁরা শক্তিকে চেনেন তাঁর অবিরাম, অনশ্বর উৎকেন্দ্রিকতার নিরিখে। বাংলা কবিতার সঙ্গে সুরাপানকে অতো প্রবলমাত্রায় তিনিই জুড়ে দিয়েছিলেন। পদ্য'কে মদ্যের অপর পিঠ করে তোলার যে নিমসাধনা, তার ভগীরথ না হলেও পরশুরাম ছিলেন শক্তি। পরবর্তী প্রজন্মের কবিযশোপ্রার্থীদের 'কবি' হয়ে ওঠার কিছু মেড-ইজি তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি, হয়তো অসচেতনভাবেই। আবার সীমাহীন যশোপ্রার্থীদের গড্ডালিকার বাহুল্যে বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, "এতো কবি কেন?" আর কোনও বাংলাশব্দশিল্পী জীবৎকালে এতো অধিক উপকথার নায়ক হতে পারেননি। উৎকেন্দ্রিকতা না অপ্রকৃতিস্থতা, তাঁর চালিকাশক্তি কী ছিলো তাই নিয়ে আজ অনেক গবেষণা হয়ে থাকে। অলোকরঞ্জন যা'কে বলেছেন "অভিনীত অপ্রকৃতিস্থতা", শক্তি তাকেই নিজের বর্ম করে তুলেছিলেন। পাগলামি'কে এমত একটি স্বীকৃত অবস্থান করে তুলতে তখনও পর্যন্ত কোনও কবি'কে আমরা দেখিনি। অনেকে অতিষ্ঠ হয়ে বলেছিলেন, শক্তি পাগলামি ভাঙিয়েই খেলো। চ্যাপলিন যেমন বলেছিলেন ডিল্যান টমাস প্রসঙ্গে, "সে একজন পাগলের থেকেও অনেক বেশি পাগলামি করে থাকে।" শেষে কি এ তাঁর মুদ্রাদোষ হয়ে পড়েছিলো? আমি শক্তি, এই আমার প্রকৃত মুদ্রা, আমি একেই ভাঙিয়ে খাবো। এতো বৃহৎমাত্রার অস্বভাবধর্মপালন করেও কিন্তু তিনি একাধিক প্রজন্মের কবিতাপ্রেমীদের কাছে হিরোর ঊর্দ্ধে, আইকন। অনেক রসিক আক্ষেপ করেন, এখন আমারও মনে হয়, শক্তি যদি জীবদ্দশায় এতো লোকপ্রিয়তা, এমত খ্যাতি না পেতেন, তবে হয়তো তাঁর কাছ থেকে আরো অনেক শ্রেয়তর সৃষ্টি আমাদের নসিব হতে পারতো। সাহিত্য অকাদেমি পেতে পেতে তিনি ফুরিয়ে গিয়েছিলেন। রাইনের মারিয়া রিলকে তাঁর এলিজি'র গুরু ছিলেন। শক্তি সারাজীবনে অসংখ্য এলিজি লিখেছেন। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠ এলিজি'টি ছিলো তাঁর অকাদেমি পাওয়া বইয়ের নাম কবিতা। নেহাৎ সংযোগ, না নিয়তি নিবিষ্ট উপসংহার।


"সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিত…
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের,
শুধু এই -
কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো
পৃথিবীকে।
মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
শুধু এই -
ঘৃণা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।"

(ক্রমশ)


(সৌজন্য - গুরুচণ্ডালি)

রুণা বন্দ্যোপাধ্যায়


ডি-কোং থেকে দু’এক ছত্র ডি-কো-ডিং





গালগল্প। ল আর প ঝগড়া শৈশব। কে যে কখন কার ঘাড়ে তারই ফন্দিফিকির। তো ফাঁদ এড়িয়ে ফন্দি খুঁজতে গিয়ে উড়োমুখের ডানা ঠেকে গেল কাঠামোর গায়ে। সুডৌল কঙ্কালের গায়ে তখন পরতে পরতে লেগে ছিল মিথ্যে ধুলোর আস্তরণ। তাকে ঝরিয়ে ফেলতে এগিয়ে এল প্রতিষ্ঠানের সাবধানবাণী পকেটে রাখা শূন্যদশকের নতুন প্রজন্ম। হাতে রইল ধারামুক্তির আনকোরা নতুন আর মাথায় রইল সেই নতুনের সম্প্রসারণ পদ্ধতির খোঁজ। জাদুকরের উন্মাদ আঙুল তখন ঝরিয়ে ফেলছে প্রাচীন মিথবিনির্মাণের সিঁড়িতে হরিতাহত বেড়ালের করুণ ক্রন্দন। কান্নারও কিছু নিজস্ব রুটম্যাপ থাকে। আবহমানের মুখোশ সরিয়ে অনন্তর ঘরবাড়িতে জমে উঠল না-নাটক। কান্নাধোয়া চোখে নতুন নির্মাণ। দ্রাঘিমায় রেখে আসে হর্ষচিহ্ন বহনকারী ক্লাউনের ঠিকানা...

জাদুকর আজিজুল ও অন্যান্য

গালগল্প অথচ গোল নয়, সুডৌল নয়, বলতে গেলে নির্দিষ্ট কোনো আকারই নেই। প্রকাশিত  দার্জিলিং এর ডি কোং থেকে। হালকা পলকা কলেবর হলেও নজর কাড়ে। শুরু থেকে শেষ, মায় প্রচ্ছদ পর্যন্ত নিবিড়ে গভীরে গলাগলি। কিছু অনুভব কিছু অনুরণন গল্পের অবয়বে; নতুন কাঠামোয় নতুন উপলব্ধিতে। গল্পসমুদ্র থেকে দুএকটা মুক্তো কুড়িয়ে আসুন না পাঠক, একটু নদীর খোঁজে যাই, যেখানে উপরিতলের স্বচ্ছ শান্ত জলের নিচে কুটিল আবর্ত, আপনাকে টেনে ডুবিয়ে দেবে অতলে; অথচ কোথায় যেন একটা ভেন্টিলেশান রেখে রেখে এগিয়েছেন কবি অরূপরতন ঘোষ, যে পরিসরে নিঃশ্বাস নিলে গন্ধহীন পলাশেরও ঘ্রাণ উঠে আসে।

শুরুর গল্প আমার বৈদেশিক যোগাযোগ। লন্ডন যাওয়ার আগে কোট তৈরি এবং  সীমা, যার সঙ্গে দরদাম ঠিক হয়েছে মেট্রোর নীচে, তার সঙ্গে একই ছাতার তলায় বৃষ্টির মধ্যে - এই দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক ভিন্ন আত্মানুসন্ধান।

পাঠক, আপনি কি প্রচলিত ধারার গল্প আশা করে বইটি হাতে তুলে নিয়েছেন? সাবধান, আশাহত হবেন নিশ্চিৎ। বরং আসুন না, ধারা থেকে একটু বাইরে যাই, ঘুরে আসি বিধারায়। ওই যেখানে সমুদ্র প্রতিটি মুহূর্তে ঢেউ তুলছে, প্রত্যেকটি তরঙ্গ এক অথচ প্রতিটি মননের চৌকাঠে সে অনন্য বিভঙ্গে ভেঙে ভেঙে পড়ে; পা রাখে অন্যপ্রান্তে অন্যদিগন্তে সময়ফেরৎ ভাবনাসমুদ্রে।

দ্বিতীয় গল্পঃ অশোককুমারের একদিন - তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বঃ শিয়র;  অর্থাৎ গল্পের মাথার দিক, যেখানে শুরুতেই জানা যায় অশোককুমারকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে অর্থশালী বাড়িওলা, কারণ ওই অঞ্চলে শপিংমল তৈরি হবে। অরূপরতন কেবল গল্পকার নন, চলচ্চিত্র পরিচালকও বটে, ফলত গল্পের কাঠামোয় কয়েকটিমাত্র শব্দের আঁচড়ে ফুটে ওঠে চলচ্চিত্রের ছোট ছোট ফ্রেম যার ভেতর ভিন্ন ডায়মেনশনে, ভিন্ন ভাষার টোনে অশোককুমারের চরিত্রচিত্রণ ও বাড়িওলার সম্পর্ক তৈরি করেন, যেখানে দেখি লেখকের জুড়ে দেওয়া একটি টিকা-

[উত্তেজক দৃশ্যের অবতারণা ও সেই সংক্রান্ত কূটনৈতিক সমস্ত চাল ভেস্তে দিয়ে এইবার অশোককুমার অবতীর্ণ হবেন; মঞ্চে এইবার... এ যুগের শিব, আমাদের এই অশোককুমার।]

পাঠককে একটি সম্ভাব্য নাটকের ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিয়েই লেখক চ্যালেঞ্জ জানালেন না-নাটকের। কারণ এর পরই দেখি বাসা থেকে গোটা রাস্তা ছাতাহীন বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এলেও অশোককুমার একফোঁটা ভেজেনি - এই একটিমাত্র নাটকীয় আভাস দিয়েই লেখক মঞ্চের আলো নিভিয়ে দিয়েছেন। ঠিক পরের পর্বঃ - এই আঁধার, এই অতিক্রম্য সুখ। যে সুখ অতিক্রম্ করা যায় সেই সুখে নিমজ্জিত অশোককুমারের (এ কে) শেষ পর্যন্ত মৃত্যু হয়, কারণ অজানা। নামের সংক্ষিপ্তকরণে কী যেন প্রশ্ন, কী যেন ধরা-অধরা পাখীর মত, ডানায় একশ-একটা রঙ অথচ একটা রঙও  ভিসিবল রেঞ্জে নেই! শেষ পর্বঃ সমাপ্তি-তে এসে অশোককুমার বেওয়ারিশ লাশ হয়ে ডাক্তারী ছাত্রদের কাজে লাগে।  এখানে এসেই গল্প শেষ হয়ে যেতে পারত। কিন্তু লেখক কবিও বটে! তাই শেষ লাইনে তারই আভাস, “কি গ্রাম ছিলো তা! দূরে পাহাড়। খানদানি সঙ্গীতের রেওয়াজ ছিলো ঘরে ঘরে

প্রচলিত গঠন ও আঙ্গিককে দুমড়ে মুচড়ে এক নতুনের এক্সপেরিমেন্ট, ভাষার নিরীক্ষা। পূর্বরাগের দুরন্ত প্রেম থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের খুঁটিনাটি সহ নটে গাছ মুড়োনো নেই। কোনো গোল গল্পের চালচিত্র নেই। বরং ঘটনা ও চরিত্রের বাহুল্য অগ্রাহ্য করে লেখকের চেতনার তরঙ্গপ্রবাহকে বা চিন্তাসূত্রগুলোকে লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস দেখি লেখক অরূপরতন ঘোষের গল্প সংকলনে।

তৃতীয় গল্প - কাঞ্চনের লোভে। লেখক যখন শংকর লাহিড়ীর মুখার্জীকুসুম বইটির উল্লেখ করেন, অনেক স্মৃতি ভীড় করে আসে। সেই মুখার্জী বাড়ির মেয়েটির সঙ্গে আমি নামক নায়কের প্রেমের গল্প। বহু ব্যবহারে কচকচলিত প্রেমের গল্প আশা করছেন পাঠক? তবে বলি, ঠকবেন। এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণে প্রেম ও জীবন নতুন হয়েছে, রঙে ঢঙে বিভঙ্গে। মেয়েটি কেমন, বলতে গিয়ে খুব অচেতনে লেখকের একটি সিদ্ধান্ত প্রকাশিতঃ - যেসব মেয়েদের রাস্তাঘাটে দেখা যায় তারা ফেউ টাইপের!! আপনি কি পাঠিকা? একটু বুঝি গায়ে লাগল? অগ্রাহ্য করুন। মা-মেরির দিব্যি (মাইরি বলতে গিয়েও সামলাতে হল, লেখক আবার কোনো টাইপের কথা ভাবতে বসবেন!) বলছি কি, ঠকবেন না। আসুন আমরা আর একটু এগিয়ে যাই। মুখার্জী বাড়ির ভেতরটা কেমন ভাবতে ভাবতে এবং একটা মিষ্টি প্রেমের অল্প আদুর গায়ের ছোঁয়া দিয়েই লেখক মুখার্জী বাড়িতে বিসমিল্লা বসিয়ে দিলেন। না-পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে “আমি” এসে দাঁড়ালো হারু ও হারুর বউয়ের সামনে - শুরু হল গল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

নতুন যুগের কবি বা লেখক কথা বলবেন না, কাহিনী বাঁধবেন না অথচ একটি চিত্র তুলে ধরবেন পাঠকের সামনে, যেখানে পাঠক ডানা মেলবে তার নিজস্ব পৃথিবীতে। পরের গল্প- বাইসনঃ একটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। আর শেষে আছে জাদুকর আজিজুল - পড়ুন অনুভব করুন। বইটি শেষ করে মুড়ে রাখতে রাখতে নিশ্চিৎ আপনি নিজের গল্পটি পেয়ে গেছেন; এইখানেই লেখকের গল্প লেখা সার্থক।  

অনন্ত-র ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য

ওই যেখানে রাত্রিময় ঘোড়ার চাবুক আর দিনবিড়ালির নখে খুব জমে ওঠে খেলা সেখানে রচিত হয়েছে শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের “অনন্ত-র ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য” কাব্যসংকলন। এ ঘরবাড়ি রাত্রিদিনময়, টানা, খোলামেলা। সেখানে অনন্ত আর তার বৌ কবিতা, দাবার ছক পাতে। চতুরঙ্গের ছকে বাঁধা হাতি ঘোড়া রাজা আর সাধারণতন্ত্রের পণ, সকলেই হেতুময় জালে বন্দি থেকে যায়; শুধু পড়ে থাকে চাঁদ আর নৌকা আর অধোগতি নারীদের মুখ। অহেতু ঝরিয়ে অনন্ত নৌকোবিহারে দিগন্ত পাড়ি দিতে গেলে টেরিটিবাজার থেকে ছুটে আসে পিছুফেরা সময়, “আমাদের ভুলে গেলে? কথা ছিল যাবো এক সাথে"।

এই ঘর এই বাড়ি থেকেই অনন্তর ভ্রমণ ডিহি সুতানটি গ্রাম গোবিন্দপুর, যেখানে অনন্ত ভুল পথে গিয়ে আলেয়াব্রিজ দেখে,

কলাকাতার নষ্ট চাঁদে পোকা পড়ে, নিয়মফাঙ্গাস লাগে
রাস্তায়।
অনন্ত, ভুল পথে গিয়ে,
দেখেছে আলেয়াব্রিজ, পরচুলা, মাদারির তাঁবু,
                                                তার পাশে
বণিক ও বেবুনেরা একসাথে কাড়াকাড়ি করে
রুটি খায়, মুখ মোছে লালচে রুমালে।
সারারাত,
অনন্ত মাটি খুঁড়ে রাখে মদ, চুক্তিপত্র, গোপন মাদুলি।      

অথবা সদর স্ট্রিটে ঘুম ভাঙে
                বেশ্যা আর বিদেশীর আড়কাঠি-ভিড়ে  [কলকাতা ভ্রমণ]

বাংলা শব্দভান্ডারের সীমায় অতৃপ্ত কবি শব্দজোড়ে হাত রাখেন, নিয়মফাঙ্গাস, আলেয়াব্রিজ, রবার-প্রদীপ, হাঙরপাহারা, লিরিকবিষাদ; রঙিন পালক গুঁজে কবি ডানা মেলেন আকাশে। বাঁধাপথের সমস্ত দরজাগুলো খুলে রাখেন শুধু শব্দজোড় নয়, এখানেও দেখি চলচ্চিত্রের ভাবনা ও ভাষা কথা কয় পঙ্‌ক্তির ভেতর। মেধাজারিত এক অপর কবিতার খোঁজ। যেমন একটি কবিতায় দেখি মশারির ভাঁজ খুলে সেরিব্রামের ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে পড়ছে গোপন সাঁজোয়া। নিস্তব্ধ রাতের স্বপ্নের মধ্যে চাবিহীন দেরাজগুলো পালিশ হয়ে নিলামে চড়ে আর অনন্ত ঘুমের মধ্যে ফিরে পেতে থাকে “হারানো চশমা আর বলপেন”-গুলো। নির্জনতার বিষণ্ণ ঘোর নামে কবির দৃষ্টির প্রান্তসীমায়। বিষাদের সুর ও সুরায় একীভূত হয় দিনযাপনের নিবিড় মূর্ছনা। কোমল ও কড়িতে কোনো মিড় খুঁজে ফেরেন না কবি, তবু আঙুলের গভীরে জেগে থাকে সমাজের নিস্তব্ধ চিত্রগুলি; প্রতিষ্ঠান অগ্রাহ্য করা এক নতুন টেকনিকে নিঃশব্দে ঘটে যায় প্যারাডাইম শিফ্‌ট। কথা আর না-কথায় বেজে ওঠে পাঠকের চেতনায়,

দরজা-টোটেমচিহ্ন! ওপাশে রয়েছে মাতৃসদন, বমি-রক্তমাখা কাঁথা,  আছে পরিত্রাহী সূচ। তারও পেছনে, নেমে আসে প্যারাশুট, দুধের প্যাকেট, বিদেশী গমের গন্ধে আলোড়িত হয় ইহসকালের ঘুম, পরনির্ভরতা। অথবা সমস্ত রাত, উপদ্রুত ট্রাকে ধাতু ও রবার যায় তৃতীয় শিবিরে টোটেম বিশ্বস্ত তুমি ছিঁড়ে ফ্যালো ডানা, যদিও রবারভীতি তোমাকে করেছে ম্লান ও পরাঙ্‌মুখ। রাজভবনের দিক থেকে শোরগোল ওঠে, শোনা যায়, ইঁদুরবিল্পবের দিন বেশিদূরে নয়। অনন্ত, সমস্তদিন, শাটার নামায়। [দরজাবিষয়ক চতুর্দশপদী]

কবির পাতা জুড়ে তিলোত্তমা কলকাতা, মুখ রাখে হ্যালোজেন সভ্যতার ছড়ানো করতলে; যেখানে অনন্ত পায় তার কালো চশমা আর কানঢাকা টুপি। কবির মননে ঘুরেফিরে কল্লোলিনীর উঁকিঝুঁকি, যেখানে দিনকাল আধাসামরিক, ফুটপাথে রবার ও কাচ। ধূসর থেকে ধূসরতর সরণি বেয়ে রঙহীন ক্যানভাসে কবির মাতাল খোঁজ। ঘুরেফিরে ময়দান, চিড়িয়াখানা, মানিকতলা, আহিড়িটোলা এসেছে কিন্তু প্রেম ছুঁয়ে বৃষ্টি নামেনি। দিনান্তে যেমন ক্লান্ত পাখির ডানায় মুখ রাখে বিষণ্ণ আকাশ তেমনি অনন্ত এন্টালি ঘুরে ফিরে আসে নৌ-নাব্যতার কাছাকাছি। কারণ অনন্ত বোঝে, “বৌ-এর সঙ্গে তার এই খুনসুটি/হাসিঠাট্টা/রহস্য/রগড়, আসলে ষাঁড় ও ভল্লুকের পারস্পরিক অবস্থান দ্বারা নিরূপিত”।

না-ভোর বিষাদের এলোমেলো উঠোনে পা রাখেন কবি, তীব্র আবেগের উষ্ণ ছোঁয়ায় তিরতির করে কেঁপে যায় মননের স্তরগুলি। অথচ কাব্যগ্রন্থের কোথাও আবেগাক্রান্ত পঙ্‌ক্তি নেই। এখানেই বুঝি নতুন পথের কবির কবিতাপ্রেম। চলপথের মুহূর্তজাত অভিজ্ঞতার ক্রিয়া বিক্রিয়া নিঃশব্দ জারণ ও বিজারণ ঘটায় কবির চেতনায়; যেখানে কবি ডানাদুটি মেলে ঘুরতে থাকেন চক্রাকারে। স্তর থেকে স্তরে চয়নের অস্থির কম্পন নিয়ে অশান্ত পা রাখেন শব্দের পাশে,

ডাইনির চুল ছিল অনন্ত-র খাতার ভেতরে
ছিল চাঁদ, প্রচন্ড শিমূল
                        আজ, এতদিন পরে
বেরোল তক্ষক হয়ে, জুড়িগাড়ি হয়ে,
নায়েবের জুতো হয়ে, খোজা হয়ে, মুচ্ছুদ্দি হয়ে,
                ডিহি সুতানটি,  গ্রাম গোবিন্দপুরে
বেজায় মোচ্ছব হল, খেলা হল পাশা ও পোকার। [ডাইনির সঙ্গে ভালোবাসা]

একটু ছন্দ কুড়িয়ে দ্বন্দ্ব্ব উড়িয়ে উড়ান নেবেন? আসুন পাঠক খেলাধুলো পড়ি,

বুকের ভেতর লাল জড়ুলে মাছি বসছে তোমার হাতে আলাদিনের রবার-প্রদীপ হাওয়ায় এখন পালকি উড়ছে চাটুজ্জ্যেদের ছেলে যাচ্ছে চাকরিসূত্রে দূরবিদেশে হাওয়ায় এখন পালকি উড়ছে ছায়ার সঙ্গে কুস্তি লড়ছে জোয়ান কাহার আট বেহারা ছেঁড়াখাতায় পরাগরেণু ঝরছে ভীষণ ভোজনগানে ঢাকা পড়ছে হাড়কাঁপানো লিরিকবিষাদ তোমার মাথায় বর্ষাফলক রবীন্দ্রগান রবারজাত খেলার জিনিশ লুটের মালে ভাগবাঁটোরা হচ্ছে যখন শ্যামবাজারে

অনন্ত আজ ভরদুপুরে শুনতে পেল বাগানকাতর যুবতীদের গাভীন-হ্রেষা   [খেলাধুলো]

পাঠক আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন কবিতাটিতে পংক্তিসজ্জা নেই, কোথাও কোনো যতিচিহ্ন নেই। কবি কি পাঠককে স্বাধিনতা দিয়ে গেলেন নিজের মত পড়ুন? হয়তো কেউ খুঁজে পাবেন এক নিবিড় গূঢ় ছন্দ আবার কেউ হয়্তো খুঁজে নেবেন কদ্যরূপের সীমানা। একটু ধরাছোঁয়ার মধ্যে রাখার মানসেই যেন কবি সুকুমার-খ্যাত ছায়ার সঙ্গে কুস্তি লড়ছে এবং হেমন্ত-খ্যাত জোয়ান কাহার আট বেহারা বাক্যবন্ধ দুটো ব্যবহার করেছেন। কবিতায় কবি তাঁর চলনপথের কিছু চিহ্ন ছড়িয়ে যাবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।   

শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থটি শুরু হয়েছে ভূমিকা-য় ব্যক্তিগত আয়নায় ঝুঁকে থাকা প্রেক্ষাপট নিয়ে এবং শেষ হয়েছে উপসংহার-এ এসে,

হাওয়াবদলের কথা মনে হলে, বাস্তবিক,
                                        অনন্ত দ্যাখে
কে যেন সমস্ত ঘর এলোমেলো করে
                                চলে গেছে
...............
অনন্ত বসে আছে একা, তার হাতে
পশমের লাল বল ভীষণ জটিল হয়ে উঠেছে
                                ক্রমশ  [উপসংহার]

কিন্তু উপসংহারে এসেও যেন শেষ হয়নি কবির পথচলা। গোপন আঁতাত নিয়ে সমস্ত বিষাদ একদিন অহেতু ঝরিয়ে সমুদ্রস্নানে যাবে, অপেক্ষায় থাকেন কবি। নিরীক্ষায় দেখে নেন কতটুকু কবিতার প্রেম আর কতটুকু পথ পেরোতে পারে অনন্তর বাঁশি ওই আয়নায় প্রতিফলিত দিগন্তহীনতায়। বেদনার একতারে বাঁধা বাউলাঙ্গ থেকে ঝরে যায় চাঁদ আর রহস্যজটিল হয়ে ওঠে অবয়ব, দিনমানে জড়ুলখচিত কল্পচিত্রগুলি।

দ্রাঘিমাঃ ক্লাউন

মিছিলিম। পাকদন্ডী। ত্রাহিদেশ। ত্রাহিদেশ।
পুলিশ ডুবে গেলে ফের বনেট খুলছে হাইরোড
ওয়েদার উপচে প্রস্তুতিঃ নর্তকী, সিরিঞ্জ...এসব

আর নিয়ন পড়ে আছে নিয়নের মত

শিক্ষানবিশী শরীরের ছোঁয়া।

এখনো গালের ভেতর সেপ্টেম্বর...   [অ]

আবহমানের বাঁধন ছিঁড়ে নতুনের দিগন্তে এক অননুমেয় সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতেছেন কবি নবেন্দু বিকাশ রায়। তাঁর দ্রাঘিমাঃ ক্লাউন কাব্যগ্রন্থটি সেই সংবাদ  বহন করে হাজির হয়েছে পাঠকের দরবারে। এক্কেবারে প্রথমেই হাতে আসছে মিছিলিম, অচেনা শব্দটি নিয়ে পাঠক আপনি খেলতে থাকুন... মিছিল... ছিলিম...  আপনি ভাবতে থাকুন। আমি ততক্ষণ দ্রাঘিমারেখা বরাবর স্বরবর্ণদের আগামী পদক্ষেপের রহস্যময় বর্ণ ও বর্গের সমাবেশ দেখে আসি। যেখানে প্রথম বিস্ময়টি অপেক্ষা করে আছে, কবিতাগুলির নামকরণে। কোনো শব্দ নয়। কোনো বাক্য নয়। শুধু স্বরবর্ণেরা, একক অস্তিত্বে। যেমন কাব্যগ্রন্থটির নামকরণে দ্রাঘিমারেখা নামক সেই অতি পরিচিত কাল্পনিক রেখাটিকে কবি আপনার কল্পজগতের রূপে ও রসে নিমজ্জিত করেছেন; শব্দনির্মিত এক অলীক কাঠামোর অন্তরে বাঁধা পড়েছে কবির অস্থির সৃষ্টিসুখের চেতনাসমূহ।

বোবা জংশন, যেমন তুমিও জড় কর উৎসবের
লাশের ওপর মৃত কমিউন
আর ৎ-র টুকরো
তোমারো গালে শীত লেগে আছে
কেউ কেউ এর অধিক মৃত্যু চেয়েছিল
তারা চাঁদ থেকে নাড়ি কাটার শব্দ টের পায়।    [আ]

পাঠক আপনি কি বাংলা-বাঁচাও কমিটির সদস্য? তাহলে কিন্তু আপনাকে মাঝে মাঝেই ঝাঁকুনি খেতে হবে এই বাংলা কাব্যগ্রন্থে ছড়ানো ছেটানো ইংরিজি শব্দমালায়। কোনো কবিতা যখন আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের সহ বা অসহযোগে নিউরোনের জটিলে, কোষ থেকে কোষান্তরে ছড়িয়ে রাখে গাঢ় অনুভূতির কথামালা, সেখানে পুলিশ ডুবে গেলে ফের বনেট খুলছে হাইরোড/ওয়েদার উপচে প্রস্তুতি পড়তে গিয়ে বিভাষার কথা মনেও পড়ে না। বরং প্রতিদিনের পরিচিত ইংরিজি প্রতীকগুলির দক্ষ প্রতিস্থাপনে জেগে ওঠে কবিতার সূচিমুখ; যেখানে বোধ ও বোধ্যতার নিবিড় অ্যাসোসিয়েশন।

কাব্যগ্রন্থটির আনাচে কানাচে লেগে থাকে কবির চাঁদোয়া প্রেম। কিন্তু তা কখনই চাঁদনী রোমান্টিকতায় জড়সড় নয়, নড়বড়ে নয়। বরং সপাট ও তীক্ষ্ণ শ্লেষে চাঁদ থেকে নাড়ি কাটার শব্দ টের পাওয়া যায়। গুডনাইট থেকে সুইটড্রিম খসে যায়/চাঁদে নামে লোডশেডিংযেখানে চাঁদোয়া বা শামিয়ানার কোনো আনাই চোখে পড়ে না। শুধু চোখের সামনে আদিগন্ত সম্ভাবনার খোলা দরজাগুলো হাট হয়ে যায়। একটার পর একটা দরজা পেরিয়ে আমরা ঢুকে পড়তে থাকি কবির রহস্যময় কবিতাবলয়ে,

বারান্দা লেগে আছে মৌসমের গালে
ডোরাকাটা স্কার্টেদের লঙমার্চ লেগে আছে

ততদূর ঘুমবাহী বাহন
আর নেশাতুর চেনা ছলাৎ
ততোধিক প্রেয়ার হয়ে আছে রেলিয়ার্ড
অকারণ রেনিডেতে
বিল্বমঙ্গল হয়ে আছে কেউ কেউ
তাদেরও নোটেশান লেখা আছে

আপাতত লালে মদ, টোটেম...     [ই]

ই-কার যখন আরো দীর্ঘ হয়ে আসে, অনুভাবিত উচ্চারণে গড়িয়ে যায় ধারামুক্তির নদীতে, যেখানে কোনো পূর্বস্মৃতির লক্ষণ ধরা দেয় না; যেখানে কোনো স্থিতি নেই, কোনো গন্তব্য নেই, শুধু বয়ে চলা আছে সার্বিক অনুভবের খড়কুটো জড়ো করতে করতে,

আরো দীর্ঘ হয়ে আসে রঙরূট
হাওয়া কেটে নেয় উপোসী গাল
এ দ্রাঘিমা ক্লাউনের, আমরা লক্ষ্য করেছি
প্রত্যেকেই চারমিনার খায়
আর আমরাও মদ নিয়ে গোল হয়ে বসে গেছি
কেমন যেন সন্ধ্যে হয়ে যায়
আর গাছেদের হাতে
মারাত্মক সব বন্দুক উঠেছে আজকাল     [ঈ]

আবহমানের চিহ্নগুলো মুছতে মুছতে কবি হাঁটতে থাকেন। পাকদন্ডীর নির্দিষ্ট -কারন্তে কুড়িয়ে নেওয়া কবির প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি জড় হতে থাকে ভাবনার অনির্দ্দিষ্ট সীমানায়। মূর্ত অভিজ্ঞতাগুলির এক বিমূর্ত রূপরেখা তৈরি হতে থাকে,

...গড়নে আসফল্টে
চুপ শিকড়, চুপ অসম্ভব লূ...
জড়িয়ে আছি বুক খোলা গল্পগাছায়
ময়দান শুষে নিচ্ছে বর্নমালায় ঘাম      [উ]

ধনুকের টানটান জ্যা বরাবর যতখানি সম্ভাবনার দিগন্ত, সেই কল্পনার জগতে বসত করে কবির দ্বিতীয় জীবন। আর সেই কাল্পনিক অভিজ্ঞতার এক অপরূপ চিত্রায়ণ উঠে আসে কবিতার শরীরে,

চাঁদ উবে গেলে বেয়নেট উঁচিয়ে আদুর সিপাহী
পরা থেকে অপরা, মাথা নেমে যায়
এক মেঘ মেঘ এ সময়ঃ শিলং ঢুকে যাচ্ছে চাঁদের ভেতর
প্রায় কবিতার মত ধোঁয়ায়
কুচকাওয়াজ অত্যাদি ভীড় করে আসে
এখনো খুব জুলাই নয় অথচ পাখিদের ঘুম
মেয়েদের নরম বুকের ওপরে অনুদৈর্ঘ্য        [ঊ]

কবি তাঁর দ্বিতীয় জীবনে কবি হলেও প্রথম জীবনে তিনি সমাজবদ্ধ মানুষ। তাই তাঁর চেতনে মননে সমাজ সচেতনতা গড়ে ওঠে স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু কখনই তিনি সমাজবিপ্লবের ধ্বজাধারী হয়ে ওঠেন না। কবি শুধু দায়বদ্ধ তাঁর চেতনার কাছে, অনুভবের সৎ প্রতিফলনের কাছে, যা আরো একজনের চেতনায় টঙ্কার তুলবে, যা অনুরণিত হবে চেতনা থেকে চেতনায়। ধূসর হয়ে আসা আমাদের চারপাশের জীবন কবির মননে এক বিষণ্ণ সুর হয়ে বাজে, যে সুরে আমাদেরও নিভৃত সুরগুলো একই সূত্রে বেজে ওঠে,

সিপাহীর রিফিলের ভেতর অনেকখানি চ্যাপ্টা চাঁদ
আর প্রায় একযুগ হতে চললঃ কেউ চিঠি লেখে না
ডোরেমির ভেতর মিডোরা হয়ে আছি    [ঊ]

কিংবা এর ভেতর মনখারাপের গাঢ় মেঘ ছায়া ফেলে যায়, বিষাদের গহন থেকে উঠে আসে কবির গভীর উচ্চারণ,

ডাঙা থেকে কেউ ডাকে না আজকাল
সুতরাং টিউবের সাথে এক গোপন সম্পর্ক গড়ে তুলেছি  [ও]

অনুভূতি আর উপলব্ধির মধ্যে যে দোটানা, বস্তুর রূপ আর গুণের মধ্যে যে আকাশজমিনতা সেইখানে কবি হাত রাখেন, খাদ্যভয় শাণিত কবিতারা হাঁটুর নীচে শুধু নেশা জড় করে চলে। আমরা টেলিফোনিক নীরবতার অভিঘাতটি নিয়ে ক্রিয়া ও বিক্রিয়ায় অভিভূত হই। শব্দনির্মিত কাঠামোর ভেতর কবিভাবনার সেন্টার অফ গ্র্যাভিটির স্পর্শ পেতে থাকি,

তামাকের এই স্বতসিদ্ধ উপনিবেশ এখন খুলে যাচ্ছে প্রতিটি ক্লোরোফিল-বি-হীন-পর্ণ-গ্রাফি-তি। বর্ণহীনতা স্বাভাবিক। আর আঙুলের দারুণ বিভঙ্গে ওফেলিয়ার ফ্লাইং কিস। অসুখ নামছে মিসচিফে।

ওদিকে টেলিফোনে কথা হয়েছিল। এইরূপ...

১-হ্যালো
২-নীরবতা
৩-মারিজুয়ানা       [ঔ]

--------  

যে কবিদের যৌথ খামারে আমার এই ডিকোডিং এর প্রচেষ্টা তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
গল্পগ্রন্থঃ  জাদুকর আজিজুল ও অন্যান্য
প্রচ্ছদঃ   ডি কোং
প্রকাশকঃ  ডি কোং
প্রকাশকালঃ বইমেলা ২০০৯
লেখকঃ অরূপরতন ঘোষ


কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা। অরূপরতন ঘোষের লেখালিখি মূলত ছোটপত্রিকা-নির্ভর। এ-পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ—‘ফেরীঘাট’, ‘মর্ত্য’, ‘লং ড্রাইভ’, ধ্বংসস্তূপ’, ও ‘পূবদেশ থেকে’। লিখেছেন ‘সূর্যহীন’ নামে একটি ব্যতিক্রমী উপন্যাস ও একাধিক ছোটগল্প, যা সংকলিত হয়েছে ‘যাদুকর আজিজুল ও অন্যান্য’ এবং ‘অশোককুমারের একদিন’-নামক দুটি বইতে। চলচ্চিত্র-মাধ্যমের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে, ‘নতুন কবিতা’, ‘ব্রজী’ এবং’ অবসরডাঙা’ পত্রিকার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। 


কাব্যগ্রন্থঃ  অনন্ত-র ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য
প্রচ্ছদঃ   ডি কোং
প্রকাশকঃ  ডি কোং
প্রকাশকালঃ বইমেলা ২০০৯
কবিঃ   শৌভ চট্টোপাধ্যায়


শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের (১৯৮৩) জন্ম ও বেড়ে ওঠা হাওড়ার শিবপুরে। পড়াশোনার সুবাদে কিছুদিন লাখনৌ-তে বসবাস। এবং, বর্তমানে, কর্মসূত্রে দিল্লির বাসিন্দা। প্রায় দেড়-দশক যাবৎ কবিতা লিখছেন। কবিতা প্রকাশিত হয়েছে অনুবর্তন, কৃত্তিবাস, কৌরব, দাহপত্র, নতুন কবিতা, শুধু বিঘে দুই, যাপনচিত্র ইত্যাদি নানান পত্রপত্রিকায়। এ-যাবৎ প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা চার—‘অনন্ত-র ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য’ (২০০৯, ডি কোং), ‘মুনিয়া ও অন্যান্য ব্যূহ’ (২০১৩, নতুন কবিতা), ‘মায়াকানন’ (২০১৬, সৃষ্টিসুখ), এবং ‘নিঃশব্দে অতিক্রম করি’ (২০১৯, শুধু বিঘে দুই)। যুক্ত ছিলেন ‘অবসরডাঙা’ ও ‘ব্রজী’-নামক দুটি পত্রিকার সঙ্গেও। 


কাব্যগ্রন্থঃ  দ্রাঘিমাঃ ক্লাউন
প্রচ্ছদঃ   ডি কোং
প্রকাশকঃ  ডি কোং
প্রকাশকালঃ বইমেলা ২০০৯
কবিঃ   নবেন্দু বিকাশ রায়



জন্ম ১৯৮৬। কবি, গল্পকার নবেন্দু অ্যাশট্রে পত্রিকার তরুণ সম্পাদক।