ডি-কোং থেকে দু’এক ছত্র ডি-কো-ডিং
গালগল্প। ল আর প ঝগড়া আশৈশব। কে যে কখন কার ঘাড়ে তারই ফন্দিফিকির। তো ফাঁদ এড়িয়ে ফন্দি খুঁজতে গিয়ে উড়োমুখের
ডানা ঠেকে গেল কাঠামোর গায়ে। সুডৌল কঙ্কালের গায়ে তখন পরতে পরতে লেগে ছিল মিথ্যে
ধুলোর আস্তরণ। তাকে ঝরিয়ে ফেলতে এগিয়ে এল প্রতিষ্ঠানের সাবধানবাণী পকেটে রাখা
শূন্যদশকের নতুন প্রজন্ম। হাতে রইল ধারামুক্তির আনকোরা নতুন আর মাথায় রইল সেই
নতুনের সম্প্রসারণ পদ্ধতির খোঁজ। জাদুকরের উন্মাদ আঙুল তখন ঝরিয়ে ফেলছে প্রাচীন
মিথ। বিনির্মাণের সিঁড়িতে হরিতাহত বেড়ালের করুণ ক্রন্দন। কান্নারও কিছু নিজস্ব
রুটম্যাপ থাকে। আবহমানের মুখোশ সরিয়ে অনন্তর ঘরবাড়িতে জমে উঠল না-নাটক। কান্নাধোয়া
চোখে নতুন নির্মাণ। দ্রাঘিমায় রেখে আসে হর্ষচিহ্ন বহনকারী ক্লাউনের ঠিকানা...
জাদুকর আজিজুল ও অন্যান্য
গালগল্প অথচ গোল নয়, সুডৌল নয়, বলতে গেলে নির্দিষ্ট কোনো
আকারই নেই। প্রকাশিত দার্জিলিং এর ডি কোং
থেকে। হালকা পলকা কলেবর হলেও নজর কাড়ে। শুরু থেকে শেষ, মায় প্রচ্ছদ পর্যন্ত নিবিড়ে
গভীরে গলাগলি। কিছু অনুভব কিছু অনুরণন গল্পের অবয়বে; নতুন কাঠামোয় নতুন উপলব্ধিতে।
গল্পসমুদ্র থেকে দু’একটা মুক্তো কুড়িয়ে আসুন না পাঠক, একটু নদীর খোঁজে যাই,
যেখানে উপরিতলের স্বচ্ছ শান্ত জলের নিচে কুটিল আবর্ত, আপনাকে টেনে ডুবিয়ে দেবে
অতলে; অথচ কোথায় যেন একটা ভেন্টিলেশান রেখে রেখে এগিয়েছেন কবি অরূপরতন ঘোষ, যে
পরিসরে নিঃশ্বাস নিলে গন্ধহীন পলাশেরও ঘ্রাণ উঠে আসে।
শুরুর গল্প ‘আমার বৈদেশিক যোগাযোগ’। লন্ডন যাওয়ার আগে কোট তৈরি এবং সীমা, যার সঙ্গে দরদাম ঠিক হয়েছে মেট্রোর নীচে, তার সঙ্গে
একই ছাতার তলায় বৃষ্টির মধ্যে - এই দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে এক ভিন্ন
আত্মানুসন্ধান।
পাঠক, আপনি কি প্রচলিত ধারার গল্প আশা করে বইটি হাতে তুলে
নিয়েছেন? সাবধান, আশাহত হবেন নিশ্চিৎ। বরং আসুন না, ধারা থেকে একটু বাইরে যাই,
ঘুরে আসি বিধারায়। ওই যেখানে সমুদ্র প্রতিটি মুহূর্তে ঢেউ তুলছে, প্রত্যেকটি তরঙ্গ
এক অথচ প্রতিটি মননের চৌকাঠে সে অনন্য বিভঙ্গে ভেঙে ভেঙে পড়ে; পা রাখে
অন্যপ্রান্তে অন্যদিগন্তে সময়ফেরৎ ভাবনাসমুদ্রে।
দ্বিতীয় গল্পঃ ‘অশোককুমারের একদিন’ - তিনটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বঃ শিয়র; অর্থাৎ গল্পের মাথার
দিক, যেখানে শুরুতেই জানা যায় অশোককুমারকে বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিয়েছে অর্থশালী বাড়িওলা, কারণ ওই অঞ্চলে শপিংমল তৈরি হবে। অরূপরতন
কেবল গল্পকার নন, চলচ্চিত্র পরিচালকও বটে, ফলত গল্পের কাঠামোয় কয়েকটিমাত্র শব্দের
আঁচড়ে ফুটে ওঠে চলচ্চিত্রের ছোট ছোট ফ্রেম যার ভেতর ভিন্ন ডায়মেনশনে, ভিন্ন ভাষার টোনে
অশোককুমারের চরিত্রচিত্রণ ও বাড়িওলার সম্পর্ক তৈরি করেন, যেখানে দেখি লেখকের জুড়ে
দেওয়া একটি টিকা-
[উত্তেজক দৃশ্যের
অবতারণা ও সেই সংক্রান্ত কূটনৈতিক সমস্ত চাল ভেস্তে দিয়ে এইবার অশোককুমার অবতীর্ণ
হবেন; মঞ্চে এইবার... এ যুগের শিব, আমাদের এই অশোককুমার।]
পাঠককে একটি সম্ভাব্য নাটকের ইঙ্গিত ছুঁড়ে দিয়েই লেখক
চ্যালেঞ্জ জানালেন না-নাটকের। কারণ এর পরই দেখি বাসা থেকে গোটা রাস্তা ছাতাহীন
বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে এলেও অশোককুমার একফোঁটা ভেজেনি - এই একটিমাত্র নাটকীয় আভাস
দিয়েই লেখক মঞ্চের আলো নিভিয়ে দিয়েছেন। ঠিক পরের পর্বঃ - এই আঁধার, এই অতিক্রম্য
সুখ। যে সুখ অতিক্রম্ করা যায় সেই সুখে নিমজ্জিত অশোককুমারের (এ কে) শেষ পর্যন্ত
মৃত্যু হয়, কারণ অজানা। নামের সংক্ষিপ্তকরণে কী যেন প্রশ্ন, কী যেন ধরা-অধরা পাখীর মত, ডানায় একশ-একটা রঙ অথচ একটা রঙও ভিসিবল রেঞ্জে নেই! শেষ
পর্বঃ সমাপ্তি-তে এসে অশোককুমার বেওয়ারিশ লাশ হয়ে ডাক্তারী ছাত্রদের কাজে
লাগে। এখানে এসেই গল্প শেষ হয়ে যেতে পারত।
কিন্তু লেখক কবিও বটে! তাই শেষ লাইনে তারই আভাস, “কি গ্রাম ছিলো তা! দূরে পাহাড়। খানদানি
সঙ্গীতের রেওয়াজ ছিলো ঘরে ঘরে”।
প্রচলিত গঠন ও আঙ্গিককে দুমড়ে মুচড়ে এক নতুনের
এক্সপেরিমেন্ট, ভাষার নিরীক্ষা। পূর্বরাগের দুরন্ত প্রেম থেকে শুরু করে বিভিন্ন
পর্যায়ের খুঁটিনাটি সহ নটে গাছ মুড়োনো নেই। কোনো গোল গল্পের চালচিত্র নেই। বরং
ঘটনা ও চরিত্রের বাহুল্য অগ্রাহ্য করে লেখকের চেতনার তরঙ্গপ্রবাহকে বা
চিন্তাসূত্রগুলোকে লিপিবদ্ধ করার প্রয়াস দেখি লেখক অরূপরতন ঘোষের গল্প সংকলনে।
তৃতীয় গল্প - কাঞ্চনের লোভে। লেখক যখন শংকর লাহিড়ীর
মুখার্জীকুসুম বইটির উল্লেখ করেন, অনেক স্মৃতি ভীড় করে আসে। সেই মুখার্জী বাড়ির
মেয়েটির সঙ্গে আমি নামক নায়কের প্রেমের গল্প। বহু ব্যবহারে কচকচলিত প্রেমের গল্প
আশা করছেন পাঠক? তবে বলি, ঠকবেন। এক ভিন্ন দৃষ্টিকোণে প্রেম ও জীবন নতুন হয়েছে,
রঙে ঢঙে বিভঙ্গে। মেয়েটি কেমন, বলতে গিয়ে খুব অচেতনে লেখকের একটি সিদ্ধান্ত
প্রকাশিতঃ - যেসব মেয়েদের রাস্তাঘাটে দেখা যায় তারা ফেউ টাইপের!! আপনি কি পাঠিকা?
একটু বুঝি গায়ে লাগল? অগ্রাহ্য করুন। মা-মেরির দিব্যি (মাইরি বলতে গিয়েও সামলাতে
হল, লেখক আবার কোনো টাইপের কথা ভাবতে বসবেন!) বলছি কি, ঠকবেন না। আসুন আমরা আর
একটু এগিয়ে যাই। মুখার্জী বাড়ির ভেতরটা কেমন ভাবতে ভাবতে এবং একটা মিষ্টি প্রেমের
অল্প আদুর গায়ের ছোঁয়া দিয়েই লেখক মুখার্জী বাড়িতে বিসমিল্লা বসিয়ে দিলেন।
না-পাওয়ার যন্ত্রণা নিয়ে “আমি” এসে দাঁড়ালো হারু ও হারুর বউয়ের সামনে - শুরু হল
গল্পের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
নতুন যুগের কবি বা লেখক কথা বলবেন না, কাহিনী বাঁধবেন না
অথচ একটি চিত্র তুলে ধরবেন পাঠকের সামনে, যেখানে পাঠক ডানা মেলবে তার নিজস্ব পৃথিবীতে।
পরের গল্প- বাইসনঃ একটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। আর শেষে আছে জাদুকর আজিজুল - পড়ুন অনুভব
করুন। বইটি শেষ করে মুড়ে রাখতে রাখতে নিশ্চিৎ আপনি নিজের গল্পটি পেয়ে গেছেন;
এইখানেই লেখকের গল্প লেখা সার্থক।
অনন্ত-র ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য
ওই যেখানে রাত্রিময় ঘোড়ার চাবুক আর
দিনবিড়ালির নখে খুব জমে ওঠে খেলা সেখানে রচিত হয়েছে শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের “অনন্ত-র
ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য” কাব্যসংকলন। এ ঘরবাড়ি রাত্রিদিনময়, টানা, খোলামেলা।
সেখানে অনন্ত আর তার বৌ কবিতা, দাবার ছক পাতে। চতুরঙ্গের ছকে বাঁধা হাতি ঘোড়া রাজা
আর সাধারণতন্ত্রের পণ, সকলেই হেতুময় জালে বন্দি থেকে যায়; শুধু পড়ে থাকে চাঁদ আর
নৌকা আর অধোগতি নারীদের মুখ। অহেতু ঝরিয়ে অনন্ত নৌকোবিহারে দিগন্ত পাড়ি দিতে গেলে
টেরিটিবাজার থেকে ছুটে আসে পিছুফেরা সময়, “আমাদের ভুলে গেলে? কথা ছিল যাবো এক
সাথে"।
এই ঘর এই বাড়ি থেকেই অনন্তর ভ্রমণ ডিহি
সুতানটি গ্রাম গোবিন্দপুর, যেখানে অনন্ত ভুল পথে গিয়ে আলেয়াব্রিজ দেখে,
কলাকাতার নষ্ট চাঁদে পোকা পড়ে, নিয়মফাঙ্গাস
লাগে
রাস্তায়।
অনন্ত, ভুল পথে গিয়ে,
দেখেছে আলেয়াব্রিজ, পরচুলা, মাদারির তাঁবু,
তার
পাশে
বণিক ও বেবুনেরা একসাথে কাড়াকাড়ি ক’রে
রুটি খায়, মুখ মোছে লালচে রুমালে।
সারারাত,
অনন্ত মাটি খুঁড়ে রাখে মদ, চুক্তিপত্র, গোপন
মাদুলি।
অথবা সদর স্ট্রিটে
ঘুম ভাঙে
বেশ্যা আর বিদেশীর
আড়কাঠি-ভিড়ে [কলকাতা ভ্রমণ]
বাংলা শব্দভান্ডারের সীমায় অতৃপ্ত কবি
শব্দজোড়ে হাত রাখেন, নিয়মফাঙ্গাস, আলেয়াব্রিজ, রবার-প্রদীপ, হাঙরপাহারা,
লিরিকবিষাদ; রঙিন পালক গুঁজে কবি ডানা মেলেন আকাশে। বাঁধাপথের সমস্ত দরজাগুলো খুলে
রাখেন। শুধু শব্দজোড় নয়, এখানেও দেখি চলচ্চিত্রের ভাবনা ও ভাষা কথা কয় পঙ্ক্তির
ভেতর। মেধাজারিত এক অপর কবিতার খোঁজ। যেমন একটি কবিতায় দেখি মশারির ভাঁজ খুলে সেরিব্রামের
ভাঁজে ভাঁজে ঢুকে পড়ছে গোপন সাঁজোয়া। নিস্তব্ধ রাতের স্বপ্নের মধ্যে চাবিহীন
দেরাজগুলো পালিশ হয়ে নিলামে চড়ে আর অনন্ত ঘুমের মধ্যে ফিরে পেতে থাকে “হারানো চশমা
আর বলপেন”-গুলো। নির্জনতার বিষণ্ণ ঘোর নামে কবির দৃষ্টির প্রান্তসীমায়। বিষাদের
সুর ও সুরায় একীভূত হয় দিনযাপনের নিবিড় মূর্ছনা। কোমল ও কড়িতে কোনো মিড় খুঁজে
ফেরেন না কবি, তবু আঙুলের গভীরে জেগে থাকে সমাজের নিস্তব্ধ চিত্রগুলি; প্রতিষ্ঠান
অগ্রাহ্য করা এক নতুন টেকনিকে নিঃশব্দে ঘটে যায় প্যারাডাইম শিফ্ট। কথা আর না-কথায়
বেজে ওঠে পাঠকের চেতনায়,
দরজা-টোটেমচিহ্ন! ওপাশে
রয়েছে মাতৃসদন, বমি-রক্তমাখা কাঁথা, আছে
পরিত্রাহী সূচ। তারও পেছনে, নেমে আসে প্যারাশুট, দুধের প্যাকেট, বিদেশী গমের গন্ধে
আলোড়িত হয় ইহসকালের ঘুম, পরনির্ভরতা। অথবা সমস্ত রাত, উপদ্রুত ট্রাকে ধাতু ও রবার
যায় তৃতীয় শিবিরে – টোটেম বিশ্বস্ত তুমি – ছিঁড়ে ফ্যালো ডানা,
যদিও রবারভীতি তোমাকে করেছে ম্লান ও পরাঙ্মুখ। রাজভবনের দিক থেকে শোরগোল ওঠে,
শোনা যায়, ইঁদুরবিল্পবের দিন বেশিদূরে নয়। অনন্ত, সমস্তদিন, শাটার নামায়। [দরজাবিষয়ক
চতুর্দশপদী]
কবির পাতা জুড়ে তিলোত্তমা কলকাতা, মুখ রাখে
হ্যালোজেন সভ্যতার ছড়ানো করতলে; যেখানে অনন্ত পায় তার কালো চশমা আর কানঢাকা টুপি।
কবির মননে ঘুরেফিরে কল্লোলিনীর উঁকিঝুঁকি, যেখানে দিনকাল আধাসামরিক, ফুটপাথে রবার
ও কাচ। ধূসর থেকে ধূসরতর সরণি বেয়ে রঙহীন ক্যানভাসে কবির মাতাল খোঁজ। ঘুরেফিরে
ময়দান, চিড়িয়াখানা, মানিকতলা, আহিড়িটোলা এসেছে কিন্তু প্রেম ছুঁয়ে বৃষ্টি নামেনি।
দিনান্তে যেমন ক্লান্ত পাখির ডানায় মুখ রাখে বিষণ্ণ আকাশ তেমনি অনন্ত এন্টালি ঘুরে
ফিরে আসে নৌ-নাব্যতার কাছাকাছি। কারণ অনন্ত বোঝে, “বৌ-এর সঙ্গে তার এই
খুনসুটি/হাসিঠাট্টা/রহস্য/রগড়, আসলে ষাঁড় ও ভল্লুকের পারস্পরিক অবস্থান দ্বারা
নিরূপিত”।
না-ভোর বিষাদের এলোমেলো উঠোনে পা রাখেন কবি,
তীব্র আবেগের উষ্ণ ছোঁয়ায় তিরতির করে কেঁপে যায় মননের স্তরগুলি। অথচ কাব্যগ্রন্থের
কোথাও আবেগাক্রান্ত পঙ্ক্তি নেই। এখানেই বুঝি নতুন পথের কবির কবিতাপ্রেম। চলপথের
মুহূর্তজাত অভিজ্ঞতার ক্রিয়া বিক্রিয়া নিঃশব্দ জারণ ও বিজারণ ঘটায় কবির চেতনায়;
যেখানে কবি ডানাদুটি মেলে ঘুরতে থাকেন চক্রাকারে। স্তর থেকে স্তরে চয়নের অস্থির
কম্পন নিয়ে অশান্ত পা রাখেন শব্দের পাশে,
ডাইনির চুল ছিল অনন্ত-র খাতার ভেতরে
ছিল চাঁদ, প্রচন্ড শিমূল
আজ,
এতদিন পরে
বেরোল তক্ষক হয়ে, জুড়িগাড়ি হয়ে,
নায়েবের জুতো হয়ে, খোজা হয়ে, মুচ্ছুদ্দি
হয়ে,
ডিহি
সুতানটি, গ্রাম গোবিন্দপুরে
বেজায় মোচ্ছব হল, খেলা হল পাশা ও পোকার। [ডাইনির সঙ্গে ভালোবাসা]
একটু ছন্দ কুড়িয়ে দ্বন্দ্ব্ব উড়িয়ে উড়ান
নেবেন? আসুন পাঠক ‘খেলাধুলো’ পড়ি,
বুকের ভেতর লাল জড়ুলে
মাছি বসছে তোমার হাতে আলাদিনের রবার-প্রদীপ হাওয়ায় এখন পালকি উড়ছে চাটুজ্জ্যেদের
ছেলে যাচ্ছে চাকরিসূত্রে দূরবিদেশে হাওয়ায় এখন পালকি উড়ছে ছায়ার সঙ্গে কুস্তি লড়ছে
জোয়ান কাহার আট বেহারা ছেঁড়াখাতায় পরাগরেণু ঝরছে ভীষণ ভোজনগানে ঢাকা পড়ছে
হাড়কাঁপানো লিরিকবিষাদ তোমার মাথায় বর্ষাফলক রবীন্দ্রগান রবারজাত খেলার জিনিশ
লুটের মালে ভাগবাঁটোরা হচ্ছে যখন শ্যামবাজারে
অনন্ত আজ ভরদুপুরে শুনতে
পেল বাগানকাতর যুবতীদের গাভীন-হ্রেষা [খেলাধুলো]
পাঠক আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন কবিতাটিতে
পংক্তিসজ্জা নেই, কোথাও কোনো যতিচিহ্ন নেই। কবি কি পাঠককে স্বাধিনতা দিয়ে গেলেন
নিজের মত পড়ুন? হয়তো কেউ খুঁজে পাবেন এক নিবিড় গূঢ় ছন্দ আবার কেউ হয়্তো খুঁজে
নেবেন ‘কদ্য’রূপের সীমানা। একটু ধরাছোঁয়ার মধ্যে রাখার মানসেই যেন কবি সুকুমার-খ্যাত “ছায়ার সঙ্গে
কুস্তি লড়ছে” এবং হেমন্ত-খ্যাত “জোয়ান কাহার আট বেহারা” বাক্যবন্ধ দুটো
ব্যবহার করেছেন। কবিতায় কবি তাঁর চলনপথের কিছু চিহ্ন ছড়িয়ে যাবেন, সেটাই তো স্বাভাবিক।
শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থটি শুরু
হয়েছে ‘ভূমিকা’-য় ব্যক্তিগত আয়নায় ঝুঁকে থাকা প্রেক্ষাপট নিয়ে এবং শেষ হয়েছে ‘উপসংহার’-এ এসে,
হাওয়াবদলের কথা মনে হলে, বাস্তবিক,
অনন্ত
দ্যাখে
কে যেন সমস্ত ঘর এলোমেলো করে
চলে
গেছে
...............
অনন্ত বসে আছে একা, তার হাতে
পশমের লাল বল ভীষণ জটিল হয়ে উঠেছে
ক্রমশ [উপসংহার]
কিন্তু উপসংহারে এসেও যেন শেষ হয়নি কবির
পথচলা। গোপন আঁতাত নিয়ে সমস্ত বিষাদ একদিন অহেতু ঝরিয়ে সমুদ্রস্নানে যাবে,
অপেক্ষায় থাকেন কবি। নিরীক্ষায় দেখে নেন কতটুকু কবিতার প্রেম আর কতটুকু পথ পেরোতে
পারে অনন্তর বাঁশি ওই আয়নায় প্রতিফলিত দিগন্তহীনতায়। বেদনার একতারে বাঁধা বাউলাঙ্গ
থেকে ঝরে যায় চাঁদ আর রহস্যজটিল হয়ে ওঠে অবয়ব, দিনমানে জড়ুলখচিত কল্পচিত্রগুলি।
দ্রাঘিমাঃ ক্লাউন
মিছিলিম। পাকদন্ডী। ত্রাহিদেশ। ত্রাহিদেশ।
পুলিশ ডুবে গেলে ফের বনেট খুলছে হাইরোড
ওয়েদার উপচে প্রস্তুতিঃ নর্তকী, সিরিঞ্জ...এসব
আর নিয়ন পড়ে আছে নিয়নের মত
শিক্ষানবিশী শরীরের ছোঁয়া।
এখনো গালের ভেতর সেপ্টেম্বর... [অ]
আবহমানের বাঁধন ছিঁড়ে নতুনের দিগন্তে এক
অননুমেয় সৃষ্টিসুখের উল্লাসে মেতেছেন কবি নবেন্দু বিকাশ রায়। তাঁর ‘দ্রাঘিমাঃ
ক্লাউন’ কাব্যগ্রন্থটি সেই সংবাদ বহন করে হাজির হয়েছে পাঠকের দরবারে। এক্কেবারে প্রথমেই হাতে
আসছে ‘মিছিলিম’, অচেনা শব্দটি নিয়ে পাঠক আপনি খেলতে থাকুন... মিছিল...
ছিলিম... আপনি ভাবতে
থাকুন। আমি ততক্ষণ দ্রাঘিমারেখা বরাবর স্বরবর্ণদের আগামী পদক্ষেপের রহস্যময় বর্ণ ও
বর্গের সমাবেশ দেখে আসি। যেখানে প্রথম বিস্ময়টি অপেক্ষা করে আছে, কবিতাগুলির
নামকরণে। কোনো শব্দ নয়। কোনো বাক্য নয়। শুধু স্বরবর্ণেরা, একক অস্তিত্বে। যেমন
কাব্যগ্রন্থটির নামকরণে দ্রাঘিমারেখা নামক সেই অতি পরিচিত কাল্পনিক রেখাটিকে কবি
আপনার কল্পজগতের রূপে ও রসে নিমজ্জিত করেছেন; শব্দনির্মিত এক অলীক কাঠামোর অন্তরে
বাঁধা পড়েছে কবির অস্থির সৃষ্টিসুখের চেতনাসমূহ।
বোবা জংশন, যেমন তুমিও জড় কর উৎসবের
লাশের ওপর মৃত কমিউন
আর ৎ-র টুকরো
তোমারো গালে শীত লেগে আছে
কেউ কেউ এর অধিক মৃত্যু চেয়েছিল
তারা চাঁদ থেকে নাড়ি কাটার শব্দ টের
পায়। [আ]
পাঠক আপনি কি বাংলা-বাঁচাও কমিটির সদস্য?
তাহলে কিন্তু আপনাকে মাঝে মাঝেই ঝাঁকুনি খেতে হবে এই বাংলা কাব্যগ্রন্থে ছড়ানো
ছেটানো ইংরিজি শব্দমালায়। কোনো কবিতা যখন আমাদের পঞ্চেন্দ্রিয়ের সহ বা অসহযোগে
নিউরোনের জটিলে, কোষ থেকে কোষান্তরে ছড়িয়ে রাখে গাঢ় অনুভূতির কথামালা, সেখানে “পুলিশ ডুবে গেলে
ফের বনেট খুলছে হাইরোড/ওয়েদার উপচে প্রস্তুতি” পড়তে গিয়ে বিভাষার কথা
মনেও পড়ে না। বরং প্রতিদিনের পরিচিত ইংরিজি প্রতীকগুলির দক্ষ প্রতিস্থাপনে জেগে
ওঠে কবিতার সূচিমুখ; যেখানে বোধ ও বোধ্যতার নিবিড় অ্যাসোসিয়েশন।
কাব্যগ্রন্থটির আনাচে কানাচে লেগে থাকে কবির
চাঁদোয়া প্রেম। কিন্তু তা কখনই চাঁদনী রোমান্টিকতায় জড়সড় নয়, নড়বড়ে নয়। বরং সপাট ও
তীক্ষ্ণ শ্লেষে “চাঁদ থেকে নাড়ি কাটার শব্দ” টের পাওয়া যায়। “গুডনাইট থেকে
সুইটড্রিম খসে যায়/চাঁদে নামে লোডশেডিং”। যেখানে চাঁদোয়া বা শামিয়ানার কোনো আনাই চোখে
পড়ে না। শুধু চোখের সামনে আদিগন্ত সম্ভাবনার খোলা দরজাগুলো হাট হয়ে যায়। একটার পর
একটা দরজা পেরিয়ে আমরা ঢুকে পড়তে থাকি কবির রহস্যময় কবিতাবলয়ে,
বারান্দা লেগে আছে মৌসমের গালে
ডোরাকাটা স্কার্টেদের লঙমার্চ লেগে আছে
ততদূর ঘুমবাহী বাহন
আর নেশাতুর চেনা ছলাৎ
ততোধিক প্রেয়ার হয়ে আছে রেলিয়ার্ড
অকারণ রেনিডেতে
বিল্বমঙ্গল হয়ে আছে কেউ কেউ
তাদেরও নোটেশান লেখা আছে
আপাতত লালে মদ, টোটেম... [ই]
ই-কার যখন আরো দীর্ঘ হয়ে আসে, অনুভাবিত
উচ্চারণে ‘ঈ’ গড়িয়ে যায় ধারামুক্তির নদীতে, যেখানে কোনো পূর্বস্মৃতির লক্ষণ ধরা দেয় না;
যেখানে কোনো স্থিতি নেই, কোনো গন্তব্য নেই, শুধু বয়ে চলা আছে সার্বিক অনুভবের
খড়কুটো জড়ো করতে করতে,
আরো দীর্ঘ হয়ে আসে রঙরূট
হাওয়া কেটে নেয় উপোসী গাল
এ দ্রাঘিমা ক্লাউনের, আমরা লক্ষ্য করেছি
প্রত্যেকেই চারমিনার খায়
আর আমরাও মদ নিয়ে গোল হয়ে বসে গেছি
কেমন যেন সন্ধ্যে হয়ে যায়
আর গাছেদের হাতে
মারাত্মক সব বন্দুক উঠেছে আজকাল [ঈ]
আবহমানের চিহ্নগুলো মুছতে মুছতে কবি হাঁটতে
থাকেন। পাকদন্ডীর নির্দিষ্ট ‘উ’-কারন্তে কুড়িয়ে নেওয়া কবির প্রথম জীবনের অভিজ্ঞতাগুলি জড়
হতে থাকে ভাবনার অনির্দ্দিষ্ট সীমানায়। মূর্ত অভিজ্ঞতাগুলির এক বিমূর্ত রূপরেখা তৈরি
হতে থাকে,
...গড়নে আসফল্টে
চুপ শিকড়, চুপ অসম্ভব লূ...
জড়িয়ে আছি বুক খোলা গল্পগাছায়
ময়দান শুষে নিচ্ছে বর্নমালায় ঘাম [উ]
ধনুকের টানটান জ্যা বরাবর যতখানি সম্ভাবনার
দিগন্ত, সেই কল্পনার জগতে বসত করে কবির দ্বিতীয় জীবন। আর সেই কাল্পনিক অভিজ্ঞতার
এক অপরূপ চিত্রায়ণ উঠে আসে কবিতার শরীরে,
চাঁদ উবে গেলে বেয়নেট উঁচিয়ে আদুর সিপাহী
পরা থেকে অপরা, মাথা নেমে যায়
এক মেঘ – মেঘ – এ সময়ঃ শিলং ঢুকে যাচ্ছে চাঁদের
ভেতর
প্রায় কবিতার মত ধোঁয়ায়
কুচকাওয়াজ অত্যাদি ভীড় করে আসে
এখনো খুব জুলাই নয় অথচ পাখিদের ঘুম
মেয়েদের নরম বুকের ওপরে অনুদৈর্ঘ্য [ঊ]
কবি তাঁর দ্বিতীয় জীবনে কবি হলেও প্রথম
জীবনে তিনি সমাজবদ্ধ মানুষ। তাই তাঁর চেতনে মননে সমাজ সচেতনতা গড়ে ওঠে
স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু কখনই তিনি সমাজবিপ্লবের ধ্বজাধারী হয়ে ওঠেন না। কবি শুধু
দায়বদ্ধ তাঁর চেতনার কাছে, অনুভবের সৎ প্রতিফলনের কাছে, যা আরো একজনের চেতনায়
টঙ্কার তুলবে, যা অনুরণিত হবে চেতনা থেকে চেতনায়। ধূসর হয়ে আসা আমাদের চারপাশের
জীবন কবির মননে এক বিষণ্ণ সুর হয়ে বাজে, যে সুরে আমাদেরও নিভৃত সুরগুলো একই সূত্রে
বেজে ওঠে,
সিপাহীর রিফিলের ভেতর অনেকখানি চ্যাপ্টা চাঁদ
আর প্রায় একযুগ হতে চললঃ কেউ চিঠি লেখে না
ডোরেমির ভেতর মিডোরা হয়ে আছি [ঊ]
কিংবা ‘ও’ এর ভেতর
মনখারাপের গাঢ় মেঘ ছায়া ফেলে যায়, বিষাদের গহন থেকে উঠে আসে কবির গভীর উচ্চারণ,
ডাঙা থেকে কেউ ডাকে না আজকাল
সুতরাং টিউবের সাথে এক গোপন সম্পর্ক গড়ে
তুলেছি [ও]
অনুভূতি আর উপলব্ধির মধ্যে যে দোটানা,
বস্তুর রূপ আর গুণের মধ্যে যে আকাশজমিনতা সেইখানে কবি হাত রাখেন, খাদ্যভয় শাণিত
কবিতারা হাঁটুর নীচে শুধু নেশা জড় করে চলে। আমরা টেলিফোনিক নীরবতার অভিঘাতটি নিয়ে
ক্রিয়া ও বিক্রিয়ায় অভিভূত হই। শব্দনির্মিত কাঠামোর ভেতর কবিভাবনার সেন্টার অফ
গ্র্যাভিটির স্পর্শ পেতে থাকি,
তামাকের এই স্বতসিদ্ধ উপনিবেশ এখন খুলে যাচ্ছে
প্রতিটি ক্লোরোফিল-বি-হীন-পর্ণ-গ্রাফি-তি। বর্ণহীনতা স্বাভাবিক। আর আঙুলের দারুণ
বিভঙ্গে ওফেলিয়ার ফ্লাইং কিস। অসুখ নামছে মিসচিফে।
ওদিকে টেলিফোনে কথা হয়েছিল। এইরূপ...
১-হ্যালো
২-নীরবতা
৩-মারিজুয়ানা [ঔ]
--------
যে কবিদের যৌথ খামারে আমার এই ডিকোডিং এর প্রচেষ্টা তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
গল্পগ্রন্থঃ জাদুকর
আজিজুল ও অন্যান্য
প্রচ্ছদঃ
ডি কোং
প্রকাশকঃ
ডি কোং
প্রকাশকালঃ বইমেলা ২০০৯
লেখকঃ অরূপরতন ঘোষ
কবি, গল্পকার,
ঔপন্যাসিক, চলচ্চিত্র পরিচালক ও অভিনেতা। অরূপরতন ঘোষের লেখালিখি মূলত
ছোটপত্রিকা-নির্ভর। এ-পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা পাঁচ—‘ফেরীঘাট’,
‘মর্ত্য’, ‘লং ড্রাইভ’, ধ্বংসস্তূপ’, ও ‘পূবদেশ থেকে’। লিখেছেন ‘সূর্যহীন’ নামে
একটি ব্যতিক্রমী উপন্যাস ও একাধিক ছোটগল্প, যা সংকলিত হয়েছে ‘যাদুকর আজিজুল ও
অন্যান্য’ এবং ‘অশোককুমারের একদিন’-নামক দুটি বইতে। চলচ্চিত্র-মাধ্যমের প্রতি তাঁর
বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে, ‘নতুন কবিতা’, ‘ব্রজী’ এবং’ অবসরডাঙা’ পত্রিকার
সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
কাব্যগ্রন্থঃ অনন্ত-র ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য
প্রচ্ছদঃ
ডি কোং
প্রকাশকঃ
ডি কোং
প্রকাশকালঃ বইমেলা ২০০৯
কবিঃ শৌভ
চট্টোপাধ্যায়
শৌভ
চট্টোপাধ্যায়ের (১৯৮৩) জন্ম ও বেড়ে ওঠা হাওড়ার শিবপুরে। পড়াশোনার সুবাদে কিছুদিন
লাখনৌ-তে বসবাস। এবং, বর্তমানে, কর্মসূত্রে দিল্লির বাসিন্দা। প্রায় দেড়-দশক যাবৎ
কবিতা লিখছেন। কবিতা প্রকাশিত হয়েছে অনুবর্তন, কৃত্তিবাস, কৌরব, দাহপত্র, নতুন
কবিতা, শুধু বিঘে দুই, যাপনচিত্র ইত্যাদি নানান পত্রপত্রিকায়। এ-যাবৎ প্রকাশিত
বইয়ের সংখ্যা চার—‘অনন্ত-র ঘরবাড়ি, হাতিঘোড়া ও অন্যান্য’ (২০০৯, ডি কোং), ‘মুনিয়া
ও অন্যান্য ব্যূহ’ (২০১৩, নতুন কবিতা), ‘মায়াকানন’ (২০১৬, সৃষ্টিসুখ), এবং
‘নিঃশব্দে অতিক্রম করি’ (২০১৯, শুধু বিঘে দুই)। যুক্ত ছিলেন ‘অবসরডাঙা’ ও
‘ব্রজী’-নামক দুটি পত্রিকার সঙ্গেও।
কাব্যগ্রন্থঃ
দ্রাঘিমাঃ ক্লাউন
প্রচ্ছদঃ
ডি কোং
প্রকাশকঃ
ডি কোং
প্রকাশকালঃ বইমেলা ২০০৯
জন্ম ১৯৮৬। কবি, গল্পকার নবেন্দু ‘অ্যাশট্রে’ পত্রিকার তরুণ সম্পাদক।