ধারাবাহিক উপন্যাস
লাল-নীল-পেন্সিল
(১)
পশ্চিমকোণের
জানালার পাশে লোহার স্ট্যাণ্ডে রাখা এ্যাকোয়ারিয়াম থেকে মৃদু শব্দ ছাড়া আপাতত ঘরে
আর শব্দ নেই। মাছেরা প্রায় অতি অশ্রুত আওয়াছে ঘোরাফেরা করছে। বুড়বুড়ি তুলছে উবু
হয়ে বসে-থাকা প্লাস্টার অব প্যারিসের বুড়ো ডুবুরি – মুখে লাগানো প্লাস্টিকের নল
জলের উপরিতলে উঠে এসেছে। বাতাস থেকে নেওয়া অক্সিজেন জলে সরবরাহ হচ্ছে।
এ্যাকোয়ারিয়ামের সাইজ যথেষ্ট বড়ো, আকারে আয়তক্ষেত্র। জলতলে বালির স্তর, ওপরে সাদা
সাদা নুড়ি ইতঃস্তত। কয়েকটা জলঝাঁঝি পুঁতে দেওয়া আছে।
মাছেরা নীচে এসে মর্জিমতো ঘাই মেরে যায়, সূক্ষ্ম দাঁতে ছিঁড়ে খায় অনেক সময়ে। এ্যাকোয়ারিয়াম রাখা এবং
আরো বিশদে বললে যত্নে রাখা পরিশ্রমসাধ্য শুধু নয়, দক্ষতার ব্যাপারও বটে। অনেক
প্রজাতির মাছ একই সঙ্গে অন্য যে কোনো প্রাণীর মতো তাদের পছন্দ-অপছন্দ, খাদ্যাভ্যাস, অসুখ-বিসুখেও কিছু না কিছু
তফাৎ আছে। লিপিকা আজ রান্না শর্টকাট করে মাছের বাক্স নিয়ে পড়েছে। অবশ্য এটা তার
রুটিন কাজ – কমবেশি দু’সপ্তাহ
পরপর সকাল থেকে মাছেদের পরিচর্যা।
প্রথমে ছাঁকনিতে তুলে নিয়ে মাছেদের বালতির পরিষ্কার জলে ছেড়ে দেয়। এ্যাকোয়ারিয়ামের
প্রায় পুরো জল ফেলে দিয়েছে। আলাদা করে গামলায় জল নিয়ে জীবাণুনাশক দিয়ে বালি-পাথর ধুয়েছে।
ডুবুরির গায়ের পাতলা শ্যাওলা ঘষে তুলে জলঝাঁঝির পচা পাতা ফেলে দিয়েছে। আবার নতুন
জল ছেড়েছে কাচের বাক্সে, সাজিয়ে রেখেছে তুলে রাখা জিনিস। ফোঁটা ফোঁটা তরল নীল জীবাণুনাশক ঢেলেছে জলে। খুব ধীরে বৃত্ত তৈরি করে জলের সঙ্গে মিশতেই আবছা নীলাভ হয়ে
উঠছে জল। ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন জলাধার সামুদ্রিক চেহারা পেয়েছে। মাছেরা বোধহয় স্বস্তির
নিঃশ্বাস ফেলেছে। লিপিকা জলে দু’চিমটি গুঁড়োখাবার ছড়িয়েছে। বাক্সের সুদৃশ্য ঢাকনার ধারে আটকে রেখেছে সরু ছেঁদার ফানেল – সেখানে চুলের
মতো সরু কেঁচোগুলো হিলহিল করে মাথা বের করছে। মাছেরা খিদে পেলে টেনে বের করে খেয়ে
নেবে। জলজ্যান্ত খাদ্যখাদক সম্পর্কের উদাহরণ। মাছেরা এখন ভরপেট বলে কেঁচোদের কাছাকাছি গিয়ে ফিরে আসছে, খাচ্ছে না।
চকচকে
ধূসরে হাল্কা কালো ডোরাকাটা চারটে এঞ্জেল একধারে কাছাকাছি নিঃস্পন্দ ভেসে থাকে –
এদের বেশ পোশাকী রাজকীয়তা আছে। ছটফটে মলিরা চঞ্চল বাচ্চাদের মতো উঠছে, নামছে।
ডুবুরির গা ঘেঁষে, জলজ উদ্ভিদের ডগা ছুঁয়ে ঘোরাফেরা করছে। নিয়ন কমলারঙের গোল
গোল্ডফিশ মন্থরভাবে ওপর নীচ করছে। বিস্তৃত ডিজাইনার লেজের প্রদর্শনীতে ব্যস্ত। এ্যাকোয়ারিয়ামের
সবচেয়ে বৃদ্ধ ও পুরনো বাসিন্দা বিশালকায় সলমন মোটামুটি হাতদেড়েক লম্বা। এগারো বছর
আগে ছোট্ট দুটো শার্ক এনেছিল শোভন, নাম দিয়েছিল সলমন আর নেফারতিতি। তখন এই
এ্যাকোরিয়াম শোভনের তীব্র নেশা। নেফারতিতি মাসছয় বেঁচেছিল, তারপর থেকে সলমন একাই। আর একজনকে অবশ্য এনেছিল মাঝখানে, সলমনের সঙ্গে পটল না।
ইনফেকশন হয়ে মরে গেল।
লিপিকা
ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল। ঘাড়ের ওপরে ঝুলে-থাকা চুলগুলোকে ক্লাচার দিয়ে তুলে আটকাল।
ঘড়িতে আড়াইটে, তার দুপুরের খাওয়া হয়নি এখনো।
জানালা দিয়ে গরম রোদ আসছে। এ্যাকোয়ারিয়ামে সোজাসুজি বেশি রোদ লাগা ভালো নয়, সবুজ
সবুজ এ্যালগী জন্মায়। ঘোলাটে জলে মাছ আর দেখা
যায় না। ঠাণ্ডা বেশী হলে মাছেদের চামড়ায় একধরনের ইনফেকশন হয়। এ্যাকোয়ারিয়ামের মাছ বড্ড সুখী প্রাণী। মাছপোষার মধ্যে নান্দনিকতা আছে, দামী শখ। বেড়ালছানার মতো গায়ে
চটকানো আদর নেই। একটুক্ষণ একদৃষ্টে বিরসমুখে তাকিয়ে জানালার ভারী পর্দ্দা টেনে রোদ
ঢেকে দিল। অনেকক্ষণ আগে জোরে খিদে পাচ্ছিল, এখন মরে গেছে।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন