কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ১০১


এবছর বিগত মার্চ মাসে সবার কৌতূহল, জিজ্ঞাসা, সন্দেহ ও আশা-নিরাশার নিরসন ঘটিয়ে দুটি আন্তর্জাতিক বইমেলা সম্পন্ন হলো দুই প্রতিবেশী দেশ  ভারত ও বাংলাদেশে – কলিকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলা এবং অমর একুশে বইমেলা। এর আগে শেষ বইমেলা হয়েছিল ২০২০ সালে। বইমেলা শেষ হবার ঠিক এক-দেড় মাস পরেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মতোই ভারত ও বাংলাদেশও আক্রান্ত হয়েছিল অতিমারিতে। স্বাভাবিক কারণেই তাই প্রায় সারা বিশ্ব একপ্রকার অচল হয়ে পড়েছিল, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, মৃত্যুমিছিলে ভারাক্রান্ত হয়েছিল মানুষের জীবন ও যাপন। এই দুঃসহ কালবেলায় তাই অন্যান্য অনেক কিছুর মতোই বইমেলা আয়োজন করার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। একদিকে প্রকৃত পাঠক-পাঠিকারা যেমন নিয়মিত পড়ার আনন্দ এবং জ্ঞানচর্চার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন, অন্যদিকে তেমনি যাঁরা বই প্রকাশ করেন এবং বিপণন করেন, তাঁরা মুখোমুখি হয়েছিলেন চরম আর্থিক দুর্দশার। এবং শুধুমাত্র তাঁরাই  নন, বরং বিশ্ব জুড়ে অধিকাংশ মানুষই এই আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলেন। ২০২১ সালে তাই বইমেলার আয়োজন স্থগিত রাখতে হয়েছিল। এরই পাশাপাশি প্রবাহিত সময়ের কারণে সংক্রমণের ভয়াবহতা হ্রাস পাবার ফলে অনেকেরই মনে আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিল, ২০২২-এ বইমেলা কি হবে? না কি হবে না? কিন্তু শেষপর্যন্ত তা হলো, তবে প্রতি বছরের মতো নির্ধারিত সময়ে নয়, বরং কিছুটা পরে। বিগত দু’বছরের বুভুক্ষু পাঠক-পাঠিকারা তাঁদের চাহিদা, প্রত্যাশা, সাধ ও সাধ্যানুযায়ী সংগ্রহ করার সুযোগ পেলেন হাজার হাজার বইয়ের ভিড় থেকে প্রার্থিত বইয়ের সম্ভার। সেইসঙ্গে পুনর্মিলিত হলেন পরিচিত মানুষজনের সঙ্গে এবং সদ্য পরিচয়ের সূত্রে সম্পর্কিত হলেন আরও বিভিন্ন মানুষজনের সঙ্গে। আর মেলার তাৎপর্য তো এই মেলামেশার মধ্যেই নিহিত থাকে।

এবছর বিগত মার্চ মাসে আরও একটি উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল গত ১৬ই মার্চ তারিখে (১লা চৈত্র)। দিনটি ছিল ১৯৩৮ সালে প্রয়াত তৎকালীন যুগের স্বনামধন্য সাহিত্যিক ও সম্পাদক রায়বাহাদুর জলধর সেনের ১৬৩তম জন্মদিবস। ‘জলধর সেন স্মৃতিরক্ষা সমিতি’র পক্ষ থেকে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কলকাতার বালীগঞ্জের বাসভবনে। জলধর সেনের ১৬১তম জন্মদিবসও আয়োজিত হয়েছিল ২০২০ সালের ১৬ই মার্চ এই বাসভবনেই। করোনার কারণে ২০২১ সালে অনুষ্ঠান স্থগিত রাখতে হয়েছিল। প্রথম অনুষ্ঠানের মতোই এবছরের অনুষ্ঠানেও জলধর সেনের ওপর বক্তব্য রেখেছেন বিশিষ্ট জলধর বিশেষজ্ঞরা। প্রথম ও দ্বিতীয় বছরের দুটি আলোচনা সভাতেই অত্যন্ত মননশীল বক্তব্য রেখেছেন ড. বারিদবরণ ঘোষ। এবছর আরও একজন বিশিষ্ট জলধর বিশেষজ্ঞ ড. সুবিমল মিশ্রও বক্তব্য রেখেছেন। অন্যান্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন ড. অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়, সন্দীপ দত্ত এবং পৌলমী মালিক। পৌলমী বিশ্বভারতীতে জলধর সেনের ওপর গবেষণা কাজে এখন নিমগ্ন আছেন। সম্পাদক জলধর সেন তাঁর সম্পাদিত বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রবীণ ও নবীন লেখক-লেখিকাদের সারাজীবন সমাদর করেছেন। সম্ভাবনাময় লেখক-লেখিকাদের উৎসাহ ও প্রেরণা যুগিয়েছেন। জলধর সেন স্মৃতিরক্ষা সমিতির পক্ষ থেকেও বর্তমানে যাঁরা সাহিত্য-সংস্কৃতি-শিল্পকলা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, তাঁদের সংবর্ধনা ও সম্মাননা জ্ঞাপন করা হয়েছে। বিশেষত বিগত দুটি অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ে বাসভবনের বৈঠকখানায়, যেখানে একসময় শরৎচন্দ্রের সঙ্গে মিলিত হয়েছেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ, জলধর সেন, নরেন্দ্র দেব, রাধারানী দেবী, কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু এবং বাংলা সাহিত্য জগতের ও রাজনীতি জগতের অসংখ্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বগণ। আসলে এই বাসভবন তো তীর্থক্ষেত্র আমাদের সবার কাছে!

বাংলা নতুন বছরের সূচনায় সবাইকে জানাই আমাদের শুভেচ্ছা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।      

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

কথনবিশ্ব

 

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১৮ 




আগের পর্বে বলেছিলাম এবার আমরা এশিয়ার সিনেমায় ফিরব। আজ এশিয়া ভ্রমণের প্রথমেই ইরান। তবে এবার আমরা একটু অন্য পদ্ধতিতে এগোব। প্রতিবারের মত ছবি ধরে ধরে নয় – আজ পরিচালক ক্রমানুযায়ী ইরানের সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব। আসলে ইরানে বিভিন্ন সময়ে বড়জোর কয়েকজন করে পরিচালক ছাপ রেখেছেন, তাই সেইসব পরিচালকদের ধরতে পারলেই আমরা মোটামুটি ইরানের সিনেমার একটা সময়পঞ্জী পেয়ে যাব।

আজ যাদের নিয়ে আলোচনা করব, তাঁরা হলেন – কিয়ারোস্তামি, মখমলবাফ্‌, মজিদি, ফারহাদি। তবে এঁদের নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে একটা পুরনো ছবি নিয়ে কিছু লিখব কারণ আমার মতে সত্তরের দশকের সেই সিনেমাকে ছবির পর্দায় কবিতা বলা উচিৎ এবং সে্টাই ছিল ইরানি সিনেমার আর্ট ফিল্ম হয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ। ধৈর্য ধরে দেখলে মনে হবে ইয়াসুজিরো ওজু-র সিনেমা দেখছেন। শোহরাব শাহিদ-সালেসের ‘স্টিল লাইফ’ (১৯৭৪)।

এক অচিন গ্রামের নির্জন রেল স্টেশন। আশেপাশে কেউ নেই। সেখানে ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করছেন এক ক্রশিং গার্ড। এখন বৃদ্ধ। একই কাজ, একই রোজনামচা। একঘেয়ে জীবন। বাড়িতে তাঁর বয়স্কা স্ত্রী সময় কাটানোর  জন্য দিনরাত সেলাই করেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান তাঁদের ছেড়ে গিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। এটাকে হয়ত থিম বলা যায় আবার হয়ত এটা নতুন কোন থিম নয় কারণ বেশিরভাগ বয়স্ক মানুষের একাকীত্ব এরকমই। কিন্তু  ৯৩ মিনিটের সিনেমায় যেটা ভাল লাগবে, সেটা হল ধীরে ধীরে বয়ে চলা নিখুঁত লং শট এবং ক্যামেরার ওয়াইড অ্যাঙ্গল, যা পুরো ফ্রেমকে ধরে নিয়ে চোখের সামনে এক বাস্তব জীবন তুলে ধরে। রুটিন কাজ। গার্ড আস্তে আস্তে স্টেশনে গেলেন, সিগনাল দিলেন এবং ফিরে এলেন। কোথাও ক্যামেরার সিন-কাট নেই। অথবা তাঁর স্ত্রী ডিনার খাচ্ছেন। দীর্ঘ শট। কাট নেই। প্রতি সিন নতুনভাবে তোলা  হয়েছে, কিন্তু ঘুরেফিরে সেই একই দৃশ্যের পুনরায়ন। বুঝতে পারবেন না আপনি কোন্‌ টাইম-ফ্রেমে বসে আছেন। ফলে গতানুগতিক পথ পেরিয়ে এই সিনেমা আর্ট-ফিল্ম হয়ে উঠেছে। ঠিক এই কারণে ‘দ্য হাউজ ইজ ব্ল্যাক’ বা ‘ব্রিক অ্যান্ড মিরর’ বা ‘দ্য কাউ’ না বেছে এই সিনেমাকেই বাছলাম ইরানের শুরুর দিকের  প্রতিভূ হিসেবে।    

এবার পরিচালকদের আলোচনায় ফিরি। প্রথমেই আব্বাস কিয়ারোস্তামি। একটুও ভুল বলা হবে না যদি বলি আব্বাস কিয়ারোস্তামি ছিলেন প্রথম পার্সি পরিচালক যিনি ইরানি ছায়াছবিকে ধারাবাহিকভাবে বিশ্বমানের করে তুলেছিলেন। সেই সত্তরের দশক থেকে এত অসাধারণ সব সিনেমা উনি উপহার দিয়েছেন রিপোর্ট (১৯৭৭), হয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হোম? (১৯৮৭), ক্লোজ-আপ (১৯৯০), টেস্ট অব চেরি (১৯৯৭), দ্য উইন্ড উইল ক্যারি আস (১৯৯৯) ইত্যাদি, যে ওনাকে ইরানের ছবির সত্যজিৎ রায় বলা যায়। এখানে ওনার ঠিক দুটো ছবি নিয়ে বলব - ক্লোজ-আপ (১৯৯০) এবং টেস্ট অব চেরি (১৯৯৭)। এই দুটোর গল্প এবং স্টাইল, পাঠক, ভাল করে লক্ষ্য করবেন।

কোন এক গরীব লোক হোসেন, যে চিত্র পরিচালক মখমলবাফের ফ্যান, নিজেকে মখমলবাফ হিসেবে পরিচয় দিয়ে তেহরানের এক ধনী পরিবারে ঢুকে পড়ে এবং সবাইকে প্রতিশ্রুতি দেয় তার পরবর্তী সিনেমায় সে তাদের দিয়েই অভিনয় করাবে। তাদের থেকে কিছু টাকা ধার নেয়। এই হাসির থিম নিয়ে ‘ক্লোজ-আপ’ শুরু। সেই পরিবারের সন্দেহ হওয়ায় তারা পুলিশে খবর দেয়,  লোকটি জোচ্চোর হিসেবে ধরা পড়ে এবং তার বিচার শুরু হয়। বিচার চলাকালীন লোকটি জানায় সে তার আচরণের জন্য অনুতপ্ত। বিচারক এবং  অভিযোগকারী পরিবারের সবাই একমত হয়ে তাকে এবারের জন্য মাফ করে এবং শর্ত রাখে যে তাকে এবার সৎ নাগরিক হয়ে উঠতে হবে। অবশেষে স্বয়ং মখমলবাফ এসে তাকে বাইকে চাপিয়ে বাড়ি ছেড়ে আসেন। এই সিনেমার বিশেষত্ব হল যে এখানে প্রতি চরিত্র তার নিজের নামেই অভিনয় করেছেন। এবং চিত্র পরিচালক মখমলবাফ্‌ নিজে এই সিনেমায় অভিনয় করেছেন। প্রধানত আইডেনটিটি ক্রাইসিস এবং মনস্তত্ত্ব নিয়ে তৈরি এই ছবি আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসা কুড়িয়েছিল। পাঠকের হয়ত মনে থাকতে পারে যে আমি ১১ নং পর্বে যখন আমার বাছাই গোটা পৃথিবীর প্রথম ২০ ‘টাইমলেস ক্লাসিক’ লিস্ট  বানিয়েছিলাম, তখন এই ছবিকে সেই লিস্টে ২১ নম্বর হিসেবে রেখেছিলাম।    

ক্লোজ-আপের এই গল্পের উল্টোদিকে এবার আসুন ‘টেস্ট অব চেরি’ গল্পে।  তেহরানের এক ধনী ব্যক্তি বাডি নিজেকে মেরে ফেলতে চান এবং এটাও চান যে তিনি আত্মহত্যা করার পর কেউ তাঁকে কবর দিক। উনি সারাদিন তেহরানের  বিভিন্ন আলিগলিতে গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকেন সেই লোকের খোঁজে, যে তাঁকে কবর দেবে। কিন্তু কেউ রাজি হয় না। অবশেষে এক ব্যক্তি এই কাজ  করতে রাজি হয় যেহেতু তার টাকার দরকার। কিন্তু সেও বাডিকে আত্মহত্যা করতে মানা করে। এও জানায় যে সে নিজে একবার নিজেকে খতম করতে গেছিল কিন্তু পারেনি। বাডি সেই রাতে নিজের জন্য খোঁড়া কবরে শুয়ে পড়ে এবং ঝড়বৃষ্টি দেখতে থাকে। সিনেমা এখানেই শেষ। উপসংহার বিহীন মিনিমালিস্ট ছবি।

এবার দেখুন, এই দুই ছবিই কিন্তু তির্যক, সোশাল স্যাটায়ার। কেউ নিজের আইডলকে এত পছন্দ করে যে নিজেকে সেই আইডল হিসেবে পরিচয় দেয় বা আরেকজন নিজের কবর দেওয়ার লোক খুঁজতে থাকে, এগুলো সমাজের বিভিন্ন অংশের সাধারণ মানুষের মনস্তত্ত্ব ফুটিয়ে তোলে। এবং ছবিগুলো একটাও অ্যাবস্ট্রাক্ট নয়, বরং মিনিমালিস্ট। সমাজের কোন এক সত্যি অংশকে ফুটিয়ে তোলা। কল্প কিন্তু অনেকটা ডকুমেন্টরি গোছের। এটাই কিয়ারোস্তামির বৈশিষ্ট্য। এছাড়াও ওনার সিনেমার প্রতি আমার ভাললাগার আরো কয়েকটা কারণ হল, উনি ক্যামেরা প্রধানত এক জায়গায় বসিয়ে (স্ট্যাটিক) সেখান থেকে পুরো সিন ফুটিয়ে তোলেন, যা বেশ কষ্টকর। এবং ওনার সিনেমার আবহে মাঝে মাঝেই পার্সি কবিতা ফুটে ওঠে।    

রাজনৈতিক সিনেমা বানাতে বানাতে আশির দশকের একদম শেষদিকে মোহসেন মখমলবাফ্‌ বানিয়েছিলেন ‘দ্য সাইক্লিস্ট’ (১৯৮৯)। সেই শুরুতেই এক  শক্ত বার্তা (ক্লোজ-আপ ছবিতে এই সিনেমার রেফারেন্স দেওয়া হয়েছে)। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ৯০ এর দশকে মখমলবাফ্‌ হয়ে ওঠেন ইরানের সিনেমার প্রধান মুখ। ক্রিটিকাল কিছু সিনেমা উপহার দিয়েছেন দর্শকদের। ওয়ান্স আপন এ টাইম, সিনেমা (১৯৯২), হ্যালো সিনেমা (১৯৯৫), এ মোমেন্ট অব ইনোসেন্স (১৯৯৬), দ্য সাইলেন্স (১৯৯৮), কান্দাহার (২০০১), সেক্স অ্যান্ড ফিলসফি (২০০৫) ইত্যাদি অদ্ভুত এবং সাহসী সব সিনেমা। আমরা এখানে ওনার একটাই সিনেমা পর্যালোচনা করব - সেক্স অ্যান্ড ফিলসফি (২০০৫)।

এই সিনেমাও স্যাটায়ার, কিন্তু এর ভেতরের প্যাঁচ লক্ষ্য করুন। তাহলে বুঝবেন কেন এটা বাছলাম। মধ্যবয়স্ক নাচের শিক্ষক, জাঁ, ডিপ্রেশনে ভুগছেন। উনি ঠিক করলেন ওনার চারজন প্রেমিকাকে একসঙ্গে ডেকে বলে দেবেন যে উনি তাদের চারজনের সঙ্গেই প্রেম করেন এবং কেন, ঠিক কি কি পরিস্থিতিতে ওনার তাদের একে একে ভালো লেগেছিল বা কেন উনি এখনো তাদের চারজনকেই ভালবাসেন – কারো প্রতি ভালবাসা কমেনি। উনি সেই মিটিং করেন এবং তার প্রতি প্রেমিকাকে একটা করে হাতঘড়ি উপহার দেন। উনি ভেবেছিলেন হয়ত তার প্রেমিকারা তাকে বকাঝকা বা মারধর করবে কিন্তু তারা কিছুই করে না, ঘড়ি নিয়ে চলে যায়। এর কিছুদিন পর জাঁ-কে তার এক প্রেমিকা তার নিজের বাড়িতে ডেকে পাঠায়। সেখানে গিয়ে জাঁ বুঝতে পারে যে তার সেই প্রেমিকারও একাধিক প্রেমিক আছে এবং সেই প্রেমিকা তার সমস্ত প্রেমিকদের তার বাড়িতে একত্রে ডেকেছে – ঠিক জাঁ এর মত।

অদ্ভুত, অসাধারণ, দুরন্ত। কি নেই এখানে? মানুষের আদিম প্রবৃত্তি থেকে মনোস্তত্ত্ব, সততা বা অসততা, সাহস, ঈর্ষা, ভয়, আকুলতা – সবকিছু। এজন্যই  মখমলবাফ্‌ অন্যরকম এবং এত সাহসী। কিন্তু এর ওপরেও এই সিনেমার আরেক ডাইমেনশন আছে। খুব ভালভাবে দেখলে বোঝা যাবে, এইসব সুন্দরী প্রেমিকারা অহরহ জাঁ-এর মনের মধ্যে রয়েছে, হয়ত বাস্তবে তারা নেই। এবং জাঁ এক স্টপ-ওয়াচ ব্যবহার করছে, যেখানে সে নিজের মত সময় সেট করছে। তাহলে কি এই পুরোটাই আমাদের দৃষ্টিভ্রম? আমাদের সমাজের দৃষ্টিভ্রম? ভাবতে পারেন, এই ব্যতিক্রমী সিনেমাকে অস্কার কমিটি সেরা বিদেশী সিনেমার দৌড় থেকে বাদ দিয়েছিল! কারণটাও শুনে রাখুন – এই সিনেমার ইংলিশ সাবটাইটেল ছিল না। আর এই কারণেই অস্কার কমিটির প্রতি মাঝে মাঝে আমি ক্ষোভ উগড়ে দিই। যাইহোক, এই সিনেমায় সুররিয়েলিজম এবং অ্যাবস্ট্রাক্ট সিন বেশ  কিছু। যেমন গাড়ি চলছে, আর তার মাঝে সামনের-পেছনের যাত্রী ফোনে কথা বলে চলেছে। অথবা এক বিশাল বড় এরোপ্লেনে মাত্র একজন যাত্রী। ক্যামেরার ওয়াইড অ্যাঙ্গলের কাজ বেশ ভাল। এবং পরিচালককে যেখানে ফুল মার্ক্স দিতেই হবে, তা হল ঠিকঠাক লোকজনকে দিয়ে নিখুঁত অভিনয় করানো। আদ্যন্ত ভয়ডরহীন তাঁর সিনেমার স্টাইল। যে কারণে বনিবনা হয়নি বলে মখমলবাফ্‌ ইরান ছেড়ে চলে যেতেও দ্বিধা করেননি।       

৯০এর দশক ও শূন্য দশকে যে পরিচালক বিভিন্ন রকমের থিম নিয়ে কাজ করে সকলের মন জয় করেছেন, যাকে নিয়ে কিয়ারোস্তামি বা মখমলবাফের মত কোন বিতর্ক নেই, তিনি হলেন মজিদ মজিদি। তাঁর যে যে সিনেমা মনে রাখার  মত, সেগুলোর নাম – বাদুক (১৯৯২), চিল্ড্রেন অব হেভেন (১৯৯৭), কালার অব প্যারাডাইস (১৯৯৯), বারান (২০০১), দ্য উইলো ট্রি (২০০৫) এবং দ্য সং অব স্প্যারোজ (২০০৮)। এগুলোর ভেতর আজ আমরা মজিদির চিল্ড্রেন অব হেভেন (১৯৯৭) এবং বারান (২০০১) নিয়ে আলোচনা করব।

‘চিল্ড্রেন অব হেভেন’ শুরু হচ্ছে ইরানের এক গ্রাম্য পটভূমিতে এক গরীব  ভাড়াটে পরিবারে। দু’ভাইবোন – আলি আর জারা। স্কুল-পড়ুয়া। আলি এক মুচির  কাছে জারার স্কুলের জুতো ঠিক করিয়ে নিয়ে আসার পথে সেটা খোয়া যায়। তাদের বাবা এত গরীব যে নতুন জুতো হয়ত বাবা কিনে দিতে পারবে না, সেই ভয়ে আলি বাড়িতে এই জুতো হারানোর কথা বলতে পারে না। সে নিজের বোনকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রাজি করায় যে তার জুতোজোড়া এবার থেকে জারা সকালে স্কুলে পরে যাবে, আর জারা ফিরে আসার পর আলি সেই জুতো পরে স্কুলে যাবে। কিন্তু বাড়িতে কিছুই জানানো চলবে না। বোনের মন রাখার জন্য আলি স্কুলে থেকে প্রাইজ হিসেবে পাওয়া সোনালি পেন জারাকে দিয়ে দেয়। এদিকে রোজ স্কুলফেরৎ জারার জন্য আর জুতোর জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে আলি স্কুলে লেট হয়ে যায়। এই নিয়ে হেডমাস্টার তাকে বকাঝকা করে, কিন্তু আলি কিছুই বলতে পারে না। সে চুপচাপ কাঁদে। একদিন আলিকে সঙ্গে নিয়ে তার বাবা শহরে যায়, বাগানের কাজ করে বেশ কিছু টাকা রোজগার করে এবং ঠিক করে এবার জারাকে নতুন জুতো কিনে দেবে। কিন্তু রাস্তাতেই তার বাবার দুর্ঘটনা ঘটে যায়। নতুন জুতো আর কেনা হয় না। তখন আলি ঠিক করে সে এক দৌড় প্রতিযোগিতায় নাম লেখাবে এবং সেখান থেকে প্রাইজ হিসেবে নতুন জুতোজোড়া এনে তার বোনকে দেবে। কিন্তু সেখানে সে ফার্স্ট হয় এবং জুতোর বদলে এক বিশাল কাপ পায়। আলি মনের দুঃখে কাপ নিয়ে বাড়ি ফেরে। তখন আরেক কাট-সিনে দেখায় যে তাদের বাবা সাইকেলে বাড়ি ফিরছে, সামনে ছেলেমেয়ের জন্য নতুন দু’জোড়া জুতো। এই সিনেমার এক হিন্দি রিমেক  হয়েছিল – বাম বাম বোলে (২০১০)। দেখেছেন কি?

‘বারান’ এমন এক সিনেমা যা মজিদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দিয়েছিল। এই  সিনেমায় ইরানের সেই সময়ের এক জ্বলন্ত সমস্যা দেখান হয়েছিল অনেকটা রূপকথার মত। আফগান উদ্বাস্তুরা মাঝে মাঝেই তেহরানে এসে জড়ো হয় একটু উন্নত জীবন আর রুজিরুটির সন্ধানে। সেই নিয়ে ‘বারান’। এক আফগান  শরণার্থী পরিবারের মেয়ে ছেলে সেজে এক কনস্ট্রাকশন সাইটে কাজ করতে আসে। বারান হয়ে যায় রহমত। কিন্তু এই গোপন তথ্য শুধুমাত্র সেই পরিবার আর সেই দালাল, যে মেয়েটিকে কাজ করাতে এনেছে, জানে। অন্য কেউ জানে না। কিন্তু একদিন অন্য এক শ্রমিক লতিফ দূর থেকে বারানকে স্নান করতে দেখে ফেলে এবং বুঝে যায় সে মেয়ে। সে মনে মনে বারানকে ভালবেসে ফেলে, তাকে অন্যদের থেকে বাঁচিয়ে রাখে, তার কাজ হাতেহাতে করে তার ভার হাল্কা করে দিতে চায়। কিন্তু একদিন কিছু সরকারী ইন্সপেক্টর এসে সাইট পরিদর্শনের সময় বারানকে ধরে ফেলে। বুঝে যায় যে সে হচ্ছে বেআইনি আফগান শরণার্থী।  বারান ছুটে পালিয়ে যায়। এরপর লতিফ খুঁজে খুঁজে বারানের বাড়িতে যায় এবং দেখতে পায় সে মেয়ের পোষাকে অন্য এক জায়গায় পাথর ভাঙার কাজ করছে।

এই দুই সিনেমাই গ্রাম্য পটভূমিতে তৈরি। এবং মজিদি এই ব্যাপারটাই তাঁর বিভিন্ন ছবিতে খুব ভালভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারেন। তাঁর প্যানোরামিক ক্যামেরা, ওয়াইড অ্যাঙ্গল, প্রকৃতির দৃশ্যায়ন – মজিদির হাতে সহজেই ফুটে ওঠে। একেক গল্প হয়ে ওঠে রূপকথা। সিনেমা দেখতে বসে দর্শকের ভাল লাগে, কোন বিতর্ক বা কঠিন চিন্তাভাবনা মজিদির সিনেমায় আসে না। ফলে উনি হয়ে ওঠেন সব বয়সের দর্শকের পরিচালক।       

এবার মজিদির উল্টোদিকের এক পরিচালকের কথায় আসি। শূন্য দশকের যে ইরানি পরিচালককে প্রতি সিনেমায় তার বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে আসা মনস্তাত্ত্বিক গল্পকথার জন্য সবথেকে শক্তিশালী ধরা হয়, তার নাম আসগর ফারহাদি। যে কটি সিনেমা উনি পরিচালনা করেছেন - অ্যাবাউট এলি (২০০৮), এ সেপারেশন (২০১১), দ্য পাস্ট (২০১৩), দ্য সেলস্‌ম্যান (২০১৬), এভরিবডি নোজ (২০১৮) এবং এ হিরো (২০২১), এর প্রত্যেকটাই অনবদ্য গল্পে সাজানো যা দেখে দর্শক ভাবতে বাধ্য হবেন। আমরা এখানে এই সিনেমাগুলো থেকে এ সেপারেশন (২০১১) এবং দ্য সেলস্‌ম্যান (২০১৬) নিয়ে আলোচনা করব। এই দুটোই বিদেশি ভাষায় অস্কার পুরস্কার পাওয়া সিনেমা।

‘এ সেপারেশন’এর আমি মাত্র একটা অংশ বলব। বাকিটা আপনাদের দেখে নিতে হবে। এক দম্পতি কোর্টে ডিভোর্স কেস ফাইল করেছে কারণ স্ত্রী বাইরে চলে যেতে চায়, কিন্তু স্বামী নিজের বাড়িতে থেকে তার আলঝেইমার আক্রান্ত  বাবাকে দেখতে চায়। এদের ১১ বছরের একমাত্র মেয়ে চুপচাপ। কোর্টের জাজ এই কেসে কোনো মেরিট খুঁজে না পেয়ে ডিভোর্স বাতিল করে দেন। স্ত্রী চলে যায় বাপের বাড়ি আর মেয়ে বাবার হাত ধরে বাবার বাড়ি চলে আসে। অবশেষে অনেকদিন পর তাদের ডিভোর্স মঞ্জুর হয় এবং মেয়েকে জাজ জিজ্ঞেস করতে শুরু করেন যে সে কার কাছে থাকতে চায়। কিন্তু এর মাঝের এক বড় অংশ জুড়ে আরেক মনস্তাত্তিক গল্প আছে - আলঝেইমার আক্রান্ত বাবা ও তার জন্য রাখা আয়াকে ঘিরে। সেই গল্প জানতে হলে এই ছবি নিজে দেখতে হবে।

দ্য সেলস্‌ম্যান’ ছবিতেও গল্পের মধ্যে গল্প। সাহাব আর তারানা এক অভিনেতা  দম্পতি যারা স্টেজে রোজ আর্থার মিলারের The Death of a Salesman নাটকের অভিনয় করে। তাদের ফ্ল্যাটের হাল খারাপ হয়ে যাওয়ায় তারা এক নতুন জায়গায় থাকতে শুরু করে। এক রাত্রে তারানা যখন নতুন ফ্ল্যাটে একা, সে বাথরুমে চান করতে ঢোকে এবং কেউ বা কারা তার ওপর অত্যাচার করে। সাহাব বাড়িতে ফিরে দেখে তার ফ্ল্যাটের দরজা খোলা, ভেতরে তারানা নেই, বাথরুম জুড়ে চাপচাপ রক্ত। এক প্রতিবেশী তাকে জানায় তারানা-কে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে এবং তার ফ্ল্যাটের দরজার তালা পালটানো দরকার। সাহাব হাসপাতালে যায় এবং তারানার সংগে কথা বলে বুঝতে পারে এটা দুর্ঘটনা নয়, তার স্ত্রীকে অপরিচিত কেউ মেরেছে। তারা ফিরে আসে। সাহাব খোঁজখবর শুরু করে জানতে পারে যে তাদের আগে ঐ ফ্ল্যাটে যে মহিলা থাকতেন, তিনি পেশায় ছিলেন এক যৌনকর্মী এবং তার ক্লায়েন্টদের সঙ্গে বিভিন্ন রকম ঝামেলা লেগে থাকত। সাহাব সেই অজ্ঞাত পরিচয় আক্রমণকারীদের  খুঁজতে শুরু করে। এদিকে তারানা এই ফ্ল্যাটে ফিরে আসার পর থেকে আতঙ্কে ভুগতে শুরু করে। সে একা থাকতে ভয় পায়, বাথরুমে স্নান করতে যেতে ভয়  পায়, স্টেজে অভিনয় করতে করতে হঠাৎ থেমে কান্নায় ভেঙে পড়ে স্টেজ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এমনকি সে পুলিশের কাছে রিপোর্ট লেখাতে যেতেও ভয় পায়। এদিকে আক্রমণকারী তার গাড়ির চাবি আর কিছু টাকা ভুল করে ফেলে গেছিল,  যে সূত্র ধরে সাহাব তাকে খুঁজতে থাকে। নিজের এক ছাত্রের পুলিশ অফিসার বাবার সাহায্য নেয়। এবং এক বয়স্ক ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে যার সঙ্গে কথা বলে সাহাব বুঝতে পারে যে সেই তার স্ত্রীকে সেরাত্রে আক্রমণ করেছিল। কিন্তু সেই বয়স্ক ব্যক্তি মুখে সেটা অস্বীকার করে। এরপর আবার একপ্রস্থ নাটক এবং সেই বয়স্ক ব্যক্তিকে পুলিশে তুলে দেবার বদলে সাহাব হাসপাতালে পাঠায় চিকিৎসার জন্য। কিন্তু সেই একপ্রস্থ নাটক ঠিক কী, সেটা বলব না – সেটা  জানতে হলে আপনাকে নিজে এই ছবি দেখতে হবে।

ফারহাদি, যেটা একটু আগেই বললাম, মজিদির উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে শহুরে ইরানের জটিল জীবন তুলে ধরতে পছন্দ করেন। এই দুটো সিনেমাই সেরকম দুই থিম নিয়ে। তাঁর সিনেমায় মনস্তত্ত্ব আসে সামাজিক ক্লাস, নারী-পুরুষ বা  ধর্মীয় টানাপোড়েন থেকে। এছাড়াও তাঁর প্রতি সিনেমাতে থাকে গল্পের মধ্যে গল্প। পুরোটাই আধুনিক ইরানকে ঘিরে। এবং এই সিনেমার বিষয়ে ইতি টানার আগে আরেকজনের কথা বলে নিই। সিনেমার নায়িকা তারানা আলিদুস্তি। আমার চোখে ইন্টেলেকচুয়াল সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি। মাত্র ১৮ বছর বয়সে তারানা সেরা অভিনেত্রীর সন্মান পেয়েছিলেন। এই ছবিতেও যথেষ্ট ভাল অভিনয় করেছেন।      

আর একজন পরিচালকের কথা সংক্ষেপে বলে আজকের আলোচনা শেষ করব। কারণ তাঁর কথা না লিখলে সমালোচক হিসেবে আমার অধর্ম হবে। কেরিয়ার  শুরু করেছিলেন আব্বাস কিয়ারোস্তামির সহকারি হিসেবে। তারপর ১৯৯৫ সালে এক অনবদ্য সিনেমা বানান – দ্য হোয়াইট বেলুন। এরপর একে একে দ্য মিরর (১৯৯৭), দ্য সার্কল (২০০০), অফসাইড (২০০৬) ইত্যাদি ছবি যেগুলো কান বা বার্লিন বা ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভাল থেকে বিভিন্ন পুরস্কার এনেছে। কিন্তু প্রতি সিনেমায় এত স্ট্রং মেসেজ থাকত যে ইরান সরকার ওনাকে ‘সরকার-বিরোধী তকমা দিয়ে ২০১০-এ জেলে ঢুকিয়ে দেয়। শুধু ওনাকেই নয়, ওনার স্ত্রী, মেয়ে, ১৫ জন বন্ধু – সবাইকে। ছ’বছর জেল হয়। মজার ব্যাপার, জেলে বসেও উনি  একে একে পুরস্কার পেয়েছিলেন, যদিও নিতে যেতে পারেননি। এরকম একজন পরিচালকের কথা না বলে কী করে শেষ করি বলুন তো? জাফর পানাহি। এখানে জাফর পানাহির ‘দ্য হোয়াইট বেলুন’ (১৯৯৫) নিয়ে কয়েকটি কথা বলব।

পরের দিন ইরানে নতুন বছর। তাই আগেরদিন সন্ধেবেলা ছোট্ট মেয়ে রাজিয়া তার মায়ের সঙ্গে শপিং করছে। একটা নতুন গোল্ডফিশ কিনে দেবার জন্য তার মাকে আব্দার করছে। কিন্তু তার মা সেটা কিনে না দিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে চলে আসে কারণ তাদের বাড়িতে ইতিমধ্যেই কয়েকটা গোল্ডফিশ আছে। রাজিয়া  বাড়ি ফিরে তার দাদা আলিকে বলে মা-কে বলার জন্য। দাদাকে রাজি করানোর জন্য নিজের একটা বেলুন সে দাদাকে দিয়ে দেয়। রাজিয়ার মা অবশেষে তার হাতে ৫০০ টোমান তুলে দিয়ে বলে গোল্ডফিশ কেনার পর খুচরো টাকা তার ফেরৎ চাই। রাজিয়া আর তার দাদা দৌড় লাগায় মাছের দোকানে, কিন্তু রাস্তায় এক ড্রেনের নিচে রাজিয়া নোটটা হারিয়ে ফেলে। গভীর ড্রেন, তাই নোটটা তুলতেও পারে না। এক বেলুন বিক্রেতার সাহায্যে শেষে সেই নোট উদ্ধার হয়। শেষ সিনে দেখা যায় রাজিয়া আর তার দাদা গোল্ডফিশ কিনে ফিরছে, আর সেই বেলুন বিক্রেতা একটাই সাদা বেলুন নিয়ে এক জায়গায় বসে আছে। আবহে ভেসে ওঠে ইরানের নতুন বছর।  

এই সিনেমার বিশেষত্ব হল এটা একদম সাদামাটা বাচ্চাদের ছবি, অনেকটা রূপকথার ঢংয়ে বলা। এখানে কোন বিদ্বেষ নেই, বিরোধীতা নেই, ঘৃণা নেই – শুধু ভাললাগা আছে। এটাই তো সত্যিকারের পরিচালকের লক্ষণ। নিজের মনের  কথাগুলো সেলুলয়েডে ফুটিয়ে তোলা। সেটা ভাল-খারাপ দুইই হতে পারে। তবুও পারাজানভ বা পানাহিদের ‘বিরোধী’ তকমা দিয়ে নিজেদের দেশে জেলে পুরে  দেওয়া হয়। সমালোচক হিসেবে এর প্রতিবাদ তো জানাতেই হয়।      

সবশেষে একটা অ্যানিমেশন ছবি দেখতে বলব – পার্সেপোলিস (২০০৭) দেখুন। দেখে মন্তব্য করবেন।

 

 

 

 

 

 


অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়

 

জলধর সেন




গত ১৬ই মার্চ ২০২২, জলধর সেনের একশত ত্রিষষ্টিতম জন্মদিবসে ২৪ অশ্বিনী দত্ত রোডস্থ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাসভবনে আয়োজিত জলধর সেনের স্মরণসভা ও সম্বর্ধনাদান অনুষ্ঠানে  গিয়ে কয়েকটা কথা মনে এলো এবং হলো। বাংলা সাহিত্যে অদীক্ষিত, অপ্রাজ্ঞ পাঠক হিসেবে আমার জলধর সেন সম্পর্কে সীমিত জ্ঞানের জন্যে অপরাধবোধ আছে, কিন্তু লজ্জা কম, কারণ অন্য অনেকের সমুদ্রোপম অজ্ঞতার সঙ্গে আমার নাম জুড়ে আছে। তাই আমার লজ্জা ঢেকে  গেছে। সভায় জলধর সেনের অনেক প্রিন্ট-বহির্ভূত ভ্রমণ কাহিনী, কিশোর সাহিত্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদিকে ফিরিয়ে আনা একা ভগীরথ  ডঃ সুবিমল মিশ্র, তাঁর সম্পর্কে তথ্যের আকর জলধর সেনের শ্রীবারিদবরণ ঘোষ, লিটল  ম্যাগাজিন সংরক্ষণের যুদ্ধের একক সংগ্রামী শ্রীসন্দীপ দত্ত, জলধর সেনের স্বপৌত্র সাহিত্যিক কাজল সেন ইত্যাদি প্রগাঢ় জলধর সেন বিশেষজ্ঞদের মাঝে হংসমধ্যে বকোযথা বসে থাকতে থাকতে আমার একটা কথা মনে হলো। ১৮৯৪ সালের ৮ই এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্রের তিরোধানের পরে চৈতন্য লাইব্রেরি এবং বীডন স্কোয়ার লিটারারি ক্লাব কর্তৃক আয়োজিত শোকসভায় কবি নবীনচন্দ্র সেন সার্বজনিক, বারোয়ারি শোকসভার কৃত্রিমতার কারণে এতে সভাপতিত্ব করতে নারাজ হ’লে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এটি অনুষ্ঠিত হয়, আর তাতে রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ নামে একটি অসাধারণ প্রবন্ধ পাঠ করেন, যেটি ‘সাধনা’ নামের সাহিত্যিক সাময়িকীর  বৈশাখ, ১৩০১ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় (১৮৯৪-এর এপ্রিল-মে) বেরোয়। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ‘সাহিত্য’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় সংখ্যায় লেখেন ‘রবীন্দ্রবাবু বাঙ্গলা সাহিত্যের মুখ রাখিয়াছেন। যথার্থ সাহিত্যসেবীর মত তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যমূর্ত্তির উজ্জ্বল নিখুঁত চমৎকার ছবি আঁকিয়াছেন। … এরূপ প্রবন্ধ ভাষার গৌরব।’

সে যাই হোক, নবীনচন্দ্রের অস্বীকৃতিতে ক্ষিপ্ত রবীন্দ্রনাথ ‘সাধনা’-র জ্যৈষ্ঠ  ১৩০১ সংখ্যায় ‘শোকসভা’ নামে এক প্রবন্ধ লিখলেন, যেখানে তিনি সাহিত্যসভায় বা সাহিত্যিকের স্মরণসভায় ‘পাব্লিক’-এর আহ্বান করলেন। লিখলেন, ‘এ কথা আমি অস্বীকার করি না যে, আমাদের দেশের পাব্লিক আমাদের দেশীয় মহাত্মা লোকের বিয়োগে যথোচিত শোক অনুভব করে না। আমাদের এই অল্পবয়স্ক পাব্লিক অনেকটা বালক-স্বভাব। সে আপনার হিতৈষীদিগকে ভালো করিয়া চেনে না, যে উপকারগুলিকে পায় তাহার সম্পূর্ণ মূল্য বুঝে না। বন্ধুদিগকে শীঘ্রই বিস্মৃত হয় এবং মনে করে আমি কেবল গ্রহণ করিব মাত্র কিন্তু তাহার পরিবর্তে আমার কোনো কর্তব্য নাই। আমি বলি, এইরূপ পাব্লিকেরই শিক্ষা আবশ্যক এবং সভা-আহ্বান ও সেই সভার আলোচনাই শিক্ষার প্রধান উপায়।’

ফলে যখন আলোচনা শুনে বুঝলাম যে মুষ্টিমেয় জলধর সেন অনুরাগী এবং বিশেষজ্ঞের বাইরে তিনি যখন অনেকটাই বিস্মৃত, যে অন্যায়ের প্রতিবিধানের জন্য ও অন্যান্য অনেক কারণের মধ্যে জলধর সেন স্মৃতিরক্ষা সমিতির গঠন করতে হয়েছে, সেখানে তার সভায় আমার মতো মূঢ়েরও বসে থাকার দায়িত্ব আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই ‘শিক্ষা আবশ্যক’ কথাটার ফলে মনে আগডুম বাগডুম অন্য অনেক প্রসঙ্গ এসে গেল। ঘোড়াডুম হয়ে ভাবতে লাগলাম জার্মান সমাজতাত্ত্বিক Ferdinand Tönnies তাঁর ১৮৮৭ সালের Community and Society বইতে যে পাব্লিক তথা gesselschaft-এর কথা বলেছিলেন যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের এই অদ্ভুত মিল হলো কী ক’রে? Tönnies সাহেব লিখলেন লোকসমাজ (gemeinchaft)-এর প্রতিতুলনায় সমাজ (gesselschaft) হলো ‘public life’ and “new as a name as well as a phenomenon”। আর রবীন্দ্রনাথ ‘পাব্লিক’ সম্বন্ধে লিখলেন, ‘পদার্থটিও নূতন, তাহার নামও নূতন।’ আবার Tönnies-এর অনেক আগে, ১৮২০ সালে, আরেক জার্মান সমাজতাত্ত্বিক Hegel তাঁর Elements of the Philosophy of Right বইয়ে ‘burgerliche gesselschaft’ বা পুরসমাজের সঙ্গে  যে  ‘public’এর কথা  বলেছিলেন, তার সুশীলতা আনার জন্য তিনিও ‘bildung’ বা শিক্ষার  আবশ্যকতার কথা  বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ১৮২০ সালে হেগেলের লেখা অনুবাদে পড়েও থাকতে পারেন। কিন্তু তা ব’লে ‘শোকসভা’ লেখার সাত বৎসর আগে Tönnies-এর লেখাও পড়ে ফেললেন? অনুবাদ হয়েছিল? নাকি, উত্তর কলকাতায় বসে রবীন্দ্রনাথ সারা ইউরোপের সমস্ত রাষ্ট্রীয় বা সাধারণ দার্শনিক, সমাজতত্ত্ববিদদের ভাবনা একাই ভেবে ফেলছেন?

আক্কেল গুড়ুম অবস্থায় আমার আরেকটা কথা মনে এসে যায়। জলধর সেনের কথা বলতে গেলেই এই ‘bildung’-এর কথা এসে যাবে না কি? তাঁর  পরিব্রাজক, সাংবাদিক, লেখক ইত্যাদি বহুস্তরীয় সত্তাকে ছাড়িয়ে আমার তাঁর সম্পাদক সত্তার কথাই বেশি মনে পড়ে। মনে রাখতে হবে যে ঔপনিবেশিক বাংলার শিক্ষিত ভদ্রলোকরা তাঁদের সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক বোধের ও আকাঙ্ক্ষার তৃপ্তি ও উন্নয়নের জন্য যে কটি পত্রিকা বাড়িতে রাখতেন, তাদের মধ্যে দুটি ছিল  ১৩০৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে সূচনা হওয়া রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী ‘ ও ‘Modern Review’, আর বঙ্গাব্দ ১৩২০-র আষাঢ় থেকে ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬ বছর জলধর সেনের সম্পাদনা করা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রকল্পিত ‘ভারতবর্ষ’। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পত্রিকা প্রকাশের ঠিক আগে অকালমৃত্যুর ফলে  তিনি চলে যাওয়ায় কতকটা আকস্মিকভাবেই এর সম্পাদনার ভার জলধর সেনের হাতে পড়ল। ১৩৪৩-এর ভাদ্র সংখ্যার 'ভারতবর্ষে' প্রকাশিত তাঁর লেখা থেকেই জানি যে, ‘সুলভ সমাচার’  উঠে যাওয়ার সংবাদ পেয়েই আমার পরম  হিতৈষী বন্ধু আমার পূর্ব্ব মনিব সন্তোষের কবি-জমিদার শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ রায় চৌধুরী মহাশয় আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং যত দিন আর কোন সুবিধা না হয় তত দিন তাঁর প্যারাগন প্রেসের ভার নিতে বললেন। এখন যেখানে আমাদের ভারতবর্ষ-অফিস হয়েছে পূর্ব্বে সেখানে ট্রাম কোম্পানীর আস্তাবল ছিল। সেই  আস্তাবলের ঘরগুলি ভাড়া নিয়ে প্রমথবাবু প্যারাগন প্রেস করেছিলেন। আমি সেই প্রেসের ম্যানেজার হলাম’। এর পরে যখন ‘ভারতবর্ষ’  প্রচারের আয়োজন চলছে খুব ধুমধাম ক’রে, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় এবং অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ যুগ্ম-সম্পাদকত্বে, তখন ‘ভারতবর্ষ’-এর স্বত্বাধিকারী হরিদাস চট্টোপাধ্যায় এই  প্যারাগন প্রেসেই ‘ভারতবর্ষ’ ছাপানোর ব্যবস্থা করেন, আর তাঁকে এর জন্য  অগ্রিম টাকাপয়সাও দেন। কিন্তু এই পত্রিকার প্রুফ দেখতে দেখতেই দ্বিজেন্দ্রলাল মৃত্যুবরণ করেন এবং লেখক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, বহুবিদ বিদ্যাভূষণমশায় থাকতেও হরিদাস চট্টোপাধ্যায় জলধর সেনকে পত্রিকার সম্পাদক পদে প্রায় জোর ক’রে বসিয়ে দেন।

আমি ভাবতে থাকি যে তবুও সম্পাদক হিসেবে উভয়ের নিষ্ঠার মিলটুকু বাদ দিলে জলধর আর রামানন্দর সামাজিক আচরণের পার্থক্য ছিল সমুদ্রপ্রতিম। সম্পাদক রামানন্দ ছিলেন পাব্লিক-বিমুখ, এলিটিস্ট, পারতপক্ষে কর্তব্যবোধে কোন সামাজিক নিমন্ত্রণ, ক্রিয়াকর্মে গেলেও খাদ্যগ্রহণে অনিচ্ছুক। আর উপরোধে লেখা ছাপা? এ বিষয়ে একটি চালু গল্প আছে। যদিও তার সত্যতা সন্দেহাতীত  নয়। তবে বলেছেন সাগরময় ঘোষ, ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ বইতে। কাশীতে মণিকর্ণিকা-র ঘাটে আশ্বিনের ভরা গঙ্গার চোরা আবর্তে নিমজ্জমান  রামানন্দ-র উদ্ধারকারী একটি যুবককে তিনি প্রত্যুপকার করতে চেয়ে নিজের নাম ও ‘প্রবাসী’ কার্যালয়ের ঠিকানা লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ফলে ছেলেটি  তাঁকে কিছুকাল পরে একটি কাঁচা, অমুদ্রণযোগ্য কবিতা ‘প্রবাসী’-তে ছাপানোর জন্য নিয়ে এলে তিনি তাকে নাকি কাতরকণ্ঠে বলেন, ‘এ-কবিতা তো ছাপতে পারব না। তার চেয়ে যে-গঙ্গা থেকে আমাকে তুমি উদ্ধার করেছিলে সেই গঙ্গায় আবার আমাকে ফেলে দিয়ে এস।’ আর জলধর সেন? যে-কোন নেমন্তন্নবাড়ি থেকে ওঁকে আমন্ত্রণ জানালে উনি কিছুতেই না বলতে পারতেন না, পাছে ফিরিয়ে দিলে তাঁরা মনে দুঃখ পান! সবকটিতে যেতেন, সবকটিতে খেতেন, সমপরিমাণ আগ্রহ নিয়েই। নিমন্ত্রণ রক্ষা করে যখন উনি ফিরতেন, তখন দেখা যেত ‘তাঁর উদরের সঙ্গে গলাবন্ধ কোটের বুকপকেটটাও ফুলে ঢোল।’ তাতে থাকত ছোটগল্প, প্রবন্ধ, কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই কবিযশোপ্রার্থীদের কবিতা। এইসব লেখক-সম্মান অভিলাষীকেই জলধর সেন প্রচুর বাক্যোৎসাহ দিতেন। কোনো বাড়িতে আবার কেউ লেখা না দিলে প্রায় বলি—বলি ব্যাপারখানা কী প্রশ্ন করার স্তরে চলে যেতেন। অবশ্যই সেই লেখাগুলোর প্রায় কোনোটাই ছাপা হতো না, আর তার কারণও হতো যেমন বিচিত্র তেমনই চিত্তাকর্ষক। কোট ধোবার বাড়ি চলে যাওয়া, গতাসু স্ত্রীর অগোছালো সংসারে সব জিনিস হারিয়ে যাওয়া,  এমনকি নিজের কানে খাটোত্বের আশ্রয় নিয়ে লেখা জমাকারকের কথাই শুনতে না পাওয়া। তো, একবার এক ভারতবর্ষ প্রেমিকের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে তাঁর পুত্রের কাছে এরকম উপরোধী লেখা না পেয়ে শুধোলেন, ‘এ-ধরনের  অনুষ্ঠানে যখনই আমার ডাক পড়ে তখনই বাড়ি ফেরার সময় কিছু-না-কিছু আমাকে নিয়ে ফিরতেই হয় — এই যেমন গল্প প্রবন্ধ বা কবিতা। একমাত্র এখানেই তার ব্যতিক্রম দেখে আশ্চর্য হয়ে তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।’

এই উপরের কথাটা ছিল সরলভাবে বলার ছলে শাণিত বিদ্রূপ। জার্মান সমাজতাত্ত্বিক Georg Simmel সমাজের ভিত হিসেবে ধরেছিলেন একটি ধারণাকে, ‘sociation’, এবং  ‘pure  sociation’, যাকে আমরা শিথিল বঙ্গানুবাদে বলতে পারি সামাজিকতা বা বিশুদ্ধ সামাজিকতা। জলধর সেন যেন তাঁর সামাজিকতার তাড়নার এই অন্যায়  সুযোগগ্রহণ-কে কশাঘাত করলেন। এই সম্পাদকীয় নিষ্ঠা না থাকলে কি তিনি ছাব্বিশ বৎসর ‘ভারতবর্ষছাড়াও  তার আগে কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা,’ ‘বঙ্গবাসী’, ‘বসুমতী’, ‘সন্ধ্যা’, ‘হিতবাদী’, ‘সুলভ সমাচার’ ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদকীয় কাজের দায়িত্ব পালন করতে পারতেন? ‘বঙ্গবাসী’-র মূলমন্ত্র মেনে নিতে না পারায় মাত্র দেড় মাস পরে সেই কাজ ছেড়ে দিতে পারতেন?

অনেকের সস্নেহ প্রশ্রয়ে জলধর সেনের সাহিত্য প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন তাঁর নামকারক স্বনামখ্যাত হরিনাথ মজুমদার, ঔপনিবেশিক কলকাতার জাতীয়তাবাদী বাঙালিদের অসীম শ্রদ্ধাষ্পদ ‘কাঙাল হরিনাথ’। নামকরণে অভিনবত্ব ছিল না, যদি মনে রাখি যে জলধরের বাবার নাম ছিল হলধর। এ ছাড়া তাঁকে শিক্ষায়, সাহিত্যকর্মে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছেন স্বয়ং  বিদ্যাসাগর, বিদ্যাসাগরমশাইয়ের দৌহিত্র সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ইত্যাদি। তাঁর ভ্রমণ সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ, ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ইত্যাদি। ভ্রমণ সাহিত্যের কথায় মনে পড়ে গেল, আমার জলধর সেনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়, তাঁর ‘দার্জিলিং ভ্রমণ’ নামের একটি পাঠ্যাংশ থেকে আমাদের  চতুর্থ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যপুস্তক ‘কিশলয়’-এ। কী পরিমিত সেই লেখা! একটি  কথা বেশি নেই। একটি কথা কম নেই। আর পড়ার পর, মনে পড়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের কথা, ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি, মনে হবে শেষ হয়ে হইল না শেষ’। লেখাটি কোথায় আছে খেয়াল নেই, ‘হিমাচল পথে’ নামে দার্জিলিং ভ্রমণের একটি কাহিনীতে, যেটি তাঁর ‘মুসাফির মঞ্জিল’ নামক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, নাকি, ‘তেহরির পথে’-তে?

অন্নদাশঙ্কর রায়ের অমর কথা, 'ভ্রমণ থেকেই হয় ভ্রমণ কাহিনী … কিন্তু ভ্রমণকারীদের সকলের হাত দিয়ে নয়’-কে সার্থক ক’রে জলধর সেনের লেখা গাইডবুক আর ভ্রমণোপন্যাস এই দুই-এর রিক্ততা আর আতিশয্যের দুই দোষকেই এড়িয়ে গেছে। তাঁর সম্ভবতঃ দশটি ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও কালজয়ী ‘হিমালয়’ (১৯০০)-এর লেখকত্বের বিতর্ক বাদ দিয়েই বলছি, একদিকে যেমন বইটি দেবপ্রয়াগের শোভা, রুদ্রপ্রয়াগ থেকে পিপল চটির তৎকালীন দুর্গমতা, বদরিগামী পথের বৈচিত্র্য, বরফ কেটে রাস্তা তৈরি, যোশীমঠের পথের অলৌকিক সৌন্দর্য, ব্যাসগুহায় তুষারাচ্ছন্ন নদীপরিসর ইত্যাদির অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছে, তেমনি অজস্র অন্য প্রসঙ্গ এনে ভ্রমণ বর্ণনাকে একঘেয়ে হতে দেয়নি, যেমন, জন বানিয়ানের পিলগ্রিমস্‌ প্রগ্রেস, একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত, বঙ্কিমের আনন্দমঠ, বিবর্তনবাদ, মেসমেরিজম, থিয়োসফি, শঙ্করাচার্যের শিক্ষা ইত্যাদির উল্লেখ, তেমনি তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘স্বর্ণলতা’  উপন্যাসের কথা, বদরির পাণ্ডা প্রসঙ্গে বা ঈশ্বর গুপ্তের পাঁঠা বিষয়ক কবিতা, শেক্সপীয়র, মীরাবাঈ-এর উল্লেখ, আবার শিক্ষিত বাঙালি ও অশিক্ষিত গাড়োয়ালির তুলনা, গণেশকে নিরীহ করণিক হিসেবে দেখা, দ্রৌপদী ও বৃকোদর-কে নিয়ে তামাশা ইত্যাদি।

জলধর সেনের ভ্রমণ সাহিত্য সুদীর্ঘ। তার মধ্যে পড়ে ‘প্রবাসচিত্র’ (১৩০৬/১৮৯৯); ‘হিমালয়’ (১৩০৭/১৯০০); ‘পথিক’ (১৩০৮/১৯০১); ‘হিমাচল বক্ষে’ (১৩১১/১৯০৪); ‘পুরাতন পঞ্জিকা' (গল্প ও ভ্রমণ, ১৯০৯); 'হিমাদ্রি' (১৩১১/১৯০৪); 'আমার য়ুরোপ ভ্রমণ (১৩২২/১৯১৫); 'দশদিন'  (১৩২৩/ ১৯১৬); ‘মুসাফির মঞ্জিল’ (১৩৩১/১৯২৪); 'দক্ষিণাপথ' (১৩৩৩/১৯২৬); 'মধ্যভারত' (১৩৩৭/১৯৩০) ইত্যাদি বই ছাড়াও, ‘প্রবাসের সুখ’ (‘প্রদীপ’ মাসিক পত্রিকা, ১৩০৪/১৩০৫ বৈশাখ ও শ্রাবণ সংখ্যা), ‘প্রবাসে  এক রাত্রি’(‘প্রদীপ’, ১৩০৮ বৈশাখ সংখ্যা), ‘প্রবাসের কথা’(ঢাকা সম্মিলন ও রিভিউ, ১৩১৮ ভাদ্র সংখ্যা), ‘হিমালয়ের কথা’(চিত্র সহ) (‘ভারতবর্ষ, ১৩২৩  আশ্বিন), ছোটদের জন্য প্রকাশিত ‘হিমাদ্রি’ (১৩১৮/১৯২৫) এবং ‘বদ্রিকাশ্রমে নারায়ণ দর্শন’(‘ধ্রুব’মাসিক পত্রিকা, ১৩১৯ অগ্রহায়ণ পৌষ সংখ্যা) ইত্যাদি সাময়িকীর লেখা। হিমালয় সংক্রান্ত প্রায় সবই সুবিমল মিশ্র সম্পাদিত ‘হিমালয় সমগ্র’ গ্রন্থে পাওয়া যাবে। এই বইগুলির ভাষার কথা আর তার স্বকীয়তার  কারণটির কথা একটু বলি। ‘প্রদীপ’ পত্রিকার ১৩০৭-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ‘হিমালয়’ সম্পর্কে লিখেছিলেন, “ভাষার বিশেষত্ব আছে, তাহা পুস্তকের ভাষা নহে … শুষ্ক কঠোর কঙ্কর বা পাষাণস্তূপের ন্যায় দুরধিগম্য নহে, অথচ নানা তত্ত্বকথায় সুসংযত। এরূপ সুলিখিত সুললিত ভ্রমণ কাহিনীর কে না সমুচিত সমাদর করিবে?” এই অ-সংস্কৃতগন্ধী ভাষার কারণটি খুব কৌতুকাবহ। কে বিশ্বাস করতো জলধর সেন নিজে না বললে যে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাভিলাষী, গণিতে পারঙ্গম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দাক্ষিণ্যে জেনারাল অ্যাসেম্বলীজ-এ ভর্তি হওয়া জলধর সেন কেবল সংস্কৃতে দুর্বল ছিলেন ব’লে এল.এ. পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি ব’লে তাঁর প্রাযুক্তিক শিক্ষা হলো না! ১৮৬০ সালে জন্ম নেওয়া কোনো শিক্ষিত বাঙালির পক্ষে এই ঘটনা বিস্ময়ের। এই ঘটনার ‘teleology’ বা পরমকারণিকতার কথা দিয়ে শেষ করি। যে যুগে বঙ্কিমচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের কোনো ছাত্রের লেখা নিতেন না, সব লেখাই ‘নদ, নদী, গিরি-কান্তার-মরু’ দিয়ে শুরু হতো ব’লে, এবং সেভাবেই শুরু হওয়া সত্বেও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখা নিয়েছিলেন, সেখানে জলধর সেন এরকম লিখতেন, যেমন দেবপ্রয়াগ ভ্রমণের সময়,

“ছোট মেয়েটি আমার কাছে এসে দাঁড়ালো। আমি তাদের বাড়ি কোথা, কে আছে, কয় ভাই, কয় বোন প্রভৃতি প্রশ্নে  আলাপ আরম্ভ করলুম। প্রথমে তাদের কথা কইতে একটু বাধ বাধ ঠেকলো, কিন্তু শীঘ্রই সে সঙ্কোচভাব দূর হয়ে গেল।  অনেকক্ষণ কথাবার্তা হল। সব কথা মনে নেই, কিন্তু একটা কথা আমাকে বড় বেজেছিল, তাই সেটা বেশ মনে আছে। আমি তাকে যখন বললুম যে, ‘আমার বাপ নেই, স্ত্রী নেই, ছেলেও নেই’, তখন সে তার করুণ আয়ত চক্ষুদুটি আমার  মুখের উপর রেখে কোমল স্বরে বলল ‘লেড়কি ভি নেহি?’ কথাটা আমার প্রাণে তীরের মত বিদ্ধ হল! আমার একটি ‘লেড়কি’ ছিল, জানিনে কোন অপরাধে  তাকে তিন বৎসর হারিয়েছি। আজ এই বালিকার একটি কোমল প্রশ্নে সেই সুপ্ত স্মৃতি জেগে উঠলো। আমার চোখে জল দেখে বালিকার মুখখানি কেমন শুকিয়ে গেল। সে তার অপরিষ্কার ওড়না দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে, তার কোমল ছোট ছোট আঙুল দিয়ে আমার হাতের আঙুল নাড়তে লাগল। আর তার সেই স্নেহস্পর্শে, তার সেই অকপট সহানুভূতিতে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলুম। বালিকা আমাকে আর কোন কথা বলতে পারলে না। ... সন্ধ্যা বেশ ঘন হয়ে এল। মেয়ে দুটি আগে আগে পথ দেখিয়ে চলতে লাগলো, আর ঘন ঘন ‘হুঁশিয়ারি’, ‘খবরদারি’ বলতে লাগলো, পাছে আমার পায়ে ঠোক্কর লেগে আমার পায়ে ব্যথা হয়। আমাকে তারা রাস্তায় তুলে দিয়ে বিদায় নিলে। আমার বড় কষ্ট বোধ হল। হায়, আবার কখনো কি জীবনে তাদের সঙ্গে দেখা হবে?”

কী গদ্য! Max Weber-এর ভাষায় জলধর সেনের প্রার্থিত ‘qualifikation von fachwissen’ (specialist qualifications) এবং বিশেষতঃ প্রায়োগিক/প্রাযুক্তিক শিক্ষাযোগ্যতা হলো না সংস্কৃতে দুর্বলতার জন্য। কিন্তু তার বলেই তিনি হয়ে উঠলেন ‘colonial bildung’-এর এক প্রধান পুরুষ।

এর পরে আচমকাই যখন উদ্যোক্তারা আমার নাম ঘোষণা করেন এই মহাত্মার সম্পর্কে কিছু বলার জন্য, তখন আমি অনুভব এবং উপলব্ধি করি যে, আমি এই  স্বল্প সময়ে জলধর সেনের সম্পর্কে কিছু বলতে গেলে তাঁর সাহিত্যকৃতি সম্পর্কেও বলতে হবে, কেবল ভ্রমণসাহিত্য নয়। উপরন্তু — 'চাহার দরবেশ' (উর্দু উপন্যাস থেকে অনূদিত, ১৯০০); 'নৈবেদ্য' (গল্প, ১৯০০); 'ছোট কাকী ও অন্যান্য গল্প' (১৯০৪); 'নূতন গিন্নী ও অন্যান্য গল্প' (১৯০৭); 'দুঃখিনী' (উপন্যাস, ১৯০৯); 'বিশুদাদা' (উপন্যাস, ১৯১১); 'আমার বর ও অন্যান্য গল্প' (১৯১৩); 'কাঙ্গাল হরিনাথ' (জীবনী, ১৯১৩); 'করিম সেখ' (উপন্যাস, ১৯১৩);  'আলান কোয়াটারমেন' (অনূদিত উপন্যাস, ১৯১৪); 'পরাণ মণ্ডল ও অন্যান্য গল্প' (১৯১৪); 'অভাগী' (উপন্যাস, ৩খণ্ডে, ১৯১৫, ১৯২২, ১৯৩২); 'আশীর্ব্বাদ' (গল্প, ১৯১৬); 'বড়বাড়ী' (উপন্যাস, ১৯১৬); 'এক পেয়ালা চা' (গল্প, ১৯১৮); 'হরিশ ভাণ্ডারী' (উপন্যাস, ১৯১৯); 'ঈশানী' (উপন্যাস, ১৯১৯); 'পাগল' (উপন্যাস, ১৯২০); 'কাঙ্গালের ঠাকুর' (গল্প, ১৯২০); 'চোখের জল' (উপন্যাস, ১৯২০); 'ষোল-আনি' (উপন্যাস, ১৯২১); 'মায়ের নাম' (গল্প, ১৯২১); 'সোনার বালা' (উপন্যাস, ১৯২২) ; 'দানপত্র' (উপন্যাস, ১৯২২); 'মুসাফির-মঞ্জিল' (ভ্রমণ, ১৯২৪); 'পরশ পাথর' (উপন্যাস, ১৯২৪); 'ভবিতব্য' (উপন্যাস, ১৯২৫); 'তিন পুরুষ' (উপন্যাস, ১৯২৭); 'বড় মানুষ' (গল্প, ১৯২৯); 'সেকালের কথা' (কথাচিত্র, ১৯৩০); 'উৎস' (উপন্যাস, ১৯৩২) — ইত্যাদির সাহিত্যগুণের আলোচনা করতে হবে। সে ক্ষমতা আমার কই? উপস্থিত সাহিত্যিকরা সব্বাই  আমার চেয়ে বেশি জানেন। সদাহাস্যময় পৌত্র নিজে ব’সে আছেন। জ্ঞানের  দীনতা ধ’রে ফেলবেন, কেবল স্বভাবগুণে বলবেন না। এমনিতেই যা লিখেছি তার সমাজ বৈজ্ঞানিক অংশটুকু বাদে সবই অন্যের কথা। তিনি নিজেই কবি, ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক এবং সম্পাদক। তাই তাঁকেই বরং খান দুই প্রশ্ন করতে পারি। এক, সম্পাদক জলধর সেন ছাব্বিশ বছর ধ’রে পত্রিকা সম্পাদনা, জহুরীব্রত ইত্যাদি করার পর এত লিখলেন কী ক’রে? মানে, ঘুমোতেন টুমোতেন তো? আর দুই, সম্পাদক জলধর সেনই কি সাহিত্যিক জলধর সেনকে খেয়ে ফেলল? কিন্তু সে কথা যাক, বুঝতে পারি, শরৎচন্দ্র বাসভবনের এই বিদগ্ধ ‘কোণে / আমি অসহ্য অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও’, একটু অল্পস্বল্প কথা ব’লে বাড়ির পথ ধরি।

 

 

 


মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি



প্রতি,

এ চিঠি বা প্রতিবেদন। এ লিখন। এ স্মৃতিকথা। না, কবি জীবনানন্দের 'ধূসর পাণ্ডুলিপি' নয়। তারচেয়েও কিছু দুস্তর ফ্ল্যাশব্যাকের কথা। সিনেমায় ফ্ল্যাশব্যাক হয়। কিন্তু থিয়েটারে? হয় কি? হয় হয়। স্মৃতির ভুবনে হাত পাতলেই হয়। হ্যাঁ, একটা হলদে আলোই হবে বা সাদাও হতে পারে। কে একজন কাব্যি করে বলেছিলেন, 'সুনীল আকাশে উড়িল বিহঙ্গ পতঙ্গ রে'। কোন বড় কবির লেখা কিনা, তাও জানেন না যিনি এই সংলাপ আওড়ে আমার স্মৃতি ফিকে হতে দেননি। ঘরের পরে বলেই হয়ত, বাচ্চা কাঁদলে মন ভোলাতে এই সংলাপ হেসে উঠত। থরথর নাকি ঘরঘর কীরকম শব্দ হয়েছিল? শিশু-কান আজ আর তা   শুনতে পায় না। কিন্তু পেলে ভাল হত। মজার লাগত সেসময় সব। একটা কিছু হবে যেটা মঞ্চ নামিয়ে নিয়ে যেত। ফিকে আলোয় মন দিয়ে তাকিয়ে থাকা। মাঝখানে বিশাল গোল গর্ত। আবার সেটায় করে লোকে-ওঠে নামে। থিয়েটার শুরুর আগে পর্যন্ত ওটা ফাঁকাই থাকে। আর শুরু হলে ওটা নেমে যায়, অভিনয়-করিয়েদের নিয়ে উঠে আসে। এক-আধবার বোধহয় আশপাশ দিয়েও অভিনেতা প্রবেশ করতেন। দর্শকরা যে যার সিট ছেড়ে লাফিয়ে উঠতেন দেখার জন্যে। পরে  বুঝেছি, ওঁরা বক্স আর্টিস্ট। আর একুশ শতকের সাংস্কৃতিক-অর্থনীতির ভাষায় ওঁদের টিআরপি বেশ বেশির দিকে। আরও মজার ছিল মঞ্চ তো ঘুরে যেত এদিকে ওদিকে, আলাদা সব ঘরবাড়ি আবছা আলোয় দেখা যেত। তারপরই আলো জোরে এসে পড়ত, যেমনটি পড়ার কথা। কিন্তু, এই মঞ্চের নাম মনে নেই। থিয়েটারের নাম ছিল 'কাকের বাসা'। আর একটা দেখে মজা লাগত, সেটা হল একটা প্লেন সুতোয় বাঁধা লাইন দিয়ে চলে আসত। সামনে। মাথার উপর হবে বা। কারোর সঙ্গে সঙ্গে সংলাপ ছিল, বম্বে যাওয়ার। মঞ্চের কোণায় একজন শিল্পী দাঁড়াতেন এসে। খুব কিছু বলবেনও বা। না, মনে পড়ে না। শুধু শেষের সংলাপ মনে পড়ে, মানিয়ে নাও, একটু মানিয়ে নাও, একটু অ্যাডজাস্টমেন্ট।  অনেক পরে জেনেছিলাম, ঐ মানিয়ে নেওয়া হল মানিয়ে চলা, মিলেমিশে চলা। মোটাসোটা একজন লোক সেটা বলতেন খুব জোরের সঙ্গে। তিনি ছিলেন সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। বাবা ভক্ত না হলেও কলেজ স্ট্রিট পাড়া থেকে হাতিবাগানে যেতেন। সপরিবারে। বন্ধু- আত্মীয় জুটিয়ে, তাঁদের টিকিট কেটে নিয়ে। রবিবার। সন্ধ্যা সাড়ে ছটা। এই সময় কবে থেকে চালু হয় কে জানে! কিন্তু রবিবারের কথা  খুব মনে পড়ে। সন্ধ্যা ছটায় বাবার প্রেসের সামনে এসে জুটতাম। জুতো মোজা পরা আমাদের সাজুগুজু ভাব। আর বাবা হাতের কণুই পর্যন্ত কালি মেখে। বাবার  জামাতেও কালি। মা ব্যাগে করে একটা জামা আনতে ভুলত না। সেটাই বাবা হাতে-মুখে-চোখে জল দিয়ে পরে নিত। ভাগ্য ভাল থাকলে একটা ট্রাম মিলত।  সৌভাগ্য চরমে থাকলে ট্যাক্সি। দেরি হয়ে গেছে। কোনমতে হাত ধরে ছুটে চলা। কোনদিন এমনও হয়েছে থিয়েটারের টিকিট পুরনো জামায় রয়ে গেছে। জামা তো প্রেসে ঝুলছে। আবার ছুটত বাবা। আমাদের জন্যে সেদিন থিয়েটার বোধহয় অপেক্ষা করত। এমন একটা কিছু করে পিছিয়ে যেত, যেখানে আমরা বুঝতে পারি। বোঝাতে কেউই চাইত না। ফিসফিস করে বলত, ঐ যে অপর্ণা সেন। স্বরলিপি, বিশ্বরূপা মঞ্চে তাঁর জন্যেই হিট হিট হিট। কে বলত, ঐ যে দীপঙ্কর। কখনও এভাবেই শুনেছি কিছু নাম। কানে ভাসে কিছু আর কিছু নয়। তবে, উত্তর কলকাতার ভাগে দেশভাগের পর সিনেমা থিয়েটার যাত্রাপালা আর সার্কাসে মুগ্ধ ছিল। টিকিট পাওয়া যেত না মাঝে মধ্যেই। হাউসফুল লেখা একটা বোর্ড টাঙানো থাকত। কলকাতাবাসী বাঙালির জীবনে এই থিয়েটার পাড়া এসে পড়েছিল। ভাগের বাংলার অভিনেত্রীদের মধ্যে নাম করা লিলি চক্রবর্তী-র ‘বিলকিস বেগম’ কত রজনী পূর্ণ করেছিল, তা কোথাও লেখা হয়ত রয়েছে,  কিন্তু সর্বজনীনভাবে কেউই জানেন না। বাঙালি মাত্রই জানেন মনোজ মিত্রের নাটক 'দম্পতি'র কথা। আর গীতা দে-র সঙ্গে নাট্যকার ও অভিনেতা মনোজ মিত্রের কেমিস্ট্রি মানে রসায়ন। সঙ্গে ছিলেন আরও এক নামজাদা অভিনেতা শুভেন্দু চ্যাটারজি। দেশভাগের পর এই প্রফেশনাল বোর্ডের থিয়েটার, যা সাধারণ রঙ্গালয়ের পরে বাণিজ্যিক সাফল্যের চূড়ান্তে গিয়ে পৌঁছেছিল। একদিকে, কাজ  করেছেন নামজাদা অভিনেত্রীরা। যাঁদের এই মঞ্চ থেকে সিনেমা এবং সিনেমার সঙ্গে সঙ্গে থিয়েটারে কাজ। চলেছে সমান্তরালভাবেই। আর্থিক স্বচ্ছলতা পেয়েছেন। সাফল্য পেয়েছেন। যেখানে কেতকী দত্তের অভিনীত 'বারবধূ' খুব সাফল্য পায়। ইতিহাস তৈরিও হয়। কিন্তু তার সন্ধান করে লিপিবদ্ধ হয় না। প্রগতিশীল সংস্কৃতি চর্চায় একসময়ে পাঠক্রমে থিয়েটার এল। পাশ করে ডিগ্রি নিয়ে তার দ্বারা কাজ করার প্রবণতা তৈরি হল। সেই প্রবণতা বা ঝোঁক নিয়ে তথ্য বিশ্লেষণ করলে খুব উঁচু দরের শিল্প-প্রেমীদের সন্ধান পাওয়া যায় না। তবে যা মেলে, তা হল একটা দিক, যেখানে কেতকী দত্ত প্রমুখের নামের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় সন্ধান। কেমন ছিল ঐ থিয়েটারের জগত? সেখানে কি কেবলই অর্থের জন্যেই অভিনয় করা হত? মানে, অর্থের মাহাত্ম্যে অভিনয়, নাকি অভিনয়ের মাহাত্ম্যে অর্থলাভত? নাকি অভিনয় এবং অর্থলাভ সমার্থক হয়ে ওঠে? তাত্ত্বিক  বিশ্লেষণে না গিয়েও অনায়াসেই এই তথ্য প্রকাশিত হয় যে, অর্থ নিয়ে অভিনয় করলেও, সেটা ছিল অধ্যয়নের 'সাধনার মতন'। 'সাধনার মতন' শব্দবন্ধের ব্যবহার করেছেন আলোচক সিদ্ধার্থ চক্রবর্তী। তিনি নাট্য-গবেষক। তিনি ২০২২ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতায় নাটকে বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত  বিভাগীয় প্রধান। এবং নিয়মিত অভিনেতা গ্রুপ থিয়েটার পর্বের। তিনি এক ‘রঙরূপ’ দল প্রযোজিত ও সীমা মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত নাটকে অভিনয় করে  থাকেন। চর্চা করতে গিয়ে সংলগ্ন গ্রুপ থিয়েটার পর্বের অভিনেত্রীদের সঙ্গে জুড়ে যায় মঞ্চ, কাল ও আর্থিক এক বিশ্লেষণ। সমাজ এরই সমন্বয়ে চলমান।



মনে পড়ে সারকারিনায় এসেছিলাম। অনেক বছর পর শ্রদ্ধেয় অমর ঘোষ মাস্টারমশায়ের হাত ধরে। তিনি রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়-আয়োজিত একটি কর্মশালা করিয়েছিলেন। সেখানেই আলাপ। তারপর জানালেন, সারকারিনায় অভিনয় করবে? লিড ক্যারেক্টার। গিয়ে দেখলাম সেই সারকারিনা, যেখানে একদিন জুলুষে ঠিকরে পড়ত চোখ। এখন হলদে আলোয় বসে থাকা মলিন চেয়ার হাতলে জঙ। আর স্যারের কপালে ভাঁজ। শুনে অবাক হয়েছিলাম, ঐ মঞ্চে বসে দেখছিলাম নাটক 'মরজিনা'। সেই চরিত্রটিই আমাকে করতে হবে আগামীতে। কিন্তু এই কী হাল! ততদিনে যেতে যেতে বুঝেছিলাম, ওটা চালাতে  গিয়ে স্যারের সব গেছে। বাড়ি বলতে মঞ্চই তাঁর আপন ঘর। এভাবেও ভাবতে  পারেন? স্যার আমায় দেখে শোয়ের শেষে বলেছিলেন যে, বুঝেছি, এই ক্যারেক্টারটা করবে না, তাই তো? আসলে পোশাক। পোশাক বিতর্কে সারকারিনা  বরাবরই সমালোচনায়। দর্শক টানতে যদি ওইরকম পোশাক পরতেও হয়, কী  এসে যায়? তদ্দিনে তো হেলেন-সিনেমায় ওরকম পোশাক পরেছেন। এবং, হিট ছবির হিট গানে আজও সেসব প্রাণবন্ত। কিন্তু কলকাতা নেয়নি। মানে, দর্শক। তাহলে সিনেমায় যা চলে তা কিন্তু চলে না থিয়েটারে। কিন্তু আবার সেই একই কলাকুশলীদের জন্যে থিয়েটারের হাউসফুল শো- হয়। কিন্তু গপ্প, কাহিনি, পোশাক যেন মঞ্চের বাতাবরণে এসে ঠেকে যায় একটা সভ্যতার চরে। নাকি সংস্কৃতির পিঠস্থান বলে একদা খ্যাত মঞ্চনাটকের পাড়া তখনও নাকউঁচু হয়েই ছিল! তাই, অনেক করেও চলেনি ঐ মর্জিনা। চলে গেছে সময়। অনেক বছর পর  আবার থিয়েটার পাড়ায় যাতায়াত। এদিকে ওদিকে সব পাল্টে গেছে। রয়েছে লাল কটি বাড়ি বা উঁচুতল। যারা হেরিটেজ বলেই পাল্টে যায়নি। তাহলে, দর্শকের  কাছে প্রশ্ন এই যে, হেরিটেজ কি থিয়েটার নয়? যেখানে এত রমরমা সেসব হল বা প্রেক্ষাগৃহ নয়? 

গত সময়ের অনতিদূরে নাকউঁচু বাংলা ও বাঙালির সংস্কৃতি ছিল আছে থাকবে। কিন্তু কোথায় গেল এতগুলো মঞ্চ বা হল? হাতিবাগান অঞ্চলের থিয়েটার পাড়া  নিয়ে লেখা হচ্ছে। এবং তা স্মৃতি উসকে দিচ্ছে। কিন্তু সীমাবদ্ধ সেই পরিসর। আন্তর্জাতিক থিয়েটারের সঙ্গে বাঙালির জুড়ে যাওয়া। জুড়ে যাওয়া বাঙালির সিনেমা ও থিয়েটার নিয়ে মাতামাতি। দর্শক হয়ে ওঠা। অভিনেতা অভিনেত্রী হয়ে  ওঠা। নির্দেশক, ম্যানেজার হয়ে ওঠা। কলাকুশলী হয়ে ওঠা এবং টিকে থাকার লড়াই। যা ক্ষণস্থায়ী পর্যবেক্ষণের নয়। যা বিচ্ছিন্ন করে একটা ইতিহাসের পাণ্ডুলিপিও তৈরি করে না। এ হল অধুনাকৃত গবেষণা-পদ্ধতির ভাষা। যার চর্চা আগেও ছিল, পরেও থাকবে। আর থিয়েটার প্রেমী ডটকমে উঠে আসবে, না জানা তত্ত্ব, তথ্য। যার রসায়ন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সলতে পাকাচ্ছে।

_ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্ত্বাধিকারী 

 


শুভ্রনীল চক্রবর্তী

 

এরিয়া ৫১ - ভিনগ্রহী গ্রহান্তর




আমরা বাঙালিরা খুবই সাধারণ মানুষ আর নির্বিকারে সেই সাধারণত্ব নিয়ে  বড়াই করে থাকি। পৃথিবীর মধ্যে কত যে বিস্ময়কর রহস্য লুকিয়ে আছে তা জানার চেষ্টা খুব কম বাঙালিই করে থাকেন, এই ধরুন এক্সট্রাটেরেস্ট্রিয়াল বা  মেটা ফিজিক্যাল ব্যাপার বা ঘটনা। না বস্তুবাদী হওয়া খুবই জরুরি, তার বিরোধিতা আমি করছি না, তবে কি জানেন তো এই মহাবিশ্বের ৯০ ভাগের  বেশিই কিন্তু অ্যান্টি ম্যাটার বা বিপরীত বস্তু। তাই যুগের সাথে এগিয়ে যেতে হলে আমাদের গতে-ধরা মধ্যবিত্ত সাহিত্যচর্চা বিশেষ করে ফিকশন-প্রিয় বাঙালির উচিত একটু টেকনোলজিক্যাল ব্যাপ্তি নিয়েও পড়াশোনা করা। যেখানে এ বিষয়ে আমরা সবাই অবগত যে, আমেরিকা থেকে শুরু করে চীন অথবা প্রথম বিশ্বের সবকটি দেশই কিন্তু নিজেদের সমৃদ্ধ করেছে এই প্রযুক্তি নির্ভর হয়েই। আমরা আজ যে জিনিসটা নিয়ে জানছি বা দু’এক কথা এদিক ওদিক থেকে শুনছি, তার চর্চা হয়তো মার্কিন মুলুকে হয়েছে কম করে বিশ ত্রিশ বছর  আগে। এবং আজ যে বিষয়টা নিয়ে বলতে চলেছি তা সম্পর্কে হয়তো বেশিরভাগ মানুষই অবগত নন। আচ্ছা আপনারা তো শুনেছেন যে চাঁদের বুকে প্রথম পা রেখেছে আমেরিকা থেকে নীল আমস্ত্রং, কিন্তু এটা কি জানেন বা শুনেছেন সেটি একটি সেটে বানানো সিনেমা ছাড়া আর কিছুই নয়? খুব অবাক লাগছে? আজ্ঞে হ্যাঁ, এই শুটিং প্লেসটির নাম এরিয়া-৫১, যেটা নিয়ে আমরা আজ আলোচনা করতে চলেছি।

এই এরিয়া ৫১ হলো আমেরিকার নেভাডায় অবস্থিত এক গোপনীয় স্থান যেখানে মার্কিন বিমানবাহিনী বিভিন্ন রিসার্চ ওরিয়েন্টেড কাজ করে থাকে। এখানে বর্তমানে ঠিক কোন বিষয় নিয়ে গবেষণা চলছে তা জানার কোনো উপায় নেই। তবে ইতিহাস বলে যে, বিভিন্ন এয়ারক্রাফট ও ওয়েপন সিস্টেম নিয়েই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হয় এই জায়গাটিতে। শুরু থেকেই গোপনীয়তা ও রহস্যের  বেড়াজালে ঘেরা এই স্থান নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম কথা উঠে এসেছে, কেউ বলে এখানে ইউ. এফ. ও-দের আনাগোনা আছে, কেউ বলে এখানে  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও এলিয়েনরা একসাথে না কী কাজকর্ম চালাচ্ছে ভবিষ্যতের পৃথিবী তৈরীর জন্য, আর এসবের সঙ্গে চাঁদে অবতরণের কনস্পিরেসি থিওরি  তো আছেই। আমরা আজ চেষ্টা করবো একটু বিষদে এই এরিয়া ৫১ সম্পর্কে জানার এবং এই বিভিন্ন কনস্পিরেসী থিওরির সত্যতা যাচাই করার।

একদম গোড়া থেকে শুরু করতে গেলে আমাদের যেতে হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে, তখন সোভিয়েত রাশিয়া খুবই শক্তিশালী এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র  ভারে বা ধারে তাদের বেশ সমঝেই চলতে হত। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নের মতিগতি, তারা কী নিয়ে গবেষণা করছে, তারা কোনো আকস্মিক হামলা করে বসবে কিনা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয় নিয়ে বেশ উত্তপ্ত ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদদের মস্তিষ্ক। পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য অপেক্ষাকৃত নিচু দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমান পাঠায় যুক্তরাষ্ট্র। তবে সোভিয়েত বাহিনীর হাতে সেগুলো অচিরেই ভূপাতিত হয়। অবশেষে ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট ডি. আইজেনহাওয়ার এক গোপন প্রোজেক্টের অনুমোদন দেন। সেই প্রোজেক্টের লক্ষ্য ছিলো এমন এয়ারক্রাফট বানানো যেগুলো অনেক উচ্চতা থেকেও শত্রুপক্ষের বিভিন্ন বিষয়ে নজরদারি করতে পারবে। এ প্রোগ্রামের ফসল হিসেবেই পরবর্তীতে তারা তৈরি করেছিলো ইউ-২ স্পাই প্লেন। ১৯৫৫ সালের জুলাই থেকে ইউ-২ স্পাই প্লেনের টেস্ট ফ্লাইট শুরু হয়। মজার ব্যাপার হলো, এর অল্প কিছুদিনের মাঝেই যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গা থেকে ‘ইউএফও’ দেখার  দাবি করতে শুরু করে লোকজন। এর পেছনের কারণটা অবশ্য বেশ মজার। ইউএফও দেখতে পাওয়ার দাবি করা মানুষগুলোর অধিকাংশই ছিলো কমার্শিয়াল এয়ারলাইনের পাইলট। তৎকালে এরোপ্লেনগুলো সাধারণত ১০,০০০ থেকে ২০,০০০ ফুট উচ্চতা দিয়ে উড়তো। মিলিটারি এরোপ্লেনগুলো উড়তো আরো উঁচু দিয়ে, প্রায় ৪০,০০০ ফুট। অনেকেই ধারণা করতো যে, ‘মানুষের তৈরি’ কোনো  এরোপ্লেন এর বেশি উঁচু দিয়ে উড়তে পারবে না! আর ঠিক এ জায়গাতেই লেগে গেলো যত গোলমাল। কারণ ইউ-২ প্লেনটি উড়ে যেত ৬০,০০০ ফুটেরও বেশি উচ্চতা দিয়ে! ব্যাস তখনই মানুষের মনে ঢুকে গেলো সন্দেহ, প্রচার হয়ে গেল এটা মানুষের বানানো কিছুতেই হতে পারে না, এ নিশ্চয় কোনো এলিয়েনের  কীর্তি। বিমান বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অবশ্য জানতেন যে, ইউএফও দাবি করা জিনিসগুলো আসলে তাদের গোপন প্রোজেক্টের ইউ-২ স্পাই প্লেন। কিন্তু এ সত্যটি জনসম্মুখে বলা বারণ ছিলো তাদের জন্য। কারণ এটি ছিলো একটি টপ সিক্রেট প্রোজেক্ট। ফলে লোকমুখে ছড়াতেই থাকে ইউএফও দেখতে পাওয়ার সেসব ভিত্তিহীন দাবি।

এবার আসি, এরিয়া ৫১ সম্পর্কে গুজব বা রহস্যের ধাঁধা যাই বলুন, তার মূল  কান্ডারী ওরফে বব লেজারের কথায়। ১৯৮৯ সালে বব লাজার দাবী করে বসেন যে, তিনি কিছুদিনের জন্য এরিয়া ৫১-এরই একটি অংশে কাজ করেছিলেন, যার  নাম এস-৪। সেই জায়গাটি এতটাই গোপনীয় যে, ঐ প্রজেক্টে তিনি এবং তার অন্যান্য সহকর্মীদের যে বাসে করে নেয়া হয়েছিলো, তার জানালাগুলো বন্ধ ছিলো যাতে তারা যাতায়াতের রাস্তা মনে রাখতে না পারেন। এস-৪এ লাজার এমন সব ফ্লাইং সসার দেখতে পেয়েছিলেন, যেগুলো কোনোভাবেই পৃথিবীতে তৈরি হতে পারে না বলে দাবী লাজারের। সেগুলোর শক্তি সরবরাহ করা হচ্ছিলো এন্টিম্যাটার রিঅ্যাক্টরের মাধ্যমে, জ্বালানী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিলো লালচে-কমলা বর্ণের একটি পদার্থ যার নাম ‘এলিমেন্ট-১১৫’। তাঁর মতে, সামরিক খাতে  ব্যবহারের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে তৈরি করছিলো ইউএফও।

তদপুরি লাজার এও দাবী করেন যে, ভিনগ্রহী বা এলিয়েনদের না কী এখানে যথেষ্ট আনাগোনা ও তাদের বিভিন্ন জিনিস জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এই অঞ্চলেই। ১৯৯৭ সালে এমন দাবি করেছিলেন ভিক্টর নামে আরেক ব্যক্তি। তিনি এরিয়া ৫১এ চাকরি করেন বলে দাবি করেছিলেন। তিনিও এলিয়েনদের জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারটি দেখেছিলেন বলে জানান। নব্বইয়ের দশকে মাঝামাঝি সময়ে একটি ভিডিও প্রকাশ্যে আসে যেখানে এলিয়েনদের ময়না তদন্ত হচ্ছে দেখা যায়, অনেকে এটিকে ভুয়ো বললেও মানুষের কৌতুহল কিন্তু থেমে থাকেনি। আপনি যদি এলিয়েনদের ময়নাতদন্ত তত্ত্বে বিশ্বাস করতে চান, তাহলে হতাশ হবেন না। কারণ ২০১২ সালে ‘Alien from Area 51: The Alien Autopsy Footage Revealed’ শিরোনামে একটি ডিভিডি বেরিয়েছিলো, যেখানে আবার সতর্কতা হিসেবে লেখা আছে- ‘Graphic Material’! ২০১৪ সালে সর্বশেষ এমন আরেকটি ভিডিও দেখা যায়। সেই ভিডিওতে প্রায় ৪ ফুট লম্বা একটি এলিয়েনের আংশিক কাটা মাথা দেখা গিয়েছিলো।

এবার আসি এরিয়া ৫১ নিয়ে সবথেকে জনপ্রিয় তত্ত্বে, বলা হয় আমেরিকার চাঁদের বুকের পা রাখাটা সম্পূর্ণ ভুয়ো এবং পুরো ব্যাপারটি একটি সিনেমার মত  শুটিং হয় এরিয়া ৫১এ। এ ধারণাটির প্রবক্তা কনস্পিরেসি লেখক বিল কেসিং। তাঁর মতে, ষাটের দশকের শেষের দিকে নাসার বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে,  তীব্র তেজষ্ক্রিয়তার জন্য চাঁদের বুকে অবতরণ করা কোনো মানুষ আর বেঁচে ফিরতে পারবে না! কিন্তু এতদিন ধরে চালানো এই প্রোগ্রামও বাতিল করা সম্ভব ছিলো না। তাই তারা আশ্রয় নেয় ইতিহাসের অন্যতম সেরা জালিয়াতির। এজন্য অ্যাপোলো-১১ জনগণের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়ার পরই গোপন একটি মিলিটারি এয়ারক্রাফটে করে ক্রুদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো পূর্বপ্রস্তুত একটি মুভি স্টেজে! এর কিছুদিন পরে সেখানেই স্থাপন করা সব ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেন নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন। এরপর সেই ভিডিওই বিশ্বজুড়ে প্রচারের ব্যবস্থা করা হয় নাসার পক্ষ থেকে।

এরিয়া ৫১এ যে আসলে কী আছে সেই সম্পর্কে জনগণের ধারণা বেশ কম। এই কম ধারণা থেকেই পরবর্তীতে জন্ম নিয়েছে নানা কল্পনার শাখা-প্রশাখা। এই যেমন মাটির তলার বাঙ্কারটির কথা বলা যায়। কোনো কোনো কন্সপিরেসি থিওরিস্টের মতে, এরিয়া ৫১এ মাটির নিচে বিশাল বাঙ্কার গড়ে তুলেছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। আর সেখানেও রয়েছে প্রযুক্তির অত্যাধুনিক আশীর্বাদপুষ্ট বিমানের আনাগোনা। সেই বিমানগুলোকে সেখানে লুকিয়ে রাখা হয় যাতে স্যাটেলাইটের মাধ্যমেও সেগুলোর কোনো হদিস কেউ না পায়। কারো মতে সেই বাঙ্কারগুলো ৪০ তলা ভবনের সমান উঁচু! আবারো বব লাজারের শরণাপন্ন হতে হয় বাঙ্কারের কথায়। তাঁর মতে, এলিয়েনদের সেই স্পেসক্রাফটগুলো লুকিয়ে রাখা হয়  পাহাড়ের নিচে। সেই বাঙ্কারের প্রবেশপথে রয়েছে বিশাল বড় দরজা যার ডিজাইন আশেপাশের মাটির মতোই করা। ফলে দূর থেকে দেখে একে পাহাড়ের অংশই ভাববে যে কেউ!

আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের তথ্য মোতাবেক, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী মেঘের পরিবর্তন করে বৃষ্টিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা তা নিয়ে পরীক্ষা চালিয়েছিলো। আবার ১৯৬২ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ন্যাশনাল ওশানিক এন্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ কমানোর জন্য কাজ করেছিলো, যদিও তাদের সেই গবেষণা ততটা ফলপ্রসূ হয়নি। এ থেকেই অনেকে ধারণা করে থাকে যে, আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটানোর জন্য এমন বিভিন্ন পরীক্ষাও চলে এরিয়া ৫১এ।

'ম্যাজেস্টিক ১২’ নামে সুপরিচিত একটি টার্ম আছে, যা দিয়ে আমেরিকার একটি  গোপন দলকে বোঝায়। বিভিন্ন বিজ্ঞানী ও সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত সেই দলটি নাকি গত ছয় দশক ধরে নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছে এমন একটি ব্যবস্থা করার জন্য যাতে আমাদের এই ধরণীটি একইসাথে মানুষ এবং অভিজাত এলিয়েনরা পরিচালনা করতে পারবে! ম্যাজেস্টিক ১২ নাকি ইতিমধ্যেই এলিয়েনদের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৪৭ সালে  সূত্রপাত হওয়া এ প্রজেক্টের মাধ্যমে এলিয়েনদের বিভিন্ন প্রযুক্তি যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এসেছে বলে দাবি কনস্পিরেসি থিওরিস্টদের। বিনিময়ে এলিয়েনরা পেয়েছিলো বিভিন্ন পশুপাখি, এমনকি মানুষের উপর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা চালানোর অধিকার!

এরিয়া ৫১এর কথা আমেরিকা সরকার প্রথম ৬০ বছরে স্বীকার করেনি, তাই কাল্পনিক রহস্যময় অঞ্চল হিসেবেই মানুষের কাছে জনপ্রিয় ছিল এই অঞ্চল। অনেকে বিশ্বাস করত, অনেকেই আবার স্রেফ গুজব বলে উড়িয়ে দিত, কিন্তু  সমগ্র বিশ্ব নড়ে চড়ে বসে ২০১৪ সালে, ওবামার সময় সি. আই. এ প্রথম স্বীকার করে এরিয়া ৫১এর অস্তিত্ব নিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে মানুষ খানিকটা হলেও জানতে পারে এই অঞ্চলের সত্যতা। এখনো বহাল তবিয়তেই চলছে এরিয়া ৫১এর গোপন পরীক্ষা নিরীক্ষা যার কুল কিনারা আমার আপনার মত সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তবে গুগল আর্থ থেকে বেশ কিছু স্যাটেলাইট ফটো দেখে বোঝা যায় আগের তুলনায় যথেষ্ট সম্প্রসারণ হচ্ছে এর এরিয়া। একথা বলাই বাহুল্য যে এরিয়া সম্প্রসারণ মানে কাজের পরিধি ও নিশ্চয়ই  বেড়েছে তাদের। তবে ভেতরে যে ঠিক কী চলছে তা অনুমান করা বড়ই কঠিন,  হয়তো ভবিষ্যতে আমরা জানতে পারবো যদি আমেরিকা এই নিয়ে আবার কোনোদিন মুখ খোলে। তবে পিটার মার্লিনের মতে এরিয়া ৫১এ বর্তমানে উন্নততর স্টেলথ টেকনোলজি, অ্যাডভান্সড ওয়েপন, ইলেকট্রনিক ওয়্যারফেয়ার এবং ইউএভি (আনম্যান্‌ড এরিয়াল ভেহিক্‌ল) নিয়ে কাজ হচ্ছে। ওদিকে ইউ-২ বিষয়ক ইতিহাসবিদ ক্রিস পোককের মতে এখন সেখানে বিশেষ ধরনের এয়ারক্রাফট, রেডিও কমিউনিকেশনের অত্যাধুনিক কোনো প্রযুক্তি, ডিরেক্টেড এনার্জি ওয়েপন এবং লেজার নিয়ে গবেষণা চলছে।

তথ্যসূত্র

popularmechanics.com/military/research/a24152/area-51-history/

nsarchive.gwu.edu/NSAEBB/NSAEBB443/


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

আমার ইংরেজী বই পড়া




 

()

স্কুলের প্রথম শ্রেণীতে ইংরেজী পাঠ্যবইটির নাম এখনো মনে আছেঃ With Peter and Susanতৃতীয় শ্রেণী থেকেই মনে হয় চালু হয়ে গিয়েছিল তৎকালীন ওরিয়েন্ট লংম্যান সংস্থার The New Method Readersতার সঙ্গে থাকতো দ্রুতপঠনের জন্য কিছু গল্পের বই। চতুর্থ শ্রেণীর এমন একটি বই খুব ভালো লেগেছিলোঃ The Hair Tree নামে একটি মিলনান্তক রূপকথা, যার সঙ্গে ছিল The Story of the Opal নামের আরেকটি বিয়োগান্তক গল্প – সব ভুলে গেছি, শুধু মনে রয়ে গেছে দ্বিতীয় গল্পে nightingale পাখীর উপস্থিতি, আর প্রথম গল্পের এই ছড়াটিঃ

I know, I know:

Inside the wind does blow,

Inside the waters go:

This makes the Hair Tree grow–

I know, I know.

আপনারা যাঁরা আমার বাংলা বই পড়া নিয়ে স্মৃতিচারণ পড়েছেন, তাঁদের মনে থাকতে পারে যে এই সময় পাঠ্যপুস্তকের বাইরে আমি পড়েছি শুধুই বাংলা গল্প। এ  নিয়ে আমার বাবা-মা খানিকটা চিন্তিতই ছিলেন। স্কুলের ইংরেজী বইগুলি মোটামুটি পড়তাম, পরীক্ষায় নম্বর উঠতো ভালো-খারাপ মিশিয়ে। অবশ্য পঞ্চম শ্রেণী থেকে যে বাংলাতেও খুব একটা ভালো করতাম, তা নয়! এই সময় ষষ্ঠ শ্রেণীতে ঘটে গেল আমার পাঠ্যজীবনে একটা বড় পরিবর্তন। শ্রেণীশিক্ষক প্রশান্তকুমার সিংহ মহাশয় পড়াতেন ইংরেজী, ইতিহাস এবং গণিত। ইংরেজীতে নির্দিষ্ট পাঠ্যবই ছাড়াও, অবসর পেলেই তিনি পড়ে শোনাতে শুরু করলেন সেই ওরিয়েন্ট লংম্যান থেকেই প্রকাশিত The Hand of the Law নামের একটি বই। নাম শুনে বিষয়বস্তু কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন কি? ইংল্যান্ডের একটি শহরের পুলিশ এবং সেখানে ঘটে যাওয়া এক-এক অপরাধমূলক রহস্যের সমাধান কাহিনী। মনে করিয়ে দিই যে এই সময় আমি হেমেন্দ্রকুমার রায়ের একনিষ্ঠ পাঠক! হঠাৎ ইংরেজীতে রহস্য গল্প! অবশ্য এর অনেক আগে থেকেই (চতুর্থ শ্রেণী) রাতে ঘুমোতে যাবার আগে বাবা শার্লক হোমসের একটি করে ছোট গল্প বাংলায় অনুবাদ করে শোনাতেন, কিন্তু সেও তো বাংলাতেই! দক্ষিণ কলকাতার শরৎ বোস রোডের ‘গ্রন্থ চয়ন’ থেকে আমাদের স্কুলের যাবতীয় বই-খাতা কেনা হতো। তার প্রায় পাশেই ছিল (এখনও আছে কি?) মৃত্যুঞ্জয় ঘোষের মিষ্টির দোকান। মনে আছে, বাড়ির গাড়ি করে সেখানে যাওয়া  হয়েছে সপরিবারে। বাবা-মা মিষ্টি কিনতে ব্যস্ত, গাড়িতে বসে দীর্ঘ রোগভোগের পর সাম্প্রতিক আরোগ্যপ্রাপ্ত দাদা। আমি হঠাৎ টুক করে নেমে গিয়ে গ্রন্থ চয়নে ঢুকে জিজ্ঞেস করলাম, “Hand of the Law পাওয়া যাবে?” একটু বিরক্তি-সহকারে একজন কর্মচারী বললেন, “ওটা আবার কোন ক্লাসে লাগছে এখন?” তারপর বেশ কিছু বই ঘেঁটে উক্ত পুস্তকটির একখানা কপি বেরোল। আরও মুখ তেতো করে কর্মচারীটি প্রশ্ন করলেন, “তোমার কি এটা খুবই দরকার?” প্রায় হাঁউমাঁউ করে উত্তর দিলাম, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুউউব দরকার! মৃত্যুঞ্জয়ের দোকানেই বাবা-মা আছেন, দাম বলুন, এক্ষুণি এনে দিচ্ছি!” উত্তর এলো, “দু’ টাকা বাষট্টি পয়সা।” ছুটে গেলাম মৃত্যুঞ্জয়ে; “ও বাবা, বাবা, ২ টাকা ৬২ পয়সা দেবে, একটা ভালো ইংরেজী বই কিনব!” ইংরেজী বই কেনার কথা শুনে বোধহয় খানিকটা বিস্মিত এবং আশান্বিত হয়েই বাবা একটি ২ টাকার নোট এবং খুচরো ৬৫ পয়সা হাতে দিলেন। আবার ছুটে গিয়ে গ্রন্থ চয়নে দাম দিয়ে পেলাম The Hand of the Law এবং ৩ নয়া পয়সা ফেরৎ (আপনাদের কারোর স্মরণে আছে এইসব ১, ২, ৩, ৫, ১০  পয়সা?)। বাড়ি ফিরে গোগ্রাসে গিললাম ইন্সপেক্টার কাউলি, কনস্টেবল টাফট  প্রমুখের রহস্য ভেদের ছোট-ছোট গল্প।

শ্রেণীশিক্ষক সিংহমশায় আরো একটি ভালো কাজ করার প্রয়াস করেছিলেন। দ্রুতপঠনে পাঠ্য ছিল Monte Cristoবুঝতেই পারছেন, এ হলো দুমার ‘কাউন্ট অব মন্টি ক্রিস্টো’র সংক্ষেপিত রূপ। সেই সময় (সালটা ১৯৬৮), ভবানীপুরের অধুনালুপ্ত ‘পূর্ণ’ প্রেক্ষাগৃহে প্রতি রবিবার সকালে ১০-৩০-এ ইংরেজী ছবি দেখানো  হতো। এক রবিবার, জানা গেলো দেখান হবে ১৯৬১ সালে ফরাসী ভাষায় তৈরী এবং ১৯৬২-তে ইংরেজীতে রূপান্তরিত The Story of the Count of Monte Cristoসিংহমশায় হলের ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে আমাদের পুরো ‘ক্লাস’টিকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করলেন। সে এক দারুণ উত্তেজনা। সিনেমা তো কতই দেখি, বিশেষ করে ইংরেজী সিনেমা। কিন্তু সে তো বাবা-মা-দাদার সঙ্গে। স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে ছবি দেখা এক অভিনব ব্যাপার! দুর্ভাগ্যক্রমে ছবিটির print ছিল শতছিন্ন! যাবার উৎসাহ অনেকটাই ধাক্কা খেয়েছিল!

১৯৬৮ আমার ইংরেজী বই পড়ার ইতিহাসে এক অত গুরুত্বপূর্ণ বছর। সে বছরেই ‘মেট্রো’ সিনেমায় মুক্তি পায় ইংরেজী-বাংলা-হিন্দী মিলিয়ে যত ছবি দেখেছি, তার মধ্যে, আমার সবচেয়ে প্রিয় ছবি, ওয়াল্ট ডিজনির Mary Poppinsআমার সিনেমা দেখার স্মৃতিচারণে বলেছি যে মেট্রোতে ৬ হপ্তা চলাকালীন ছবিটি দেখতে যাই তিনবার! এর পরে বেরোই ছবি যে বইগুলি থেকে অনুপ্রাণিত, সেগুলির খোঁজে। সবার আগে পাওয়া গেল অধুনালুপ্ত ‘লাইটহাউস’ সিনেমার উল্টোদিকে ছোট কিন্তু বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘মডার্ন বুক ডিপো’য় Mary Poppins Comes Back, যেটি সিরিজের দ্বিতীয় বই। পড়ে দারুণ লাগল। ছবিটির শেষে মেরি পপিন্সের চলে যাওয়ায় আমার আজও চোখে জল আসে। বইতে দেখলাম সে আবার ফিরে এসেছে সেই Banks পরিবারে। এরপর দাদা জোগাড় করে এনে দিলেন প্রথম বই Mary Poppins, যার মলাটে আর পেছনে ছিল ছবিতে মেরি পপিন্সরূপিনী, এবং ততদিনে সকলের কাছে The Sound of Music-এর Maria-রূপে বিখ্যাত, Julie Andrews-এর ছবি। পড়ে দেখলাম যে প্রিয় ছবিটির কাহিনীর উপাদান মূলত এই প্রথম বইটি থেকেই নেওয়া ফুটপাথে আঁকা ছবির মধ্যে ঢুকে যাওয়া, মেরি পপিন্সের আত্মীয়ের বাড়িতে সিলিঙে বসে চা খাওয়া, ইত্যাদি। কিন্তু সিরিজে তো আরো দু’টি বই আছে!  এখানেই বিধি বাম! প্রথম বই দু’টি ‘পেপারব্যাক’ সংস্করণে কেনা, দাম ২ থেকে চার টাকার মধ্যে। আর পরের বইদু’টি ‘হার্ডব্যাক’, এক-একটির দাম ১২ টাকা ১৫ পয়সা! মনে রাখবেন, সালটা ১৯৬৮, তখন, যতদূর মনে আছে ভারতীয় ৯ টাকায় এক পাউন্ড (এখন বোধহয় ১০০ টাকায় পাউন্ড!)। উদাস নয়নে পার্ক স্ট্রীটের অধুনালুপ্ত ‘কেম্ব্রিজ বুক এ্যান্ড স্টেশনারি’র তাকে বইগুলির দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া গতি নেই!

বছর প্রায় শেষ, তখনকার স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী প্রতি শ্রেণীর প্রান্তিক পরীক্ষা হতো বছরের শেষে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। ষষ্ঠ শ্রেণীর বাৎসরিক ফলাফল বেরোল। মোটামুটি  ফল পেয়ে সপ্তম শ্রেণীতে ওঠার ছাড়পত্র পেলাম। পঞ্চম শ্রেণীর প্রান্তিক পরীক্ষার পর, ফল বেরোবার আগেই বাবা কলেজ স্ট্রীট চত্বর থেকে কিনে দিয়েছিলেন  একতাড়া হেমেন্দ্রকুমার (যার মধ্যে ছিল তাঁর ‘ড্রাকুলা’র রূপান্তর ‘বিশালগড়ের দুঃশাসন’), এবং এও বলেছিলেন, “ফেল করলে কিন্তু এই সব ফেরত দেব!” তা, সেবারেও ফেল আর করিনি, আর ষষ্ঠশ্রেণীর ফল হলো তুলনায় একটু ভাল (স্কুলে অষ্টম শ্রেণী অবধি আমার পরীক্ষার ফলাফল মধ্যমেধার দিকেই ইঙ্গিত করত)। তার ওপর ছেলে নিজের আগ্রহে পাঠ্যপুস্তকের বাইরে ইংরেজী গল্পের বই পড়ার আগ্রহ দেখাচ্ছে! অতএব পুরস্কার হিসেবে পেলাম ‘মেরি পপিন্স’ সিরিজের ৩য় ও ৪র্থ বই দু’টি – মোট ২৪ টাকা ৩০ পয়সা দামে!

এই বইগুলি নিয়ে কিছু কথা আছে। পরে জেনেছি যে অনেক বিদেশী লেখার মধ্যেই জাতি এবং বর্ণবিদ্বেষের প্রকাশ ঘটেছে। যেমন Mary Poppins Opens the Door বইয়ের আরম্ভেই চিমনি পরিস্কার করতে যে Chimney Sweep Banks-পরিবারের চেরি ট্রি লেনের বাড়িতে ঢুকেছে, বাড়ির দুই কাজের মহিলার মধ্যে একজন ক্ষেপে  গিয়ে বলছেন যে ওই ‘হটেনটট’ যদি বসবার ঘরে ঢোকে, তিনি তৎক্ষণাৎ কাজে জবাব দেবেন! কারণ স্পষ্ট, চিমনির ময়লা পরিস্কার করতে-করতে উক্ত স্বেতাঙ্গটির  শ্বেতবর্ণ কালিতে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। এরপর, রসিক sweep যখন জোর করেই ওই মহিলার সঙ্গে করমর্দন করেন, মহিলা চরম বিরূপতা প্রকাশ করে চেঁচিয়ে উঠছেন, “Let me go, you Hindoo!” অর্থাৎ, মহিলার ভূগোল জ্ঞান কালো রঙের সঙ্গে আফ্রিকা-এশিয়াকে এক করে ফেলেছে! আমার ব্যাপারটা খুব মজারই লেগেছিল। এখন শুনছি এই কথাগুলো নাকি বাদ দিয়ে বইগুলি ছাপা হয়। জানি না, এর কোন প্রয়োজন আছে কিনা! মহিলা চরিত্রটির জাতি ও বর্ণবিদ্বেষ যে লেখিকা (তিনি যে লেখিকা, লেখক নন, এটা জানতে অনেক বছর লেগেছে। এমনকি, সেই ৬৮ সালে Collins-এর প্রকাশিত hardback বইতেও কাহিনীকার P. L. Travers সম্বন্ধে ‘he’ সর্বনামটিই ব্যবহার করা হয়েছিল) সমর্থন করছেন না, বরং ব্যঙ্গ করছেন এটা অন্তত আমার কাছে তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।

আবার প্রথম বইতে একটি ঘটনা শুরু হচ্ছে চেরি ট্রি লেনে একটি গাভীর ঘুরে বেড়ানো দিয়ে। গল্পের শিশুরা অবাক হয়ে মেরি পপিন্সকে প্রশ্ন করছে যে গরু কীভাবে রাস্তায় ঘোরে! এখন ভাবুন, ১৯৬৮ সালে, কলকাতার রাস্তায় গরু ঘুরে  বেড়ানো খুবই সাধারণ দৃশ্য ছিল, এখনও যে তাদের রাস্তায় দেখা যায় না, তা নয়! আমি অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে রাস্তায় গরু দেখে শিশুরা অবাক হবে কেন!

এবার ১৯৬৯ সালে আমার হাতে এলো Five have a Wonderful Time – আমার দেখা Enid Blyton-এর প্রথম বই! আস্তে-আস্তে নেশা ধরল Famous Five-এর, এবং কিছু পরে আরও ভালো লেগে গেল Five Find-Outers and Dog-দের, তাদের গ্রামে একেকটি করে রহস্যভেদ। এটা অভিনব লেগেছিল, অপরাধের কিনারা  করছে জয়ন্ত বা হেমন্তর মতো প্রাপ্তবয়স্করা নয় – একদল স্কুলে পড়া ছেলেমেয়ে। তার মধ্যে সবচেয়ে তীক্ষ্নবুদ্ধি যে, তার নাম Frederick Algernon Trotteville (F A T), এবং তার নামের আদ্যাক্ষর মিলে যা হয়, সে তাইই – মোটা! পরে স্ত্রীর কাছে শুনেছি যে বাংলায় এই দ্বিতীয় পঞ্চম-ও-সারমেয় দলটির রূপান্তর করেছেন ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’দের মাধ্যমে।

 

(ক্রমশ)