প্রাচীন ভারতে শূদ্রেরা
(অনুবাদ: চন্দন দত্ত)
(নিম্নতর বর্গের আনুমানিক ৬০০ খৃষ্টাব্দের
পূর্বেকার এক সামাজিক ইতিহাস। ভারতের প্রথম সারির ইতিহাসবিদদের মধ্যে অন্যতম, প্রয়াত
শ্রদ্ধেয় রামশরণ শর্মা দ্বারা লিখিত ‘SUDRAS IN ANCIENT INDIA -- A Social
history of the lower order down to circa AD 600’ নামক প্রসিদ্ধ গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ।)
অধ্যায়
- ১
এই
ইতিহাস-রচনার প্রেক্ষাপট ও অভিমুখ
প্রাচীন ভারতীয় সমাজ-ব্যবস্থার আধুনিক
পর্যালোচনার বিষয়টি, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই সংক্রান্ত তৎকালীন প্রয়াসের কাছে
বিশেষ ভাবে ঋণী, কারণ এই দেশে নিজেদের শাসন ও নিয়ন্ত্রণ মজবুত করার স্বার্থে তারা
এখানে প্রাধান্য বিস্তারকারী বহিরাগত জনগোষ্ঠীটির প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি সমূহ সম্পর্কে
বিস্তারিত অধ্যয়ন ও জ্ঞান অর্জন করেছিল, যেটি বস্তুত প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের ভিত্তিভূমি।
'A Code of Gentoo Laws (1776)', যেটি এই সংক্রান্ত প্রাথমিক ইংরেজি রচনাগুলির মধ্যে
অন্যতম ছিল এবং যেটি সেই সময়কার ভারতীয় সমাজের প্রাথমিক অবস্থার ইতিহাস সম্পর্কে
যথার্থ ধারণা সংবলিত ছিল, তার মুখবন্ধে লেখা হয়েছে যে, ভারতে ব্যবসায়িক কর্মকান্ড
ও বাংলায় আমাদের প্রাদেশিক অবস্থানের সুযোগ-সুবিধার সদ্ব্যবহার করা যেতে পারে কেবলমাত্র
"সেই সমস্ত মৌলিক সংস্থাগুলির আস্থা অর্জন করার মাধ্যমে, যেগুলি এই দেশের বহিরাগত
দখলদারদের নিয়ম-নীতি ও স্বার্থের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখে"। আধুনিক
মতবাদের স্রষ্টা সদৃশ, স্যার উইলিয়াম জোন্স, তাঁর 'মনুস্মৃতি (১৭৯৪)'র অনুবাদের ভূমিকায়
সংযোজিত করেছেন যে --- যদি উক্ত কর্মনীতি বজায় রেখে চলা যায়, তবে 'কয়েক মিলিয়ন
হিন্দু জনগোষ্ঠীর সুনির্দিষ্ট ঔদ্যোগিকীকরণের পরিকল্পনা' প্রকৃতপক্ষে ব্যাপক হারে ব্রিটেনের
সম্পদ বৃদ্ধি করবে'। এর চার বছর পর, ১৭৯৮ সালে,
এইসব সূত্রের ওপর ভিত্তি করে, কলিব্রুক, 'Enumeration of Indian Classes' (ভারতীয়
শ্রেণীসমূহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ) নামক একটি প্রবন্ধ লেখেন, যে শ্রেণী বিভাজনকে তাঁর কাছে
ভারতীয় সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি বলে মনে হয়েছে। অতি শীঘ্রই, ১৮১৮ সালে,
এইসব তথ্যসূত্রের যথার্থ উপযোগের মাধ্যমে Mill (মিল), তাঁর History of India' নামক
বইয়ে, ভারতের এই জাতিবর্ণ প্রথাকে ব্যাখ্যা করেছেন। শূদ্রদের নানান অক্ষমতার কথা বিবৃত
করার সাথে সাথে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, জাতিগত অধীনতার বিদ্বেষবিষ-এর প্রয়োগ
অন্যান্যদের তুলনায় হিন্দুদের দ্বারা অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক মাত্রায় করা হয়েছিল এবং
মন্তব্য করেন যে, সেই পর্যায়ে ভারতে হিন্দুদের এক বীভৎস ও পশুতুল্য সমাজ-ব্যবস্থা বিদ্যমান
ছিল। কিন্ত একই সূত্র মারফত এলফিনস্টোন-এর
অনুমান ছিল যে, কিছু পুরাতন রিপাবলিকের ক্রীতদাসদের তুলনায় বা অবশ্যই মধ্যযুগের দুর্দশাগ্রস্তদের
তুলনায় অথবা অন্যান্য ক্রীতদাসতুল্য শ্রেণী, যেগুলির অস্তিত্ব বর্তমানে বিলুপ্ত হয়
গিয়েছে, তাদের তুলনায় শূদ্রদের অবস্থা যথেষ্ট ভাল ছিল।
নিঃসন্দেহে পুরাতন যুগের বেশ কিছু সামাজিক
কুপ্রথার অস্তিত্ব ঊনবিংশ শতাব্দীতেও বিদ্যমান ছিল। ফলে ইংল্যান্ডের উদীয়মান শিল্প
ভিত্তিক সমাজ এবং ভারতের পুরাতন ও ক্ষয়িষ্ণু সমাজের বৈপরিত্যের মধ্যে, সমাজের সেইসব
শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের মনোযোগ আকর্ষিত হয়েছিল, যাঁরা জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে আশ্লিষ্ট
ছিলেন। তাঁরা অনুভব করেছিলেন যে, সতীদাহ, আজীবন বৈধব্য, বাল্যবিবাহ এবং জাতিগত অন্তর্বিবাহ
প্রভৃতি নানান কুপ্রথা, জাতীয় অগ্রগতির পক্ষে এক বিরাট অন্তরায় স্বরূপ বিদ্যমান রয়ে
গিয়েছে। কিন্ত যেহেতু সেইসব কুপ্রথা টিকে ছিল ধর্মগ্রন্থের অনুমোদন সাপেক্ষে, সুতরাং
তাঁদের মধ্যে এই অনুভূতির উন্মেষ হয়েছিল যে, এইসব কুপ্রথার নিবারণ সম্ভবপর হতে পারে
একমাত্র ধর্মগ্রন্থের অন্যত্র উল্লেখিত অনুকূল কোনো নির্দেশের উপস্থাপনার মাধ্যমে।
এইভাবে ১৮১৮ সালে রামমোহন রায় তাঁর প্রথম সতীদাহ বিরোধী গবেষণামূলক পুস্তিকা প্রকাশ
করেন, যার মাধ্যমে তিনি সাব্যস্ত করেন যে, ধর্মশাস্ত্র অনুসারে 'সতীদাহ-প্রথা', নারী
জাতিকে রক্ষা করার শ্রেষ্ঠ উপায় নয়। একই শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
'মনুস্মৃতি' তোলপাড় ক'রে বিধবা বিবাহের সপক্ষে অন্য একটি সাকারাত্মক যুক্তি প্রতিষ্ঠিত
করেন। ১৮৭৯ সালে আর্য সমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ, 'সত্যার্থপ্রকাশ' নামক সংস্কৃত
পুঁথি থেকে নানান উদ্ধৃতি প্রকাশ করেন, বংশানুক্রমিক জাতিবর্ণ প্রথার বিপক্ষে এবং বিধবা
বিবাহ ও শূদ্রদের বৈদিক শিক্ষালাভের অধিকার প্রতিষ্ঠার সপক্ষে। একথা জানা নেই যে, বৃটিশ
স্কলার মুইয়ার (Muir) যে, তাঁর সমকালীন রচনাগুলিতে একথা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেছেন
যে, বহুযুগ ধরে চলে আসা চতুর্বর্ণ ব্যবস্থার প্রতি বিশ্বাস, প্রাচীন যুগে ছিল না, তার
থেকে ভারতের সমাজ সংস্কারকরা কতটা প্রেরণা
সঞ্চার করেছিলেন। একই ধারণার প্রকাশ দেখা গেছে জার্মান পন্ডিত ওয়েবার
(Weber)-এর লেখায়, যিনি ব্রাহ্মণ ও শূদ্রদের মধ্যে বিভাজনমূলক ভিত্তির ওপর টিকে থাকা
জাতিবর্ণ ব্যবস্থার ওপর সর্বপ্রথম একটি গুরুত্বপূর্ণ সমালোচনামূলক অধ্যয়ন প্রকাশ করেছেন।
১৮৯১ সালে, 'Age of Consent Bill'-এর
প্রবর্তন উপলক্ষে, স্যার আর জি ভান্ডারকর, একটি সুন্দর নথিভুক্ত ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রকাশ
করেন, যাতে তিনি সংস্কৃত নানান শ্লোক উপস্থাপিত করে এই বক্তব্য প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা
করেন যে, মেয়েদের বিবাহ একমাত্র পরিণত বয়সেই হওয়া উচিত। অন্যদিকে, বি জি তিলক, যাঁর
কাছে বৈদেশিক শাসকদের জন্য যে কোনো একটি লাঠিই যথেষ্ট ছিল, তিনি এই 'কনসেন্ট বিল'-এর
বিরোধিতায় পুরাতন পুঁথি থেকে নানান উদ্ধৃতি তুলে ধরেছিলেন।
আধুনিক
সংস্কারের সপক্ষে
প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ থেকে নানান উদ্ধৃতি
তুলে ধরার এই প্রবণতা-কে অত্যন্ত সুন্দরভাবে
বিবৃত করা যেতে পারে, আর জি ভান্ডারকর-এর ১৮৯৫ সালের এই মন্তব্য থেকে --- "প্রাচীন
কালে, মেয়েদের বিবাহ দেওয়া হতো পরিণত বয়স উত্তীর্ণ হওয়ার পর, বর্তমানে সেটি যেন
অবশ্যই হতে হবে তার পূর্বেই; অতীতে বিধবা বিবাহ ছিল একটি সাধারণ রীতি, এখন সেটি সম্পূর্ণরূপে
পরিত্যক্ত হয়েছে। ... অতীতে জাতিগুলির মধ্যে
সামুহিক-ভোজন নিষিদ্ধ ছিল না, অধুনা অসংখ্য জাতি সমূহের মধ্যে সেই পারস্পরিক আদানপ্রদান
সম্ভব নয়।"
কিন্ত অতীতের সামাজিক রীতি-নীতি সমূহকে
অধিক ফলদায়ক হিসেবে আধুনিক মস্তিষ্কে প্রেরণ
করার ভারতীয় বিদ্বজ্জনেদের প্রচেষ্টা, সবসময় পশ্চিমী লেখকদের প্রশংসা অর্জন করতে সক্ষম
হয়নি। যেমন সেনার্ট (Senart), ১৮৯৬ সালে সুনির্দিষ্ট করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, একমাত্র
ইংরেজি আবহে প্রতিপালিত হওয়া হিন্দুরাই ইউরোপীয়দের সামাজিক ভেদাভেদের সাথে ভারতীয়
জাতিভেদ প্রথার তুলনা করে, যদিও সেইসব তুলনাগুলি করা হয় ইউরোপীয় সামাজিক শ্রেণীগুলির
খুবই দূরবর্তী অবস্থান থেকে। একই ভাবে ১৮৮১ সালে হপকিন্স (Hopkins) বলেছিলেন যে, শূদ্রদের
অবস্থান, ১৮৬০ সালের আগেকার আমেরিকান গৃহ-ভৃত্যদের থেকে ভিন্ন ছিল না। হপকিন্সের এই
সাধারণীকরণের পর্যালোচনা করে ১৮৯৬ সালে হিলিব্র্যান্ট (Hilbrant) মন্তব্য করেছিলেন
যে, শূদ্রদের অবস্থান বিচার করা উচিত প্রাচীন যুগে পৃথিবী জুড়ে দাসেদের অবস্থানের
সাথে, পরবর্তী কালের বিকশিত হওয়া অবস্থার সাপেক্ষে নয়।
হপকিন্স-কে সমালোচনা করে ১৯১১ সালে কেতকার
অভিযোগ করেন যে, ইউরোপীয় লেখকরা নিগ্রোদের বিরুদ্ধে তাদের জাতিগত ভেদাভেদমূলক ধারণার
দ্বারা প্রভাবিত এবং সেইজন্য অসঙ্গত ভাবে তাঁরা ভারতের জাতিবর্ণ ব্যবস্থার প্রতি তাদের
আচরণকে অতিরঞ্জিত করে প্রকাশিত করেন। সমকালীন ভারতীয় লেখকদের, যেমন কেতকার, দত্ত,
ঘাউরি এবং অন্যান্যদের রচনায় প্রধানত যে প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে, তা হল, ব্যবস্থাটিকে
এমন ভাবে উপস্থাপিত করা যাতে বর্তমান প্রয়োজন সমূহের সাথে সেটিকে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে
পুনর্গঠিত করতে সাহায্য করা যেতে পারে। ফলে মনে হবে যেন প্রাচীন ভারতীয় সমাজের সমস্যাগুলি
বহুল পরিমাণে চর্চিত হয়েছে, গোঁড়া সনাতনপন্থী ও উদার সংস্কারবাদীদের সংগ্রামের পটভূমিকায়।
সংস্কারবাদী ও জাতীয়তাবাদীদের প্রভাবশালী অভিপ্রায় নিঃসন্দেহে ভারতের গোড়ার দিকের
সামাজিক জীবন সম্পর্কে মূল্যবান সব রচনাসমূহ উপস্থাপিত করেছে ; কিন্ত আধুনিক মানদন্ডের
তুলনায় যে বিষয়টি জোড়াতালি সদৃশ ও কদর্য বলে প্রতীয়মান হয়েছে, সেটি হচ্ছে কিছু
প্রশ্নের, হয় উপেক্ষা করা অথবা যুক্তিহীন ব্যাখ্যা প্রস্তুত করা। উদাহরণস্বরূপ, এমন
যুক্তিও পেশ করা হয়েছে যে, শূদ্রদের অক্ষমতা তাদের সুখী বা সুস্থিত জীবনকে ব্যাহত
করেনি।
পূর্বকালীন সামাজিক জীবনের কেবল সন্তোষজনক
দিকগুলির উপর মনযোগ কেন্দ্রীভূত করার উপরোল্লিখিত এই প্রবণতাই, প্রাচীন ভারতে শূদ্রদের
অবস্থান বিষয়ক কোনো মৌলিক রচনা প্রস্তুত না হওয়ার জন্য দায়ী। এমনকি ইউরোপীয় লেখকেরাও
তাঁদের মনযোগ কেন্দ্রীভূত করেছেন প্রধানত হিন্দু সমাজের উচ্চতর শ্রেণীর অবস্থান অধ্যয়নের
মধ্যেই। এইভাবে মুইয়ার, ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়দের সংগ্রামের ওপর লিখতে গিয়ে ১৮৮ পাতা
উৎসর্গীকৃত করেছেন কিংবদন্তীদের উপর, হপকিন্স ১৮৮৯ সালে, "প্রাচীন ভারতে শাসক
জাতির অবস্থা"(Position of Ruling Caste in Ancient India) শীর্ষক একটি সর্বাঙ্গীন
অধ্যয়ন উপহার দিয়েছেন। দক্ষিণ ভারতের সামাজিক সংগঠন সম্পর্কিত ১৮৯৭ সালে লেখা ফিক্
(Fick)-এর একটি প্রশংসনীয় রচনায়-ও বিষয়বস্ত সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে প্রধানত ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ ও গ্রহপতি বা সেঠদের আচরণ বিধির
মধ্যে। এটি ব্যাখ্যা করা নিতান্তই কঠিন যে, কেন নিম্নতর বর্গের জীবন-জীবিকা ও আশা আকাঙ্ক্ষার
প্রতি এই সমস্ত লেখকদের আগ্রহের এত অভাব ছিল, যদি না ধরে নেওয়া যায় যে তাঁদের নজর
সীমাবদ্ধ ছিল সেই যুগের প্রাধান্যবিস্তারকারী শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গির বেড়াজালের মধ্যে।
শূদ্রদের ওপর প্রথম স্বতন্ত্র ও সংক্ষিপ্ত
রচনাটি প্রস্তুত করেছিলেন ভি এস শাস্ত্রী, ১৯২২ সালে। তিনি 'শূদ্র' শব্দটির দার্শনিক
ভিত্তির ওপর আলোকপাত করেছিলেন। উক্ত বিষয়ে ১৯২৩ সালে আরেকটি রচনায় তিনি দেখানোর চেষ্টা
করেছেন যে, শূদ্ররা বৈদিক ধর্মানুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারতেন। শ্রীযুক্ত ঘোষাল, ১৯৪৭
সালে প্রকাশিত একটি পত্রিকায়, ধর্মশাস্ত্রে শূদ্রদের সামাজিক মর্যাদা সম্পর্কিত বিষয়ে
আলোচনা করেছেন। ১৯৫০ সালে রুশী লেখক, জি এফ ইলিন (G. F. Ilyin)-এর অত্যন্ত মূল্যবান
একটি রচনা প্রকাশিত হয়েছিল, যে রচনায় ধর্মশাস্ত্রের প্রামাণিক তথ্যের ভিত্তিতে উনি
দেখিয়েছিলেন যে, শূদ্ররা দাস ছিল না। শূদ্রদের ওপর বিশদ বিবরণ সম্পন্ন একমাত্র প্রবন্ধটি
(monograph) প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালে, একজন সুপরিচিত ভারতীয় রাজনীতিবিদ দ্বারা,
যিনি নিজের রচনার বিষয়বস্তু সীমাবদ্ধ রেখেছিলেন কেবল শূদ্রদের উৎসমূল-এর প্রশ্নে।
এই রচনায় লেখক তাঁর তথ্যসূত্রের জন্য সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন তাঁর পূর্বোক্ত লেখা, 'কারা ছিল
শূদ্র' (Ambedkar --- Who were the Sudras,) নামক প্রবন্ধের অনুবাদের উপর এবং এক্ষেত্রে
সবচেয়ে জঘন্য বিষয় যে, তিনি শূদ্রদের উচ্চতর উৎসমূলের বিষয়টি প্রমাণ করার সেই স্থির
প্রবণতা দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন, যে প্রবণতা বহুল পরিমাণে পরিলক্ষিত হতো তৎকালীন
নিম্ন জাতির শিক্ষিত শ্রেণীর মানুষজনের মধ্যে। "সতী পার্বন"-এর একটিমাত্র
প্যারাগ্রাফ, যাতে বিবৃত করা হয়েছে যে শূদ্রদের 'পাইজাভানা'য় পশুবলি সম্পাদিত করা
হতো, একমাত্র সেটিই ছিল তাদের কাছে এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করার পক্ষে যথেষ্ট যে, শূদ্ররা
ছিল মূলত ক্ষত্রিয়। পরিস্থিতিগত বিভিন্ন জটিলতাই যে শূদ্র নামক শ্রমজীবী শ্রেণীর উদ্ভবের
কারণ, লেখক সেই বিষয়টিকে ভ্রুক্ষেপের মধ্যে আনেননি। আমাদের আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত,
১৯৫৭ সালে প্রকাশিত, কে এম সারিন-এর 'Labour in ancient India' শীর্ষক একটি প্রকাশনা,
প্রাচীন ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানান তথ্যসমূহকে একত্রীভূত করেছে, কিন্ত তার দ্বারা
আমাদের জ্ঞানের পরিসরে নতুন কোনো গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন সাধিত হয়নি। এই বইয়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রাচীন ভারতের শ্রম সম্পর্কিত অর্থনৈতিক
পরিসরের বিষয়গুলির অন্বেষণ করা এবং সেই অন্বেষণে, আধুনিক মজুরি পর্ষদ (Modern
Wage-board), সালিশীকর্তা (Arbitrators) এবং সামাজিক সুরক্ষা (Social security) প্রভৃতি
অতীতের সমান্তরাল বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য রাখা, যদিও পরিশেষে এই উপলব্ধি হয়েছিল যে,
আধুনিকতার অভাবের কারণে এই কাজ যথেষ্ট ব্যহত হয়েছে। এছাড়াও, এই বই প্রধানত এই সিদ্ধান্ত
অনুমোদন করেছিল যে, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ত্রুটিপূর্ণ এবং এতে ঐতিহাসিক ধারণার অভাব
আছে।
বর্তমান রচনার উদ্দেশ্য, শুধুমাত্র প্রাচীন
কালে শূদ্রদের অবস্থা বিবরণের প্রতি সুবিচার করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং একই
সাথে, তাদের সাম্প্রতিক অবস্থার যে আধুনিক চিত্রায়ন করা হয়েছে --- সংস্কারপন্থী বা সংস্কারবিরোধীদের
প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, অপর্যাপ্ত পরিসংখ্যান পরিবেশন মারফত, তার একটি যথার্থ মূল্যায়ন
করার জন্যও। এই লক্ষ্যে, আনুমানিক ৬০০ খ্রীষ্টাব্দে, শূদ্রদের অবস্থার ক্ষেত্রে যে
নানান বিকাশ বা অগ্রগতি ঘটেছে, তার একটি নিয়মানুগ ও সুসংবদ্ধ বিবরণ পেশ করার চেষ্টা
করা হবে।
যেহেতু শূদ্ররা একটি শ্রমজীবী শ্রেণী
হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে, সুতরাং এই অধ্যয়নে, তাদের বস্তুগত অবস্থা এবং উচ্চতর বর্ণের
সাথে তাদের সামাজিক-অর্থনৈতিক সম্পর্কের চরিত্র ইত্যাদি বিষয়গুলি অনুসন্ধানের দিকে
বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায়, দাসেদের অবস্থা অধ্যয়নের বিষয়টিও স্বাভাবিক
ভাবেই এর সাথে সংযুক্ত হয়ে গেছে, যারা শূদ্রদের সমগোত্রীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। অস্পৃশ্যরাও
তাত্ত্বিক ভাবে এই শূদ্র বর্ণেরই অন্তর্গত এবং সেই কারণে তাদের উৎস ও অবস্থাও সমান
গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়েছে।
কিছু প্রশ্নের উত্থাপন ব্যতিরেকে প্রাচীন
ভারতীয় সমাজের নিম্নতম বর্গের অবস্থার অধ্যয়ন হতে পারে না। কী কারণে শূদ্র সম্প্রদায়ের
সৃষ্টি হয়েছিল? শূদ্রদের সৃষ্টি যদি উচ্চতর তিনটি বর্গের সেবার নিমিত্তই হয়ে থাকে,
তবে তাদের কি দাস হিসেবে পরিগণিত করা যায়? প্রাচীন ভারতীয় সমাজ কি দাস সমাজ ছিল?
শূদ্রদের ধার্মিক প্রতিষ্ঠা কি তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল? বিভিন্ন
সামাজিক কারণে গড়ে ওঠা পুনঃসংশোধিত ধার্মিক অংশসমূহ কি সমাজের নিম্নতম বর্গের অবস্থার
কোনো মৌলিক পরিবর্তন সাধনে সক্ষম হয়েছিল অথবা তারা কি অন্যান্য নানান সামাজিক কারণে
সঙ্ঘটিত বিভিন্ন পরিবর্তনকে ধারণ করতে বা স্থিরিকৃত করতে সচেষ্ট হয়েছিল? শতাব্দীর
পর শতাব্দী ধরে অর্থ ব্যবস্থায় নিম্নতর বর্গের ভূমিকার কী কোনো পরিবর্তন হয়েছে? এটি
কী করে সম্ভব যে দ্বিতীয় প্রজন্মের বৈশ্যরা শূদ্রদের পর্যায়ে হ্রস্বীকৃত
(reduced) হল এবং শূদ্রদের স্থান, বৈশ্যদের সমপর্যায়ে পরিগণিত হতে লাগল? আমাদের অধ্যয়ন
পর্বের শেষ দিকের ক্রীতদাস সুলভ পর্যায়ের বিস্তৃতি সম্পর্কিত ব্যাখ্যা কী ভাবে করা
যেতে পারে? শূদ্ররা কী প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল তাদের দাসত্ব ও অক্ষমতা সম্পর্কে?
তুলনামূলকভাবে প্রাচীন ভারতে, সামাজিক বিদ্রোহের অনুপস্থিতির কারণ কী? উক্ত রচনায়
এই সমস্ত বিষয়ের এবং অন্যান্য অনুরূপ সমস্যা সমূহের সমাধানের চেষ্টাই আমরা করেছি।
এই অধ্যয়ন অবশ্যই হতে হবে প্রধাণত পুঁথিগত
সূত্র ভিত্তিক, যার যথাযথ কাল নির্ধারিত করা এবং সেইসব সূত্রের নানান অংশ সমূহের কাল
নির্ধারিত করা অত্যন্ত বিভ্রান্তিকর একটি সমস্যা। আমরা এক্ষেত্রে পুঁথিগত সূত্র সমূহের
সাধারণভাবে স্বীকৃত কালপঞ্জী স্বীকার করে নিয়েছি, কিন্ত মতপার্থ্যক্যের ক্ষেত্রে আমরা
যথাযথ যুক্তি প্রদর্শন মারফত রীতিবিরুদ্ধ ভাবেও কাল নির্ধারণ করেছি।
রচনার বিষয়বস্ত যদিও নানান ভিন্ন ভিন্ন
পর্যায়ভুক্ত, কিন্ত সেগুলি বিরক্তিকরভাবে একই সূত্র ও পরিভাষাগুলিকে বারংবার উল্লেখিত
করে, যা সমাজের বিভিন্ন পরিবর্তনসমূহ চিহ্নিত করার বিষয়টিকে দূরূহ করে তোলে; সুতরাং
সেই সমস্ত বিভিন্ন রূপগুলিকে (variants) অনুধাবন করানোর ক্ষেত্রে বিশেষ মনযোগ দেওয়া
হয়েছে। এই সমস্ত পাঠ্যাংশের অনেকগুলি ভাষ্যকারের সাহায্য ছাড়া বোধগম্য হয় না, যে
ভাষ্যকারেরা আবার অনেক ক্ষেত্রেই নিজ কালের ধারণা সমূহকে পূর্বকালে অভিক্ষিপ্ত করে
থাকেন।
তদতিরিক্ত, পুঁথিগত বিষয়বস্তুসমূহ,
ব্রাহ্মণ্য হোক বা অব্রাহ্মণ্য, সেগুলি সমস্ত ক্ষেত্রেই ব্রাহ্মণদের বা ব্রাহ্মণ ও
ক্ষত্রিয়দের অথবা উভয়েরই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে উৎসুক থাকে এবং সেগুলি কষ্টসহকারেও
শূদ্রদের প্রতি কোনো সমবেদনা প্রকাশ করে না। সেক্ষেত্রে যুক্তি প্রতিষ্ঠা করা হয় যে,
ধর্মশাস্ত্র ও অন্যান্য সুক্তগুলি যেহেতু শূদ্রদের শত্রুদের দ্বারা লিখিত, সুতরাং এইসবের
কোনো প্রামাণিক মূল্য নেই। কিন্ত অন্যান্য প্রাচীন সমাজের আইনের পুস্তকগুলি, মুখ্য
শ্রেণী অধিনিয়মগুলির নীতিসমূহ-কে অনুসরণ করে, যেমনটি ধর্মশাস্ত্র করে থাকে; দুর্ভাগ্যজনক ভাবে, যথেষ্ট পরিসংখ্যানের অভাবে,
আমরা নিশ্চিত ক'রে বলতে পারি না যে ধর্মশাস্ত্র কতটা আইন অনুসরণ করে চলতো।
পৌরাণিক কথা এবং রীতি-রেওয়াজ, যেগুলি
দ্বারা পরিপূর্ণ থাকে প্রাচীন গ্রন্থ সমূহ, সেগুলি সামাজিক ইতিহাস পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে
নানান গুরুত্বপূর্ণ সূত্রের ভূমিকা পালন করে। সম্প্রতি, সমাজবিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রভাবিত
কিছু পশ্চিমী সংস্কৃত বিশারদ, এই পদ্ধতির বৈধতা সম্পর্কিত প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন।
তাঁরা ধর্মানুষ্ঠানগুলির (rituals) প্রতি নানান ধরনের প্রতীকী তাৎপর্য আরোপিত করেছেন
এবং এর কিছু সংখ্যক-কে সৃজন প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত করেছেন। আমরা আচার-অনুষ্ঠানের
উদ্ভাবনশীলতাকে অস্বীকার করতে পারি না, কিন্ত জেনে রাখতে হবে যে, সেগুলি উদ্ভিদ, পশু
ও মনুষ্য প্রজাতির উৎপাদনের গুরুত্বকে উপেক্ষা করে। নিত্য নৈমিত্তিক জীবনে আচার-অনুষ্ঠান
প্রক্রিয়া দেখিয়ে দেয় যে, সেগুলির উদ্ভব বাস্তবিকতায় এবং বাস্তব জীবনের পরিবর্তনের
সাথে সেগুলি পরিবর্তিত হয়। সুতরাং ঐতিহাসিকরা আচার অনুষ্ঠানের উপর অধ্যয়ন খারিজ করতে
পারেন না। বাস্তবতার কিছু ছিন্নাংশ পৌরাণিক কথা দিয়ে অস্বীকার করা যায় না। এটি নিশ্চিতই
কিছু সামাজিক প্রয়োজনের প্রত্যুত্তর ছিল যে, 'মহাভারত'-এর ৮৮০০ প্রাথমিক শ্লোক, প্রথমে
২৪০০০ শ্লোকে এবং পরিশেষে ১০০০০০ শ্লোকে উন্নীত করা হয়েছিল।
যেহেতু ধাতব জগতের বিকাশসমূহের থেকে
বিচ্ছিন্ন ভাবে সামাজিক শ্রেণীসমূহের ইতিহাস অনুসরণ করা যায় না, তাই ধাতব সংস্কৃতির
নানান পরিবর্তনসমূহের সময়কালের উল্লেখ করা হয়েছে, পুরাতত্ত্ব ও শিলালিপির কালক্রম
অনুসারে। সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পর্যায়ে, স্থিরিকৃত কৃষিজীবন, উদীয়মান বাণিজ্য
ও জমির অনুদান প্রভৃতির প্রতিক্রিয়া অনুসন্ধান করা হয়েছে এবং এইসবের পেশাগত ও স্থানিক গতিশীলতার তাৎপর্য আলোচনা
করা হয়েছে।
শূদ্রদের অবস্থান সম্পর্কিত নির্দিষ্ট
কিছু বিকাশের ব্যাখ্যা ও স্পষ্টিকরণের উদ্দেশ্যে, যেখানেই সম্ভব হয়েছে, সমগোত্রীয়
অন্যান্য প্রাচীন সমাজের বিকাশের সাথে এবং নৃতত্ত্ববিদ্যায় পরিচিত অন্যান্য প্রাচীন
জনগোষ্ঠীর সাথে তুলনা করা হয়েছে।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন