কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

নীতা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


জীবনখাতার অক্ষরলিপি আর মেয়েটা

সারাদিনের কাজের শেষে মেয়েটা যখন আকাশের দিকে তাকাতো, রক্তাক্ত সূর্য তখন পশ্চিমের  বিশাল শিমুল গাছটার ওপর দিয়ে যেতে যেতে সারা আকাশ আর শিমুল যুবতীদের লজ্জারুণ করে তার সারাদিনের কর্মভারাক্রান্ত শরীরটাকে স্নিগ্ধস্নানে ভরিয়ে দিতে সুবর্ণরেখা নদীর ভেতর ডুব দিয়েছে। মেয়েটার মন খারাপ হয়ে যেত। একটা পুরো দিন খরচ হয়ে যাওয়ার মনখারাপে আচ্ছন্ন হয়ে  উঠতো মেয়েটা। অস্তসূর্য দেখলে তখন কান্না পেত ওর। ওর যে ডুব দেওয়ার কোনো নদী ছিলো না। রাতের অন্ধকার ভয় দেখাতো ওকে। কাঁদতে কাঁদতে একদিন ঘুম ভেঙে দেখে খোলা জানালা দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঢেকে দিয়েছে ওর সারা শরীর। সেই আলো-রাত কান্না ভুলিয়ে দেয় ওর। চাঁদের আলোর আশকারা পেয়ে অক্ষর চিনতে শিখলো মেয়ে। দীর্ঘ ‘ঈ’ শিখলো যেদিন, সেদিন, কী  আশ্চর্য, ও একটা পথ দেখতে পেলো। বন পেরিয়ে গ্রাম পেরিয়ে দীর্ঘ সে পথ। যতদূর দেখার ইচ্ছে দেখে নিতে চাইলো মেয়েটা। অনুস্বরের সিংহকে সে আর ভয় পেলো না। কারণ বন্যপ্রাণীশংকুল জঙ্গলের মধ্যে সে ঋষিমশাইকে পদ্মাসন মুদ্রায় বসে  ধ্যান করতে দেখে নিয়েছে। ওর ধারণায় ঋষিমশাই পূজায় বসেন সকলের মঙ্গলের জন্য। তবে ও কেন কাঁদবে!

কাজের শেষে ‘ক’ লিখতে লিখতে মেয়ে কাক কোকিল কাকাতুয়া, আরো সব প্রহরী পাখিদের দেখতে পেলো, যারা ঋষিমশাইকে পাহারা দিয়ে চোখে চোখে রাখে। সিংহমশাইয়ের থাবা থেকে আগলে রাখে। সিংহকে তারা একটুও ভয় পায় না। ‘অ’ লিখতে লিখতে সেই অরণ্য বনাণী ও আগেই দেখে নিয়েছিলো। সেখানে হিংসা আর অহিংসার ভারসাম্য দেখেছিলো। সেখানে যেমন বুনোফুলের মিষ্টি গন্ধ, ঋষিতুল্য মানুষের শরীরের পূজাগন্ধ, ফলপাকুড়ের আনন্দগন্ধ, ঠিক তেমনই হিংস্র জন্তু, ততোধিক হিংস্র মানুষের নোংরাগন্ধ। কিন্তু সূর্য ডুবে গেলে সেখানে চাঁদ এসে, ধ্রুবতারা এসে এক আশ্চর্য আলো দেখায়। চাঁদকে ও নিত্যসঙ্গীই করতে চাইলো। কারণ মামাজাতীয় কেউ আসেনি ওর জীবনে। মামারা কেমন মানুষ ও জানে না। ধ্রুবতারাকেও তেমন বুঝতে পারে না মেয়ে। কোন পথ তার পথ হবে তা একটা তারা কি করে দেখাতে পারে? ওদের মতো মেয়েদের ডেস্টিনেসন বলে কি কিছু থাকে! ‘ধ্রুবতারা আমাদের জন্য নয়’, একথা নিজেই নিজেকে বলে, আর বিশ্বাসও করে।

রোজ রোজ প্রত্যেকটা অক্ষর ওকে বিশ্ব চেনায় আশ্চর্য কেতায়। ‘প’ লিখতে শিখে পাহাড় আর উচ্চতা শেখে মেয়েটা। কিছু কিছু মানুষকে সেই উচ্চতা দিয়ে মাপতে শেখে মনে মনে। ‘ফ’ লিখতে শিখে ফালতু ভয়গুলোকে উড়িয়ে দিতে  চাইলো। ভয় তো ও ‘ভ’ শেখার আগেই জেনেছিলো! বড় হতে হতে ভয়ের ভয়ঙ্করকে দেখতে পাচ্ছিলো প্রত্যেকদিন। ‘ব’ শিখে বরাভয়ের কিছু হাত ওর কাছে পৌঁছালেও সব হাতকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না মেয়েটা। ‘জ’এর জঙ্গল ওকে ভয়ের বদলে প্রকৃতিপাঠ শেখায়। মা শেখায়। প্রকৃতি মা। আনন্দে ও ‘স’ শিখতে শিখতে সমুদ্র দেখে ফেলে। পড়ে ফেলে তার উদাত্ত উত্তাল ঢেউ-এর স্বরলিপি, তার তুমুল আকর্ষণের রূপকথা, সঙ্গে সঙ্গে চোরা স্রোতের সাতকাহন। তাই ‘ন’ অক্ষর যেদিন ওকে নদী চেনালো, মেয়েটা সেদিন থেকে তার  জলঢেউ, রূপোলি মাছ, খেয়া পারাপার দেখতে দেখতে দীর্ঘ সময় নদীর সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে, নদীর দুপারের অবদান চিনতে চিনতে অন্যনদীর সাথে মিশে যাবার সমর্পণানন্দ শিখে নিলো। শরীরে মনে শিহরণ লাগলো তার। মেয়েটা তারপর রোজ নদীর সাথে হাঁটে। আর বুঝতে পারে, এতদিন ধরে নদী হতে চেয়েছিলো সে।

কেমন করে যেন ও বুঝতে পারলো বর্ণমালায় জীবন লেখা থাকে। নদী হয়ে বয়ে যেতে চাইলেও, ও কীভাবে যেন বুঝতে পেরছিলো নদীর বয়ে যাওয়া আর নারীর  বয়ে যাওয়া এক নয়। নদীর মত নিজের আনন্দে নারী বয়ে গেলে মস্ত মস্ত অন্ধকার গহ্বর তাকে গিলে নিতে এগিয়ে এগিয়ে আসে। নারী বয়ে গেলে সকলে তাকে নষ্টমেয়ে বলে। তাই বাঁধ দিয়ে রাখতে হয় নিজেকে। সংসারে নদীর মতো শস্-স্নেহ-ফল-জীবন সব দিয়েও তার নদী হয়ে ওঠার সম্মান অনেকেই পায় না।  সম্মান আর ভালবাসা যে একে অপরের পরিপূরক, তাও সে জেনে যায়। যেখানে সম্মান নেই, সেখানে ভালোবাসাও নেই।

‘ম’ অক্ষর তাকে মা শিখিয়েছিল, স্নেহের প্রথম সিঁড়ি শিখিয়েছিল, সেই তো কবেই! কিন্তু সে বড় ক্ষণকালের ছিলো। স্নেহ চলে গেলে সব আলো নিভে নিভে আসে, সেটাও সে অনুভব করেছে। ‘ভ’ অক্ষর শেখবার আগেই মেয়ে ‘ভয়’  চিনেছিলো। সে ছোট বয়েসের ভুতের ভয়। অক্ষরপরিচয়হীন মেয়েরও যে কীভাবে সিক্সথ সেন্স গ্রো করে! ‘ভ’ লিখে যেদিন বুঝলো সমাজের আনাচে  কানাচে যে ভয় নামের ভুত ওঁৎ পেতে থাকে তারা সবাই ছায়া নয়। ছায়া-ছায়া কল্পিত ভুতের স্বপ্নওম আর রহস্য-মজা ওকে ছেড়ে চলে গেলো, যেদিন থেকে টের পেলো জ্যান্ত ভুতের অস্তিত্ব। আর সেদিন  থেকে ‘স’এর কাছে সাহস প্রার্থনা করতে করতে সাহসী হয়ে ওঠবার আপ্রাণ চেষ্টা তার। বুঝল ‘সাহস’  জিনিসটার ভেতরও একটা আলো থাকে! আলো আরেকটু মজবুৎ হয়ে এসেছিলো কি মেয়ের কাছে! কেননা প্রার্থনা কার কাছে! মন্দিরে যে মূর্তি আছে তাদের ধাক্কা দিলেও নড়ে না। লোভের হাত থেকে তারা নিজেদেরই রক্ষা করতে পারে না! এখানে সেখানে যখন তখন শোনা যায় মন্দিরের অনড় মূর্তিদের সোনার মুকুট, রূপোর চোখ খোয়া গেছে। চোখ খুবলে নিলেও তাঁরা কিচ্ছু করতে পারে না। সাহস প্রার্থনা করতে যেতে হয় কিছু কালো হাতের দোজখে। ঈশ্বর এই মহার্ঘ জিনিষটা দিতে পারে না। 

মেয়ে বুঝতে পারলো ‘ম’ অক্ষর শুধু মা শেখায় না, মৃত্যুzone চিনতে শেখায় সন্তর্পণে। এত কিছু বুঝতে পেরে মেয়েটা বড্ড বেশি মা’মুখী হয়ে ওঠে তার মন  প্রাণ সর্বাঙ্গে। মায়ের স্পর্শ যেন এই মৃত্যুzone অনায়াসে পেরোনোর কৌশল-চিঠি নিয়ে আসবে। মেয়েটা বিশ্বাস করতে চায় সেই চিঠিতে থাকবে রাস্তা পেরোনোর পথনির্দেশিকা! সেই পথনির্দেশিকা সে সবসময় তার সাথে রেখে দেবে। যেন মায়ের স্নিগ্ধ হাতের যাদু। যাদু যেন হয়ে উঠবে জ্যান্তভুত রোখবার  মন্ত্র! সেই মহামন্ত্র আঁকড়ে চলতে চলতেও ক্রমশ বুঝতে পারে, ‘শ’ ‘ষ’ ‘স’ - এই তিন ভিন্নধর্মী অক্ষর চারদিক থেকে সঙ্গীন উঁচিয়ে ওকে যত্রতত্র  বিদ্ধ করবার সুযোগ খোঁজে। আর সেখান থেকেই মেয়ে মনে মনে জীবনের অর্থ খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে। বুঝতে শেখে, গতিই জীবন। সে জানতে শেখে, শুধু বেঁচে থাকাই জীবন নয়। জন্ম আর মৃত্যুর মধ্যে যে সময়, যে কালপ্রবাহ তা যতখানি অর্থবহ হয়ে ওঠে, তা’ই হচ্ছে জীবন। বাকি সব মরণ। তাতে কোনো কাব্য নেই।  কোনো কারুকাজ নেই। অক্ষরমালাকে জিন্দাবাদ দেয় মেয়েটা। প্রত্যেকটা অক্ষর জীবনকথামালার এক একটা গল্প হয়ে ওঠে ওর কাছে। মেয়েটা রোজ সেই গল্পের আপডেট ফলো করে…   

 

                              

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন