নিম বসন্ত
সকালের একটা মিষ্টি কুহু ডাকে কাকলির ঘুম ভাঙল। পাশেই শুভো কেমন অঘোরে ঘুমোচ্ছে, ঘুমোক! তাড়াতাড়ি টয়লেট সেরে ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে পাশের বাড়ির আমগাছের দিকে তাকাল। ভুরু কুঁচকে কোকিলটাকে খুঁজতে শুরু করল বটে, তবে তার পাত্তা পেল না। পাবে কেন, সে তো উড়ে গেছে তার সঙ্গিনীর খোঁজে! কাকলির মনটা কেমন আনন্দে ভরে উঠল। সকলকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করল- ‘তোমরা দেখ, আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’, কিন্তু কাকেই বা সকাল সকাল মনের এই ব্যাকুলতার কথা জানাবে? এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে পেল, প্রতিবেশিনী গীতা দেবী ব্যস্ত পায়ে এদিকেই আসছেন।
উৎসাহিত হয়ে কাকলি বলে, ‘দিদি কোথায় যাচ্ছেন?’
–
‘আর বলো না ভাই, যাচ্ছি নিমপাতার খোঁজে।’
–
‘ও, আচ্ছা, তা দেখুন না, চারিদিকে কেমন বসন্ত’
–
‘বসন্ত তো বটেই, জ্বলে পুড়ে মরছি। একটার পর একটাকে ধরছে।’
–
‘তাই তো ধরবে, ধরবে না? আমাকে, আপনাকে, সব্বাইকে ধরবে। ছোট, বড়ো সব্বাইকে না ধরলে কি তার চলবে?’
– ‘তার মানে? কী বাজে কথা বলছ? সাত সকালে বাসি মুখে
এমন অলুক্ষুণে কথা!’
‘কী
যে বলেন, এই যে কেমন পলাশ শিমূলের রক্তরাগে মন রাঙিয়ে দেওয়া, আমগাছের কচি পাতার আড়ালে কোকিলের কুহু ডাক, সকাল বেলার মিঠে
হাওয়া - এসব কি কিছুই না?’
সব
শুনে গীতা দেবী ভাবেন, দূর, এর আবার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি! তারপর বিরক্ত মুখে হাত
নেড়ে বলেন, ‘আচ্ছা ভাই, আমার তাড়া আছে চলি।
নিমের ডাল যোগাড় করতে হবে।’
কাকলির মনে প্রশ্ন জাগে। আচ্ছা, নিম পাতার দরকার পড়ল কোন সুবাদে? ও হরি, এখন কচি কচি নিমপাতা ভাজা আলুসিদ্ধ দিয়ে, গরম ভাতে মেখে খেতে দারুণ লাগে। হায় হায় হায়, আমার বাড়ির পিছনেই তো মাঝারি মাপের একটা নিমগাছ আছে। সেখান থেকে না হয় পেড়েই দিতাম কটা ছোট ছোট ডাল। আর সেই ফাঁকেই না হয় আমার এই পাগল পারা মনের কথা শুনিয়ে দিতাম। তা নয়, চলেই গেল! দূর দূর, আমি নিজে মহিলা হলে কী হবে, এ পাড়ার বয়স্ক মহিলারা বড্ড বেরসিক, এ সব বুঝতেই চায় না! এসব ফিলিংস পুরুষ মানুষের সঙ্গেই শেয়ার করতে হয়। ঐ তো নিখিলবাবু আসছেন। বেশ মানুষটি, কেতাদুরস্ত, কথা বার্তায় পরিশীলিত। বাড়ির সামনে দিয়েই যাবেন, পাশেই দুধের ডিপো থেকে দুধ আনতে। মনের ব্যাকুল, আকুল, বসন্ত ব্যাকুলতার কথাটা ওকেই জানাতে হবে।
– ‘এই যে নিখিলবাবু, ভাল আছেন?’
–
‘ভাল আর আপনারা থাকতে দিলেন কোথায়! এই দেখুন না, দু হাতে বাজারের থলি, এ সব আর ভাল লাগে না!’
-‘এ
তো ঠিক কথাই বলেছেন। সকালের এমন ঠান্ডা দখিনা বাতাস, ঝকঝকে আকাশ, রেডিওতে কণিকার রবীন্দ্রসঙ্গীত,
আর আপনি…’
–
আমি, আমি কী? বাজারের থলির ভারে বলে কুঁজো হয়ে যাচ্ছি, এখনও দুধ নিতে হবে, আর একগোছা
নিমপাতা। আমি চলি মিসেস মুখার্জি, এই বলে প্রায় ছুটে বাড়ির সামনে দিয়ে চলে যান।
ইস্, ইনিও নিমপাতার খোঁজ করছেন? আমার বাড়ির গাছ থেকে ওঁকেও তো নিমপাতা পেড়ে দিতে পারতাম! তারপর না হয়, ড্রয়িংরুমে বসিয়ে এক কাপ চা দিয়ে আমার মনের এই ব্যাকুল ব্যাকুল বসন্ত বিধুরতার কথা জানাতে পারতাম। কিছুই তো হল না বলা, ঐ রবীন্দ্রনাথ আর কি! এমন সময় রাঁধুনি মানদা কলিংবেল বাজায়। বিরক্ত কাকলি ব্যাজার বদনে দরজা খুলে দিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফায় ধপ করে বসে পড়ে, আর আপন মনে গেয়ে ওঠে – ‘শোন গো দখিন হাওয়া, প্রেম করেছি আমি।’ এই গান শুনে মানদার তো গালে হাত। বিরক্ত চোখে মুখ বেঁকিয়ে কাকলিকে বলে,
–
‘মাসীমা কী কী রান্না হবে বলে দিন তাড়াতাড়ি।’
–
‘কেন, এত তাড়া কিসের, ঘোড়ায় জিন লাগিয়ে এসেছিস মনে হচ্ছে? শুনতে পাচ্ছিস না গান গাইছি?’
–
‘তা তো শুনতেই পাচ্ছি। তা মাসিমা এই বয়সে এ সব প্রেমের ঢেউ খেলানো গান নাই বা গাইলেন।
ও সব ছেলে ছোকরারা গায়, ঠিক আছে। দু দিন বাদে ঘরে ছেলের বউ আসবে, আর আপনি এই সব অসৈরণ
গান গাইছেন!’
–‘তাতে
তোর কী রে মানদা?’
–
‘আমার আবার কী, তাড়াতাড়ি রান্না সেরে বাজার যেতে হবে, ছেলের আজ নিম হলুদের চান আছে।’
–‘ঐ
দ্যাখ, তুইও বলছিস তো হলুদের কথা। বসন্তের রঙইতো হলুদ রে! বুদ্ধদেব গুহর উপন্যাস,
‘হলুদ বসন্ত’।
–
‘মা গো মাসীমার এ কী হল! যাই ফিরিজ থেকে এক বোতল ঠান্ডা জল নিয়ে আসি। মাথায়
ঢালতে হবে।’
মানদা ঠান্ডা জল আনতে যায়। আর সেই ফাঁকে কাকলি বান্ধবী দীপালিদির নম্বরে ফোন লাগায়, আশা করে ওপার থেকে দীপালিদি উচ্চ কণ্ঠে বলে উঠবে, ‘কী রে কাকলী, কেমন আছিস?’ তা নয়, ‘কী গো কেমন আছো’ জিজ্ঞেস করতেই, করুণ স্বরে দীপালিদি চিনচিন নাকি মিনমিন করে বলে ওঠে, ‘বল কাকলী, কী বলবি?’ কাকলী অবাক হয়ে যায়, নিরুত্তাপ কণ্ঠস্বরে। তবু গলায় আবেগ ঢেলে এক কলি গেয়ে ওঠে ‘আজি এ বসন্তে কত’, মাঝপথে গান থামিয়ে দিয়ে দীপালিদি বলে, ‘হ্যাঁ রে, তাই তো খাচ্ছি’।
–
‘কী?’
-‘নিমের
সরবৎ, চারিদিকে যা বসন্ত!’
ফাটাফাটি
উত্তরমুছুন