কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

শতাব্দী দাশ

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১০৬


শূন্যপুর ১৩

নামঘরে খোল কোলে ঢুলছে দুলাল। আজকাল হাতে বোল খ্যালে না৷ সুবলের দোকানও খোলে না হপ্তাখানেক। সেও দাওয়ায় ঝিমুচ্ছে এখন।

আঞ্জুমবিবি এল বৌমাকে নিয়ে। লাঠি ঠুকে জন্মান্ধ কৈবল্য। ধনঞ্জয়ের পিঠ বেঁকে গেছে, ধরে আনছে ছেলে। কে কে বাকি বটে? শ্রীপতি কাকা নিজেই আসেনি। আসার পথে ঢুঁ মেরেছিল দুলাল। কাকার থেকে নামঘরের চাবি নিয়ে দরজা খুলে সে-ই বসেছিল প্রথম।

অ্যাসবেস্টসে ছাওয়া চারদেওয়াল, সিমেন্টের প্রলেপবিহীন। মেঝেটা মেটে। সন্ধেয় নামগান হত। দুলালের খোল। শ্রীপতি হারমোনিয়ামে। কত্তাল তুলে নিত সুবল। শাঁখে-ফুঁ-দেওয়া-বেলায় কীর্তন জমে উঠত। 'রাধাগোবিন্দের নামটি বদনে লয়ে / নয়ননীরে সদা ভাসো রে…'

কাকার গলা বুজে আসত। রিডের উপর আঙুল কাঁপত থরোথরো। মাথা ঝাঁকিয়ে বাজাত দুলাল। হরিমতি খুড়ি তখন চাটাইয়ে বসে হাউহাউ কাঁদছে। পিঠে হাত বোলাচ্ছে কপিলা।

খুড়ি মারা গেছে গত বছর, ভাগ্যিস! কপিলা বিহু পরবে গেছিল, ফেরে নাই। সিলেটের বর্ডার থেকে দিয়ে গেল মিলিটারি। এখন আলুথালু ঘুরে বেড়ায়। একে তাকে শুধোয়, 'নাম আছে?'

মধু ডাক্তার ঢোকে। ডাক্তারবাবুর বড়ছেলে বাদ পড়েছে কীভাবে যেন! আর চাকা ঠেলতে ঠেলতে নিজেই নিজের হুইলচেয়ারখানা নিয়ে…. অংশুরও নাম নাই! কীভাবে হাজিরা দেবে ট্রাইবুনালে? হুইলচেয়াল ঠেলে শ’মাইল পাড়ি দেওয়া যায়?

কথাবার্তা শুরু হয়। ষড় করেছে পাশের গাঁ, কেউ বলে। এতজন বাদ! তাও যদি ইয়ে হত! যেমন মোল্লাখালি। দশজনে সাতজন বাদ। তবু ওরা  মোসলমান, এ'গাঁয়ে এত বাদ কেন?

ডাক্তারবাবু বলে, কাগজ তৈরির নানা দোকান গজিয়েছে শহরে। বানিয়ে দেবে ডকুমেন্ট, যেমনটি চাও। কয়েক হাজার নেবে জনপ্রতি। মোল্লাখালির কথা শুনে সিঁটিয়ে গেছিল আঞ্জুমবিবি। এখন চোখ গোল করে বলে, 'আমাগো আটজন! এত টাহা কোতা পাইমু?'

শ্রীপতি আসে সব শেষে। মনে পড়ে দুলালের, ওর নাম আছে কি নাই, জিজ্ঞাসা করা হয়নি৷ কাকার কেউ নাই এ'গাঁয়ে। ভাইয়ের হাতে মার খেয়ে মধু ডাক্তারকে দেখাতে এসেছিল চা-বাগান হাসপাতালে। স্টিচ পড়েছিল। গাঁয়ে ফিরলে ভাই জ্যান্ত রাখবে না, শুনে ডাক্তার নিয়ে এসেছিল। ক্ষেতে কাজে লাগিয়েছিল। কাজ সেরে নামঘর। গলাখানা শোনার পর ধন্য ধন্য পড়ল। সকলের জোটানো টাকায় একখান মাটিরঘর তুলে খাটিয়া নিয়ে উঠে গেল শ্রীপতি, ডাক্তারেরই দেওয়া দেড় কাঠায়। নামঘরের চাবি তার কাছেই থাকে।

এমন প্রশান্তি নিয়ে ঢুকল শ্রীপতি, যেন এখনই গেয়ে উঠবে দু’কলি। টুপ করে  বসে পড়ল দুলাল আর সুবলের মাঝে। ডাক্তার বলল, 'তোমার নাম? গিয়াসিলা কম্পুটার দোকান?'

মিটিমিটি হাসি।

'দেহি নাই। এপ্লাইও করি নাই৷'

ঘরে বাজ পড়ে। পাগল বাড়ল বুঝি গাঁয়ে?

'দুইখান কাগজ বাপ দেসিল। দলিল। জমির। আমার নামে। সেজন্যি ভায়ে মাথা ফাটাইল। কাগজের ফিকিরে আমি নাই।'

হাঁইহাঁই করে দুলাল। ডাক্তারবাবু বোঝায় হাত নেড়ে। শ্রীপতির মুখে একই হাসি। 'রাধাগোবিন্দের খাতায় সবার নাম আসে। কপিলারও, আঞ্জুমবিবিরও।'

সুবল বলে, 'পাগল হইস। ফুল ম্যাড!'

ঘর ফাটিয়ে হেসে ওঠে শ্রীপতি। কেঁপে ওঠে দেশ, সীমান্ত।

 'ক্যাডা পাগল? আমি না ওরা? ভাবতাসি।'

 

 

 

 

 

 


1 কমেন্টস্:

  1. সীমান্তের জটিলতা, না কি এন আর সি র রাজনীতি? সত্যিই তো মানুষের প্রকৃত পৃথিবীতে কোন সীমান্ত নেই! ভালো লাগলো।

    উত্তরমুছুন