কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

মধুবাণী ঘোষ

 

ভালোবাসার কথা বলতে এলাম : প্রাণের মানুষ ৬




আমট্র্যাক রেল কোম্পানির  লেক-শোর লিমিটেড-এ তিন রকমের যাত্রাব্যবস্থা  রয়েছে। এক: চেয়ার কার। এটি সবচেয়ে পকেটবন্ধু হলেও রাত্রিযাপনের জন্য প্রশস্ত নয়। ঘুমন্ত অবস্থায় জনসমক্ষে সুদৃশ্যমান এবং সুশ্রাব্য হবার বয়স অতিক্রান্ত। দুই: রুমেট (Roomette)। খরচের দিক দিয়ে মধ্যপথালম্বী হলেও ঘরটির প্রস্থ চার ফুটেরও কম। এই ঘরে দুজন যাত্রী নীচ ওপর করে যেতে পারে। তবে তাদের অবয়ব উচ্চিংড়ের মত হলে সুবিধে হয়। ঘরটির দরজা বন্ধ করা যায় তাই একটা নিভৃত অবস্থান রয়েছে। তিন: এছাড়া রয়েছে বিভিন্ন সাইজের বেডরুম এবং সঙ্গে  এটাচড বাথরুম, তবে তার দাম আকাশছোঁয়া।

ভারতীয় রেলের মতো সুলভ দরে সার্বজনীন স্লীপার কারের ব্যবস্থা এখানে নেই কারণ ঝট করে কোথাও যেতে গেলে সস্তায় গন্ডায় প্লেনে যাওয়া যায় আর ঢিমে তেতালায় বেড়াতে যেতে গেলে চমৎকার রাস্তা দিয়ে গাড়িতে যাওয়া যায়।  নিতান্ত নিম্ন মধ্যবিত্তেরও একটা অন্তত গাড়ি থাকে। অতএব ট্রেনে সফরের খদ্দেরও তেমন নেই। যারা নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করেন বা করতেন তাদের  মধ্যে অন্যতম হল বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ১৯৭২ সালে একটি গাড়ি দুর্ঘটনায় তার মেয়ে ও প্রথম স্ত্রীর মৃত্যু হয়। ছোট ছোট ছেলেরাও গুরুতর আহত। প্রতি রাতে তাই সেনেটর  বাবাকে ছেলেদের কাছে ফিরতে হতো। পরবর্তী ৩৬ বছর বাইডেন আমট্র্যাক ট্রেনে চেয়ার কারে ওয়াশিংটন ডিসি আর ডেলাওয়ার ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতেন বলে তার নাম দেওয়া হয়েছিল 'আমট্র্যাক জো'। ওনার জীবনের চারটে বছর তিনি ট্রেনেই কাটিয়েছেন। অতএব এদেশে যারা নিয়মিত ট্রেনে যাতায়াত করে অথবা  দূরপাল্লার সফরে ট্রেন বেছে নেয়,  তারা খানিকটা চেনা ছকের বাইরের মানুষ। খরিদ্দার কম অতএব ট্রেনে সুলভ দরে সার্বজনীন  স্লীপার কারের ব্যবস্থা নেই।

আমি ট্রেনে উঠে টিকিট দেখাতেই কন্ডাক্টার আমাকে একটা বাঁদিকের রুমেট দেখিয়ে দিলেন। ঐটিই আমার জন্য নির্দিষ্ট। কিন্তু ম্যাপ অনুযায়ী সিরাকিউস থেকে শিকাগো যেতে জলাশয়গুলি সব ডানদিকে পড়বে।

'Sir, could I please have a roomette  on the right side? I would like to see the lakes.'

'Very well.But we will pass most of them at night'

এটা শুনে খুব  মুষড়ে পড়লাম! এর চেয়ে আমার মাথায় এক বালতি লেকের জল ঢেলে  দিতে পারতেন! আমি ওনার দিকে ঠায় চেয়ে রইলাম।

'Er.....do you want your bed turned down?'

'Yes please.'

উনি বসবার সিটকে ঝটপট একটা ধবধবে সাদা বিছানার চেহারা দিলেন, আর আমাকে দু বোতল খাবার জল দিয়ে বললেন 'Good night Madam. We serve breakfast from 6:30 AM in the Cafe car.'

'Good night.'

আমি দরজা বন্ধ করে দিলাম। ৬.৫' বাই  ৩.৫' এক চিলতে একটা ঘর। সেটিকে যথাসম্ভব সফরবন্ধু করে গোছানো হয়েছে। ঘরের মধ্যে একটি ঢাকা দেওয়া কমোড রয়েছে যেটাকে নিষ্কর্ম সময়ে একটা টেবিল হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এই ম্লেচ্ছপনা দেখে আমার ঠাকুমা কি বলতেন মনে করে খুব খানিকটা হেসে নিয়ে গভীর রাতে লেক-এর পাশ দিয়ে যাবার দুঃখ খানিকটা ভুললাম। এরপর আবার বাবা রামদেবের মত কসরত করে ওই চিলতে ঘরে পোশাক পাল্টে, বেসিনে দাঁত মেজে বিছানায় আধশোয়া হয়ে জানালার বাইরের আলো অন্ধকারের সঙ্গে আলাপচারিতা।

পিছনে ফেলে আসা শহরের মানুষগুলির কথা, তাদের মুখগুলি, তাদের অভিব্যক্তিগুলি, জানালার বাইরে অন্য ট্র্যাকে বিপরীতগামী পুবমুখো ট্রেনের মতো দ্রুতগতিতে সরে সরে যাচ্ছে। আমি চলেছি একাকী পশ্চিমে…

‘যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা--

নয়নে আঁধার রবে, ধেয়ানে আলোকরেখা।

সারাদিন সঙ্গোপনে সুধারস ঢালবে মনে

পরানের পদ্মবনে বিরহের বীণাপাণি’।

ভোরবেলা, মুখে আলো পড়তেই ঘুম ভাঙলো। চোখ মেলে বাইরে চেয়ে দেখি প্রথম আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ সবুজ ভুট্টার ক্ষেত। তার মাঝে লম্বা লম্বা শস্য মজুত করবার সাইলো। ট্রেনের আওয়াজে চমকে উঠে দৌড়ে পালাচ্ছে সোনার হরিণের পাল। সে যে কী সুন্দর!

একটা স্টেশনের  সাইনবোর্ডে দেখলাম লেখা আছে পুলাস্কি টাউনশিপ, ওহায়ো। এমনি করে ট্রেন পেরোলো ওয়াটারলু, ইন্ডিয়ানা, এল্কহার্ট, ইন্ডিয়ানা এবং আরও কত ছোট ছোট স্টেশন। ছোট স্টেশনে লেক-শোর লিমিটেড থামে না, ওই এক পলকের একটু দেখায় মিলিয়ে যায় কত না নতুন শহর আর শহরতলি। সব দেখলাম তবে জানালার ঠিক বাইরে মাইলের পর মাইল জলাশয় অদেখাই  থেকে গেল…

‘যখন এসেছিলে অন্ধকারে

চাঁদ ওঠে নি সিন্ধুপারে।

হে অজানা, তোমায় তবে জেনেছিলেম অনুভবে-

গানে তোমার পরশখানি বেজেছিল প্রাণের তারে।

তুমি গেলে যখন একলা চলে

চাঁদ উঠেছে রাতের কোলে।

তখন দেখি, পথের কাছে মালা তোমার পড়ে আছে-

বুঝেছিলাম অনুমানে এ কণ্ঠহার দিলে কারে।

যখন এসেছিলে অন্ধকারে

চাঁদ ওঠেনি সিন্ধুপারে’।

সকাল সাড়ে নটায় ট্রেন পৌঁছবে শিকাগো ইউনিয়ন স্টেশন। সেখানে আমাকে নিতে আসবেন মোহিতের বাবা মা, মদন এবং অনিতা মানোচা। আমি অনেকবার বলেছিলাম যে আমি একটা ট্যাক্সি ধরে ওনাদের বাড়ি পৌঁছে যাবো,  কিন্তু মানোচা দম্পতি মানলেন না। তারা আমাকে জানালেন যে ঠিক সময়ে তারা  শিকাগো ইউনিয়ন স্টেশনা থাকবেন। আমিও অগত্যা কাফে কারে ব্রেকফাস্ট সেরে জিনিসপত্র গুছিয়ে রেডি।

ইন্ডিয়ানা থেকে ইলিনয় যাবার পথে এক বিশাল কয়লাবাহী মালগাড়ি আমাদের ট্রেনের সামনে পড়ল। ব্যাস আর যায় কোথা! আমাদের পৌঁছনোর সময় পেছোতে শুরু করল। ... ৯:৩০ থেকে ১০:১৮, ১০:৪৯, ১০:৫৬, ১১:১২...

আমার পীড়াপীড়িতে অগত্যা মানোচা দম্পতি বাড়ি ফিরে গেলেন। মালগাড়ি তার গন্তব্যস্থানে বেঁকে গেলো, লেক-শোর লিমিটেড ১১:৩০ নাগাদ শিকাগো ইউনিয়ন স্টেশন পৌঁছলো আর আমি একটা উবের ধরলাম।

এলমহার্স্ট টাউনে ওদের বাড়ির সামনে উবের থামতেই বেরিয়ে এলেন মদন মানোচা। আমাকে না নিয়ে ফিরে আসার জন্য বিশেষভাবে বিব্রত। আমার জিনিসপত্র নিয়ে ভেতরে গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলেন। অনিতা আমার দুটি হাত ধরে বললেন, 'Madhubani ji... we are so sorry to have left without you. There is no parking just outside the station and the police wanted us to leave and not park there anymore. Please make yourself comfortable. I will make you some fresh parathas.'

'Anitaji, Madanji, It is wonderful to meet you. Thank you so much for  hosting me at such short notice. It was lovely to spend some time with Mohit and Shriddha. They send you their regards.'

ছেলে বৌ-এর নাম শুনে ওদের মুখদুটো মমতায় নরম। ...মা বাবারা সবখানে একই ধাতুতে গড়া। ফ্রেশ পরাঠা শব্দদুটি আমার কানে বাঁশির মতো বাজলো। মোহিত বলেছিলো যে ওর মা ফাটাফাটি স্টাফড পরোটা বানান। তবে পাঞ্জাবী শুনলেই যেমন মনের ভেতরে তান্দুরি চিকেন ঘুরঘুর করে ওরা  তেমন পাঞ্জাবী নন। ঘোর নিরামিষাশী। হাত মুখ ধুয়ে পরনে একটা কুটুমবাড়ি স্পেশাল  সালোয়ার কামিজ চড়িয়ে খেতে এলাম। কী যে যত্ন করে আমাকে গরম গরম  বাড়ির তৈরী ঘিয়ে ভাজা মেথি পরোটা, আচার আর ঘরে পাতা দই খাওয়ালেন তা আর কী বলবো! উনি মদনজিকে আপনি করে সম্বোধন করছিলেন আর  'রাজা' বলে ডাকছিলেন। আমি মনোযোগ দিয়ে ফ্রেশ পরাঠা খেতে খেতে কান খাড়া করে সব শুনছিলাম। ওরা পরস্পরের সঙ্গে হিন্দীতে কথা বলছিলেন আর আমার সঙ্গে ইংরেজিতে। ভাষাগত বিভেদ ঘোচাতে আমিও হিন্দীতে কথা কইতে লাগলাম।

''अरे  मधुबाणीजी, आप हिन्दी कहाँ से सीखें?'

'अनीता जी, वो   अपने  राजेश खन्ना से'

এই কথায় আমরা তিনজনেই খুব খ্যাক খ্যাক করে হাসতে লাগলাম আর নতুন আলাপের সমস্ত জড়তা কটি পতং হয়ে জানালার বাইরে দিয়ে উড়ে গেল। একটা দিন কেমন হুশ করে কেটে গেলো । ওনাদের সঙ্গ আমাকে অনেকটা পথের রসদ জুগিয়ে দিল যেন।

পরদিন সকালে ভোর ভোর উঠে স্নান সেরে, জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে পড়তে হল। সকাল ৯টায় শিকাগো বিমানবন্দরের থ্রিফটি কার রেন্টালে অপেক্ষা করছে Nissan Rogue SUV. মানোচা দম্পতি এর আগে কাউকে দেখেননি যে কিনা এমন একটা সফরের পরিকল্পনা করেছে। বেয়ান সম্পর্কীয় কাউকে তো দূরস্থান! আমাকে বিমানবন্দরে পৌঁছনোর সময় ওদের চোখে মুখেও চিন্তার ছায়া। এতগুলো মানুষকে চিন্তায় ফেলতে খারাপ লাগছিলো ঠিকই... তবে ওই যে ঋজুকে বলেছিলাম...

'The road is calling me. I have to go.'

এ বড় অমোঘ টান।

বেয়াই বেয়ানকে বিদায় জানিয়ে হাতে গড়ানো ছোট সুটকেস, পিঠে ব্যাকপ্যাক আর গলায় বটুয়া ঝুলিয়ে ঠিক সময়ে পৌঁছে গেলাম থ্রিফটি কার রেন্টালের কাউন্টারে। সামনে জনা তিনেক যাত্রী। আমার সময় এলে, কাগজপত্র দেখে নিয়ে, টাকা পয়সা বুঝে নিয়ে  কাউন্টারের লাল জামাপরা ভদ্রলোক বললেন,

'Here are your papers. Take a left turn and go through the sliding doors. You will find your car in the reserved slot number 967. Your keys are in the car. Safe Travels!’

ইন্টারস্টেট ৯০ হলো আমেরিকার দীর্ঘতম হাইওয়ে। ৩০২২.৪৪ মাইল (৪৮৬১ কিঃ মিঃ) লম্বা এই পথ বস্টন থেকে সিয়াটল অবধি এই দেশটাকে যেন বুক বরাবর চিরে ফেলেছে। পশ্চিমদিকে এই পথ একেবারে কন্টিনেন্টাল ডিভাইডের ওপর দিয়ে যায়। এই একটি পথ ধরেই সূর্যাস্তের আলোর দিশায় পৌঁছে যাব সিয়াটল... এমনটাই মনস্থ করেছিলাম। যেহেতু আমি শিকাগো অবধি ট্রেনে করে এসেছি তাই আমি যদি সোজা নাক বরাবর যাই তাহলে আমাকে কেবল ২০৪৩ মাইল (৩২৮৮ কিঃ মিঃ) গাড়ি চালাতে হবে। তবে  সোজা পথে গেলে ইয়েলোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক পড়বে না।  ওয়াইওমিং দিয়ে যাবো আর ইয়েলোস্টোন ন্যাশানাল পার্ক দেখবো না... তাও কি হয়? তাই মাঝে মাঝেই ইচ্ছেমতন ইন্টারস্টেট ৯০ থেকে সরে গিয়েছি, পথ হারিয়েছি, পথ খুঁজে আবার ফিরে এসেছি...

গাড়ি বলত  'রিক্যালকুলেটিং'...

'সোজা পথের ধাঁধাঁয় আমি অনেক ধেঁধেছি

পথ হারাব বলেই এবার পথে নেমেছি'

তা আমি তো থ্রিফটি কার রেন্টালের কাগজপত্র নিয়ে বাঁদিকের স্লাইডিং ডোর পেরিয়ে শিকাগো এয়ারপোর্টের বিশাল রেন্টাল কার পার্ক এরিয়ায় এসেছি। দেখি চারিদিকে যেদিকে দুচোখ যায় সারি সারি গাড়ি। মেঝেতে সাদা কালিতে স্লট নাম্বার লেখা রয়েছে। প্রথমেই দেখলাম ২০৫। তাই যুক্তিমতো যেদিকে নম্বর বাড়ছে আমি সেইদিকে মালপত্র নিয়ে হাঁটা দিয়েছি। ৩০৯... ৪২০... ৫৫৫...  এইসব দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছি হঠাৎ  ৮০০র ঘরে পৌঁছে দেখি  থ্রিফটি কার রেন্টালের গাড়ি আর নেই... অন্য কোম্পানির গাড়ি রাখা আছে। আমার নির্দিষ্ট ৯৬৭ স্লট কোত্থাও নেই। এই দেখে তো আমার কানের মধ্যে একটা মশার আওয়াজ বিন বিন করতে লেগেছে। আমি একটা বোকা গুবরেপোকার মতো হাতে চাকাওয়ালা সুটকেস, পিঠে ব্যাকপ্যাক আর গলায় বটুয়া ঝুলিয়ে সারা কারপার্ক ঘুরে বেড়াতে লাগলাম! অবশেষে থ্রিফটি কার রেন্টাল লেখা জামা গায়ে এক বৃদ্ধ  আটেনড্যান্টের দেখা পেলাম। তাকে প্রশ্ন  করতে তিনি বললেন, 

'Oh... you are in the wrong area ... 967 will be in the Reserved car section. Here, let me take you there.'

'Thank you!'

আমি বাধ্য মেয়ের মতো ওনার পেছন পেছন লটবহর নিয়ে রিসার্ভড সেকশানে স্লট ৯৬৭এ  তাকে দেখলাম ... আমার পার্থসারথি ... আমার পথের কান্ডারী  Nissan Rogue SUV.  আমার সেডানের তুলনায় বেশ একটা জাহাজের মতো গাড়ি। পামেলা বলেছিল এইটেই ভালো হবে। ধাক্কাধুককি হলে লাগবে কম, লম্বা সফরে ব্যথাবেদনাও হবে কম। এইবার একটু নার্ভাস লাগছিল। এতদিন আত্মীয় পরিজনের মধ্যে ছিলাম, ট্রেনের সুরক্ষিত পরনির্ভর অবস্থানে ছিলাম। এইবার বুঝি ছত্রধরের ওভারটাইম ডিউটি শুরু হলো!

'গিরি সংকট, ভীরু যাত্রীরা গুরু গরজায় বাজ,

পশ্চাৎ-পথ-যাত্রীর মনে সন্দেহ জাগে আজ!

কান্ডারী! তুমি ভুলিবে কি পথ? ত্যজিবে কি পথ-মাঝ?

করে হানাহানি, তবু চলো টানি, নিয়াছ যে মহাভার!'

গাড়ি খোলাই ছিল। মালপত্র  ঠিকমত রেখে সামনের ড্রাইভার্স সিটে  বসে মনে হল কেমন একটা যেন দোতলায় বসেছি। প্রথমেই যে গন্ডগোলটা হল তা হচ্ছে চাবি খুঁজে না পাওয়া। সামনের ড্যাশবোর্ডে দেখলাম, পাশের গ্লাভ বক্সে দেখলাম, দরজার খোপে দেখলাম ... কোথাও নেই। সেই বৃদ্ধ  আটেনড্যান্টের আর দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার কানের মধ্যে একটা মশার আওয়াজ বিন বিন করতে লেগেছে। এমন সময় দেখি ঠিক উইন্ড স্ক্রিনের সামনেই চাবিটা রাখা আছে। স্টিয়ারিং হুইলের পেছনে ছিল বলে দেখতে পাইনি। বুঝলাম বেশ ঘাবড়েছি। সহজ জিনিস কঠিন ঠেকছে। কয়েক ঢোক জল খেয়ে একটু স্থিতু হলাম। ঠোঁটের ওপরে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছিলো। মুখ মুছে এবার গাড়ির ভেতরটা চিনতে চেষ্টা করলাম। এ গাড়ির গিয়ার ব্যবস্থা আমারটির চেয়ে আলাদা। দেশে যে মারুতি ভ্যান চালাতাম অনেকটা তার মতো...  স্টিকশিফট  তবে অটোম্যাটিক ট্রান্সমিশন। গাড়ির আয়নাগুলি আমার সুবিধে অনুযায়ী গুছিয়ে নিলাম। এইবার আমার ফোনের সঙ্গে গাড়ির ব্লু টুথ সংযুক্ত করলেই গুগল ম্যাপ হবে দিশারী  এবং আই টিউন হবে নেপথ্য সঙ্গীত পরিচালক।

এইখানেও খানিক জল ঘোলা হল। গাড়ি জানালো যে সে পূর্ববর্তী এতো ব্লু টুথের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছে যে আর কোনো নতুন প্রেমিক গ্রহণযোগ্য নয়। গুগলে ভিডিও দেখে শিখে নিলাম এই মডেলের গাড়িতে কী করে পুরনো প্রেম মুছে ফেলে নতুনভাবে সংযুক্ত হওয়া যায়। এতক্ষণে প্রায় কুড়ি মিনিট অতিক্রান্ত। সেই বৃদ্ধ  আটেনড্যান্ট একবার ঘুরে ঘুরে আমাকে দেখে গেলেন। বোধহয় ভাবলেন যে  এই ভদ্রমহিলা থ্রিফটি রেন্টালের কার পার্কে বসে থাকার জন্যেই গাড়ি ভাড়া করেছেন! আমি খুটখাট করে  চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

'মিলন হবে কত দিনে

আমার মনের মানুষের সনে।

চাতক প্রায় অহর্নিশি

চেয়ে আছি কালো শশী

হব বলে চরণ দাসী,

ও তা হয় না কপাল গুণে।

মিলন হবে কত দিনে

আমার মনের মানুষের সনে’।

 

অবশেষে ইয়ে যাকে বলে... মিলন হল!

 

'শেষে দিলেন রা

পাগল ছাড়ো পা'

আমার ফোনের সঙ্গে গাড়ি কথা কইল। আমি পরবর্তী ঠিকানা তাকে জানালাম। তিনি বললেন, 'এখন থেকে ৭ ঘন্টা মতো ঠিকঠাক গাড়ি চালালে, তোমাকে পৌঁছে দেব।'

ঠিক করলাম আমার পার্থসারথির একটা নাম দেব। Nissan Rogue SUVর ভেতরে একটা দুর্বিনীত দস্যুভাব আছে। যে কোনো মুহূর্তে 'কিতনে আদমি থে ?' শুধিয়ে গুলিগোলা চলতে পারে। সেটা বেশ একটা বাজে ব্যাপার হবে। এতটা পথ একসঙ্গে যাওয়া যাবে না । তাই ভক্ষক থেকে রক্ষকে রূপান্তর ঘটাতে আমি তার নাম দিলাম বাজ বাহাদুর। মালওয়া রাজ্যের শেষ সুলতান, রানী রূপমতীর প্রেমিক, গান আর কবিতা ভালোবাসা যুদ্ধবিমুখ এক রাজা। মধ্যপ্রদেশের মান্ডু শহরে যার প্রেমকথা এখনো লোকের মুখে মুখে ঘোরে।

গাড়ি স্টার্ট দিলাম। পথ বলে দিচ্ছে বাজ বাহাদুর। সিকুরিটি গেট পার করে শিকাগোর পথে নামলো গাড়ি। ধীরে ধীরে ইন্টারস্টেট ৯০ ধরলাম। খেয়াল করলাম দু হাতে শক্ত করে স্টিয়ারিং ধরে গাড়ি চালাচ্ছি... বুঝলাম এখনো ত্রস্ত হয়ে রয়েছি। বাজ বাহাদুরের সঙ্গে প্রথম প্রথম আলাপ কিনা! মুচকি হেসে একটা  হাত স্টিয়ারিং থেকে সরিয়ে আমার গানের ঝুলি থেকে একটা গান বের করে ওকে শোনাতে বললাম। এখন একটু হেলান দিয়ে বসেছি, পথচলতি শহুরে দৃশ্য খেয়াল করছি, একাত্ম হচ্ছি এই সফরের সঙ্গে... বাজ বাহাদুর গাইছে-

'ও মন কখন শুরু, কখন যে শেষ, কে জানে?

এ যে বাজিকরের খেলারে মন যার খেলা হয় সে জানে’।

 

(ক্রমশ)


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন