কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শনিবার, ১৫ জুলাই, ২০২৩

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 

কালিমাটি অনলাইন / ১১৫ / একাদশ বর্ষ : পঞ্চম সংখ্যা




জনপ্রিয় সোশাল মিডিয়া ফেসবুকের সদস্যসংখ্যা অগণিত। আমার পরিচিত এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর, যার ফেসবুক একাউন্ট নেই। আমার নিজের তো আছেই। তবে ফেসবুক সদস্য হলেই যে সবাই সমান সক্রিয়, তা একেবারেই নয়। বরং বলা যেতে পারে, অধিকাংশ সদস্যই কম-বেশি নিষ্ক্রিয়। তাঁরা কেন যে একাউন্ট খুলেছেন, তা সম্ভবত তাঁরাও ঠিক জানেন না। অনেক ক্ষেত্রেই অনেকে একাউন্ট খোলার পর বার কয়েক চোখ বুলিয়ে আর উৎসাহ ধরে রাখতে পারেন না। পরবর্তীতে আর নিজের টাইমলাইন খোলার আগ্রহ থাকে না। অথচ যেহেতু তাঁরা নিজেদের সদস্যতা ইন-অ্যাকটিভ বা ডিলিট করেন না, তাই জায়গা জুড়ে বসে থাকেন। তাঁদের বন্ধুদের বন্ধুসংখ্যা কিছুতেই হ্রাস হতে দেন না। বন্ধুরা ভাবেন, তাঁদের বন্ধুভাগ্য ভালো, প্রায় পাঁচহাজার বন্ধু (ফেসবুকে সবারই সর্বোচ্চ পাঁচহাজার বন্ধুই অনুমোদিত) তাঁদের যাবতীয় পোস্ট করা মেসেজ, ছবি, ভিডিও দেখছেন, তা কিন্তু আদৌ ঠিক নয়। সেই পাঁচহাজারের মধ্যে খুব কম সংখ্যক বন্ধুর কাছে তা পৌঁছচ্ছে, বাকিদের কাছে  পৌঁছলেও তাঁরা দেখছেন না আদৌ। আবার যাঁরা দেখছেন, তাঁরা সেই মেসেজগুলো পড়ার বা ছবি-ভিডিও দেখার জন্য সক্রিয় হচ্ছেন, এমন নাও হতে পারে। আমরা প্রায় সবাই কোনো একটা কিছু নিজের টাইমলাইনে পোস্ট করে অপেক্ষায় থাকি, কতগুলো লাইক পড়ল এবং কতজন তাঁদের অভিমত জানালেন, সেই সংখ্যা গণনার জন্য। বলা বাহুল্য, যাঁরা লাইক দিচ্ছেন, তাঁরা কতটা লাইক করে লাইক দিচ্ছেন তা জানার কোনো উপায় নেই। তবে তাঁদের মেসেজ বা ছবি দেখে ভালো লেগেছে, তাই তাঁরা লাইক বাটন ক্লিক করেছেন, তা না হতেই পারে। কেননা, অনেকেরই অন্যের পোস্টে লাইক দেবার একটা অভ্যাস বা বাতিক আছে। সেটা তাঁরা মেসেজ না পড়েও দিয়ে থাকেন এবং পরিচিত বন্ধু, তাই দিয়ে থাকেন। অর্থাৎ ব্যাপারটা দাঁড়াচ্ছে এই, কোনো পোস্টের তলায় লাইকের সংখ্যা গণনা করে নিশ্চিত হওয়া যায় না যে, সেই পোস্টটি একটি উল্লেখযোগ্য পোস্ট। বিশেষত এমনও হামেশাই দেখা যায়, সত্যি সত্যিই কোনো প্রয়োজনীয়, গুরুত্বপূর্ণ, তথ্য ও তত্ত্ববহুল কোনো পোস্টের নিচে লাইকের সংখ্যা নিতান্তই হাতেগোণা। কারও কোনো অভিমত নেই বললেই চলে। মানে, যাঁরা ফেসবুক পেজ খুলেছিলেন, তাঁরা সেই পোস্টের প্রতি আদৌ মনোযোগী হননি বা গুরুত্ব দেননি। বিপরীতে অবশ্য এটাও দেখা যায় যে, কোনো কম গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ বা ছবি ভাইরাল হয়েছে। পাতি কথায় বলা যেতে পারে, মেসেজ বা ছবিটা দারুণ হিট করেছে। আগে কোনো চলচ্চিত্র জনপ্রিয় ও হাউসফুল হলে এবং বেশিদিন সিনেমা হলগুলোতে প্রদর্শিত হলে এই ‘হিট’ শব্দটি সেই চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হতো। আর সেই হিট ছবি দেখার জন্য সিনেমাহলে প্রবেশের টিকিট চড়া দামে ‘ব্ল্যাক’ হতো। যাইহোক সে অন্য প্রসঙ্গ। কিন্তু একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, ফেসবুক আজ সবথেকে প্রয়োজনীয় ও শক্তিশালী সোশ্যাল মিডিয়া, যার মাধ্যমে আমরা আমাদের যাবতীয় চিন্তাভাবনা, তথ্য ও তত্ত্ব, সৃষ্টি ও সৃজনসংবাদ এবং উপাদান ছড়িয়ে দিতে পারছি সারা বিশ্বময়। বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী অদেখা, অচেনা, অজানা মানুষদের সঙ্গে। অনুভব করার সুযোগ পাচ্ছি বৃহত্তর মন ও মানসিকতার। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, বিগত দশ বছর আগে ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের সূচনা করে তা ফেসবুকের মাধ্যমে সবার সামনে উপস্থাপন করেছিলাম। ইতিমধ্যে তার ১১৫টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে, বিশ্বের ৮০টিরও বেশি দেশে তা পঠিত হচ্ছে, এবং এই মুহূর্তে সম্পাদকীয় লেখার সময় তার ক্লিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬ লক্ষ ৭০ হাজার ৮৬০। প্রতিদিন এই সংখ্যা নিরন্তর বেড়েই চলেছে। এবং তা একমাত্র সম্ভব হচ্ছে ফেসবুকে ব্লগজিনের প্রতিটি সংখ্যার কথা পরিবেশনা করার কারণে। 

সবাই ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, এই আন্তরিক কামনা।

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ : Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

 


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 

কথনবিশ্ব 


শময়িতা চক্রবর্তী

 

চেক কমিউনিস্ট আগ্রাসনের নিন্দার জন্য দেশ ছাড়লেও আপোস করেননি

(৯৪ বছর বয়সে প্যারিসে প্রয়াত মিলান কুন্দেরা)




শ্লেষ আর হিউমার, তীর্যক ব্যাঙ্গাত্মক ভাষায় অসাধারণ গদ্য। বারবার নোবেলের জন্য মনোনীত কিন্তু পুরস্কার মেলে না। বিখ্যাত চেক সাহিত্যিক মিলান কুন্দেরা নোবেল প্রাইজকে যেন ঠাট্টা করেই প্রয়াত হলেন ৯৪ বছর বয়সে। তাঁকে পুরস্কৃত করতে না পারায় যেন খর্ব হল নোবেল কমিটির সম্মান। চেক  প্রজাতন্ত্রের মোরাভিয়ান লাইব্রেরি বুধবার তাঁর মৃত্যুসংবাদ জানায়। কুন্দেরার ব্যক্তিগত সংগ্রহ নিয়ে গড়ে উঠেছে এই মোরাভিয়ান লাইব্রেরি। এই লাইব্রেরির মুখপাত্র আনা ম্রাজোভা বলেছেন, দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে কুন্দেরা মঙ্গলবার প্যারিসে মারা গিয়েছেন।

কাফকাকাম্যুসার্ত্র-এর পর পশ্চিমের যে ঔপন্যাসিক ত্রয়ী গোটা বিশ্বে সবচেয়ে আলোচিত, তাঁদের অন্যতম ছিলেন কুন্দেরা। ইতালো ক্যালভিনো এবং টমাস বার্নহার্ডের পাশাপাশি। অবশ্য কুন্দেরা শুধু একজন মহৎ ঔপন্যাসিকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন বিশ্বমানের একজন উপন্যাসতাত্ত্বিকও। কুন্দেরা সারাজীবন ধরে যা লিখেছেন, তা লিখে কখনই নোবেল পাওয়া যায় না। নোবেল না পাওয়ার জন্য যে  ধরনের লেখা জরুরি, কুন্দেরা ঠিক তাই লিখে গিয়েছেন আজীবন।

শুরুর দিকেও কুন্দেরা গল্প লিখেছেন, তাঁর দেশের কমিউনিস্ট স্বৈরাচারকে প্রকাশ্যে, গোটা বিশ্বের নজরে নিয়ে এসেছেন, এই অব্দি ঠিকই ছিল। কিন্তু প্রথম বইটির পরই, ঠিক ক্যালভিনো এবং বার্নহার্ডের মতোই তিনি গল্প বলার রাস্তা থেকে পুরোপুরি সরে এলেন।

তিনি ফর্ম এবং কনটেন্ট নিয়ে যথেচ্ছভাবে পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করলেন। রাজনীতি এবং যৌনতা হয়ে উঠল তাঁর লেখার মূল দুটি বিষয়। তাঁর লেখা ক্রমেই হয়ে উঠল আরো বেশি করে সেরিব্রাল। তিনি ভোলত্যের বা দিদেরোর মতো ফিলোজফিক্যাল ন্যারেটিভ লিখতে শুরু করলেন। এই ধরনের পরীক্ষামূলক লেখা কখনই নোবেলের জন্য বিবেচিত হতে পারে না। অন্তত নোবেলের ইতিহাস তাই বলে। নোবেল যাঁরা উপন্যাস লিখে পেয়েছেন, তাঁরা গল্প বলেই পেয়েছেন, গল্পকে ভেঙেচুরে তছনছ করে নয়।

১৯২৯ সালে কুন্দেরার জন্ম চেকোস্লোভাকিয়ার বার্নো শহরে। তাঁর বাবা লুডভিক কুন্দেরা ছিলেন খ্যাতনামী পিয়ানোবাদক ও সঙ্গীততত্ত্ববিদ। বাবার হাত ধরেই সঙ্গীতশিল্পে হাতেখড়ি তাঁর।

প্রাথমিক ভাবে সঙ্গীতের শিক্ষা লাভ করলেও পরে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন লেখালেখিতেই। আধুনিক কাফকা আখ্যা দেওয়া হয় তাঁকে। ১৯৪৮-এ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন কুন্দেরা। কিন্তু  ১৯৫০-এই পার্টি থেকে তাঁকে বিতাড়িত করা হয় কমিউনিজ়ম-বিরোধী কার্যকলাপের জন্য। সেই সময়  প্রাগে পাঠরত ছিলেন মিলান। স্নাতক হওয়ার পর সেই শহরেই অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হন। ১৯৫৬-এ তাঁকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়া হলেও ১৯৭০ সালে আবার তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৭৫ সালে দেশ থেকেও বিতাড়িত হন তিনি এবং ফ্রান্সে বসবাস করতে শুরু। পরে চেক নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হলেও নিজেকে ফরাসি লেখক হিসাবে পরিচয় দিতেই পছন্দ করতেন কুন্দেরা।

কুন্দেরা কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ-সহ সাহিত্যের প্রায় সব শাখাতেই তাঁর অবদান রেখেছেন। তবে, তাঁর প্রসিদ্ধি মূলত ঔপন্যাসিক বা আখ্যানকার হিসেবেই। তাঁর প্রথম উপন্যাস 'দ্য জোক' প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালে। সেখানে তৎকালীন চেকোস্লোভাক কমিউনিস্ট শাসনের রূঢ় ছবি তুলে ধরেন তিনি। ১৯৬৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের সমালোচনা করার জন্য তাঁকে একঘরে করা হয়। ১৯৭৫ সালে ফ্রান্সে চলে আসেন তিনি। প্রথমদিকের লেখালিখিতে তীব্র রাজনৈতিক বক্তব্য থাকলেও আর্ট  অফ দ্য নভেল গ্রন্থে নিজেকে তিনি ইউরোপীয় নবজাগরণ পর্বের সাহিত্যের উত্তরাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করেন।

১৯৮৪ সালে 'দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং' উপন্যাসটি প্রকাশিত হলে বিশ্ব-সাহিত্যমহলে আলোড়ন পড়ে যায় তাঁকে ও তাঁর লেখা নিয়ে। ১৯৮৮ সালে তাঁর এই উপন্যাস নিয়ে হলিউড ছবিও বানায়। কুন্দেরা পরিচিত হতে শুরু করেন ‘দার্শনিক লেখক’ হিসাবে। তাঁর পূর্ববর্তী রচনা ‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ থেকেই রেনেসাঁসের আমলের লেখক সেরভান্তিস, জিওভান্নি বোকাচ্চিও বা  ৱ্যাবলের প্রভাব তাঁর রচনায় স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। তিনি নিজে সে কথা স্বীকারও করেন। আর এক ফরাসি ঔপন্যাসিক বালজাকের মতো জীবনের নানা দিককে ব্যাঙ্গাত্মক দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখেছেন তিনি। ‘ইম্মর্টালিটি’, ‘আইডেন্টিটি’ বা ‘ইগনোর‌্যান্স’ উপন্যাসে তিনি এই আখ্যান কৌশল এবং দর্শনকেই আরও  বিস্তীর্ণ এলাকায় নিয়ে যান। লেখালিখি তো বটেই, প্রকাশনা নিয়েও বেশ খুঁতখুঁতে ছিলেন। একাধিক বইয়ের প্রচ্ছদও এঁকেছেন কুন্দেরা।

কুন্দেরার রচনায় স্বৈরশাসন বা স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার বিরুদ্ধে বারবার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছে। তবে সেই প্রতিবাদ কখনই সরব ছিল না। নিজের আদৰ্শ পাঠকদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয়, বরং নিস্পৃহ ভঙ্গীতে স্বেচ্ছাচারের বিবরণ দিতেন। ২০০৮ সালে তাঁর বিরুদ্ধে চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট সরকারের চরবৃত্তির অভিযোগও ওঠে। তবে তাঁর রচনার মতো এই সব অভিযোগকে তিনি শ্লেষের সঙ্গেই উড়িয়ে দেন। ২০১৯ সালে তাঁকে চেকোস্লোভাকিয়ার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁর নিজের শহর বার্নোতে মিলান কুন্দেরা লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু জন্মভূমিতে আর কোনোদিন ফেরেননি কুন্দেরা। জীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন কুন্দেরা। ১৯৮৫ সালে তিনি জেরুজ়ালেম পুরস্কার পান। ১৯৮৭তে পান তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘দি আর্ট অফ নভেল-এর জন্য পান অস্ট্রিয়ার স্টেট প্রাইজ ফর ইউরোপিয়ান লিটারেচার। ২০২০ সালে তাঁকে ফ্রান্জ কাফকা পুরস্কার প্রদান করে তাঁর দেশ চেকোস্লোভাকিয়া।


প্রদোষ ভট্টাচার্য

 

কলকাতায় বাংলা ছবির ‘মুক্তি-শৃঙ্খল’ ষষ্ঠ পর্ব

 

(কলকাতায় বাংলা ছবির একক প্রেক্ষাগৃহ)

 

পাঁচ পর্ব লেখা হলো, প্রথমে ত্রয়ী প্রেক্ষাগৃহ যেখানে বাংলা ছবি মুক্তি পেত, এবং তারপর যুগল প্রেক্ষাগৃহ নিয়ে। এবার বলব কিছু একক প্রেক্ষাগৃহের কথা।

 

বসুশ্রী

 


ভবানীপুর-কালিঘাট অঞ্চলে হাজরা রোড আর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় রোড চৌমাথার কাছে বসুশ্রী যুক্ত ছিল উত্তর কলকাতার ঠনঠনে কালিবাড়ী সংলগ্ন বীণা সিনেমা হলের সঙ্গে। আমি কোনদিন বীণায় ঢুকিনি, আর যবে থেকে (১৯৭৬-এর মাঝামাঝি) কলেজ স্ট্রীট-বিধান সরণী দিয়ে যাতায়াত শুরু করেছি, বীণাতে শুধু হিন্দী ছবির প্রদর্শনই চোখে পড়েছে। তাই শুধু বসুশ্রীর কথাই হবে।

মা’র স্মৃতিচারণের খাতায় দেখছি ১৯৬২ সালে বসুশ্রীতে ‘তরণীসেন বধ’ ছবির কথা। ছোট পিসেমশাই বসুশ্রীতে ‘তরণীসেন বধ’ দেখিয়েছিলেন। রামভক্ত তরণী রামের দিকে তীর ছুঁড়লেন, আর সেই তীর রামের গলায় লেগে মালা হয়ে গেল – এ দৃশ্য আজও চোখে ভাসে। আর রামের হাতে তরণীর মৃত্যু একেবারেই মেনে নিতে পারিনি। মন এতটাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে মা কৃত্তিবাসের ছন্দ অনুসরণ করে ‘তরণীসেনের পুনর্জীবন লাভ’ নামে একখানা গল্প লিখে,আমাকে শুনিয়ে মন ভালো করার চেষ্টা করেছিলেন! আর ঐ  বছরের ১৬ই সেপ্টেম্বর তারিখ দিয়ে মা লিখছেন যে বাড়ীতে ছবির দৃশ্য অভিনয় করছি। মা’র ভাষাতেই শুনুনঃ ‘ধনুক-বাণ নিয়ে প্রদীপকে [আমার ১০ বছরের বড়দাদা] বলা হল, “এই বাণে আমি তোকে সংহার করব!” কিন্তু বাণ ছুঁড়তে পারল না, প্রদীপ হেসে ফেলায় বল্লে – “শিখিয়ে দিবি তো, হাসচিস্ কেন?”

এরপর ১৯৬৫ সালে পরপর বাংলা ছবি দেখেছি। মা ৩০শে এপ্রিল তারিখে তিনটি ছবির নাম লিখে রেখেছেনঃ একটি ইংরেজী, দুটি বাংলা। একই দিনে একাধিক ছবি দেখার চল আমাদের পরিবারে ছিল না, আর তিনটি ছবি একদিনে তো অকল্পনীয়! ৩০শে এপ্রিলেই মুক্তি পেয়েছিল হাসির ছবি ‘পতি সংশোধনী সমিতি’। রাতের শোয় বসুশ্রীতে গিয়ে গিয়ে হলে বেশীর ভাগ মহিলা দর্শক দেখে বলে উঠেছিলাম, “এরা সবাই পতি-বিরোধী!” মা আঁতকে উঠে আমার মুখ চেপে ধরেছিলেন। ছবিটি মোটামুটি উপভোগ্য লেগেছিল। অভিনেতাদের মধ্যে গোঁফ লাগানো ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন, আর মহিলাদের নেত্রী ছিলেন মঞ্জু দে।

৭১-এর শেষে বসুশ্রীতে দেখলাম বহু-প্রতীক্ষিত হাসির ছবি ‘ভানু গোয়েন্দা জহর অ্যাসিস্টেন্ট’। জনপ্রিয় ছবি, তবে মনে হয়েছিল যে ভানু-জহরের চেয়ে বেশী প্রাধান্য পেয়েছে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়-লিলি চক্রবর্তীর ‘রোমান্স’।

৭৪-এর ডিসেম্বরে মুক্তি পায় বাংলায় যুগান্তকারী অ্যাডভেঞ্চার ছবি, সত্যজিৎ রায়ের ‘সোনার কেল্লা। ঐ মাস থেকেই ৩ মাস ধরে আমি ছিলাম রোগে শয্যাশায়ী। কলেজ যাওয়াই বন্ধ, সিনেমা তো কোন ছার! অবশেষে ১৯৭৫-এর গোড়ার দিকে বসুশ্রীতে দেখা হল যে ছবি তার থেকে মনে গেঁথে আছে হলুদ মরুভূমির বুক চিরে কালো ধোঁয়ার কুজ্ঝটিকা উড়িয়ে ছুটে চলা ট্রেন! এটি আমার দেখা সম্ভবত প্রথম সম্পূর্ণ রঙিন বাঙলা ছবি। ৭৪-এ কিছু অতি-আঁতেল হাহাকার করে উঠেছিলেন যে ‘এইসব (তুচ্ছ) বিষয়ে ছবি করার নাকি “অনেক লোক আছে, সত্যজিৎ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ গভীর-গম্ভীর বিষয়বস্তু নিয়েই ছবি করুন!’ ‘এইসব’ ছবি করা একেবারেই সহজ নয়। আজও, কোটি-কোটি টাকা খরচ করে মিশরে, দক্ষিণ আফ্রিকায়, বা আমাজনের জঙ্গলে গিয়েও, কোনো বাংলা অ্যাডভেঞ্চার ছবি ‘সোনার কেল্লাকে অতিক্রম করতে পারেনি।

১৯৮০ আপামর বাঙালীর কাছে ইন্দ্রপতনের বছর! কিন্তু তা ছাড়াও ১৯৮০ এক যুগান্তকারী বাংলা ছবির রজত জয়ন্তী বর্ষ, এবং সম্ভবত সেই বছরেই বসুশ্রীতে আমি সেটি দেখি। সেই ১৯৫৫ সালে এই বসুশ্রী, বীণা আর শ্রী-তে মুক্তি পেয়েছিল সত্যজিৎ রায় পরিচালিত প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’! উপন্যাসখানা পড়া ছিল, তাই দেখতে-দেখতে কিছু তুলনা টেনেছিলাম। সর্বজয়ার হাতে দুর্গার প্রহার, এবং তার অনেক পরে, দুর্গার অকালমৃত্যু ঘটেছে, আর সে ব্যাপারে অজ্ঞ হরিহর বাড়ি ফিরে যখন স্ত্রীকে মেয়ের কথা জিজ্ঞাসা করছে, দুটি দৃশ্যেই পরিচালকের সংযম চমৎকৃত করেছিল, বিশেষ করে দ্বিতীয়টিতে, যেখানে বিভূতিভূষণ প্রত্যাশিত গ্রাম্য হাহাকারযুক্ত কান্নাই রেখেছিলেন। সঙ্গে পণ্ডিত রবিশঙ্করের আবহ সঙ্গীতও অসাধারণ! আর চোখে আজও ভাসে, ঝড়ের হাওয়ায় পুকুরে পদ্মপাতাগুলি উল্টে যাওয়ার চিত্রায়ন!

কোন এক সময় রবিবার সকালে বিশেষ প্রদর্শনীতে দেখেছি আরও দুটি পুরনো বাংলা ছবিঃ

১। ১৯৫২ সালের মহাপ্রস্থানের পথেঃ প্রবোধকুমার সান্যালের আখ্যানভিত্তিক ছবিতে মুখ্য ভূমিকায় ছিলেন বসন্ত চৌধুরী ও অরুন্ধতী মুখোপাধ্যায়। অন্যান্য চরিত্রের মধ্যে নজর কেড়েছিলেন, যথারীতি তুলসী চক্রবর্তী, এবং এক আপাত-কৌতুকধর্মী কিন্তু জটিল ‘ব্রহ্মচারী’ চরিত্রে অভি ভট্টাচার্য। এই দ্বিতীয় অভিনেতাকে আগে ও পরে অনেক ছবিতে দেখেছি – এমনকি হিন্দী মহাভারত-এ কৃষ্ণ-রূপেও – কিন্তু ব্রহ্মচারীর মতো বিচিত্র চরিত্রে আর কখনও তাঁকে দেখিনি। সবার ওপরে ছিল ছবির গানঃ হিন্দী এবং সংস্কৃত ভাষায়! হিন্দীতে বীরেন বল, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, এবং বিনতা চক্রবর্তী, সংস্কৃত শ্লোকগানে মুখ্য কণ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক পঙ্কজকুমার মল্লিকের। এই ছবির পদাঙ্ক অনুসরণ করেই আসে ১৯৫৯ সালে মরুতীর্থ হিংলাজ, ১৯৭২-এ বিগলিত করুণা জাহ্নবী যমুনা (এই ছবিরও সুরকার পঙ্কজবাবু), আর ১৯৭৮-এ তুষারতীর্থ অমরনাথ।

২। ১৯৬২ সালের দাদাঠাকুরঃ শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের জীবন কাহিনি। ছবি বিশ্বাস-অভিনীত শেষ ছবিতে তাঁর ছাড়াও ভাল লেগেছিল ছায়া দেবী ও তরুণকুমারের অভিনয়। বাড়তি পাওনা ছিল দাদাঠাকুরের স্বরচিত গান, ‘কলকাতা কেবল ভুলে ভরা (কণ্ঠ দেবব্রত বিশ্বাসের), আর ‘ভোট দিয়ে যা’ (কণ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক হেমন্ত  মুখোপাধ্যায়ের), যে গান প্রতি ভোটের সময় মাইকে বাজানো উচিৎ। হেমন্ত-দেবব্রতর এই যুগলবন্দী এর আগে বাঙালি দর্শক পেয়েছেন ১৯৪৮ সালে ‘ভুলি নাই আর ১৯৫১-য় ‘৪২’ ছবিতে।

এছাড়া বসুশ্রীতে রবিবার সকালে দেখেছি একের পর এক বিখ্যাত ইংরেজী ছবি – Hatari (তৃতীয় বার!), The Robe, Abbot and Costello Meet the Invisible Man – এবং নিয়মিত প্রদর্শনীতে দুটি হিন্দি ছবিঃ ১৯৬৭-তে শাম্মী কাপুর, আশা পারেখ, প্রেমনাথ অভিনীত, এবং জনৈক ‘আর ডি বর্মণ সুরারোপিত রহস্য ছবি ‘তিসরী মঞ্জিল! এত ভাল লেগেছিল যে দুবার দেখেছিলাম (এবং তার জন্য মার কাছে বকুনিও খেয়েছিলাম) আর এক কাকার কাছ থেকে ছবির সমস্ত গানের লং-প্লে রেকর্ড উপহার হিসেবে আদায় করেছিলাম! দ্বিতীয় ছবি ১৯৬৯ সালে পৌরাণিক ‘বলরাম-শ্রীকৃষ্ণ’, নাম ভূমিকায় যথাক্রমে কুস্তিগীর দারা সিং এবং শাহু মোডক।

সবশেষে উল্লেখ করব এক রবিবার সকালে বসুশ্রীর সাদা পর্দা সরিয়ে স্টেজে দুটি নাটক দেখার কথা। একটি সংস্থা উপস্থাপিত করেছিলেন সুকুমার রায়ের ‘চলচ্চিত্ত-চঞ্চরী এবং রসরাজ অমৃতলাল বসুর ‘ব্যাপিকা বিদায়’।


প্রিয়া



সেই ছোট পিসেমশায়, যিনি বসুশ্রীতে ‘তরণীসেন বধ’ দেখতে নিয়ে গিয়েছিলেন, তিনিই ১৯৬৫ সালের পর  কোন এক সময় দেশপ্রিয় পার্কের পাশে প্রিয়াতে সম্ভবত রবিবার সকালের শো তে, ১৯৫৯ সালের ছবি ‘দেড়শো খোকার কাণ্ড’ দেখিয়েছিলেন। ততদিনে পড়তে শিখেছি, হেমেন্দ্রকুমার রায়ের বইটি পড়াও হয়ে  গেছে। প্রথমেই মূল শিশু-চরিত্র (গোবিন্দ?) কে দেখেই চিনেছি – এতো সেই তরণীসেন (মাস্টার তিলক)! চোর জটাধর বক্সীর ভূমিকায় কে অভিনয় করেছিলেন মনে নেই, কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার এক কাকার চেহারার খুব মিল খুঁজে পেয়েছিলাম! রেস্তোরাঁয় ঢুকে গোবিন্দর কাছ থেকে চুরি করা টাকা দিয়ে জটাধর খাবে বেশ কিছু টোস্ট, মামলেট, আর চা। তার দেওয়া অর্ডার শুনেই মনে হলো, টোস্ট আর মামলেটের সংখ্যা তো বইতে যা আছে তার সঙ্গে ঠিক মিলছে না! বাড়িতে ফিরে সে কথা বলতে মা বা দাদা সহানুভূতির সঙ্গে বলেছিলেন, “তাই তো! খুব অন্যায় করেছে!” এছাড়া মনে আছে ছবির প্রথম দিকে নেচেনেচে এক বৃদ্ধ গাইছেন, ‘খড় খড় খড়’। গানের শেষে সম্ভবত এক পাহারাওয়ালা বা পুলিশ এসে একটানে নাচিয়ের ছদ্মবেশ খুলে দেখান যে ব্যক্তিটি মোটেই বুড়ো নন! সাম্প্রতিক গানটি পেয়েছি। গায়ক সেই হেমন্ত!

এরপর প্রিয়াতেও, বসুশ্রীর মতো, রবিবার সকালে দেখেছি ইংরেজী ছবি, আর নিয়মিত প্রদর্শনে অনেক হিন্দী ছবি, যার মধ্যে আছে শাম্মী কাপুর-সাধনা-প্রাণ-পৃথ্বীরাজ কাপুর অভিনীত ‘রাজকুমার’, বিশ্বজিত-আশা পারেখ-প্রাণ অভিনীত ‘মেরে সনম’, দেব আনন্দ-ওয়াহিদা রহমান অভিনীত ‘গাইড’, নিরূপা রায়-বলরাজ সাহনী-কুমুদ চুগানী অভিনীত ‘লাডলা’, যা অনেক পরে বুঝেছি, বাংলা ‘মায়ামৃগ’ ছবির রূপান্তর, আর  রাজেশ খান্না-তনুজা অভিনীত ‘হাথী মেরে সাথী’।

১৯৯৩ সালে বিয়ের পর আবার কয়েকবার প্রিয়াতে সস্ত্রীক আসি। এর মধ্যে একমাত্র গৌতম ঘোষ পরিচালিত ‘দেখা’ (সৌমিত্র-পরাণ-রূপা গাঙ্গুলী-ইন্দ্রাণী হালদার) খাঁটি বাংলা ছবির তকমা পেতে পারে। অপর্ণা সেন  পরিচালিত Mr and Mrs Iyer-কে কোনও বিচারেই বাংলা ছবি বলা চলবে না, যদিও পরিচালিকা এবং নায়ক-নায়িকা, এবং বেশ কিছু পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতারা সব বাঙালী।


দর্পণা



১৯৮০তে দর্পণায় (শ্যামবাজার) দেখেছি জীবেন বসু, প্রণতি ঘোষ, নবদ্বীপ হালদার, তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত ১৯৫২ সালের ‘পাত্রী চাই’। মূলত হাসির ছবি, কিন্তু কিছু অভিমান-ভুল বোঝাবুঝির মশলা ছিল।  বিলেত-ফেরত বিত্তবান পাত্র (জীবেন বসু) কবি-পাত্রীর খোঁজ করছেন। এক প্রতারক পুরুষ মেয়ে সেজে এসে সরু গলায় তার কাব্যপ্রেম ব্যক্ত করছে, “আমি খাবার সময় ডালে পটলভাজা ডুবিয়ে তাই দিয়ে থালায় পদ্য লিখি!” বিশ্বস্ত ভৃত্য (নবদ্বীপ হালদার) সব বিপদ থেকে প্রভুকে রক্ষা ক’রে তারপর দাবি করে, “একবার ‘মাই ডিয়ার’ বলে ডাকো!” চিত্রনাট্যকার সাহিত্যিক এবং আমার ছোটবেলা থেকে আমার অতিপ্রিয় দুজন  বাঙালী লেখকের অন্যতম, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়!

১৯৮৯-র একটি উপভোগ্য ছবি ৬ই জানুয়ারী শ্যামবাজারের দর্পণায় মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভ্যাম্পায়ার’দের নিয়ে ‘নিশিতৃষ্ণা’! ছবিটির প্রথমার্ধ খানিকটা ভয়-উৎপাদনে সফল হয়েছিল, বিশেষ সেই দৃশ্যে, যাতে মানবী থেকে  রক্তশোষকে রূপান্তরিত বান্ধবী প্রেমিকের গাড়ির রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে তার গলায় নিজের ছুঁচলো শ্বদন্ত-দ্বয়  বিঁধিয়ে রক্তপান করতে থাকে! তবে, বিরতির পর প্রসেনজিৎ, দ্বৈত-ভূমিকায় মুনমুন সেন (যমজ বোন, একজন প্রসেনজিতের বেদিনী-প্রেমিকা, আরেকজন রক্তশোষক ‘ডাকুন’ মানস মুখোপাধ্যায়ের শিকার), শেখর চট্টোপাধ্যায় (‘ডাকুনে’র আজ্ঞাবহ ভৃত্য, যে ডাকুনের কফিন ঘোড়ার গাড়িতে করে নিয়ে প্রভুর  শিকারের খোঁজে  ঘুরে বেড়ায় – মনে হয় ষাটের দশকে নির্মিত Dracula, Prince of Darkness-থেকে এ ব্যাপারটি অনুপ্রাণিত!) চিত্রনাট্য ও পরিচালনার ত্রুটির জন্য তেমন জমাতে পারেননি! গত পর্বে রাধায় দেখা ‘রক্তের স্বাদ’ ছবির মতো, বন্ধু ও ভ্যাম্পায়ার-বিশেষজ্ঞ Andy Boylan, এই ছবিটিরও একটি আলোচনা লিপিবদ্ধ করেছেনঃ 

https://taliesinttlg.blogspot.com/2018/08/nishi-trishna-review.html

বিয়ের পর দর্পণায় আরও দু’বার এসেছি, দু’বারই অপর্ণা সেন পরিচালিত ছবি দেখতেঃ

১। যুগান্ত (১৯৯৫) অতিদীর্ঘ, ক্লান্তিকর একটি ‘আঁতেল’ ছবি। বিবাহ-বিচ্ছিন্ন যুগল, অনসূয়া (রূপা গাঙ্গুলী)  আর দীপক (অঞ্জন দত্ত) তাদের মধুচন্দ্রিমা-যাপনের জায়গায় আবার দেখা করে। ছবিটির একটি ব্যাপারই নজর কেড়েছিল। নারী এবং নারীবাদী পরিচালিকা অতীত দেখাতে গিয়ে প্রত্যাশিতভাবেই অনসূয়াকে কাব্যিককল্পনাপ্রবণ, আদর্শবাদী, আর দীপককে এক কথায় অসংবেদনশীল ‘শালার ব্যাটা’ পুরুষ প্রতিপন্ন করেছেন। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে অনসূয়াই অনেক বেশী cynical, বিশেষ করে পরিবেশের প্রতি দীপককেই মনে হয় অনেক বেশী সংবেদনশীল।

২। পারমিতার একদিন (২০০০) একান্নবর্তী পরিবারের গৃহিণী সনকা (অপর্ণা সেন) এবং তাঁর পুত্রবধূ পারমিতার (ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত) সম্পর্কের পতন-উত্থান নিয়ে আখ্যান। অপর্ণা প্রাণপণে ‘লুচি’-কে ‘নুচি উচ্চারণ করে উত্তর কলকাতার গৃহবধূ হবার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু এ জাতীয় চরিত্রে তিনি চিরকালই ব্যর্থ। তাঁর নাগরিক পরিশীলিততা এবং গ্ল্যামার ভেদ করে তিনি খুব-একটা বেরোতে পারেননা। তুলনায়, অভিনয়- জীবনের গোড়ায় চরমভাবে অদক্ষ ঋতুপর্ণার অভিনয় অনেক পরিণত এবং বিশ্বাসযোগ্য। রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার সুচিন্তিত, কিন্তু প্রেক্ষাগৃহ-কর্তৃপক্ষ তো শেষে ‘বিপুল তরঙ্গ রে’ একটু হবার পরেই প্রোজেকশান বন্ধ করে দিলেন! ছবির প্রকৃতি বুঝে আর একটু সংবেদনশীল হওয়া যেত না?

কলকাতার বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে বাংলা ছবি দেখার আখ্যান এখানেই শেষ করছি।

 

 


পঙ্কজকুমার চ্যাটার্জি

 

ওয়ান হু ফ্লিউ ওভার দি কাকুজ নেস্ট




অনেক কালজয়ী সিনেমা দেখেছি। যেমন, আইজেনস্টাইনের 'ব্যাটলশিপ পটেমকিন', দি সিকার 'বাইসাইকেল থীফ', মৃণাল সেনের 'মৃগয়া' ও 'ভুবন সোম', সত্যজিতের প্রায় সব ছবি, শ্যাম বেনেগালের 'নিশান্ত', হৃষিকেশ মুখার্জির 'আনন্দ' ইত্যাদি। কমার্শিয়াল ছবির মধ্যে 'সাউন্ড অফ মিউজিক', 'মাই ফেয়ার লেডী', জিনা লোলোব্রিজিদার 'সামার অফ ৪২', 'রোমান হলিডে' (যা বাংলায় 'নায়িকা সংবাদ') অন্যতম। তবে একটি  অসামান্য ইংরাজী ছবি কলকাতায় বোধহয় এক সপ্তাহের বেশি চলেনি। সেইটি আমার দেখা সর্বসেরা ছবি। নাম 'ওয়ান হু ফ্লু ওভার দি কাক্কুজ নেস্ট'। একাডেমির সব পুরস্কার (পাঁচটি) বিজয়ী দ্বিতীয় চলচিত্র এটি। আর  আকিরা কুরোসাওয়া নির্বাচিত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দশটি চলচিত্রের মধ্যে এইটি অন্যতম। অভিনেতা জ্যাক নিকলসনের অনবদ্য অভিনয়। কাহিনী সংক্ষেপে জানাই।

ধর্ষণের অভিযোগে ১৫ বছরের কারাদণ্ডভোগী ম্যাকমারফি (জ্যাক নিকলসন) জেলের কঠোর পরিশ্রম এড়াতে মানসিক রোগীর ভান করে মানসিক চিকিৎসালয়ে চলে আসে। সেখানে এক নার্স তার রোগীদের দমন করতে অত্যাচারীর ভূমিকা নিতেন। নার্স ম্যাকমারফির প্রাণোচ্ছল এবং বিদ্রোহী মনোভাব দেখে তাঁর ক্ষমতা দেখিয়ে রোগীদের সিগারেট এবং রেশন বাজেয়াপ্ত করেন এবং তাস খেলাও বন্ধ করে দেন। নার্সের সঙ্গে ম্যাকমারফির সংঘাত শুরু হয়। একদিন সে এক স্কুলবাস চুরি করে অন্য রোগীদের নিয়ে সমুদ্রের তীরে মাছ ধরতে যায়। এতে সহরোগীদের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়।

এক আর্দালি একদিন ম্যাকমারফিকে জানায় যে মেয়াদি কারাদণ্ড মানসিক রোগীদের জন্য প্রযোজ্য নয়। তখন থেকেই ম্যাকমারফি পালানোর চেষ্টা করতে থাকে। সে ব্রমডেনকে হাইড্রোথেরাপি মেশিন তুলে জানালা ভেঙে পালিয়ে যেতে প্ররোচিত করে। এটা জানা যায় যে ম্যাকমারফি, ব্রমডেন এবং আর একজন রোগী দুরারোগ্য রোগী নয়। তাই বাকি রোগীরা দুরারোগ্য হওয়ায় তাদের যে কোন সময়েই ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে একদিন এক রোগী সিগারেটের জন্য প্রচন্ড চেঁচামেচি শুরু করলে, ম্যাকমারফি আর্দালিদের সঙ্গে লড়াই করে এবং তখন ব্রমডেন বাধা দেয়। এরপর নার্স এই তিনজনকে শক থেরাপির জন্য পাঠান। এই সময় ম্যাকমারফি বুঝতে পারে যে ব্রমডেন বোবা বা মূক নয়। ইলেকট্রোথেরাপির পর নিজের শয্যায় ফিরে এসে ম্যাকমারফি মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে যাওয়ার ভান করে।

এরপর ব্রমডেনের সঙ্গে ম্যাকমারফি পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করতে থাকে। খ্রীষ্টমাসের দিন গোপনে তারা এক পার্টির আয়োজন করে। নার্স রাতের ডিউটি সেরে চলে যাওয়ার পর শুরু হয় পার্টি। ম্যাকমারফি প্রহরীদের ঘুষ দিয়ে মদের বোতল এবং দুইটি মেয়েকে জেলের ভিতরে নিয়ে আসার বন্দোবস্ত করে। কিন্তু, অধিক পানের ফলে ম্যাকমারফি অত্যাসক্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লে পালিয়ে যাওয়া হয় না। পরদিন সকালে নার্স এসে ওয়ার্ডের নয়ছয় অবস্থা দেখেন এবং এও দেখেন যে বেশির ভাগ রোগী পালিয়ে গেছে। এক রোগী ও একটি মেয়েকেও একসাথে শুয়ে থাকতে দেখেন। তিনি সেই রোগীকে সবার সামনে অপমান করতে গেলে সেই রোগী ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। তখন তাকে ডাক্তারের ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেই সময় ম্যাকমারফি এক আর্দালিকে ঘুষি মারেন এবং ব্রমডেনকে নিয়ে জানালা ভেঙে পালিয়ে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করেন। ইতিমধ্যে সেই রোগী জানালার ভাঙা  কাঁচের ফলা দিয়ে গলনালী কেটে আত্মহত্যা করে। নার্স অবস্থা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন। তখন ম্যাকমারফি নার্সের গলা টিপে ধরেন। আর্দালিরা নার্সকে বাঁচায়।

কিছুক্ষণ পরে নার্সকে গলায় বন্ধনী লাগিয়ে ওয়ার্ডে আসতে দেখা যায়। কিন্তু, ম্যাকমারফিকে কোথাও দেখা যায় না। গুজব ছড়ায় সে পালিয়ে গেছে। সেই রাতে ব্রমডেন ম্যাকমারফিকে তার শয্যায় ফিরে আসতে দেখে। সে দেখে ম্যাকমারফি খোঁড়াচ্ছে এবং কোন সাড়া দিচ্ছে না। সে তার কপালে এক স্নায়ু-শল্যচিকিৎসার চিহ্ন দেখতে পায়। বুঝতে পারে নার্স তাঁর প্রতিশোধ নিয়েছেন। কান্নায় ব্রমডেন ম্যাকমারফিকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি আমার সঙ্গে আসবে এবং তার গলায় বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলে তাকে যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দেয়। সে তখন বিশাল হাইড্রোথেরাপি মেশিন মেঝে থেকে উপড়ে ফেলে তা দিয়ে জানালা এবং গরাদ ভেঙে পালিয়ে যায়।

 

 


ময়ূরী মিত্র

 

রঙ্গালয়ে বাঙালি মধ্যবিত্ত

 


(পর্ব – ২)  

গতদিন যে প্রশ্নে এসে লেখাটা শেষ করেছিলাম সেটা ছিল ধনী বাবুদের শখের ও ইংরেজি ধাঁচের নাট্যচর্চায় কতটুকু যোগ ছিল কলকাতার সাধারণ নিম্নবিত্ত বাঙালির৷ কেন এই প্রশ্ন বারবার থিয়েটারের ইতিহাসে উঠে এসেছে, আগে তা একটু বিস্তৃত বলি। আসলে উনিশ শতকের গোড়া থেকেই কলকাতা শহরে বৃত্তিগত স্বাধীনতা বা occuupational  freedom তৈরি হওয়া এবং সেই সঙ্গে জমিদারদের গ্রাম ছেড়ে ক্রমাগত শহরে বসবাসের ফলে তাদের বিত্ত ও বিলাস কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল এই থিয়েটারে। বিনয় ঘোষ বলছেন – “উনিশ শতক শেষ হতে দেখা যায়, কলকাতা শহরের আঞ্চলিক রূপায়ন খানিকটা বৃত্তিপ্রধান রূপ (dominant occupational zones) ধারণ করেছে।  এর ফলে উনিশ শতকের শেষ পর্যন্ত কলকাতা শহরের কূলগত বৃত্তিবন্ধন একেবারে ছিন্ন না হলেও অন্তত বেশ খানিকটা শিথিল হয়ে যাচ্ছিল”।

ফলে থিয়েটার করতে যাঁরা উদ্যোগী হলেন, দেখা যাচ্ছিল সেখানেও নাট্যশালাগুলোর যাবতীয় আর্থিক দায়ভার কখনো এককভাবে একজন ধনী ব্যক্তি বা কখনো বা তাঁরই দু একজন সহযোগী মিলেমিশে নিচ্ছিলেন। আর যেহেতু থিয়েটারে অর্থখরচের দায়িত্ব একজন ধনী ব্যক্তিই নিতেন এবং স্বচ্ছন্দে নিতেন, সেহেতু সাধারণ মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করার  প্রয়োজনই মনে করেনি এই অবাণিজ্যিক থিয়েটার। অর্থের ঘাটতি না থাকায় থিয়েটার করে অর্থপ্রাপ্তি বা উপার্জনের  প্রত্যাশাই জন্ম নেয়নি তখন থিয়েটারে। প্রায় উনিশ শতকের অর্ধভাগ জুড়েই উচ্চবিত্তশাসিত এই থিয়েটার সাধারণ মানুষের রুচি ও ভাবনাকে অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাতে পেরেছিল, যা স্বয়ং লিয়েবেদিয়েফও পারেননি। টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা তো ছিলই না, আমন্ত্রণমূলক অভিনয়ের বাতায়নগুলো ছিল পুরোপুরি মঞ্চমালিকের সহচর ও পরিজনবর্গের আওতায় - বলা ভালো কব্জায়। আরো বলে নেওয়া যেতে পারে, কিছু বিশেষ দর্শক ছাড়া ইংরাজি বা সংস্কৃত নাটকের দুরূহ অনুবাদ শুধু নিম্নবিত্ত কেন, মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্ত সম্প্রদায়ের কতদূর বোধগম্য হচ্ছিল, এ বিষয়ে বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায়। এমনকি সাহেবরাও যে এসব অভিনয় দেখে খুশি হয়েছিলেন, তার প্রমাণ নেই। খানিকটা

আলোকপ্রাপ্ত এবং প্রভূত অর্থগরিমায় সমৃদ্ধ একটি ব্রিটিশ-অনুগৃহীত সম্প্রদায়ের আত্মশ্লাঘা সামান্য মাত্রায় স্ফীত হয়েছিল কেবল। পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত জনসংযোগবিচ্ছিন্ন এইসব অসংগঠিত নাট্যপ্রচেষ্টা সম্পর্কে একটি পরিষ্কার ছবি  পাওয়া যায় অধ্যাপক মন্মথমোহন বসুর লেখায় ৷ অধ্যাপক বসু লিখছেন “গণশিক্ষার বাহন ও ভগবৎপ্রেমের পরিবেশকরূপে যাত্রা ছিল আমাদের একটি শ্রেষ্ঠ জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং সেইজন্য যাত্রার আসরে জনসাধারণের অবাধ প্রবেশাধিকার ছিল। কিন্তু অভিজাত-সম্প্রদায় কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নবযুগের রঙ্গালয় সমূহে নিম্নশ্রেণীর জনসাধারণ দূরে থাকুক, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভদ্রলোকগণ পর্যন্ত সহজে প্রবেশ লাভ করিতে পারিতেন না ৷ সেগুলিতে কেবল পরিচালকবর্গের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব ব্যতীত সম্ভ্রান্তব্যক্তিগণ ও সাহেবসুবারা নিমন্ত্রিত হইতেন এবং সাহেবদের প্রশংসালাভের জন্য তাহারা এত ব্যগ্র ছিলেন যে, যে সকল সাহেব অনুগ্রহ করিয়া তাঁহাদের থিয়েটার দেখিতে আসিতেন তাঁহাদের বোধ ও সৌকর্য্যার্থ বহুব্যয় করিয়া অভিনীত নাটকের ইংরেজী অনুবাদ করাইতেও তাঁহারা কুণ্ঠিত হইতেন না”।

তবুও ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বাঙালি মধ্যবিত্তের রাজনৈতিক উত্তরণ ঘটল। আত্মসঙ্কট থেকেই বুদ্ধিজীবী ভদ্রলোকদের আত্ম-আবিষ্কারের সূত্রপাত ঘটল। ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ও সমঝোতায় অবিশ্বাস দানা বাঁধতে  শুরু করল -- পেশা ও জীবিকা নিয়ে শাসক শাসিতে মনোগত লড়াইটা অন্তত বড় হতে লাগল। ১৮৫৮-এ হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের মতো বুদ্ধিজীবী এই সময়ের সবথেকে প্রাসঙ্গিক প্রশ্নগুলো উত্থাপন করলেন তাঁর ‘Who is to blame’  প্রবন্ধে। কী ছিল সেই প্রশ্নগুলো? দেখে নিই একবার --

১) ইংরাজের প্রতি ভারতবাসীর অন্তরে সংগোপনে সঞ্চিত হচ্ছে ক্ষোভ ও ঘৃণা ৷ এর জন্য দায়ী কে?

২) ভারতবর্ষে শাসক ও শাসিতে পারস্পরিক বিদ্বেষ বিস্তৃত হচ্ছে। এর জন্য দায়ী কে?

৩) ভারতে বর্তমান শাসকেরা নরম্যানদের ঘৃণা করলেও এখন নিজেরাই ঘৃণার পাত্র। এর জন্য দায়ী কে?

আজ এই অব্দি ৷ পরের দিন বলব ১৮৫০-৭৬ এই দীর্ঘ ছাব্বিশ বছরের বাঙালি ভদ্রলোকদের সামূহিক রদবদলের কথা, যা কিনা নিশ্চিতভাবেই প্রভাব ফেলেছিল বাঙালির নাট্যবিষয় নির্বাচনে, নাট্যসংগঠনের নতুন রূপ ও ইতিহাস নির্মাণে।

এই পর্বের উৎসনির্দেশ :

১) বিনয় ঘোষ, বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা (১৮০০-১৯০০), সাময়িক পত্রে বাংলার সমাজচিত্র গ্রন্থমালার শেষ (পঞ্চম খণ্ড), নভেম্বর ১৯৬৮, গ্রন্থকার ৷

২) মন্মথমোহন বসু, বাংলা নাটকের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৫৯ ,কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়।

৩) Nares Chandra Sen Gupta ed. Selections from the Writings of Hurrish Chunder Mookerj, Compiled from the Hindu Patriot, The Cherry Press, Dhurrumtola.


মৌ চক্রবর্তী

 

ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালি




প্রতি,

‘মেয়েদের মহাভারত' নিয়ে এবারের লেখা। মেয়েদের জন্যে সবই হচ্ছে তাই মহাভারত হলেও হবে এই  একুশ শতকে। মহাভারতের প্লট সাবপ্লটে অনেক নারী চরিত্র। কিন্তু তারজন্যে কখনওই মেয়েদের মহাভারত হয়ে ওঠেনি। তবে একুশ শতকের পুনঃভাবনার জোয়ারে এমন সৃষ্টি হতেই পারে।  

আমাদের দেশের বাংলা ভাষায় স্ত্রী-পুরুষ, তারপর নর-নারী বা নারী-পুরুষ এবং মেয়েমানুষ শব্দের ব্যবহার সামাজিকভাবে প্রচলিত। দুনিয়া ডটকমে নারী আন্দোলনের ইতিহাস এখন সমাদৃত একটি বিশেষ আবহ। যেখানে নারী শব্দের ব্যবহারে আধুনিকমনস্কতা বোঝাতে পারা যায়। এবং, নারীবিষয়ক প্রবন্ধের চর্চা বেড়েছে। একি জাতির উন্নতি? তাহলে রামমোহন সার্থক বলতে হবে। এদ্দিনে মানে একুশ শতকে এসে নারী মানে মেয়েদের তিনি এক সার্থক স্থানে দেখতে পাচ্ছেন। তবে, রবিঠাকুরের কথাটিও মনে রাখার, যা ভাল তা অল্প বলেই ভাল। এই ভাল-তে মেয়েদের দিক থেকে ধরে মহাভারত নিয়ে একটা নাটক লিখে ফেলা সাধুবাদ যোগ্য।

আবার, এখনও সমাজে মানে জাতিতে দেখা যায় বাস, ট্রাম রেল প্রভৃতিতে মহিলা আসন সংরক্ষণ রয়েছে। কারণ, মহলের মেয়েরা যানবাহনে চড়ে কাছারি যাবেন। আর বিশ শতকের মতন তো আর নয়, যে মহিলা দেখে ফিসফাস চলবে। যদিও তা নয়, তবুও মহিলা মেয়ে নারীদের সংরক্ষণ রাখতে হয়েছে। এ সদর্থক নাকি নঞর্থক সেটাও ভাবার। একদিকে নারী প্রগ্রতির ঢালাও বিজ্ঞাপন অন্যদিকে নারীর জন্যে সংরক্ষণ আভাস দেয় যে, ততটা উন্নতি হয়নি। যে দুই লিঙ্গকেই সমান সমান ভাবা যাচ্ছে । আসলে উন্নতি কোন ফলাফল নয়, একটি প্রক্রিয়া যা চলতেই থাকবে। আর তাই নারীর ব্যবহার কতটা হবে তাও অনির্ধারিত ভাবে চলতেই থাকবে।

যেমন, বিজ্ঞাপন বেশি আর্থিক মুনাফার জন্যে নারীর স্থান পাকা, তেমন যদি জাতির ভাবনায় হয়ে যায়, তাহলে বুঝতে হবে যে, এই জাতি বেগম রোকেয়া পড়েছে। এবং শিক্ষা নিয়েছে। এবং তারপরও নারী যে সামাজিক গাড়ির সেই দু –চাকার একটি, এবং অপরিহার্য। ফলে নারীকে নিয়ে নতুন ভাবনাকে স্বাগত। সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হচ্ছে যে, মেয়েদের জন্যে সবই একটু করে আলাদা হয়ে যায় বা রাখা। যথা, জন্ম থেকেই তার সূচনা, ভ্রূণ হত্যা। এ নিয়ে বিশিষ্ট বহুমুখী নাট্যশিল্পী নির্দেশক সুরঞ্জনাদির কথা মনে পড়ে গেল। মানে মাধবমালঞ্চী কন্যা- সুরঞ্জনা দাশগুপ্ত। বলেছিলেন, "আমরা যাঁরা ভ্রূণে হত্যা হইনি...", তাঁদের মধ্যে তিনিও একজন। এই যে বিষয় তা নিয়ে অগুণিত আলোচনা, এবং টিআরপি-যুক্ত আলোচনা হয়ে চলে। যেখানে, মেয়েদের জীবনের সবকিছুই পরিমাপ করে কেমন যেন আলাদা। মেয়েদের ব্যবহারের গন্ধ হবে আলাদা।

মেয়েদের ব্যবহারের রঙ একেবারে শিশুকাল থেকেই হবে গোলাপি বা হালকা নরমগোছের। যেন মেয়ে মানেই ওই নরম পুতলের মতন্। এমনকি মেয়েদের জন্যে পুতুলগুলো আলাদা, আর মেয়েদের শেখান সমাজে ব্যবহারের রীতি সব আলাদা। ফলে মেয়েদের পোশাক, মেয়েদের সাজ, চুলের ছাট, চলাবলা, ফেরা, তাঁদের শিক্ষার পরিসর – সবই আলাদা। এমনকি যখন নারীশিক্ষার সূচনা হয়,  তখন অভিজ্ঞ বিজ্ঞদের মতে ছিল যে, মেয়েদের জন্যে গণিত, ভাষা প্রাথমিক ভূগোলের সঙ্গে সঙ্গে সেলাই শেখান হবে। সেটাই মেয়েদের সিলেবাস। শুরুর দিকে ওইসময়ে এই বিষয় যে কত ঠুনকো তার প্রমাণ তো মেয়েদের বিএ পাশ করাতেই বোঝা যায়। মেয়েদের পেশাদারি রোজগারের জন্যেও এই জাতীয় ধারণা ছিল। মেয়েদের জন্যে সংরক্ষণ যদিও একদিকে মেয়েদের এগিয়ে দেওয়া। আবার অন্যদিকে তো মেয়েদের একুশ শতকে এসে গতিপথ বেঁধেও দেওয়া বটে। আগের ধারণা থেকে মুক্তি এখনও মেলেনি মেয়েদের বিষয়ে। এগিয়ে যাওয়ার ছবি-বিজ্ঞাপন পেরিয়ে পরিবার সমাজের অন্দরমহলে এলেই এই চিত্র প্রমাণ করতে কোন তথ্যসূত্র দিতে হবে না। কারণ এ তো সর্বজনবিদিত মেয়েদের অবস্থান। এক্ষেত্রে মেয়েদের মহাভারত বেশ জাগিয়ে তোলা নাম।

এবারে থিয়েটারের বর্ণনায় আসা যায়। মেয়েদের মহাভারত দেখতে প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ ছিল। এ আনন্দের। আবার কপাল কুঁচকে দেওয়াও নয়? মেয়েদের যুক্ত হতেই মহাভারত পাল্টে যাবে? আসলে বিষয়টা মহাভারত নয়, মেয়েদের, মেয়েদের-ই।

যথার্থ নাট্যশিক্ষা পেয়ে তবে মঞ্চে এসেছেন কুশীলবরা। এটুকু বোঝা যায়। মঞ্চ আলোর এক স্বতন্ত্র কাজ চলে নাট্য ঘটনার প্রবাহ ঠিক রাখতে। এটাও মিলে যাচ্ছে। এত কম খরচে মানে উপাদান ব্যবহার করে মঞ্চসজ্জা ভাবায়। কারণ, মূল্য বৃদ্ধির বাজারে তো এরও মূল্য এক নাট্যদলকেই চোকাতে হয়।

এমত অবস্থায়, থিয়েটারের প্লট হল আসল। যেখানে সব পেরিয়ে ঘটনাগুলো এক মালার ফুলের মতন গাঁথা হবে। যাঁদের মহাভারত পড়া বা দেখা, তাঁদের কাছে ঘটনা চেনা। কিন্তু প্রশ্ন হল একটা মঞ্চনাটকের ঘটনা সব জানা হলেও, মেয়েদের জন্যে দেখব – ভেবেই প্রত্যাশী  দর্শক।

মহাভারতের পাঁচ নারী চরিত্র। নাট্যকার শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়-এর নতুন ভাবনা। নারী চরিত্রদের মধ্যে প্রথমে মঞ্চে তাই অঙ্গনার প্রবেশ। সন্তানলাভের নিয়োগপ্রথা দ্বারা রানীকে মাতৃত্ব ধারণ করতে হয়। এক্ষেত্রে রানী নিজে না এসে, তার দাসীকে পাঠিয়ে দেয়। এও জানা ঘটনা। নাট্যকারের দৃষ্টিতে নতুন তাহলে অঙ্গনার সংলাপগুলো। প্রথমে 'অনাম্নী অঙ্গনা' মনে পড়ে গেল। মঞ্চে প্রবেশ করে যখন প্রথম উপেক্ষিতা হয়ে থাকা চরিত্র অঙ্গনা। দাসী চরিত্রের রূপটি মনেহয়নি নবভাবনা। কারণ বুদ্ধদেব বসু তো আগেই লিখেছেন। হ্যাঁ, সংলাপে দুই অঙ্গনা মেলে না ঠিকই। তবে, ধারণাটা ওইখানে ফ্রিজ করে দেয় একটা আলপিনে গেঁথে দেয় চিন্তাকে। তাহলে নাট্যকার পরের চরিত্র কী নিলেন। মঞ্চে আসে হিড়িম্বা।   

মহাভারতের ঘটনায় কিছু চরিত্র সাব-প্লট হয়ে থাকে। তারা নারী চরিত্র হলেও গৌণ ভূমিকা। নাকি তাদের কালের প্রবাহে উপেক্ষিতা বলেই সম্বোধন করা হবে। আলোচ্য প্লট ধরলে নাট্যকার এর উত্তর হিড়িম্বাকে দিয়ে বলিয়েছেন। ক্লাস ডিভিশন মানে জাতি ভাগ। মানে বর্ণ ভাগ। উচ্চবর্ণ নয় বলেই হত্যা করতে আগে পাঠানো হয় ঘটোৎকচকে। এখানে স্ত্রী-হিড়িম্বা নিজের অবস্থান বলে যায়। তার বর্ণ অনুসারে মহাভারতের যুদ্ধে তার সন্তানকে কৌশলে মেরে ফেলতে চাওয়া। এবং বহুবিবাহের ফলে হিড়িম্বার প্রতি ভালোবাসায় পক্ষপাতিত্ব, যা নাটকের ঘটনার গতি ধরাতে চায়।

নিষাদ মা আসে মঞ্চে। তার পাঁচ সন্তানকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা জ্যান্ত তীব্র হয়ে ওঠে। কারণ যুধিষ্ঠির এই নিষাদ মায়ের খোঁজে আসে। এবং পেয়েও যায়। নিষাদ মা তার সংলাপে না-পাওয়া দরিদ্রবর্গের ঠকে যাওয়া মৃত্যুর ঘটনা বলে। দর্শকের স্নায়ু উত্তেজিত হয় কিনা। নাট্যঘটনা দানা বাঁধে না। কারণ, নাটকের প্রথম চরিত্রে দর্শক যা ভাবতে থাকছিল, পরে তা থাকল না।

দর্শক উশখুশ করেছেন আর কিছুর জন্যে। রাধা মা আসে, কর্ণ আসে। জন্ম পরিচয় থেকে আলোচনা হয়। এখানে লাল কাপড়ের ব্যবহার, লম্বা কাপড়ের ব্যবহার অতিরঞ্জিত এবং বাহুল্য বলেই মনেহয়। নাটকীয়তা ক্রম- এক, মঞ্চে রাধার উপস্থাপনা, দুই, কর্ণের মৃত্যুর দৃশ্য, তিন, দুধের বাটি নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পালিত মায়ের সন্তানের খোঁজ। উপেক্ষিতা রাধা মায়ের অবদান ভুলে সমাজের উচ্চবর্ণে ঢুকে পড়তে চাওয়া কর্ণ পর্যন্ত ঘটে যায়। এদিকে দর্শক ভাবেন কিছু ব্যতিক্রমী হবে কিনা? গান্ধারী-র চরিত্র মূল চরিত্রের মতনই থাকে। তবে, নাট্যঘটনায় গান্ধারীর সংলাপ থাকে মহাভারতের প্রেক্ষিতেী। সব ঘটনা জানা, দেখা চেনা। শুধু নাট্যকার এদের কীভাবে উপস্থাপন করতে চলেছেন, সেটাই অজানা। মঞ্চে নাটক মানেই মঞ্চনাটক। সেইসূত্রের অবকাশ থাকে না। কিন্তু যা অনুপস্থিত তা হোল নাটকের প্রয়োজনীয়তা কতটা ছিল? মেয়েদের জন্যে তেল সাবানের বিজ্ঞাপনের পাশে – এরকম একটা মহাভারত কী ভার লাঘবের? এসব প্রশ্ন উঠবেই। কারণ, মঞ্চে কুশীলবদের পারদর্শিতা অন্যভাবে কাজে লাগানো যেত বলে মনে করার। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে হতে থাকে মেকআপের আধিক্য। যেন মঞ্চসজ্জার আধুনিক ভাবনার বিপরীত। যেখানে মহাভারতের সিম্বল এক রথের চাকা,সেখানে কোন বাস্তবতার সন্ধানে মেকআপ, পোশাকের এই সাযুজ্যহীনতা। প্রশ্ন, যেহেতু এ মঞ্চনাটক, তাই নির্দেশক ত্রুটি শুধরিয়ে নেবেন। নাটকের পাঁচ উপাদানের মধ্যে পোশাক অন্যতম। যেখানে পোশাক প্রথমেই চিনতে সাহায্য করে চরিত্রকে। এই ত্রুটি একটি ২৮ বছরে পা দেওয়া নাট্যদলের ক্ষেত্রে প্রশ্নের। বিশেষত আলোচ্য নাটকে মঞ্চসজ্জা, আলোর অনুষঙ্গ -- ভালো নাটকের ভাবনাকে উসকিয়ে দেয়।  

নির্ধারিত মেয়েদের সূত্রে গাঁথতে চাইলেও, মহাভারতের এইসব চরিত্রদের তুলে ধরে নাটকে প্রয়োজনীয়তা সমাজের জন্যে কতটা ছিল? আর থাকলেও সেই ক্রাইসিস উঠে এলো না কেন, নাট্যকারের কলমে। এই নাট্যে অতিরিক্ত প্রাপ্তি হল নাট্যকার নিজেই নির্দেশক। এবং নাট্যকার নিজেই দর্শকের উদ্দেশ্য বলেন, নাটকে সব বলা হয়েছে। ঠিকই কিন্তু নতুন কি পাওয়া গেল? প্রশ্ন মেয়েদের নির্ধারিত বিজ্ঞাপনের মধ্যে এই নাটকের ভবিষ্যতে স্থান কেবলই কি নাট্যকারের নাটকরূপেই? প্রশ্ন রইল।

৯জুন ২০২৩ তারিখে কল্যাণী কলামণ্ডলম নাট্যদলের ২৮তম জন্মদিন।একাডেমি, কলকাতায়, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়-এর এই চরিত্রদের অন্যভাবে উপস্থিত করার চেষ্টা। জারি থাকুক এমন প্রয়াস। কারণ, নাট্যধারায় এ বিশেষভাবে জরুরি।

নাটকের অভিনয়ে থাকা কুশীলব হলেন, অনন্যা দাস, আরতি চৌধুরী, জয়িতা বসু, মালবিকা গুপ্ত, বৃষ্টি সান্যাল, অরিত্রী বাড়ৈ, অরুণিমা আদক, জয়ন্ত চৌধুরী, মেহেবুব বিশ্বাস, সঞ্জীব দেবনাথ, অভিনন্দন সিনহা, উদয় মণ্ডল ও সাগর। মেকআপ সঞ্জয় সামন্ত। আলো শান্তনু দাস। অঙ্কন পরিকল্পনা শুভেন্দু সরকার। মঞ্চ সহায়তায় নজরুল হক। আবহ সুভাষ দে, নব কুমার, নির্মাল্য পাল। অনন্যা দাসের গান্ধারী চরিত্রের অভিনয় সাবলীল। তবে রূপসজ্জা কুশীলবদের মঞ্চ-অভিনয়ের ভূমিকাকে সাহায্য করে না। নিষাদ মায়ের অভিনয় দর্শক করতালিতে প্রশংসিত হয়। ভীম-এর স্ত্রী হিড়িম্বা, রাধা মা চরিত্রের শিল্পীদের অভিনয় মনে থাকার।

_ ইতি

একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্তাধিকারী


শুভ্রনীল চক্রবর্তী

 

সুভাষচন্দ্র বসু, পরবর্তী ১৯৪৫ (৬)  

 




নেতাজি কি এখনো জীবিত?

এতদিন আমরা নেতাজীকে নিয়ে যেটুকু জেনেছি অর্থাৎ ১৯৯০এর আগে পর্যন্ত বা বলা যায় গুমনামী বাবার মৃত্যুকাল পর্যন্ত তা কম বেশি ক্লাসিফাইড এবং কিছু প্রামাণ্য দলিল মেলে কিন্তু ১৯৯এর পরবর্তী কার্যকলাপ জানা একপ্রকার দুরূহ ব্যাপার। আমি বহুবছর এই নিয়ে গবেষণা করছি এবং বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি যেগুলো যথাসম্ভব আপনাদের সামনে তুলে ধরবো, কিন্তু আমার বিগত ধারাবাহিকগুলোর মত পুঙ্খানপুঙ্খ সোর্স বা রেফারেন্স দিতে পারবো না, কারণ বেশিরভাগই শোনা বা দ্যাখা অন্যান্য গবেষক বা নেতাজির সহকর্মীদের থেকে যাদের সাথে দেখা করা বা কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আমি বেশ কিছু ঘটনা বা রাজনৈতিক কার্যকলাপ তুলে ধরার চেষ্টা করবো এবং আমার এই গবেষণা পত্রের শেষ লগ্নে এসে যেগুলো মিসিং লিঙ্ক হিসেবে আপনাদের সাহায্য করবে। আবার অনেক ঘটনা আমি চাইলেও প্রকাশ করতে পারবো না, কারণ তাতে আমাকে রাষ্ট্রের কাছে অনেক আইনি জটিলতার সম্মুখীন হতে হবে। বিগত  আলোচনাগুলোর মাধ্যমে আপনারা নিশ্চয় বুঝতেই পেরেছেন নেতাজির মত হাইভোল্টেজ মিস্ট্রি আজ পর্যন্ত বা আধুনিক ইতিহাসে আমরা দেখিনি এবং এই বিষয়ের মত ওয়াল্ড কনস্পিরেসি আর কোনো রাষ্ট্র নায়ককে নিয়ে হয়নি, তাকে নিয়ে সব সত্যি সামনে আসলে বিশ্ব রাজনীতিতে অনেক কিছুই ওলোট পালোট হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে তাই ব্যক্তি বা সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও সব সত্যি বা ১৯৪৫ পরবর্তী বেশিরভাগ সত্যিই প্রকাশ করা সম্ভব হয়নি।

১৯৯০ সালে নর্শিমা রাও প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন কংগ্রেস স্বাধীনতা পরবর্তী পর্যায়ে প্রথম নেতাজীকে তাদের একজন বলে মেনে নেয় এবং গান্ধী পরিবারের ক্ষমতা কিছুটা শিথিল হওয়ায় নেতাজির পরিবারের উপর নজরদারিও বেশ শিথিল হয়। ১৯৯২ সালে ভারত সরকার সুভাষ বসুকে মরণোত্তর ভারত রত্ন দেন, কিন্তু বসু পরিবারের বহু মানুষ এই পুরস্কার অস্বীকার করে্ন, কারণ তারা মনে করতেন নেতাজি বিমান দুর্ঘটনায় মারা যায়নি এবং এখনো বেঁচে আছেন,   তাই মরণোত্তর ভারতরত্ন মেনে নেওয়া মানে সুভাষ বসু মৃত এটা মেনে নেওয়া। সেই কারণেই তারা এই পুরস্কার বয়কট করার সিদ্ধান্ত নেন। হঠাৎ ঠিক সেই সময়ে ৯২ সাল নাগাদ নেতাজির এক সহকর্মী জেনারেল অমর বাহাদুর সিং দাবী করেন তিনি নেতাজীকে দেখেছেন ও কথাও বলেছেন। উত্তরপ্রদেশের সীতাপুরে মৌনীবাবা বা সন্ত সম্রাট যোগী নামে এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করে তিনি এই কথাটি সর্বসমক্ষে আনেন এবং মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট দেখলেও  জানতে পারবেন জেনারেল অমর বাহাদুর সিং ছাড়া আরও ৩ ব্যাক্তি মৌনীবাবাকে নেতাজি বলে দাবী করেন। ঠিকই ধরেছেন এক্ষেত্রেও নেতাজি বহুবার মৌনীবাবার ছদ্মবেশে এসে তাঁর কার্যকলাপ সম্পন্ন করতেন। মৌনীবাবা মারা যান ২০০৩ সালে এবং তারপর তার ব্যবহৃত বহু জিনিস পাওয়া যায় যেখান থেকে নেতাজি সম্পর্কিত বহু তথ্য উঠে আসে এবং সবথেকে মজার বিষয় হলো এই মৌনীবাবার সঙ্গে গুমনামী বাবার যোগাযোগেরও তথ্য উঠে আসে। শুধু গুমনামী বাবা নন আরও অনেক সাধুর সঙ্গেই তার যোগাযোগ ছিল যাদের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন ব্যক্তি নেতাজি ভেবেছেন। এই বিষয়ে নিয়ে পৃথকভাবে পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করবো। তবে এই মৌনীবাবা ও গুমনামি বাবার ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি নেতাজি বহুবার বিভিন্ন সাধুর ছদ্মবেশে আবির্ভূত হতেন তার কার্যকলাপ সম্পন্ন করতে তাই শুধুমাত্র গুমনামী বাবাই নেতাজি এবং গুমনামী বাবার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে নেতাজির মৃত্যুকে জুড়ে দেওয়া একপ্রকার বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয়। আরও একটি বিষয় বলে রাখা দরকার গুমনামী বাবা যেমন পর্দার আড়ালে বেশিরভাগ সময়  থাকা পছন্দ করতেন ঠিক তেমনই মৌনীবাবাও তাই অনেকে তাকে পর্দা বাবাও বলতেন। একথা বলা অপ্রয়োজনীয় যে সুভাষ বসুকে মান্যতা দেওয়ার ক্ষমতা ভারতবাসীর নেই তাই এ আমাদের পরম দুর্ভাগ্য যে চিরকালই তাকে পর্দার আড়ালেই থাকতে হয়েছে দেশের স্বার্থে ও দেশবাসীর স্বার্থে।

এইবার যে ঘটনাটি বলবো তার তথ্য প্রমাণ বা ব্যক্তির নাম কিছুই দেওয়া যাবে না, শুধু ঘটনাটির উল্লেখ করবো, মানা বা না মানা সম্পূর্ণ পাঠক মহোদয়ের উপর। ১৯৯৭ সালের ২৩শে জানুয়ারি নেতাজি উত্তরপ্রদেশ ও নেপাল বর্ডারে  গোন্ডা প্রদেশে সম্ভবত মুজেহেনাতে তার ১০০ বছর জন্মদিন উদযাপন করেন এবং জাতীর উদ্দেশ্যে তার ঘনিষ্ট মহলে বক্তৃতা দিয়ে চলে যান, সঙ্গে ছিল তার লিবারেশন আর্মির বেশ কিছু লোক। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান ৯৭এর ২৩শে জানুয়ারি বর্ডার এলাকার নো ম্যানস ল্যান্ডে সকালবেলায় হঠাৎ একটি চপার আসে এবং সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন শ্বেত  বসন ও সানগ্লাস পরিহিত এক সাধু। সঙ্গে ছিল বেশ কয়েকজন লোকজন এবং কিছু আর্মড বডিগার্ড। বেশ কিছু সময় কাটিয়ে সেখান থেকে তিনি আবার চপারে উঠে চলে যান। তবে গ্রামের লোকজন বলতে পারেননি তিনি সুভাষ বসু কিনা, তবে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাওয়া যায় তিনিই নেতাজি এবং মজার বিষয় হলো ঠিক তার পরেই ১৯৯৭ সালে সুপ্রীম  কোর্ট তার মরণোত্তর ভারতরত্ন পুরস্কার ফিরিয়ে নিতে ভারত সরকারকে নির্দেশ দেয়। ভাবতে অবাক লাগলেও এটাই সত্যি যে ৯২ সালে পুরস্কার ঘোষণার ৫ বছর পর সেই পুরস্কার ফিরিয়ে নেওয়া হয় এবং ভারতের ইতিহাসে  এটি  প্রথম ঘটনা যে কাউকে মরণোত্তর পুরস্কার প্রদান করে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সুতরাং পাঠক মহোদয় তার বুদ্ধি দিয়ে সহজেই এই কো ইনসিডেন্ট ধরতে পেরেছেন আশাকরি এবং নেতাজির জনসমক্ষে আশার ঠিক পরপরেই এহেন আচরণ প্রমাণ করে কোর্ট বা সরকার ও জানে যে তিনি মৃত নন।

বলাইবাহুল্য এরপর ১৯৯৯ সালে অটল সরকার এসে মুখার্জি কমিশন গঠন করে এবং এই একটি মাত্র কমিশনই সর্বপ্রথম বলেছে যে নেতাজি প্লেন দুর্ঘটনায় মারা যাননি। মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট পড়লে বোঝা যায় তারা অনেক দূর এগিয়েছিল নেতাজির কার্যকলাপ নিয়ে কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পার্লামেন্টে পেশ করার পর সবই নাকচ হয় এবং তড়িঘড়ি করে কমিশন বন্ধ করার কথা বলা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে শুধু এটুকুই পাশ হয় যে নেতাজি ১৯৪৫ সালে তাইহুকো বিমান দুর্ঘটনায় মারা যাননি। জাস্টিস মুখার্জির কাছে আরও অনেক তথ্য থাকলেও সেদিন তা সামনে আসেনি।

আর একটি ঘটনা বলি, আমাদের মত সাধারণ মানুষের কাছে এটা বিস্ময়কর হলেও এটা চরম সত্যি এবং এই ঘটনার বইয়ের রেফারেন্সও আমি উল্লেখ করবো শেষে। আপনারা অনেকেই হয়তো শুনেছেন বরফানি দাদাজি মহারাজের কথা তিনি ২২১ বছর বেঁচে ছিলেন (গুগল করলে পেয়ে যাবেন)। রঞ্জিতকুমার মজুমদার, তাকে নিয়ে রিসার্চ করছিলেন এবং ২০১০ সালে অমরকণ্টকে তার আশ্রমে তিনি যান ও দাদাজির সঙ্গে দেখা করেন। বিভিন্ন কথার প্রসঙ্গে সুভাষ বসুর কথা আসে এবং দাদাজী মহারাজ বলেন সুভাষচন্দ্র বসু বেঁচে আছেন এবং তিনি কঠোর যোগ সাধনায় রত। রঞ্জিতবাবু এই সম্পূর্ণ কথোপকথন তার বরফানি দাদাজি মহারাজ বইতে লিখেছেন। প্রথমে লেখক অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করেন  দাদাজী মহারাজকে যে  নেতাজি এখন বেচে থাকলে তার ১১৩ বছর বয়স হবে, তো এটা কি অস্বাভাবিক নয়? মহারাজ বলেন, তাহলে তো আমিও ২০০ বছরের বেশী বেচে আছি এটাও তোমার বিশ্বাস করা উচিৎ নয়, মুচকি হেসে আবার বলেন, যোগবলে কি না হয়!

আপনারা ধারাবাহিকভাবে একটু দেখলে বুঝতে পারবেন নেতাজি কিন্তু একজন আদ্যপ্রান্ত ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন, তিনি মহামায়ার উপাসক ছিলেন, সাবমেরিন করে আসার সময় তিনি দুর্গা ষষ্ঠীর দিনে সাবমেরিনের ভেতরেই মা দুর্গার পূজা করেন নিজে হাতে, এতটাই তিনি ধর্মপ্রাণ ছিলেন। এছাড়াও ছোটবেলায় দুবার তিনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যান সন্ন্যাস নিতে। প্রথমবার খুব ছোটই ছিলেন তাই কোনোভাবে ফেরানো হয় তাকে এবং দ্বিতীয়বার এই ঘটনা ঘটে ১৪ বছর বয়সে এবং প্রায় ১ মাস তিনি বাইরে বাইরে ঘোরেন। সেই সময় এক সাধুর সঙ্গে তাঁর দেখা হয় এবং তাঁর কাছ থেকে নেতাজি দীক্ষা নিয়ে ধর্মচর্চা করতে চান কিন্তু সেই সাধু তাকে বলেন এখনো সেইসময় আসেনি ধর্মচর্চার তোমার এখনো অনেক কাজ বাকী। সেই সাধু আর কেউই নন আমাদের ঋষি অরবিন্দ যাকে নেতাজি নিজের পথ প্রদর্শক মনে করতেন। ঋষি অরবিন্দর ছায়া কিন্তু নেতাজির মধ্যেও সমারভাবে বিদ্যমান তাই আগে বিপ্লবী এবং পরে সন্ন্যাসীর হওয়ার এক অদ্ভুত প্রবণতা গুরু শিষ্য দুজনের মধ্যেই থাকবে এটাই স্বাভাবিক।

আমার কাছে আরও কিছু তথ্য আছে যার ভিত্তিতে হলফ করে বলতে পারি নেতাজি আজও জীবিত আছেন। একজন সাধুর ১২৬ বছর বাঁচাটা কোনো ব্যাপারই নয় কিন্তু। হ্যাঁ আমাদের সাধারণ মানুষের এটা বিশ্বাস করতে খুব অবাক  লাগলেও এটা কিন্তু সত্যি, আপনি একটু রিসার্চ করলে দেখবেন জাপানের লোকদের গড় আয়ু ৯০ বছর, কারণ তাদের খাদ্যাভ্যাস। হুঞ্জা বলে একটি প্রজাতি আছে যারা বেলুচিস্তানে থাকে এবং তাদের গড় আয়ু ১২০-১৫০ এমনকি ৮০  বছরের মহিলারাও গর্ভবতী হন (গুগল করে দেখতে পারেন )। সুতরাং পরিমিত আহার এবং উপযুক্ত জলবায়ু থাকলে ১২৬ বছর সাধারণ মানুষই বাঁচতে পারে সেখানে একজন যোগবলে বলীয়ান সাধুর ক্ষেত্রে এই বয়স নেহাত অবাক হওয়ার মত বিষয় নয়। আমি অনেক ক্ষেত্রেই মুখার্জি কমিশনে কর্মরত কিছু মানুষের সান্নিধ্যে এসেছি এবং তারা ২০২১ সালে নেতাজির ছবি আমায় দেখিয়েছেন, যখন তার বয়স ১২৪ বছর। যদিও প্রামাণ্য দলীল হিসেবে সেই ফটো বা তাদের নাম আমি কিছুই দিতে পারলাম না এখানে কারণ নেতাজির মত হাই ভোল্টেজ বিষয়ে ডি ক্লাসিফাইড না  হলে কিছু তথ্য দেওয়া মানে সরকার ও রাজনৈতিক দলের চক্ষুশুল হওয়া। তবে এটা ভাববেন না যে রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার এই খবর জানে না, প্রত্যেকেই জানে কিন্তু অনেক রকম বৈদেশিক চাপ আছে তাদের উপর, সব সত্যি সামনে আনলেই মুশকিল। এটা আমার কথা নয় রাজনাথ সিং স্বয়ং একথা বলেছেন ২০১৬ সালে যে, সব ফাইল ডি ক্লাসিফাই করলে আমাদের বিদেশ নীতির অনেক রকম অসুবিধা হতে পারে।

এইবার লেখার শেষ পর্যায়ে আসি আর একটা বিষয় নিয়ে, যেটা আলোকপাত করা ভীষণ দরকার। অনুজ ধর ও চন্দ্রচুর ঘোষের কোনানড্রাম বেরোনোর পর বিশেষ করে সৃজিত পরিচালিত গুমনামী বাবা বেরোনোর পর অনেকেই প্রায় এই বিষয়ে সন্ধিহান যে গুমনামী বাবার সঙ্গে নেতাজিও ১৯৮৬ সালে মারা যান। সহায় কমিশন যদিও বলে দিয়েছে গুমনামী বাবা নেতাজি নন, কিন্তু তাও আমি আরও কিছু তথ্য এবং যুক্তি দেওয়া যথোপযুক্ত মনে করি এ বিষয়ে। এত বছরের গবেষণার পর আমি নিজে এই বিশ্বাসে উপনীত যে নেতাজি গুমনামী বাবা কিন্তু গুমনামী বাবা নেতাজি নন। অর্থাৎ নেতাজি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাজে তার ডামি ইউস করতেন কারণ স্বাধীন ভারতে জনসমক্ষে তিনি আসতে কোনোদিন চাননি এদিকে তাকে তার কার্যকলাপ চালিয়ে যেতে হবে সুতরাং অগত্যা বিভিন্ন সময়ে তাকে বিভিন্ন সাধুর বেশ নিতে হয়েছে। গুমনামী বাবা এতটা বিখ্যাত হয়েছেন প্রচারের কারণে কিন্তু এছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাধুর ছদ্মবেশ ধারণ করেছেন যেমন মৌনী বাবার কথাও আমরা আগে আলোচনা করেছি। এনারা ছাড়াও অনেক সাধুর বেশ তিনি নিয়েছেন এবং আমি সেগুলো আপনাদের সামনে আজ তুলে ধরছি।

শৈলমারি আশ্রমে সারদানন্দ জী মহারাজের কথা আমরা আগেই আলোচনা করেছি সেটা ৬০ এর দশকে। এছাড়া তার পরবর্তী সময়ে মধ্য প্রদেশের পন্ডলা নামক গ্রামে শ্রী জ্যোতিরদেব মহারাজ। অনেকেই বলেছেন এই সাধু নাকি মাঝে মধ্যেই গ্রাম থেকে চলে যেতেন এবং অনেক সিনিয়র আর্মি অফিসার রাজনৈতিক নেতারা তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। ১৯৭৭ সালে এই সাধু মারা যান এবং নাগদা ডিস্ট্রিক এর জগন্নাথপ্রসাদ গুপ্তা সহ আরও ৪জন ব্যক্তি মুখার্জি কমিশনকে জানান এই ব্যক্তি নেতাজি ছাড়া আর কেউই হতে পারে না।

এছাড়াও জয় গুরুদেব বলে একজন সাধু মথুরাতে ছিলেন যাকে তার সমর্থকরা নেতাজি বলে দাবী করতেন এমনকি স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন, এছাড়াও সেইসময় বাজপেয়ী আদবানির সঙ্গেও তার ফটো পাওয়া যায়। সুতরাং বুঝতেই পারছেন একজন যে সে সামান্য সাধু হলে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন না।

এছাড়া আর একজন সাধু হলেন লালধারী মুত্যা, তিনি দক্ষিণ ভারতের বাসিন্দা এবং অনেকেই তাকে নেতাজি মনে করতেন। তার মৃত্যুর পর নেতাজি সম্পর্কিত বহু জিনিস সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সময় জার্মানি ঘড়ি, মিলিটারী জ্যাকেট, ক্যাপ এসব অনেক জিনিস পাওয়া যায়।

সুতরাং শুধু গুমনামী বাবা বা মৌনীবাবা নন নেতাজি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাধুর বেশ ধারণ করে নিজের বৃহৎ কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন এবং হয়তো এখনো তিনি এভাবেই আত্মগোপন করে জাতীর উদ্দেশ্যে কাজ করে চলছেন। হয়তো আরো ১০-১৫ বছর পর তা আমাদের সামনে আসবে। তবে আমার এখনো পর্যন্ত গবেষণায় আমি এই ধারণায় দৃঢ় বিশ্বাসী যে, নেতাজি এখনো বেঁচে আছেন, যতটা তথ্য দিয়ে সম্ভব আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করেছি, কিন্তু আরও অনেক বিষয় আমি নিজে জানতে পেরেছি যেটা চাইলেও এই মুহূর্তে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে পারছি না, তবে সব কিছুর উপর ভিত্তি করে আমার এখনো পর্যন্ত তাকে নিয়ে সিদ্ধান্ত আপনাদের জানালাম। আমি নিশ্চিত সরকার নিশ্চয় আরও ফাইল আমাদের সামনে আনবেন এবং আমরা তার সম্পর্কে আরও অনেক অজানা তথ্য আগামী দিনে জানতে পারবো।

(ক্রমশ)


জয়িতা ভট্টাচার্য

 

বর্ণমালার সাতকাহন (পর্ব ৬)

 


ধর্ম ও বিত্ত

শূন্যতার উপলব্ধি সেই ছয় বছর বয়সে। আত্মীয়স্বজন কচিকাঁচা মিলিয়ে প্রায় দ্বারা জন্মদিনে চুনার বেড়াতে যাওয়া হয়েছিল। সেই সময় সঙ্গে থাকত বেডিং নামক এক ভ্রাম্যমাণ বিছানা। দড়ি খুললেই তার ওপর টপাটপ সবাই বসে গড়িয়ে পড়ত। ট্রেনে বড়োরা তাস খেলতেন। 29 অথবা ব্রে। ছোটোরা লুডো। ওই বেডিংএ কিনা থাকত! আচারের শিশি পর্যন্ত। যা বলছিলাম। সেইসব এবং মানুষদের সকলকে ফেরার ট্রেনে তুলে দিয়ে একা বাবা প্ল্যাটফর্মে। সবার শেষে উঠবেন। চুনার স্টেশনে অল্প সময় দাঁড়ায় ট্রেন। ছেড়ে দিয়ে ট্রেন চলতে শুরু করল। বাবা রয়ে গেলেন। ক্রমে দূরে। হয়ত কয়েক মিনিট। তারপর হৈ হৈ। চেন টেনে ট্রেন থামানো। বাবা উঠলেন। কিন্তু সেই যে বাবাকে ফেলে চলে যাচ্ছি এক ভয়ঙ্কর শূন্যতার উপলব্ধি। সেই প্রথম। বুকের ভেতর সেই অসীম শূন্যতা পাকাপাকি বাসা করে আছে সারাজীবন। বাবা চলে গেছেন দু বছরের বেশি। আমি দাঁড়িয়ে আছি প্ল্যাটফর্মে। যাইহোক, যত বড় হচ্ছিলাম ততই নাগালের বাইরে যাচ্ছিল মন।

সব রাস্তারই একটা শর্টকাট থাকে। আমাদের বাড়ি ও রেল স্টেশনেরও ছিল মূল পথ ছাড়া শর্টকাট, সরু পথ আর তারপর বিরাট একটা মাঠ পেরিয়ে পুকুরপাড় দিয়ে একটা রাস্তা। এই মাঠটা অধিকাংশ সময় ফাঁকা অব্যবহৃত থাকত, কখনো কোনো গরু বাছুর ঘাস খেতে আসতো। মাঠ পেরোলেই ট্রেনপথ, ট্রেন অনেক উঁচু দিয়ে যেন টিলার ওপর দিয়ে যেত। মাঠটির বিশেষত্ব ছিল এখানে সমস্ত গাছে অসংখ্য বাবুই পাখির বাসা ঝুলত। বাবুই পাখির বাসার মতো এত সুনির্মিত বাসা দেখা যায় না। ঠাস বুনন। একদিকে ঢোকার পথ অন্যদিকে বেরোবার। বাসার ভেতর মাটি লেপে সুন্দর দেয়াল আর তার গায়ে জোনাকি আটকানো। এমনকি একাধিক ঘরও থাকত। দেখতে উল্টোনো কুঁজোর মতো কিছুটা। সার সার বাবুইবাসা দেখতে পাব বলে ওই মাঠটায় একা একাও যেতাম স্কুল থেকে ফেরার সময় নির্জন দুপুরে। পরে আমার গ্রামতুতো এক বন্ধু একটি পড়ে যাওয়া বাসা এনে দিয়েছিল।

রাত সরগরম তক্ষক আর ঝিঁঝিঁর কনসার্টে। বর্ষাকালে ব্যাঙের ডাক। আমাদের ঘরে থপ থপ করে ঘুরে বেড়াত তারা কিন্তু সোনাব্যাঙ খুব দুরন্ত কিন্তু আকারে ছোটো। ঘরের এক কোণ থেকে আরেক কোণে লাফ দিত। সাপ সারা বছর। এবং আমার প্রিয় প্রাণী। ওরা আসলে খুব ভীতু এবং শান্তিপ্রিয়।

সেই সময় গড়িয়ায় এত কম লোক বাস করত যে সব ট্রেন দাঁড়াত না। লোডশেডিংয়ের সন্ধ্যাবেলা অনেক সময়

মা-বাবা-আমি স্টেশনে বেঞ্চিতে বসে থাকতাম। অনেকটা উঁচু থেকে নিচে মহাশূন্যের মতো অন্ধকার গড়িয়া, জোনাকির ভিড়ে টিমটিম করত। যে কজন নামতেন ট্রেন থেকে বেশিরভাগই চেনা।

মা গল্প করতেন। বাবা।

🦋

ছোটোবেলা থেকে সামাজিক বিভাজন আর যাপনের ভিন্নতা দেখেছি।

সম্পর্ক তখনও distant relative হয়ে যায়নি। দুটি বাড়িতেই ছিলো অবাধ যাতায়াত। ছুটি ছাটায় ভাই বোনেরা এবাড়ি সেবাড়ি গিয়ে থাকা হতো। পড়াশোনা একটা মরণ বাঁচন ব্যাপার ছিলো না। তাই আমরা অনেক ঘটনা মনের কোঠায় এখনো সাজিয়ে রাখতে পারা গেছে। নীরবে লক্ষ্য করতাম আচার ব্যবহারের ভিন্নতা। মজা পেতাম নানা বৈপরীত্যে, কথায় ও কাজে।

এমনই একটি বাড়ি ছিল কলকাতার ভীষণ বড়লোক পাড়ায়। সে বাড়িতে ছিল বিত্তের বিকট প্রদর্শন। তাঁদের বাড়ির কর্তা উচ্চপদস্থ ছিলেন শুনতাম। রামকৃষ্ণ মঠ মিশনের একেবারে ভয়াবহ ভক্ত। প্রতি কথায় নির্মোহের বাণী। তাঁর দশটি সন্তান ছিল। তিনি মেয়েদের তের ও চোদ্দ বছর বয়সে বিবাহ দেন। শৈশবে মাতৃহীন বোনের প্রথাগত শিক্ষা দেননি।

এঁরা বাবাকে মাকে আপনি বলতেন কিন্তু ভাই ভাই কলহ করতেন, মদ্যপান সহ সবই করতেন। এঁর এক কন্যার প্রাসাদে প্রথম দেখেছি সেলার। যার মধ্যে রাখা সারি সারি শিশি। আরো অনেক কিছু।

এঁদের সেই ধনীগৃহে বিবাহিত কন্যার শেষ জীবন কাটে একেবারে নিঃস্ব ও নিঃসঙ্গ অবস্থায়। মনে পড়ে রাত বারোটায় স্বামীর সঙ্গে অন্য রকম সেজে তাঁর রাত পার্টিতে যাওয়া।

আমাদের বনেদি এন্টালির বাড়িতে এসব কখনও দেখিনি। এসব তাই ছিল অভিনব অভিজ্ঞতা।

কয়েকদিন পর আমাদের সেই অজ পাড়াগাঁয়ে ফিরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। সেখানে গাছ থেকে ফল পাড়া। গরুর পাল, রাখালদের সঙ্গে বন্ধুত্ব। আজও মার্জিনাল মানুষজনের সঙ্গেই আমি বেশি আরাম বোধ করি।

দুটো ব্যাপার আমি উপলব্ধি যে করেছিলাম বছর দশেক বয়সের মধ্যেই যে ধর্মাচারণ বা এরিস্ট্রোকেসি কিন্তু সফিসটিকেটেড মননশীলতা গঠন করতে পারে না কিম্বা পারবেই না একথাও বলা যায় না।

(ক্রমশ)