কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১

<<<< সম্পাদকীয় >>>>

 


কালিমাটি অনলাইন / ৯৪




আক্ষরিক অর্থে আমরা অর্থাৎ এই বিশ্বে বসবাসকারী মানুষেরা এখন বসবাস করছি এক পরিবর্তিত বিশ্বে। বিগত ২০১৯ থেকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলশ্রুতিতে এক অপ্রত্যাশিত ও অভাবিত অবস্থা এবং পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছে। আমাদের দৈনন্দিন ও স্বাভাবিক জীবনযাপন হয়েছে বিপর্যস্ত। আগের মতো আমরা কেউ আর সাধারণ শারীরিক পদ্ধতিতে শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহণ ও বর্জন করতে পারছি না। সামাজিক ভাবে কেউ কারও সঙ্গে মেলামেশা করতে পারছি না। এমনকি সংক্রমণের আশঙ্কার দরুণ কেউ কারও সুখে দুঃখে অংশগ্রহণও করতে পারছি না। তাহলে মনে মনে উদ্বেগ ছড়াতেই পারে, আমরা কি ক্রমে ক্রমে অসামাজিক প্রাণীতে রূপান্তরিত হচ্ছি? ছেলেবেলা থেকে সামাজিক বিজ্ঞানের বইতে পড়া ‘মানুষ এক সামাজিক প্রাণী’ এই ধারণা থেকে ক্রমশ বিচ্যুত হচ্ছি? বস্তুত পক্ষে যাঁরা এই করোনা সংক্রমণে আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যেই প্রয়াত হয়েছেন, তাঁরা অবশ্যই এই ধারণা মনে মনে পোষণ করেই পৃথিবী থেকে অকালে বিদায় গ্রহণ করেছেন। তাঁরা অন্তত পৃথিবী ভবিষ্যতে কোনো একদিন আবার সুস্থ ও স্বাভাবিক হয়ে উঠবে, এই ভাবনার রূপায়ণ দেখে যেতে পারেননি। স্বপ্ন দেখার অবকাশ পাননি, ‘একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে’।

অনেকেই তর্ক বিতর্কে অংশগ্রহণ করে প্রশ্ন তোলেন, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের দরুণ সারা পৃথিবী জুড়ে যে মৃত্যুতান্ডব চলেছে, তা অস্বীকার করছি না, কিন্তু সেইসঙ্গে এটাও তো বাস্তব যে, পৃথিবীতে আরও অনেক অনেক ভাইরাসের সংক্রমণে এবং অন্যান্য রোগে বা অসুখে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। দুর্ঘটনায় কত কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। বিশেষত এমন কিছু অসুখ আছে, যার নিরাময়ের সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। আর তাই, মৃত্যুর জন্য আতঙ্কিত না হয়ে বরং আমাদের সাবধানতা অবলম্বন করা একান্ত জরুরি, যাতে আমরা মৃত্যুকে যতদিন সম্ভব ঠেকিয়ে রাখতে পারি।

হ্যাঁ, এটাই হচ্ছে আসল কথা। এটাই হচ্ছে যুক্তিপূর্ণ কথা। আমরা ছেলেবেলায় সামাজিক বিজ্ঞানের বইতে যেমন পড়েছি, ‘মানুষ এক সামাজিক প্রাণী’, ঠিক  তেমনি প্রাণী বিজ্ঞানের বইতে পড়েছি, ‘মানুষ মরণশীল প্রাণী’। না, এসব আদৌ কোনো নতুন কথা নয়, আমরা সবাই এসব কথা জানি। এবং শুধুমাত্র মানুষ কেন, পৃথিবীতে যতরকম প্রাণী আছে, পশুপাখি-কীটপতঙ্গ-ব্যাকটেরিয়া-ভাইরাস, সবারই মৃত্যু আছে। আবার শুধু প্রাণেরই বা কথা কেন, বিজ্ঞানীদের মতে, জড় ও অজড়, সব কিছুই পরিবর্তনশীল এবং তাদের বিনাশ ঘটে। সুতরাং যাবতীয় প্রাণ ও অপ্রাণের জন্ম-মৃত্যু একটা প্রক্রিয়ার দুটি দিক। তবে যেহেতু প্রাণীদের মধ্যে মস্তিষ্কের সর্বোচ্চ বিকাশ ঘটেছে মানুষের, তাই একমাত্র মানুষেরই মৃত্যুচিন্তার পাশাপাশি আছে মৃত্যুচেতনা। আর এই মৃত্যুচেতনাই বিভিন্ন বিষম পরিস্থিতিতে মানুষকে বিভ্রান্ত, বিপর্যস্ত ও আতঙ্কিত করে তোলে। এবং তারই পরিণামে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই জীবনের স্বাভাবিক নিয়ম ও সমীকরণ। বেঁচে থাকার আনন্দের স্বাদই আমরা বিস্মৃত হই মৃত্যুচেতনার প্রেক্ষিতে।   

সুতরাং পরিশেষে এইটুকুই বলা যেতে পারে, মৃত্যুর ভাবনা মুলতুবি রেখে সবাই বাঁচার আনন্দ উপভোগ করুন এবং ভালো থাকুন।  সবাইকে জানাই শারদ শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন, ‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের বর্তমান সংখ্যায় স্লাইড শো’তে যে পাঁচটি ছবি আছে, সেই পাঁচটি ছবি আমাদের অত্যন্ত স্নেহের ও ভালোবাসার চিত্রশিল্পী রূপক কুন্ডুর সৃষ্টি। এবং রূপক শুধু চিত্রশিল্প নয়, বরং মননশীল কবিও। রূপকের কবিতা ও চিত্রশিল্পের একটি সংকলন সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘বৈভাষিক প্রকাশনী’ থেকে। বইটির শিরোনাম ‘রূপকধর্মী’। আগ্রহী পাঠক ও চিত্রশিল্পীরা বইটি সংগ্রহ করতে পারেন প্রকাশনী থেকে।

 

আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com

দূরভাষ যোগাযোগ : 9835544675

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India.

 

 

 

  


<<<< কথনবিশ্ব >>>>

 


কথনবিশ্ব


চিত্তরঞ্জন হীরা

 

যে ফাঁক থেকে উঁকি দেয় পাখিদের ভূমধ্য




সবটুকুই প্রলাপ অথবা এ জীবন শুধু পাখি পাখি। ডানাহীন উড়ে যাওয়া। গাছগল্পের খই নিয়ে। বোঝা কি গেল! এ জীবনের কতটুকু আর বোঝা যায়! কানে বাজছে ভোরভিখারির খোল করতাল। সকাল থেকে জীবন চললো তার পায়ে পায়ে। আমিও কি ছাই এতো সব বুঝি ! সভ্যতার পালে হাওয়া লাগে। দোল খায় পরিহাস নিয়ে।

তো আমরা আমাদের জীবন-অভিজ্ঞতায় বুঝলাম একজন স্রষ্টা একই সঙ্গে সময় ও প্রতিভার সন্তান। তবু সময় নিয়ে আমাদের বিভ্রান্তির কোনও শেষ নেই। সে অশেষ। কেউ সময়কে বিচার করেন কোলাহলের বৃত্তে দাঁড়িয়ে। আবার কেউ দেখেন কেন্দ্রের উৎস থেকে। শূন্য থেকে কণা কণা এই চরাচরের পুরো দৃশ্যগুলো আকণ্ঠ হয়। দূর সংকেতের বাঁশি বাজে। তখন বিষয়ের মধ্যের বিষয় বা ঘটনার অন্তরে নিহিত ঘটনাই প্রধান। একটি সরলরেখার কথা ভাবি। চলতে চলতে পায়ের বেগে আবেগ হলো অথৈ। যার এক মুখে বাজছে প্রবল সংযোগের রতি, অন্য মুখে ভরা বিযুক্তি। এই দুটি মুখ যে যার দিকে প্রসারিত। এই চলতা ছন্নছাড়া। তবু সেই-ই সভ্যতার মুখে দেয় বিকাশের বাতি। সৃষ্টির শিখায় নিয়তি হয়ে জ্বলতে থাকে স্রোতস্বিনী ফল্গু হয়ে।

"বৈশ্য লেখকের পক্ষে শূদ্র পাঠকের মনোরঞ্জন করা সঙ্গত। সুতরাং যাই করো না কেন পাঠকের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করো না।" বলেছিলেন প্রমথ চৌধুরী। সে তো আর আজকের কথা নয়। 'সবুজপত্র' প্রথম প্রকাশ পায় ১৯১৪ সালে। যে পত্রিকা হয়ে উঠেছিল কালের কণ্ঠ। কিন্তু এসব কথার আবার নানা অর্থ হয় ওই যে আমরা বলেছি সরলরেখার দুটি মুখ'বৈশ্য' 'শূদ্র', এরপর আসবে কুলীন লেখক পাঠকদের কথা এভাবে জাত বর্ণ বিভাজন নিয়ে কথা বাড়িয়ে কোনও লাভ নেই। প্রতি কালেই একদল লেখক পাঠকের মনোরঞ্জনের কথা সবার আগে ভেবেছেন  আর আরেক দল লেখক প্রচলিত ধারা বা ভাষাকে অতিক্রমের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। এই দুটোর মধ্যে একটা সংযোগ অবশ্য তলে তলে অখণ্ড জলরাশির মতো গড়েই ওঠে । কারণ নতুনধারা সবসময় প্রত্যক্ষে হোক বা পরোক্ষে সে মূলধারাকে পুষ্ট করেই এসেছে।

তবে পাঠকের মনোরঞ্জন করা একটা দুঃসাধ্য কাজ। কারণ পাঠক যে ঠিক কী চায় সে নিজেই জানে না। মধুর তোমার পারাপারখানি। পাড়ে নৌকো বাঁধা আছে। যাবে কি যাবে না তুমি ভাবো। যাহোক উঠে পড়েছো, এবার ভাবো কোন্ ঘাটে ভিড়াবে তোমার নাও ! অর্থাৎ পাঠক হলো নানা রুচির। একজন লেখক বোধহয় সবার আগে ভাববেন –এই ব্রক্ষ্মাণ্ডে তাঁর অবস্থান কোথায় ! এরপর ভাববেন – তিনি যা লিখছেন বা লিখতে চান, সে লেখায় নিজের প্রতি খোঁজ জারি আছে কীনা ! অর্থাৎ আত্মানুসন্ধান। আরও ভাবার হলো তিনি নিজের কাছে সৎ তো ! যে সৃষ্টির মধ্যে সত্যের খোঁজ নেই, ভবিষ্যতের কাছে তার মূল্য কোথায়!

'মূল্য' শব্দটিও বড্ড আপেক্ষিক। জীবন সম্পর্কে এক একজনের মূল্যবোধ এক একরকমের। সমাজ সম্পর্কে ধারণাটাও তাই বদলে যায় ব্যক্তিবিশেষে। কাল এবং কালান্তরে, মন এবং মননে ঘুরে ফিরে জীবন এক পূর্ণতার কথা বলে। কিন্তু পূর্ণ বলে তো কিছু হয় না। এক রহস্য থেকে আরেক রহস্যের দিকে যেতে যেতে পূর্ণতার খোঁজ চলতে থাকে। এক জীবনে কলসটা আর পূর্ণ হয় না। আবার জীবন সেই একটাই। তাহলে উপায়! কোথায় এলাম কোথায় যাবো ভাবতে ভাবতে এক অনির্ণেয়তার মধ্যে দিয়ে এই জীবনযাত্রা। কবিও চলেছেন, পাঠকও চলেছেন। চলাটাই সত্য। ভেতরে অচিন পাখির গান, পালকের ঘ্রাণ, সংসার, অন্তরের অন্তর –এসব নিয়েই চলতে থাকা।

এসব ভাবতে বসলে আবার জীবন মেলে না। আর ওই পাঠক, যিনি সৃষ্টির রহস্য নিয়ে, শব্দের লীলাখেলা নিয়ে বসবেন, তিনি সামাজিক জীবন হারাবেন। এখন ভেবে দেখুন কোন্ পথ আপনার ! লেখক ভাবছেন – কিছুই লিখতে পারিনি আমি, অন্তত সেই লেখাটি যা আমি লিখতে চাই। আর পাঠকও ভাবছেন – এই পৃথিবীর কী অপার বিস্ময়, কিছুই জানা হলো না আমার ! এমনটা হলে সব গেলো, সংসার এলোমেলো। এ জীবন তো এক বিকিকিনির হাট। সব মিলিয়ে কথা হলো লেখক যেমন তাঁর সত্তার আলোড়নটুকু ধরতে চাইবেন, পাঠ যেমন এক অভ্যাস, নিরাকারের খেলার মতো ভেতরে ভেতরে গড়ে তুলতে হয় পাঠক হয়ে ওঠাও অভ্যাসের মধ্যেই পড়ে

আমরা এখনও বিশ্বাস করি সৃষ্টি শুধু বিনোদনের বিষয় বা বস্তু নয়, সে হবে ভবিষ্যতের বার্তাবাহী। কেনাবেচার সারাৎসারে জীবন পড়বে একলা পথের বাঁকে। বনকাপাসির মাঠে তুলো উড়ছে বীজ নিয়ে। তাহলে সৃষ্টিকেও হতে হবে রূপান্তরিত রসের ঘনঘটায় একেবারে কোলাহলমুক্ত। যে সময়ের কোলাহলকে ছিঁড়ে-ছেনে তার গভীরের গূঢ় নির্যাসকে তুলে এনে শব্দে সাজিয়ে দিতে সক্ষম হবে, অন্তত চেষ্টাটা জারি থাকবে। সময়কে টপকে অতিক্রমের ভাষা নির্ধারণ করতে সক্ষম হবে, তার মধ্যেই ভবিষ্যতের বার্তাটুকু। অর্থাৎ সম্ভাবনা। পুরোনোকে বর্জন করে নতুনের খোঁজ হলো তার সচেতন প্রয়াস।

যা কিছু অতীত তার সবটুকু কি ইতিহাস হতে পারে ! বোধহয় নয়। ইতিহাস হয়ে ওঠার জন্যে কিছু উপাদান চাই। ঐতিহ্যের নিহিতে যে গূঢ় ঘটনার সম্ভার তাকে জমিয়ে জমিয়ে কালের ইতিহাস। পায়ে পায়ে এক বিস্তারের খেলা। ক্রমে পেরিয়ে যাওয়া আর পথের বাঁকে ছাপ ফেলে রাখা। এমন এক একটা সময় আসে মনে হয় চারপাশে সব কিছু যেন থেমে আছে। তখন ভেতরের অস্থিরতা বাইরে প্রকাশ পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে রুগ্ন উটের পিঠে চেপে সওয়ার হচ্ছে সময়। তাহলে কি এই উর্বরা মাটি মরুভূমি হলো ! তাতো নয়। এই যে চর্যাপদ থেকে পায়ে পায়ে সময়ের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে এতদূর এলো সেতো একই ধারায় আসেনি গতি-প্রকৃতি বদলে, ভাষা-আঙ্গিক বদলে আজ এখানে এসে পৌঁছেছে। এক একটা রাহুগ্রস্ত সময়ের ধোঁয়া-ধুলো বাঁচিয়ে, ঝড়-জল-মরুভূমি, পাহাড়-নদী-সমুদ্র পেরিয়েই এখানে আসা

আসলে এই মুহূর্তে যা অসম্ভব, যা অবাস্তব এবং যা অনির্ণেয় – তাকে খুঁজতে খুঁজতে এগিয়ে চলা। মুহূর্তের ব্যর্থতাকে ছড়িয়ে নিয়ে বসা। তার মাঝে যে আনন্দটুকু লুকিয়ে রয়েছে তাকে উদ্ধার করা। যেমন এখন আমাদের সন্ধান করতে চাইছি জীবনানন্দ পরবর্তী কবিতার ভাষাপথ। যে পথে পড়ে আছে আজও সার্বিক গ্রাহ্যতার বাইরে। যেভাবে আমরা পেরিয়ে এসেছি মাইকেলের যুগ, রবীন্দ্রনাথের যুগ তারপর জীবনানন্দের যুগ। গ্রহণ করতেই অনেকটা সময়। এখন বলতে হচ্ছে তাকে অতিক্রমের পথ কেন এতো দীর্ঘ হচ্ছে ! অনেকটা পেরিয়ে আসার পরও কেন এতো পিছুটান ! আমরা আজও কেন পরাবাস্তবতার ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতে পারছি না !

শিল্প-সাহিত্যের মূলধারার একটা শর্ত থাকে, তা হলো, মিডিয়া যা চায় তাকে পুষ্ট করা। আর একটি দিক আমরা জানি, সেটা হলো স্রোতের বিরুদ্ধে হাঁটা। দেখা গেছে আঙ্গিক ও প্রকরণের দিক থেকে কবিতায় যখনই নতুনের অভিমুখটি খুলে যায় তখন ভাষা তাকে পথ দেখায়। তবে এই ভাষাভ্রমণে আমরা লক্ষ্য করেছি এক ধারা থেকে পরবর্তী ধারায় পৌঁছতে পূর্ববর্তী চিহ্নগুলির কখনোই একেবারে বিলুপ্তি ঘটে না। কিছু বৈশিষ্ট্য নতুন নতুন রূপ নিয়ে ফিরে ফিরে আসে।

এক্ষেত্রে বলার কথা হলো শব্দের যেমন নিজস্ব কিছু সত্যতা রয়েছে, তেমনি তার বাস্তবতার রূপ স্থান ও কাল ভেদে ভিন্ন। সূর্য এবং পৃথিবীর অবস্থান, বস্তুর ধারণা, পদার্থের চেতনা যেমন এক একটি বিজ্ঞানদর্শনের হাত ধরে বদলে যেতে সক্ষম হয়েছে তেমনি সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলো, সংস্কার, বিশ্বাসও পাল্টে যায় চেতনার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে। এপথেই ভাষার রূপান্তর, শিল্প-সাহিত্যের রূপান্তর

আগামীর সম্ভাবনা তখনই উজ্জ্বল হতে পারে যখন সমস্ত চলমানতাকে নস্যাৎ করে নতুন ভাবনায় পদার্পণ করা যায়। এটা বুঝতে হবে সীমাহীন কালের দ্যোতনা দিয়ে। যেমন ভাষা নিয়ে ভাবতে বসলে প্রথমেই প্রচলিত শব্দার্থ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কারণ শব্দের নিজস্ব কোনও অর্থ নেই। কোনও বস্তুকে চিনতে শব্দ দিয়ে একদিন তাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বস্তুর ধারণা পাল্টে গেলে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়। তখন বদলে যাবে চিহ্ন এবং চিহ্নিতের মধ্যে সম্পর্ক। এভাবে বস্তু থেকে বাস্তবতা। বাস্তব হলো কাল্পনিক অভিজ্ঞতা, যা লালিত হয় মস্তিষ্কে

এই প্রসঙ্গে কল্পনাকে যদি অনুভূতি দিয়ে মাপা হয় তাহলে উন্মোচনের আধারটি সামনে প্রকট হতে পারে। কবির চেতনা নিত্য প্রসারিত হতে হতে সামনে এগিয়ে চলে। আমরা জীবনানন্দ পরবর্তী বাংলা কবিতার ভাষাপথের সন্ধান করতে গিয়ে দেখলাম যে লক্ষণগুলো কবিতায় প্রকট হচ্ছে তা বাস্তব নয়, পরাবাস্তবিক, অবচেতনার। জীবনানন্দের মৃত্যুর অনেকগুলো বছর পেরিয়ে এসে ১৯৮৮-তে কবি বারীন ঘোষাল একটি বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে বোঝাতে চাইলেন এপথেই অবচেতনার অবসান ঘটুক। তিনি অতিচেতনার কথা বললেন।

এখন কথা হলো কী সেই অতিচেতনা, যা আমাদের অবচেতনার ঘোর থেকে বাইরে এনে দাঁড় করাতে পারে ! তিনি দেখালেন চেতনার ভেতরে যে চেতনার কথা এতদিন আমরা ভেবেছি সেটি হলো অবচেতনা। এখন ভেতর থেকে বাইরে এসে দাঁড়াতে হবে। আমাদের বহির্মুখী হতে হবে। যেখানে চিন্তার উৎস এক, মাপক এক, শুধু অভিমুখটি বদলে যাবে। এই ভাবনায় জারিত হয়ে কবিতার একটা পালাবদল ঘটলো। তাতে যে লক্ষণগুলো উঠে এলো, তাকে সাজালে মোটামুটি যা আমরা দেখতে পাই

. কবিতায় আমিময়তার প্রভাব কমে নৈরাত্ম কবিতা লেখার প্রয়াস।

. ব্যাকরণসিদ্ধ ছন্দে লেখা থেকে বেরিয়ে কবিতা হলো মুক্ত ও স্বাধীন। শব্দ ব্যবহারের স্বাধীনতা বেড়ে গেলো।

. কবিতা ছন্দোমুক্ত হয়ে তথাকথিত লিরিক্সও বদলে যায়। অর্থাৎ পেলব গীতল কবিতা লেখার প্রবণতা হ্রাস পায়। টানা গদ্যে লেখার প্রবণতা। অনেকেরই কবিতা হয়ে উঠলো গদ্যভাষার কাছাকাছি

. উপমা এবং সাদৃশ্যবাচক শব্দের ব্যবহার কমে গেলো

. বিশেষণ ব্যবহারের পদ্ধতিও বদলে গেলো

  কবিতায় যুক্তিপরম্পরা ও সিদ্ধান্তমুখীনতাকে ভেঙে দেওয়া সম্ভব হলো

. বিষয়কেন্দ্রিকতাও মুক্ত হলো

. উজ্জ্বল একটি পংক্তি রচনার চেয়ে গোটা একটি কবিতা বা টোটাল পোয়েট্রির দিকে ঝোঁক বেড়ে গেলো

. শব্দ ব্যবহারের প্রযুক্তি কবিতাকে করে তুললো জীবনের মতো গতিময়

আরও অনেক বৈশিষ্ট্য উদ্ধার করা যায়। সময় যত বদলাবে নতুন নতুন বৈশিষ্ট্যেরও জন্ম হবে। তবে চলার মধ্যেও একটা নাচলাও থাকে। অর্থাৎ গতানুগতিক। থাকতে থাকতে খোলসের গায়ে শ্যাওলা জমে। সময়ে দাঁড়িয়ে তার খোলস ছাড়িয়ে যদি ভিন্ন এক এককের সামনে দাঁড়ানো সক্ষম হয় তবেই এই বদলগুলো বুঝে ওঠা সম্ভব। যেকোনও  শিল্পের প্রকাশ হলো, যা সামনাসামনি দেখছি সেখান থেকে নয়, ঘটনার ভেতরের ঘটনা থেকে

বারীন ঘোষাল চেয়েছিলেন বাংলা কবিতা সার্বিকভাবে জীবনানন্দ প্রভাবমুক্ত হোক। তিনি বলেছিলেন, পুরোনো কবিতার সমস্ত চিহ্নবর্জিত কবিতাই হয়ে উঠবে নতুন কবিতা। যেমন বুদ্ধদেব বসুরা ভেবেছিলেন কবিতাকে যদি রবীন্দ্রপ্রভাবমুক্ত করে তোলা না যায় তাহলে সময়ের সঙ্গে এগিয়ে চলা সম্ভব নয়। অর্থাৎ প্রতিটি সময়ের নতুন হলো যে অতীতের হাত ছেড়ে আগামীর সম্ভাবনাকে উজ্জ্বল করে তুলতে চায়।

এখন দেখার, কবিতার ভেতরের পরিবর্তনগুলো আসছে কীভাবে! লক্ষ্য করা গেলো, শব্দ মূলত ধ্বনির সমন্বয়ে সৃষ্টি। তাহলে শব্দের উৎসে যে ধ্বনি তার সংকেতকে উদ্ধার করতে পারলেই শব্দের বোধকে পাল্টে দেওয়া সম্ভব। বস্তুর বোধ থেকে অনুভবে পৌঁছনোটা খুব জরুরি। অনুভবই প্রথম স্পর্শ। বস্তুর একটা তরঙ্গসূত্র রয়েছে। যেখান থেকে কার্যকারণ সম্পর্কের মাধ্যমে পাঠকের পাঠ শুরু হয়। যা অনুভবকে জাগিয়ে তোলে। মূলত সেই ধ্বনি। ধ্বনি থেকে আলো বিচ্ছুরিত হয়, আলো থেকে রঙ, রস, বর্ণ, গন্ধ। সব মিলিয়ে এক একটা চিত্রের গড়ে ওঠা। সেই কাল্পনিক চিত্র স্নায়ুকে জাগায়। এজন্যই বলা হয় কবিতা হলো কাল্পনিক অভিজ্ঞতার ফসল।

আমরা আগেও বলতে চেয়েছি, যেকোনও সৃষ্টির মূলে থাকে তুমুল অস্থিরতা। অস্থিরতার আলোড়ন। সৃষ্টির আগের মুহূর্তে সবকিছু বিশৃঙ্খল হতে থাকে। সেই বিশৃঙ্খলা, অবিন্যস্ততার ভেতর থেকে কবির শব্দরা আসে। তাকে সাজিয়ে তোলাই কবির কাজ। কালিক বাস্তবতায় প্রতিটি সময়ের অস্থিরতা তার ঘটনাপ্রবাহের উপর নির্ভর করে। ফলে শব্দের চলন বদলায়। কবিতার ভাষা বদলায়, আঙ্গিক বদলায়। প্রতি মুহূর্তে কবির সত্তায় এক একটি দৃশ্যের জন্ম হয়। একটি দৃশ্য থেকে আরেকটি দৃশ্যের জন্ম হওয়াকে কবি ধরেন বোধের আলোড়ন দিয়ে। এই প্রক্রিয়ায় দৃশ্য এবং বোধ ক্রমাগত জায়গা বদল করতে চায়। ভাষার নতুন বিন্যাস খোঁজে। প্ররোচিত করে।

যেমন পরাবাস্তব কবিতার যাত্রা পর্যন্ত আমরা লক্ষ্য করেছি কবিতা ক্রমশ আখ্যানের আশ্রয় ছেড়ে খণ্ড খণ্ড অনুভূতির স্ফূরণ হয়ে উঠছে। পাশাপাশি মিথ ভেঙে নতুন মিথ নির্মাণের দিকে একটা প্রবণতার জন্ম হয়েছে। তখন আখ্যানের বদলে দীর্ঘ বা মহাকবিতা লেখার ঝোঁক অনেকের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে। এছাড়া টানা গদ্যে লেখা শুরু হয়েছে এবং অন্ত্যমিলের প্রাধান্য থাকছে না। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যুগচেতনা  ইতিহাস ছুঁয়ে নতুন সমাজচেতনার উদ্ভাসগুলো ফুটিয়ে তুলতে চাইছে

আমরা এও লক্ষ্য করলাম বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে কবিতার চেতনকাঠামো ও প্রযুক্তির বদল ঘটছে। গত শতকের ষাটের দশকের আন্দোলনগুলো আঙ্গিক ও প্রকরণ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে নিদর্শন দেখিয়েছিলো, বাংলা সাহিত্যে তার প্রভাব অস্বীকার করার নয়। জীবনানন্দ অনুভব করেছিলেন একজন কবির বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকাটা বিশেষ জরুরি। স্বাভাবিক জ্ঞানে আমরাও অনুভব করলাম মৌলিক হওয়ার চেতনা ছাড়া পৃথিবীর কেউ নতুন পথ দেখাতে পারেনা। এই চেতনাই বিজ্ঞান। কবিতায় বিজ্ঞান আসে চেতনার মাধ্যমেই। বিজ্ঞান যেহেতু জীবনকে চালিত করে, অধিকাংশ ভাবনাও এগিয়ে যায় বৈজ্ঞানিক মনোভঙ্গী নিয়ে। কবিতায় ভাষার প্রযুক্তিও বিজ্ঞান। যেমন অণু-পরমাণুর গঠন, তাদের সম্পর্ক, বস্তুর অবস্থান – এসব নিয়েই কবিতা এগিয়ে চলে।

আমরা শুরুতেই বলতে চেয়েছি সামাজিক জীবন এবং কবির জীবন –এই দুইয়ে মিলে সৃষ্টির ভুবন। এই দুটিকে মেলানোই এক কঠিন কাজ। সকলেই স্রষ্টা নন। সকলে কবিও নন। তাহলে কবি কে? –এও এক কঠিন প্রশ্ন। বিতর্কিতও বটে। সবার সঙ্গে সবার মতের মিল হবেই সেটা দাবি করা যায় না। এই প্রসঙ্গে গৌরীদেবীর কথা মনে পড়ছে। গৌরী ধর্মপাল। তিনি এক জায়গায় বলেছেন, কবি তিনিই "যিনি সবার সঙ্গে প্রায়-এক, এবং সর্বমিলনের আনন্দপুলক, পুরোপুরি-মিলতে-পারার বেদনার সঙ্গে মেশামেশি হয়ে, যাঁর হৃদয় থেকে, আত্মার, সত্তার গভীরতম প্রদেশ থেকে এক আশ্চর্য অ-লৌকিক তরঙ্গিত ভাষা হয়ে বেরিয়ে আসে"

লক্ষ্য করার, এই 'প্রায়-এক' শব্দবন্ধ গৌরী দেবী ব্যবহার করেছিলেন এবং পুরোপুরি মিলতে না পারার বেদনার কথাও বলেছেন। এভাবে আশ্চর্য এক অনুভূতির গভীরে তিনি ঠেলে দিলেন। এভাবে সবাই কি দেখতে পান! একজন কবি যখন লিখতে বসেন তখন সৃষ্টির সমস্ত আলোড়ন তাকে একটি বিন্দুতে এনে দাঁড় করায়। প্রথম পংক্তিটি এলো, তারপর ক্রমশ সত্তা তাঁকে টেনে চলেছে আত্মভ্রমণের পথ ধরে অনির্ণেয়তার দিকে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেলো তিনি যা লিখতে চেয়েছিলেন আর যা লিখলেন তা এক নয়। কোনোদিনই যেন লেখা হয়ে ওঠে না সেই কবিতাটি। ফলে অস্তিত্বের সন্ধানও কখনও শেষ হয় না। যা তিনি লিখে উঠলেন পাঠকও তার সবটুকু উদ্ধার করতে পারেন না বলে প্রতি পাঠে নতুন নতুন রহস্যের দিক উন্মোচিত হয়। কবিতার সার্থকতা সেখানেই। ক্রমাগত রক্তাক্ত হচ্ছে আত্মভ্রমণের পথ। আর আর্ত হয়ে ঝরে পড়ছে 'অ-লৌকিক তরঙ্গিত ভাষা'

যাবতীয় গতানুগতিকতার অতিক্রমণ ঘটে প্রসারিত চেতনার নির্দেশে। ভাবনার পাল্টে যাওয়া থাকে মূল্যবোধের তাড়নার মধ্যে। তাকে সংস্কার দিয়ে বাঁধলে ভাষার প্রসার এবং সম্ভাবনা দুই-ই থেমে থাকতে পারে। অর্থাৎ নতুন ভাষার উদ্ভব সম্ভব নয়। সংস্কৃতি যেহেতু সময়ের দাসত্ব করে না, তাই চেতনার নির্দেশ তার কাছে সবার আগে পৌঁছায়। তারপর অন্তর্জগতের আলোড়ন থেকে প্রকাশিত হয় বিমূর্ত সৌন্দর্য। বিশ্বসংসার তড়িৎ চুম্বকের তরঙ্গে ভাসছে। প্রতিটি ঢেউ অতিক্রম করতে চায় প্রতি মুহূর্তের বর্তমানকে।

অস্তিত্বকে অনুভব করা যায়, কিন্তু বর্ণনা করা যায় না। এই অবর্ণনীয় অস্তিত্বের সন্ধানেই একজন কবিকে হেঁটে যেতে হয় সারাটা জীবন কাঁটা বেছানো পথ ধরে। কারণ সময়কে অতিক্রমের পথ কখনও মসৃণ নয়। বারীন ঘোষাল ভেবেছিলেন, "যে কোন শিল্প মাধ্যমেই অনুভূতি ও কাল্পনিক অভিজ্ঞতার প্রকাশ গঠিত ও নির্মিত হয়ে থাকে। রূপে গুণে সজ্জিত হয়ে থাকে। নির্মাণ সম্পূর্ণ হবার পর তাতে রূপ গুণ আরোপ করা যায় না। নির্মাণ চলাকালীনই রূপ গুণ মিশতে থাকে তাতে। শিল্পী সচেতনভাবে একাজটা করেন না। তাই মনে হয় শিল্পীর ভেতরেই আছে সেই ছবি যা তিনি বাইরে নিয়ে আসেন, পুনর্গঠন করেন" (কবিতা ধারার মুক্তি)

পাঠক ভেবে দেখতে পারেন। সৃষ্টির আলোড়ন এখানেই। সমাজসত্যের বাইরের রূপটি যেমন তাকে যদি আমরা কার্যকারণ সম্পর্কের ভেতর থেকে না দেখি তাহলে বোঝা যাবে না যে ঘটনা বাহ্যরূপে নেই। নিহিত যে সত্য তাকে উদঘাটনের জন্যেই এতো এতো কথা। এপথে যার প্রথম পদধ্বনি শোনা যায় সে আমাদের আত্মজিজ্ঞাসা। সে নিজেকে আঘাত করে আরও ভেতরকে জাগায়। আমাদের বুঝতে হবে এইমাত্র যে বর্তমান অতীত হলো, তার মধ্যেও বাস্তব রয়েছে। আর সেই বাস্তবতার হাত ধরে আমাদের হেঁটে যেতে হবে আরেক বাস্তবের দিকে যা আগামীর ভবিষ্যৎ। এভাবেই স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ মেলাতে মেলাতে আমাদের নিরাসক্ত হেঁটে যাওয়া। যে চলার কোনও শেষ নেই। অস্তিত্বের স্বজ্ঞার জন্যে নিরাসক্ত হওয়া ছাড়া লেখকের আর কিছু চাওয়া নেই। এতো এতো কলকল্লোলের মধ্যে কবি শুধু নৈঃশব্দ্যকে লেখেন। যে জীবন কবির জীবন। একান্ত তাঁর নিজের। নিজের সত্তার খোঁজে আত্মার নির্দেশে হেঁটে যাওয়া পথ কবির একার।

 

 

 

 


অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ১২




লেখাটা শুরু করতে গিয়ে কবি স্বদেশ সেনের ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু কবিতার বইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। সেই সত্তরের দশকে লেখা অন্যধারার কবিতা- ‘গুন লাগে কমলালেবুর/গায়ে গায়ে সমস্ত শরীরে’। কারণ আজ একটু অন্যধারার সিনেমা নিয়ে আসরে নামব। একটু বেয়াড়া টাইপ ছবি। যে সিনেমা  সবাই বসে উপভোগ করতে পারবে না। এগুলো ‘মেনস্ট্রিম’ বা উপভোগ্য সিনেমা কোনোভাবেই বলা যাবে না। নিটোল কোন গল্প এখানে থাকে না। কিন্তু শিল্প ও সংস্কৃতি জগতে এইসব ছায়াছবির মূল্য অনেক, কারণ এরা বিভিন্নভাবে সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। এক্সপেরিমেন্টাল বলুন বা আভাঁ-গার্ড বা আর্ট-হাউজ -- এইসব সিনেমা, পরিচালক বা অভিনেতা বা সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্যান্য মানুষদের বা আমাদের মত সমালোচকদের ছবির বিভিন্ন দিক অনেক অ্যাঙ্গল থেকে বুঝতে সাহায্য করে। এবং পরবর্তীকালের অনেক সিনেমা তৈরিতে এদের থিম বা ক্যামেরার অবদান থাকে। অবশ্য বলাই বাহুল্য, এইসব সিনেমা সাধারণ দর্শক টানতে ব্যর্থ হয় বলে হলগুলোয় বেশিদিন  চলে না। তবে এটাও শুনিয়ে রাখি, আগের বার যে ১২টা সিনেমার কথা উল্লেখ করলাম পৃথিবীর সেরা ক্লাসিক মাস্টারপিস হিসেবে, সেগুলোর বেশিরভাগ কিন্তু এক্সপেরিমেন্টাল না হোক, আর্ট-হাউজ সিনেমা হিসেবেই ধরা হয়।    

যাইহোক, আমি আজ আর্ট-হাউজের পাশাপাশি যে যে সিনেমা কোন না কোনভাবে এক্সপেরিমেন্ট করেছে, তাদের নিয়েই মূলত আলোচনা করব। আমার চোখে সিনেমার ইতিহাসের একদম প্রথম দিকের এক্সপেরিমেন্টাল ডকুমেন্টারি ছবি হল ‘ম্যান উইথ এ মুভি ক্যামেরা’ (১৯২৯)। কুড়ির দশকের সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা গোটা দিন। এই সিনেমায় বিভিন্ন সিনে ক্যামেরা এত অদ্ভুতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে, হবু ফটোগ্রাফারদের জন্য এই সিনেমা আবশ্যিক করে দেওয়া উচিৎ। এরপর বলতে হয় প্রথম দিকের বিমূর্ত এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা -- লুই বুনুয়েল ও সালভাদোর দালির ‘আন চিয়েন আন্দালু’ বা ‘অ্যান আন্দালুশিয়ান ডগ’ (১৯২৯)। দুটো স্বপ্ন। 

প্রথমটা লুই বুনুয়েলের। এক মেঘ রেজার ব্লেডের মত চাঁদ কেটে দিচ্ছে। দ্বিতীয় স্বপ্ন সালভাদোর দালির। একটা হাত পিঁপড়েদের সঙ্গে হামাগুড়ি দিচ্ছে। এই দুই স্বপ্ন নিয়ে তৈরি হল ১৬ মিনিটের এক নির্বাক চলচ্চিত্র ‘আন চিয়েন আন্দালু’। আপাতদৃষ্টিতে কোন অর্থ নেই। অবশ্য এর মাঝে এক যুবতীর গল্প আছে, খাপছাড়া। এই সিনেমা প্রথম যখন দেখানো হয়েছিল, তখন সিনেমার শোয়ের সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য সরাসরি গ্রামোফোন বাজানো হয়েছিল।

তবে আমি এই নির্বাক জমানা থেকে কোন ছবি বেছে নেব না। সরাসরি চলে আসব ১৯৪০-এর দশকে যখন ছায়াছবি সবাক হয়ে গেছে। ‘৪০ থেকে শুরু করে প্রত্যেক দশকে আমি মাত্র দুটো করে এক্সপেরিমেন্টাল ও আর্ট-হাউজ সিনেমা বেছে নেব যারা এই গোত্রের সিনেমায় গোটা পৃথিবীতে পথিকৃত। কাজটা বেশ কঠিন কারণ একটা বাছতে গিয়ে অন্য বেশ কয়েকটা ভাল মুভি বাদ পড়বেই। কিন্তু আবারো বলি, এটা আমার ছাঁকনি, আমার বাছাই হিসেবে দেখুন। আপনাকে এর সঙ্গে সহমত হতেই হবে, তার কোন মানে নেই।

৪০-এর দশক: ১) সিটিজেন কেন (১৯৪১), ২) মেশেস অব দ্য আফটারনুন (৪৩)

৫০-এর দশক: ৩) অর্ফিয়াস (৫০), ৪) হিরোশিমা মাই লাভ (৫৯) 

৬০-এর দশক: ৫) পারসোনা (৬৬), ৬) দ্য কালার অব পমেগ্রেনেট্‌স (৬৯)

৭০-এর দশক: ৭) ইরেজারহেড (৭৭), ৮) স্টকার (৭৯)

৮০-র দশক: ৯) কোয়ানিসকাৎসি (৮২), ১০) দ্য লাস্ট অব ইংল্যান্ড (৮৮)

৯০-এর দশক: ১১) ড্রিমস (৯০), ১২) সেভেন সার্ভেন্টস্‌ (৯৬) 

২০০০-এর পর: ১৩) মালহল্যান্ড ড্রাইভ (২০০১), ১৪) দ্য ফাউন্টেন (২০০৬)

খুব সংক্ষেপে যদি বলতে বলা হয় কেন এগুলো বাছলাম, কী কী শেখার আছে  এইসব সিনেমা থেকে, তাহলে আমার উত্তরঃ (১) নন-লিনিয়ার ন্যারেশন ও ক্যামেরার ডিপ ফোকাস, (২) স্বপ্নের মাঝে পর্যায়ক্রমে ঘুরে চলা মোটিফ ও ক্যামেরার বিভিন্ন টেকনিক, (৩) কবিকে অমর করে তোলার জন্য অসামান্য থিম এবং সহজ কিছু স্পেশাল এফেক্ট, (৪) শুধুমাত্র সংলাপ এবং তার থেকে তৈরি হওয়া ছোট ছোট ফ্ল্যাশব্যাক, (৫) অস্তিত্ব রক্ষা এবং অস্তিত্ব মুছে ফেলার এক ভয়ঙ্কর মনস্তাত্ত্বিক ড্রামা, (৬) সংলাপের তোয়াক্কা না করে, শুধুমাত্র মিউজিক ও ঘন রং ব্যবহার করে সেলুলয়েডে কী করে কবিতা ফুটিয়ে তোলা  যায়, (৭) সাদা-কালো সিনেমাটোগ্রাফি এবং তার সঙ্গে মানানসই অদ্ভুত ব্যাকগ্রাউন্ড শব্দ ও মিউজিক, যা স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমারেখা মুছে দিয়েছে, (৮) কল্পবিজ্ঞান, দর্শন, মনস্তত্ব, রূপক ও জটিলতাকে কী করে একসঙ্গে মিশিয়ে  দেওয়া যায়, (৯) সংলাপ ছাড়া শুধু কিছু ছবি/দৃশ্য পরপর জুড়ে আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চালিয়ে কীভাবে সিনেমা তৈরি করা যায়, (১০) হাতক্যামেরা দিয়ে শুটিং করে স্পিডের তারতম্য ঘটিয়ে সিনেমার নতুন ভাষা তৈরি, (১১) রংয়ের ব্যবহার, (১২) মোটিফের অদ্ভুত ব্যবহার এবং বোঝানো যে মাথা ও হৃদয় একসঙ্গে কাজ করা উচিৎ, (১৩) এক নিটোল সিনেমা হঠাৎ কী করে ধাঁধাঁ হয়ে যায়, (১৪) তিনটে সমান্তরাল গল্পের মধ্যে দিয়ে অমরত্ব ও ভালবাসার প্রকৃত সম্পর্ক অন্বেষণ।

এই প্রতিটা সিনেমাই নিজের জায়গায় অনবদ্য। কিন্তু এতগুলো সিনেমা নিয়ে  একদিনে আলোচনা সম্ভব নয়। তাছাড়া এর মধ্যে কয়েকটা মুভি নিয়ে আমি আগে আলোচনা করেছি বা পরে করব। ফলে সেগুলো লিস্ট থেকে বাদ। আজ আমি বেছে বেছে এই কটা সিনেমা নিয়ে লিখবঃ মেশেস অব দ্য আফটারনুন, হিরোশিমা মাই লাভ, দ্য কালার অব পমেগ্রেনেট্‌স, কোয়ানিসকাৎসি ও সেভেন সার্ভেন্টস্‌। আর একটু ছুঁয়ে যাব দ্য লাস্ট অব ইংল্যান্ড ও দ্য ফাউন্টেন।

১৯৪৩ সালের ‘মেশেস অব দ্য আফটারনুন’  ছবিতে সর্বত্র বিরাজমান মায়া ডেরেন। এই ছবির পরিচালক, প্রযোজক, স্ক্রিন রাইটার, এডিটর এবং নায়িকা। মাত্র ১৪ মিনিটের সিনেমা। এক মহিলার ঘুমন্ত অবস্থার অনুভূতি। অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তিকে দেখতে না পেয়ে বারবার স্বপ্নে একই জায়গায় ফিরে আসা। বাড়ির জিনিষপত্রের পর্যায়ক্রমে ঘুরে চলা মোটিফ এবং স্বপ্ন ও বাস্তবের সীমানা একাকার করে দেওয়া। অবশেষে মহিলার আত্মহত্যা।

এবার এই সিনেমা থেকে আমাদের প্রাপ্তি। ক্যামেরার জাম্প কাট, অনবদ্য অ্যাঙ্গল, স্লো মোশন এবং অদ্ভুত এডিটিং দিয়ে মানুষের অবচেতন মনের কয়েকটা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বাড়ির খুব সাধাণ কিছু জিনিষ। রোজকার একঘেয়েমি কীভাবে একটা চাবিকে ছুরি হিসেবে দেখতে বাধ্য করে, ছুরির জায়গা বদলে যায়, ফোনের জায়গা বদলে যায়, মানুষ আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে ওঠে। এমনকি ঘুমের মধ্যে বারবার একই ইচ্ছে উঠে আসে। দর্শক বুঝতে পারে না কতটা বাস্তব আর কতটা পরাবাস্তব। একটা ছোট উদাহরণ দিই। নায়িকার সিঁড়ি বেয়ে বারবার ওঠা, বাস্তবে ও ঘুমের মধ্যে। প্রথমবার ক্যামেরা নায়িকার সঙ্গে বডি মুভমেন্টে। দ্বিতীয়বার ক্যামেরা নায়িকার জুতোর হিল ফলো করছে। তৃতীয়বার নায়িকার মাথা ঘোরার সাথে ক্যামেরাও অ্যাবরাপ্ট ঘুরছে। তারপর হঠাৎ দোতলায় উঠে ক্যামেরা জানলায় ফোকাস করছে এবং সাসপেন্স ভেঙেচুরে একাকার। ফলে মায়া এখানে ইচ্ছে করেই ক্যামেরা আর এডিটিং দিয়ে স্পেস-টাইম ডুয়ালিটি তৈরি করেছেন এবং বারবার ভেঙেছেন। হয়ত এই এক্সপেরিমেন্ট সবক্ষেত্রে সফল হয় নি, কিন্তু ভবিষ্যতের পরিচালকদের জন্য উনি এক বিশাল বড় দরজা খুলে দিয়েছেন। স্পেস-টাইম ডুয়ালিটি নিয়ে কাজ করার দরজা। এবং হঠাৎ হঠাৎ ক্যামেরাকে অবজেক্টিভিটি থেকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। মাত্র ১৪ মিনিট মনোযোগ দিয়ে দেখলে এই ছবি তারিফ করতেই হবে।

অ্যালান রেনে-র ‘হিরোশিমা মাই লাভ’ (১৯৫৯) ইউরোপের নব্য-বাস্তব সিনেমা আন্দোলনের নিদর্শন। অবশ্য ত্রুফো বা গোদারের থেকে রেনে-র সিনেমা সামান্য উল্টোদিকের কারণ রেনে ছিলেন ‘লেফট্‌ ব্যাঙ্ক’ গোষ্ঠীর পরিচালক। যদিও সমস্ত নব্য-বাস্তব ছবির পরিচালকেরা এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালবাসতেন। ‘হিরোশিমা মাই লাভ’ ফ্রান্স ও জাপানের যৌথ উদ্যোগ। ছবির কাহিনি এক ফ্রেঞ্চ প্রেমিকা ও  জাপানি প্রেমিকের ৩৬ ঘন্টার সংলাপ ঘিরে। মেয়েটি অভিনেত্রী এবং ছেলেটি আর্কিটেক্ট। দুজনের নামও অর্থবহ – প্রেমিকার নাম ‘এলি’ (স্ত্রীলিঙ্গে ‘সে’, (her) এবং প্রেমিকের নাম ‘লুই’ (পুংলিঙ্গে ‘সে’, him)। তাদের এই দেড় দিনের প্রেম,  প্রেমের ওঠাপড়া এবং ৩৬ ঘন্টার ছোট্ট প্রেম শেষে দুজনকেই নিজের নিজের জায়গায় ফিরে যেতে হবে, সেই ব্যাকড্রপে সংলাপ দিয়ে তৈরি সিনেমা। হিরোশিমার কোন এক হোটেলের ঘরে বসে এলির মনে হচ্ছে সে ১৯৪৫-এর ৬ই অগস্ট অ্যাটম বোমের আঘাতে হিরোশিমা ধ্বংস নিজের চোখে দেখেছে, আর লুই তাকে বোঝাচ্ছে সে কিছুই দেখেনি। শারীরিক প্রেম ও সংলাপ, দুই এগিয়ে  চলে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ফ্ল্যাশব্যাকে স্মৃতি উঠে আসে। অবশ্যই, সেই স্মৃতির চর্চা নন-লিনিয়ার, অনেকটা সিটিজেন কেন-এর মত।

এই সিনেমায় প্রথম চোখে পড়বে সংলাপ। নিবিড় ব্যক্তিগত সংলাপ, যা মাঝে মাঝেই কবিতা বলে মনে হয় – ‘out of thousand of things in your life, I choose nevers...it was there, as I understand it, that I almost lost you... that I risked never, ever meeting you’। একইসঙ্গে ড্রামা এবং গভীরতা। তারপর ক্যামেরার কাজ। নায়ক-নায়িকার অনবদ্য স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স দেখানোর জন্য অন্তরঙ্গ সিনে ক্যামেরা স্ট্যাটিক রেখে মুখে ফোকাস। নগ্ন পিঠে নখের আঁচড় ও সংলাপ। দুটো দেহ যখন মিশে যাচ্ছে, তখন রূপোর মত চকচকে গায়ে যেন রঁদার ভাস্কর্য। কখনো সখনো মাটি থেকে কম উচ্চতায় ক্যামেরা রেখে অ্যাঙ্গল প্রায় ১৮০ ডিগ্রি করে দেওয়া হয়েছে। ফলে চলাফেরায় খুব সহজেই সাসপেন্স ফুটে উঠেছে (এখন এই টেকনিক প্রায় সব পরিচালক ব্যবহার করেন)। তারপর মিউজিক। শুধু পিয়ানো, হাওয়াই গিটার, বিভিন্ন বাঁশি আর ভায়োলিনের সাহায্যে ধীরলয়ে কী সুন্দর আবহ ফুটিয়ে তোলা যায়, তা এই  ছবি থেকে শিখতেই হবে। তবে আমি এর একটা অন্য রকম থিম খুঁজে পাই। প্রেমিকা যখন প্রেমিককে ভুলতে চেয়ে তার নাম দেয় ‘হিরোশিমা’, তখন এক  শাশ্বত ফ্রেম ফুটে ওঠে – জীবনে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এই সিনেমা যতবার দেখেছি, মনে হয়েছে যেন স্ট্রিম অব কনসাসনেস-এর নন-লিনিয়ার ন্যারেটিভ চোখের সামনে ভাসছে। যেন লেখক উইলিয়াম ফকনারের লেখা পড়ছি। মানতেই হবে, নব্য-বাস্তবতায় রেনে-র এই সিনেমা শক্তিশালী। ছবিতে প্রেমিকের ভূমিকায় এইজি ওকাদার অভিনয় নজর কাড়বে। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্যই ওনাকে পরবর্তীকালে মার্লন ব্রান্ডোর সঙ্গে অভিনয়ের জন্য ডাকা হয়েছিল।

‘দ্য কালার অব পমেগ্রেনেট্‌স’ (১৯৬৯) এবং ‘কোয়ানিসকাৎসি’ (১৯৮২) দেখলেই আমার কমল চক্রবর্তীর ‘মিথ্যে কথা’ কবিতা বই মাথায় ভাসে। বাংলা সাহিত্যে প্রতিকবিতা ব্যাপারটা কমলের ‘মিথ্যে কথা’ থেকেই প্রথম উঠে আসে। প্রতিকবিতাও কবিতা কিন্তু কবিতার ব্যাকরণছুট। সেই রকম পমেগ্রেনেট্‌স এবং কোয়ানিসকাৎসি যেন সিনেমা হয়েও সিনেমা নয় – প্রতিসিনেমা।

সের্গেই পারাজানভের ‘দ্য কালার অব পমেগ্রেনেট্‌স’ (এবং ‘শ্যাডোজ অব ফরগট্‌ন অ্যানসেস্টার্স’) রং ও পোষাকের ব্যবহারে সম্পূর্ণ অন্যরকম। দুঃসাহসী পরিচালক। বাঁধা গন্ডীর বাইরে সিনেমা করার অপরাধে রাশিয়ান সরকার বিভিন্ন ছলছুতোয় ওনাকে তিনবার জেলে পুরেছিল। মানসিক ও শারীরিক ভাবে ওনাকে প্রায় শেষ না করে দিলে আজ রাশিয়ান সিনেমা ওনার হাত থেকে আরো বেশ কিছু ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক পেত।

‘পমেগ্রেনেট্‌স’ আর্মেনিয়ান কবি সায়াৎ-নোভার জীবনী। অবশ্য, ঐ যে বললাম, বাঁধা গতে নয় – সংলাপ প্রায় বাদ দিয়ে শুধুমাত্র এক ভিসুয়াল জার্নির ভেতর দিয়ে সেলুলয়েডে কবিতা ফুটিয়ে তোলা। মোট সাত খন্ডে এই সিনেমাকে ভাগ করা হয়েছেঃ শৈশব, যৌবন, রাজার আদালত, মন্দির, স্বপ্ন, বার্ধক্য এবং মৃত্যুদূত ও মৃত্যু। পুরোটাই যাত্রাপালার মত। এই ছবি আর্মেনিয়ার সংস্কৃতির এক বিশেষ অংশ ‘মিনিয়েচার’ পেইন্টিং ফুটিয়ে তুলেছে। তবে এটাও বলে রাখা ভাল,  যেহেতু সিনেমার ব্যাকরণ মানা হয় নি, তাই সাধারণ দর্শক দেখলে এর অর্থ  সেভাবে নাও বুঝতে পারেন। ফলে দেখার আগে এই সিনেমার আবহ বুঝে নেওয়া জরুরী। এবং আমরা সবাই জানি যে, কোন শিল্পের বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলি মিলেই সেই শিল্পের মান নির্ধারণ করে। সেদিক থেকে দেখলে ‘পমেগ্রেনেট্‌স’ আমার মত সমালোচকদের মুগ্ধ করে, এর সৌন্দর্যের জন্য। এই সিনেমাকে উপেক্ষা করে এক্সপেরিমেন্টাল/আভাঁ-গার্ড/আর্ট-হাউজ ছবির লিস্ট সম্পূর্ণ হতে পারে না।

গডফ্রে রেজিও-র কাৎসি ট্রিলজির প্রথম সিনেমা ‘কোয়ানিসকাৎসি’। আজটেক সভ্যতার হোপি ভাষায় যার অর্থ ‘ভারসাম্যহীন জীবন’। শুরুতেই বলেছি, সংলাপ  বা ন্যারেশন ছাড়া শুধু কিছু ছবি/দৃশ্য স্লো-মোশনে পরপর জুড়ে অথবা ওভারল্যাপ করে আর আবহে মিনিমালিস্ট মিউজিক চালিয়ে কীভাবে সিনেমা তৈরি করা যায়, তার একমাত্র উদাহরণ কোয়ানিসকাৎসি। প্রকৃতির সৌন্দর্য  থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় চলন্ত মানুষ ও গাড়ির সারি ফোকাস করে অ্যাটম বোম বিস্ফোরণ হয়ে রকেট ও মহাকাশে তার ভেঙে পড়া অব্ধি প্রচুর  সিকোয়েন্স এখানে দেখানো হয়েছে। এবং বোঝানো হয়েছে, মানুষ এই সুন্দর প্রকৃতি কীভাবে তিলে তিলে নষ্ট করছে। রেজিও, আমার মনে হয়েছে, এই  সিনেমায় সভ্যতার ক্যাওস দেখাতে চেয়েছিলেন। সেই কাজে উনি পুরোপুরি সফল। কোন সংলাপ ব্যবহার না করেই। রেজিও-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,  কেন উনি এই ছবিতে কোন সংলাপ বা বর্ণনা ব্যবহার করেন নি। উনি কয়েক লাইনে মানানসই এক জবাব দিয়েছিলেন - ‘from my point of view, our language is in a vast state of humiliation – it no longer describes the world in which we live.’ মারাত্মক জবাব, তাই না? এই খাপছাড়া ছবিও কিন্তু ভবিষ্যতে আরো অনেক সিনেমা তৈরিতে সাহায্য করেছে। যেমন, এই ছবি না দেখলে আপনি বুঝবেন না পরবর্তীর ‘বারাকা’ (১৯৯২) বা ‘সামসারা’-র (২০১১) ভাবনা কীভাবে এল।

আমার মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে, কেন আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির জগতে পারাজানভ বা রেজিও-র মত পরিচালকদের হিরো হিসেবে তুলে ধরা হয় না? যারা দর্শকের সামনে সিনেমার সংজ্ঞা বদলে দেবার ক্ষমতা রাখেন!

আজকের লিস্টে ‘সেভেন সার্ভেন্টস্‌’ (১৯৯৬) দেখে অনেকে ভুরু কোঁচকাতে  পারেন। কিন্তু ইরানিয়ান পরিচালক দারিয়ুস শোকফ এই ছবি বানিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। আর্চি-র চরিত্রে অ্যান্থনি কুইন অনবদ্য। এটাই ছিল ওনার শেষ অভিনয়। ছবির থিম বদখদ। হাসি পাবেই। আর্চি সাতজন চাকরকে কাজে বহাল করেন, তিনজন মহিলা ও চারজন পুরুষ। এদের কাজ হচ্ছে আর্চির শরীরের বিভিন্ন ফুটোগুলো বন্ধ করে রাখা – নাক, কান, মুখ, পেছন ইত্যাদি। আর্চির ধারণা, টানা দশদিন তার ফুটোগুলো এভাবে বন্ধ থাকলে সে শান্তিতে স্বর্গে যেতে  পারবে। শেষ দৃশ্যে আর্চির পুরনো সঙ্গিনী এসে ওনার ওপর সঙ্গমের ভঙ্গিতে বসবে এবং আরেক তরুণী ওনার মুখে মুখ রেখে এমনভাবে চুমু খাবে যাতে আর্চি আর প্রশ্বাস নিতে না পারে। তারপর আর্চির মৃত্যু হয়।

এবার আসা যাক সিনেমার ভাষায়। অরিফিস বন্ধ রাখার এই যে উদ্ভট আইডিয়া, এটা তো শুধু একটা মোটিফ। এর পেছনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ধরতে হলে আপনাকে ফিরতে হবে গ্যেটে-র ‘ফাউস্ট’-এ। প্রথম ভাগ। ফাউস্ট  নিজের জায়গায় অখুশি। দ্বিতীয় ভাগ। ফাউস্ট পরিদের রাজ্যে এসে খুশি। সে জানে এরপর স্বর্গে যাবে। এই দুয়ের মাঝে যে মিসিং লিঙ্ক, সেটাই ‘সেভেন সার্ভেন্টস্‌’ তুলে ধরতে চেয়েছে। এর দর্শনশাস্ত্র সেটাই। শরীরের ফাঁকগুলো বুজে গেলে মাথা ও হৃদয় কাছাকাছি চলে আসে, একসঙ্গে কাজ করে। তারুণ্য   বার্ধক্য পাশাপাশি আসে। জীবন ও মৃত্যু। আর্চির কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু সবাইকে একসাথে এনে একাকার করে দেয়। তবে হ্যাঁ, এই ছবিতে ক্যামেরার কাজ মাঝারি মানের। বেশিরভাগ শট্‌ ইন্ডোর।

‘দ্য লাস্ট অব ইংল্যান্ড’ (১৯৮৮) বানানোর পেছনে ডেরেক জার্মেন-এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মার্গারেট থ্যাচারের আমলে ইংল্যান্ডের কী রকম অবনতি হয়েছে,  তা দেখানো। সেই উৎকন্ঠা তুলে ধরার জন্য ৮ মিলিমিটারের কাঁপা হাত-ক্যামেরা দিয়ে পুরো শুটিং হয়েছে। এই ছবি নাটকীয় ভাষা নয়, বরং কবিতার ভাষায় বলা। দৃশ্যের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে এলিয়টের ‘দ্য হলো মেন’ এবং গিনস্‌বার্গের ‘হাউল’ পাঠ করা হয়েছে। এরকম কবিতার আবহে দৃশ্যায়ন আর কোন সিনেমায় হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ছবিতে টিল্ডা সুইনটনের আগুনের দৃশ্যে অভিনয় ভাল লাগে।

ড্যারেন অ্যারোনফস্কি তুলনামূলক ভাবে তরুণ পরিচালক। বয়স মাত্র ৫২।  হলিউডে এর মধ্যেই বেশ কিছু সাড়া জাগানো মনস্তাত্বিক ড্রামা বানিয়ে ফেলেছেন। তার মধ্যে ‘দ্য ফাউন্টেন’ (২০০৬) অন্যতম। ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ ছবির জন্য অস্কার পেয়েছেন। যাইহোক, ‘দ্য ফাউন্টেন’ ছবির বিশেষত্ব হল ম্যাজিকাল রিয়েলিজম-কে সিনেমার পর্দায় তুলে ধরা। সুর-রিয়েলিজম বা নিও-রিয়েলিজম ছাড়িয়ে এক অন্য পথে যাত্রা করা। তিন বিভিন্ন শতক থেকে তিনজন চরিত্র ‘ট্রি অব লাইফ’ খুঁজে চলেছে, যা অমরত্ব দেয়। এক রাজা, এক বৈজ্ঞানিক এবং এক  স্পেস ট্রাভেলার। সেখান থেকে ভালবাসা ও নৈতিকতার মধ্যে প্রকৃত সম্পর্ক অন্বেষণ। বারবার ঘুরে চলা একই মোটিফ এবং ম্যাচ-কাট দিয়ে স্পেস টাইম ডুয়ালিটি এখানে মুন্সিয়ানার সঙ্গে দেখানো হয়েছে।

তাহলে আজ এই অব্ধি। আপনারাও এক্সপেরিমেন্টাল ছবি দেখুন ও লিস্ট তৈরি করুন। একটা ব্যাপার মাথায় রাখবেন, দশটা এক্সপেরিমেন্ট না করলে কোন সফল আবিষ্কার হয় না। আমার চোখে কিন্তু (এখনো পর্যন্ত) এক্সপেরিমেন্টাল/আর্ট-হাউজ সিনেমার উজ্জ্বলতম পরিচালক ইংমার বার্গম্যান ও স্ট্যানলি কিউব্রিক। বার্গম্যানের সিনেমায় যেমন বেশিরভাগ সিনে জটিল মনস্তত্ব, কিউব্রিকের সিনেমার প্রধান আকর্ষণ হল ওনার বুদ্ধিমত্তা এবং প্রতি সিনেমার বিভিন্নতা। এবং লেখা থামানোর আগে বিমূর্ত সিনেমার জন্য একজনের নাম না নিলে ভারি অন্যায় হবে। কানাডার পরিচালক মাইকেল স্নো। ওনার স্ট্রাকচারাল সিনেমা এবং বিশেষত ‘ওয়েভলেন্থ’ (১৯৬৭) আজো এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমার এক মাইলস্টোন।  

এতগুলো অনন্য আর্ট-হাউজ সিনেমার শেষে আমি শুধু একটা নতুন সিনেমা রাখতে চাই - ‘বয়হুড’ (২০১৪)। হয়ত পাঠক বলবেন, এটা অর্বাচীন মন্তব্য। অল্টারনেটিভ বা আর্ট সিনেমার মাঝে ‘বয়হুড’ থাকতেই পারে না। কী শেখার  আছে এই ছবি থেকে? নিটোল কোন গল্প নেই ঠিকই, কিন্তু বাচ্চা বড় করে তোলার মত জটিল বিষয় তুলে ধরা ছাড়া এই ছবির অন্য বিশেষত্ব কী? আমি  বলব – এই সিনেমার থিম বা অভিনয় বা সিনেমাটোগ্রাফি বা এডিটিং, এসব কিছু নিয়েই আমি মন্তব্য করতে চাই না। এর থেকে শুধু শিখতে হয়, সিনেমার রিলে জীবন ফুটিয়ে তুলতে গেলে পরিচালককে কতটা ধৈর্য্যশীল হতে হয়। এই ছবির শুটিং হয়েছিল বারো বছর, যাতে এক বালক ও বালিকার যুবক/যুবতী হয়ে ওঠা অব্ধি পুরো পরিবর্তন ক্যামেরার চোখে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। বারো বছর মানে এক যুগ। এক যুগ ধরে একটা মুভির শুটিং চলেছে। কোন কমার্শিয়াল পরিচালক পারবেন কি এইরকম ধৈর্য্য দেখাতে?

গোটা পৃথিবীর ক্লাসিক আর এক্সপেরিমেন্টাল/আর্ট-হাউজ সিনেমা নিয়ে অনেক হল। সামনের বার আবার আমি পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ব। এবারের লক্ষ্য ইতালি। ভা বেনে?

 

 

 


শিবাংশু দে

 

মাণ্ডবীর গান




 

কেউ কেউ জানেন, অনেকেই জানেন না। এদেশে একটা রাজ্য আছে যেখানে দুপুরে ঘুমোবার ছুটি পাওয়া যায়। মানে, সিয়েস্তার জন্য ​​​​​​​ছুটি। সরকারি ভাবে অনুমোদিত নিত্য প্রাপ্তি। দুপুর একটা থেকে  চারটে, রাস্তায় কুকুর বেড়ালও চোখে পড়ে না। বোধহয় তারাও শয়নে পদ্মনাভ হতে চায়। চারটে থেকে আবার অফিস-দফতর খোলে। চলে ছটা-সাড়ে ছটা পর্যন্ত। রাজকীয় বিলাসিতা। আরবসাগরের তীরে এই জনপদ। সন্ধে হতে সাড়ে সাতটা। সকাল নটা নাগাদ ছোটা হাজরিতে ‘সরপোতেল’ সেবা করে অফিসে আসা। আর বেলা একটায় ভরপেট ভাত আর জিট্টি কোড়ি খেয়ে গভীর সিয়েস্তা। আর একটু উমদা খাবার লাগলে চিকেন জাকুটি বা কাফরিল অথবা পর্ক ভিন্দালু। ঘুমটা জমিয়ে হয়। সারা বছরই মনে হয় সেখানে 'উসসব'। আলাদা করে মন্ত্রীদের বাণী-টানি দিয়ে ফিতে কাটতে হয় না। ঠিকই ধরেছেন। আমি গোমন্তক দেশের কথা বলছি। মানে, গোয়া। উত্তরে তিরাকোল থেকে দক্ষিণে তিলমাতি বড়ো জোর একশো তিরিশ-চল্লিশ। আরামসে গেলেও সাগরের তীর ধরে গাড়িতে সাড়ে তিনঘন্টা। পূর্ব দিকে কোলেমই শেষ। পশ্চিমে ভাস্কো থেকে মাত্র ষাট কিমি। গাড়িতে বড়ো জোর ঘন্টা দেড়েক। তার পরেই গোয়ার পৃথিবী শেষ।

শুধু আমি নই, গোয়া আমাদের সবার কাছেই অতি প্রিয় ছোট্টো একটা স্বর্গ। ভুলিয়ে দেওয়া, হারিয়ে যাবার অনন্ত ঠিকানা। বহুদিন ধরে সারা দেশ থেকে, সারা পৃথিবী থেকে কতশত মানুষ ভিড় জমিয়েছে এখানে। কতরকমের কালচার জড়াজড়ি করে রয়েছে। প্রেয়, প্রার্থিত অন্য স্বাদের দুনিয়া। অবসরের পর ভেবেছিলুম কয়েকবছর এখানে থাকবো। চাকরি করার সময় পোস্টিঙের সুযোগ হয়নি। কিন্তু  অবসরের ​​​​​​​পর ভেবেছিলুম একবার লড়ে যাবো। আমার এক অগ্রজ প্রিয়জনের একটি ঠেক আছে  ভাস্কোতে। বছরে একবার তিনি স্যামচাচার দেশ থেকে কয়েকমাসের জন্য আয়েশ করতে আসেন এখানে। তখন বারবার আমন্ত্রণ জানান। বহুবার কথা দিয়েও রাখতে পারিনি। তাঁর উদার আমন্ত্রণ অকারণ উড়ে গেছে আরব সাগরের পাগলা হাওয়ায়। আমারও বহুদিন গোয়া যাওয়া হয়নি।

অবসরের ​​​​​​​পর ​​​​​​​থাকা ​​​​​​​যাবে ​​​​​​​ভেবে গোয়ায় পনজিতে, আমার পুরনো বন্ধুরা মাণ্ডবীর  উত্তরে দু'চার বছর থাকার মতো একটা ঠেকও ব্যবস্থা করে দিয়েছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর থাকা হয়ে ওঠেনি। ঐ যে... যাহা চাই, ইত্যাদি। তাতে অবশ্য কিছুই যায় আসে না। আমার মনে গোয়ার জন্য প্রেমদুর্বল প্রদীপের আলোয় একটি অলিন্দ জেগে থাকে। থেকে যায়।   

গোয়া-চর্চা করতে গিয়ে বারবার একটা ​​​​​​​কথা মনে পড়ে। সূর্যমুখী ফুলের মতো তৃপ্ত  এই বসতিটির অন্দর মহলটিও ​​​​​​​কি ​​​​​​​এতোটাই ​​​​​​​পরিপূর্ণ? প্রদীপের নিচে ছায়াটি  ​​​​​​​প্রায়শ ​​​​​​​আমাদের ​​​​​​​চোখ এড়িয়ে ​​​​​​​যায়। কতোটা অন্ধকার রয়েছে ​​​​​​​সেখানে? একদিকে গৌড়ীয় সারস্বত ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি। অন্যদিকে পর্তুগিজ 'ম্লেচ্ছ' কালচার। দুইয়েরই  ভিত্তি রয়েছে কোঙ্কণী মৎসজীবী, শ্রমজীবীদের বিশ্বাসের মাটিতে। কিছুটা মরাঠি, কিছুটা কন্নড়। নানা রকম সমন্বিত ঐতিহ্যের  রহস্যটান ​​​​​সাগরতীরের এই ছোট্টো জনপদটিকে ​​​​​​​সমৃদ্ধ ​​​​​​​করেছে। যাবতীয় আপাত সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে গোয়া তাই আমাদের মজিয়ে রাখে। বলা হয় গোয়ায় প্রতি একশো মিটারে একটি শৌণ্ডিকশালা  দেখা ​​​​​​​যাবে। আর গির্জার ​​​​​​​সংখ্যা ​​​​​​​নাকি সুরাবিপণীর থেকেও বেশি। এই ​​​​​​​সব ​​​​​​​পরস্পরবিরোধী ​​​​​​​কাটাকুটি সারা হলে ​​​​​​​শেষ ​​​​​​​পর্যন্ত ​​​​​​​হাতের ​​​​​​​পেনসিলটি কেমন থাকে? ব্যাপারটা শেষ পর্যন্ত  কোথায় ​​​​​​​দাঁড়ায়? এক কথায় বলতে ​​​​​​​গেলে, কিছুই  দাঁড়ায় না। গোয়া হলো 'গোয়া'! ইতিহাসের নানা পর্বে নানা সংস্কৃতির মিশেলে গড়ে ওঠা  এই ভারতবর্ষটির কোনও আলাদা নাম দেওয়া যায় না।  সে নিজেই একটা দৃষ্টান্ত। একম এবং অদ্বিতীয়ম।

প্রকৃতিদেবী গোয়ার প্রতি উদারতায় এতো দাক্ষিণ্যসুন্দর, যে তার কথা আলাদা করে বলা অর্থহীন। তার তুলনা পাওয়া যাবে আরব সাগরের তীর ধরে কেরালা আর শ্রীলংকায়। প্রকৃতি আর মানুষের সমবায়ে গড়ে ওঠা এই প্রান্তটি মনে হয় 'সব পেয়েছির দেশ'। অন্তত বহিরঙ্গে তো সেরকমই। কিন্তু প্রকৃতি যতো উদারই হোক না কেন, মানুষ তার আবিলতা ছাড়তে পারে না। মানুষের গল্পে অন্ধকারের ইশারা বারবার ঘুরে আসবেই।

গোয়ায় যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তার সঙ্গীত ঐতিহ্য। ভারতীয় লোক ও  মার্গসঙ্গীতের সঙ্গে য়ুরোপিয় মিশেল এমন অনুপম ভাবে সেখানে জড়িয়ে গেছে, যার তুলনা সে নিজেই। গোয়ার লোকসঙ্গীত এদেশের সঙ্গীত ধারার এক অনন্য শৈলী। অন্যান্য প্রান্তের মতো গোয়ার সংস্কৃতিতেও সঙ্গীত ও নৃত্যের পরম্পরাটি পরস্পর বিজড়িত। বিভিন্ন ধারার মধ্যে গোয়ায় একটি নাচের ঘরানা আছে, 'দেখন্নি' এই নৃত্যশৈলীটি নানা কারণে গোয়ার সংস্কৃতির মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেশ কিছুদিন ধরে। বিশেষত বম্বের চিত্রজগতের দৌলতে গোয়ার লোকনৃত্য বলতে 'দেখন্নি'রই বোলবালা।

সবচেয়ে বিখ্যাত ‘দেখন্নি’র গানটি কম্পোজ করেছিলেন কার্লোস ইউজেনিও ফেরেরা, ১৮৮৭ সালে। তাঁর সাকিন ছিলো, কর্জ্যুয়েম, আলডোনা। ভাই এডুআর্ডো ছিলেন পিয়ানোবাদক। ১৮৯৫ সালে তিনি পারীতে 'কোঙ্কনী ব্যালাড' নামে এই সুরটি বাজিয়ে খ্যাত হয়েছিলেন। তারপর কয়েক দশক কেটে গেছে। ১৯২৬ সালে তিপোগ্র্যাফিয়া র‌্যাঞ্জেল গানটিকে আবার গোয়ায় ফিরিয়ে আনেন।  

যদিও ​​​​​​​আপাতভাবে 'দেখন্নি' নৃত্যপরা বালিকাদের গান। কিন্তু ​​​​​​​এই ​​​​​​​গানটির ​​​​​​​অন্দরে ​​​​​​​রয়েছে ​​​​​​​এক ​​​​​​​বিষাদের ​​​​​​​ইতিকথা। ​​​​​​​​​​​বিষয়, একটি মেয়ে বন্ধুর বিয়েতে যাবে নদীর ঐ পারে। মাঝি যেতে রাজি নয়।  দুজনের ​​​​​​​মধ্যে দরাদরি চলছে। মেয়েটি তাকে ফুল দিলো, অলংকারও দিলো। কিন্তু মাঝি রাজি নয়। তার ​​​​​​​অন্য ​​​​​​​বাসনা ​​​​​​​আছে। সে মেয়েটির থেকে একটি চুম্বনের প্রার্থী। তা না নিয়ে সে নৌকা ছাড়বে না।  অনেক ​​​​​​​রাতে মেয়েটির ​​​​​​​বাড়ি ফেরার সময়ও একই দুর্যোগ। মাঝি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে না। তার তখন ​​​​​​​চুম্বনের ​​​​​​​থেকেও ​​​​​​​বেশি ​​​​​​​কিছু চাই। বিষণ্ণ একলা মেয়েটির আকুতি ফুটে ওঠে এই গানে। যদিও এটি একটি লোককথা। কিন্তু তার গভীরে ইতিহাসের আরও একটা বিষাদিত-অধ্যায় লুকিয়ে আছে।  

গানটি বাংলায় অনুবাদ করলে এমনটা দাঁড়াবে,

 "আমি নদীর ঐপারে যেতে চাই

আমার বন্ধু দামু'র বিয়ে আজ

আমি যাবার পথ চিনি না

আমাকে নিয়ে চলো সেখানে

বিনতি করি

 

দামুর বিয়ের মণ্ডপে

নাচিয়ে মেয়েরা নেচে যাচ্ছে

দামুর বিয়ের মণ্ডপে

নাচিয়ে মেয়েরা নেচে যাচ্ছে

 

নাও, নাও নাও (ঘে ঘে ঘে)

 

না, আমি চাই না আমার পায়েলগুলি 

চাই না, চাই না

না, তুমিই নাও, নাও নাও"

মেয়েটির কাছে মহার্ঘতম সঞ্চয় তার পায়ের নুপূরজোড়া। মাঝিকে সে অনুনয় করছে সে দুটি নিয়ে যেন তাকে রেহাই দেওয়া হয়। কিন্তু গল্প সেখানেই শেষ হয় না।

আমরা অনেকেই জানি না, গোয়ার প্রতাপশালী সারস্বত ব্রাহ্মণরা আসলে বাঙালি ব্রাহ্মণদের বংশধর। বহুদিন আগে জলপথে বাংলা থেকে তাঁদের পূর্বপুরুষরা গোমন্তকদেশে গিয়েছিলেন। এদেশ থেকে তাঁরা নিয়েছিলেন দেবীপূজার ঐতিহ্যটি। গোয়ায় শক্তিদেবী, যেমন, কালীর পূজা হয়ে আসছে বহুদিন ধরে। কালীমন্দিরের দেবদাসীদের বলা হতো 'কালীবন্তী', অপভ্রংশে 'কলবন' তাঁদের কাজ ছিল দেবতার পূজার সময় নাচ পরিবেশন করা। সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেবদাসীদের কী দুর্গতি হয়, সবাই জানে। ক্ষমতাশালী লোকেরা তাঁদের পণ্যা করে রাখতে পছন্দ করেন। বৃত্তি হিসেবে কলবনরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ‘দেখন্নি’ নাচ পরিবেশন করতেন।  বিশেষত বিবাহাদি অনুষ্ঠানে তাঁদের নাচ জরুরি ছিল। ঠিক যেমন দেশের উত্তর প্রান্তে বিবাহাদি, এমন কি 'ধর্মীয়' অনুষ্ঠানেও বাই-নর্তকীদের নৃত্যগীত অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠেছিলো একদিন। অথচ তাঁদের কোনও সামাজিক সম্মান ছিল না। মানুষ তাঁদের নিতান্ত 'সহজলভ্যা' মনে করতো। এই গানটির রচয়িতা, কার্লোস ফেরেরা, কলবন মেয়েদের প্রতি সামাজিক নিপীড়নকে কেন্দ্রে রেখে গানটি বেঁধেছিলেন। বস্তুত এটি একটি প্রতিবাদ, প্রতিরোধের গান।     

পর্তুগিজরা গোয়া দখল করার পর স্থানীয় ধর্মীয় ও সামাজিক কার্যকলাপের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিলো।। সালেকর বংশের কুখত্তোবা রানে নামের একজন বিদ্রোহী শাসকদের অত্যাচারের বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁর এই প্রতিবাদের সূত্রে পর্তুগিজরা দেশীয় সাংস্কৃতিক  ঐতিহ্যের প্রতি তীব্র দমননীতি প্রয়োগ করে। বিভিন্ন আনন্দ অনুষ্ঠানে প্রচলিত রীতিরেওয়াজের প্রতি বিধিনিষেধ প্রয়োগ করা হয়। শহরের মধ্যে প্রকাশ্যে কলবনদের নাচগান বন্ধ করে দেওয়া হয়। নিরুপায় কলবনরা তখন বিপজ্জনকভাবে নদী পেরিয়ে অন্যপারে নাচগান করে ক্ষুধানিবৃত্তি করতেন। সেরকমই একদিন এক কলবন যখন গভীর রাতে নদী পেরিয়ে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার পর একাকিনী ফিরে আসছিলেন, তখন নৌকোর মাঝি তাঁকে বলপূর্বক অধিকার করতে চায়। সবাই জানে, কলবন নারী মানেই বহুভোগ্যা। মেয়েটি তার কাছে যা অলংকার, অর্থ ছিল সব দিয়ে নিস্তার পেতে চাইলেন। কিন্তু মাঝি নাছোড়। আক্রান্ত মেয়েটি তাঁর আরাধ্যা কালীর নামে শপথ  নিয়ে মাঝির প্রচেষ্টা প্রতিরোধ করতে সফল হন। মরিয়া লড়াইয়ের পর তিনি মাঝিকে নৌকো থেকে নদীতে ফেলে দেন। রাত ভোর হবার আগেই ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মেয়েটির ধীরে ধীরে বাড়ির পথ বাওয়া। সেই ভোর  যা ‘মচকাফুলে’র মতো লাল। গানটি উঠে আসে সেখান থেকেই।



মূল কোঙ্কনী গানটি "হাঁও সাইবা পোলতোদ্দি ওয়েতম" (নদী পেরিয়ে অন্য পারে যাই) শুনলেই আমাদের মনে গোয়ান সংস্কৃতির আনন্দময় উদযাপনের যে ছবিটি ভেসে ওঠে, তার ইতিহাসটি কিন্তু রক্তাক্ত নিপীড়নের সাক্ষী। গোয়া-সমুচিত, আপাত আনন্দ উৎসারের আড়ালে যে অন্ধ-অতীত আমাদের পীড়িত করে, বিড়ম্বিত করে, তার আসল রূপটি জানা হয়ে যায় মূল  "হাঁও সাইবা পোলতোদ্দি ওয়েতম"  গানের অন্দরে প্রবেশ করলে। আমরা কজন জানি? কোন অশ্রুবিন্দুর মুক্তো এই চেনা সুরের ছন্দকে উদভাসিত করে এসেছে গত প্রায় দেড়শো বছর ধরে! মূল কোঙ্কনী গানটি নতুন করে শোনা যায় গোনজাগা কুটিন্হোর কণ্ঠে। সিনেমার গানের জাঁকজমক নেই তাতে। কিন্তু সেই একলা মেয়েটির আকুতিটি সমান ভাবে বরকরার।

https://www.youtube.com/watch?v=eC2O1RnnQ0g

পরবর্তীকালে এই সুরটি অবিকল অনুসরণ করে  অনেক ​​​​​​​গান ​​​​​​​বাঁধা ​​​​​​​হয়েছে। ​​​​​​​খোদ ​​​​​​​গোয়া ​​​​​​​​​​​​​​অন্যত্র। আমাদের জোয়ান বয়সে লক্ষ্মীকান্ত-প্যারেলাল সেই অবিস্মরণীয় গানটি সিনেমার ​​​​​​​জন্য বেঁধেছিলেন।  সে গানের সঙ্গে পা মেলায়নি এমন ছেলে-মেয়ে ছিলো না সেকালে। হঠাৎ সেদিন আবার গানটি শুনে মনে পড়ে গেলো পুরনো সেই দিনের ​​​​​​​কথা। মান্না দে'র গলায় আমাদের কিশোরবয়সের স্বপ্নের গানটা না শুনলে  যেন মাণ্ডবী নদীর যাত্রা সম্পূর্ণ হয় না--

(145) Bobby - Song - Na Maangoon Sona Chandi - Manna Dey, Shailendra Singh - YouTube

ভিভা লা গোয়া...