সমকালীন ছোটগল্প |
মনে মনে
শর্করা আজকাল সব বয়েসের মানুষের
শরীরের প্রিয় বন্ধু। মাঝে মাঝেই সে হৃদয়কেও
ভালোবেসে জড়িয়ে ধরে। দামি ওষুধের বায়নাক্কা নিয়ে মানব-জমিনে দিব্যি স্থায়ী ঘরদোর বানিয়ে সে পা ছড়িয়ে আয়েস করে
বসে। আবাদ করলে যেখানে সোনা ফলার কথা, সেখানে আবাদ না করেই শর্করা।
ফিস ফিস করে বলে, এই ধরে ফেলেছি হে তোমাকে। এবার ডাক্তারের এ্যাপো নিতে অফিস কামাই
করে লাইন লাগাও সকাল-বিকেল! কেমন মজা! অবহেলা দেখলেই আমরা হৃদয়ের সঙ্গে ভাব করি।
চিনি দিদিমণির সঙ্গে হৃদয়বাবুর ভালো আন্ডারস্ট্যানডিং। হৃদয় বলে, তুমি রক্তস্রোতকে যত মধুর করবে, ততই আমার-তোমার কাছাকাছি আসা। তবে তুমি যত নিঃশব্দে চলাফেরা করতে পারো, আমি কিন্তু তা পারি না। আমার চলা-ফেরায় ধমক-চমক থাকে। এ বড় মজার খেলা। দুজনের শলাপরামর্শে এই বাড়াবাড়ি খেলা নিঃশব্দে চলতে থাকে অনেক দূর পর্যন্ত। হৃদয় ভালোবেসে চিনির নাম দিয়েছে ‘সাইলেন্ট কিলার’। খাদ্যপ্রেমিক মানুষটি যখন ভজহরি মান্নার রেওয়াজি পাঁঠার শাহি রেজালা আর মারোয়াড়ি রেস্তোঁরার পনিরবাটার মশালার স্বর্গীয় স্বাদের ঢেঁকুর তুলে বাংলার নলেন গুড়ের রসগোল্লা দুটি খেয়ে রোব্বারের ভাতঘুমে, তখন সুগার দিদিমণি ডগোমগো হয়ে হৃদয়ের দোরে নক করে তার নিজের হাজিরার মাত্রাটা নিঃশব্দে জানিয়ে দিচ্ছে। এ ওদের দুজনের গোপন খেলা। হঠাৎ কোনো এক সুন্দর সন্ধ্যায় বা অফিসের প্রোজেক্ট প্রেজেন্টেশনের রাশভারি দুপুরে অথবা রাতঘুমের নিশ্চিন্ত যামে হৃদয়টি ম্যাসিভ এ্যাটাকের গম্ভীর সিগন্যাল বাজিয়ে দেয় আচমকা। সেদিন থেকেই চিনি আর হৃদয়ের গোপন আঁতাত জানাজানি হয়ে যায় ডাক্তারের চৌকশ প্রেসকিপসনে। তো তারই শিকার হয়েছেন জয়তী দেবি, ঘরে কারো কাছে তেমন মিষ্টতা না পেয়েও। আসলে নিজের দিকে তাকানোর ইচ্ছে বা সময় না থাকার অবহেলাও শরীরের রক্তে চিনি শত্রুর বেশে জাঁকিয়ে বসে।
শান্ত মহিলাটি নিজেকে নিয়ে তেমন ভাবতে চান না। শান্ত মহিলাটি সেদিন কার্ডিওলজিষ্টের কাছে বেশ ঝাড় খেয়েছেন। ব্লাড সুগার কন্ট্রোলে ডাক্তারী ওষুধে কোনো কাজ হয় না যদি না পেশেন্ট নিজেকে ভালোবেসে রোজ নিয়ম করে কয়েক কিলোমিটার হাঁটেন। জয়তী চ্যাটার্জীর একমাত্র ছেলে সৌম্যও ডাক্তারবাবুর সঙ্গে একমত। কেন মা সকালে উঠে হাঁটতে যাও না! কাল থেকে কিন্তু হাঁটা শুরু করবে বলে দিলাম। কেন যে জয়তী হাঁটতে যান না সে কথা তো বলা যায় না ছেলেকে। নাতির স্কুলে যাবার আগে তার ব্রেকফাস্ট, স্কুলের টিফিন, সব রেডি করার পর যখন ফুরসৎ পান তখন সূর্যদেব বেশ রোদ নামিয়ে দেয় তাদের আবাসনের হাঁটার রাস্তায়। যতক্ষণ জয়তী এসব সারেন ততক্ষণ ধরে বৌমা অফিস যাবার প্রস্তুতি সারে। ক্লান্ত শাশুড়িমায়ের একটু অভিমান হতেই পারে! অভিমান তিনি নিজের ঘরের বালিশে লুকান। এভাবেই বয়স বেড়ে উঠছে তাঁর গত পাঁচ ছয় বছর ধরে। নাতিকে চুমো দিয়ে জয়তী নিজের ঘরে এলিয়ে পড়েন আজকাল। নাতির পুলকারের জন্য অপেক্ষা করতে পারেন না। এসব কথা কি ছেলেকে বলা যায়! মায়ের না-বলা অবস্থার কথা সেদিন হঠাৎ চোখে পড়ে গেছিলো ছেলে সৌম্যর। বুঝতে পেরে মা’কে নিয়ে নিজেই ভোরে তাদের আবাসনের প্লেগ্রাউন্ডে কয়েক চক্কর হাঁটিয়ে অভ্যস্ত করে দিয়েছে স্ত্রীর ঠান্ডা চোখ উপেক্ষা করেই। সেই থেকে জয়তীর ওয়াকিং শুরু এবং এখন তিনি একাই হাঁটেন, আরও অনেক স্বাস্থ্যান্বেষী মেয়ে পুরুষের মতো। যদিও তাঁর হাঁটার মধ্যে নিজের স্বাস্থ্য উদ্ধারের কোনো ইচ্ছেই থাকে না। ক্লান্তি এসে পা জড়িয়ে ধরলে গ্রানাইড বাঁধানো বড় বকুল গাছটার তলায় এসে বসেন। অভিমান হয় স্বামীর ওপর। ছেলে সৌম্য তখন সবে চাকরি পেয়েছে। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ম্যাসিভ হার্ট-এ্যাটাকে স্বামীকে হারিয়ে বড় নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছেন জয়তী ভট্টাচার্য। অভিমান তাঁর স্বামীর ওপরেও। বকুলতলায় বসে এইসব কথা ভাবতে ভাবতে গভীর বিষাদে যাতনায় তলিয়ে যান। বিশাল বকুলাগাছটার ছায়াও তাঁকে ছায়া দিতে পারে না। এখনও নি:সঙ্গতা তাঁকে মনে মনে কাঁদায়। একাকীত্ব আজও সরব মনে মনে। আসলে কোনো কিছু উচ্চকিত না হলে আমরা সাধারণ মানুষেরা দেখতে পাই না তো! দেখতে চাইও না।
রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার নীলাব্জ সেনের মতো সদা হৈচৈ মুখর চনমনে মানুষটির চোখে কিন্তু পড়েছে এই শান্ত মহিলার নির্বাক একাকীত্বের কষ্ট। অকৃতদার এই মানুষটি তাঁর সদাহাস্যময় উপস্থিতি দিয়ে পুরূষ মহিলা নির্বিশেষে আবাসনের সকলকে আপন করে নিয়েছেন। হার্টের পেশেন্ট তিনি জানেন জীবনের অনিশ্চয়তার কাহিনী। তাই জমিয়ে স্ফুর্তিতে জীবনকে যাপন করে নেন। সকলের কাছে তিনি প্রিয় নীলদা। তিনিও জয়তীর নিস্পৃহ শীতলতার দরজা ঠেলে ঢুকতে ইতস্তত করেন। বাইরে হাসিখুশি মানুষটির মনের ভেতরের তীব্র যাতনার নদীটির হদিশ কেউ জানেনা, যে যন্ত্রণা জয়তীর শান্ত চোখে, নিশ্চুপ মুখে সবসময় প্রতিফলিত হয়। চোখই তো মনের প্রতিফলন ক্ষেত্র! সেই প্রতিফলিত ছবি একমাত্র সেইই পড়তে পারে যার হৃদয় সমযন্ত্রণায় ঝংকৃত! নিলাব্জ সেন আর্মফোর্সে জয়েন করায় তাঁর ভালোবাসার নারী তাঁর জীবন থেকে সরে গেছিলো। হয়তো এই চাকরি তার পছন্দ হয়নি! অথবা বাড়ির চাপে তাকে সরতে হয়েছিল। আর বিয়ে করার কথা ভাবেন নি নিলাব্জ সেন। একাকীত্বকে ঢেকে রেখেছেন সমাজ সেবায়। সকলের প্রয়োজনে এই বয়সেও তিনি সদা প্রস্তুত। মানুষের মনের ভেতরটাও বোধহয় পড়তে পারার মত সহৃদয় একটি মন আছে নীলাব্জ সেনের। ভীড়ের হা হা হি হি’র বাইরের এই শান্ত মহিলাটি তাঁর চোখে পড়েছে। রোজ কীভাবে যেন একটু একটু করে জয়তীর মনের কাছে এগিয়ে এসেছেন নীলাব্জ। তার বকুল গাছের তলায় হাতভর্তি বকুলফুল নিয়ে রোজ নিশ্চুপ বসে থাকাও দেখেছেন। কিন্তু আজ যেন এই বসে থাকায় কিছু অস্বাভাবিকতা দেখলেন। এতক্ষণে তো মহিলা বাড়ি ফিরে যান! হাতে থাকে কিছু ঝরে পড়া বকুল। হয়তো সেগুলো দেবতাকে নিবেদন করেন! হয়তো এই ফুলগুলোর সাথে কোনো স্মৃতি জড়িয়ে আছে।
ভাবতে ভাবতে নীলাব্জ বকুলতরুর
কাছে একটু বসতে চান!
বেলার দিকে আবাসনের বাতাসে মহিলার অসুস্থ হয়ে পড়ার গুঞ্জন শুনতে পান। এই গুঞ্জন আর্মি-অফিসার নীলাব্জ সেনকে কেন যে বিষণ্ণ ও উদ্বিগ্ন করে তোলে! ভালো খবরের জন্য প্রতীক্ষা করতে করতে তিনি জয়তীর হাতের অঞ্জলিভরা বকুলের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে বসে থাকার ছবি দেখতে পান। বেলা পর্যন্ত কোন খবর শুনতে না পেয়ে অবেলায় জয়তীর ফ্ল্যাটের ডোরবেলে হাত রাখেন। শুভকামনা আর অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই তাঁর। কিন্তু নীলাব্জের মন আরও বেশি কিছু করতে চায় তাঁর জন্য!
জয়তী দেবীর বেশ কিছুদিনের অনুপস্থিতিতে বকুলতরুটি উদ্বিগ্ন হয়েছিলো কিনা জানা নেই। নীলাব্জ কিন্তু হয়েছিলেন, যেদিন থেকে জয়তীর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার খবর পেয়েছিলেন। ওয়াকিং শেষে রোজ একবার বকুলতলাটা ছুঁয়ে যান। শূন্য বকুলতলা তাঁকে ব্যথিত করে কেন যে!
আজও আত্মমগ্ন হয়ে জয়তীর বসে থাকার বকুল তলায় এসে চোখ তুলতেই অপ্রত্যাশিত ভাবে তাকেই দেখলেন। দেখলেন আরও শীর্ণ বিষাদগ্রস্ত জয়তী তার দুহাতের অঞ্জলিভরা বকুলফুলের দিকে তাকিয়ে নিবিষ্ট বসে আছে। পারলেন না নীলাব্জ সেন, রিটায়ার্ড আর্মি অফিসার। বিশ্ব ভুলে গিয়ে তিনি জয়তীর পাশে এসে বসলেন।
মর্নিংওয়াক সেরে দুজনে দুদিক থেকে এসে বকুল তলার ঝকঝকে গ্রানাইড বাঁধানো বেদিতে নিশ্চুপ বসে থাকেন। কেমন আছেন-ভালো আছি, এছাড়া কথা এগোয় না। মনে মনে নিভৃত সংলাপে থাকেন দুজনে হয়তো। বসার দূরত্ব ঠিকই থাকে দুজনের। নিভৃতে দুজনে দুজনের কাছের মানুষ হয়ে ওঠে। আর আশ্চর্য, জয়তী দিনে দিনে সুস্থ আর সুন্দর হয়ে উঠতে থাকেন। নীলাব্জ হয়তো মনে মনে গেয়ে ওঠেন, ‘তুমি যে এসেছো বকুল বিছানো পথে’। নিভৃত বকুলতলা আবার গুঞ্জনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে আবাসনের বাতাসে।
জয়তীর অসুস্থতায় ভদ্র শিক্ষিত আবাসিকরা কষ্ট পেয়েছিলো। ওর সুস্থাতাতেও কি ওদের মনে কষ্ট দিচ্ছে! প্রশ্নে-বিদ্রুপে বাতাস কেন তবে মেতে উঠেছে? জয়তী শুধু বুঝতে পারেন, সমবেদনা আর সুস্থ ভালোবাসা সব কলুষ অবহেলে মাড়িয়ে গুঁড়িয়ে হেঁটে যেতে পারে। নীলাব্জ আর জয়তী মনে মনে আবাসনের গেট পেরিয়ে যান। চলতে থাকেন, চলতে থাকে্ আর দীর্ঘ চলতে থাকেন অবেলার ভালোবাসার হাত ধরে, মনে মনে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন