কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ২৭ আগস্ট, ২০১৪

কালিমাটি অনলাইন / ১৮



সম্পাদকীয়



সময়ের হিসেব অনুযায়ী আমরা এখন শরৎকালে জীবনযাপন করছি। শুনেছি, এই শরৎকাল অতীতের রাজা ও সম্রাটদের কাছে খুব প্রিয় ঋতু ছিল। বর্ষাকাল পেরোলেই তাঁরা তাঁদের সাম্রাজ্য বিস্তারের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় বেরিয়ে পড়তেন যুদ্ধযাত্রায়। পরবর্তীকালে, অর্থাৎ রাজা ও সম্রাটদের যুগ যখন প্রায় অস্তমিত, তখন সদ্যজাত  জমিদার শ্রেণীর কাছেও শরৎকাল খুবই সমাদৃত হয়েছিল। তাঁরা অবশ্য সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য নয়, বরং তাঁদের এই ঋতুতে আগ্রহের কারণ ছিল মৃগয়া। তবে শুধুমাত্র  হরিণের পেছনে দৌড়ে বেড়ানোয় আর কৃতিত্ব কোথায়! বরং তাঁদের সাহস ক্ষমতা ও পৌরুষ জাহির করার জন্য বাঘশিকার ছিল একান্ত জরুরি প্রমোদসূচি। ইদানীং কালে  অবশ্য ক্ষমতাশালীদের পুরুষত্ত্ব প্রমাণ করার জন্য বাঘ বা হরিণশিকারে অনেক হ্যাপা, রীতিমতো দন্ডনীয় অপরাধ। তাই তাঁদের শিকারের ক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। আসলে দুনিয়া জুড়েই তো ফাঁদ পাতা আছে রকমারি শিকার পর্ব বা উৎসবের। এবং একথাও অনস্বীকার্য যে, যুগ যুগ ধরে সারা বিশ্ব জুড়ে যে নৃশংসতম শিকার উৎসব উৎযাপিত হয়ে আসছে, যে উৎসবে ক্ষমতাশালীদের আমোদ প্রমোদ চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়, তা হচ্ছে মানুষশিকার। এবং এজন্য শরৎকাল আসার অপেক্ষায় হা পিত্যেশ করে বসে থাকারও কোনো প্রয়োজন হয় না, বছরের ছ’টি ঋতুই তার জন্য সমান অনুকূল। আরও দুঃখের কথা, এইসব শিকার উৎসব আজন্ম দেখতে দেখতে  আমরাও মানে নিতান্তই আম জনতা এতই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি যে, আমাদেরও আর তেমন কোনো বিকার হয় না। ভাগ্যবাদী মানুষ আমরা ভাগ্যের দোহাই দিয়ে সব রকম পরিস্থিতিতেই নির্বিকার থাকি। না না, এসব কোনো নতুন কথা নয়। আমরা সবাই  এসব কথা শুরু থেকেই জানি। বুঝি। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে এই, আমরাই আবার নিজেদের সভ্য-ভদ্র বলে জাহিরও করি। ‘মানুষ’ রূপে জন্ম নিয়েও মানবিকতা কিছুতেই আয়ত্ত্ব করতে পারি না। আবার আমাদের মধ্যে যাঁরা সাহিত্য-কলা-সংস্কৃতি চর্চা করেন, তাঁরা একথা প্রায়ই বলে থাকেন যে, আমাদের যাবতীয় সৃজন উঠে আসে আমাদেরই সমাজজীবন থেকে। কথাটা হয়তো খুবই সত্যি। আর তাই হয়তো ইদানীং কালের সাহিত্য-কলা-সংস্কৃতির মধ্যে প্রতিবাদী ভাবনার বড়ই অভাব। লড়াকু মানসিকতার অভাব। মানুষের অধিকার ও বোধ সম্পর্কে নিতান্তই নিরুচ্চার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে, আমরা কি এভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম যুগের পর যুগ ক্ষমতাশালীদের প্রমোদ উৎসবে নিজেদের সমর্পণ করে যাব? তাদের শিকার পর্বের নিশানা হয়ে থাকব? প্রতিবাদ প্রতিরোধের কোনো সৎসাহস দেখাব না? তাহলে আর মানুষজন্মের সার্থকতা কোথায়?   

দিন কয়েক আগে প্রয়াত হলেন আমাদের একান্ত প্রিয়জন এবং ‘কালিমাটি’র খুবই আপনজন দীপক চট্টোপাধ্যায়। দীপকদা ছিলেন মূলত নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক। ‘দ্যোতনা’ নামে একটি নাটকের দলও তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জামশেদপুরে। তাঁর রচিত দুটি নাটকের বই প্রকাশিত হয়েছিল এবং সমাদৃত হয়েছিল নাট্যানুরাগীদের কাছে। পরবর্তী কালে তিনি ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সঙ্গে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হবার পর নিয়মিত ভাবে গল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর অনেক গল্প ‘কালিমাটি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মূলত ‘কালিমাটি’তেই গল্প লিখতেন। ‘কালিমাটি প্রকাশনী’ থেকে তাঁর প্রথম গল্প সংকলন ‘আপাহিজ’ প্রকাশিত হয়েছিল। তাঁর দ্বিতীয় গল্প সংকলন ‘তরল আগুন উষ্ণ আগুন’ প্রকাশিত হয়েছিল ‘কৌরব প্রকাশনী’ থেকে। তিনি ‘কৌরব’ পত্রিকার সঙ্গে আরও অনেক আগে থেকেই ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বস্তুত পক্ষে,  ‘কালিমাটি’ পত্রিকার ক্রম উত্তোরণের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন স্বদেশ সেনের একটা বিরাট ভূমিকা আছে, অন্যদিকে তেমনই বিশাল ভূমিকা আছে দীপক চট্টোপাধ্যায়ের। এছাড়া আরও অনেক অগ্রজের অনেক অবদান আছে, যাঁদের মধ্যে আজ অধিকাংশই প্রয়াত। এই প্রসঙ্গে সেইসব প্রয়াত অগ্রজদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় – সুধীরচন্দ্র সেনগুপ্ত, সত্যেন্দ্রনাথ দে, পদ্মলোচন বসু, গোপালহরি বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রভাত চক্রবর্তী...। সময়ের নিয়মেই একে একে চলে গেছেন তাঁরা। আর আমরা একটু একটু করে একা হয়ে যাচ্ছি, নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। সদ্য দীপকদাকে হারিয়ে সেই একাকীত্ব আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।

‘কালিমাটি অনলাইন’ ব্লগজিনের ১৮তম সংখ্যা প্রকাশিত হলো। আমরা এই ব্লগজিনের বিভিন্ন বিভাগের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে কিছু কিছু লেখা নিয়মিত পাচ্ছি। আমরা আরও লেখা ও ছবি পেতে আগ্রহী। আপনারা লেখা ও ছবি পাঠিয়ে সহযোগিতা করুন।
আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :


 
প্রয়োজনে দূরভাষে যোগাযোগ করতে পারেন :                

0657-2757506
09835544675
                                                          

অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen,
Flat 301, Parvati Condominium,
Phase 2, 50 Pramathanagar Main Road,
Pramathanagar, Jamshedpur 831002, Jharkhand, India

     
   
     

<<< কালিমাটির কথনবিশ্ব >>>


০১) তানিয়া চক্রবর্তী


 
“আমার বিষয়বস্তু মুখে একটা ফুলকাটা দাগ”

বিশেষত যে সময় পাঠক শামুক হন বা নিভৃতে নিজেকে মেলে ধরেন, যখন আর  রং-চং খেলা নয়, নিজেকে ডুমো ডুমো কিল-চড় মারতে ইচ্ছা করে, তখন যে ধরনের লেখনী অনুভূতির গোঁড়া খুঁচিয়ে নিজেকে সমকালীন থেকে অন্যদিকে নিয়ে যায় -- সে প্রসঙ্গে স্বদেশ সেন।

‘রহস্য নিয়ে’ শীর্ষক একটি গদ্যে স্বদেশ সেন বলেছেন, কীভাবে নতুন আসে -- কৃতি  থেকে বিকৃতি — বিকৃতি আর বিশৃঙ্খলা এক তাগিদ নয়, দুটো ছিন্নমূলও নয়। কখন তার প্রয়োগ স্বাভাবিকের থেকে আলাদা হয়েও স্বাভাবিক, তেজী, আবেদনকারী ও গ্রাহ্য বিকৃতি, সেটাই গ্রহণযোগ্য। স্বদেশ সেন বুঝিয়েছেন, রহস্যের ঘোমটা কতক্ষণ অবধি   প্রসূত চিন্তার কায়েমী ফল – যেন পারমাণবিক বিভাজন।

‘মাটিতে দুধের কাপ’ কাব্যগ্রন্থের ‘গণনীয় হয়ে’ কবিতায় ধারালো ক্ষুব্ধতাকে সহজ  আলিঙ্গনে তুলে এনেছেন যেন -- “কিন্তু এ নম্বরী জন্ম / ঠাসা মাংসে, এক দাগ মেধায় / শুধু পাশখানে ব’সতে চায় / আরো  কার চোখে পড়তে চায় / একবার গণনীয় হয়ে’’

‘ব’ল না জায়গা নেই’ কবিতায় -- “বললাম তো হাইফেনগুলো তোমাকে মিলিয়ে  দেবে দেখো / ...সাত শরিকের পিঁড়ি তোমার নিজের পিঁড়ি ধরো” – এই যে গ্রাহ্য দূরত্ব আর অবস্থানের ক্লিশে খেলা, এটাতেই কবি আশ্চর্যজনক ভাবে সহজ, এই সহজটা  যারা কবিতার ক্রোশ ক্রোশ দূরে কুণ্ডলীকৃত, তাদের সত্যির মতো।  


‘আস্ত একটা ব্যাপার কবিতায়’ কবিতায় -- “এই যে তুমি লবণাক্ত সেটা একটা  ব্যাপার”-- আমরা যারা ক্ষণিক চরিত্রের প্রকাশে ক্রমশ পোলারাইজড, তারা স্থায়িত্বের হেতু হই বা না হই, সেটাই বিশেষ বিশেষণ, তা এখানে প্রতিফলিত।

কখনও প্রকৃতির নিমগ্নতা থেকে শুকনো হওয়া অবধি খাঁজে খাঁজে গাঢ় হওয়া অথবা সচেতন চরিত্রের গতিপথ তাঁর কবিতার মধ্যে চোরাস্রোতের মতো। কিছু কিছু লেখনীই থাকে, তা যেন “বানানো উনুনের কাছ থেকে চাহিদার মতো তাপ নিতে শেখায়”,   আবার কিছু থাকে “তা যেন মেরুবাসীর কাছে সূর্যের মতো’’ — দ্বিতীয় ক্ষেত্রে স্বদেশ সেনের কবিতা।

‘সাদা ট্যাবলেট’ কবিতায় -- “ভোরে সাদা ট্যাবলেট রাত্রে হলুদটা / ভোলা নেই / একটু জল খেয়ো একটু বেশী” -- যেন দ্রাব দ্রাবকের সম্পৃক্ততার খামতি আর তাকে প্রতিস্থাপনের পরিমাণে ভেজিয়ে দেওয়া... যেন নিভৃত সময়ের অনুকৃতিকে পূরণ করার খেলা।

‘ছায়ায় আসিও’ কাব্যগ্রন্থের ‘ভালোবাসা’ কবিতায় একটা কোষীয় কায়জমার মতো  ভাষা, যা আমরা জানি অথচ জানি না — “ওকে চেনার খুব দরকার ছিল / ওকে বোঝা অনিবার্য ছিল... অনিবার্য ছিলো একটু ভালোবাসা / ভালোবাসাই অনিবার্য ছিল”।

‘ছায়ায় আসিও’ কাব্যগ্রন্থের ‘একত্রিশ আশা’ কবিতায় -- ধ্রুবক হয়ে গেছে বক্তব্যের ধারাবাহিকতা যেখানে অধ্যাস নেই অথচ গন্তব্য বিহ্বলতা -- “এই বলা একবার বলো /ধনে জনে থাকো / ...থাকো হিসাবের তাপে /পরিমাণের রোদে” ‘সুখ একটা ধারণা’ কবিতায় -- “সুখ একটা ধারণা পেছনে প্রাণ মহাপ্রাণ দৌড়য়’’ অতিপ্রাকৃত   ভাবে ভাবলে এগুলো “+/-’’এর মতো কল্প আঙ্গিকের রূপক, তার পিছনে স্তরীভূত হওয়ার জন্য চলছি, আসলে অ্যাবস্ট্রাকশন একটা মুক্তকল্পের মতো দর্শকহীন অডিটোরিয়ামে নিজেকে নাচায়... কোথাও তীব্র মুদ্রায় এসে স্থাপিত হয়, সেটা চরমবিন্দু। এখানে কেউ আক্রান্ত হই, কেউ হই না। পাঠক আর লেখকের অ্যগ্লুটিনেশন মানেই আক্রান্তকারী কবিতা -- সফল কবিতা।

‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ কাব্যগ্রন্থের ‘কোথায় এক পরিবর্তন’ কবিতায় দুটি লাইন -- “পড়ো এমন করে, এমন অসাধারণভাবে পড়ো / যা মৃত্যুচিৎকার থেকে বড়ো ও সমানে ছড়িয়ে যায়” -- একটা ধরার চেষ্টা আর না ধরতে পারার প্রপাত -- সেটাই তো কায়েমী বিকৃতি, কিন্তু বিশৃঙ্খলা নয়, তা এখানে বোঝা যাচ্ছে। ‘জাদু’ কবিতায় তুলনামূলক জিঘাংসা -- “একটা কি সূর্য উঠছে না আগুনের ব্লুম” আসলে কবিতার ব্যুৎপত্তি হয় না, তার যে কোনো সূত্র বা ধর্মের দায় নেই -- এটা এই কবিতায় ধরা দিচ্ছে, বিশেষত কবিতা হচ্ছে একটা আস্ত ‘হয়তো’, যেখানে সম্পূর্ণতা  একটা চাপ -- রূপকরা সত্তা... স্বদেশ সেনের কবিতা বিমূর্তকরণকে ধারারেখ করে দেখায় 

‘ছায়ায় আসিও’ কাব্যগ্রন্থের ‘আমার বিষয়বস্তু’’ কবিতায় -- “আমার বিষয়বস্তু মুখে  একটা ফুলকাটা দাগ” শেষ লাইন -- “তবুও বিষয়বস্তু মুখে একটা ফুলকাটা দাগ”  এই যে কবিতার এন্ট্রি আর এক্সিট -- ফিরে আসার কথা না ভেবেও তার দ্রাঘিমার পাশে ঘুর ঘুর করা অথবা ফেরার প্রবণতায় অজানাকে নিয়ে ভুলভুলাইয়ার যাপন,  তাই তো চরম অভিব্যক্তি...

সব শেষে বলি, স্বদেশ সেনের কবিতায় অ্যাবস্ট্রাক্ট জরুরিপনার যে আলগোছ বাস্তব  নশ্বরতা পেয়েছি, তা কতটা সফল, বলার ক্ষমতা নেই... তবু এটুকু সত্যি যে, তা  আক্রান্তকারী... এমন কবি তিনি, যাঁর কবিতা তাৎক্ষণিকের নয়... একটা অসামঞ্জস সময়ের সমসংস্থ চয়ন। আসলে যা পৃথিবীতে আছে কিংবা যা নেই অথবা যা হ্যালুসিনেশনের প্রাথমিক অবয়ব, তারা তো চিত্রকল্প হয়েই আভিযোগী হয়এখানেই আমরা তাদের জন্য কাল্পনিক ছিপ নিয়ে ঘুরে বেড়াই... আর এখানেই তাঁর সক্রিয়তা দৃষ্টান্তমূলক। তাঁর লেখনীর আরোহণে তাঁকে আপ্রাণ শ্রদ্ধা জানাই।  
                                                                   

০২) অনুপম মুখোপাধ্যায়




একটা খুলিগ্রাম আর একটা খুলিগ্রাম

যে কোনো লেখার ইতিহাস থাকে। তার মধ্যে একটা অংশ হলো প্রকাশের ইতিহাস।  কখনো পত্রিকা লেখাটিকে বেছে নেয়। কখনও লেখাটি পত্রিকাকে বেছে নেয়। লেখাটি ‘কী’ এটাই বিবেচ্য, লেখাটা ‘কোথায়’ এটা সম্ভবত খুব গৌ ব্যাপার। কিন্তু আমাদের  এখানে একজন লেখক ‘কী’ লেখেন, তার চেয়ে ঢের জরুরি প্রশ্ন হয়ে যায়, তিনি ‘কোথায়’ লেখেন।

‘সিরিয়াস’ পাঠকরা সফল পত্রিকার সার্থক লেখার দিকেও তাকাতে চান না। আবার ঠিক এই একইভাবে ‘সফল’ কবিরা লিটল ম্যাগাজিনের কবিদের প্রকাশ্যে হেয় করতে দ্বিধা করেন না।

আসলে আমাদের এই লোকসমাজে আমরা বেশ কিছু ধারণা নিয়ে বাঁচি। বেশ কিছু ধারণা আমাদের স্কিজোফ্রেনিক করে রেখেছে। আমরা আমাদের খুলির মধ্যে একটা একটা পৃথিবী বানিয়েছি। সেটা প্রত্যেক খুলিতে আলাদা। সমস্যাটা হয়, যখন একটা খুলিগ্রাম আরেকটা খুলিগ্রামকে দখল করতে এগোয় বা একটা খুলিরাজ্য আরেকটাকে চুরমার করে দিতে চায়।

আমরা যারা লেখালেখি করি, তারা হয়তো ব্যতিক্রম নই, বরং আরো বেশি করে আজকাল এটা নির্বাহ করছি আমরা, এই খুলির পৃথিবীর আলো বাতাস নিজেরাই বানিয়ে নিচ্ছি আমরা। আমরা কেউ চাই না নিজেদের অপ্রাসঙ্গিক ভাবতে। ফলে যেটা ঘটছে, যে কোনো দুটো পৃথিবীর তুলনামূলক পরিসরটা পাঞ্জা লড়ার জায়গায় চলে যাচ্ছে। অনেক সময় ছায়ার সঙ্গে লড়াই করছি আমরা। কখনও সেই ছায়ার নাম প্রতিষ্ঠান, কখনও লিটল ম্যাগাজিন।

‘লিটল ম্যাগাজিন’ নামটা মেনে নিতে আমার সমস্যা হয়। কেন লিটল? কোন  দৃষ্টিকোণ থেকে লিটল? যে কোনো বিগ’এর চেয়ে এই পত্রিকাগুলো বিগ তারপরেই মনে হয়, লিটল মাস্টার সুনীল বা সচিন বা সেই পারমাণবিক বোমার নাম ছাড়াও, আমাদের মাইথোলজিতে বিষ্ণুর অন্যতম অবতার হলেন বামন। একটি লিটল ম্যাগাজিন আসলে ওই বামন অবতার। আমাদের পরিত্রাতাকে আমরা আদর করে ওই নাম দিয়েছি। তার রক্ত-ঘাম-অশ্রুর যে ইতিহাস, তা আমাদের মাথা নত করে দেয়।

ছোট পত্রিকায় লেখা একজন লেখকের কাছে এক প্রাপ্তি, এক পুরস্কার। ছোট পত্রিকার বড়ো লেখক হওয়া বড়ো পত্রিকার ছোট লেখক হওয়ার চেয়ে ঢের কাম্য।

বাণিজ্যিক পত্রিকার ধারণাটি এক সোনার পাথরবাটি। সব কাগজই বাণিজ্যিক। এমন   কোনো পত্রিকা যদি প্রকাশিত হয়, যে নিজের বিনিময় মূল্য লেখে না, তাহলে একমাত্র সেই পত্রিকাই অ-বাণিজ্যিক। আমরা হয়তো বাণিজ্যিক পত্রিকার আড়ালে সেইসব  পত্রিকাকে হেয় করতে চাই, যারা বিশেষ এক ধরনের লেখা ছেপে চলেছে নিজের আপামর পাঠকের কাছে বিক্রয়যোগ্য করে তোলার জন্য। লিটল ম্যাগাজিন চায় স্বল্প কিন্তু সমর্থ পাঠকের সামনে নিজেকে বিক্রয়যোগ্য করতে, অযোগ্য পাঠকের জন্য তার কোনো সমঝোতা নেই। কিন্তু বাজারসফল একটি পত্রিকা সেই সমঝোতাটা করে। প্রশ্ন হলো, খুব ভুল কি করে?

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কিন্তু সাহিত্যের ক্ষেত্রে আমাদের অক্ষর পরিচয়টুকুও ঠিকভাবে করায় না। আমরা কি এটা আশা করতে পারি যে, যে কোনো একজন বি এ বা এম এ পাশ ‘শিক্ষিত’ মানুষের সামনে ‘সুহাসিনীর পমেটম’ বা ‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ রেখে দিলেই তিনি তার প্রতি উদগ্রীব হবেন? যদি, যে পত্রিকাগুলোর প্রতি আমাদের  এত ঘৃণা, তারা ওইসব লেখা ছাপত, বাংলা সাহিত্যের কোনো মঙ্গল হতো? আমাদের এখানে এমন কি কলেজে অধ্যাপনা করার জন্যও ওই বই দুটির নাম জানা আবশ্যক নয়। বরং না জানলেই পড়াতে সুবিধে হয়।

আমি বলছি শুনুন, যদি বাংলা বাজারের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকাটি আলোক সরকার, মণীন্দ্র গুপ্ত, উদয়ন ঘোষ, স্বদেশ সেনদেরই কবিতা ছাপত, তাহলে ওই পত্রিকার বিক্রি কমে আসত হাজারের তলায়। আর তখন এখনকার তথাকথিত ‘সফল’ কবিদের কবিতা ছাপার জন্য অন্য কাগজ তৈরি হতো, তাদের বিক্রি বাড়তে বাড়তে ওই  পত্রিকাটির জায়গায় পৌঁছত। আমাদের এখানে কোনোদিনই বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত হতে পারবেন না রাজ চক্রবর্তী বা হরনাথ চক্রবর্তীর মতো জনপ্রিয়। যদি ভেংকটেশ ফিল্মস দেব, জি, কোয়েল, শ্রাবন্তীদের বাদ দিয়ে ঋত্বিক চক্রবর্তীকে বরণ করে নেয়, যেটা ঘটবে, মফস্বলের সিনেমা হলগুলোতে দক্ষিণী আর ওড়িয়া সিনেমা চালানো ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না।  

ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘গানের ওপারে’ নামে একটি অত্যন্ত রুচিশীল সিরিয়াল আরম্ভ  করেছিলেন আমাদের ড্রইংরুমের জন্য। সেটা তিনি শেষ করতে পারেননি, করতে দেওয়া হয়নি। ‘গানের ওপারে’র ইতিহাসটা জানলেই আমাদের সমসাময়িক ইতিহাস আপনাদের কাছে প্রাঞ্জল হয়ে যাবে আশা রাখছি। লোকে রুচি চায় না, ‘ফুলকো লুচি’ চায়। অভিনয় চায় না। ফূর্তি চায়।

এটা অবশ্যই ঘটনা, এই মুহূর্তে বাংলা কবিতার অবক্ষয়ের পিছনে সাহিত্যকে বিক্রি করার মানসিকতাই দায়ী। আমাদের এখানে যে শিক্ষা ব্যবস্থা, তাতে সাহিত্যকে বিক্রি করতে হলে এমন কিছু নামকে আইকন করে তুলতেই হয়, যারা পাঠককে সস্তা বিনোদন ছাড়া কিছু দিতে পারেন না, এবং সেটাও দেন আবার ফুটো পয়সার বিনিময়ে। এর ফলেই আজকাল সত্যিকারের শিক্ষিত বাঙালিরা লিটল ম্যাগাজিনের দিকে তাকান। ফাঁপা উন্নাসিকরা তাকান ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্যের দিকে। তাঁরা  ‘প্যান্টি’ পরেন, থুড়ি, পড়েন না, ‘মিডনাইট’স চিলড্রেন’ বা ‘গোল্ডেন গেট’ পড়েন।
দোষটা কিন্তু বিগ হাউসের নয়। বিগ হাউসকে ভিলেন বানিয়ে লাভ নেই। একটা বিগ হাউস গেলে আরেকটা তার জায়গায় তৈরি হবে। অলীক প্রতিষ্ঠান বিরোধীতার কোনো অর্থ হয় না। যদি প্রতিষ্ঠানের বিরোধীতা করতে হয়, নবারুণ ভট্টাচার্যের মতো করে করতে হবে। তিনি একটা ‘ভাষাবন্ধন’ বানিয়েছিলেন। আপনিও বানান।
শুধু মনে রাখা ভালো, বদল ঘটাতে হবে আমাদের সামাজিক সাহিত্যরুচির। কেউ  যদি ভাবেন, সেটা সত্যিই বদলে ফেলবেন, তাহলে শুধু সাহিত্যিক হিসেবে নয়, তাঁকে   সেখান থেকে শুরু করতে হবে, যেটা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পরিসর, বঙ্কিমবাবুর নয়।