গুড়ান
বে-আক্কেলে
একরৈখিক একঘেয়েমি, ভারবাহী ট্রেন তার ভার খালাস করে চলে গেলে সারি সারি সব, অনেকেই
দাঁড়িয়ে পড়ি ভারমুক্ত হতে, সমান্তরাল পেতে রাখা সুদুরগামী রেল, সদ্য উষ্ণতা
প্রাপ্ত ইস্পাতের নিরাপদ দূরত্বে, ঝোপে জঙ্গলে আড়ালে, দৃষ্টিটা ভারহীন ভেসে থাকা
আকাশের দিকে একটু উদাসীন লক্ষ্যহীন করে তুলতে পারলেই লাজহীন, ভারমুক্ত হওয়ার তাগিদ এতটাই
তীব্র গভীর, সঙ্কোচ সংস্কারের ভারে যারা অসমর্থ তাদেরও হেঁটে চলার গতি তারতম্যে
অনায়াস চিনে নেওয়া যায়, ভারবহন এক সামাজিক
অস্বস্তি, ডায়াবেটিস, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনুভবের ভার বাড়ে, বাড়ে ভার নিবৃত্তির
বাসনাও, স্বল্প বিত্তের বে-রঙিন জীবন অনেকটা অ্যাটলাসের মতোন, নিস্কৃতিহীন, আসলে
অনেকদিন পর দেশ বাড়িতে ফেরত আসা, প্ল্যাটফর্মের মাথার দিক থেকে মাঝখানে ওভারব্রিজ
অবধি যেতে গেলে ভেন্ডারের বগি পেরোনো এক
দুঃসহ জ্বালা, বড় ভারি ভারি ঝাঁকা, সবজী ফল, মাছ, প্যাকিং বাক্স বস্তায় আরও হরেক
নিত্য নৈতিক, দৈনন্দিন, মাল মালবাহক মিলে ঠাসাঠাসি, পড়ন্ত বিকেলের এই ট্রেনটাকে
মালগাড়িই বলে অঞ্চলের লোকজন, অনেক কষ্টে ফাঁক ফোকর দেখে কাটিয়ে টপকে এগোতে গিয়ে অসতর্ক হোঁচট, যার
কথা হঠাৎই করে মনে পরে গেল, সে ছিল গুড়ান।
“গুড়ানের কথা তোর
মনে পরে অভীক?” চলমান অশরীরীর প্রিয় সেই পিগমি নেতার নামেই ডাকতাম, সবাই তখন অলস ধূমপায়ী,
বেকার আড্ডাবাজ, তাড়িয়ে তাড়িয়ে দেখতাম অশরীরী ভারবাহককে, ভার বইতেও যার এত আনন্দ।
হাইট বড় জোর চার ফুট, চোখ-মুখ মনুষ্যেতর, স্ট্রাকচার মালবাহকদের মতোই, গাঁট্টাগোট্টা,
গলায়, কোমরে গামছা পেঁচানো, ছাতা পড়া ধুলো
মাখা উদোম শরীর, বারমুডা-টাইপ টেরিকটের নীল মলিন হাফ-প্যান্ট হাঁটু ছাড়িয়ে পায়ের
গুলিতে, তাক লাগানো শরীর নিশ্চয়ই নয়, সব থেকে আশ্চর্য লাগত ওর দৃপ্ত অহংকারী
ভঙ্গি, হাতের আধ খাওয়া বিড়ি দু এক টানে পুরোটা শেষ করে পায়ের তলায় পিষে মারত
দম্ভে, তারপর অবলীলায় ভারবহন এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, হাইট কম থাকায় ভারি
অদ্ভুত লাগত উপর থেকে দেখলে, ভারের আড়ালে ঢাকা পরে যেত ছোট্ট শরীর, ওভারব্রিজে
দাঁড়িয়ে থেকে লক্ষ্য করেছি, হঠাৎই যেন প্রাণ সঞ্চার হতো নির্জীব পরে থাকা মস্ত
সমস্ত ভারগুলোতে, যেন নিজেরাই নিজেদের বয়ে নিয়ে যাচ্ছে যথা নিয়মে ম্যাজিকের মতো,
বলতে দ্বিধা নেই, আমার তখনকার ঝিমিয়ে পড়া মেরুদণ্ডে অ্যাড্রনিল যোগাত ওর এই
পরিশ্রমী আভিজাত্য, অন্যদের থেকে যেহেতু কয়েক বোঝ সব সময় বেশিই বইত, মজুরী নিয়েও
দরদাম খুব একটা চোখে পরেনি, স্বভাবতই গুড়ানের একচেটিয়া কদর ছিল স্টেশন-চত্বর
সংলগ্ন ব্যবসায়ী মহলে।
“তুই বোধহয় জানিস
না, গুড়ানের বেশ বড় সড় অ্যাকসিডেন্ট হয়েছিল কয়েক বছর আগে,
বেশি ভারি ঘাড়ে তুলতে গিয়ে মাথায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, জোর প্রাণে বেঁচে গেছে,
ক্লাব, ব্যবসায়ী সমিতি থেকে ট্রিটমেন্টে সাহায্যও করা হয়েছিল, একটা সাইড একদমই পড়ে
গেছে,” কথা বলতে বলতে ওভারব্রিজ পেড়িয়ে রাস্তার মোড়ে পৌঁছাতেই,
অনেক ঝকঝকে চওড়া হয়েছে রাস্তাঘাট, জমজমাট, বড় পঞ্জাব লরি ঢুকে রাস্তা আটকে, মাল
খালাস চলছে দ্রুততায়, অনেকেই কাজ করছে, সেই বড় বড় বস্তা মাথায় করে নিয়ে দোকানে
দোকানে।
“বাবু?” পিছনে
তাকাতেই গুড়ান, এত কাছ থেকে দেখিনি কখনও, বলিষ্ঠ ডানদিক নেতিয়ে পড়েছে একেবারে, ল্যাগব্যাগে ডানহাত, একটা
চোখ প্রায় বোজা, মুখটাও বেঁকে গেছে, পাশে
দাঁড়িয়ে থাকা মহিলাটির উপর ভর করে বাম হাতে ধরে থাকা ভাঙা স্টিলের বাটিটা এগিয়েও
দিয়েছে যথাযথ, এলোমেলো চুল, মলিন ছিন্ন হলেও মোটামুটি পরিষ্কার গেঞ্জি লুঙ্গি,
নিরপরাধ অসহায় করুণ চাউনি, কিংকর্তব্যবিমূঢ় মানিব্যাগে হাত চলে গেল যান্ত্রিক।
যেতে যেতে অভীক বলছিল,
“তখন অত পরিশ্রম করেও কী জুটত কে জানে? এখন মনে হয় আয় বেড়েছে, সংসার পেতেছে, দেখলি তো!”
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন