সিনেমার পৃথিবী – ১২
লেখাটা শুরু করতে গিয়ে কবি স্বদেশ সেনের
‘রাখা হয়েছে কমলালেবু’ কবিতার বইয়ের
কথা মনে পড়ে গেল। সেই সত্তরের দশকে লেখা অন্যধারার কবিতা- ‘গুন লাগে কমলালেবুর/গায়ে
গায়ে সমস্ত শরীরে’। কারণ আজ একটু অন্যধারার সিনেমা নিয়ে আসরে নামব। একটু বেয়াড়া টাইপ
ছবি। যে সিনেমা সবাই বসে উপভোগ করতে পারবে
না। এগুলো ‘মেনস্ট্রিম’ বা উপভোগ্য সিনেমা কোনোভাবেই বলা যাবে না। নিটোল কোন গল্প এখানে
থাকে না। কিন্তু শিল্প ও সংস্কৃতি জগতে এইসব ছায়াছবির মূল্য অনেক, কারণ এরা বিভিন্নভাবে
সিনেমাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করেছে। এক্সপেরিমেন্টাল বলুন বা আভাঁ-গার্ড বা আর্ট-হাউজ
-- এইসব সিনেমা, পরিচালক বা অভিনেতা বা সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অন্যান্য মানুষদের
বা আমাদের মত সমালোচকদের ছবির বিভিন্ন দিক অনেক অ্যাঙ্গল থেকে বুঝতে সাহায্য করে। এবং
পরবর্তীকালের অনেক সিনেমা তৈরিতে এদের থিম বা ক্যামেরার অবদান থাকে। অবশ্য বলাই বাহুল্য,
এইসব সিনেমা সাধারণ দর্শক টানতে ব্যর্থ হয় বলে হলগুলোয় বেশিদিন চলে না। তবে এটাও শুনিয়ে রাখি, আগের বার যে ১২টা
সিনেমার কথা উল্লেখ করলাম পৃথিবীর সেরা ক্লাসিক মাস্টারপিস হিসেবে, সেগুলোর বেশিরভাগ
কিন্তু এক্সপেরিমেন্টাল না হোক, আর্ট-হাউজ সিনেমা হিসেবেই ধরা হয়।
যাইহোক, আমি আজ আর্ট-হাউজের পাশাপাশি
যে যে সিনেমা কোন না কোনভাবে এক্সপেরিমেন্ট করেছে, তাদের নিয়েই মূলত আলোচনা করব। আমার
চোখে সিনেমার ইতিহাসের একদম প্রথম দিকের এক্সপেরিমেন্টাল ডকুমেন্টারি ছবি হল ‘ম্যান
উইথ এ মুভি ক্যামেরা’ (১৯২৯)। কুড়ির দশকের সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের একটা গোটা দিন। এই
সিনেমায় বিভিন্ন সিনে ক্যামেরা এত অদ্ভুতভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যে, হবু ফটোগ্রাফারদের
জন্য এই সিনেমা আবশ্যিক করে দেওয়া উচিৎ। এরপর বলতে হয় প্রথম দিকের বিমূর্ত এক্সপেরিমেন্টাল
সিনেমা -- লুই বুনুয়েল ও সালভাদোর দালির ‘আন চিয়েন আন্দালু’ বা ‘অ্যান আন্দালুশিয়ান
ডগ’ (১৯২৯)। দুটো স্বপ্ন।
প্রথমটা লুই বুনুয়েলের। এক মেঘ রেজার ব্লেডের মত চাঁদ কেটে
দিচ্ছে। দ্বিতীয় স্বপ্ন সালভাদোর দালির। একটা হাত পিঁপড়েদের সঙ্গে হামাগুড়ি দিচ্ছে।
এই দুই স্বপ্ন নিয়ে তৈরি হল ১৬ মিনিটের এক নির্বাক চলচ্চিত্র ‘আন চিয়েন আন্দালু’। আপাতদৃষ্টিতে
কোন অর্থ নেই। অবশ্য এর মাঝে এক যুবতীর গল্প আছে, খাপছাড়া। এই সিনেমা প্রথম যখন দেখানো
হয়েছিল, তখন সিনেমার শোয়ের সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের জন্য সরাসরি গ্রামোফোন বাজানো
হয়েছিল।
তবে আমি এই নির্বাক জমানা থেকে কোন ছবি
বেছে নেব না। সরাসরি চলে আসব ১৯৪০-এর দশকে যখন ছায়াছবি সবাক হয়ে গেছে। ‘৪০ থেকে শুরু
করে প্রত্যেক দশকে আমি মাত্র দুটো করে এক্সপেরিমেন্টাল ও আর্ট-হাউজ সিনেমা বেছে নেব
যারা এই গোত্রের সিনেমায় গোটা পৃথিবীতে পথিকৃত। কাজটা বেশ কঠিন কারণ একটা বাছতে গিয়ে
অন্য বেশ কয়েকটা ভাল মুভি বাদ পড়বেই। কিন্তু
আবারো বলি, এটা আমার ছাঁকনি, আমার বাছাই হিসেবে দেখুন। আপনাকে এর সঙ্গে সহমত হতেই হবে,
তার কোন মানে নেই।
৪০-এর
দশক: ১) সিটিজেন কেন (১৯৪১), ২) মেশেস অব দ্য আফটারনুন (৪৩)
৫০-এর
দশক: ৩) অর্ফিয়াস (৫০), ৪) হিরোশিমা মাই লাভ (৫৯)
৬০-এর
দশক: ৫) পারসোনা (৬৬), ৬) দ্য কালার অব পমেগ্রেনেট্স (৬৯)
৭০-এর
দশক: ৭) ইরেজারহেড (৭৭), ৮) স্টকার (৭৯)
৮০-র
দশক: ৯) কোয়ানিসকাৎসি (৮২), ১০) দ্য লাস্ট অব ইংল্যান্ড (৮৮)
৯০-এর
দশক: ১১) ড্রিমস (৯০), ১২) সেভেন সার্ভেন্টস্ (৯৬)
২০০০-এর
পর: ১৩) মালহল্যান্ড ড্রাইভ (২০০১), ১৪) দ্য ফাউন্টেন (২০০৬)
খুব সংক্ষেপে যদি বলতে বলা হয় কেন এগুলো
বাছলাম, কী কী শেখার আছে এইসব সিনেমা থেকে,
তাহলে আমার উত্তরঃ (১) নন-লিনিয়ার ন্যারেশন ও ক্যামেরার ডিপ ফোকাস, (২) স্বপ্নের মাঝে
পর্যায়ক্রমে ঘুরে চলা মোটিফ ও ক্যামেরার বিভিন্ন টেকনিক, (৩) কবিকে অমর করে তোলার জন্য
অসামান্য থিম এবং সহজ কিছু স্পেশাল এফেক্ট, (৪) শুধুমাত্র সংলাপ এবং তার থেকে তৈরি
হওয়া ছোট ছোট ফ্ল্যাশব্যাক, (৫) অস্তিত্ব রক্ষা এবং অস্তিত্ব মুছে ফেলার এক ভয়ঙ্কর
মনস্তাত্ত্বিক ড্রামা, (৬) সংলাপের তোয়াক্কা না করে, শুধুমাত্র মিউজিক ও ঘন রং ব্যবহার
করে সেলুলয়েডে কী করে কবিতা ফুটিয়ে তোলা যায়,
(৭) সাদা-কালো সিনেমাটোগ্রাফি এবং তার সঙ্গে মানানসই অদ্ভুত ব্যাকগ্রাউন্ড শব্দ ও মিউজিক,
যা স্বপ্ন আর বাস্তবের সীমারেখা মুছে দিয়েছে, (৮) কল্পবিজ্ঞান, দর্শন, মনস্তত্ব, রূপক
ও জটিলতাকে কী করে একসঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া যায়,
(৯) সংলাপ ছাড়া শুধু কিছু ছবি/দৃশ্য পরপর জুড়ে আর ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক চালিয়ে কীভাবে
সিনেমা তৈরি করা যায়, (১০) হাতক্যামেরা দিয়ে শুটিং করে স্পিডের তারতম্য ঘটিয়ে সিনেমার নতুন ভাষা
তৈরি, (১১) রংয়ের ব্যবহার, (১২) মোটিফের অদ্ভুত ব্যবহার এবং বোঝানো যে মাথা ও হৃদয়
একসঙ্গে কাজ করা উচিৎ, (১৩) এক নিটোল সিনেমা হঠাৎ কী করে ধাঁধাঁ হয়ে যায়, (১৪) তিনটে
সমান্তরাল গল্পের মধ্যে দিয়ে অমরত্ব ও ভালবাসার প্রকৃত সম্পর্ক অন্বেষণ।
এই প্রতিটা সিনেমাই নিজের জায়গায় অনবদ্য।
কিন্তু এতগুলো সিনেমা নিয়ে একদিনে আলোচনা সম্ভব
নয়। তাছাড়া এর মধ্যে কয়েকটা মুভি নিয়ে আমি আগে আলোচনা করেছি বা পরে করব। ফলে সেগুলো
লিস্ট থেকে বাদ। আজ আমি বেছে বেছে এই কটা সিনেমা নিয়ে লিখবঃ মেশেস অব দ্য আফটারনুন,
হিরোশিমা মাই লাভ, দ্য কালার অব পমেগ্রেনেট্স, কোয়ানিসকাৎসি ও সেভেন সার্ভেন্টস্।
আর একটু ছুঁয়ে যাব দ্য লাস্ট অব ইংল্যান্ড ও দ্য ফাউন্টেন।
১৯৪৩ সালের ‘মেশেস অব দ্য আফটারনুন’
ছবিতে সর্বত্র বিরাজমান মায়া ডেরেন। এই ছবির
পরিচালক, প্রযোজক, স্ক্রিন রাইটার, এডিটর এবং নায়িকা। মাত্র ১৪ মিনিটের সিনেমা। এক
মহিলার ঘুমন্ত অবস্থার অনুভূতি। অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তিকে দেখতে না পেয়ে বারবার স্বপ্নে
একই জায়গায় ফিরে আসা। বাড়ির জিনিষপত্রের পর্যায়ক্রমে ঘুরে চলা মোটিফ এবং স্বপ্ন ও বাস্তবের
সীমানা একাকার করে দেওয়া। অবশেষে মহিলার আত্মহত্যা।
এবার এই সিনেমা থেকে আমাদের প্রাপ্তি।
ক্যামেরার জাম্প কাট, অনবদ্য অ্যাঙ্গল, স্লো মোশন এবং অদ্ভুত এডিটিং দিয়ে মানুষের অবচেতন
মনের কয়েকটা দিক ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। তার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে বাড়ির খুব সাধাণ কিছু
জিনিষ। রোজকার একঘেয়েমি কীভাবে একটা চাবিকে ছুরি হিসেবে দেখতে বাধ্য করে, ছুরির জায়গা বদলে যায়, ফোনের জায়গা
বদলে যায়, মানুষ আত্মহত্যা প্রবণ হয়ে ওঠে। এমনকি ঘুমের মধ্যে বারবার একই ইচ্ছে উঠে
আসে। দর্শক বুঝতে পারে না কতটা বাস্তব আর কতটা পরাবাস্তব। একটা ছোট উদাহরণ দিই। নায়িকার
সিঁড়ি বেয়ে বারবার ওঠা, বাস্তবে ও ঘুমের মধ্যে। প্রথমবার ক্যামেরা নায়িকার সঙ্গে বডি মুভমেন্টে।
দ্বিতীয়বার ক্যামেরা নায়িকার জুতোর হিল ফলো করছে। তৃতীয়বার নায়িকার মাথা ঘোরার সাথে
ক্যামেরাও অ্যাবরাপ্ট ঘুরছে। তারপর হঠাৎ দোতলায় উঠে ক্যামেরা জানলায় ফোকাস করছে এবং
সাসপেন্স ভেঙেচুরে একাকার। ফলে মায়া এখানে ইচ্ছে করেই ক্যামেরা আর এডিটিং দিয়ে স্পেস-টাইম
ডুয়ালিটি তৈরি করেছেন এবং বারবার ভেঙেছেন। হয়ত এই এক্সপেরিমেন্ট সবক্ষেত্রে সফল হয়
নি, কিন্তু ভবিষ্যতের পরিচালকদের জন্য উনি এক বিশাল বড় দরজা খুলে দিয়েছেন। স্পেস-টাইম
ডুয়ালিটি নিয়ে কাজ করার দরজা। এবং হঠাৎ হঠাৎ ক্যামেরাকে অবজেক্টিভিটি থেকে নিজের দিকে
ঘুরিয়ে দিয়েছেন। মাত্র ১৪ মিনিট মনোযোগ দিয়ে দেখলে এই ছবি তারিফ করতেই হবে।
অ্যালান রেনে-র ‘হিরোশিমা মাই লাভ’ (১৯৫৯)
ইউরোপের নব্য-বাস্তব সিনেমা আন্দোলনের নিদর্শন। অবশ্য ত্রুফো বা গোদারের থেকে রেনে-র
সিনেমা সামান্য উল্টোদিকের কারণ রেনে ছিলেন ‘লেফট্ ব্যাঙ্ক’ গোষ্ঠীর পরিচালক। যদিও
সমস্ত নব্য-বাস্তব ছবির পরিচালকেরা এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালবাসতেন। ‘হিরোশিমা মাই লাভ’
ফ্রান্স ও জাপানের যৌথ উদ্যোগ। ছবির কাহিনি এক ফ্রেঞ্চ প্রেমিকা ও জাপানি প্রেমিকের ৩৬ ঘন্টার সংলাপ ঘিরে। মেয়েটি অভিনেত্রী
এবং ছেলেটি আর্কিটেক্ট। দুজনের নামও অর্থবহ – প্রেমিকার নাম ‘এলি’ (স্ত্রীলিঙ্গে ‘সে’,
(her) এবং প্রেমিকের নাম ‘লুই’ (পুংলিঙ্গে ‘সে’, him)। তাদের এই দেড় দিনের প্রেম, প্রেমের ওঠাপড়া এবং ৩৬ ঘন্টার ছোট্ট প্রেম শেষে দুজনকেই
নিজের নিজের জায়গায় ফিরে যেতে হবে, সেই ব্যাকড্রপে সংলাপ দিয়ে তৈরি সিনেমা। হিরোশিমার
কোন এক হোটেলের ঘরে বসে এলির মনে হচ্ছে সে ১৯৪৫-এর ৬ই অগস্ট অ্যাটম বোমের আঘাতে হিরোশিমা
ধ্বংস নিজের চোখে দেখেছে, আর লুই তাকে বোঝাচ্ছে সে কিছুই দেখেনি। শারীরিক প্রেম ও সংলাপ,
দুই এগিয়ে চলে। মাঝে মাঝে ছোট ছোট ফ্ল্যাশব্যাকে
স্মৃতি উঠে আসে। অবশ্যই, সেই স্মৃতির চর্চা নন-লিনিয়ার, অনেকটা সিটিজেন কেন-এর মত।
এই সিনেমায় প্রথম চোখে পড়বে সংলাপ। নিবিড়
ব্যক্তিগত সংলাপ, যা মাঝে মাঝেই কবিতা বলে মনে হয় – ‘out of thousand of things in
your life, I choose nevers...it was there, as I understand it, that I almost
lost you... that I risked never, ever meeting you’। একইসঙ্গে ড্রামা এবং গভীরতা।
তারপর ক্যামেরার কাজ। নায়ক-নায়িকার অনবদ্য স্পেসিয়াল প্রক্সেমিক্স দেখানোর জন্য অন্তরঙ্গ
সিনে ক্যামেরা স্ট্যাটিক রেখে মুখে ফোকাস। নগ্ন পিঠে নখের আঁচড় ও সংলাপ। দুটো দেহ যখন
মিশে যাচ্ছে, তখন রূপোর মত চকচকে গায়ে যেন রঁদার ভাস্কর্য। কখনো সখনো মাটি থেকে কম
উচ্চতায় ক্যামেরা রেখে অ্যাঙ্গল প্রায় ১৮০ ডিগ্রি করে দেওয়া হয়েছে। ফলে চলাফেরায় খুব
সহজেই সাসপেন্স ফুটে উঠেছে (এখন এই টেকনিক প্রায় সব পরিচালক ব্যবহার করেন)। তারপর মিউজিক।
শুধু পিয়ানো, হাওয়াই গিটার, বিভিন্ন বাঁশি আর ভায়োলিনের সাহায্যে ধীরলয়ে কী সুন্দর
আবহ ফুটিয়ে তোলা যায়, তা এই ছবি থেকে শিখতেই
হবে। তবে আমি এর একটা অন্য রকম থিম খুঁজে পাই। প্রেমিকা যখন প্রেমিককে ভুলতে চেয়ে তার
নাম দেয় ‘হিরোশিমা’, তখন এক শাশ্বত ফ্রেম ফুটে
ওঠে – জীবনে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। এই সিনেমা যতবার দেখেছি, মনে হয়েছে যেন স্ট্রিম
অব কনসাসনেস-এর নন-লিনিয়ার ন্যারেটিভ চোখের সামনে ভাসছে। যেন লেখক উইলিয়াম ফকনারের
লেখা পড়ছি। মানতেই হবে, নব্য-বাস্তবতায় রেনে-র এই সিনেমা শক্তিশালী। ছবিতে প্রেমিকের
ভূমিকায় এইজি ওকাদার অভিনয় নজর কাড়বে। এই সিনেমায় অভিনয়ের জন্যই ওনাকে পরবর্তীকালে
মার্লন ব্রান্ডোর সঙ্গে অভিনয়ের জন্য ডাকা হয়েছিল।
‘দ্য কালার অব পমেগ্রেনেট্স’ (১৯৬৯)
এবং ‘কোয়ানিসকাৎসি’ (১৯৮২) দেখলেই আমার কমল চক্রবর্তীর ‘মিথ্যে কথা’ কবিতা বই মাথায়
ভাসে। বাংলা সাহিত্যে প্রতিকবিতা ব্যাপারটা কমলের ‘মিথ্যে কথা’ থেকেই প্রথম উঠে আসে।
প্রতিকবিতাও কবিতা কিন্তু কবিতার ব্যাকরণছুট। সেই রকম পমেগ্রেনেট্স এবং কোয়ানিসকাৎসি
যেন সিনেমা হয়েও সিনেমা নয় – প্রতিসিনেমা।
সের্গেই পারাজানভের ‘দ্য কালার অব পমেগ্রেনেট্স’
(এবং ‘শ্যাডোজ অব ফরগট্ন অ্যানসেস্টার্স’) রং ও পোষাকের ব্যবহারে সম্পূর্ণ অন্যরকম।
দুঃসাহসী পরিচালক। বাঁধা গন্ডীর বাইরে সিনেমা করার অপরাধে রাশিয়ান সরকার বিভিন্ন ছলছুতোয়
ওনাকে তিনবার জেলে পুরেছিল। মানসিক ও শারীরিক ভাবে ওনাকে প্রায় শেষ না করে দিলে আজ
রাশিয়ান সিনেমা ওনার হাত থেকে আরো বেশ কিছু ওয়ার্ল্ড ক্লাসিক পেত।
‘পমেগ্রেনেট্স’ আর্মেনিয়ান কবি সায়াৎ-নোভার
জীবনী। অবশ্য, ঐ যে বললাম, বাঁধা গতে নয় – সংলাপ প্রায় বাদ দিয়ে শুধুমাত্র এক ভিসুয়াল
জার্নির ভেতর দিয়ে সেলুলয়েডে কবিতা ফুটিয়ে তোলা। মোট সাত খন্ডে এই সিনেমাকে ভাগ করা
হয়েছেঃ শৈশব, যৌবন, রাজার আদালত, মন্দির, স্বপ্ন, বার্ধক্য এবং মৃত্যুদূত ও মৃত্যু।
পুরোটাই যাত্রাপালার মত। এই ছবি আর্মেনিয়ার সংস্কৃতির এক বিশেষ অংশ ‘মিনিয়েচার’ পেইন্টিং
ফুটিয়ে তুলেছে। তবে এটাও বলে রাখা ভাল, যেহেতু
সিনেমার ব্যাকরণ মানা হয় নি, তাই সাধারণ দর্শক দেখলে এর অর্থ সেভাবে নাও বুঝতে পারেন। ফলে দেখার আগে এই সিনেমার
আবহ বুঝে নেওয়া জরুরী। এবং আমরা সবাই জানি যে, কোন শিল্পের বিষয়বস্তু ও নির্মাণশৈলি
মিলেই সেই শিল্পের মান নির্ধারণ করে। সেদিক থেকে দেখলে ‘পমেগ্রেনেট্স’ আমার মত সমালোচকদের
মুগ্ধ করে, এর সৌন্দর্যের জন্য। এই সিনেমাকে উপেক্ষা করে এক্সপেরিমেন্টাল/আভাঁ-গার্ড/আর্ট-হাউজ
ছবির লিস্ট সম্পূর্ণ হতে পারে না।
গডফ্রে রেজিও-র কাৎসি ট্রিলজির প্রথম
সিনেমা ‘কোয়ানিসকাৎসি’। আজটেক সভ্যতার হোপি ভাষায় যার অর্থ ‘ভারসাম্যহীন জীবন’। শুরুতেই
বলেছি, সংলাপ বা ন্যারেশন ছাড়া শুধু কিছু ছবি/দৃশ্য
স্লো-মোশনে পরপর জুড়ে অথবা ওভারল্যাপ করে আর আবহে মিনিমালিস্ট মিউজিক চালিয়ে কীভাবে
সিনেমা তৈরি করা যায়, তার একমাত্র উদাহরণ কোয়ানিসকাৎসি। প্রকৃতির সৌন্দর্য থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্কের রাস্তায় চলন্ত মানুষ ও
গাড়ির সারি ফোকাস করে অ্যাটম বোম বিস্ফোরণ হয়ে রকেট ও মহাকাশে তার ভেঙে পড়া অব্ধি প্রচুর
সিকোয়েন্স এখানে দেখানো হয়েছে। এবং বোঝানো
হয়েছে, মানুষ এই সুন্দর প্রকৃতি কীভাবে তিলে তিলে নষ্ট করছে। রেজিও, আমার মনে হয়েছে,
এই সিনেমায় সভ্যতার ক্যাওস দেখাতে চেয়েছিলেন।
সেই কাজে উনি পুরোপুরি সফল। কোন সংলাপ ব্যবহার না করেই। রেজিও-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল,
কেন উনি এই ছবিতে কোন সংলাপ বা বর্ণনা ব্যবহার
করেন নি। উনি কয়েক লাইনে মানানসই এক জবাব দিয়েছিলেন - ‘from my point of view, our
language is in a vast state of humiliation – it no longer describes the world
in which we live.’ মারাত্মক জবাব, তাই না? এই খাপছাড়া ছবিও কিন্তু ভবিষ্যতে আরো অনেক
সিনেমা তৈরিতে সাহায্য করেছে। যেমন, এই ছবি না দেখলে আপনি বুঝবেন না পরবর্তীর ‘বারাকা’
(১৯৯২) বা ‘সামসারা’-র (২০১১) ভাবনা কীভাবে এল।
আমার মাঝে মাঝে ভাবতে অবাক লাগে, কেন
আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির জগতে পারাজানভ বা রেজিও-র মত পরিচালকদের হিরো হিসেবে তুলে
ধরা হয় না? যারা দর্শকের সামনে সিনেমার সংজ্ঞা বদলে দেবার ক্ষমতা রাখেন!
আজকের লিস্টে ‘সেভেন সার্ভেন্টস্’
(১৯৯৬) দেখে অনেকে ভুরু কোঁচকাতে পারেন। কিন্তু
ইরানিয়ান পরিচালক দারিয়ুস শোকফ এই ছবি বানিয়ে বিখ্যাত হয়েছিলেন। আর্চি-র চরিত্রে অ্যান্থনি
কুইন অনবদ্য। এটাই ছিল ওনার শেষ অভিনয়। ছবির থিম বদখদ। হাসি পাবেই। আর্চি সাতজন চাকরকে
কাজে বহাল করেন, তিনজন মহিলা ও চারজন পুরুষ। এদের কাজ হচ্ছে আর্চির শরীরের বিভিন্ন
ফুটোগুলো বন্ধ করে রাখা – নাক, কান, মুখ, পেছন ইত্যাদি। আর্চির ধারণা, টানা দশদিন তার
ফুটোগুলো এভাবে বন্ধ থাকলে সে শান্তিতে স্বর্গে যেতে পারবে। শেষ দৃশ্যে আর্চির পুরনো সঙ্গিনী এসে ওনার
ওপর সঙ্গমের ভঙ্গিতে বসবে এবং আরেক তরুণী ওনার মুখে মুখ রেখে এমনভাবে চুমু খাবে যাতে
আর্চি আর প্রশ্বাস নিতে না পারে। তারপর আর্চির মৃত্যু হয়।
এবার আসা যাক সিনেমার ভাষায়। অরিফিস
বন্ধ রাখার এই যে উদ্ভট আইডিয়া, এটা তো শুধু একটা মোটিফ। এর পেছনের মূল প্রতিপাদ্য
বিষয় ধরতে হলে আপনাকে ফিরতে হবে গ্যেটে-র ‘ফাউস্ট’-এ। প্রথম ভাগ। ফাউস্ট নিজের জায়গায় অখুশি। দ্বিতীয় ভাগ। ফাউস্ট পরিদের
রাজ্যে এসে খুশি। সে জানে এরপর স্বর্গে যাবে। এই দুয়ের মাঝে যে মিসিং লিঙ্ক, সেটাই
‘সেভেন সার্ভেন্টস্’ তুলে ধরতে চেয়েছে। এর দর্শনশাস্ত্র সেটাই। শরীরের ফাঁকগুলো বুজে
গেলে মাথা ও হৃদয় কাছাকাছি চলে আসে, একসঙ্গে কাজ করে। তারুণ্য ও বার্ধক্য
পাশাপাশি আসে। জীবন ও মৃত্যু। আর্চির কাঙ্ক্ষিত মৃত্যু সবাইকে একসাথে এনে একাকার করে
দেয়। তবে হ্যাঁ, এই ছবিতে ক্যামেরার কাজ মাঝারি মানের। বেশিরভাগ শট্ ইন্ডোর।
‘দ্য লাস্ট অব ইংল্যান্ড’ (১৯৮৮) বানানোর
পেছনে ডেরেক জার্মেন-এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মার্গারেট থ্যাচারের আমলে ইংল্যান্ডের
কী রকম অবনতি হয়েছে, তা দেখানো। সেই উৎকন্ঠা
তুলে ধরার জন্য ৮ মিলিমিটারের কাঁপা হাত-ক্যামেরা দিয়ে পুরো শুটিং হয়েছে। এই ছবি নাটকীয়
ভাষা নয়, বরং কবিতার ভাষায় বলা। দৃশ্যের সঙ্গে বেশির ভাগ সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে এলিয়টের
‘দ্য হলো মেন’ এবং গিনস্বার্গের ‘হাউল’ পাঠ করা হয়েছে। এরকম কবিতার আবহে দৃশ্যায়ন
আর কোন সিনেমায় হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ছবিতে টিল্ডা সুইনটনের আগুনের দৃশ্যে অভিনয়
ভাল লাগে।
ড্যারেন অ্যারোনফস্কি তুলনামূলক ভাবে
তরুণ পরিচালক। বয়স মাত্র ৫২। হলিউডে এর মধ্যেই
বেশ কিছু সাড়া জাগানো মনস্তাত্বিক ড্রামা বানিয়ে ফেলেছেন। তার মধ্যে ‘দ্য ফাউন্টেন’
(২০০৬) অন্যতম। ‘ব্ল্যাক সোয়ান’ ছবির জন্য অস্কার পেয়েছেন। যাইহোক, ‘দ্য ফাউন্টেন’
ছবির বিশেষত্ব হল ম্যাজিকাল রিয়েলিজম-কে সিনেমার
পর্দায় তুলে ধরা। সুর-রিয়েলিজম বা নিও-রিয়েলিজম ছাড়িয়ে এক অন্য পথে যাত্রা করা। তিন
বিভিন্ন শতক থেকে তিনজন চরিত্র ‘ট্রি অব লাইফ’ খুঁজে চলেছে, যা অমরত্ব দেয়। এক রাজা,
এক বৈজ্ঞানিক এবং এক স্পেস ট্রাভেলার। সেখান
থেকে ভালবাসা ও নৈতিকতার মধ্যে প্রকৃত সম্পর্ক অন্বেষণ। বারবার ঘুরে চলা একই মোটিফ
এবং ম্যাচ-কাট দিয়ে স্পেস টাইম ডুয়ালিটি এখানে মুন্সিয়ানার সঙ্গে দেখানো হয়েছে।
তাহলে আজ এই অব্ধি। আপনারাও এক্সপেরিমেন্টাল
ছবি দেখুন ও লিস্ট তৈরি করুন। একটা ব্যাপার মাথায় রাখবেন, দশটা এক্সপেরিমেন্ট না করলে
কোন সফল আবিষ্কার হয় না। আমার চোখে কিন্তু (এখনো পর্যন্ত) এক্সপেরিমেন্টাল/আর্ট-হাউজ
সিনেমার উজ্জ্বলতম পরিচালক ইংমার বার্গম্যান ও স্ট্যানলি কিউব্রিক। বার্গম্যানের সিনেমায়
যেমন বেশিরভাগ সিনে জটিল মনস্তত্ব, কিউব্রিকের সিনেমার প্রধান আকর্ষণ হল ওনার বুদ্ধিমত্তা
এবং প্রতি সিনেমার বিভিন্নতা। এবং লেখা থামানোর আগে বিমূর্ত সিনেমার জন্য একজনের নাম
না নিলে ভারি অন্যায় হবে। কানাডার পরিচালক মাইকেল স্নো। ওনার স্ট্রাকচারাল সিনেমা এবং বিশেষত ‘ওয়েভলেন্থ’ (১৯৬৭)
আজো এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমার এক মাইলস্টোন।
এতগুলো অনন্য আর্ট-হাউজ সিনেমার শেষে
আমি শুধু একটা নতুন সিনেমা রাখতে চাই - ‘বয়হুড’ (২০১৪)। হয়ত পাঠক বলবেন, এটা অর্বাচীন
মন্তব্য। অল্টারনেটিভ বা আর্ট সিনেমার মাঝে ‘বয়হুড’ থাকতেই পারে না। কী শেখার আছে এই ছবি থেকে? নিটোল কোন গল্প নেই ঠিকই, কিন্তু
বাচ্চা বড় করে তোলার মত জটিল বিষয় তুলে ধরা ছাড়া এই ছবির অন্য বিশেষত্ব কী? আমি বলব – এই সিনেমার থিম বা অভিনয় বা সিনেমাটোগ্রাফি
বা এডিটিং, এসব কিছু নিয়েই আমি মন্তব্য করতে চাই না। এর থেকে শুধু শিখতে হয়, সিনেমার
রিলে জীবন ফুটিয়ে তুলতে গেলে পরিচালককে কতটা ধৈর্য্যশীল হতে হয়। এই ছবির শুটিং হয়েছিল
বারো বছর, যাতে এক বালক ও বালিকার যুবক/যুবতী হয়ে ওঠা অব্ধি পুরো পরিবর্তন ক্যামেরার
চোখে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। বারো বছর মানে এক যুগ। এক যুগ ধরে একটা মুভির শুটিং
চলেছে। কোন কমার্শিয়াল পরিচালক পারবেন কি এইরকম ধৈর্য্য দেখাতে?
গোটা পৃথিবীর ক্লাসিক আর এক্সপেরিমেন্টাল/আর্ট-হাউজ
সিনেমা নিয়ে অনেক হল। সামনের বার আবার আমি পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ব। এবারের লক্ষ্য
ইতালি। ভা বেনে?