জলধর সেন
গত ১৬ই মার্চ ২০২২, জলধর সেনের একশত
ত্রিষষ্টিতম জন্মদিবসে ২৪ অশ্বিনী দত্ত রোডস্থ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাসভবনে আয়োজিত
জলধর সেনের স্মরণসভা ও সম্বর্ধনাদান অনুষ্ঠানে গিয়ে কয়েকটা কথা মনে এলো এবং হলো। বাংলা সাহিত্যে
অদীক্ষিত, অপ্রাজ্ঞ পাঠক হিসেবে আমার জলধর সেন সম্পর্কে সীমিত জ্ঞানের জন্যে অপরাধবোধ
আছে, কিন্তু লজ্জা কম, কারণ অন্য অনেকের সমুদ্রোপম অজ্ঞতার সঙ্গে আমার নাম জুড়ে আছে।
তাই আমার লজ্জা ঢেকে গেছে। সভায় জলধর সেনের
অনেক প্রিন্ট-বহির্ভূত ভ্রমণ কাহিনী, কিশোর সাহিত্য, উপন্যাস, প্রবন্ধ ইত্যাদিকে ফিরিয়ে
আনা একা ভগীরথ ডঃ সুবিমল মিশ্র, তাঁর সম্পর্কে
তথ্যের আকর জলধর সেনের শ্রীবারিদবরণ ঘোষ, লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণের যুদ্ধের একক সংগ্রামী শ্রীসন্দীপ দত্ত, জলধর সেনের স্বপৌত্র সাহিত্যিক কাজল সেন ইত্যাদি
প্রগাঢ় জলধর সেন বিশেষজ্ঞদের মাঝে হংসমধ্যে বকোযথা বসে থাকতে থাকতে আমার একটা কথা মনে
হলো। ১৮৯৪ সালের ৮ই এপ্রিল বঙ্কিমচন্দ্রের তিরোধানের পরে চৈতন্য লাইব্রেরি এবং বীডন
স্কোয়ার লিটারারি ক্লাব কর্তৃক আয়োজিত শোকসভায় কবি নবীনচন্দ্র সেন সার্বজনিক, বারোয়ারি
শোকসভার কৃত্রিমতার কারণে এতে সভাপতিত্ব করতে নারাজ হ’লে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি
গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এটি অনুষ্ঠিত হয়, আর তাতে রবীন্দ্রনাথ ‘বঙ্কিমচন্দ্র’
নামে একটি অসাধারণ প্রবন্ধ পাঠ করেন, যেটি ‘সাধনা’ নামের সাহিত্যিক সাময়িকীর বৈশাখ, ১৩০১ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় (১৮৯৪-এর এপ্রিল-মে)
বেরোয়। সুরেশচন্দ্র সমাজপতি ‘সাহিত্য’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় সংখ্যায় লেখেন ‘রবীন্দ্রবাবু
বাঙ্গলা সাহিত্যের মুখ রাখিয়াছেন। যথার্থ সাহিত্যসেবীর মত তিনি বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যমূর্ত্তির
উজ্জ্বল নিখুঁত চমৎকার ছবি আঁকিয়াছেন। … এরূপ প্রবন্ধ ভাষার গৌরব।’
সে যাই হোক, নবীনচন্দ্রের অস্বীকৃতিতে
ক্ষিপ্ত রবীন্দ্রনাথ ‘সাধনা’-র জ্যৈষ্ঠ ১৩০১
সংখ্যায় ‘শোকসভা’ নামে এক প্রবন্ধ লিখলেন, যেখানে তিনি সাহিত্যসভায় বা সাহিত্যিকের
স্মরণসভায় ‘পাব্লিক’-এর আহ্বান করলেন। লিখলেন, ‘এ কথা আমি অস্বীকার করি না যে, আমাদের
দেশের পাব্লিক আমাদের দেশীয় মহাত্মা লোকের বিয়োগে যথোচিত শোক অনুভব করে না। আমাদের
এই অল্পবয়স্ক পাব্লিক অনেকটা বালক-স্বভাব। সে আপনার হিতৈষীদিগকে ভালো করিয়া চেনে না,
যে উপকারগুলিকে পায় তাহার সম্পূর্ণ মূল্য বুঝে না। বন্ধুদিগকে শীঘ্রই বিস্মৃত হয় এবং
মনে করে আমি কেবল গ্রহণ করিব মাত্র কিন্তু তাহার পরিবর্তে আমার কোনো কর্তব্য নাই। আমি
বলি, এইরূপ পাব্লিকেরই শিক্ষা আবশ্যক এবং সভা-আহ্বান ও সেই সভার আলোচনাই শিক্ষার প্রধান
উপায়।’
ফলে যখন আলোচনা শুনে বুঝলাম যে মুষ্টিমেয়
জলধর সেন অনুরাগী এবং বিশেষজ্ঞের বাইরে তিনি যখন অনেকটাই বিস্মৃত, যে অন্যায়ের প্রতিবিধানের
জন্য ও অন্যান্য অনেক কারণের মধ্যে জলধর সেন স্মৃতিরক্ষা সমিতির গঠন করতে হয়েছে, সেখানে
তার সভায় আমার মতো মূঢ়েরও বসে থাকার দায়িত্ব আছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের এই ‘শিক্ষা
আবশ্যক’ কথাটার ফলে মনে আগডুম বাগডুম অন্য অনেক প্রসঙ্গ এসে গেল। ঘোড়াডুম হয়ে ভাবতে
লাগলাম জার্মান সমাজতাত্ত্বিক Ferdinand Tönnies তাঁর ১৮৮৭ সালের Community and
Society বইতে যে পাব্লিক তথা gesselschaft-এর কথা বলেছিলেন যার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের
এই অদ্ভুত মিল হলো কী ক’রে? Tönnies সাহেব লিখলেন লোকসমাজ (gemeinchaft)-এর প্রতিতুলনায়
সমাজ (gesselschaft) হলো ‘public life’ and “new as a name as well as a
phenomenon”। আর রবীন্দ্রনাথ ‘পাব্লিক’ সম্বন্ধে লিখলেন, ‘পদার্থটিও নূতন, তাহার নামও
নূতন।’ আবার Tönnies-এর অনেক আগে, ১৮২০ সালে, আরেক জার্মান সমাজতাত্ত্বিক Hegel তাঁর
Elements of the Philosophy of Right বইয়ে ‘burgerliche gesselschaft’ বা পুরসমাজের
সঙ্গে যে
‘public’এর কথা বলেছিলেন, তার সুশীলতা
আনার জন্য তিনিও ‘bildung’ বা শিক্ষার আবশ্যকতার কথা
বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ ১৮২০ সালে হেগেলের লেখা অনুবাদে পড়েও থাকতে পারেন।
কিন্তু তা ব’লে ‘শোকসভা’ লেখার সাত বৎসর আগে Tönnies-এর লেখাও পড়ে ফেললেন? অনুবাদ হয়েছিল?
নাকি, উত্তর কলকাতায় বসে রবীন্দ্রনাথ সারা ইউরোপের সমস্ত রাষ্ট্রীয় বা সাধারণ দার্শনিক,
সমাজতত্ত্ববিদদের ভাবনা একাই ভেবে ফেলছেন?
আক্কেল গুড়ুম অবস্থায় আমার আরেকটা কথা
মনে এসে যায়। জলধর সেনের কথা বলতে গেলেই এই ‘bildung’-এর
কথা এসে যাবে না কি? তাঁর পরিব্রাজক, সাংবাদিক,
লেখক ইত্যাদি বহুস্তরীয় সত্তাকে ছাড়িয়ে আমার তাঁর সম্পাদক সত্তার কথাই বেশি মনে পড়ে।
মনে রাখতে হবে যে ঔপনিবেশিক বাংলার শিক্ষিত ভদ্রলোকরা তাঁদের সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক
বোধের ও আকাঙ্ক্ষার তৃপ্তি ও উন্নয়নের জন্য যে কটি পত্রিকা বাড়িতে রাখতেন, তাদের মধ্যে
দুটি ছিল ১৩০৮ বঙ্গাব্দের বৈশাখ মাসে সূচনা
হওয়া রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের ‘প্রবাসী
‘ ও ‘Modern Review’, আর বঙ্গাব্দ ১৩২০-র আষাঢ় থেকে ১৩৪৫ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৬
বছর জলধর সেনের সম্পাদনা করা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রকল্পিত ‘ভারতবর্ষ’। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পত্রিকা প্রকাশের
ঠিক আগে অকালমৃত্যুর ফলে তিনি চলে যাওয়ায় কতকটা
আকস্মিকভাবেই এর সম্পাদনার ভার জলধর সেনের হাতে পড়ল। ১৩৪৩-এর ভাদ্র সংখ্যার
'ভারতবর্ষে' প্রকাশিত তাঁর লেখা থেকেই জানি যে, ‘সুলভ সমাচার’ উঠে যাওয়ার সংবাদ
পেয়েই আমার পরম হিতৈষী বন্ধু আমার পূর্ব্ব
মনিব সন্তোষের কবি-জমিদার শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ রায় চৌধুরী মহাশয় আমাকে ডেকে পাঠালেন
এবং যত দিন আর কোন সুবিধা না হয় তত দিন তাঁর প্যারাগন প্রেসের ভার নিতে বললেন। এখন
যেখানে আমাদের ভারতবর্ষ-অফিস হয়েছে পূর্ব্বে সেখানে ট্রাম কোম্পানীর আস্তাবল ছিল। সেই
আস্তাবলের ঘরগুলি ভাড়া নিয়ে প্রমথবাবু প্যারাগন
প্রেস করেছিলেন। আমি সেই প্রেসের ম্যানেজার হলাম’। এর পরে যখন ‘ভারতবর্ষ’ প্রচারের আয়োজন চলছে খুব ধুমধাম ক’রে, দ্বিজেন্দ্রলাল
রায় এবং অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণ যুগ্ম-সম্পাদকত্বে, তখন ‘ভারতবর্ষ’-এর স্বত্বাধিকারী
হরিদাস চট্টোপাধ্যায় এই প্যারাগন প্রেসেই
‘ভারতবর্ষ’ ছাপানোর ব্যবস্থা করেন, আর তাঁকে এর জন্য অগ্রিম টাকাপয়সাও দেন। কিন্তু এই পত্রিকার প্রুফ
দেখতে দেখতেই দ্বিজেন্দ্রলাল মৃত্যুবরণ করেন এবং লেখক সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, বহুবিদ
বিদ্যাভূষণমশায় থাকতেও হরিদাস চট্টোপাধ্যায় জলধর সেনকে পত্রিকার সম্পাদক পদে প্রায়
জোর ক’রে বসিয়ে দেন।
আমি ভাবতে থাকি যে তবুও
সম্পাদক হিসেবে উভয়ের নিষ্ঠার মিলটুকু বাদ দিলে জলধর আর রামানন্দর সামাজিক আচরণের পার্থক্য ছিল সমুদ্রপ্রতিম। সম্পাদক রামানন্দ ছিলেন
পাব্লিক-বিমুখ, এলিটিস্ট, পারতপক্ষে কর্তব্যবোধে কোন সামাজিক নিমন্ত্রণ, ক্রিয়াকর্মে
গেলেও খাদ্যগ্রহণে অনিচ্ছুক। আর উপরোধে লেখা ছাপা? এ বিষয়ে একটি চালু গল্প আছে। যদিও
তার সত্যতা সন্দেহাতীত নয়। তবে বলেছেন সাগরময়
ঘোষ, ‘সম্পাদকের বৈঠকে’ বইতে। কাশীতে মণিকর্ণিকা-র
ঘাটে আশ্বিনের ভরা গঙ্গার চোরা আবর্তে নিমজ্জমান রামানন্দ-র উদ্ধারকারী একটি যুবককে তিনি প্রত্যুপকার
করতে চেয়ে নিজের নাম ও ‘প্রবাসী’ কার্যালয়ের ঠিকানা
লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু তার ফলে ছেলেটি তাঁকে
কিছুকাল পরে একটি কাঁচা, অমুদ্রণযোগ্য কবিতা ‘প্রবাসী’-তে
ছাপানোর জন্য নিয়ে এলে তিনি তাকে নাকি কাতরকণ্ঠে বলেন, ‘এ-কবিতা তো ছাপতে পারব না।
তার চেয়ে যে-গঙ্গা থেকে আমাকে তুমি উদ্ধার করেছিলে সেই গঙ্গায় আবার আমাকে ফেলে দিয়ে
এস।’ আর জলধর সেন? যে-কোন নেমন্তন্নবাড়ি থেকে ওঁকে আমন্ত্রণ জানালে উনি কিছুতেই
না বলতে পারতেন না, পাছে ফিরিয়ে দিলে তাঁরা মনে দুঃখ পান! সবকটিতে যেতেন, সবকটিতে খেতেন,
সমপরিমাণ আগ্রহ নিয়েই। নিমন্ত্রণ রক্ষা করে যখন উনি ফিরতেন, তখন দেখা যেত ‘তাঁর উদরের
সঙ্গে গলাবন্ধ কোটের বুকপকেটটাও ফুলে ঢোল।’ তাতে থাকত ছোটগল্প, প্রবন্ধ, কিন্তু বেশীরভাগ
ক্ষেত্রেই কবিযশোপ্রার্থীদের কবিতা। এইসব লেখক-সম্মান অভিলাষীকেই জলধর সেন প্রচুর বাক্যোৎসাহ
দিতেন। কোনো বাড়িতে আবার কেউ লেখা না দিলে প্রায় বলি—বলি ব্যাপারখানা কী প্রশ্ন করার
স্তরে চলে যেতেন। অবশ্যই সেই লেখাগুলোর প্রায় কোনোটাই ছাপা হতো না, আর তার কারণও হতো
যেমন বিচিত্র তেমনই চিত্তাকর্ষক। কোট ধোবার বাড়ি চলে যাওয়া, গতাসু স্ত্রীর অগোছালো
সংসারে সব জিনিস হারিয়ে যাওয়া, এমনকি নিজের
কানে খাটোত্বের আশ্রয় নিয়ে লেখা জমাকারকের কথাই শুনতে না পাওয়া। তো, একবার এক ভারতবর্ষ
প্রেমিকের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে তাঁর পুত্রের কাছে এরকম উপরোধী লেখা না পেয়ে শুধোলেন,
‘এ-ধরনের অনুষ্ঠানে যখনই আমার ডাক পড়ে তখনই
বাড়ি ফেরার সময় কিছু-না-কিছু আমাকে নিয়ে ফিরতেই হয় — এই যেমন গল্প প্রবন্ধ বা কবিতা।
একমাত্র এখানেই তার ব্যতিক্রম দেখে আশ্চর্য হয়ে তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।’
এই উপরের কথাটা ছিল সরলভাবে বলার ছলে
শাণিত বিদ্রূপ। জার্মান সমাজতাত্ত্বিক Georg Simmel সমাজের ভিত হিসেবে ধরেছিলেন একটি
ধারণাকে, ‘sociation’, এবং ‘pure sociation’, যাকে আমরা শিথিল বঙ্গানুবাদে বলতে পারি
সামাজিকতা বা বিশুদ্ধ সামাজিকতা। জলধর সেন যেন তাঁর সামাজিকতার তাড়নার এই অন্যায় সুযোগগ্রহণ-কে কশাঘাত করলেন। এই সম্পাদকীয় নিষ্ঠা
না থাকলে কি তিনি ছাব্বিশ বৎসর ‘ভারতবর্ষ ‘ ছাড়াও তার আগে কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা প্রকাশিকা,’ ‘বঙ্গবাসী’,
‘বসুমতী’, ‘সন্ধ্যা’, ‘হিতবাদী’, ‘সুলভ সমাচার’ ইত্যাদি পত্রিকার সম্পাদকীয় কাজের দায়িত্ব
পালন করতে পারতেন? ‘বঙ্গবাসী’-র মূলমন্ত্র মেনে নিতে না পারায় মাত্র দেড় মাস পরে
সেই কাজ ছেড়ে দিতে পারতেন?
অনেকের সস্নেহ প্রশ্রয়ে জলধর সেনের সাহিত্য
প্রতিভা বিকশিত হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে প্রধান ছিলেন তাঁর নামকারক স্বনামখ্যাত হরিনাথ
মজুমদার, ঔপনিবেশিক কলকাতার জাতীয়তাবাদী বাঙালিদের অসীম শ্রদ্ধাষ্পদ ‘কাঙাল হরিনাথ’।
নামকরণে অভিনবত্ব ছিল না, যদি মনে রাখি যে জলধরের বাবার নাম ছিল হলধর। এ ছাড়া তাঁকে
শিক্ষায়, সাহিত্যকর্মে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছেন স্বয়ং বিদ্যাসাগর, বিদ্যাসাগরমশাইয়ের দৌহিত্র সুরেশচন্দ্র
সমাজপতি, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ইত্যাদি। তাঁর ভ্রমণ সাহিত্যের অনুরাগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ,
ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায়, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
ইত্যাদি। ভ্রমণ সাহিত্যের কথায় মনে পড়ে গেল, আমার জলধর সেনের সঙ্গে প্রথম পরিচয়, তাঁর
‘দার্জিলিং ভ্রমণ’ নামের একটি পাঠ্যাংশ থেকে আমাদের চতুর্থ শ্রেণির বাংলা পাঠ্যপুস্তক ‘কিশলয়’-এ। কী পরিমিত সেই লেখা! একটি কথা বেশি নেই। একটি কথা কম নেই। আর পড়ার পর, মনে
পড়ে যাবে রবীন্দ্রনাথের কথা, ‘অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি, মনে হবে শেষ হয়ে হইল না
শেষ’। লেখাটি কোথায় আছে খেয়াল নেই, ‘হিমাচল পথে’ নামে দার্জিলিং ভ্রমণের একটি কাহিনীতে,
যেটি তাঁর ‘মুসাফির মঞ্জিল’ নামক গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, নাকি, ‘তেহরির পথে’-তে?
অন্নদাশঙ্কর রায়ের অমর কথা, 'ভ্রমণ থেকেই
হয় ভ্রমণ কাহিনী … কিন্তু ভ্রমণকারীদের সকলের হাত দিয়ে নয়’-কে সার্থক ক’রে জলধর সেনের
লেখা গাইডবুক আর ভ্রমণোপন্যাস এই দুই-এর রিক্ততা আর আতিশয্যের দুই দোষকেই এড়িয়ে গেছে।
তাঁর সম্ভবতঃ দশটি ভ্রমণ কাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ও কালজয়ী ‘হিমালয়’ (১৯০০)-এর
লেখকত্বের বিতর্ক বাদ দিয়েই বলছি, একদিকে যেমন বইটি দেবপ্রয়াগের শোভা, রুদ্রপ্রয়াগ
থেকে পিপল চটির তৎকালীন দুর্গমতা, বদরিগামী পথের বৈচিত্র্য, বরফ কেটে রাস্তা তৈরি,
যোশীমঠের পথের অলৌকিক সৌন্দর্য, ব্যাসগুহায় তুষারাচ্ছন্ন নদীপরিসর ইত্যাদির অপূর্ব
বর্ণনা দিয়েছে, তেমনি অজস্র অন্য প্রসঙ্গ এনে ভ্রমণ বর্ণনাকে একঘেয়ে হতে দেয়নি, যেমন,
জন বানিয়ানের পিলগ্রিমস্ প্রগ্রেস, একাধিক রবীন্দ্রসঙ্গীত, বঙ্কিমের আনন্দমঠ, বিবর্তনবাদ,
মেসমেরিজম, থিয়োসফি, শঙ্করাচার্যের শিক্ষা ইত্যাদির উল্লেখ, তেমনি তারকনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের
‘স্বর্ণলতা’ উপন্যাসের কথা, বদরির পাণ্ডা প্রসঙ্গে
বা ঈশ্বর গুপ্তের পাঁঠা বিষয়ক কবিতা, শেক্সপীয়র, মীরাবাঈ-এর উল্লেখ, আবার শিক্ষিত বাঙালি
ও অশিক্ষিত গাড়োয়ালির তুলনা, গণেশকে নিরীহ করণিক হিসেবে দেখা, দ্রৌপদী ও বৃকোদর-কে
নিয়ে তামাশা ইত্যাদি।
জলধর সেনের ভ্রমণ সাহিত্য সুদীর্ঘ। তার
মধ্যে পড়ে ‘প্রবাসচিত্র’ (১৩০৬/১৮৯৯); ‘হিমালয়’ (১৩০৭/১৯০০); ‘পথিক’ (১৩০৮/১৯০১);
‘হিমাচল বক্ষে’ (১৩১১/১৯০৪); ‘পুরাতন পঞ্জিকা' (গল্প ও ভ্রমণ, ১৯০৯); 'হিমাদ্রি' (১৩১১/১৯০৪);
'আমার য়ুরোপ ভ্রমণ (১৩২২/১৯১৫); 'দশদিন'
(১৩২৩/ ১৯১৬); ‘মুসাফির মঞ্জিল’ (১৩৩১/১৯২৪); 'দক্ষিণাপথ' (১৩৩৩/১৯২৬); 'মধ্যভারত'
(১৩৩৭/১৯৩০) ইত্যাদি বই ছাড়াও, ‘প্রবাসের সুখ’ (‘প্রদীপ’ মাসিক পত্রিকা, ১৩০৪/১৩০৫
বৈশাখ ও শ্রাবণ সংখ্যা), ‘প্রবাসে এক রাত্রি’(‘প্রদীপ’,
১৩০৮ বৈশাখ সংখ্যা), ‘প্রবাসের কথা’(ঢাকা সম্মিলন ও রিভিউ, ১৩১৮ ভাদ্র সংখ্যা), ‘হিমালয়ের
কথা’(চিত্র সহ) (‘ভারতবর্ষ, ১৩২৩ আশ্বিন),
ছোটদের জন্য প্রকাশিত ‘হিমাদ্রি’ (১৩১৮/১৯২৫) এবং ‘বদ্রিকাশ্রমে নারায়ণ দর্শন’(‘ধ্রুব’মাসিক
পত্রিকা, ১৩১৯ অগ্রহায়ণ পৌষ সংখ্যা) ইত্যাদি সাময়িকীর লেখা। হিমালয় সংক্রান্ত প্রায়
সবই সুবিমল মিশ্র সম্পাদিত ‘হিমালয় সমগ্র’ গ্রন্থে পাওয়া যাবে। এই বইগুলির ভাষার কথা
আর তার স্বকীয়তার কারণটির কথা একটু বলি। ‘প্রদীপ’
পত্রিকার ১৩০৭-এর অগ্রহায়ণ সংখ্যায় অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ‘হিমালয়’ সম্পর্কে লিখেছিলেন,
“ভাষার বিশেষত্ব আছে, তাহা পুস্তকের ভাষা নহে … শুষ্ক কঠোর কঙ্কর বা পাষাণস্তূপের ন্যায়
দুরধিগম্য নহে, অথচ নানা তত্ত্বকথায় সুসংযত। এরূপ সুলিখিত সুললিত ভ্রমণ কাহিনীর কে
না সমুচিত সমাদর করিবে?” এই অ-সংস্কৃতগন্ধী ভাষার কারণটি খুব কৌতুকাবহ। কে বিশ্বাস
করতো জলধর সেন নিজে না বললে যে ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যাভিলাষী, গণিতে পারঙ্গম, ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগরের দাক্ষিণ্যে জেনারাল অ্যাসেম্বলীজ-এ ভর্তি হওয়া জলধর সেন কেবল সংস্কৃতে
দুর্বল ছিলেন ব’লে এল.এ. পরীক্ষায় পাস করতে পারেননি ব’লে তাঁর প্রাযুক্তিক শিক্ষা হলো
না! ১৮৬০ সালে জন্ম নেওয়া কোনো শিক্ষিত বাঙালির পক্ষে এই ঘটনা বিস্ময়ের। এই ঘটনার
‘teleology’ বা পরমকারণিকতার কথা দিয়ে শেষ করি। যে যুগে বঙ্কিমচন্দ্র সংস্কৃত কলেজের
কোনো ছাত্রের লেখা নিতেন না, সব লেখাই ‘নদ, নদী, গিরি-কান্তার-মরু’ দিয়ে শুরু হতো ব’লে,
এবং সেভাবেই শুরু হওয়া সত্বেও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর লেখা নিয়েছিলেন, সেখানে জলধর সেন
এরকম লিখতেন, যেমন দেবপ্রয়াগ ভ্রমণের সময়,
“ছোট মেয়েটি আমার কাছে এসে দাঁড়ালো।
আমি তাদের বাড়ি কোথা, কে আছে, কয় ভাই, কয় বোন প্রভৃতি প্রশ্নে আলাপ আরম্ভ করলুম। প্রথমে তাদের কথা কইতে একটু বাধ
বাধ ঠেকলো, কিন্তু শীঘ্রই সে সঙ্কোচভাব দূর হয়ে গেল। অনেকক্ষণ কথাবার্তা হল। সব কথা মনে নেই, কিন্তু একটা
কথা আমাকে বড় বেজেছিল, তাই সেটা বেশ মনে আছে। আমি তাকে যখন বললুম যে, ‘আমার বাপ নেই,
স্ত্রী নেই, ছেলেও নেই’, তখন সে তার করুণ আয়ত চক্ষুদুটি আমার মুখের উপর রেখে কোমল স্বরে বলল ‘লেড়কি ভি নেহি?’
কথাটা আমার প্রাণে তীরের মত বিদ্ধ হল! আমার একটি ‘লেড়কি’ ছিল, জানিনে কোন অপরাধে তাকে তিন বৎসর হারিয়েছি। আজ এই বালিকার একটি কোমল
প্রশ্নে সেই সুপ্ত স্মৃতি জেগে উঠলো। আমার চোখে জল দেখে বালিকার মুখখানি কেমন শুকিয়ে
গেল। সে তার অপরিষ্কার ওড়না দিয়ে আমার চোখের জল মুছিয়ে, তার কোমল ছোট ছোট আঙুল দিয়ে
আমার হাতের আঙুল নাড়তে লাগল। আর তার সেই স্নেহস্পর্শে, তার সেই অকপট সহানুভূতিতে আমি
মুগ্ধ হয়ে গেলুম। বালিকা আমাকে আর কোন কথা বলতে পারলে না। ... সন্ধ্যা বেশ ঘন হয়ে এল।
মেয়ে দুটি আগে আগে পথ দেখিয়ে চলতে লাগলো, আর ঘন ঘন ‘হুঁশিয়ারি’, ‘খবরদারি’ বলতে লাগলো,
পাছে আমার পায়ে ঠোক্কর লেগে আমার পায়ে ব্যথা হয়। আমাকে তারা রাস্তায় তুলে দিয়ে বিদায়
নিলে। আমার বড় কষ্ট বোধ হল। হায়, আবার কখনো কি জীবনে তাদের সঙ্গে দেখা হবে?”
কী গদ্য! Max Weber-এর ভাষায় জলধর সেনের
প্রার্থিত ‘qualifikation von fachwissen’ (specialist qualifications) এবং বিশেষতঃ
প্রায়োগিক/প্রাযুক্তিক শিক্ষাযোগ্যতা হলো না সংস্কৃতে দুর্বলতার জন্য। কিন্তু তার বলেই
তিনি হয়ে উঠলেন ‘colonial bildung’-এর এক প্রধান পুরুষ।
এর পরে আচমকাই যখন উদ্যোক্তারা আমার
নাম ঘোষণা করেন এই মহাত্মার সম্পর্কে কিছু বলার জন্য, তখন আমি অনুভব এবং উপলব্ধি করি
যে, আমি এই স্বল্প সময়ে জলধর সেনের সম্পর্কে
কিছু বলতে গেলে তাঁর সাহিত্যকৃতি সম্পর্কেও বলতে হবে, কেবল ভ্রমণসাহিত্য নয়। উপরন্তু
— 'চাহার দরবেশ' (উর্দু উপন্যাস থেকে অনূদিত, ১৯০০); 'নৈবেদ্য' (গল্প, ১৯০০); 'ছোট
কাকী ও অন্যান্য গল্প' (১৯০৪); 'নূতন গিন্নী ও অন্যান্য গল্প' (১৯০৭); 'দুঃখিনী' (উপন্যাস,
১৯০৯); 'বিশুদাদা' (উপন্যাস, ১৯১১); 'আমার বর ও অন্যান্য গল্প' (১৯১৩); 'কাঙ্গাল হরিনাথ'
(জীবনী, ১৯১৩); 'করিম সেখ' (উপন্যাস, ১৯১৩); 'আলান কোয়াটারমেন' (অনূদিত উপন্যাস, ১৯১৪); 'পরাণ
মণ্ডল ও অন্যান্য গল্প' (১৯১৪); 'অভাগী' (উপন্যাস, ৩খণ্ডে, ১৯১৫, ১৯২২, ১৯৩২); 'আশীর্ব্বাদ'
(গল্প, ১৯১৬); 'বড়বাড়ী' (উপন্যাস, ১৯১৬); 'এক পেয়ালা চা' (গল্প, ১৯১৮); 'হরিশ ভাণ্ডারী'
(উপন্যাস, ১৯১৯); 'ঈশানী' (উপন্যাস, ১৯১৯); 'পাগল' (উপন্যাস, ১৯২০); 'কাঙ্গালের ঠাকুর'
(গল্প, ১৯২০); 'চোখের জল' (উপন্যাস, ১৯২০); 'ষোল-আনি' (উপন্যাস, ১৯২১); 'মায়ের নাম'
(গল্প, ১৯২১); 'সোনার বালা' (উপন্যাস, ১৯২২) ; 'দানপত্র' (উপন্যাস, ১৯২২); 'মুসাফির-মঞ্জিল'
(ভ্রমণ, ১৯২৪); 'পরশ পাথর' (উপন্যাস, ১৯২৪); 'ভবিতব্য' (উপন্যাস, ১৯২৫); 'তিন পুরুষ'
(উপন্যাস, ১৯২৭); 'বড় মানুষ' (গল্প, ১৯২৯); 'সেকালের কথা' (কথাচিত্র, ১৯৩০); 'উৎস'
(উপন্যাস, ১৯৩২) — ইত্যাদির সাহিত্যগুণের আলোচনা করতে হবে। সে ক্ষমতা আমার কই? উপস্থিত
সাহিত্যিকরা সব্বাই আমার চেয়ে বেশি জানেন।
সদাহাস্যময় পৌত্র নিজে ব’সে আছেন। জ্ঞানের দীনতা ধ’রে ফেলবেন, কেবল স্বভাবগুণে বলবেন না। এমনিতেই
যা লিখেছি তার সমাজ বৈজ্ঞানিক অংশটুকু বাদে সবই অন্যের কথা। তিনি নিজেই কবি, ছোটগল্পকার,
ঔপন্যাসিক এবং সম্পাদক। তাই তাঁকেই বরং খান দুই প্রশ্ন করতে পারি। এক, সম্পাদক জলধর
সেন ছাব্বিশ বছর ধ’রে পত্রিকা সম্পাদনা, জহুরীব্রত ইত্যাদি করার পর এত লিখলেন কী ক’রে?
মানে, ঘুমোতেন টুমোতেন তো? আর দুই, সম্পাদক জলধর সেনই কি সাহিত্যিক জলধর সেনকে খেয়ে
ফেলল? কিন্তু সে কথা যাক, বুঝতে পারি, শরৎচন্দ্র বাসভবনের এই বিদগ্ধ ‘কোণে / আমি অসহ্য
অতিরিক্ত, ধরবে না কোথাও’, একটু অল্পস্বল্প কথা ব’লে বাড়ির পথ ধরি।