প্রতিবেশী সাহিত্য
অশোক ভৌমিকের গল্প
(অনুবাদ : মিতা দাশ)
লেখক পরিচিতি : জন্ম ৩১শে জুলাই ১৯৫৩ নাগপুর, মহারাষ্ট্র। বামপন্থী রাজনীতি থেকে গণসংস্কৃতি
মঞ্চের সংস্থাপক সদস্যের একজন। প্রগতিশীল কবিতার
পোস্টার শেখানোর জন্য কার্যশিবির আয়োজন,
দেশ-বিদেশে চিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করেছেন। তাঁর
প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ -- মোনালিসা হঁস রহি হ্যায়,
শিপ্রা এক নদীকে নাম হ্যায় নাম, জীবনপুর হাট জাংশনন; উপন্যাস -- আইস-পাইস।
এছাড়া বাদল
সরকার : ব্যক্তি ওর রঙ্গমঞ্চ, সমকালীন ভারতীয়
চিত্রকলা : হুসেন কে বাহানে, অকাল কি কলা ওর
জাইনুল আবেদিন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
চৌকিদার
|
কিছু-কিছু
মানুষ এমনও হয় যারা অনেক রাত অবধি জেগে থাকতে পারে। খুব কম সময়ে চাঁদগড়ে আমার নাম এমন
লোকেদের ভেতর হয়ে গেল। আমি নাকি নিশাচর! আসলে চাঁদগড়ে আমার কাজ সব দিনেই এক রকম শেষ
হয়ে যেত, ঠিক একটু আধটু
আরামের টহল পর্বের মত । এই রকম আমার সময়টা আমার মত অন্য মেডিকাল রিপ্রেসেন্টেটিভদের সঙ্গেই কাটত, কিন্তু কেন জানি না রাত
বাড়লেই একটি অন্যরকম অনুভব আমায় ঘিরে ধরত। দু’বেলা দুটি ভাতের দায় ছাড়া আমি এখানে
আর কিছুই করতে পারবো না এমন মনে ভাব হতে লাগলো। চাকরি করাটা আমার দরকারের ভেতর পড়ে,
তাই কাজ শেষ করার পর অনেক রাত অবধি জেগে
ছবি আঁকতাম বা একটা দুটো ভালো বই পড়তাম। তাই চাঁদগড়ে বন্ধুরা আমায় নিশাচর বলেই
ডাকতো!
চাঁদগড় জেলা মুখ্যালয়
হওয়াতে কোর্টের কাজ, ব্যাঙ্কের কাজ সব সরকারি কাজের
জন্য এখানে আস্তেই হয়। তারপর সরকারি অফিস বন্ধ হবার পর সবাই যে-যার বাড়ি ফিরে যায়। সিভিল লাইন্সে
কাছারির আশেপাশের চায়ের দোকান ও খাবারের দোকানে সারাদিন ধরে আসা যাওয়া লেগেই থাকত,
কিন্তু দুপুর শেষ হতেই ওই জায়গাগুলিকে একটি নিস্তব্ধতা ঘিরে নিত। হোটেলগুলির
উনুনের আগুন ছাইয়ে চাপা পড়ে যায় আর হোটেলের মেঝে, থালাবাসন মাজা ঘষার কাজ আরম্ভ
হয়ে যেত। তারপর যদি চা খাওয়ার ইচ্ছে করে তাহলে খুঁজতে হয় কোন হোটেলের উনুনে এখনো
আঁচ রয়েছে বা কার কাছে এখনো দুধ বাকি।
চাঁদগড়ে
বিকেলের পর রাত নামার অন্তরালটা খুব একটা বেশি থাকত না। ছবি আঁকতে
আঁকতে বা পড়তে পড়তে কখনো কখনো বেশ রাত হয়ে যেত। রাত আড়াইটা বা কখনো
রাত তিনটা বেজেই যেত ঘুমোতে। এই এলাকায় হরিরাম চৌকিদারের প্রথম পাহারা শুরু হত ঠিক
রাত দশটায়। হরিরামকে সবাই ‘পহলবান’ বলে ডাকত। ওর একটা পায়ে বোধহয় কখনো কোন চোট লেগেছিলো, তাই একটু লেঙিয়ে
লেঙিয়ে হাঁটতো। আমার কলোনির লোকেরা রাতে ওকে পাহারা দিতে খুব কম দেখেছে। ওরা শুধু ওকে
মাসে একবার রেজিস্টার হাতে চৌকিদারীর টাকা নিতে আস্তে দেখেছে। কিন্তু আমি প্রায় ওর
সঙ্গে রোজ দেখা করতাম। আমার কামরায় আলো দেখে ওর সিটি বাজাবার ও হাঁক দেওয়ার দরকার
পড়ত না, কিন্তু আমি ওর হাঁক দূর হতে পাশে তারপর আবার দূরে চলে যাওয়াটা বেশ মনে হত।
‘জাগতে রহো! হোশিয়ার! জাগাতে ...রহো!’ হাঁক লাগিয়ে সে আবার একটা হুইসিল দিয়ে নিজের হাতে একটি সাত ফুট
লম্বা লাঠি দিয়ে থেকে থেকেই মাটিতে প্রহার করতে থাকে। বৃষ্টি
হোক, গরমের দিন হোক বা হোলি, দীপাবলী, দশহরা হোক, সে নিত্য এই রকম একই ভাবে নিজের
ডিউটি করে যেত। সে কোন জায়গা থেকে পাহারা দেয়া শুরু করতো ও কোথায় শেষ করতো এ কথা
কেউ জানতো না, কিন্তু মুন্নালাল কলোনী হয়ে স্টেট ব্যাঙ্ক, কোর্ট এবং অফিসার্স
কলোনী, তারপর ফেরত আমাদের কলোনী দিয়ে হাঁক দিয়ে যেত। গোটা রাতে বোধহয় সে কমপক্ষে
তিন চক্কর তো মেরেই নিত।
রাতে কখন যদি
ওর সঙ্গে দেখা হত তো সে আমায় ‘সেলাম সাহেব’ বলে এগিয়ে যেত আর এর চেয়ে বেশি কোনো
কথাই সে বলত না। আমার সেই সময় একটি বদ অভ্যেস ছিল, তাও আবার রাতে, যখন রাতে
বন্ধুরা যে যার ঘরে চলে যেত তখন আমায় সিগারেটটাই আমার বন্ধু হয়ে উঠত। একদিন রাতে
আমার সিগারেট ফুরিয়ে যাওয়াতে আমি বেশ অসহায় হয়ে পড়লাম। সব দোকান বন্ধ হয়ে গেছে, রাতও বেশ গড়িয়েছে, মনে হয় রাত বারোটা।
আমি কিছু বুঝে উঠতে পারছিলাম না। বেশ অসহায় বোধ করছিলাম, রাতের আমার এই বন্ধুটি যে
আমার পাসে আজ নেই! যারা কখন সিগারেট খায় না মানে সিগারেটের সঙ্গে বন্ধুত্ব ঘটায়নি
তারা এই রকমের অসহায়তাকে ঠিক বুঝে উঠতেই পারবেনা। এর পরেও যারা সিগারেটকে ঘৃণা করে
ওরা এই বন্ধুত্তকে ‘নেশা’ বলতেও ছাড়েনা। কিন্তু আমি আজ এই সব নিয়ে কোন তর্ক
বিতর্কে যাবো না। তক্ষুনি আমি এই দিকে হরিরামকে আসতে দেখলাম।
‘হরিরাম তুমি
আমার একটা কাজ করে দেবে?’
‘হুকুম করেন
সাহেব!’
‘আমার সিগারেট
ফুরিয়ে গেছে, তুমি আমার জন্য বাসস্ট্যান্ড থেকে সিগারেট এনে দিতে পারবে?’
‘কেন আনতে
পারবোনা, চায়ের দোকানের পাশেই আমার সাইকেল দাঁড়ানো থাকে, আমি এক্ষুনি বাসস্ট্যান্ড
থেকে নিয়ে আসছি’। দশ-পনেরো মিনিটেই হরিরাম সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে হাজির, আর এই
ভাবেই হরিরামের সঙ্গে আমার প্রথম কথাবার্তা শুরু।
তারপর কখনো
যদি সিগারেটের দরকার হত হরিরাম আমার জন্য বাসস্ট্যান্ড থেকে বা মোড় থেকে এনে দিত।
একবার আমি
বাসে চেপে লখনৌ থেকে ফিরছি, বৃষ্টির দিনে, বেশ কয়েক জায়গায় বন্যার জন্য রাস্তাঘাট
বন্ধ। বাস ড্রাইভার জানি না কোন কোন রাস্তা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আমাদের চাঁদগড়ে বিকেল চারটার
জায়গায় রাত দুটোয় পৌঁছে দেয়। কলোনীতে রিকশায় চেপে পৌঁছলাম, সামনে দেখি হরিরাম।
‘সালাম
সাহেব!’
আমি এমনি কথার
ছলে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কটা বাজলো রে হরিরাম?’
‘এক্ষুনি বলছি
সাহেব!’ বলেই সে নিজের সাতফুট লম্বা লাঠিটার একদিক মাটিতে ঠেকিয়ে নিজের শরীর থেকে
দুই হাত দূরে সোজা হিয়ে দাঁড়ালো। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে এমন ভাব করলো যেন সে
আকাশকে মাপছে।
‘সাহেব, দুটো
বেজে চল্লিশ মিনিট হয়েছে’।
আমি তার জবাব
শুনে এক্কেবারে আশ্চর্য বোধ করলাম। নিজের হাত ঘড়িতে নজর রাখলাম, দেখলাম ঠিক পৌনে
তিনটা বাজে।
‘হরিরাম তুমি
ঘড়ি না দেখেই এতো সঠিক সময় কী করে বললে?’
‘সাহেব
ফ্রন্টে যখন ঘড়ি থাকতো না তখন আমি এই ভাবেই সময় দেখতে শিখেছিলাম। তারপর আমায় আর ঘড়ির দরকার হয় না’।
সেই রাতে আমি
নিজের বাংলোর সিঁড়িতে বসে প্রথমবার হরিরামের গল্প শুনলাম -- আমি চাঁদগড়ের পূর্বের
একটা গাঁ, যার নাম সোজপুর, তারি বাসিন্দা। একদিন বাড়ি থেকে পালিয়ে ফৌজে ভর্তি হতে বেনারস ছাউনী
পৌঁছে গেলাম। কুড়ি বছরের চেয়েও কম বয়স ছিল আমার, ইংরেজ বাহাদুরের কাছে চাকরি পেয়ে
গেলাম। তখন আমার পোস্টিং ছিল সিঙ্গাপুরে, তখন জাপানিরা সিঙ্গাপুরকে নিজের কব্জায়
করে ফেলেছিল। আমাদের সেনা বাহিনীদের কোনো পাত্তাই পাওয়া যাচ্ছিলনা। আমি কিছুদিন
এদিক ওদিক বেয়ারার মত ঘুরে বেড়ালাম তারপর ১৯৪৩র জুলাই মাস ছিল, নেতাজী সিঙ্গাপুরে
পৌঁছলেন। উনি স্লোগান দিলেন, ‘তুম মুঝে খুন দো, মাই তুমহে আজাদী দুঙ্গা’। সত্যি
বলছি সাহেব, গোলামী যে কী সেটা প্রথমবার আমি অনুভব করলাম। নেতাজীকে স্বাগত জানানোর
জন্য ক্যাপটেন রাম সিং ঠকুরীর ব্যান্ডগান করল, ‘সুভাষজী , সুভাষজী, ওহে জানে হিন্দ
আ গয়ে / নাজ হ্যায় জিস পে হিন্দ কো ওহ শান-এ- হিন্দ আ গয়ে’।
‘সাহেব আপনি
শুনেছেন এই গান?’
রাত শেষ হয় হয়,
পুবের আকাশে হালকা আলো দেখা যাচ্ছিলো। চাঁদগড়ের মুন্নালাল কলোনির একটাও বাসিন্দা
এখনো জাগেনি বোধহয়! হরিরাম চাপা গলায় সম্পূর্ণ আবেগের সঙ্গে আমায় সেই গানটা শোনার।
ষাট বছরেও হরিরামের গলায় একটা বেশ চমক ছিল, আর ওর সুর-তালও সঠিক ছিল। এই ঘটিনার পর
আমার সাহসে আর কুলালো না, আমি হরিরামকে দিয়ে আর কখনো সিগারেট আনতে বলি!
‘সাহেব, আমি
কাপ্তান রাম সিং ঠকুরীকে বেশ শ্রদ্ধা করতাম। যখন আমি সময় পেতাম কাপ্তানের কাছে
গিয়ে বসতাম। কত রকমের
বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন উনি! সাহেব আপনি বংশীধর শুক্লা জী'র নাম শুনেছেন? উনি আজাদ
হিন্দ ফৌজের মার্চ-এর গান লিখেছিলেন – ‘কদম-কদম বাড়ায়ে জা, খুশী কে গীত গায়ে জা।
য়ে জিন্দেগী হায় কৌম কি তু কৌম পে
মিটায়ে জা’। খানিকক্ষণ চুপ হয়ে জানিনা কী ভাবছিল হরিরাম, তারপর যেন সে নিজেকেই
বোঝাচ্ছে এমন মনে হল! তারপর সে বলে উঠল, ‘মানুষ বলবান হয় না, সময় বলবান হয়’। আমি তেপ্পান্ন সালে জন্মেছিলাম, মানে
স্বাধীনতার ছয় বছর পর। পড়াশশোনা করলাম, বড়
হলাম এই আজাদ ভারতে। কিন্তু এই বড় হওয়ার মাঝে সেই সব কথা আমার শোনা, সেই কথাই তো
হরিরামের মুখে আমি শুনছিলাম। আমি ওর সঙ্গে অনেক কথা বলতে ও শুনতে চাইছিলাম। ডিউটির
ফাঁকে ফাঁকে সে সময় বের করে আমার বাংলোয় চলে আসতো। তারপর সে ক্রমশঃ নিজের জীবনের,
নিজের সময়, আজাদ হিন্দ ফৌজের আর সৈনিকদের গল্প করতো। আমি মাঝে মাঝেই ওর কথা বৃত্তান্তগুলি ডায়রিতে লিখে
রাখতাম। তারপর আমি ওর জ্ঞানের কথায় আর আশ্চর্য বোধ করা ছেড়ে দিলাম। কারণ ওর কাছে
এতো সম্পদ ছিল, এত গল্প ছিল, সে সব আমার অজানাই ছিল। ওর সেই সব ঘটনা ও গল্পগুলির
তারিখ ও দিন সব মুখস্থ।
হরিরাম
চৌকিদার আমার আর অনেকের চেয়ে শিক্ষায় কোনো অংশে কম নয়!
‘ভাই সাহেব
নেতাজি, বন্দে মাতরম বেশ ভালো বাসতেন। কিন্তু উনি আজাদ হিন্দ ফৌজের কৌমি গানের
জন্য রবীন্দ্রনাথের গান জনগণমন অধিনায়ক জয় হে’ সিলেক্ট করলেন। কিন্তু এই গান নিয়ে
বেশ মুস্কিলেই পড়লেন কারণ এই গানটা হিন্দি ভাষায় লেখা হয়নি। তখন আমাদের কাপ্তান
আবিদ আলীকে বললেন, আপনি গুরুদেবের গানটাকে অবলম্বন করে একটি নতুন গান যেন রচনা করে
দে্ন। আপনি আবিদ আলীর নাম তো নিশ্চই শুনেছে? বেশ শিক্ষিত ও সহজ সরল মানুষ ছিলেন
উনি। তারপর উনি জনগনণমন -কে নিজের মত করে অনুবাদ করে আবার সুরও দিলেন। গানটি ছিল,
‘শুভ সুখ চইন কি বরখা বরসে, ভারত ভাগ হে জাগা’। আহা কী সুন্দর গান! গানটি ছিল, ‘সবার
মনে প্রেম ঢালে, তোমার মিষ্টি বাণী, প্রত্যেক জায়গার মানুষ, প্রত্যেক ধর্মের
প্রাণী, সব ভেদাভেদ মিটিয়ে, সবার কোলে এসে আমি, গাঁথব প্রেমের মালা’।
আবিদ আলীর নাম
আমি কখনো শুনিনি, আমায় কেউ কখনো বলেনি। আমি জানতাম না যে কোনটা আজাদ হিন্দ ফৌজের
কৌমি গান! হরিরাম চৌকিদার আমায় বলল,
‘জানেন ভাই সাহেব! জয় হিন্দ-এর স্লোগান সেই মেজর আবিদ আলীর দেয়া। আমি যখন থার্ড
গরিল্লা রেজিমেন্টে ছিলাম, তখন আমার সঙ্গে ছিলেন কর্নেল গুলজারা সিং। আমারদের
গ্রেপ্তার করে হিন্দুস্তান আনা হয়েছিল। আমায় বাহাদুরগড় ক্যাম্পে রাখা হয়েছিল।
তারপর মোকদ্দমা চলল আর ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হল, যার জন্য আমরা সবাই মিলে
লড়েছিলাম। আমারা জেল থেকে ছাড়া পেলাম। আমরা জানতাম যে, এতো বড় দেশে নিশ্চয়ই আমরা
ফৌজে একটা ভালো চাকরি পেয়ে যাব। কিন্তু ইংরেজরা নেহরুজীকে হিন্দুস্তান হাতে দেয়ার
সময় আদেশ দিয়েছিলো, আজাদ হিন্দ ফৌজের কাউকেই কোনো চাকরি দেবেন না! নেহরুজী তাই করলেন।
আমরা সবাই নিজের দেশেই চৌকিদার ও চাপরাসির চাকরির জন্য এখানে সেখা্নে পাগলের মত
ঘুরে বেড়ালাম। ভাই সাহেব, আপনি জানেন মানুষ বলবান হয়না, সময় বলবান হয়!
চাঁদগড় ছেড়েছি
অনেক দশক আগে। কতশত কথা মনে ছিল, কিন্তু কিছু কিছু কথা ভুলেও গেছি। কিন্তু হরিরাম
চৌকিদারকে আমি কখনো ভুলতে পারবোনা। ওর এক একটা কথা আমার স্মৃতির ডায়রিতে হলুদ হয়ে
আসা পাতায় গাঁথা আছে। স্মৃতির সেই ডায়রিতে এও লেখা আছে, একদিন হরিরামকে এই
চৌকিদারের চাকরি ছাড়তে হল। রাতে পাহারা দেওয়ার সময় সে পা’য়ে সাধারণ চোট পায়।
কিন্তু সেই চোট ধীরে ধীরে গ্যাংগ্রিনে পরিবর্তিত হয়ে যায়। জেলা হসপিটালে ডাক্তারের
ওর হাঁটুর নিচের পা কাটা ছাড়া ওদের আর কোনো উপায় ছিলোনা। কিন্তু আমি এই সব ঘটনা
জানতাম না। অনেক মাস পরে একদিন রাতে হরিরাম
আমার সঙ্গে দেখা করতে এলো। ক্র্যাচের সাহায্য নিয়ে দাঁড়াল আমার সামনে। তখন সে বেশ
দুর্বল, মনে হচ্ছিল। আমি কিন্তু ওর পায়ের কথা জিজ্ঞাসা করলাম না। শুধু এদিক ওদিকের
কথা বললাম। ও নিজেই বলল যে, ওর চাকরিটা
এখন আর নেই। তাই এখন সে চাঁদগড় ছেড়ে নিজের গ্রাম সোজপুর থাকে। আমার কাছে বিদায়
নেবার আগে আবার সেই এক কথা বলল, ‘ভাই সাহেব, মানুষ বলবান হয়না, সময় বলবান হয়’। তারপর
ওর সঙ্গে আমার আর দেখা হয়নি।
**
সোজপুর
গ্রামটা ছিল চাঁদগড় জেলায়, কিন্তু আমি সেখানে আগে কখনো যাইনি। ডাক্তার রায়ের ভাইয়ের বরযাত্রী হিসেবে হঠাৎ আমার
সোজপুর যাওয়ার সুযোগ হল। আমি ভাবলাম, বেশ বিয়েতেও সামিল হতে পারবো, আবার হরিরামের
সঙ্গে দেখাও করে নেব। এক বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেছে, হরিরামের সঙ্গে আমার দেখা হয়নি।
বরযাত্রী যখন
সোজপুর পৌঁছাল তখন সন্ধ্যে নেমে এসেছে, কিন্তু বিয়ের লগ্ন অনেক রাতে। আমি বরযাত্রীদের
যেখানে দাঁড় করানো হয়েছিল, তার পাশেই একটা চায়ের দোকান ছিল। আমি দোকানে গিয়ে
হরিরামের ঠিকানা জানতে চাইলাম। চা-ওয়ালা হরিরাম কে চেনেনা। কিন্তু যখন আমি ওর
পায়ের অবস্থার কথা বললাম, সে চিনতে পারল। ‘আরে সেই লেঙ্গা চাপরাসি! ব্লকের স্কুলে
চাপরাসি ছিল সে, কিন্তু গতমাসে ডেঙ্গু হয়ে মারা গেছে। কিন্তু সাহেব আপনি ওকে কী
করে চেনেন? ওকে তো এই
গ্রামে কেউ চেনেনা। বেশ ভালো মানুষ ছিল সে। স্কুলের ঘন্টা বাজাত, আবার স্কুলের
বাচ্চাদের গানও শেখাতো’।
আমি কাউকে
কিছুই না বলে বাসস্ট্যান্ডে এসে সোজপুর থেকে চাঁদগড় যাবার বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে
রইলাম। সোজপুর ব্লকের স্কুলের বাচ্চাদের হরিরাম ‘শুভ চেইন বরখা বরসে’ গানটা
নিশ্চয়ই শিখিয়েছে। কাপ্তান রাম সিং ঠকুরী ও মেজর আবিদ আলী জাফরানীর গল্প নিশ্চয়ই
শুনিয়েছে! আমি এইসব কল্পনা করতে করতে আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকালাম। শহরের চেয়ে গ্রামের আকাশে বেশি তারা।
বেশি চমকায়। গোটা আকাশটা তারায় ভরা। সেই তারাদের দেখেই তো হরিরাম সময় বলত! আর সে
বলত, ‘সাহেব মানুষ বলবান হয় না, সময় বলবান হয়’।
ভালো গল্প । গায়ে কাঁটা দেয় । অনুবাদও বেশ সুন্দর ।
উত্তরমুছুনঅনেক - অনেক ধন্যবাদ
মুছুনআপনাকে অনেক - অনেক ধন্যবাদ জানাই
উত্তরমুছুন