কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

ঊষাকিরণ খাঁ




 প্রতিবেশী সাহিত্য



ঊষাকিরণ খাঁ’র গল্প           

(অনুবাদ : মিতা দাশ) 




লেখক পরিচিতি :  জন্ম - লাহেরিয়া সরায়, দারভাঙ্গা, বিহার।  শিক্ষা - এম এ,  পি এচ ডি। তিনি হিন্দি এবং মৈথিলী দুই ভাষাতেই সাহিত্য রচনা করেছেন। তাঁর রচিত হিন্দি রচনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘বিবশ বিক্রমাদিত্য’, ‘দুব ধান’,  ‘কাশবন, ‘গিলি পাঁক’, ‘জন্ম অবধি’, ‘ঘর সে ঘর তক’, ‘সীমান্ত কথা’, ‘সিরজন্হার’ এবং মৈথিলী ভাষায় রচিত রচনাগুলি ‘ভামতি, ‘হাসিনা মঞ্জিল’, পোখরি রাজখোরি’ ইত্যাদি। সাহিত্যসৃষ্টির জন্য তিনি বিভিন্ন পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। বিহার রাষ্ট্রভাষা পরিষদ থেকে হিন্দি সেবী সন্মান, বিহার রাজভাষা      বিভাগ থেকে মহাদেবী ভার্মা সম্মান, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার, কুসুমাঞ্জলি পুরস্কার, বিদ্যানিবাস মিশ্র পুরস্কার এবং পদ্মশ্রী পুরস্কার। 


বাড়ি থেকে বাড়ি অব্দি


সেই ভোরটি বেশ সামান্য কিন্ত সুন্দর ছিল। আশা'র ট্রেন গয়া রেলওয়ে স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছিল। নিজের মনের উৎসাহেই আশা বিভোর। দিল্লির টিকিট কাউন্টারের ধাক্কার ঠেলায় সে নিজের আশেপাশে দাঁড়ানো লোকেদের জিজ্ঞাসা করতে ভোলেনিকোন গাড়িতে চাপলে সে গয়া ভালোভাবে পৌঁছতে পারবে ও কোন ক্লাসের টিকিট কাটলে ওর সুবিধে  হবে।

আপনি যদি জানলা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে যেতে চান তাহলে সেকেন্ড ক্লাসের  স্লীপারের টিকিট কিনুন। আর যদি সুবিধে অনুযায়ী যেতে চান তাহলে এ সি টিকিট কিনুন। কিন্ত সেই বগিগুলির জানলা বন্ধ থাকে”। ... একটি কিশোর ছাত্র ওর কথার জবাবে বলল। আশা ওর কথা মেনে নিয়ে মহিলাদের লাইনে দাঁড়িয়ে দুজনের টিকিট কেটে নিল। এবার ট্রেনে সেই কিশোর ছেলেটাও ওর সঙ্গে ছিল।

আপনি কতদিন পরে ভারতে এসেছেন?
একশো পঁচিশ বছর পরে।
কী? সে শুনে চমকে উঠল।
হ্যাঁ, আমার ঠাকুরদা ও ঠাকুরমা একশো পঁচিশ বছর আগে ভারত থেকে গুয়ানা দিনমজুর হয়ে চলে গিয়েছিল। আর আমি আজ ভারতে ফিরেছি, নিজের মাটিতে পা রেখেছি
আচ্ছা এখন আমি বুঝেছি, তাই আপনি ভালোই হিন্দি ভাষায় কথা বলতে পারছেন।
আমি বি এ অনার্স করেছি হিন্দি ভাষায় বাড়িতে আমরা সবাই সব ভাষায় কথা বলি।
আপনি এখানে কেন এসেছেন? টুরিষ্ট হয়ে?
না, আমি এখানে একটা কোর্স করতে এসেছি। আর সত্যি কথা বলতে, আমি আমার পূর্বপুরুষদের বাড়িঘর দেখতেই এসেছি।
ভারত আপনার কেমন লাগছে?
ভালো, খুবই ভালো।
আচ্ছা! কিশোরটি আশ্চর্যের চোখে তাকিয়ে রইল।
এখানে আমি ঠিক মিশে গেছি , কেন জানো, আমার চেহারা এদের চেয়ে একটুও আলাদা নয়। আমি এখানকার ভীড়ে ঠিক ওদেরই মত, এমন মনে হওয়াটা কতই না সুখের সেই সব তুমি বুঝবে না আমি তোমায় তুমি বলতে পারি তো, কারণ তুমি আমার চেয়ে বেশ ছোট।
হ্যাঁ, আমি আপনাকে এই কথাই বলতে যাচ্ছিলাম, আমি দিদি বলে ডাকতে চাই। আপনার নাম কী?
আমার নাম আশা রামরূপ তোমার নাম? তুমিও নিজের সম্পর্কে কিছু বল।
আমার নাম সুধীরকুমার আমি দিল্লিতে পড়াশোনা করি। নিজের গ্রাম থেকে গয়া, গয়া থেকে দিল্লি , এই আমার যাত্রার বিবরণ।
তোমার মা বাবা গ্রামে থাকেন?
হ্যাঁ,  গ্রামে থাকেন, একটু আধটু জমি রয়েছে , সেখানেই চাষবাস করেন। আপনি কি গয়া দেখেই ফিরে যাবেন?
আমি বোধগয়া ও গয়ার মাঝে নিজের গ্রামটি খুঁজবো।
আপনার গ্রামের নাম কি?
কুঢ়নী'র মুসহরি, মনে হয় তখন  মুসহরি গ্রামের সঙ্গে থেকেও গ্রামের সঙ্গে যুক্ত ছিলো না তখন লোকেরা বেশ অস্পৃশ্যতা পালন করত। একজন অপরের ছায়া ও মাড়াত না। ঠাকুরদাদা বলতেন, ওরা নির্ধন দিনমজুর ছিলেন তার উপর  অস্পৃশ্য।
ওহঃ ! সুধীর এক নজরে আশাকে দেখল।
তুমি আমায় আমার গ্রাম খুঁজতে সাহায্য করবে?
কেন করব না, নিশ্চয়ই করব। কুঢ়নি ফল্গু নদীর নিকটবর্তী গ্রাম আজকাল কিন্ত ওখানকার মুশহরীতে বেশ গোলমাল। বিশেষ করে সেখানকার মহিলারা কোন এন জি ও’র সঙ্গে বালির উপর বৃক্ষ রোপন করছে আর গোটা জায়গাটা বেশ সবুজ হয়ে উঠেছে।

সুধীর এইসব কথা বলে নিজের মনে মনেই বেশ খুশি হচ্ছিলো যে, আশাদিদি যখন নিজের গ্রামে যাবে তখন সেই সবুজ গ্রাম দেখে বেশ খুশিই হবে। গ্রামের ঘরবাড়ি খড়ের কিন্ত এখন সেখানের মহিলারা ছেঁড়া কাপড় গায়ে দেয় না,  পুরুষেরাও এখন আর কৌপিন পরে থাকে না, ওরা এখন শার্ট-প্যান্ট পরে, আর যখন লাঙ্গল বা কোদাল দিয়ে ক্ষেতে নাম তখন হাফপ্যান্ট পরে। মাথায় লাল  গামছা বাঁধে। মহিলারাও রোলগোল্ডের কানে ঝুমকো ও গলায় মুঙ্গা ও মনকার মালা পরে। ওরা এখন আধুনিক হয়ে উঠেছে। কিন্ত কিছু কিছু পুরনো অভ্যেস এখনো যায়নি, যা রোজগার করে, সব খরচ করে ফেলে। রোজ মাছ , সবজি ও ভাত খায়, কিন্তু টাকাপয়সা সঞ্চয় করতে পারে না। টাকাপয়সা সঞ্চয় করা ওদের ধাতেই নেই। বোধহয় আনদিদি এই কথা জেনে বেশ খুশি হবে যে, একজন মুসহারী মহিলা ভগবতিয়া এখন এম  পি  হয়েছে, এখন তাকে সবাই ভগবতী দেবী বলে ডাকে। কিন্ত সিকির ও-পিঠের মতো এখনো অনেক  মুসহারীরা এখনো নিজের বউ-বাচ্চা, জোয়ান-বুড়ো মহিলা ও পুরুষেরা এল্যুমিনিয়ামের থালা-বাটি নিয়ে শুয়োরের মাংসের জন্য ঝগড়ায় মেতে থাকে। দিন মজুরি করেও দু’বেলার খাবার জোটে না, তাই আজকাল লোকেরা শহরে পাড়ি দিয়ে সেখানে স্লাম-এ বসবাস করার জন্য। যে সব গ্রামে স্বয়সেবী সহায়তা কেন্দ্রগুলির পদার্পণ হয়েছে, সেই গ্রামগুলির অবস্থা কিছুটা বদল হয়েছে।

“তোমার গ্রাম কোন দিকে?”
“কুঢ়নি গ্রামের কাছেই। আমার গ্রাম হয়েই আপনি নিজের গ্রামে পৌঁছবেন। আপনি নিজের থাকার জন্য কোনো ব্যবস্থা করেছেন?
“লোকেরা বলেছিল যে বোধগয়ায় অনেকগুলি হোটেল ও গেস্টহাউস আছে। সেইগুলির মধ্যে কোনো এক জায়গায় থাকব। এটা এমন কোনো কঠিন কাজ তো নয়”।
“না না, এখন অফ সিজন। আমিও আপনার থাকার জন্য সাহায্য নিশ্চই করব।  আমার গ্রাম বোধগয়ার এক্কেবারে লাগানো গ্রাম।”
“ধন্যবাদ, শুক্রিয়া, থ্যাঙ্কস!”
“আরে আরে দিদি, একটু বেশি হয়ে গেল না?” সুধীর এই বলে হেসে ফেলল।
“আমাদের এখানে বেশ ধান হয়?”
“ধান? হ্যাঁ, ধান হয় কিন্ত বেশি হয় না”।
“আর কী কী হয়? ঠাকুরদা ও ঠাকুরমা বলতেন, যখন খরা হত তখন ওরা  জঙ্গলের পাতা খেয়ে থাকতেন, এখন তো আর সেইরকম অবস্থা নেই? এখন তো হরিত ক্রান্তির জমানা”।
“গম, মক্কা, অড়হর আর মহুয়ার চাষ হয় ক্যানালের ধারে। বালিতেও অনেক রকমের সবজি, মৌসুমের ফল অনেক হয়। কিন্ত এইসব চাষ যাদের জমি–জমা আছে তাদের জন্য লাভের, কিন্ত যারা দিনমজুর ওরা আজও দিনমজুর। ওরা আজও অন্যের জমিতে চাষ করে, ঠেলা চালায়, ফল–সবজি বিক্রি করে। টাকা পয়সা তেমন মিলত না তাই ওরা ঝগড়া করা শিখে নিয়েছে।”
“সেই ভালো হয়েছে। মুখে শব্দ গজিয়েছে। না হলে তো ওরা কখনোই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সুর তুলতেই জানতো না।”
“শুধু সুর তুললেই তো হয় না দিদি, এখনো কোন পথে যাবে, তাও তো বোঝে না!”
“দেশ স্বাধীন হয়েছে, প্রজাতন্ত্র হয়েছে, এটাই কি কম?”
“অন্তত আমরা বিশ্বাস করি না। এতো কম পয়সা, কম খাবার ও অল্প–সল্পের ভেতর বেঁচে থাকার সিদ্ধান্ত পালন করা আমার ভালো লাগে না। আমাদেরও সেইসব কিছু চাই যা যা আমাদের পূর্ব পুরুষদেরকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল।”
“ সেসব কি?”
“আমাদের গরুও চাই, গরুর দুধও চাই। মরাগরু ও মরা গরুর ছাল চাই না আমরা। গরু আমাদেরও মা, কিন্তু বোবা মা। আমাদের আরও দুধ চাই... হ্যাঁ দুধ”।
“কে মানা করেছে তোমায়? তুমি কি গরুর দুধ খেতে পারবে না? কোনো আইন আছে নাকি?”
“আমরা গরিব তাই!” সুধীর এখনো উত্তেজিত হয়ে রয়েছে।
“তুমি স্কুল পাস করেছ, কলেজে তো পড়াশোনাও কর, তাহলে কি এখনো গরুর ছাল তোলো?”
“না, এখন আমরা ছাল তুলি না, আর কারুর সাহসও হয় না আমাদের সেই কাজ করার জন্য বাধ্য করতে”।
“এটাই পরিবর্তন নয় কি? এখন আর তোমাকে কেউ বাধ্য করে না।”
“কিন্তু কত জায়গায় আবার বাধ্যও করা হয়। অনেক জায়গায় আবার দিনমজুরি করার জন্য ক্ষেতেদও ডেকে নিয়ে যায়, কিন্তু ওদের নিজেদের শর্তেই। তখন ঝগড়া হয়, মারকাট বেধে যায়।”
“তোমার এইসব ভালো লাগে?”
“না একটুও না, আমরা পরিবার সুন্দর ও নিজেরা সর্বোদয় আশ্রমে কাজ করে, আমাদের ব্যাপার একটু আলাদা। তাই তো আমরা ওদের চেয়ে একটু আলাদা ধরনের। কিন্তু এখনো অকাল পড়লে আমাদের পাতা সেদ্ধ করে খেতে হয়।”
“তাই নাকি?”
“হ্যাঁ সত্যি। সরকারী ব্যবস্থা এক্কেবারে নাজেহাল। সরকারী সহায়তা হামেশাই  দেরী হয় আর এদিকে ক্ষুধার্ত মানুষদের প্রাণ যায়–যায়।” এইসব কথা শুনে আশা চিন্তায় ডুবে গেল। দুজনেই চুপচাপ, যতক্ষণ না ট্রেনের খাবার এসে পৌছলো। রেলওয়ে ক্যান্টীনের নিরামিষ  খাবার। ওরা সেই খাবারটা চুপচাপ সেরে নিল।
“খাবারটা আপনার ভালো লেগেছে?”
“খুব ভালো খাবার ছিল, আমরা এই খাবারই খাই ওখানেও। ডাল, ভাত, রুটি ও সব্জি। আমরা সেখানেও একটি গয়া তৈরী করে নিয়েছি।”
“দিদি এখন আপনি ঘুমিয়ে পড়ুন, কাল সকালে ভোর চারটায় জাগতে হবে কিন্তু। তাহলেই জানলা দিয়ে বাইরে মাঠ ক্ষেত দেখতে পাবেন। এখন ক্ষেতে হলদে হলদে সর্ষেফুল, গম, আম ও লিচুর গাছও দেখা যাবে। আম ও লিচুর গাছে এখন মুকুল দেখতে পাবেন। ঠিক ভোর চারটায় আমরা বিহারের বর্ডারে পৌঁছে যাবো।”
“ঠিক আছে আমার গাইডমাস্টার, তাহলে আমি এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়ছি”।

দুজনেই নিজের নিজের চাদর খুলে নিয়ে শুয়ে পড়ল।  বেশ রাতেই ঘুম এলো,   কিন্তু ভোরের আগেই তার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বোধহয় ঠান্ডার জন্য বা ওখানকার ও এখানকার সময় পরিবর্তনের জন্য হতে পারে। সে গোটা চাদরটা মুড়ি দিয়ে বসে বসেই ঠান্ডার আমেজ নিয়ে জানলার বাইরের দৃশ্য চোখ মেলে দেখতে থাকল ও মনের আঙ্গিনায় ধরে রাখল। আস্তে ধীরে ধুসর রাতের আমেজ কাটতে কাটতে হালকা হয়ে উঠল। ভোরটা বেশ। গাড়ি স্টেশনে এসে পৌঁছলো। ওরা নিজেদের ব্যাগ নিয়ে প্ল্যাটফর্মে নেমে পড়ল। আশাকে এখন একদম বিহারী মেয়ের মতই মনে হচ্ছিল। সুতির ছিট দেয়া সালোয়ার–কামিজ আর ওড়না, কাঁধ অব্দি ছাঁট দেয়া চুল , নাকের সিধে একটি ছোট্ট মেরুন রঙের টিপ, সোজা হাতে কাচের মোটা চুড়ি ও অন্যহাতে ঘড়ি। এক্কেবারে বিহারী সাজ। চারিদিক থেকে কুলিরা ছুটে এলো, কিন্তু ওদের কাছে বিশেষ কিছুই ছিল না, তাই ওরা তাড়াতাড়ি বাস স্ট্যান্ড-এ পৌঁছে গেল।
"বোধগয়া যাবে তো! আগে তোমার থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে তারপর আমি নিজের গ্রামে যাবো। গ্রাম থেকে ফিরে এসে তোমায় সব জায়গা ঘুরিয়ে দেখাব”।  "যেমন তোমার ইচ্ছে।" আশা সুধীরের ওপর সবটাই ছেড়ে দিল।

দ্বিতীয় দিনে ওর দিল্লি যাওয়ার ট্রেন রাত্রেই। তারপর সেখান থেকে তৃতীয় দিন অর্ধেক রাতে ওর বাড়ি ফিরে যাওয়ার টিকিট। এই কথা সুধীরের জানা ছিল। সুধীর দেখে খালি বাসে উঠল ও আশাকে সীটে বসালো, নিজের জন্যও সীট রাখল। তারপর স্টেট বাসের টিকিট নিয়ে এলো। বাসটা স্টার্ট নিতে এখনো পনেরো মিনিট সময় আছে, তাই সে চা নিয়ে এলো। মাটির খুঁড়িতে চা , অনেক চা-ওলা আবার প্লাস্টিকের কাপ ও রেখেছে।
"বাহ কি চমৎকার সুগন্ধ!"
"পোড়া মাটির সুগন্ধ।"
আশা ভাবেই বিভোর। সুধীর দেখল ওর দিদির চোখে জল।
"ওই যে কোণার চায়ের দোকান, আমি সব সময় ওই দোকানেই চা খাই।  ভালো চা তৈরি করে”।
আশা তাকিয়ে দেখলো , মাটির উপর উঁচু করে কয়লার চুলো যেন পৃথিবী ফুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে। সেই চুলায় চা ফুটছে। ওর নিজের গ্রাম নিকেরি ডেল্টার কাছে , সেই গ্রামের কথা মনে পড়ল। পৃথিবীর উপর উঠে আসা মাটির চুলা আর কাঠ ও কয়লা ওখানেও সহজ ভাবেই পাওয়া যায়। পারামারিবো শহরে আসার পর ওর মা গ্যাসের চুলা দেখল। গ্রাম , কসবা ও শহরের এই তো তফাৎ, এটা বিশ্বব্যাপী, বোধহয় গ্লোবাল!

বড়জোর পনেরো মিনিটেই বোধগয়া পৌঁছে গেলা। পথে যেতে যেতে চোখে পড়ল কালো পাথর দিয়ে তৈরি করা জিনিস, সর্ষের ক্ষেত , বিরল  জঙ্গল ও নবীন স্থাপত্যের কিছু কিছু নমুনা। বোধগয়াতে পরিষ্কার সুন্দর হোটেল দেখে সুধীর আশাকে সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিল।
"আপনি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নেবেন। খাবার এখানেই পাওয়া যায়। তারপর আমরা পরের প্রোগ্রাম তৈরি করবো।" আশার মুখে চিন্তার ভাব দেখে সুধীর বলল, "এই ভাবে কি দেখছেন , আমি এই যাবো আর আসবো, মাত্র দু’ঘণ্টার ব্যাপার। ওই দেখুন জানলার বাইরে ওই গ্রামটাই তো আমার গ্রাম।" খড়কুটো ও টালির ছাওয়া বাড়িগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে সুধীর বলল।
"ঠিক আছে তাহলে।"
“ঠিক নয় , আপনার কাছে টাকাপয়সা আছে তো ? মানে ডলার বার করবেন না কারুর সামনে। আমি এখানে আপনার পরিচয় দিয়েছি, আপনি আমার কলেজের টিচার, বিদেশী নন। ওরা জানলে লুটেপুটে খাবে।"
"আমার কাছে টাকা আছে।" আশা হেসেই ফেলল। ঠিক আপন ভাইয়ের মত, তাই না!

সুধীর চলে গেল। আশা বাথরুমে নাইতে নাইতে ভাবছিল, ওর দুই ভাই গরিবীর ঠেলায় পড়তেই পারলো না। ওদের ইংল্যান্ড-এ গিয়ে ডেকে মজুরি করতে হল। পরে পরে ওরা সেইখানেই ঠেকাদারির কাজ করতে লাগল। তারপর ওদের কাজে বেশ টাকাকড়ি হল। মাও শহরে এসে কাজ করতে লাগল। মা ভাইয়েদের টাকা পাঠাতে আরম্ভ করলো, কিন্তু ওদের কাছে একটি শর্ত রাখলো যে ওরা ওর বোনকে পড়াবে। হিন্দি বা ইংরেজি। আহ, ভাইদুটি নিজেরা তো পড়া করতেই পারেনি কিন্তু বোনকে পড়াবার শর্ত লাগিয়েছে। সুধীরটাও ওই রকমেরই এক্কেবারে ভারতীয় ভাইদের মত। সে স্নান করে বেরিয়েই ভাবল যে একটা ফোন করা যাক টেলিফোন বুথে গিয়ে, ভাইদের সঙ্গে কথা বলবে। ওদের জানাবে সে এখন কালোমাটিতে দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে কথা বলছে আর ওর বামদিকে ফল্গুর বিস্তার আর ডানদিকে নিরঞ্জনার ক্ষীণ ধারা বইছে। নিজের চুল বাঁধছিল, তক্ষুনি বেয়ারা এসে ওর খাবার টেবিলে সাজিয়ে দিল। সে খাবার বেশ তৃপ্তি করে খেল, তারপর বিছানায় গড়িয়ে পড়ল। চোখ বন্ধ করতেই চোখে ঘুম নেমে এলো। কিন্তু মন প্রাণ পূর্ণ রূপেই জাগ্রত, চোখের পলক ভার হয়ে উঠছে। সুধীরের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ ওর ঘুম কেড়ে নিল।

“এটাই ভালো হল, আপনি তো ঘুমিয়ে পড়লেন আর আমি শুধু ছুটতেই থাকলাম”।
“তুমিও তো ট্রেনে সকালে বেশ ঘুমিয়ে নাক ডাকছিলে, আর আমি দেরিতে ঘুমোলাম ও ভোরে উঠেও গেলাম।”
“ঠিক আছে তাহলে চলুন বাইরে আপনাকে বোধগয়া ঘুরিয়ে নিয়ে আসি। দেশ  বিদেশ থেকে কত লোক এখানে শুধু বোধগয়া দেখতেই আসে।”
“সবচেয়ে প্রথমে আমি কোনো টেলিফোন বুথে যাবো। তুমি আমায় সেইখানে নিয়ে চলো। আমি আমার ভাইদের ও মা‘র সঙ্গে একটু কথা বলব।”
“চলুন!”

দুজনে কাছের বুথে গিয়ে পৌঁছল। ভাইয়েরা তো শুনেই খুশিতে কেঁদেই ফেলল। সে বলল যে ওর জন্য মাতৃভূমি কতটা গুরুত্ব রাখে ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারবে না। সব হিন্দুরা মরার পর সেখানেই তো যায়। সে বোনকে বলল, তুই গয়া গিয়ে সব পিতৃপুরুষদের নাম নিশ্চই পিন্ড দিয়ে যেন আসে। আম্মাকে বলল, “পান্ডাদের দান দক্ষিণা দিয়েই মতলব, ওরা নানান অজুহাত দেখাবে, কিন্তু আমি যতদূর জানি হিন্দুধর্মে মেয়েদেরও সেই অধিকার আছে।”
“কালকের জন্য আগেভাগেই কথা বলে রাখি। আমরা সকাল সকাল পিন্ডদানটা সেরে নেব। তারপর দুপুরে তোমার মুসাহারি যাবো।” সুধীর আশার আগামীকালের প্রোগ্রাম ঠিক করে দিল।
“যেমন তুমি ঠিক বোঝো।”
সবচেয়ে প্রথমে সুধীর মহাবোধি মন্দিরের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো আশাকে।
“আমায় বলতে দাও দেখি আমি নিজে কী কী আন্দাজ করে বলে দিতে পারি।”
“প্রত্যক্ষে যা আছে তাই সত্য, এতে আন্দাজ করবার কি বা আছে?” সুধীর বলে উঠল।
“আরে আমায় একটু বলতেই দাও না, এতে ক্ষতি কী? আমি ইতিহাসে যা পড়েছি তাই একটু যাচাই করে নিতে চাই।”
“ঠিক আছে, করো আন্দাজ।”
ওরা এইভাবেই ঘুরতে থাকলো, আন্দাজে আশা কিছু কিছু জিনিস ঠিক চিনে ফেলেছিল, যেমন বোধিবৃক্ষ, চক্রমপথ, জলাশয় ও সমাধিস্থল। কিছুক্ষণ বিভিন্ন দেশের মন্দিরের স্থাপত্য ও সাজসজ্জাও দেখল। ঘুরতে ঘুরতে প্রায় ক্লান্ত হয়ে পড়ল আশা। সন্ধ্যে হয়ে এলো, দুজনে মিলে একটি ধাবায় বসে চা–টিফিন করল।

“আপনাকে আমি নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এখন আমায় গয়া  গিয়ে আপনার পূর্বপুরুষদের পিন্ডদানের ব্যবস্থাও করার আছে। তাই এখন আপনি নিজের হোটেলেই ফিরে যান।” সুধীর বলল। তারপর আশা অনেকগুলি সেখানকার দর্শনীয় স্থলের বই নিয়ে নিল। এবার সে হোটেলের কামরায় বসে  বসে সেই বইগুলি পড়তে লাগল। সুধীর চলে গেল, সুধীরের ফিরতে প্রায় দু’  ঘন্টা লাগলো। আর হাতে কিছু জিনিসও ছিল।
“এইসব জিনিস কালকের শ্রাদ্ধের জন্য নিয়ে এলাম। আমাদের ভোর চারটায় বেরিয়ে পড়তে হবে।”
“তুমি কেন কিনতে গেলে?”
“ঘাবড়ে যাবেন না , আমি সব টাকা আপনার কাছ থেকে এক্ষুনি নিয়ে নেব।  আমি এত ধনী নয় যে আপনাকে এই সব জিনিস মুফতে দেব। আর জেনে রাখুন, এই জিনিস আপনি নিয়ে নিলেও আপনার পিতৃপুরুষেরা সেইগুলি ফিরিয়ে দেবেন। তাই আপনার পয়সাই চলবে, আমার পয়সা রিজেক্ট।” উপরের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে সুধীর যে ভাবে বলল, আশার মুখে হাসি ফুটল।

সুধীরের সাহায্যে আশার শ্রাদ্ধ সুসম্পন্ন হল। ফল্গুর কিনারে, যেখানে যেখানে  ধর্মের বৈধানিক রূপে শ্রাদ্ধ হয়, সব জায়গায় সম্পন্ন করে ফেলল। বোধহয় এই সব কাজে পান্ডারা অস্পৃশ্যদের কোনো কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। বোধহয় প্রেতকার্যেও ওরা এই সব মানে না।
শ্রাদ্ধের সময় আশার মন খুব শান্ত ও সন্তুষ্ট ছিল। একটি বড়কাজ আজ পূর্ণ হল। ওর শরীরে বেশ ফুর্তি দেখা যাচ্ছিল। সে রোমাঞ্চ অনুভব করছিল। আজ সে সাত সমুদ্র পার করে নিজের মাটিতে এসে পৌঁছেছে, এমন আভাস পেল। বড় ঠাকুরদাদা-বড় ঠাকুরমা , ঠাকুরদা-ঠাকুরমা ও দাদু-দিদা ওদের পুরো  পরিবার। আহা... আজ কত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছ।  ওর মনে হল, ওর কাঁধ আজ আরো একটু উঁচু হয়ে উঠল। ওর মাথার উপর একটি আভামন্ডল নির্মিত হয়ে উঠেছিল।  না হোক এই কথাটা সত্য কিন্তু আশা এটা কিন্তু অনুভব করছিল।
"দিদি, আপনি খাবার খেয়ে নিন, আমি বাড়ি থেকে হয়ে আসি, তারপর গ্রামে যাবো।" এই বলে সুধীর বাইরে বেরিয়ে গেল। আশা খাবার খেয়ে সুধীরের প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে রইল। সে নিজের গ্রামে যাবে, মাই বলেছিল একটু মাটি নিশ্চই নিয়ে আসবি নিজেদের জমির, সত্যি সে মাটি তুলে নিয়ে যাবে। নিজের মুসহারির মহিলাদের সঙ্গে একটু কথাও বলবে তারপর ফিরে আসবে আর যদি সময়ে কুলায় তবে সুধীরের বাড়িও যাবে।

সুধীর নিজের বাড়িতে পৌঁছেঁতেই একটি খবর বেশ ছড়িয়ে পড়েছে যে সামহো গ্রামের লোকেরা নিজেদের একটি সম্মানিত বয়স্ক মানুষের দাহ–সংস্কার করে ফল্গু থেকে ফিরছিল তখন ওদের জীপ্ গাড়ির উপর হল্লা–হামলা করে সাতখানা লাশ ফেলেছে। এখন এইসব ব্যাপার হয় কুঢ়নি–মুসহারী গ্রামের কাছে। এইসব ঘটনা শুনে সুধীরের কন্ঠ এক্কেবারে শুকিয়ে উঠল। এ আবার কী হল রে বাবা! এই তো বেশ কত দিন ধরেই তো সব ঠিকঠাকই চলছিল, সব কিছু এক্কেবারে শান্ত ছিল।  এই শান্তি কি তুফান উঠার আগের শান্তি! এখন কী হবে? নিজেদেরই গ্রামে মুসহারীরা এমনটি কেন করতে যাবে? কিন্তু হল তো সেইখানেই! এই সুখী হয়ে উঠা গ্রাম! ইন্দিরা বিকাশের মারফত তৈরী করা পাকা দেয়াল ও খড়-টালি  ছাওয়া ঘর ও সেই বাড়ির বাসিন্দারা তো পর্যাবরণ-এর কার্যকর্তা ওরা কি এমন কাজটি করতে পারে? না ... না নিশ্চই ওখানে জাহানাবাদের অপরাধীরা প্রতিশোধ নেবার জন্য ঘাপটি মেরে বসেছিল। কিন্তু জায়গাটা তো সেই মুসহারী।  আর সেখান থেকেই পুলিস লাশ উঠিয়ে নিয়ে গেছে। পুরুষদের পুলিশ ধরে থানায় নিয়ে গেছে। এখন গ্রামে শ্মশান ঘাটের মত শান্তি। সুধীর নিজের এক বন্ধুর কাছ থেকে ওর মোটর সাইকেলটি চেয়ে নিল, তারপর আশাকে নিয়ে গ্রামের দিকে চলল। কিন্তু আশাকে কোনো কথায় সে জানায়নি। ফল্গুর বালি পার হতে না হতেই ওদের চোখে পড়ল, বড় বড় আগুনের গোলা বাতাসে উড়ে উড়ে মুসহারীর দিকে আসছে। কয়েক মিনিটেই গোটা গ্রাম ধু ধু করে পুড়ে ছাই হয়ে গেল। আশা সুধীরের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। আশার চোখে প্রশ্ন ছিল।
“কাল রাতে এই গ্রামে কিছু পার্স্বগামী মানুষদের  হত্যা হয়েছে। ওরা উচ্চ বর্ণের  লোক ছিল, তাই আজ ওরা এখানকার মানুষদের পুরস্কার স্বরূপ দিল আগুনের গোলা।”

বাম পাশেই মহিলারা নিজেদের যে যার বাচ্চাদের হাত ধরে দাঁড়িয়েছিল ভীড় করে। ওদেরকে আশা প্রশ্ন করল, “আপনারা কে?”
“আমরা এই মুসহারী গ্রামের লোক। আমরা এমনটি হবে জানতাম, তাই বাচ্চাদের নিয়ে বেরিয়ে এসেছি। দেখো না সব কিছু ভস্ম হয়ে গেল।” একথা বলে বৃদ্ধা মহিলাটি হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল।
এদের চোখের সামনে সব কিছু ছাই হয়ে গেল। আশা কেমন যেন বোকা বোকা হয়ে গেল। এদের কী বলবে সে ... সে কি বলবে সাতসমুদ্র পার হয়ে লাল মাটির জমি ছেড়ে এতদূর এখানে নিজের জমির কালোমাটি নিতে এসেছে! আর এরা সবাই ওর বোনেরা কত শতাব্দী পরে এসেছে। এখান থেকে কি একমুঠো ওর পূর্ব পুরুষদের ঘামেমাখা মাটি পাবে? কি রক্ত মাখানো ছাই?






0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন