আমি তবারক
বলছি
আমি তবারক বলছি, শুনতে পাচ্ছেন? কান থেকে তুলোটা
একটু ফেলবেন? হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি! আমাকে চিনতে পাচ্ছেন নিশ্চই? এই তো খবরের
কাগজে পড়লেন কিছুদিন আগে। ওঃ ভুলে গেছেন হয়তো, ভোলবারই তো কথা। রোজই তো খবরওয়ালারা
কিছু না একটা কিছু লিখছেই আমাদের নিয়ে, কত আর মনে রাখবেন? আর মনে রেখেই বা কী হবে?
তবে কোনোদিন ভাবিনি, খবরের কাগজে নাম বেরোবে। যাইহোক, আমার পুরো নাম তবারক আনসারি,
বয়স ৫৪, বাড়ি মহারাজগঞ্জ, উত্তরপ্রদেশ। আর কাজ করি মহারাষ্ট্রে।
দু'দিন আগে বেরিয়েছি বাড়ি যাবো বলে, সাইকেলে। একা
নই, আমরা দলে দশজন ছিলাম। কী আর করবো? কাজ নেই, থাকার জায়গা নেই, সবাই মিলে কিছু টাকা দিয়ে থুয়ে বেশ কয়েকদিন চললো বুঝলেন!
কিন্তু বেশিদিন আর পারা গেল না। খাবার
কেনার টাকাও ফুরিয়ে গেল। সব সহ্য করা যায় কিন্তু পেটের টান...! ভাবলাম বাড়ি পৌঁছলে দু’দিন অন্তত খেতে
পাবো।
ভালো লাগছে না শুনতে কথাগুলো? দুঃখ হচ্ছে? ওসব
একটু প্রথম প্রথম হবে। তো যা বলছিলাম, সবাই মিলে রওনা দিলাম। অনেকটা পথ তো, আমাদের
মত আরো কত মানুষ, কেউ হাঁটছে আর কেউ সাইকেলে। সবাইকে দেখে মনের জোর বাড়ে, আসলে
ভেতরে কেমন কেমন করছিল, এর আগে এতটা রাস্তা সাইকেল চালাইনি তো! কিছুটা চালাই,
কিছুটা জিরোই, জিরোনোর সময় সবাই মিলে একটু
সুখ দুঃখের গল্প করে নিই। আমি শুনিই বেশি, তো এরকমই এক গাছের ছায়ায় বসেছি সাইকেল রেখে, আমারই বয়সের
একজন লোক মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, পাশে তার ছোটছেলে। ওভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস
করলাম, 'কোন জেলা?' কোনো উত্তর নেই, বাচ্চা ছেলেটা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে আমাদের
মুখের দিকে। আমি এগিয়ে গিয়ে বললাম, 'কোনো দরকার লাগলে বলো দাদা।'
মাথাটা তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, 'একটা চোরকে
সাহায্য করবেন?'
আমি হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। লোকটা ফুঁপিয়ে কেঁদে
উঠল, বলল, 'সবই তো ঠিক ছিল, শক্ত শরীর
ছিল, খেটে খাওয়া মজুর ছিলাম, কী যে হলো, চোর বনে গেলাম।' আমি কী করবো কিছুই বুঝতে
না পেরে ওর পাশে বসলাম। সে বলতে শুরু
করলো, 'যা একটু খাবার ছিল তাই খেয়ে বেরিয়েছিলাম, তারপর থেকে সেরকম কিছুই পেটে পরে
নি, জলটাও শেষ হয়ে গেল জানেন! ছেলেটা এত হাঁটতে পারে না, কী আর করবো, ওকে ঘাড়ে
তুলেই হাঁটতে শুরু করলাম। বেশিদূর পারি না একবারে, মাঝে মাঝে কিছুটা পথ পায়ে
হাঁটে। একেই রোদ, পেটে তেমন কিছু নেই। এর
ওর থেকে জল চেয়ে খেলাম মাঝে। পরের দিন ছেলেটা আর পারছিল না, অসুস্থ হয়ে পড়ছিল,
খাবার তেমন কিছুই জুটলো না। কিন্ত বাড়ি তো
ফিরতেই হবে তাই হাঁটতেই হলো। আজ সকালে দেখি, ছেলেটার পা ফুলে ঢোল হয়ে গেছে, তাও
হাঁটতে হচ্ছে। কী করবো মাথায় আসছিল না। ছেলেটা গোঙাতে শু্রু করলো। বেশ কিছুটা
যাওয়ার পর একটা বাড়ি দেখতে পেলাম। আশে পাশে কোনো লোক নেই। উঠোনে একটা সাইকেল রাখা।
ব্যস খেটে খাওয়া মানুষটা চোর হয়ে গেল।
একটা কাগজের টুকরো নিয়ে তাতে লিখলাম, আমরা চোর নই, আপনাদের মতই এ দেশের একজন, বাড়ি
পৌঁছতে হবে তাই সাইকেলটা নিলাম। ছেলেকে বললাম, দরজার সামনে কাগজটা রেখে সাইকেল
নিয়ে ছুট দিবি, আমি অপেক্ষা করবো। ছেলেটা সাইকেল নিয়েই ছুট দিল, কাগজটা রাখতে ভুলে
গেল, আসলে এসব করে নি তো আগে, ঘাবড়ে গিয়েছিল।' কথাগুলো বলেই হু হু করে কাঁদতে শুরু
করলো। আমি যে কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না, জানেন! ছেলেটার মুখের দিকে তাকালাম,
দেখলাম একইভাবে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।
ও আবার কথা বলতে শুরু করলো, 'পুলিশের ভয়ে ভেতর রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, কী এক নিয়ম
করেছে, রাতে কার্ফু। আজ রাতটা যদি সাইকেল
চালাই, কাল সকাল সকাল পৌঁছে যাবো, কিন্তু ওরা বুঝবে না, ওরা শুধু নিয়ম দেখায়। ছোট
ছেলেকে নিয়ে এই রোদে যাওয়া যায়? ও যে মরে যাবে, আর পারছে না! বলুন তো, মানুষের
জীবনের থেকে নিয়ম বড় হলো? জীবনে চুরি করতে
হবে ভাবিনি, তাও যদি বাড়ি পৌঁছতে পারতাম, কী যে হবে!'
আমাকে দলের লোকেরা তাড়া দেয়, অনেক রাস্তা বাকি।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে উঠে এলাম, সাইকেলে
চাপলাম। প্রায় দু'ঘন্টা চলার পর খাবার পেলাম।
কিছু ভালোমানুষ আমাদের মত লোকদের খেতে দিচ্ছিল। চেয়ে চেয়ে পেট ভরে খেলাম। গায়ে একটু জোর পেলাম, সাইকেলের গতি
বাড়লো। অন্ধকার হয়ে আসল, একটা মাঠ দেখে শুলাম। ভোরের আলো ফুটতেই আবার রাস্তায়
নামা, আজ রোদটা খুব চড়া ছিল, সারা রাস্তা কোনো খাবার নেই, জল নেই। আমার মাথা
ঘুরছিল, থামলাম, আধা ঘন্টা জিরোলাম, তারপর আবার শুরু হলো প্যাডেল দেওয়া। পায়ে ব্যথা করছিল, জোর
পাচ্ছিলাম না। কিছুদূর কোনোরকমে যাওয়ার পর হঠাৎ দেখি, দু'তিনজন মহিলা হেঁটে
যাচ্ছে, ট্রলি টানছে আর তার ওপর একটা বাচ্চা ঘুমিয়ে পড়েছে।
এ কী আপনার চোখে জল? ও মুছে নিন, আমাদের মত
মানুষদের জন্য চোখের জল নষ্ট করবেন না।
এরকম কত ঘটে, সবার জন্য
চোখের জল ফেলতে হলে একটা বড় পুকুর তৈরি হয়ে যাবে আপনার, আমাদের বাড়ির পাশের
পুকুরটার মতো। কি ভালো মাছ হয় জানেন, বাড়ি গেলে খেতে পারবো। তো ওইরকম ঘুমন্ত
বাচ্চাকে মা ওভাবে নিয়ে যাচ্ছে দেখে হঠাৎ আমার পায়ের ব্যথা উধাও হয়ে গেল। সাইকেল
চলতে লাগলো। সূর্য ডুবল, রাত হলো। রাস্তায় কত মানুষ আমাদের মত, যে যেখানে পারছে একটু জিরিয়ে
নিচ্ছে, মাঠে, রেললাইনে, গাছের তলায় পেটে খিদে নিয়ে, বুকে তেষ্টা নিয়ে, শরীরে
ব্যথা নিয়ে আর মনে জীবন্ত অবস্থায় বাড়ি পৌঁছনোর আশা নিয়ে।
সকালে ঘুম ভাঙলো শোরগোলে, দেখি পুলিশরা লাঠি দিয়ে
তাড়া করছে। স্পষ্ট করে কী হয়েছে বোঝার আগেই সাইকেল নিয়ে রওনা দিলাম। ঘন্টা দুয়েক
চলার পর একটা পুকুর পেলাম। পেট ভরে জল
খেলাম। আবার চললাম বাড়ির পথে। কিছুদূর
যাওয়ার পর আমাদের থামিয়ে দেওয়া হলো, ক্যামেরা নিয়ে কয়েকজন দাদা দিদি এল, কত সব
প্রশ্ন করছিল। আমি রাস্তার ধারে গিয়ে বসলাম, মাথাটা ঘুরছিল আবার। আমার দলের বাকিরা
কেউ কেউ উত্তর দিচ্ছিল, দুঃখের কথা বলছিল,
খাবার নেই, জল নেই, এসব। বোকার দল। ওসব বলে কী হবে? কেউ শোনার নেই, আর শুনলেও মনে রাখবে? এক দু'জন নাকি? কত তো মানুষ রাস্তায় দেখলাম, সবার
কথা মনে রাখা যায়? একজন তো খুব সরকারকে দুষলো, কোন সরকারকে তা অবশ্য বুঝলাম না।
বাড়ির ঠিকানা একখানে, থাকি আর কাজ করি আরেকখানে - আমাদের দেখবে কে? যাইহোক, ওরা
বলে শান্তি পায় পাক। এসব ঝক্কি থেকে ছাড়া পেলাম, চললাম আবার।
কিছুক্ষণ পর পুলিশ আবার ধরলো, জিজ্ঞাসাবাদ করছিল,
হঠাৎ দেখি একটু দূরে একজন মহিলা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করল কোলের ঘুমন্ত ছেলেকে
রাস্তায় নামিয়ে। পুলিশরাও আমাদের মতই
হতবাক। তারপর বোঝা গেল, ওরা বিগত তিন চার দিন ধরে হাঁটছে, খাবার আর জল কিছুই পায়নি
সে কথা স্বীকার করছিল না প্রথমে। বাচ্চাটারও খাবার জোটেনি, মারা গেছে। পুলিশ যদি
কোনোভাবে আটকে দেয়, তাই এতক্ষণ বলে নি যে ঘুমন্ত নয়, মৃত বাচ্চাকে নিয়ে মাইলের পর
মাইল হাঁটছে।
মাথার ভেতরটা ঝনঝন করছিল, চোখে অন্ধকার দেখছিলাম
মাঝে মাঝে, কেন কে জানে। আমাদের পুলিশ ছেড়ে দিল, একটাই কথা মাথায় ঘুরছিল, ওদের
হাঁটতে অনেক বেশি কষ্ট। আসলে জ্যান্ত ছেলের থেকে মৃত ছেলের ভার বেশি মনে হয়।
চারপাশটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে। জানেন, চোখের সামনে কতগুলো মুখ ভেসে উঠছে রাস্তার বদলে, ওই
ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা বাচ্চাটার মুখ, ট্রলির ওপরে ঘুমন্ত বাচ্চাটার মুখ আর
ওই রাস্তায় পড়ে থাকা মৃত বাচ্চাটার মুখ।
মাথার ভিতর দপদপ করছে। শিরাগুলো ছিঁড়ে যাচ্ছে। হাত
আর সাইকেলের হ্যান্ডেল দুটো ধরে থাকতে
পারছে না। মুখ থুবড়ে পড়লাম। মাথার ওপর চড়া রোদ, তাও যেন সব অন্ধকার।
অনেক সময় নিলাম আপনার, খুব জ্বালাতন করলাম, বলতে
ইচ্ছে হলো হঠাৎ এই প্রথমবার, আমি তো সারারাস্তা চুপই ছিলাম। ভালো থাকবেন, সাবধানে
বাড়ি যাবেন।
কি জানেন, চুরি করা সাইকেলে হয়তো বাবা তার ছেলেকে
চাপিয়ে বাড়ি ফিরতেও পারে, ঘুমন্ত বাচ্চাকে
টানতে টানতে ক্লান্ত মা’ও হয়তো বাড়ি ফিরতে পারে, মৃত ছেলের বোঝা বয়ে সর্বহারা বাবা
মা বাড়ি ফিরতেও পারে। কিন্তু আমি আর বাড়ি ফিরবো না, কোনোদিন না।
তবু নির্লজ্জের মতো আমরা বাড়ি ফিরে যাই, প্রতিদিন !
উত্তরমুছুন