সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

<<<< সম্পাদকীয় >>>>



কালিমাটি অনলাইন / ৭৯



ইংরেজিতে একটা প্রবাদবাক্য আছে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়, যে দৃষ্টির বাইরে আছে বা চলে গেছে, সে নাকি মনের বাইরেও আছে অথবা চলে গেছে।  প্রবাদবাক্যটির মধ্যে  নিশ্চয়ই কোনো পরীক্ষিত অনুভব বা উপলব্ধি আছে, না হলে এখনও এই প্রবাদবাক্যটি সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হয় কেন! তবে আমার নিজের জীবন অভিজ্ঞতায় ইতিপূর্বে যেটুকু বুঝেছি, তাতে আমার মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা আংশিক সত্য। কেননা যাকে আপনজন মনে করি, ভালোবাসি, তার শারীরিক ভাবে আমার দৃষ্টির মধ্যে থাকা বা না থাকার ওপর নির্ভর করে না তার প্রতি আমার ভালোবাসার গভীরতা বা ঘনত্ব। একটা সময় ছিল, যখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি আজকের মতো এতটা সাফল্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছায়নি, যখন দূরের প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল চিঠি, দূরভাষ ছিল আয়ত্বের বাইরে, জরুরি প্রয়োজনের ছিল টেলিগ্রাম, তখন প্রিয়জন দৃষ্টির বাইরে থাকলেও মনের বাইরে কখনও থাকেনি। বরং তাকে মনের ভেতর আরও নিবিড়ভাবে ধরে রেখেছি। আজ অবশ্য কোনো কিছুই দৃষ্টির বাইরে নেই। আমারা ইচ্ছে করলেই প্রযুক্তির হাত ধরে সেই মুহূর্তেই পৌঁছে যেতে পারি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের আনাচে কানাচে, এমনকি পৃথিবীর বাইরেও। সুতরাং কেউ দৃষ্টির বাইরে যদি থেকেও থাকে, তাহলে একথা বলতেই হয় যে, তাকে আমি দৃষ্টিগোচর করতে আগ্রহী নই বলেই সে আমার দৃষ্টির বাইরে অবস্থান করছে। আমি যে মুহূর্তে তার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হব, কোনো প্রযুক্তিযন্ত্রের মাধ্যমে তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারব। অন্যদিকে যদি কেউ আমার মনের বাইরে অবস্থান করে, তবে সে আমার দৃষ্টির সামনে ঘুরে বেড়ালেও মনের বাইরেই থেকে যাবে।

বাংলায় একটি প্রবাদবাক্য আছে, সবারই তা জানা, ধান ভানতে বসে শিবের গান গাওয়া। তা ব্যাপারটা সেরকমই হলো। ধান ভানতে বসে এতক্ষণ শিবের গানই গাইছিলাম বা শোনাচ্ছিলাম। আসলে আমি সম্পাদকীয় লিখতে বসে কী লিখব ভেবে না পেয়ে সাম্প্রতিক বিশ্বের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের দরুণ যে কিছু সামাজিক বিধি নিষেধ আরোপ করা হয়েছে সর্বত্র,  সেই ব্যাপারটা মাথাচাড়া দিল। নিজে সংক্রমণ থেকে বাঁচতে এবং অন্যকে বাঁচাতে যে তিনটি স্বাস্থ্যসম্মত আচরণ করার জন্য সবাইকে সচেতন করা হয়েছে এবং নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে প্রথমটি হলো, বারবার সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে হাতকে বিপদমুক্ত রাখা। দ্বিতীয়ত মুখে মাস্ক পরে থাকা, যাতে নাক ও মুখের সুরঙ্গ দিয়ে ভাইরাস অনুপ্রবেশ না করতে পারে। এবং তৃতীয়ত সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলা, যাতে কেউ সংক্রমিত হয়ে থাকলে তার কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা যায়। আর মজার কথা হলো, এই তৃতীয় নির্দেশের  ব্যাপারটা মাথায় আসতেই ওই ইংরেজি প্রবাদবাক্যের ব্যাপারটাও মনে এসে  গেল।

বস্তুতপক্ষে করোনার আগমনের পূর্বে আমরা যে বিশ্বে বাস করতাম, করোনার অনুপ্রবেশে সেই বিশ্ব আচমকাই কেমন যেন বদলে গেছে। সেই বদলের চেহারাটা আমরা যত দেখছি, ততই নিজেরাও চমকে চমকে উঠছি। সারা বিশ্ব জুড়ে মানুষের এই অসহায়তা ও বিপন্নতা, মানবসভ্যতা্র বিরুদ্ধেই যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাস। মৃত্যুমিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা প্রতি নিয়ত আতঙ্কিত হচ্ছি নিজেদের মৃত্যুর আশঙ্কায়। সামাজিক দূরত্ব এই সংকটময় সময়ে বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। অথচ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সামাজিকতা। জট পাকিয়ে যাচ্ছে আত্মীয়তা। বুঝতে পারছি, পরিস্থিতির চাপে মানুষ কীভাবে ক্রমশ আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার জালে জড়িয়ে পড়ছে। সৌজন্যবোধ বিদায় নিচ্ছে নিত্যদিনের জীবনযাপন থেকে। আর তখনই আরও বেশি বেশি মনে হচ্ছে,  সেই  ইংরেজি প্রবাদবাক্যটা আংশিক নয়, বরং অনেকটাই সত্য।  


আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের ই-মেল ঠিকানা :

kajalsen1952@gmail.com / kalimationline100@gmail.com


দূরভাষ যোগাযোগ :         
08789040217 / 09835544675


অথবা সরাসরি ডাকযোগে যোগাযোগ :

Kajal Sen, Flat 301, Phase 2, Parvati Condominium, 50 Pramathanagar Main Road, Pramathanagar, Jamshedpur 831002,  Jharkhand, India.


মলয় রায়চৌধুরী




একাকীত্ব আমার ভালো লাগে






একাকীত্ব আমার ভালো লাগে; ভারতের আর পৃথিবীর যে শহরেই গেছি, একা- একা পথে হাঁটতে আমার ভালো লেগেছে। কতো গ্রাম যে চাকুরিসূত্রে ঘুরেছি; কাজ শেষ হলেই একা-একা ঘুরে বেড়িয়েছি গ্রামের পথে। চারিদিকে চাইতে-চাইতে ঘুরে বেড়িয়েছি। এখন আশিতে পৌঁছে কেবল স্মৃতিচারণ করি বটে কিন্তু মগজের ভেতরে এক শহরের পথের সঙ্গে আরেক শহর, এক গ্রামের পথের সঙ্গে আরেক পথ গুলিয়ে ফেলি। কিন্তু একাকীত্বের বোধে যে আহ্লাদ তা এখনও উপভোগ করি। স্কুলে পড়ার সময়ে বন্ধু তরুণ শূরের সঙ্গে বহুবার বাড়ি থেকে পালিয়েছি; আমার মতো তরুণও কম কথা বলত। দুজনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাশাপাশি হেঁটেছি কোনো কথা না বলেই; দুজনেই চারিপাশের মানুষ, পথঘাট, বাজার, প্রকৃতি দেখতে দেখতে সময় কাটিয়েছি। হাংরি আন্দোলনের সময়েও আমি সকলের সঙ্গে বকবক করে সময় কাটাতে পারিনি। মামলার সময়ে কলকাতার রাস্তায় দুপুর, সন্ধ্যায়, রাতে একাই ঘুরেছি; প্রায় সকলেই তো আমার বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে আর সাক্ষ্য দিয়ে আলাদা  হয়ে গিয়েছিল। বস্তুত ওই আলাদা হওয়াও ছিল বোধ; একাকীত্বের আনন্দের বোধ।

আমি স্বীকার করি যে আমি ইনট্রোভার্ট, যেমনটা ছিলেন কাফকা, প্রুস্ত, আলবার্ট আইনস্টাইন, আইজ্যাক নিউটন, জে.কে.রাউলিঙ, ডাবলিউ বি ইয়েটস, ইনগ্রিড বার্গম্যান, অড্রে হেপবার্ন, গ্রেস কেলি, জুলিয়া রবার্টস, মেরিল স্ট্রিপ, ক্লিন্ট ইস্টউড, হ্যারিসন ফোর্ড, টম হ্যাংকস, আলফ্রেদ হিচকক, স্টিভেন স্পিলবার্গ, জীবনানন্দ দাশ প্রমুখ। একথা ঠিক যে ইনট্রোভার্টরা নিজেদের মানসিক স্থিতি সম্পর্কে বেশি আগ্রহী; হয়তো সেকারণে লোকে মনে করতে পারে যে সে গম্ভীর ও  সংযতবাক বা চিন্তাশীল। অন্যান্য ইনট্রোভার্টদের মতন আমিও পড়তে, লিখতে, ছবি আঁকতে, ভাবতে ভালোবাসি। একা সময় কাটাতে যতো আনন্দ পাই তা একদল লোকের মাঝে বসে পাই না। কিন্তু ইট্রোভারশান মানে শাইনেস নয়। ইনট্রোভারশান হল পক্ষপাত বা অনুরক্তি যখন কিনা শাইনেস জন্মায় আতান্তর থেকে। বন্ধুদের সঙ্গে মদ খাবার জমঘটে বা হ্যাশিশ টেনে চুপচাপ একা বসে থেকেছি, কথা বলার ইচ্ছে হয়নি। হ্যাশিশের নেশা আপনা থেকেই মনোরম দূরত্ব গড়ে তোলে, একাকীত্ব-বোধের আহ্লাদ গড়ে তোলে।

বোধ কাকে বলে? অভিধানে বলছে বোধ মানে জ্ঞান, বুদ্ধি, অনুভূতি, উপলব্ধি, সান্ত্বনা, অনুমান, ধারণা। অনুবোধ মানে বোধটির পুনরায় আবির্ভাব। ক্লিন্টন বি সিলি, যিনি জীবনানন্দ দাশ সম্পর্কে ‘এ পোয়েট অ্যাপার্ট’ বইটি লিখেছেন, তাতে ‘বোধ’ কবিতাটির ইংরেজি করেছেন ‘সেনসেশান’; আরেকজন অনুবাদক, ফকরুল আলম, করেছেন ‘ওভারহোয়েলমিং সেনসেশান’। সেনসেশান কাকে বলে? অভিধান বলছে সেনসেশান মানে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে চেতনা বা জ্ঞানলাভ, সংবেদন, গভীর আবেগের অভিব্যক্তি। বোধের এতগুলো অভিধায় আমি বেশ কনফিউজড, আর তার ফলে, আমি যে নির্বোধ তা নিজেকে মনে করিয়ে দেবার জন্য, কৈশোরে বাবার দেয়া চয়েসেস্ট উপাধিগুলো -- বেল্লিক, ইল্লুতে, নিব্বুধে -- মগজের সঙ্গীতযন্ত্রে আজও বাজিয়ে চলেছি।

এর কারণ, বয়সের ভারে, আমার একাকীত্ববোধ, আর নিঃসঙ্গতার অনুবোধ থেকে নিজেকে ছাড়াবার কোনো কারণ দেখি না। জীবনানন্দীয় বোধে আমি পীড়িত-ভারাক্রান্ত নই; কুড়িজনের একান্নবর্তী পরিবার আর অন্ত্যজ বিহারি ও অতিদরিদ্র মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ায় শৈশব কাটানোর দরুণ জীবনানন্দীয় মধ্যবিত্ত দার্শনিক অ-সুখের সম্ভাবনা গড়ে উঠতে পারেনি অস্তিত্বে।  কিন্তু সেই পাড়াটাই শিখিয়ে দিয়েছিল কেমন করে একাকীত্বকে এনজয় করতে হয়। নিঃসঙ্গতাকে নয়, একাকীত্বকে।
একাকীত্ববোধ কী? তা নিয়ে কম ভাবিনি; অন্যের নয়, নিজের। ব্যাপারটা কি অন্যের সঙ্গে আমার সম্পর্কের অভাব, নাকি মনের স্হায়ী বা সাময়িক অবস্হা? অ্যানিমাল প্ল্যানেটে দেখি প্রিডেটর প্রাণীরা, যেমন বাঘ বা সিংহ, একাই ঘুরে বেড়ায়; প্রিডেটর বলে, তাদের পারস্পরিক দূরত্ব, প্রকৃতি-নির্দেশিত, যৌনগন্ধের ঋতুর কয়েকটা দিন বাদ দিলে। তাহলে আমার এই একাকীত্ববোধ কি প্রিডেটরের নার্সিসিস্টিক বৈভব, স্বাতন্ত্র্যবোধের উল্লসিত সুবিকার? একাকীত্ববোধ, সত্তর পেরিয়ে যতটা বুঝেছি, নিঃসঙ্গতার অনুবোধ থেকে ঘামের গন্ধ পাবার কাতরতার স্তরে আলাদা।

নিঃসঙ্গতার অনুবোধ তাহলে কী? নিঃসঙ্গতা এবং একাকীত্ব যদি একজন বৃদ্ধের জীবনে একটি যৌবনের কাল থেকেই জমাটবাঁধা স্হিতি হয়ে ওঠে, তাকে কী নামে ডাকব? বর্তমান কালখণ্ডের একজন বুড়োর যাপনক্ষয়কে ব্যাখ্যা করার জন্য প্রাচীন আর আধুনিক শব্দভাঁড়ারে নির্ভরযোগ্য অভিধা পাইনি; বোধহয় তৈরি হয়নি এখনও। বুড়ো বয়সের যাপনক্ষয়কে অপরিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্যের বাহক হিসাবে এবং বস্তুজগতের সঙ্গে ভাবুকের লেনদেন দিয়ে ব্যাখ্যা করতে গেলে তাকে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হবে। চিন্তার প্রবাহকে সীমিত করে চলেছে শব্দেরা।  নিঃসঙ্গতার তাড়নায় একাকীত্বের টুঁটি টিপে তৈরি নিজস্ব অনুবোধকে কী বলব? যে নিঃসঙ্গতা আমার কাম্য নয়! আমি নিঃসঙ্গ নই। একা থাকতে চাই বলে আড্ডা দিতে পারি না। বলি বটে বোধহয় এই, বোধহয় ওই, বোধহয় তাই; আদপে বোধ কিছুই হয় না।


নাকতলার ফ্ল্যাট বেচে মুম্বাই চলে আসার পর থেকে আমি যৌবনের বিষণ্ণ মানসিকতা থেকে মুক্তির বহু উপায় খুঁজেও বেরোতে পারিনি; গোলোকধাঁধা আরও পাকিয়ে ফেলেছি। কী বলব একে? মফঃসল শহরের উদাসীন রাস্তার ধারে  কালভার্টের ওপর বসে মাথায় ওপর সান্ধ্যমশাদের উড়াল বইবার নিঃসঙ্গতা এটা নয়।  সত্তর পেরিয়ে আমি সেই অবস্হায় চলে এসেছি, যে জেলঘরে একাকীত্ববোধ আর নিঃসঙ্গতার অনুবোধ মিলেমিশে গেছে। আর, এই ক্ষতের পুঁজরক্ত, আমি রসিয়ে তারিয়ে চাটছি।

আমি অস্তিত্ববাদী নই যে আমার এই একাকীত্ববোধকে ‘হিউমান কান্ডিশান’ বলে চালিয়ে দেব; হিন্দু প্যাগান ইনফিডেল পরিবারে জন্মে এবং ক্যাথলিক স্কুলে পড়াশোনা করেও একাকীত্ববোধের খ্রিষ্টধর্মী ‘হিউমান কান্ডিশান’ সম্ভব বলে মনে হয় না। জাঁ পল সার্ত্রে, আলবেয়ার কামু, মরিস মার্লো পন্টি, কার্ল জাসপার্স প্রমুখের জীবনদশর্নের সঙ্গে খাপ খায় না আমার ভাবনাচিন্তা। অস্তিত্ববাদকে মনে হয় খাঁটি খ্রিস্টিয়।  অবশ্য, আধুনিকতার প্রভাবে পাশ্চাত্য ভাবধারা যে চুঁয়ে-চুঁয়ে   ব্যক্তিভাবুকের অজান্তেই তার যাপনে সেঁদিয়ে  যাবে না, তা চিন্তা করতে বসলেও, ওই একাকীত্ববোধ আরও জেঁকে বসছে । ভেবে দেখেছি যে আমার একাকীত্ববোধ আর নিঃসঙ্গতার অনুবোধ কবির, দার্শনিকের, স্বপ্নদ্রষ্টার, সন্ন্যাসীর বোধ নয়; আমি তো প্রচলিত অর্থে কোনোটাই নই। আমি জাস্ট একজন অ্যাননিমাস, বহুদূরে বসে থাকা প্রিডেটর। বাবাকেও দেখেছি চিরকাল একা থাকতে ভালোবাসতেন; একা গালে হাত রেখে চেয়ারে বসে থাকতেন, কিংবা একা কোনো একটা আবছা ফোটোকে একদৃষ্টে তাকিয়ে সজীব করে তুলতেন।

আমি নিজেকে ভালোবাসি, চিরকাল, সত্তর পেরিয়েও, আমার অনুভূতির মাত্রা আমায় অন্যদের থেকে আলাদা করে রাখে, সন্ত্রস্ত থাকতে পছন্দ করি; ভাবুক আমির সঙ্গে বাইরের আমিপোস্টারের অবিরাম বোঝাপড়া খেয়োখেয়ি চলতে থাক।

হিন্দু প্রসঙ্গটা এইজন্য পাড়লুম যে অস্তিত্ববাদীরা ‘গড’ নিয়ে ভাবনাচিন্তা করে গেছেন। হিন্দু প্যাগান ইনফিডেল পরিবারে জন্ম, এরকম একজন ভাবুককে যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে গড বা ঈশ্বর ব্যাপারটা কী, তাহলে তিনি সদুত্তর দিতে পারবেন না, কেননা এই ভাবকল্প, যাকে আটপৌরে ভারতীয় অভিধায় বলা হয় ‘ভগবান’, তার রূপসংজ্ঞা জানা নেই কারোর। হিন্দু বাঙালির জনমানসে তিনি কখনও পরিবার বিশেষের ইষ্টদেবতা, কখনও বা তিনি পুজোর ঘরে বা ঘরের কুলুঙ্গিতে রাখা হিন্দুর দেবী-দেবতাদের নিরাকার জগাখিচুড়ি, কিংবা নিরীশ্বরবাদী হলে তাঁর কাছে ওই শব্দটা ফোঁপরা, অনেকের বাড়িতে আবার সোনা, পিতল, রুপোর গোপাল। ব্রাহ্মরা এই দার্শনিক ফাঁদ থেকে বেরোবার প্রয়াস করেছিলেন; রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘পিতার বোধ’। হিন্দু প্যাগান ইনফিডেল পরিবারে যে জন্মেছে তার পক্ষে, সে কারণে, নিজেকে অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হিসাবে চিহ্ণিত করাটা ঘোলাটে জলে স্বেচ্ছাকৃত হাবুডুবুর ফল। কলকাতায় দেখেছি, অমন পরিবারের লেখকদের যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘আপনি কি হিন্দু’, তাহলে অনেকে  ঘাবড়ে যান, উত্তর দিতে আমতা-আমতা করেন। কেন এরকম জবড়জং মনস্হিতি তৈরি হয়, তা জরিপ করে আত্মসমীক্ষা করেন না। তাঁদের ‘বোধ’ বোধহয় বোধাতীত।

ভাবকল্প হিসাবে গড বা ঈশ্বর আছেন না নেই, সেসব যুক্তিতক্কোর সঙ্গে আমার একাকীত্ববোধের সম্পর্ক নেই। এই গদ্যের শিরোনামের এলাকা নিয়ে কথা বলছি। আমার একাকীত্ববোধ কোনো একটি বিশেষ চাহিদার চাপে তৈরি হয়নি। আমি এই লেখাটা লিখতে বসেছি, শুনতে বোকামি মনে হলেও, এই আত্মভালোবাসা-বোধের অসহ্য আচ্ছন্নতা বুঝে ওঠার জন্য।  ভান করি, কিন্তু কোনো ব্যাপারেই ‘উদাসীন’ আনন্দ বোধ করি না, অথচ দুঃখে ডুবে থাকার মতো, বাবা ও মায়ের মৃত্যুর পর,  কোনো ঘটনা ঘটেনি বহুকাল যাবত। কেউ যখন জানতে চান, ‘কেমন আছেন’, তখন তার উত্তরে বলি, ‘এক-একজন ডাক্তারের কাছে এক-একটা অঙ্গ জমা রাখতে হয়েছে’ , মানে, মগজের কথাটা ফাঁস করি না, দেহের কথা দিয়ে চাপা দিই। আসলে আমি সুস্পষ্টভাবে জানি না আমি কেমন আছি। যিনি অমন প্রশ্ন করেন, তিনি নিজেও বলেন, ‘চলে যাচ্ছ।’ ‘মনখারাপ’ কিংবা ‘মন ভালো নেই’  অভিব্যক্তিগুলোও ফালতু মনে হয়।

মৃত্যু সম্পর্কে, এই বয়সে যে মানসিক ভীতি অনেকের হয়, তাও আমার দেখা দেয়নি এখনও। আমার ভীতিটা অসুস্হ হবার, হাসপাতালে ভর্তি হবার। বেশ কয়েকবার আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে সময় কাটাতে হয়েছে। এখন মনে হয়   একাকীত্ববোধের সঙ্গে নিঃসঙ্গতার অনুবোধের মিশ্রণে গড়ে-ওঠা অবস্হাটা সহজাত, অন্তর্মুখ, স্বকীয় আত্মজ্ঞানের স্বনির্মিত ডামাডোল-কারাগার, উন্মাদ প্রেমে আটকে কিশোরের ব্যাখ্যাহীনতার মতন; আমি যেন পুনরুদ্ধারের অযোগ্য কোনও আত্মপরিসরে হারিয়ে গেছি, আমি চাই না যে আমাকে কেউ খুঁজে পাক। আমি নিজের বানানো স্বপ্রেমের বেদনাময় জেলখানা থেকে বেরোবার চেষ্টা করি,  কয়েকদিনের জন্য বেরোই, আবার একাকীত্ববোধ আর নিঃসঙ্গতার অনুবোধ ঘিরে ধরে আমাকে। অথচ  আমি তো নিঃসঙ্গ নই, সত্তর বছর বয়সী আমার স্ত্রী রয়েছেন আমার সঙ্গে। কিন্তু তিনিও, কি ক্ষমাহীন ট্র্যাজিক অবস্হা, আক্রান্ত হয়ে রয়েছেন দিনানুদৈনিকের উদাসীনতায়।

ফেসবুকের অধিবাস্তব জগতে তৈরি মানব-সম্পর্কের মাধ্যমে একাকীত্ববোধ ও নিঃসঙ্গতার অনুবোধ দূর করার প্রয়াস করে দেখেছি; পাঁচহাজার বন্ধুর কেউই তো বাস্তব নয়, রক্তমাংসের নয়। আর যে মলয় রায়চৌধুরীকে সেখানে উপস্হাপন করি, সে তো আমি নই; সে তো নির্মিত একটি প্রতিস্ব, যার জন্য মলয় রায়চৌধুরী অবন্তিকা নামে একজন তরুণীর প্রতিস্ব সৃষ্টি করতে বাধ্য হয়েছে, যে যুবতী, আমার অভিজ্ঞতায় সংগ্রহ করা বহু যুবতীর প্রতিস্বের অভ্রকণা। তাছাড়া রক্তমাংসের মানুষ তো রয়েছে আশে-পাশে, কই কোনো রদবদল তো ঘটছে না আমার ও আমার স্ত্রীর নিজের-নিজের সন্ত্রস্ত আত্মবোধে!

আমার মনে হয়, ব্যক্তির নিঃসঙ্গতার অনুবোধের সঙ্গে একাকীত্ববোধের পার্থক্য হল যে নিঃসঙ্গতার স্হিতি স্বীকার করে নেয় যে ব্যক্তি এককের চারিপাশে প্রচুর লোকজন রয়েছেন, কয়েকজন স্বজনও রয়েছেন; মানে সেই স্হিতি সাময়িক, তাকে বদলে ফেলা যায়, অন্যান্য লোকজনের সঙ্গে অর্থবহ যোগাযোগের মাধ্যমে। সেকারণে অনেকে বলে থাকেন, “আমাকে প্লিজ একটু একা থাকতে দিন!”  নিঃসঙ্গতার রসায়ন ব্যক্তিএককের বাইরের। এমনকি, ব্যক্তিএকক নিঃসঙ্গতার প্রচ্ছন্ন জখম উপভোগ করতে পারে; সৃষ্টিশীল হয়ে উঠতে পারে। একাকীত্ববোধকে সে আনন্দের অর্থে উপভোগ করতে পারে না, তা আত্মপ্রেমের ফাঁসির দড়িতে গলা ঢোকাবার দরুণ যন্ত্রণাদায়ক, দূর্দশাসৃষ্টিকারী, হাহাকারময়।  গৌতম বুদ্ধ, মহাবীর, এনারা নিঃসঙ্গতার স্বকীয় আনন্দ গড়ে এনলাইটেনড হয়েছেন; নিজেদের অভিজ্ঞতাকে অন্যান্যদের মাঝে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন।  নিঃসঙ্গতার ক্ষমতা আছে ব্যক্তিএককের জীবনকে মঙ্গলময় করে তোলার। স্হায়ী ছিল তাঁদের বোধ।



একজন ভাবুকের একাকীত্ববোধের স্হিতি ব্যক্তিএককের বাইরের নয় বলেই মনে হয়; তা ব্যক্তিএককের রসায়নে গড়ে ওঠে, এক কালোগহ্বর। একা আলাদা হয়ে বসে  থাকার ব্যাপার নয় একাকীত্ববোধ। একাকীত্ববোধ হল ফোঁটায়-ফোঁটায় সঞ্চারিত উপলব্ধি, বিপত্তিমূলক উপলব্ধি। কৈশোর থেকে ঘটা বাইরের সাময়িক নিঃসঙ্গতাগুলোর সঙ্গে আমার পরিচয় আছে, আর সেগুলো স্মৃতিকে খামচে  ঘায়ের মতন রয়ে গেছে, যা মাঝে-মাঝে জ্বালা করে। বাইরের এই জন্য বলছি যে সেসব নিঃসঙ্গতা ছিল সম্পর্কজনিত। ওই আত্মভঙ্গুর ঘটনাগুলোর কথা আমি মাঝে-মাঝে রোমন্হন করে কিংবা লিখে নিরাময় খুঁজি, সেগুলো আমার কল্পনা-উপজাত নয়।

প্রথম যে ঘটনাটা আমার মনে আছে তা হল পাঁচ বছর বয়সে আমাকে ইমলিতলার  একটা ঘরে শেকল তুলে বিকাল থেকে বন্ধ করে রেখেছিলেন মা, পাড়ায় কপিলের বাবা আমায় তাড়ি খাইয়ে দিয়েছিলেন; ইমলিতলার অন্যান্য বিহারি বাচ্চাদের সঙ্গে আমিও কয়েক ঢোঁক খেয়েছিলুম, আর তাড়ির গন্ধে ধরা পড়ে গিয়েছিলুম। তাড়ি খাবার জন্য মা শাস্তি দেননি, দিয়েছিলেন যাতে আমি মেজদার মতন চুরি-ডাকাতি-মারপিটের পথে না যাই। দাদা-মেজদার সঙ্গে তাড়ি আমি ইমলিতলায় বিয়ে কিংবা উৎসব ইত্যাদিতে অনেকবারই খেয়েছি। ইমলিতলায় বিজলিবাতি ছিল না। অন্ধকার ঘরে রাত দশটা পর্যন্ত একা বসেছিলুম এককোণে। বাবা রাতে কাজ থেকে ফিরলে শেকল খোলা হয়েছিল। হয়ত এই ঘটনার চাপে আমি ক্রমশ অমিশুকে, হিন্দু-নাস্তিক, অন্তর্মুখ, অন্তেবাসী, সীমালঙ্ঘনকারী, দ্রোহী হয়ে গিয়ে থাকব। গ্রন্হকীট হয়ে গিয়ে থাকব। আত্মসন্ত্রস্ত থাকার উদ্বেগ ও উৎকন্ঠার বীজ পোঁতা হয়ে গিয়ে থাকবে অস্তিত্বের রসায়নে।

১৯৫১ সালে রামমোহন রায় সেমিনারি স্কুলে শাস্তি পেয়ে সারাদিন ঠায় একা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল, স্কুলেরই অফিসঘরে, কেরানিবাবুর দৃষ্টির সামনে, দেয়ালে হেলান দেবারও অনুমতি ছিল না। স্কুল ছুটি হয়ে যাবার পর বিভিন্ন ক্লাসের  ছেলেমেয়েরা চলে গিয়েছিল, সন্ধ্যাও নেমে এসেছিল, শীতের সন্ধ্যায় অন্ধকারও ঘনিয়ে আসছিল, কেরানিবাবু চলে গিয়েছিলেন, একাই দাঁড়িয়েছিলুম, তারপর হেডমাস্টার ক্ষেত্রমোহন পোদ্দার স্কুল-সংলগ্ন কোয়ার্টার থেকে এসে বাড়ি যাবার অনুমতি দিলেন। ব্রাহ্মস্কুল রামমোহন রায় সেমিনারিতে পড়ার আগে আইরিশ নানদের পরিচালিত কনভেন্ট স্কুলে প্রাইমারি স্তর পর্যন্ত পড়েছিলুম; সেখানের নানরা কখনও একা বোধ করতে দেননি, যদিও ইংরেজিতে সড়গড় হতে বছরখানেক লেগে গিয়েছিল। সেসময়ে, ইংরেজিতে কথা বলতে না পারার নিঃসঙ্গতাবোধ থেকে থাকবে, যা আমার মনে নেই, কেননা তিনবছর বয়সে কনভেন্টে ভর্তি হয়েছিলুম, সপ্তাহে একদিন সংলগ্ন চার্চে গিয়ে বাইবেল ক্লাসে হাতজোড় করে অংশ নিতে হতো।

পিছন ফিরে যে মেয়েটিকে আজ  প্রেমিকা বলে চিহ্ণিত করতে পারি, সে, স্কুলেরই সহপাঠিনী, আমি যখন কলেজে ঢুকলুম, একটা দীর্ঘ চিঠি লিখে উধাও হয়ে গিয়েছিল ওর মায়ের সঙ্গে। প্রেমহীনতার নিঃসঙ্গতায় হয়ে গিয়েছিলুম বিপর্যস্ত। শৈশবের উদ্বেগ উৎকন্ঠার বীজ অঙ্কুরিত হবার মাটি পেয়ে গিয়েছিল প্রাক-যৌবনের এই ব্যর্থতাবোধে। এই ঘটনার ফলে, আমার ইনটারমিডিয়েটের (এখনকার উচ্চমাধ্যমিক) ফলাফল প্রত্যাশা অনুযায়ী হয়নি। সেই ক্রুদ্ধ স্মৃতি বয়েছি স্নাতকস্তর পর্যন্ত, আরেকটি যুবতীর সংস্পর্শে আসার আগে অব্দি। কিন্তু প্রথম জনকে ভুলতে পারছিলুম না বলে আকাঙ্ক্ষার নিঃসঙ্গ আকুলতায় আক্রান্ত হয়েছিলুম। স্কুলের শাস্তিও ছিল অন্যান্য সহপাঠীদের টিটকিরি থেকে তাকে আড়াল করার প্রয়াসে মারামারির দরুন। সেটিই আমার জীবনে প্রথম ও শেষ মারামারি। স্কুল আর  কলেজের ফাঁকটুকুতে আমি বন্ধু তরুণ শূরের সঙ্গে বেশ কয়েকবার বাড়ি থেকে না বলে পালিয়েছি, নিষ্কপর্দক, এক কাপড়ে; পালিয়ে বেড়াবার সময়ে আমরা পরস্পরের সঙ্গেও তেমন কথাবার্তা বলতুম না।

কবিতা লেখার অপরাধে, ১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হলুম, রাস্তা দিয়ে হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে থানায় নিয়ে গিয়ে পেচ্ছাপ-ভাসা লকআপে পোরা হল, আর পরের দিন ওই ভাবেই হাতকড়া-দড়িতে কয়েকজন চোর-ডাকাত-খুনির সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হল। বাবা-মা আত্মীয়স্বজন সকলেই ছিলেন আমার লেখালিখির সমর্থনকারী, আমার জন্য তাঁদের উদ্বেগ ছিল স্পষ্ট, তবু একা বোধ করেছিলুম, রাস্তা দিয়ে পরিচিত লোকজনদের সামনে হাঁটার সময়, অন্ধকার লকআপে সারাটা রাত কাটাবার সময়। কোমরে দড়ি বেঁধে যখন আমায় প্রাতঃকৃত্য সারতে পাঠানো হল তখন। ইমলিতলার ছোটোলোক পাড়ায় শৈশব কাটিয়ে থাকলেও, আমার নিম্ন-মধ্যবিত্ত বাঙালি সংবেদনায় ঘটনাটি ছিল একাকীত্ববোধ উৎসারণের জলবিভাজক।

গ্রেপ্তার হলুম বলে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করে দিল অফিস। সহকর্মীরা আমার সঙ্গ ছেড়ে দিল। ঘিরে ধরল সন্ত্রস্ত নিঃসঙ্গতা। মামলার সময় কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। দিনে কোথায় খাবো, রাতে কোথায় শোবো, এই দুশ্চিন্তা থেকে জন্মেছিল দূরত্বের একান্ত। তখনকার দিনে সাসপেন্ড হলে বেশ কিছুকাল মাইনে আটকে থাকত, তারপর দেয়া হতো কেবল বেসিক পে। একমাত্র থাকার জায়গা ছিল উত্তরপাড়ায় আমাদের বসতবাড়ির খণ্ডহর, বিজলিবাতিহীন যে বিশাল  বারোটি ভুতুড়ে ঘরের পোড়ো বাড়িতে ঠাকুমা একা থাকতেন, অত্যন্ত গরিব  কয়েকঘর ভাড়াটের সঙ্গে। দাদা সমীর রায়চৌধুরীও গ্রেপ্তার হয়েছিলেন একই মামলায়। দাদার গ্রেপ্তার হবার সংবাদে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে গ্রেপ্তারির তিন দিনের মাথায় মারা গেলেন ঠাকুমা। কলেজে পড়ার সময় দাদা উত্তরপাড়ার বাড়িতে ঠাকুমার সঙ্গে থাকতেন; দাদাকে সবচে বেশি ভালোবাসতেন ঠাকুমা, কেননা বড়জ্যাঠা আর মেজজ্যাঠার ছেলে হয়নি, ঠাকুমার কাছে দাদাই ছিলেন পরিবারের প্রথম বংশধর। বাড়িতে ঠাকুমার কাছেই সব কিছু খোলাখুলি আলোচনা করতে পারতুম। যখন তাঁকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তখনই মারা গেলেন তিনি । ‘লস’ শব্দটার বাংলা প্রতিশব্দ কী? মগজের মধ্যে ‘লস’-বোধ, একে কি নিঃসঙ্গতা বলব?

১৯৬৫ সালে যখন জানতে পারলুম যে কয়েকজন হাংরি আন্দোলনকারী মুচলেকা লিখে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছেন, আগের প্রজন্মের কয়েকজন কবি আমার বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষের সাক্ষী হয়েছেন, তখন আক্রান্ত হয়েছিলুম ‘একঘরে’ হয়ে যাওয়ার নিঃসঙ্গতায়। মামলা চলার সময়ে আদালতঘরের কয়েদি-খাঁচায় পিঠ দিয়ে দাঁড়াবার সময়গুলোয় বড়ো পরিত্যক্ত বোধ করতুম, ‘ফেরারিত্ব’ বললে মানায়, যদিও অনেকসময়ে বাবা, পিসেমশায়, দাদা ও কয়েকজন বন্ধু আসতেন কেস ওঠার দিনে। অধিকাংশ কবি ও লেখক আমাকে এড়িয়ে যেতেন; তাঁদের কাছে আমি ছিলুম জলচলহীন। কফিহাউসে কোনো টেবিলে বসতে গেলে অন্যান্যরা উঠে চলে যেতেন। খালাসিটোলাতে বসে একাই, এক-আধদিন মদ খাচ্ছি, কেউ ভাবতে পারে? তখনকার দিনে সরকারি দোকানে গাঁজা-চরসের পুরিয়া সস্তা ছিল - কেবল তা-ই একা ফোঁকা যেতে পারত। ব্যক্তিগত নিঃসঙ্গতা থেকে ছাড়ান পাবার প্রয়াসে সাহায্য করত ফুসফুসে গাঁজা-চরসের ধোঁয়া আর লিভারে মদের প্রলেপ।




আদালত সাজা দিল। এই নিঃসঙ্গতা বুঝিয়ে বলতে পারব না। কাছের বন্ধুরাও, হাতে গোনা দুতিনজন ছাড়া, সরে গেলেন; ভেন্ন করে দিলেন আমায়, এমনকী তাঁরা বিরোধী হয়ে উঠলেন। আমার সঙ্গে সম্পর্ক তাঁদের সাহিত্যিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার পক্ষে ক্ষতিকর মনে করতেন তাঁরা। বন্ধুত্ব হল সবচেয়ে বড়ো মূর্খতা। অথচ মূর্খতা,  অজ্ঞানতা, অসতর্কতা, বিভ্রান্তি, বিমূঢ়তা, হতাশা ছাড়া যাপন পানসে। অন্যদের সঙ্গে বসবাস করতে গেলে চাঞ্চল্য, বিক্ষোভ, অসন্তোষের অনিন্দ্যসুন্দর মূল্য  দিতেই হবে। কবির নিয়তি বলব একে?

হাইকোর্টে মামলা চলাকালীনই, কেস সাবজুডিস থাকা সত্ত্বেও, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় মকদ্দমার পক্ষে ক্ষতিকর সম্পাদকীয় লিখেছিলেন।  ব্যারিস্টার আমাকে তাতিয়েছিলেন ‘কনটেম্পট অব কোর্ট’ নোটিস জারি করাতে, কিন্তু তা ছিল আমার কাছে অকল্পনীয়। তারপর থেকে কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। হাইকোর্টে রিভিশন পিটিশন করে জিতে যাবার পর মামলা থেকে নিষ্কৃতি পেলুম বটে, কিন্তু ততদিনে লেখকবন্ধুরা প্রায় সবাই পৃথগন্ন করে দিয়ে ছেড়ে চলে গেছেন। অপূর্ণতাবোধ এবং গভীর নিঃসঙ্গতা ও অন্তর্মুখীনতা ঘিরে ফেলল লেখক মলয় রায়চৌধুরীকে; উদ্বেগ-উৎকন্ঠা তাদের ডালপালা বিস্তার করে ফেলল। নানারকম ক্লান্তিকর সম্পর্কজালের অসন্মানজনক জটিলতা আর বিপদাশঙ্কা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া জরুরি হয়ে উঠেছিল। বিপদের প্রশ্ন নেই, তবু অজানা সর্বনাশের  আশঙ্কায় ভুগতুম।

বেনারসনিবাসী চিত্রকর বন্ধু করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের ডাকে, মনমেজাজ ফেরাতে চলে গেলুম প্রথমে বেনারস, তারপর নেপালের কাঠমাণ্ডুতে, যেখানে গিয়ে একটা বিশাল কাঠের বাড়িতে হিপি-হিপিনীদের কলোনিতে, নানারকম মাদক, ধেনোমদ আর কাঁচামাংস খেয়ে, সাময়িক আন্তঃসম্পর্কের মাধ্যমে, নিঃসঙ্গতাকে ভুলে থাকার উপায় বের করে ফেললুম। নেপালের কবি-লেখকরা আর হিপি-হিপিনীরা ছিল দরাজ। অন্যের অর্থানুকুল্যে যতদিন থাকা যায়, সময় কাটিয়ে, স্বাস্হ্যের অবনতি ঘটিয়ে, আবার ফিরতে হল সেই কল্পিত সর্বনাশের আসন্ন ঘুর্ণির পাকে। বইপড়া হয়ে উঠল প্রধান আশ্রয়।

ধাপে-ধাপে এমন নির্জনতায় নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত হয়েছিলুম যে মানসিক ক্লান্তির চাপে লেখালিখিই ছেড়ে গেল। বা বলা যায় যে নিঃসঙ্গতার অনুবোধজনিত স্হিতির বিরুদ্ধে সংঘর্ষ, যা আমায় কুরে খেয়ে ফেলছিল, তা এড়াবার জন্যই ছেড়ে গেল লেখালিখি। এই সময় আমার পরিচয় হল মধ্যপ্রদেশের রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় সলিলা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আঁকড়ে ধরার মতন পেলুম একজনকে, আর ১৯৬৮ সালে, মাত্র তিন দিনের তুই-তোকারি পরিচয়ের শেষে, বিয়ে করলুম। আগের যাবতীয় নিঃসঙ্গতাবোধের গোপন ফোঁপানি থেকে বেরোবার জন্য, শান্তিতে নিরিবিলি পরিবেশে বসবাসের উদ্দেশে বদলি নিয়ে পাটনা থেকে চলে গেলুম লখনউ। ছেলে আর মেয়ের সঙ্গে বেশ ভালোই কেটে গেল বহুদিন। চাপা পড়ে রইল উদ্বেগ-উৎকন্ঠাজনিত নিজেকে নিয়ে গড়ে ওঠা সমস্যাগুলো। পাটনা আর কলকাতায় যাওয়াই বন্ধ করে দিয়েছিলুম। অফিসের কাজে যেতে হলে হোটেলে উঠতুম, আত্মীয়স্বজন এবং পূর্বপরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা করতুম না; পশ্চিমবঙ্গের  মফঃস্বলে কোনো তরুণ আমায় মলয় রায়চৌধুরী বলে সন্দেহ করলে হিন্দি-উর্দুর আশ্রয় নিয়ে, আত্মপরিচয় অস্বীকার করে, পাশ কাটিয়ে যেতুম। ট্যুরে তাই সম্পূর্ণ নাম ব্যবহার করতুম না, এম আর চৌধারি বলে পরিচয় দিতুম। দাড়ি-গোঁফ বাড়িয়ে, আইডেনটিটি পালটে ফেলেছিলুম। লেখালিখি সম্পর্কে কোনো আগ্রহকে প্রশ্রয় দিতুম না। লেখালিখি ছেড়ে যাবার দরুন প্রচুর পড়াশোনা করার সুযোগ হবেছিল আর দাদা ‘হাওয়া৪৯’ পত্রিকা প্রকাশ আরম্ভ করলে সেই পড়াশোনা কাজে  দিয়েছিল। নিজেকে লুকিয়ে ফেলার কারণ মনের গভীরে নিঃসঙ্গতার ভীতি স্হায়ী করে দিয়েছিল উদ্বেগ-উৎকন্ঠাকে। স্ত্রীকে ট্যুরে সঙ্গে নিয়ে যেতুম শাকিলা নাম দিয়ে, কেননা স্ত্রীও ভালো হিন্দি-উর্দু বলতে পারে।

লখনউতে মা মারা গেলেন। এই মর্মান্তিক অবস্হায় আমার চেয়ে বয়সে দেড় দশক ছোটো অবাঙালি একজন অধস্তন মহিলা অফিসার আমার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বিপদ বাড়িয়ে দিলেন। আমি তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে বাধ্য হলুম। কিছুকাল পরে উনি আত্মহত্যা করেছিলেন, যে ঘটনার জন্য আমার সব সময় মনে হয় যে আমিই দায়ি; এ আরও ভয়ানক অস্বস্তিকর বেদনাময় মনঃস্হিতি। লখনউয়ের এই নতুন ধরনের বিপজ্জনক অন্তর্মুখীনতা কাটাতে, যা ঠাকুমা ছাড়া কারোর সঙ্গে আলোচনা  করা সম্ভব ছিল না, করিনি কখনও, নিজেকে নিজে ভয়-পাওয়া এড়াতে, আমি বদলি নিয়ে লখনউ থেকে চলে গেলুম মুম্বাই, সে-শহরের অতিব্যস্ত ভিড়ে হারিয়ে থাকার অভিপ্রায়ে। মা মারা যাবার পর লেখালিখি আবার ফিরে এলো; মায়ের অনুপস্হিতিকে কাটিয়ে তোলার উপায় হিসাবে, হয়তো। গ্রন্হকীট হবার কারণে, এবং ট্যুরে প্রচুর অভিজ্ঞতার দরুণ, মগজে এত কথা জমে গিয়েছিল যে সেগুলো কাগজের পাতা ছাড়া আর কাউকে  বলা যেত না; এই প্রক্রিয়াকে বোধহয় সাহিত্যকর্ম বলা যাবে না।  ঠাকুমার আর মায়ের অনুপস্হিতি বিষণ্ণ করে তুলতো।

তাড়ি খেয়েছিলুম বলে ছোটোবেলায় মা শাস্তি দিয়েছিলেন। নতুনভাবে লেখালিখি শুরু করে আমি নতুনভাবে প্রচুর মদ আর সিগারেট খাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে উঠলুম, এবং তা একা বসে । লখনউ-এর সময় থেকে আমি অনেকের সঙ্গে বসে মদ খাওয়া  এনজয় করতে পারি না; মদ্যপান ব্যাপারটা আমার প্রিভেসির অঙ্গ; তার সঙ্গে লেখালিখির কোনো সম্পর্ক নেই। হয়তো নেশা করার মাধ্যমে মায়ের সঙ্গে যোগাযোগের প্রয়াস ছিল মদ্যপান। সত্তর পেরিয়ে অবশ্য কখনও-সখনও আবসাঁথ ও সিঙ্গল মল্ট ছাড়া আমি খাই না বিশেষ। তাও ছেলে যখন বিদেশ থেকে আসার সময়ে আনে।

মুম্বাইতে থাকার সময়ে সর্বভারতীয় ট্যুরের সুযোগ পেলুম। ভারতের প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জে ঘোরাঘুরি।  মেয়ের বিয়ে হবার পর সে বিদেশে চলে গিয়েছিল; ছেলে চলে গিয়েছিল হস্টেলে, তারপর বিদেশের চাকরিতে। অফিসের ট্যুরে আমার স্ত্রীকেও সঙ্গে নিয়ে যেতুম অনেক সময়ে, যাতে ও বাড়িতে নিঃসঙ্গ বোধ না করে। চাকুরিসূত্রে, ট্যুরের সূত্রে, হাজার-হাজার মানুষের মাঝে গিয়ে পড়েছি, তবু সর্বনাশের ঘুমন্ত উদ্বেগ-উৎকন্ঠার বোধ আচমকা উঁকি দিয়েছে কখনও-কখনও।  এরকম মনে হয়নি যে আমি এলিয়েনেটেড; যাপনে পার্থক্যবোধ কাজ করেছে বলে মনে হয় ন। মনে হয়েছে, এবার কিছু একটা নির্ঘাৎ ঘটবে, ভয়ানক কিছু ঘটতে চলল, যা অপ্রত্যাশিত তা-ই ঘটে গিয়ে আতঙ্কে ঘিরে ফেলবে আমাকে।

নিরাময় হিসাবে দাদার কাছেপিঠে থাকব অনুমান করে মুম্বাই থেকে কলকাতা অফিসে বদলি নিলুম, বিভাগীয় প্রধান হিসাবে, পশ্চিমবাংলার গ্রামীণ মানুষের জীবনকে কাছ থেকে জানবার লোভে। কলকাতায় কবি-লেখকদের কয়েকটা জমায়েতে অংশ নিয়ে বুঝতে পারলুম যে আমার নিজস্ব চিন্তার পরিসরে এই ধরনের  জমায়েতগুলো বিরক্তিকর, আমার পক্ষে বড়ই গোলমেলে, অস্বস্তিকর, মানসিক অশান্তি-সৃষ্টিকারী, মনোযোগ-ভঙ্গকারী, নিরাশাজনক, মরচে পড়া হাসির মানুষদের জমঘট। আত্মনিরীক্ষায় বসে অবাক হলুম যে এই সমস্ত জমায়েতগুলোয় অংশ নিয়ে আমি প্রকৃতপক্ষে  সর্বনাশের আশঙ্কা থেকে বেরোতে চেষ্টা করেছি, অথচ সেগুলো আমাকে আরও বেশি নিঃসঙ্গ করে তুলেছে। ভাবতুম যে আমি কি শেষে ড্যানিয়েল ডিফোর ‘রবিনসন ক্রুসো’ হয়ে গেলুম? বা মার্সেল প্রুস্তের ‘সোয়ান্স ওয়ের’ চরিত্র হয়ে গেলুম? ‘কাস্ট অ্যাওয়ে’ ফিল্মের টম হ্যাঙ্কস? নানা আত্মআরোপিত দুশ্চিন্তা এবং নিজেকে গুটিয়ে নেবার প্রক্রিয়ায় দু’বার হৃদরোগে আক্রান্ত হলুম, অ্যানজিওপ্লাস্টি করাতে হল, এবং চিকিৎসাবিভ্রাটে আমার আরথ্রাইটিস হয়ে গেল, যা থেকে সম্পূর্ণ মুক্তি পাইনি, এবং যা আমার লেখালিখির অন্তরায় হয়ে দেখা দিল। একমাত্র কেদার ভাদুড়ীকে দেখে সুস্হ বোধ করতুম, কেননা উনিও আঙুলের সমস্যায় লিখতে পারছিলেন না; একজন যুবককে ডিকটেশান দিতেন; বলতেন, যদি দরকার পড়ে তাহলে পায়ের আঙুলে ডটপেন ধরে লিখবেন।

গুটিয়ে নিয়ে আরও সামাজিকতা-বহির্ভূত হয়ে নিজের অনুভূতি নিজের ভেতরে লুকিয়ে ফেলার কৌশল আয়ত্ব করে ফেললুম। আরথ্রাইটিসের জন্য লেখকীয় কষ্ট লাঘবের নানা উপায় বাতলাতেন অনেকে, কিন্তু সেগুলো কোনোটাই গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারলুম না। লেখক-কবি যাঁরা আসতেন তাঁরা বলিয়ে-কইয়ে না হলে চুপচাপ বসে সময় কাটাতে হতো। কেউ-কেউ বলতেন, কাউকে সামনে বসিয়ে ডিকটেশান দিন। সমস্যা ছিল যে আমি চাইতুমই না যে কেউ একজন আমার সামনে বসে থাকুক। আরথ্রারাইটিসের কারণে আমাকে ফিজিওথেরাপির যোগব্যায়াম করতে হয়; সেই সূত্রে ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছিলেন যে আমি যেন মেডিটেশান করি। মেডিটেশান করতে বসে আমার মন একাগ্র হবার পরিবর্তে আরও সন্ত্রস্ত একাকীত্ব চাপিয়ে দিল আমার মগজে। তা কিন্তু অনীহা নয়। আমি এমন-কিছু নই, কিন্তু আমি যা আমি তা-ই, তো কীই বা করা যাবে!



স্মৃতিবাহিত তূষ্ণীভূত বোধের ভারে বোবা হয়ে থাকার অভ্যাস হয়ে গেল। সামনাসামনি মুখোমুখি যোগাযোগের প্রতিকল্প হয়ে উঠেছে আমার লেখালিখি। বিষণ্ণ নিঃসঙ্গতার সঙ্গে মিশে সন্ত্রস্ত একাকীত্ববোধ নিয়ে নিল নতুন রূপ। কলকাতা থেকে আবার ফিরে এসেছি মুম্বাই। ইনটারনেটকে, ফেসবুককে, ব্যবহার করার চেষ্টা করি, একজন নির্মিত মলয় রায়চৌধুরীকে উপস্হাপন করি, কিন্তু ব্যাস, যতক্ষণ কমপিউটারের সামনে বসি, ওই সময়টুকুই; তারপর যেমনকার তেমন। আরথ্রাইটিস লেখালিখির অন্তরায় হয়ে উঠেছিল বলে বার্ধক্যে আমি কমপিউটার রপ্ত করতে বাধ্য হয়েছি; এক আঙুলে টাইপ করে অদৃশ্য লেখক ও সম্পাদকের সঙ্গে অধিবাস্তব যোগাযোগ গড়ে তোলার প্রয়াস করি। সে সম্পর্ক কাচের কমপিউটার-পর্দায় সীমিত। আমার এই স্হিতিকে ডিপ্রেশান বলব না। লেখক উদয়ন ঘোষ, যিনি কলকাতায় আমার নাকতলার বাসার কাছে থাকতেন, তাঁকে দেখেছি অসুস্হতার জন্য লিখতে পারছেন না বলে অনপনেয় ডিপ্রেশানে ভুগছেন, চিকিৎসার যন্ত্রপাতিতে ঘেরা বিছানায় অদৃশ্য লিলিপুটদের দড়িতে বাঁধা গালিভার  শুয়ে আছেন।

মুম্বাইতে দেখি গুজরাতি বুড়ো-বুড়িরা কোথাও একত্রিত হন, গল্প আর হাসাহাসি করেন, মেলামেশা করেন। আমি তা পারি না। এই না-পারার উদ্বেগজনিত উৎকন্ঠায় নিজেই নিজেকে কোণঠাসা করে ফেলেছি। বাজার যাই, অটোয় চাপি, ভিড়ের ভেতর হাঁটি, কিন্তু একা থাকতে ভালোলাগার দরুণ আমার আত্মিক বিপন্নতা আরও চেপে ধরে। এ হল সদ্ভাবহীন ব্যথা, অপ্রীতিকর পীড়া, আত্মিক শাস্তি-যন্ত্রণা, যার কোনো পেইনকিলার নেই। নিগূঢ় অনাসক্তিতে ভুগি। ভুগছি যে, তা টের পাই। বুঝতে পারি যে নেগেটিভ ভাইব ঘিরে রেখেছে আমাকে যার উৎস আমি নিজে, তা কাটিয়ে উঠতে পারি না। অথচ আমি মিস্যানথ্রপ নই। আমার হাঁপানি সারাতে যে বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়েছিলুম, তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ব্যাপারটা সম্ভবত জেনেটিকাল! ওনার বক্তব্য নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি, যদিও উনি আমার হাঁপানি নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করেছেন, যা কলকাতার বিশেষজ্ঞরা পারেননি। ঠাকুরমা আর মেজজ্যাঠার হাঁপানি ছিল।

আমি ডিপ্রেশনে ভুগি না; ডিপ্রেশন হল এমন মুড যা কাউকে সক্রিয় হতে দেয় না। তা লোকটার চিন্তা, আচরণ, অনুভূতি, প্রণোদনাকে প্রভাবিত করে। তা দুঃখের  কারণে, চিন্তা করার অসুবিধার কারণে, ঘুম না হবার কারণে ঘটতে পারে। সে লোকটা আশাহীনতা, আত্মহত্যার ইচ্ছা, নিরাশা, মনোভঙ্গে ভোগে। আহ্লাদ কাকে বলে টের পায় না। ডিপ্রেশনে মনোচিকিৎসা করাতে হয়।

মনে হয়, নিঃসঙ্গতাময় সর্বনাশের ভয়, যা মগজ থেকে তলপেট পর্যন্ত ভেসে বেড়ায়, ভাসা-ভাসা এই অস্হিরতা-অনিশ্চয়তা-অব্যবস্হিতচিত্ততা থেকে উৎপন্ন আমার সন্ত্রস্ত-একাকীত্ববোধ আরও নিদারুণ এবং দুর্বিসহ হয়ে গেছে। তা যেন আমার মগজের পোড়ো বাড়ির জবরদখলকারী বাসিন্দা। বিষণ্ণ নিঃসঙ্গতার অনুবোধ  থেকে যাতে বেরোতে পারি, এই আশায় মাস ছয়েকের  জন্য কলকাতায় গিয়েছিলুম ২০১৩ সালের বর্ষায়। তরুণ কবি-লেখক-সম্পাদকরা আসতেন; তাঁদের কাছে হয়তো আমি বোধাতীত রয়ে গেলুম।  নিঃসঙ্গতায় মোড়া একাকীত্ব কাটিয়ে উঠতে পারলুম না। চেতনায় ঘাপটি মেরে-থাকা অস্বচ্ছন্দ উপদ্রুতির নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাই না, যাকে চিহ্ণিত করে এই আত্মপরিসর থেকে বেরিয়ে যেতে পারব।  লেখালিখিকে উপায় মনে করে তাতে বেশিরভাগ সময় কাটাই, তার ফলে আরও পাকিয়ে যেতে থাকি চেতনার ঘূর্ণিতে। আমি যা ইচ্ছা, যেমনভাবে ইচ্ছা লিখি,  কাঁটাতারের পাক খুলে বেরোবার উদ্দেশে, কে কী বলল বা লিখল বড় একটা এসে যায় না তাই। সাহিত্য হচ্ছে কি হচ্ছে না সেসব গালগল্পকে মনে হয় ফালতু চিন্তা।

অ্যামস্টারডমে ভ্যান গগের মিউজিয়ামে তাঁর আঁকা পেইনটিংগুলো দেখতে-দেখতে বুঝতে পেরেছি, একাকীত্ববোধের সঙ্গে স্বাধীনতাবোধকে তিনি কেমনভাবে মিশিয়ে  ফেলার প্ররোচনায় উদ্বুদ্ধ ছিলেন। ভ্যান গগের কোনো ফোটো নেই। তিনি নিজেই নিজের একাধিক পোরট্রেট এঁকে না গেলে আমরা জানতে পারতুম না তাঁকে কেমন দেখতে ছিল। নিজের স্বাধীনতাবোধকে তিনি অকাট্য, সিদ্ধ, বৈধ, পর্যাপ্ত হিসাবে বলবৎ করে গেছেন। হাঁক পাড়ার আদিমতাকে দেখিয়ে গেছেন এঁকে। দেখিয়ে গেছেন, ব্যক্তিএকক তার নিজের একাকীত্ববোধের দরুণ নিজেই নিজের মালিক।

আরথ্রাইটিস সত্ত্বেও, একটা ড্রইংখাতা আর ক্রেয়নবাক্স কিনেছি, যথেচ্ছ আঁকব বলে, একাকীত্ববোধ আর নিঃসঙ্গতার অনুবোধকে ধরে রাখতে চাই। আঁকি শুনে একজন বিদেশিনী চিত্রশিল্পী রঙতুলির এবং কাগজের পুরো সেট কিনে দিয়ে গেছেন।





ফারহানা রহমান




নব্য-বাস্তববাদী চলচ্চিত্র এবং তার প্রভাব






চলচ্চিত্র এমন এক অভিনব শক্তিশালী সৃজনশীল অথচ বিনোদনধর্মী শিল্পমাধ্যম যেখানে সমসাময়িক সময়-ভাবনা, বাস্তবতা, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, ব্যক্তিমানুষের দুঃখ-দুর্দশা, আত্মিক-সংকট, মনস্তত্ত্ব, মানবধর্ম, দর্শন, জীবনের টানাপড়েন ইত্যাদি নানা ক্ষেত্র অন্তর্নিহিত থাকে। নির্মাণের নানা পর্বে এভাবেই দেশে দেশে চলচ্চিত্র বিকাশের ক্রমধারায় বিভিন্নরকম আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে আঁভাগার্দ, সিনামাভেরিতে, রিয়েলিজম, নিও-রিয়েলিজম, ডাডাইজম, ফ্রি ফিনেমা, অথর থিওরি, নুভেল ভাগেক্সপ্রেশনিজম, ইম্প্রেশেনিজম, ইরানি নিউ ওয়েভ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তবে এসব আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল মূলত ইতালির নিও-রিয়েলিজম বা নব্য-বাস্তবাদের মাধ্যমে। 

নব্য-বাস্তববাদী বা নিও-রিয়েলিজম পরিভাষাটি সর্বপ্রথম ইতালির সাহিত্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় ১৯৩০ সালের দিকে। বুর্জোয়া জীবনচর্চার শূন্যগর্ভ ও একঘেয়ে ক্লান্তিকর অস্তিত্ব, জীবনযাপন, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানবিক অবস্থা, স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার অবদমনের ফলে উদ্ভুত নিদারুণ মনঃকষ্ট – সবকিছুর বিরুদ্ধে সোচ্চার এক তেজদীপ্ত বিশ্লেষণধর্মী উপস্থাপনের এই শৈলীকে চিহ্নিত করার জন্য সর্বপ্রথম আরনাল্ডো বসিলি (Arnaldo Bocelli) ‘নব্য-বাস্তববাদী’ অভিধাটি ব্যবহার করেন। নয়া-বাস্তববাদী সাহিত্য ও চলচ্চিত্র, এই দুটো মাধ্যমেই নন্দনতাত্ত্বিক ও ভাবাদর্শিক দিক থেকে একই ধরনের উপাদানের প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়।


জ্যঁ রেনোয়া
এই ধরনের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, সস্তা সেন্টিমেন্টের ভেজাল গল্প বা বাস্তবতার বস্তাপচা গল্পের বদলে এমন ধারার ছবি বানানো হয় যেখানে মানবতায় মণ্ডিত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। ফুটে ওঠে  বুর্জোয়া সমাজের আপাত ঝলমলে পর্দার আড়ালে লুকানো জীবনের দুর্বল ক্ষত, অবক্ষয় আর পতনের দিকগুলি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির প্রতিকূল অর্থনীতি এবং নতুন ভাবাদর্শের প্রেক্ষাপটে  মূলত সৃষ্টি হয় নিও-রিয়ালিস্ট চলচ্চিত্রধারা। এই ধরনের চলচ্চিত্রে সমাজ বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে নানা মাত্রায়। চলচ্চিত্রকলার নিজস্ব প্রকৃতি এবং সমাজের উপর চলচ্চিত্রের প্রভাব কেমন হওয়া উচিত - এ নিয়ে ভেবেছেন এই ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতারা। দর্শকদেরও ভাবতে বাধ্য করা হয়েছে তাদের চারপাশের বাস্তবতাকে নিয়ে। শুধুমাত্র গল্প-উপন্যাসকেই এখানে চলচ্চিত্ররূপ দেওয়া হয়নি, বাস্তব ঘটনাকে চলচ্চিত্রের আধেয় করা হয়েছে। সমাজবাস্তবতার হতদারিদ্র্য অবস্থা, বেকারত্ব, ক্ষুধা, পতিতাবৃত্তি, আত্মহত্যা, নরহত্যা, চুরির ঘটনা, বিষণ্ণতা, আশাহীনতা ইত্যাদি বিষয়কেই মূলত এই ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এখানে প্রধান-অপ্রধান চরিত্রবর্গের মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে উপস্থিত করা হয়। ফলে, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তত্ত্বগত কারণে এই নিও-রিয়ালিজম দীর্ঘকাল স্মরণীয় হয়ে থেকেছে। এটি মূলত একটি শিল্পদর্শন। এই ধারার চলচ্চিত্রের আদর্শ হচ্ছে স্টুডিওর মেকি ও কৃত্রিম পরিবেশ ছেড়ে ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে,  জীবন যেমন রূপালি পর্দায় ঠিক তেমন করে তুলে ধরা। একইসঙ্গে এই ধরনের ছবিতে যুক্ত হয় শিল্পীর সহজাত মানবিকতা, ন্যায় ও সত্যের মূল্যবোধ,  জীবননিষিক্ত ভালোবাসার সহজ সরল গভীর প্রতিচ্ছবি। ব্যক্তিচেতনার জাগ্রত প্রকাশ, মানুষের জীবনের প্রাত্যহিক উত্থানপতন, মানবিক মূল্যবোধের নবমূল্যায়ন, উৎকেন্দ্রিকতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ – এই সবকিছুই ইতালীয় সিনেমার   নয়া বাস্তবতার অবদান হিসেবে দেখা হয়। এই ধরনের শিল্পকর্মের মধ্যে সমাজ সচেনতার সুগভীর  ছাপ যেমন দেখা গেছে, তেমনি লক্ষ্য করা গেছে নান্দনিক উৎকর্ষ। 


ভিসকন্তি
মূলত চল্লিশের দশককেই ইতালির নিও–রিয়ালিজম ফিল্ম মুভমেন্টের সময়কাল হিসেবে ধরা হয়। ফ্রান্সের চলচ্চিত্র নির্মাতা জ্যঁ রেনোয়া ‘ফ্রেঞ্চ পোয়েটিক রিয়ালিস্ট’ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৩৪ সালে টনি (Toni) নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যাকে চলচ্চিত্র বিশারদেরা ইতালীয় নব্য-বাস্তববাদের পূর্বলক্ষণ সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র বলে গণ্য করে থাকেন। এই ছবিটি নির্মাণের সময় ইতালির পরিচালক ভিসকন্তি রেনোয়ার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলেন। জ্যঁ রেনোয়ার টনি ছবিটি একটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। ঘটনাটি অনেকটা এরকম – এক ইতালীয় অভিবাসী বা  ইমিগ্রান্ট শ্রমিক ফ্রান্সে কাজ করতে আসে। সেখানে সে এক নারীর প্রেমে পড়ে এবং তাকে পাওয়ার জন্য একটি খুন পর্যন্ত করে বসে। রেনোয়া তার টনি ছবিটিতে অপেশাদার অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে ছবিটা করেছিলেন এবং প্রামাণ্য লোকেশনে অরিজিনাল সাউন্ডট্রাক ব্যবহার করে শুটিং করেছিলেন। ফ্রান্সের কাব্যিক বাস্তববাদের ভিতরে যে সামাজিক ও দুঃখবাদী বাস্তববাদ প্রবহমান ছিল, ইতালীয় নব্য-বাস্তববাদের সঙ্গে তার এক ধরনের সঙ্করীকরণ হয়েছে। 

ইতালির এই নব্য-বাস্তববাদী চলচ্চিত্রধারার আরম্ভরেখা হিসেবে ধরা হয় ভিসকন্তির Ossessione (১৯৪২) চলচ্চিত্রকে। চলচ্চিত্র সমালোচকরা যদিও রবার্তো রোজেলিনির রোম, ওপেন সিটি (১৯৪৫)-কে নব্য-বাস্তববাদীধারার প্রথম সার্থক চলচ্চিত্র বলে গণ্য করে থাকেন। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণা ও মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখানো হয়েছে। এ ছবিটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মুহূর্তে জার্মান অধিকৃত ইতালির সমাজবাস্তবতায় প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কয়েকজন মানব-মানবীর প্রেম, সাহস ও আত্মত্যাগ উপস্থাপিত হয়েছে। কয়েকটি উপাখ্যান জুড়ে তৈরি এই ছবিতে নানা চরিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে জাতীয়তাবাদ, অস্তিত্ববাদ, নীতিবাদ ও খৃষ্টধর্মকে। এর মুল উপাদান হচ্ছে শুভর সাথে অশুভর দ্বন্দ্ব। অশুভর পরাজয়য়ের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের জয় হয়। প্রামাণ্য লোকেশন এবং শুটিংয়ের বিশদ খুঁটিনাটি বিষয়কে রোসেলিনি প্রথমবারের মতো তার চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। 


ভিত্তোরিও ডি সিকা
ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির সময় বাস্তবতাবিবর্জিত চলচ্চিত্র নির্মিত হয় এবং তাতে ইতালির সুস্থির-সুন্দর ইমেজই প্রতিফলিত হয়। ১৯৪৩ সালে ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান হতে শুরু করে এবং ১৯৪৪ সালে ইতালি মিত্রবাহিনীর দখলে চলে আসে। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুসোলিনি পরাজিত হয়, গৃহযুদ্ধের তুমুলকাণ্ডে পর্যুদস্ত অবস্থায় মুসোলিনি ইতালি পরিত্যাগ করে। অন্যদিকে এই ভীষণ রকম রাজনৈতিক অস্থিরতার অন্তরালে জন্ম নেয় চলচ্চিত্রের মহান শিল্পমন্ত্র – ‘নিও রিয়ালিজম’।

চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই নিও-রিয়ালিজম বা নয়াবাস্তবতার ইতিহাসটি টিকে ছিল ছয়-সাত বছরের মতো। সমালোচকদের মতে এর সময়সীমা ছিল ১৯৪৫-এ রোজেলিনির ‘রোম, ওপেন সিটি’ থেকে শুরু করে ১৯৫১ সালে তৈরি ভিত্তোরিও ডি সিকার ‘উমবারতো ডি’ পর্যন্ত। এই সীমিত সময়পর্বে যে কয়টি ছবি বিশ্বের দর্শকরা দর্শন করেছেন, তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিল্পপ্রভাব অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায় যে নিও-রিয়ালিস্ট আন্দোলনের সবচেয়ে মহৎ অবদান মানবিক দয়া, এর নিষ্ঠা ও স্টাইলের কঠোর শিল্পসংযম। অসংখ্য ছবির দৃশ্যকল্প যুদ্ধোত্তর মানুষকে সত্য-অন্যায়, মানুষের জীবননিগূঢ় ভালোবাসার প্রতি এগিয়ে দিয়েছেগল্পের বিষয়বস্তু অত্যন্ত সাদামাটা অথচ চরিত্রগুলো সৎ ও জীবনসংগ্রামী। নিজেদের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরিন সুসম্পর্ক। রয়েছে সূক্ষ-সংবেদনশীল রীতির আশ্রয়ে বাস্তবতার চমকপ্রদ সহজ প্রকাশ।


রবার্তো রোজেলিনি
এই আন্দোলনের বহু ছবি চলচ্চিত্র নির্মাণের বিশিষ্ট এক শিল্পাদর্শ হিসেবে আজও আলোচিত হয়। ডি সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’, ‘শুসাইন’, ‘উমবারতো ডি’, ডি স্যান্টিসের ‘ট্র্যাজিক হান্ট’, লুইজি জাম্পার ‘টু লিভ ইন পিস’, ‘এঞ্জেলিনা’, ভিসকন্তির ‘দ্য আর্থ ট্রাম্বেলস’, রোজালিনির ‘ইউরোপা ফিফটি ওয়ান’ ইত্যাদি এই আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শনরূপে চিহ্নিত।

পূর্ব ইউরোপীয় চলচ্চিত্রের যুদ্ধোত্তর ও আধুনিক ক্রমবিকাশে এই আন্দোলনের বিশেষ ভুমিকা আছে। হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়ার চলচ্চিত্র স্রষ্টারা এর দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফেলিক্স মারিয়াসে, জোলতান ফাব্রি, এল্মার ক্লজ, ইয়ান কাদার, আঁদ্রে ওয়াজদা, আঁদ্রে মুঙ্ক, জেরী কাওয়ালেরেউইজ প্রমুখ স্রষ্টার শিল্পকর্মে এর স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিখ্যাত রুশ পরিচালক মিখাইল রমও রাশিয়ান চলচ্চিত্রে নিও-রিয়ালিস্ট-এর কথা বলেছেন। এ ছাড়া ফ্রান্সের পরিচালক ক্লেমেঁ, কায়েৎ, ক্লুজো, জাপানের কিনোসিটো, ইচিকাওয়া, ওশিমার শিল্পকর্মেও এই ধারার প্রতিফলন দেখতে পাই। এমনকি  সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের পিছনেও নব্য-বাস্তববাদী বা নিও-রিয়েলিজম শিল্পশৈলীর প্রভাব ও প্রেরণা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।

নিও-রিয়ালিস্ট সিনেমা যে শুধু যুদ্ধোত্তর ইতালির চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বৈপ্লবিক শিল্পআন্দোলন ঘটিয়েছিল তাই নয়, বরং মনে করা হয় যে পরবর্তী যুগের এবং আগামী প্রজম্নের চলচ্চিত্র প্রগতির ক্ষেত্রেও এই আন্দোলনের এক সুগভীর প্রভাব বিস্তৃত থাকবে।   




শুভ্রনীল চক্রবর্তী




আল্ বিলেক্ : সময়-মানবের উপকথা





(২)

বিলেকের সবকিছু মনে পড়ার পর সে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলো যে ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্টে তার যোগদান সম্পর্কে সে পৃথিবীকে সব সত্য জানাবে। আসলে আল এবং এডের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে গেলে এই এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে আলোকপাত করা ভীষণ জরুরী। ১৯৪৩ সালে আমেরিকান নেভি দ্বারা পরিচালিত এই গোপন মিশনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন এড ক্যামেরন এবং তাঁর ভাই ডানকান ক্যামেরন।

১৯৫৫ সালে মরিস কে জেসাপ একটি বই পাবলিশ করেন ‘দ্যা কেস ফর দ্যা ইউ এফ ও’ এবং সেই বইয়ের ভিত্তিতে লেখক দুটি চিঠি পান কার্লোস মিগুয়েল  এলেন্ড বলে এক ব্যক্তির থেকে, যিনি নিজেকে গোপন ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্টের মূর্ত দর্শক হিসেবে দাবী করেন। এলেন্ড জানান, ইউ.এস.এস এলড্রীজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ধ্বংসাত্মক এই যুদ্ধ জাহাজের উপর এই পরীক্ষাটি চলে এবং পরীক্ষাস্থল ছিল ফিলাডেলফিয়া নভল শিপ ইয়ার্ডে, পেনসিলভেনিয়া। গোপন পরীক্ষা বলে স্বভাবতই তখন বেশীরভাগ কর্মী ছুটিতে ছিলেন। এই এক্সপেরিমেন্ট এমনও গুজব শোনা গিয়েছে যে পরীক্ষাটি হয়েছিল নিকোলা টেসলার থিওরির উপর ভিত্তি করে, তার মৃত্যুর ঠিক কিছু মাস পর পরই।

কার্লোস চিঠিতে জেসাপকে জানান যে  পরীক্ষাটি চলাকালীন তিনি এল ড্রিজের ডেকের এক কোণে দাঁড়িয়েছিল  এবং ঘটনার আগের মুহূর্তে সে স্পষ্ট ভাবে  বুঝতে পেরেছিল কিছু একটা ভয়ানক জিনিস হতে চলেছে। তিনি এও জানান সেই সময় ডেকে অনেক উচ্চ পদস্থ মিলিটারি অফিসিয়ালরা উপস্থিত ছিলেন যেটা সাধারণত আগে তিনি কখনো প্রত্যক্ষ করেননি। যদিও কার্লোস বুঝতে পারেননি তারা আদতে কি যন্ত্র ব্যবহার করছেন, তবে হঠাৎ দেখতে পান চারদিক ঘন সবুজ কুয়াশায় ভরে উঠেছে এবং মনে হচ্ছে সেটা জাহাজটাকে গিলে খেতে আসছে। এবং আরও অদ্ভুত ভাবে হঠাৎ দু’এক সেকেন্ডের জন্য  একটা তীব্র নীল আলোর ছটা দেখা গেলো এবং সঙ্গে সঙ্গে এল ড্রিজ অদৃশ্য হয়ে গেলো।

পরবর্তী কালে গবেষণার মাধ্যমে উঠে আসে যে, আমেরিকানরা শত্রুর রাডার থেকে নিজেদের বাঁচাতে এক অদৃশ্য যুদ্ধ জাহাজ বানানোর পরিকল্পনার স্বার্থেই  এই পরীক্ষাটি করছিল। এই এক্সপেরিমেন্টের ফলস্বরূপ কার্লোস জানান সমগ্র জাহজটা সব লোকজন নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে টেলিপর্টেড হয়ে পৌঁছে যায় ২০০ মাইল দূরে ভার্জিনিয়ার নরফ্লক শিপ ইয়ার্ডে এবং ঠিক আগের মত ভাবেই ঘন সবুজ কুয়াশা ও তীব্র নীল আলোর ছটায় জাহাজটি সব অফিসারদের নিয়েই ফিরে আসে ফিলাডেলফিয়াতে। কার্লোস জানান জাহাজে থাকা অসংখ্য লোকজন এতে মরে যায় অথবা অসুস্থ্ হয়ে পড়ে। যারা মোটামুটি ঠিক ছিলেন বা ঘটনাটাকে মেনে নিতে পেরেছিলেন তারা বাকী জীবনটা মেন্টাল এসাইলামে  বেশীরভাগ কাটিয়ে দেন।

শুনতে আশ্চর্য লাগতে পারে কিন্তু আল বিলেক তার প্রথম সাক্ষাৎকারে জানান যে তিনি ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্টের সময় এল ড্রিজে উপস্থিত ছিলেন এবং সেই সময় তিনি আল ছিলেন না, ছিলেন এড ক্যামেরন এবং তার সাথে তার ভাই ডানকান ক্যামেরন ছিল। বিলেক জানান যখন ঘন সবুজ কুয়াশা তাদের ঘিরে ধরে তখন বাকীদের মত তারা দুই ভাই আর নরফ্লকে যায়নি গেছেন ১৯৮৩ সালে, দীর্ঘ ৪০ বছর ভবিষ্যতে। কার্লোসের মতই আল তথা এড জানান চারদিকে নাবিক এবং অন্যান্য নৌ কর্মীদের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি – কেউ শ্বাস কষ্টে ভুগছে, কারুর গা হাত পা পুড়ে গেছে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, কেউ ভয়ে চিৎকার করছে। এসব দেখে তারা দু’ভাই একপ্রকার দিকবিদিক জ্ঞানহীন হয়ে সমুদ্রে  ঝাঁপ দিল এবং তারা ১৯৮৩ সালে পৌঁছয় ওয়ার্ম হোলের মাধ্যমে। কিন্তু তখন তারা সবকিছু মিলিটারিদের খুলে বলাতে মিলিটারিরা তাদের নির্দেশ দেয় ১৯৪৩ সালে ফিরে গিয়ে সব যন্ত্র ধ্বংস করে দিতে কারণ তাদের এই পরীক্ষার কারণে অনেক সময়ের গোলমাল হয়ে গেছে। আদেশ অনুযায়ী তারা তাই করলেন কিন্তু সবকিছুর শেষে একটি দুর্ঘটনার মাধ্যমে আবার ওয়ার্ম হোলে পড়ে যান।



আল জানালো মাঝখানে কিছুক্ষণের জন্য হয় তো তারা অজ্ঞান হয়ে গেছিল, যখন জ্ঞান ফিরলো নিজেদের তারা আবিষ্কার করলো একটি হাসপাতালের পাশাপাশি বেডে, দুজনের শরীরের অনেক ভাগ পুড়ে গেছে এবং সারা শরীর জুড়ে অসহ্য যন্ত্রণা।

বিলেকের মতে, সেই পুড়ে যাওয়া ক্ষতগুলো সৃষ্টি হয়েছিল টাইম হাইপারস্পেসে রেডিয়েশন বার্নএর দরুণ। এই ঘটনা প্রসঙ্গে বিলেক তার মৃত্যুর আগে একটি ইন্টারভিউ তে জানান – “আমরা আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌঁছে যাই ২১৩৭ সালে, আমাদের অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল যে প্রায় একমাস আমাদের হাসপাতালে থাকতে হয়”। ধীরে ধীরে বিলেক ও তার ভাই ডানকান বুঝতে  থাকলো তারা সম্পূর্ণ এক অন্য সময়ে চলে এসেছে। আল জানান তখন চিকিৎসা ব্যবস্থা একদমই অন্যরকম, বেশীর ভাগ চিকিৎসা হয় ভাইব্রেশন ও লাইট ট্রিটমেন্টের মাধ্যমে, আজকের দিনের মত ডাক্তার ও নার্স নেই বললেই চলে, সবই যন্ত্রচালিত।

প্রায় ছয় সপ্তাহ ২১৩৭ সালে থাকার পর বিলেক ও ডানকান ঠিক করেন তারা ফিরে যাবেন, কিন্তু বিধি বাম, সেখান থেকে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিলেক নিজেকে আবিষ্কার করেন ২৭৪৯ সালে। তিনি সেই সময় নিয়ে অদ্ভুত কিছু কথাও সংবাদ মাধ্যমকে জানান যা আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভাবা রূপকথার চেয়ে কম কিছু নয়।

তিনি দেখলেন, তখন পৃথিবীতে শহরগুলো সব ভাসমান, সেগুলো পৃথিবী জুড়ে ঘুরে বেড়াতে পারে, আজকের মত ভিসা বা সীমানা নেই কোনো। বিপরীত অভিকর্ষ নিয়ে গবেষণার ফসল - শহরগুলো মাটি থেকে প্রায় আড়াই মাইল উঁচুতে। কিন্তু তখন পৃথিবীর জনসংখ্যা মাত্র ৩০০ মিলিয়ন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তখন ৫০ মিলিয়ন মানুষ, দু’বছর থাকেন তিনি সেখানে।


তবে মজার বিষয় এই যে বিলেক জানান তখন পৃথিবীতে কোনো যুদ্ধ ছিল না, তবে রাশিয়ান ও চাইনিজ এবং আমেরিকা ও ইউরোপের মধ্যে তখন মনোমালিন্য। যেহেতু মিলিটারি, নেভি বা এয়ারফোর্স বলতে পৃথিবীতে কিছুই তখন নেই, তাই যুদ্ধও অসম্ভব। তখন আসলে কোনো সরকারও নেই, সমগ্র দুনিয়া চলছে একটি সিন্থেটিক সিস্টেম দ্বারা এবং এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সারা পৃথিবী চালাচ্ছে নিখুঁতভাবে। আল জানান একে সৃষ্টি করা হয়েছে ২৬ শতকের গোড়ার দিকে। আল এও জানান তখন মানুষের কোনো কষ্ট নেই, মানে আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা যা দেখি খাদ্য বাসস্থান সবই মানুষ পাচ্ছে নিজের  প্রয়োজন মত। তবে তখন সমুদ্র স্তরের উচ্চতা অনেক বেড়ে গেছে, বহু দেশ জলের তলায় চলে গেছে – যেমন তিনি জানান, ফ্লোরিডার ২/৩ অংশ তখন জলের তলায়। আসলে ২৭৪৯ সালে বিলেক দু’বছর কাটান এক ট্যুর-গাইড হিসেবে, তাই তার পক্ষে তখন এত বেশী জানা সম্ভব হয়েছিল।

অবশেষে বিলেক ফিরতে সক্ষম হন বিংশ শতকে, ১৯৮৩ সালে। বিলেকের কাহিনী শুনে মিলিটারিরা বুঝতে পারেন তাকে চুপ করাতে হবে। এবং এরপরই  ঘটে বিলেক তথা এড ক্যামেরনের জীবনে সবথেকে আশ্চর্য তথা অবিশ্বাস্য ঘটনা। মিলিটারিরা এডকে বয়স কমানোর প্রযুক্তি দিয়ে ছোট্ট শিশুর রূপদান করে এবং এরপর মন্টেক প্রজেক্ট পরিভ্রমণ কালে তাকে রেখে আসে বিলেক পরিবারের কাছে, ক্যামেরন পরিবার নয়। বিলেক পরিবার এক মৃত সন্তানের পরিবর্তে তাকে গ্রহণ করে, সেখানেই তিনি বেড়ে ওঠেন আল বিলেক নামে, এড ক্যামেরন নয়। যদিও মনটেক প্রজেক্ট তার সমস্ত স্মৃতি কেড়ে নিয়েছিল কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা ছিল প্রখর। শিশু আলের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমরা প্রথমেই আলোচনা করেছি। আসলে মিলিটারিরা তার জৈবিক বয়স কমালেও তার মানসিক বিকাশ পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি এবং আমরা এর সম্মক উদাহরণ পাই বিলেকের প্রথম স্মৃতি ক্রিসমাসের দিনেই।

বিলেক আরও জানান সময় পরিভ্রমণ নিয়ে বিভিন্ন তথ্য। সময় পরিভ্রমণের প্রযুক্তি মানব জাতিকে উপহার দিয়েছে অরায়ন গ্যালাক্সি থেকে আগত এলিয়ন, যারা রেপটালিয়ান। পৃথিবীকে টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিতে থাকে সিরিয়স বা লুব্ধক নক্ষত্র থেকে আগতরা। মাইন্ড কন্ট্রোল প্রযুক্তিও মানবজাতির তাদের কাছ থেকেই শেখা।

এই রকম আরো অনেক অজানা তথ্য নিয়ে তিনি রচনা করেন ‘দ্যা ফিলাডেলফিয়া এক্সপেরিমেন্ট’ গ্রন্থ এবং এছাড়াও অসংখ্য রেডিও প্রোগ্রামে তিনি  জানান তার অভিজ্ঞতার কথা। আলফ্রেড বিলেককে অনেকে নানাভাবে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার চেষ্টাও করেছেন, আবার তার অসংখ্য ভক্তকুল তার কথা বিশ্বাসও করেছেন। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, তিনি তার সমগ্র জীবনটাই উৎসর্গ করেছিলেন সময় সংক্রান্ত গবেষণায়। আইনস্টাইনের ইউনিফাইড ফিল্ড  থিওরি থেকে শুরু করে টেসলার থিওরি সব কিছুকেই বাস্তব রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন আল। ২০১১ সালে ১০ই অক্টোবর মেক্সিকোতে মারা যান বিংশ শতকের এই সময়মানব।



জিনাত রেহেনা ইসলাম




সাহসীকন্যা  





মাইক হাতে এক মেয়ের  ভিডিও কি নজর এড়িয়ে গেল? আসলে কোথাও তেমন হেলদোল দেখা গেল না। একটা বয়ান-মিছিল-প্রতিবাদ নজরে এল না! ক্ষোভ ও ধিক্কারে ফেটে পড়ল না কেউ। ঐ যে এক কিশোরীকে টেনে সরানো হচ্ছে! ধাক্কা   মেরে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে মাইক। মাত্র উনিশ মেয়েটি নীল জিনস। সাদা ছাপা  ফুলের কুর্তি দুটি শব্দ উচ্চারণ করলকথা শেষ করতে দেওয়া হল না। একদল  মানুষের  তীব্র আপত্তির দৃঢবলয়ে আটকে পড়ল মেয়েতারপরে ভিড় ঠেলে  বেরিয়ে এল। আবারও কিছু বলার চেষ্টা করল। বারবার এক সেকেন্ড সময় চাইতে থাকল। কিন্তু না, এবারেও বলতে দেওয়া হল না। মেয়েটিকে টানাহিঁচড়ে করার দৃশ্য আমার মধ্যে কাঁপুনি ধরিয়ে দিয়েছে ভয় হচ্ছে আমারও! কে জানে কার পালা এবার! ইতিহাসে প্রতিবেশী দেশগুলির কথা কতবার পড়েছি উচ্চারণ করেছি। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি মহামান্য রাষ্ট্র আমায় শাস্তি দেয়নি। এক বিরাট বড় গতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের নাগরিক আমরা। বিশ্বনাগরিকতার গল্প শুনে বড় হয়েছি। মিলেমিশে থাকুক প্রতিবেশী দেশের মানুষ। এমটাই চাইতে হয় জেনেছি।  

সংস্কৃতি, সংবিধান, আভ্যন্তরীন ও বিদেশনীতি সব দেশের নিজেস্ব। পারস্পরিক   সংঘাত ও মতপার্থক্য  থাকতে পারেতাই বলে কি একটি দেশের মানুষ আরেকটি  দেশের মানুষের শত্রু হয়? আমরা সবাই তো প্রথমে মানুষ। মানুষের জন্যই তো দেশ। এখন আমি বুঝে নিয়েছি। ভুটান ও শ্রীলঙ্কা জিন্দাবাদ কেউ বলাতে পারবে  না আমায়! আমার দেশপ্রেম ষোলোআনা খাঁটি। দেশভক্তির ঢেউয়ের বিপরীতে আখ্যায়িত দেশদ্রোহীদের থেকে আমি দূরত্ব রক্ষা করবো। বিশ্বাস করব মহান রাষ্ট্র    আমার কাছে মনুষত্ব্য ও বিবেকের চেয়ে নিঃশর্ত ভক্তি চায়। ধর্মাবতার রাষ্ট্র আমি ঠিক তো? ঐ যে ওরা তো আমার সহনাগরিক। অপরাধের বহর মেপে ওদের যখন  দেশদ্রোহী ঘোষণা করা হয়েছে তখন তাকে মান্যতা দেওয়া আমার কর্তব্য, তাই না?  ওদের ঘৃণা করতে শেখা উচিত আমাদের।   
   
আমি ‘ভাইজান’ সিনেমাটা দেখে যারা হাততালি দিচ্ছিল তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো না। মুন্নিকে প্রাণ হাতে নিয়ে নায়ক ফিরিয়ে দিচ্ছিল মেয়েটির নিজের দেশে। একি নায়কের মানায়? এই তো সেদিন এক হিন্দী সিনেমা দেখতে বসেছি। এক নাচের দল ভারতের ও অন্য একটি দল অন্যদেশের ক্রিকেট দলের জয়ের জন্য তালি বাজাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমার সেই ভারতীয় হয়ে ওঠা উচিত যারা নীলকর সাহেবের অত্যাচার পর্দায় দেখে জুতো ছুঁড়েছিল। ঠিক সেভাবেই উচিত ঐ  সমর্থকদের জুতো ছুঁড়ে নিজের ঘৃণা ব্যক্ত করা। এবং চিৎকার করে ওদের উদ্দেশ্যে বলা – ‘যাও! দূর হটো! ঐ দেশেই গিয়ে থাক!’ কিন্তু আমি তা করিনি। রাষ্ট্র আমার এই অপরাধের জন্য ক্ষমা করবে কি?  
বিবেকানন্দ কতদিন আগে ভিনদেশে কেমন যেন বলে ফেলেছিলেন বিশ্বকে  আমরাই সর্বজনীন গ্রহযোগ্যতা ও সহনশীলতা শিখিয়েছি। বিশ্বের সবাইকে  নিজের ভাই-বোন বলেছিলেন। আমি তো সেটাই বিশ্বাস করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ পড়ে বুঝেছিলাম দেশপ্রেম এক মানবিক গুণের চর্চাজাতীয়তাবাদ সমষ্টির    উন্নতির ভাবনা। দুটিরই অতিমাত্রায় বিকাশ দেশ ও জনগণের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে   উঠতে পারে। গান্ধীজিও অন্য দেশের অর্থ বরাদ্দের জন্য অনশন শুরু করেছিলেন। আমি ইতিহাসে পড়েছি। কিন্তু কথা দিচ্ছি, ভুলে যাবো। মার্টিন লুথার নিরস্ত্র সত্য ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার জয়ের কথা বলেছেন আমি কখনও বলব না। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। এমন  শিক্ষার খোঁজ দেব না কাউকেই।  
                      
দেশে সফররত আমেরিকান প্রেসিডেন্টের পাকিস্থানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক শোনার পর আমি টিভি বন্ধ করে দিয়েছি। যেখানেই প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে আলোচনা,    সেখান থেকে  দ্রুত নিজেকে সরিয়ে নেব তবে আমি দেশদ্রোহিতার অপরাধ থেকে মুক্তি পাবো তো মহামান্য রাষ্ট্র? আমার শিক্ষা, চেতনা ও মননকে আমি ঐ দেশপ্রেমের বেদীতে সঁপেছি, যেমন সরস্বতীর থানে তুলে দিতাম বইআশা ছিল,  দেবী পাশ করিয়ে দেবেরাষ্ট্র এখন আমাদের মনের ইচ্ছা পূর্ণ করবে তো? ধর্মে মহান, কর্মে মহান হবো তো আমরা?
     
বিশ্বকাপে আমি কিছুতেই ফ্রান্স বা  উরুগুয়েকে  সমর্থন করবো না ক্রিকেটে তো আমি অন্য দেশের খেলা দেখবোই না। শত্রু দেশের খেলা দেখার অন্যায় কি আমি করতে পারি? মেড ইন চায়না লেখা জিনিষ আমি ছুঁড়ে ভেঙে ফেলবো। ব্রিটিশরা  আমাদের ভীষণ অত্যাচার করেছিল তাই ম্যাপে ঐ দেশকে আমি কালো করে দেবো। রাষ্ট্রের যা না-পসন্দ তা কি আমি করতে পারি? আমি সেই তোতাপাখি হয়ে  মরে যাবো। পেটে গজগজ করবে আমার দেশপ্রেমের নথি। আমি নিজেকে রাষ্ট্রের পায়ে সঁপে দেবো এভাবেই! দেশপ্রেমে ভাসতে  না পারলে  নিজেকে নাগরিক বলিই বা করে! জাতীয়তাবাদের উন্মাদনাকে নিজের মধ্যে না অনুভব করলে নাগরিক জীবন তো বৃথা! অন্য সব দেশের সমৃদ্ধির কথা শুনবও না বলব না। অন্য যারা এমন করে তাদেরও আমি ভীষণ বকে দেবো। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাদের শর্তেই তো আমার দেশে থাকার অধিকার জন্মায়নইলে রাষ্ট্র আমায় দেশে থাকতে দেবে কেন? জেন অ্যাডামস তো খাঁটি কথাই বলেছিলেন। আমাদের দেশপ্রেমের ধারণাটি  প্রগতিশীল হওয়া দরকার। নইলে এটি  জাতির আসল স্নেহ ও আগ্রহকে বৃহৎ করে  তুলবে এটি আশা করা যায় না।

ঐ মেয়েটির জন্য দীর্ঘশ্বাস আমি বালিশে চেপে রাখবো। তাকে ঘিরে থাকা সেই  লোকবলয়ের ভয়ে আমি থরথর করে কাঁপতে শেখাবো আমার পরের প্রজন্মকে কিন্তু না, মেয়েটি  কি করে দেশদ্রোহী ভুলেও জানতে চাইবো না। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সব প্রশ্নকে কঠোর হাতে  দমন করবোএভাবেই নিজের মাথা উন্নত দেশের আড়ালে লুকিয়ে প্রকৃত নাগরিক হব। দেশ তো মামাকে শান্তি দিতেই  আমি মায়ের অন্য দেশদ্রোহী সন্তানদের সঙ্গে লড়াই জারি রাখবো! এক সহনাগরিক থেকে এক প্রতিবেশী দেশের মানুষ সকলের থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন  করে দেশপ্রেমের গরিমায় আপ্লুত থাকবো। সন্তানদের বলতে শেখাবো – ‘রাষ্ট্র  জিন্দাবাদ! দেশভক্তি জিন্দাবাদ!’ প্রাণে বেঁচে থাকার শিক্ষাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। রাষ্ট্রের শর্তপূরণের স্বাধীনতার স্বাদ পরের প্রজন্মকে উপহার দেব আমরা।

শান্তি অধ্যয়নের জনক গালতুং-এর মত ঐ মেয়েটিও কি বিশ্বাস করেছিল শান্তির ধর্মে? সহিংসতাকে জয় করতে চেয়েছিল? মানুষে মানুষে ভালোবাসার সেতু নির্মাণে ব্রতী হয়েছিল? ওর  ‘মন্দ কথার’ প্রেক্ষিতে আমি  শিক্ষা নিয়েছি। রাষ্ট্র চায় দেশের মাটিতে শুধু দেশপ্রেমিকের অবাধ স্বাধীনতা ও বিশ্বাসের বাতাবরণ। আমি নিষ্ঠার  সঙ্গে তা অটুট রাখবো মহামান্য রাষ্ট্রের বিশ্বাস অর্জন আমার রাজধর্ম। সেটাই জীবনের মূল ধর্ম। প্রাণ ও পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার আমার আবার বড্ড লোভ। শেষপর্যন্ত আমি সেটার জন্যই নিরাপদ থাকতে চাই।