সাহসীকন্যা
মাইক হাতে এক মেয়ের ভিডিও কি নজর এড়িয়ে গেল? আসলে কোথাও তেমন হেলদোল দেখা গেল না। একটা
বয়ান-মিছিল-প্রতিবাদ নজরে এল না!
ক্ষোভ ও ধিক্কারে ফেটে পড়ল না কেউ। ঐ যে এক কিশোরীকে টেনে সরানো হচ্ছে! ধাক্কা
মেরে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে মাইক। মাত্র
উনিশ মেয়েটি। নীল জিনস।
সাদা ছাপা ফুলের কুর্তি। দুটি শব্দ উচ্চারণ করল। কথা শেষ করতে দেওয়া হল না। একদল মানুষের
তীব্র আপত্তির দৃঢবলয়ে আটকে পড়ল মেয়ে। তারপরে ভিড় ঠেলে বেরিয়ে এল। আবারও কিছু বলার চেষ্টা করল। বারবার
এক সেকেন্ড সময় চাইতে থাকল। কিন্তু না, এবারেও
বলতে দেওয়া হল না। মেয়েটিকে টানাহিঁচড়ে করার দৃশ্য আমার মধ্যে কাঁপুনি ধরিয়ে
দিয়েছে। ভয় হচ্ছে
আমারও! কে জানে কার পালা এবার! ইতিহাসে প্রতিবেশী দেশগুলির কথা কতবার পড়েছি। উচ্চারণ করেছি। ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। মহামান্য রাষ্ট্র আমায় শাস্তি দেয়নি। এক বিরাট
বড় গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ
রাষ্ট্রের নাগরিক আমরা। বিশ্বনাগরিকতার গল্প শুনে বড় হয়েছি। মিলেমিশে থাকুক
প্রতিবেশী দেশের মানুষ। এমটাই চাইতে হয় জেনেছি।
সংস্কৃতি, সংবিধান, আভ্যন্তরীন ও বিদেশনীতি সব দেশের নিজেস্ব।
পারস্পরিক সংঘাত ও মতপার্থক্য থাকতে পারে। তাই বলে কি একটি দেশের মানুষ আরেকটি দেশের মানুষের শত্রু হয়? আমরা সবাই তো প্রথমে
মানুষ। মানুষের জন্যই তো দেশ। এখন আমি বুঝে নিয়েছি। ভুটান ও শ্রীলঙ্কা জিন্দাবাদ
কেউ বলাতে পারবে না আমায়! আমার দেশপ্রেম
ষোলোআনা খাঁটি। দেশভক্তির ঢেউয়ের বিপরীতে আখ্যায়িত দেশদ্রোহীদের থেকে আমি দূরত্ব
রক্ষা করবো। বিশ্বাস করব মহান রাষ্ট্র আমার কাছে মনুষত্ব্য ও বিবেকের চেয়ে
নিঃশর্ত ভক্তি চায়। ধর্মাবতার রাষ্ট্র আমি ঠিক তো? ঐ যে ওরা তো আমার সহনাগরিক। অপরাধের
বহর মেপে ওদের যখন দেশদ্রোহী ঘোষণা করা হয়েছে
তখন তাকে মান্যতা দেওয়া আমার কর্তব্য,
তাই না? ওদের ঘৃণা করতে শেখা উচিত আমাদের।
আমি ‘ভাইজান’ সিনেমাটা দেখে যারা
হাততালি দিচ্ছিল তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবো না। মুন্নিকে প্রাণ হাতে নিয়ে নায়ক
ফিরিয়ে দিচ্ছিল মেয়েটির নিজের দেশে। একি নায়কের মানায়? এই তো সেদিন এক হিন্দী সিনেমা
দেখতে বসেছি। এক নাচের দল ভারতের ও অন্য একটি দল অন্যদেশের ক্রিকেট দলের জয়ের জন্য
তালি বাজাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে আমার সেই ভারতীয় হয়ে ওঠা উচিত যারা নীলকর সাহেবের
অত্যাচার পর্দায় দেখে জুতো ছুঁড়েছিল। ঠিক সেভাবেই উচিত ঐ সমর্থকদের জুতো ছুঁড়ে নিজের ঘৃণা ব্যক্ত করা।
এবং চিৎকার করে ওদের উদ্দেশ্যে বলা – ‘যাও! দূর হটো! ঐ দেশেই গিয়ে থাক!’ কিন্তু
আমি তা করিনি। রাষ্ট্র আমার এই অপরাধের জন্য ক্ষমা করবে কি?
বিবেকানন্দ কতদিন আগে ভিনদেশে কেমন যেন বলে ফেলেছিলেন বিশ্বকে আমরাই সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ও সহনশীলতা শিখিয়েছি। বিশ্বের সবাইকে নিজের
ভাই-বোন বলেছিলেন। আমি তো সেটাই বিশ্বাস করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথ পড়ে বুঝেছিলাম
দেশপ্রেম এক মানবিক গুণের চর্চা। জাতীয়তাবাদ সমষ্টির উন্নতির
ভাবনা। দুটিরই অতিমাত্রায় বিকাশ দেশ ও জনগণের পক্ষে ক্ষতিকর হয়ে উঠতে
পারে। গান্ধীজিও অন্য দেশের অর্থ বরাদ্দের জন্য অনশন শুরু করেছিলেন। আমি ইতিহাসে পড়েছি।
কিন্তু কথা দিচ্ছি, ভুলে যাবো। মার্টিন লুথার নিরস্ত্র সত্য ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসার
জয়ের কথা বলেছেন। আমি কখনও
বলব না। প্রকৃত শিক্ষা মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। এমন শিক্ষার খোঁজ দেব না কাউকেই।
দেশে সফররত আমেরিকান প্রেসিডেন্টের পাকিস্থানের সঙ্গে ভালো
সম্পর্ক শোনার পর আমি টিভি বন্ধ করে দিয়েছি। যেখানেই প্রতিবেশীর সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে আলোচনা, সেখান থেকে দ্রুত নিজেকে
সরিয়ে নেব। তবে আমি দেশদ্রোহিতার অপরাধ থেকে মুক্তি পাবো তো মহামান্য রাষ্ট্র?
আমার শিক্ষা, চেতনা ও
মননকে আমি ঐ দেশপ্রেমের বেদীতে সঁপেছি,
যেমন সরস্বতীর থানে তুলে দিতাম বই। আশা
ছিল, দেবী
পাশ করিয়ে দেবে। রাষ্ট্র এখন
আমাদের মনের ইচ্ছা পূর্ণ করবে তো? ধর্মে
মহান, কর্মে মহান হবো তো আমরা?
বিশ্বকাপে আমি কিছুতেই ফ্রান্স বা উরুগুয়েকে সমর্থন করবো না। ক্রিকেটে তো আমি অন্য দেশের খেলা দেখবোই না। শত্রু দেশের খেলা
দেখার অন্যায় কি আমি করতে পারি? মেড ইন চায়না
লেখা জিনিষ আমি ছুঁড়ে ভেঙে ফেলবো। ব্রিটিশরা আমাদের ভীষণ
অত্যাচার করেছিল তাই ম্যাপে ঐ দেশকে আমি কালো করে দেবো। রাষ্ট্রের যা না-পসন্দ তা
কি আমি করতে পারি? আমি সেই তোতাপাখি
হয়ে মরে
যাবো। পেটে গজগজ করবে আমার দেশপ্রেমের নথি। আমি নিজেকে রাষ্ট্রের পায়ে সঁপে দেবো এভাবেই! দেশপ্রেমে
ভাসতে না পারলে নিজেকে নাগরিক বলিই বা করে! জাতীয়তাবাদের উন্মাদনাকে
নিজের মধ্যে না অনুভব করলে নাগরিক জীবন তো বৃথা! অন্য সব দেশের সমৃদ্ধির কথা শুনবও
না। বলব না। অন্য যারা এমন করে
তাদেরও আমি ভীষণ বকে দেবো। দেশপ্রেম ও জাতীয়তাদের শর্তেই তো আমার দেশে থাকার
অধিকার জন্মায়। নইলে
রাষ্ট্র আমায় দেশে থাকতে দেবে কেন? জেন অ্যাডামস তো খাঁটি কথাই বলেছিলেন। আমাদের
দেশপ্রেমের ধারণাটি প্রগতিশীল হওয়া দরকার।
নইলে এটি জাতির
আসল স্নেহ ও আগ্রহকে বৃহৎ করে তুলবে এটি আশা করা যায় না।
ঐ মেয়েটির জন্য দীর্ঘশ্বাস আমি বালিশে চেপে রাখবো। তাকে ঘিরে থাকা
সেই লোকবলয়ের ভয়ে আমি থরথর করে কাঁপতে
শেখাবো আমার পরের প্রজন্মকে। কিন্তু না, মেয়েটি কি করে দেশদ্রোহী ভুলেও জানতে চাইবো না। মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা
সব প্রশ্নকে কঠোর হাতে দমন করবো। এভাবেই নিজের মাথা উন্নত দেশের
আড়ালে লুকিয়ে প্রকৃত নাগরিক হব। দেশ তো মা। মাকে
শান্তি দিতেই আমি মায়ের অন্য দেশদ্রোহী
সন্তানদের সঙ্গে লড়াই জারি রাখবো! এক সহনাগরিক থেকে এক প্রতিবেশী দেশের মানুষ সকলের
থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দেশপ্রেমের
গরিমায় আপ্লুত থাকবো। সন্তানদের বলতে শেখাবো
– ‘রাষ্ট্র জিন্দাবাদ! দেশভক্তি জিন্দাবাদ!’
প্রাণে বেঁচে থাকার শিক্ষাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা। রাষ্ট্রের শর্তপূরণের স্বাধীনতার স্বাদ পরের প্রজন্মকে উপহার দেব আমরা।
শান্তি অধ্যয়নের জনক গালতুং-এর
মত ঐ মেয়েটিও কি বিশ্বাস করেছিল শান্তির ধর্মে? সহিংসতাকে জয় করতে চেয়েছিল? মানুষে
মানুষে ভালোবাসার সেতু নির্মাণে ব্রতী হয়েছিল? ওর ‘মন্দ কথার’ প্রেক্ষিতে আমি শিক্ষা নিয়েছি। রাষ্ট্র চায় দেশের মাটিতে শুধু
দেশপ্রেমিকের অবাধ স্বাধীনতা ও বিশ্বাসের বাতাবরণ। আমি নিষ্ঠার সঙ্গে তা অটুট রাখবো। মহামান্য রাষ্ট্রের বিশ্বাস অর্জন আমার রাজধর্ম। সেটাই জীবনের
মূল ধর্ম। প্রাণ ও পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকার আমার আবার বড্ড লোভ। শেষপর্যন্ত আমি সেটার জন্যই নিরাপদ থাকতে চাই।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন