সোমবার, ১৫ জুন, ২০২০

ফারহানা রহমান




নব্য-বাস্তববাদী চলচ্চিত্র এবং তার প্রভাব






চলচ্চিত্র এমন এক অভিনব শক্তিশালী সৃজনশীল অথচ বিনোদনধর্মী শিল্পমাধ্যম যেখানে সমসাময়িক সময়-ভাবনা, বাস্তবতা, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, ব্যক্তিমানুষের দুঃখ-দুর্দশা, আত্মিক-সংকট, মনস্তত্ত্ব, মানবধর্ম, দর্শন, জীবনের টানাপড়েন ইত্যাদি নানা ক্ষেত্র অন্তর্নিহিত থাকে। নির্মাণের নানা পর্বে এভাবেই দেশে দেশে চলচ্চিত্র বিকাশের ক্রমধারায় বিভিন্নরকম আন্দোলন গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে আঁভাগার্দ, সিনামাভেরিতে, রিয়েলিজম, নিও-রিয়েলিজম, ডাডাইজম, ফ্রি ফিনেমা, অথর থিওরি, নুভেল ভাগেক্সপ্রেশনিজম, ইম্প্রেশেনিজম, ইরানি নিউ ওয়েভ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। তবে এসব আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটেছিল মূলত ইতালির নিও-রিয়েলিজম বা নব্য-বাস্তবাদের মাধ্যমে। 

নব্য-বাস্তববাদী বা নিও-রিয়েলিজম পরিভাষাটি সর্বপ্রথম ইতালির সাহিত্য বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয় ১৯৩০ সালের দিকে। বুর্জোয়া জীবনচর্চার শূন্যগর্ভ ও একঘেয়ে ক্লান্তিকর অস্তিত্ব, জীবনযাপন, যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানবিক অবস্থা, স্বতঃস্ফূর্ত ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষার অবদমনের ফলে উদ্ভুত নিদারুণ মনঃকষ্ট – সবকিছুর বিরুদ্ধে সোচ্চার এক তেজদীপ্ত বিশ্লেষণধর্মী উপস্থাপনের এই শৈলীকে চিহ্নিত করার জন্য সর্বপ্রথম আরনাল্ডো বসিলি (Arnaldo Bocelli) ‘নব্য-বাস্তববাদী’ অভিধাটি ব্যবহার করেন। নয়া-বাস্তববাদী সাহিত্য ও চলচ্চিত্র, এই দুটো মাধ্যমেই নন্দনতাত্ত্বিক ও ভাবাদর্শিক দিক থেকে একই ধরনের উপাদানের প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়।


জ্যঁ রেনোয়া
এই ধরনের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে, সস্তা সেন্টিমেন্টের ভেজাল গল্প বা বাস্তবতার বস্তাপচা গল্পের বদলে এমন ধারার ছবি বানানো হয় যেখানে মানবতায় মণ্ডিত বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। ফুটে ওঠে  বুর্জোয়া সমাজের আপাত ঝলমলে পর্দার আড়ালে লুকানো জীবনের দুর্বল ক্ষত, অবক্ষয় আর পতনের দিকগুলি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির প্রতিকূল অর্থনীতি এবং নতুন ভাবাদর্শের প্রেক্ষাপটে  মূলত সৃষ্টি হয় নিও-রিয়ালিস্ট চলচ্চিত্রধারা। এই ধরনের চলচ্চিত্রে সমাজ বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটেছে নানা মাত্রায়। চলচ্চিত্রকলার নিজস্ব প্রকৃতি এবং সমাজের উপর চলচ্চিত্রের প্রভাব কেমন হওয়া উচিত - এ নিয়ে ভেবেছেন এই ধারার চলচ্চিত্র নির্মাতারা। দর্শকদেরও ভাবতে বাধ্য করা হয়েছে তাদের চারপাশের বাস্তবতাকে নিয়ে। শুধুমাত্র গল্প-উপন্যাসকেই এখানে চলচ্চিত্ররূপ দেওয়া হয়নি, বাস্তব ঘটনাকে চলচ্চিত্রের আধেয় করা হয়েছে। সমাজবাস্তবতার হতদারিদ্র্য অবস্থা, বেকারত্ব, ক্ষুধা, পতিতাবৃত্তি, আত্মহত্যা, নরহত্যা, চুরির ঘটনা, বিষণ্ণতা, আশাহীনতা ইত্যাদি বিষয়কেই মূলত এই ধারার চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। এখানে প্রধান-অপ্রধান চরিত্রবর্গের মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে গুরুত্ব সহকারে উপস্থিত করা হয়। ফলে, চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তত্ত্বগত কারণে এই নিও-রিয়ালিজম দীর্ঘকাল স্মরণীয় হয়ে থেকেছে। এটি মূলত একটি শিল্পদর্শন। এই ধারার চলচ্চিত্রের আদর্শ হচ্ছে স্টুডিওর মেকি ও কৃত্রিম পরিবেশ ছেড়ে ক্যামেরা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে,  জীবন যেমন রূপালি পর্দায় ঠিক তেমন করে তুলে ধরা। একইসঙ্গে এই ধরনের ছবিতে যুক্ত হয় শিল্পীর সহজাত মানবিকতা, ন্যায় ও সত্যের মূল্যবোধ,  জীবননিষিক্ত ভালোবাসার সহজ সরল গভীর প্রতিচ্ছবি। ব্যক্তিচেতনার জাগ্রত প্রকাশ, মানুষের জীবনের প্রাত্যহিক উত্থানপতন, মানবিক মূল্যবোধের নবমূল্যায়ন, উৎকেন্দ্রিকতা, বিচ্ছিন্নতাবোধ – এই সবকিছুই ইতালীয় সিনেমার   নয়া বাস্তবতার অবদান হিসেবে দেখা হয়। এই ধরনের শিল্পকর্মের মধ্যে সমাজ সচেনতার সুগভীর  ছাপ যেমন দেখা গেছে, তেমনি লক্ষ্য করা গেছে নান্দনিক উৎকর্ষ। 


ভিসকন্তি
মূলত চল্লিশের দশককেই ইতালির নিও–রিয়ালিজম ফিল্ম মুভমেন্টের সময়কাল হিসেবে ধরা হয়। ফ্রান্সের চলচ্চিত্র নির্মাতা জ্যঁ রেনোয়া ‘ফ্রেঞ্চ পোয়েটিক রিয়ালিস্ট’ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি ১৯৩৪ সালে টনি (Toni) নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যাকে চলচ্চিত্র বিশারদেরা ইতালীয় নব্য-বাস্তববাদের পূর্বলক্ষণ সমৃদ্ধ চলচ্চিত্র বলে গণ্য করে থাকেন। এই ছবিটি নির্মাণের সময় ইতালির পরিচালক ভিসকন্তি রেনোয়ার সহযোগী হিসেবে কাজ করেছিলেন। জ্যঁ রেনোয়ার টনি ছবিটি একটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি। ঘটনাটি অনেকটা এরকম – এক ইতালীয় অভিবাসী বা  ইমিগ্রান্ট শ্রমিক ফ্রান্সে কাজ করতে আসে। সেখানে সে এক নারীর প্রেমে পড়ে এবং তাকে পাওয়ার জন্য একটি খুন পর্যন্ত করে বসে। রেনোয়া তার টনি ছবিটিতে অপেশাদার অভিনয়শিল্পীদের নিয়ে ছবিটা করেছিলেন এবং প্রামাণ্য লোকেশনে অরিজিনাল সাউন্ডট্রাক ব্যবহার করে শুটিং করেছিলেন। ফ্রান্সের কাব্যিক বাস্তববাদের ভিতরে যে সামাজিক ও দুঃখবাদী বাস্তববাদ প্রবহমান ছিল, ইতালীয় নব্য-বাস্তববাদের সঙ্গে তার এক ধরনের সঙ্করীকরণ হয়েছে। 

ইতালির এই নব্য-বাস্তববাদী চলচ্চিত্রধারার আরম্ভরেখা হিসেবে ধরা হয় ভিসকন্তির Ossessione (১৯৪২) চলচ্চিত্রকে। চলচ্চিত্র সমালোচকরা যদিও রবার্তো রোজেলিনির রোম, ওপেন সিটি (১৯৪৫)-কে নব্য-বাস্তববাদীধারার প্রথম সার্থক চলচ্চিত্র বলে গণ্য করে থাকেন। এতে সাধারণ মানুষের জীবনযন্ত্রণা ও মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখানো হয়েছে। এ ছবিটিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন মুহূর্তে জার্মান অধিকৃত ইতালির সমাজবাস্তবতায় প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কয়েকজন মানব-মানবীর প্রেম, সাহস ও আত্মত্যাগ উপস্থাপিত হয়েছে। কয়েকটি উপাখ্যান জুড়ে তৈরি এই ছবিতে নানা চরিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছে জাতীয়তাবাদ, অস্তিত্ববাদ, নীতিবাদ ও খৃষ্টধর্মকে। এর মুল উপাদান হচ্ছে শুভর সাথে অশুভর দ্বন্দ্ব। অশুভর পরাজয়য়ের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের জয় হয়। প্রামাণ্য লোকেশন এবং শুটিংয়ের বিশদ খুঁটিনাটি বিষয়কে রোসেলিনি প্রথমবারের মতো তার চলচ্চিত্রে ব্যবহার করেন। 


ভিত্তোরিও ডি সিকা
ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির সময় বাস্তবতাবিবর্জিত চলচ্চিত্র নির্মিত হয় এবং তাতে ইতালির সুস্থির-সুন্দর ইমেজই প্রতিফলিত হয়। ১৯৪৩ সালে ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান হতে শুরু করে এবং ১৯৪৪ সালে ইতালি মিত্রবাহিনীর দখলে চলে আসে। চারিদিকে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মুসোলিনি পরাজিত হয়, গৃহযুদ্ধের তুমুলকাণ্ডে পর্যুদস্ত অবস্থায় মুসোলিনি ইতালি পরিত্যাগ করে। অন্যদিকে এই ভীষণ রকম রাজনৈতিক অস্থিরতার অন্তরালে জন্ম নেয় চলচ্চিত্রের মহান শিল্পমন্ত্র – ‘নিও রিয়ালিজম’।

চলচ্চিত্রের ইতিহাসে এই নিও-রিয়ালিজম বা নয়াবাস্তবতার ইতিহাসটি টিকে ছিল ছয়-সাত বছরের মতো। সমালোচকদের মতে এর সময়সীমা ছিল ১৯৪৫-এ রোজেলিনির ‘রোম, ওপেন সিটি’ থেকে শুরু করে ১৯৫১ সালে তৈরি ভিত্তোরিও ডি সিকার ‘উমবারতো ডি’ পর্যন্ত। এই সীমিত সময়পর্বে যে কয়টি ছবি বিশ্বের দর্শকরা দর্শন করেছেন, তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শিল্পপ্রভাব অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায় যে নিও-রিয়ালিস্ট আন্দোলনের সবচেয়ে মহৎ অবদান মানবিক দয়া, এর নিষ্ঠা ও স্টাইলের কঠোর শিল্পসংযম। অসংখ্য ছবির দৃশ্যকল্প যুদ্ধোত্তর মানুষকে সত্য-অন্যায়, মানুষের জীবননিগূঢ় ভালোবাসার প্রতি এগিয়ে দিয়েছেগল্পের বিষয়বস্তু অত্যন্ত সাদামাটা অথচ চরিত্রগুলো সৎ ও জীবনসংগ্রামী। নিজেদের মধ্যে রয়েছে অভ্যন্তরিন সুসম্পর্ক। রয়েছে সূক্ষ-সংবেদনশীল রীতির আশ্রয়ে বাস্তবতার চমকপ্রদ সহজ প্রকাশ।


রবার্তো রোজেলিনি
এই আন্দোলনের বহু ছবি চলচ্চিত্র নির্মাণের বিশিষ্ট এক শিল্পাদর্শ হিসেবে আজও আলোচিত হয়। ডি সিকার ‘বাইসাইকেল থিভস’, ‘শুসাইন’, ‘উমবারতো ডি’, ডি স্যান্টিসের ‘ট্র্যাজিক হান্ট’, লুইজি জাম্পার ‘টু লিভ ইন পিস’, ‘এঞ্জেলিনা’, ভিসকন্তির ‘দ্য আর্থ ট্রাম্বেলস’, রোজালিনির ‘ইউরোপা ফিফটি ওয়ান’ ইত্যাদি এই আন্দোলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শনরূপে চিহ্নিত।

পূর্ব ইউরোপীয় চলচ্চিত্রের যুদ্ধোত্তর ও আধুনিক ক্রমবিকাশে এই আন্দোলনের বিশেষ ভুমিকা আছে। হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়ার চলচ্চিত্র স্রষ্টারা এর দ্বারা বিশেষ প্রভাবিত হয়েছিলেন। ফেলিক্স মারিয়াসে, জোলতান ফাব্রি, এল্মার ক্লজ, ইয়ান কাদার, আঁদ্রে ওয়াজদা, আঁদ্রে মুঙ্ক, জেরী কাওয়ালেরেউইজ প্রমুখ স্রষ্টার শিল্পকর্মে এর স্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। বিখ্যাত রুশ পরিচালক মিখাইল রমও রাশিয়ান চলচ্চিত্রে নিও-রিয়ালিস্ট-এর কথা বলেছেন। এ ছাড়া ফ্রান্সের পরিচালক ক্লেমেঁ, কায়েৎ, ক্লুজো, জাপানের কিনোসিটো, ইচিকাওয়া, ওশিমার শিল্পকর্মেও এই ধারার প্রতিফলন দেখতে পাই। এমনকি  সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ নির্মাণের পিছনেও নব্য-বাস্তববাদী বা নিও-রিয়েলিজম শিল্পশৈলীর প্রভাব ও প্রেরণা বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়।

নিও-রিয়ালিস্ট সিনেমা যে শুধু যুদ্ধোত্তর ইতালির চলচ্চিত্রের ইতিহাসে বৈপ্লবিক শিল্পআন্দোলন ঘটিয়েছিল তাই নয়, বরং মনে করা হয় যে পরবর্তী যুগের এবং আগামী প্রজম্নের চলচ্চিত্র প্রগতির ক্ষেত্রেও এই আন্দোলনের এক সুগভীর প্রভাব বিস্তৃত থাকবে।   




কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন