কালিমাটি অনলাইন / ৭৯
ইংরেজিতে একটা প্রবাদবাক্য আছে, যার বাংলা করলে দাঁড়ায়,
যে দৃষ্টির বাইরে আছে বা চলে গেছে, সে নাকি মনের বাইরেও আছে অথবা চলে গেছে। প্রবাদবাক্যটির মধ্যে নিশ্চয়ই কোনো পরীক্ষিত অনুভব বা উপলব্ধি আছে, না
হলে এখনও এই প্রবাদবাক্যটি সবার মুখে মুখে উচ্চারিত হয় কেন! তবে আমার নিজের জীবন অভিজ্ঞতায়
ইতিপূর্বে যেটুকু বুঝেছি, তাতে আমার মনে হয়েছিল, ব্যাপারটা আংশিক সত্য। কেননা যাকে
আপনজন মনে করি, ভালোবাসি, তার শারীরিক ভাবে আমার দৃষ্টির মধ্যে থাকা বা না থাকার ওপর
নির্ভর করে না তার প্রতি আমার ভালোবাসার গভীরতা বা ঘনত্ব। একটা সময় ছিল, যখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তি
আজকের মতো এতটা সাফল্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছায়নি, যখন দূরের প্রিয়জনের সঙ্গে যোগাযোগের
মাধ্যম ছিল চিঠি, দূরভাষ ছিল আয়ত্বের বাইরে, জরুরি প্রয়োজনের ছিল টেলিগ্রাম, তখন প্রিয়জন
দৃষ্টির বাইরে থাকলেও মনের বাইরে কখনও থাকেনি। বরং তাকে মনের ভেতর আরও নিবিড়ভাবে ধরে
রেখেছি। আজ অবশ্য কোনো কিছুই দৃষ্টির বাইরে নেই। আমারা ইচ্ছে করলেই প্রযুক্তির হাত
ধরে সেই মুহূর্তেই পৌঁছে যেতে পারি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের আনাচে কানাচে, এমনকি
পৃথিবীর বাইরেও। সুতরাং কেউ দৃষ্টির বাইরে যদি থেকেও থাকে, তাহলে একথা বলতেই হয় যে,
তাকে আমি দৃষ্টিগোচর করতে আগ্রহী নই বলেই সে আমার দৃষ্টির বাইরে অবস্থান করছে। আমি
যে মুহূর্তে তার সঙ্গে দেখা করতে আগ্রহী হব, কোনো প্রযুক্তিযন্ত্রের মাধ্যমে তার সঙ্গে
যোগাযোগ করতে পারব। অন্যদিকে যদি কেউ আমার মনের বাইরে অবস্থান করে, তবে সে আমার দৃষ্টির
সামনে ঘুরে বেড়ালেও মনের বাইরেই থেকে যাবে।
বাংলায় একটি প্রবাদবাক্য আছে, সবারই তা জানা, ধান ভানতে
বসে শিবের গান গাওয়া। তা ব্যাপারটা সেরকমই হলো। ধান ভানতে বসে এতক্ষণ শিবের গানই গাইছিলাম
বা শোনাচ্ছিলাম। আসলে আমি সম্পাদকীয় লিখতে বসে কী লিখব ভেবে না পেয়ে সাম্প্রতিক বিশ্বের
পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের দরুণ যে কিছু সামাজিক বিধি নিষেধ আরোপ
করা হয়েছে সর্বত্র, সেই ব্যাপারটা মাথাচাড়া
দিল। নিজে সংক্রমণ থেকে বাঁচতে এবং অন্যকে বাঁচাতে যে তিনটি স্বাস্থ্যসম্মত আচরণ করার
জন্য সবাইকে সচেতন করা হয়েছে এবং নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে প্রথমটি হলো, বারবার
সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে হাতকে বিপদমুক্ত রাখা। দ্বিতীয়ত মুখে মাস্ক পরে থাকা, যাতে নাক
ও মুখের সুরঙ্গ দিয়ে ভাইরাস অনুপ্রবেশ না করতে পারে। এবং তৃতীয়ত সামাজিক দূরত্ব বজায়
রেখে চলা, যাতে কেউ সংক্রমিত হয়ে থাকলে তার কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা যায়। আর মজার কথা
হলো, এই তৃতীয় নির্দেশের ব্যাপারটা মাথায় আসতেই
ওই ইংরেজি প্রবাদবাক্যের ব্যাপারটাও মনে এসে গেল।
বস্তুতপক্ষে করোনার আগমনের পূর্বে আমরা যে বিশ্বে বাস করতাম,
করোনার অনুপ্রবেশে সেই বিশ্ব আচমকাই কেমন যেন বদলে গেছে। সেই বদলের চেহারাটা আমরা যত
দেখছি, ততই নিজেরাও চমকে চমকে উঠছি। সারা বিশ্ব জুড়ে মানুষের এই অসহায়তা ও বিপন্নতা,
মানবসভ্যতা্র বিরুদ্ধেই যেন চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে করোনা ভাইরাস। মৃত্যুমিছিলের সামনে
দাঁড়িয়ে আমরা প্রতি নিয়ত আতঙ্কিত হচ্ছি নিজেদের মৃত্যুর আশঙ্কায়। সামাজিক দূরত্ব এই
সংকটময় সময়ে বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। অথচ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে
আমাদের সামাজিকতা। জট পাকিয়ে যাচ্ছে আত্মীয়তা। বুঝতে পারছি, পরিস্থিতির চাপে মানুষ
কীভাবে ক্রমশ আরও বেশি আত্মকেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার জালে জড়িয়ে পড়ছে। সৌজন্যবোধ
বিদায় নিচ্ছে নিত্যদিনের জীবনযাপন থেকে। আর তখনই আরও বেশি বেশি মনে হচ্ছে, সেই ইংরেজি
প্রবাদবাক্যটা আংশিক নয়, বরং অনেকটাই সত্য।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন