কবিতার মাঠে প্রোথিত নতুন ভ্রূণ
সে এক দুরন্ত গতিময়
জীবনের কথা বলছি। যখন
আমার বা আমার মতো
আরও অনেকের কাছে তিনি
কবি। তিনি প্রেমিক, বিদ্রোহী। সুন্দরের
পূজারি। সুন্দরও। শুরু
করি তাঁর প্রেম দিয়ে। সুনন্দার
কথা বলি। শুরু করি তাঁর
প্রথম প্রেমিকার গাথা দিয়ে। বলতে
আমার দারুণ আনন্দ। তা
নিয়ে নেই কোনো সংশয়। সুনন্দাদির
ক্লাসে। বাংলা সাহিত্যের শিক্ষক তিনি। কি
তার রঙ কি তার
রূপ!
বন্ধুরা যারা বেশ কবিতা
নিয়ে নাড়াচাড়া করি, তারা খুব
জানি নির্মলেন্দু গুণের
নাম। তখন বয়স কতই বা। ১৬/১৭। সেই
গুণের প্রিয় সখী ছিলেন
আমাদের সুনন্দাদি। দুধে আলতা গায়ের
রংয়ে উজ্জ্বল কপাল। সেখানে
দারুণ এক লাল টিপ
আর সিঁথিতে টকটকে লাল
সিঁদূরে ক্লাসে ঢুকতেন রোজ। কলেজ
জীবনে বাংলার শিক্ষক। মূর্তিমান
চোখের সামনে। পড়াচ্ছেন কবিতা। আর
কি সে কবিতা পরানের
ভেতরে পশে। তার মনোহর সৌন্দর্য
দেখি দুচোখভরে। কবিতার ক্লাসে। বন্ধুরা
কানাকানি, ফিসফাস করি। এই, এই
দেখেছিস। এই সেই সুনন্দাদি; নির্মলেন্দু গুণের
প্রেমিকা। এই ছিল গুণ নিয়ে
অতি উৎসাহ। সেই কৈশোর-উত্তীর্ণ প্রথম
যৌবন আমাদের। সুনন্দাকে তো চোখের
সামনে দেখি। আর মনে মনে
ভাবি গুণের কি রূপ! তারও
চেয়ে মুগ্ধ হই তাঁর
লেখায়। আহা!
সেই প্রথম প্রেমের যুগে। হুলিয়া পড়ে যতনা বুঝি হুলিয়া কিংবা রাজনীতি তারচেয়ে মনে বেশি বসে যায়
বাসন্তীর ছায়া
আমরা ভালোবাসার নামে একদিন
সারারাত/এ গাছের
ছায়ায় লুকিয়ে ছিলুম
সেই বাসন্তী আহা সেই
বাসন্তী এখন বিহারে/ডাকাত স্বামীর ঘরে চার সন্তানের
জননী হয়েছে। (হুলিয়া)
আর আমি? হুলিয়া পড়তে
পড়তে হেঁটে চলি বারহাট্টার
পথে। জীবনে একবারই হাঁটা হয়েছিল
যে পথে।
বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে
চা খেয়েছি/অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি
দিতে এসেও রফিজ আমাকে
চিনল না/দীর্ঘ পাঁচ বছর পর/পরিবর্তনহীন গ্রামে
ফিরছি আমি (হুলিয়া)।
আমার আদিগন্ত চেতনার বিস্তৃত
প্রদোষে জড়ানো সেই নাম বারহাট্টা
। আমার
মায়ের বাপের বাড়ির যাওয়ার
পথ। কত যে শুনেছি মায়ের
মুখে সেই নাম। কোনোদিন
কি গেছি? কোনোদিন কি
যাইনি সেখানে? কেমন ঘোর লাগে মনে। হুলিয়া
পড়ি আর সেই
ষোল সতেরো
বছর বয়সে খুঁজে ফিরি
বারহাট্টা গ্রামের আলতো পথ। জীবনে
একবার আমার মাকে যেতে
দেখেছিলাম বাপের বাড়ি। সব
ভাইবোনের মধ্যে ছোটর দিকে
থাকার কারণে আমি মায়ের
সঙ্গে ছিলাম। সুনন্দাদির ক্লাস
শেষে আমি হাঁটি পথে
পথে। বাড়ি ফেরার। আর খুঁজি সেই
সাত কি আট বছর
বয়সে যখন মায়ের হাত
ধরে চলেছিলাম বারহাট্টার কোন
পথ দিয়ে। চোখে কি পড়েছিল
কোনো হুলিয়া মাথায় বয়ে
বেড়ানো বিপ্লবী? হয়তো দেখেছিলাম। চিনতে
পারিনি হয়তো। আমি তাঁকেই দেখি
শুধু দেশপ্রেমে অন্ধ এক
বিপ্লবী রূপে। তিনি নির্মলেন্দু গুণ। তখন
জীবনের অত রং রূপ অত ক্লেদ-ক্লান্তি
অত উত্তুঙ্গ সম্মান, অত অসম্মান
অর্জন কিংবা বিসর্জন অথবা
প্রেম, বুঝি না কিছুই। দেখি
আপাদমস্তক বিপ্লবী এক কবিকে। এর
চেয়ে বড় কোনো দেশপ্রেমিক
বুঝি আর নেই এ জগতে।
তারপর জীবনের আরও খানিকটা
পথ পার হই। কবিতার
সঙ্গে তখন দৃঢ় গাঁটছড়া
বাধা হয়ে গেছে। মুগ্ধ
হয়ে যাই। যখন বারবার একই
কবিতা পড়তে থাকি। স্টেজ
উঠতে হবে আবৃত্তির জন্য। বারবার
ডিসেকশন, বিষয়, কবিতা, কবি, দেশপ্রেম, ভালোবাসা। একই
কবিতা নিয়ে এত এত
বিশ্লেষণ। অবশেষে অনায়াসে ভালোবেসে ফেলি
কবি,
কবিতা আর প্রিয়দেশ প্রিয়
মাতৃভূমি। যখন পড়ি তাঁর কবিতা
তখন ভালোবেসে ফেলি সমগ্র
কবিকেও।
এ রকম বাংলাদেশে কখনো দেখনি
তুমি/মুহূর্তে সবুজ
ঘাস পুড়ে যায়/ত্রাসের আগুন লেগে লাল হয়ে
জ্বলে ওঠে চাঁদ/নরোম নদীর চর হা করা
কবর হয়ে/গ্রাস করে পরম শত্রুকে/মিত্রকে জয়ের চিহ্ন পদতলে প্রেম
ললাটে ধূলোর টিপ এঁকে
দেয় মায়ের মতন/এরকম বাংলাদেশ কখনো দেখনি তুমি। (প্রথম অতিথি)
পড়তে পড়তে মনে পড়ে
যায় মায়ের মুখে শোনা
সেই ছেলেটির কাহিনি। যে
সুরমাপাড়ে জীবন দিয়েছিল। একাত্তরের
কোন এক নির্জন রাতে। পাক
হায়েনারা যার গায়ের চামড়া
ছিলে নিচ্ছিল। ক্রুদ্ধ হাসি হাসতে
হাসতে। যার একমাত্র সাক্ষী হয়েছিলেন
গোপনে আমার মা। আজীবন
সেই গল্প শুনতে শুনতে
ভালোবেসেছি সেই মুক্তিসেনাকে। গুণের
কবিতায় যখন পড়ি:
নদীর জলের সঙ্গে মানুষের
রক্ত মিশে আছে/হিজল গাছের ছায়া বিপ্লবের সমান
বয়সী/রূপসী নারীর
চুল ফুল নয়, গুচ্ছগুচ্ছ শোকের
প্রতীক/বাংলাদেশ আজ
যেন বাংলাদেশ নয়/এ
রকম বাংলাদেশ কখনো দেখনি
তুমি (প্রথম অতিথি)।
তখন আমি চোখের সামনে
বুঝি দেখতে পাই সেই
পাক হানাদারের ছিলে ফেলে দেওয়া লবণে
ঝলসানো মুক্তিসেনার দেহটি। স্বাধীনতার
দামে সুরমা নদীর জলে
উথালপাথাল হতে হতে কি
নিঃশব্দ করুণ বেদনায় ডুবে
যায় জ্বেলে দিয়ে স্বাধীনতার
লাল সূর্যটি। আমার বুকের ভেতর
সুরমা নদীর জল মানে সেই
সে মুক্তসিনোর রক্ত। আর
আমার মায়ের চুল সেই
গুচ্ছ গুচ্ছ শোকের প্রতীক। আজও
সে গল্প বলতে গেলে
মায়ের চোখ ভেসে যেতে
দেখি জলে। বাস্তব জগত জীবন
আর স্বপ্ন কি অদ্ভুত
সুন্দরতায় কবি ফুটিয়ে তোলেন
ভবিষ্যতের জন্য। এই তার কবি
কাব্য কথকতার অনন্য সৌন্দর্যের
একটি দিক। আজও আলতো ছায়া ফেলে শুয়ে থাকে
আমার আজন্ম চেতনার পথ
আগলে।
কবি আইন প্রণেতা, বিধানকর্তা। কবি
ব্যবস্থাপক, কবি সত্যদ্রষ্টা। কবি
ঐতিহাসিক। এই দায় থেকে কোনোদিন
কবির মুক্তি নেই। এই কথাগুলোই মনে
পড়ে যখন তার লেখনীতে
যখন দেখতে পাই:
হে আগামী দিনের শিশু/হে
আগামী দিনের কবি/শিশুপার্কের রঙিন,দোলনায় দোল
খেতে খেতে তুমি
একদিন সব জানতে পারবে/আমি
তোমাদের কথা ভেবে লিখে রেখে
যাচ্ছি সেই শ্রেষ্ঠ বিকেলের
গল্প
(স্বাধীনতা,
এই শব্দটি কি করে
আমাদের হলো)
সেই ইতিহাস। সেই সে ফুটবে
বলে ফুলের কলির দারুণ
ঘ্রাণ। সেই রেসকোর্সের বিশাল
জনসমাবেশ। সেই পৃথিবী কাঁপানো দারুণ
জ্বালানো ভাষণ। স্বাধীনতা। আর তার বপিত
বীজ। কি তার দারুণ উদ্ভিন্ন
আলোকরেখা। বুঝি তিনিই আঁকতে পেরেছেন
এমন অমর কথকতায়। দারুণ
এক নেতা। দারুন এক যোদ্ধা। দারুণ
সে সংগঠক। দারুণ সে অধিনায়ক। সুচতুর
সে নেতা কিংবা মহানেতা
কিংবা মহানায়ক নির্মলেন্দু গুণের
কথায় কবিতায় উঠে এলেন
নিজেই একজন দুর্দান্ত কবি
হয়ে।
শত বছরের শত সংগ্রাম
শেষে/রবীন্দ্রনাথের মতো
দৃপ্ত পায়ে হেঁটে/অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে
দাঁড়ালেন/তখন পলকে
দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল
জল/হৃদয়ে লাগিল দোলা/জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার
সকল দুয়ার খোলা/কে
রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী?/গণ-সূর্যের
মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন
তাঁর অমর কবিতা খানি;
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির
সংগ্রাম/এবারের সংগ্রাম
স্বাধীনতার সংগ্রাম।
(স্বাধীনতা,
শব্দটি কী করে আমাদের
হলো)।
তবু বলতে হয় আজীবন
কাব্যপ্রবাহে গুণের প্রেমিক সত্তাটিই
প্রাগাঢ়। কবিতায় মনোহরণের দক্ষতা তাঁর
আয়ত্তে। অস্বীকার করবার উপায় নেই। সঙ্গে রয়েছে অসাধারণ
রোমান্টিসিজম। আমার কাছে লাগে রবীন্দ্রনাথেরই ধার কাছ ঘেষা তাঁর
সে আবেগময়তা। যখন এই লাইনগুলো
পড়ি।
মৃত্যু আর রমণীরা যেন
ঠিক সমান বয়সী/অভাব আর অক্ষমতা জীবনের সমান
দোসর।/আমি যাকে ভালোবাসি, যাকে ভাবি
সবচেয়ে প্রিয়তম জন, সে আমার
জন্মাবধি অভিন্ন মরণ।(সহবাস)।
চাওয়ার মতো করে না
পাওয়াকে কিংবা ধরার মধ্যে
অধরাকে অবলোকন। এই রোমান্টিক আবেগময়তার
স্পর্শ পাওয়া যায় কেবল
স্বভাব কবিদের কবিতার মধ্যেই। কবি
স্বয়ং বলেছেন, ‘আমার যা
বলার স্পষ্ট করেই আমি
তা বলবার চেষ্টা করি। যা
কঠিন আমার মন তাতে
সহজে সাড়া দেয় না। সহজ
করে পাওয়ার মধ্যে একটা
আনন্দ আছে। চারপাশের কঠিনের ভিড়ে
আমি চাই সহজ করে বলতে। জানি, এ স্বভাব
নাগরিক কবির নয়। লোক
কবির। মৈমনসিংহ গীতিকার কবিদের মধ্যে
আমার জন্ম| তার কবিতার ভাষা সহজ
সরল সাধারণ মানুষের। সাধারণ
জীবনের সাদামাটা সব শব্দ
আর বাক্যের মধ্য দিয়ে
তার অবাধ অগাধ চলাচল। একেবারে
বোধের গভীরে প্রোথিত। আপনার
একান্ত নিজস্ব যা। তাই
নেই উপমার মুখরতা কিংবা
চিত্রকল্পের দারুণ আতিশয্য। প্রেম
আর রিরংসা তার কাব্যে
হয়তো বা জীবনপ্রবাহে সমান্তরালে
বহমান। কখনো কখনো এরই ব্যাখ্যা
কিংবা বর্ণনায় অবগাহনের মাঝপথে
এসে গেছে নিজেরই বিশ্বাস-অবিশ্বাসের
চির দোলায়মান সংসয়াপূর্ণ স্বীকারোক্তি:
মুহূর্তেই সে মানুষ রক্তের
শাড়ি পড়ে হয়ে ওঠে
আকাকিঙ্ক্ষতা নারী/পায়েতে ঘুঙুর
বাঁধা, খোঁপায় অজস্র পাখি বাঁকানো/বাহুর বৃত্তে নৃত্য করে কাঁপায়
আমাকে/আমি তার
মৃতদেহ সযত্নে টাকার মতো
বেদনার বাস্কে তুলে রাখি/জলের শব্দ শুনে
প্রশ্ন জেগেছিল, এত শীতে
এত জল কার প্রয়োজন?/তুমিও
কি গতরাতে ছিলে তার
সঙ্গে?/তুমিও কি অবশেষে
গর্ভে নিলে মানুষের অমেয়
সন্তান?/তোমাকে দেখার নামে
পুকুরে স্নানের শেষে ঘরে
ফেরা মায়ের গোপন মুখ
ভেসে উঠেছিল(সহবাস)।
গুণের কবিতায় কাম প্রেম দেহজ আর বাসনার
প্রগলভ্তায় আক্রান্ত। যে
সময়টাতে আরিয়ান হেনরি, রজার ম্যাকগাফ
কিংবা ব্রায়ান প্যাটেন-এর কবিতায়
আমরা দেখতে পাই প্রেমিকাকে
বশে আনবার জন্য ছদ্মবেশ, মায়াকান্না। কখনো
কখনো প্রেমিকাকে বিব্রত
বিস্ত্রস্ত কিংবা বিমূঢ় করে তোলার জন্য যাবতীয়
বস্তুগত আস্ফালনই কবিতায় বিষয়আশয়
হয়ে দাঁড়ায় ঠিক তখনই
গুণের কিছ কিছু কবিতায়
দেখি তারই ছায়া। বলা
যায় ব্রিটিশ এসব কবির
দ্বারা কি তিনিও খানিকটা
আচ্ছন্ন কিংবা প্রভাবিত ছিলেন
কি।
কল্পনায় ঘিরে আছি কিছু
অন্ধ যৌনরূপের কঙ্কাল/যদি ব্যর্থ হই এরকম নিঃসঙ্গ
খেলায়
কুরে খাব চর্ব্যচুষ্য লাবণ্য
তোমার
(পিপীলিকা)
কবিতার অঙ্গিক বিন্যাসেও দেখা
গেছে তাঁদের প্রভাব। একের
পর এক অনুভব আর
ঘটনার বর্ণনা:
তুমি চলে যাচ্ছ, নদীতে কল্লোল
তুলে লঞ্চ ছাড়ছে/কালো ধোঁয়ার ধস্ ধ্স্ আওয়াজের
ফাঁকে ফাঁকে
তোমার ক্লান্ত অপসৃয়মান মুখশ্রী/সেই
কবে থেকে তোমার চলে
যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রয়েছি।
(তুমি চলে যাচ্ছ)
কিংবা
ভীরু হাতে কত আদর
শিখেছি এইখানে এলে বুঝি/কত
বেদনার ভালোবাসা নিয়ে তোমাকেই তবু খুঁজি
প্রাণ গুঁজে দেই ছবির
ভেতরে আগুনে পোড়াই হাত/করতল খোঁজে মৎসকন্যা
তুমি যদি এঁকে দাও/এখানে এলেই মনে হয় তুমি
স্তব্ধ প্রতিমা, স্মৃতি(ক্যান্টনে নিরিবিলি)
কিন্তু গুণের কবিতা বরাবরই
সহজিয়া সাধনের ধারায় প্রলুব্ধ। সাবলীল
গতিধারা। তবু পড়তে পড়তে কখন
যেন খুঁজে পাই প্রাণের
ঠাকুর, কিংবা নজরুল। কখনো
আমার কাছে মনে হয়
কি যেন এক
শাশ্মতীই
হয়ে ভেসে ওঠেন তিনি। যেন
সুধীন্দ্রনাথ তার প্রেমের কবিতায় তীব্র ক্ষোভের পরম
প্রকাশে
আমরা দুজনে রচনা করেছি
একে অপরের ক্ষতি/প্রবাসী প্রেমের পাথরে গড়েছি অন্ধ
অমরাবতী।/আমরা নিশিদিন বিহ্বলতায়
শুত্রে-শোণিতে-স্বেদে,/আমাদের
প্রেম পূর্ণ হয়েছে /বেদনায় বিচ্ছেদে
। (নাম দিয়েছি
ভালোবাসা)
বরাবর বিরহ। নারীর ভালোবাসা না
পাওয়ার অসীম যাতনা তার
প্রেমের কবিতাগুলোর রোমে
রোমে প্রোথিত। বেদনার ভাষায় দারুণ
দুঃখকাহন কখনো মনে করিয়ে
দেয় জীবনভর এক বিরহীকবির
দহনের কথা। কখনো দারুণ সংক্ষুব্ধও
কি হয়ে ওঠেন না
কবিতায়?
রমণীর ভালোবাসা না পাওয়ার
চিহ্ন বুকে নিয়ে ওটা
নদী/নীল হয়ে জমে
আছে ঘাসে।(ওটা কিছু নয়)
কিংবা
সকল ফাঁসির রজ্জু জ্বলে
যাবে প্রচুম্বিত কণ্ঠনালী
ছুঁয়ে/ছিঁড়ে যাবে
বেদনার ভারে মৃত্যু- আমাকে ছোঁবে
না।
কবিতার কথা কবির জীবনব্যাপী
এক সাধনার কথা। কতই
বা বলে শেষ করা
যায়। তিনি কবি, তিনি সত্যিই
দারুণ সত্যদ্রষ্টা। কারণ
এই কাব্য কথকতার নিবিষ্ট
জীবনপ্রবাহে আমার দৃষ্টিতে তিনি
যোগ করলেন যেন এক
নতুন প্রেরণ। এ কারণে
যে,
এই জীবদ্দশায় আমি তাকে
ছিনিয়ে নিতেও দেখেছি। আমি
একে বলি ছিনিয়ে নেওয়াই, তবে
সেটা নিজেরই অধিকার। চারিদিকে
যখন এত এত চিৎকার
এত এত আলোচনা পর্যালোচনা-সমালোচনা
তাঁর জাতীয় পুরস্কারের যোগ্য
নিজেকে ঘোষণা নিয়ে। তখন
আমি ভীষণ তৃপ্তি পাই, যখন
দেখি একজন কবি নিজের
নির্দিষ্ট অধিকার আদায়ে সোচ্চার। মনে
মনে তাঁকে জানাই প্রণতি। কেন নেবেন না বলুন
তো?
কী লজ্জাই বা আছে
এতে। যখন চারপাশে সব যোগ্যতাহীন নষ্ট-ভ্রষ্টদের
দখলে সমাজ রাষ্ট্রযন্ত্র। যখন
চারপাশে হায়নাদের প্রচন্ড- প্রতাপ। ক্ষমতা
আর দলবাজির দখলে যাবতীয়
যোগ্যতা কিংবা যোগ্যতার সনদ। যখন
ঠুলি পরা চোখ দেখতে
পায় না আসল কি
নকল। তখন কোনো হীরা কিংবা
পরশপাথর যদি মুখ ফুটে
বলে আমি, আমিই হীরে। মুকুটটা আমারই
প্রাপ্য¨ তখন
কি অপরাধ? আমি বলি
ঠিক আছে। খুব হয়েছে। বেশ
করেছেন তিনি। তাকে স্যালুট। তাকে
জানাই সালাম। যিনি আজন্ম কাব্য
সাধনায় ব্যপৃত রেখেছেন নিজেকে, যিনি
দুহাত ভরে দিয়েছেন দেশকে, সাধারণ
পাঠককে, সাহিত্য ভাণ্ডারকে করেছেন
ঋদ্ধ, তিনিই চোখে আঙুল
দিয়ে দেখাতে পারেন বৈকি। এ তো
শুধু নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠা
নয়,
এ যে কতবড় দিক দিশা
অবোধ মানবের পথ চলার। তা
বুঝে উঠতে বুঝি আরও
একটা জনম দরকার। তাই
আমি বলি তিনি পথ
এঁকেছেন। এও এক কবিতা। কবি
পথ আঁকেন বেঁচে থাকার
পথ। পথ আঁকেন হেঁটে চলার
পথ। পথ আঁকেন অধিকার আদায়ের পথ। কবি
কথা বলেন, হৃদয়ের যাতনার
কথা। কি রক্ত ক্ষরণে জন্ম
হয় প্রতিটি কথার বীজ। কি
যতনার বিষে লালিত হয়
প্রতিটি শব্দের ক্ষত। কি
আরাধনায় সমর্পিত হয় প্রতিটি
কবিতার শরীরে হৃদয়ের প্রবল
রক্ত স্রোত তা শুধু
তিনিই জানেন। তাই আমি এই
পুরো ঘটনাটিকে বলি একটি
নতুন কবিতা। ধন্যবাদ নির্মলেন্দু গুণকে
এই নতুন কবিতার জন্য। এই যুদ্ধের মাঠে
নতুন ভ্রূণ প্রোথিত করার
জন্য। আজীবন এই যুদ্ধে-দ্রোহে-প্রেমে-বিদ্রোহে আর
নৃশংসতায় জন্ম হতে থাক
তাঁর হাতে শত-শত অজর-অমর
অক্ষয় কবিতা।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন