কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

বুধবার, ২৬ নভেম্বর, ২০১৪

১২) কাজল সেন


বনলতার গল্প

বনলতা বলল, এভাবে চলে না। এভাবে চলতে পারে না! একটা কিছু হেস্তনেস্ত হওয়া  দরকার। হয় এসপার নয় ওসপার! কথাটা ঠিকই। সব কিছুরই একটা সীমা থাকা  দরকার। খুব বেশি হলে তার সীমান্ত উপযোগিতা পর্যন্ত। কিন্তু তার বেশি! কখনই নয়। বনলতা যেদিন জন্মেছিল, শোনা কথা, বনলতা কাঁদেনি, হেসেছিল। আরও মজার কথা, সে নাকি জন্মেই চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেছিল, তাকে তার মায়ের গর্ভ   থেকে ঠ্যাঙ ধরে টেনে বের করেছে কারা। আসলে বনলতার মায়ের তো স্বাভাবিক প্রসব হয়নি! গর্ভের ভেতর তার মাথাটা নাকি ওপরের দিকে ছিল আর পা নিচে। বাধ্য হয়ে তাই রীতিমতো অপারেশন করে তাকে বের করতে হয়েছিল। বড় হয়ে ব্যাপারটা জেনে বনলতার একেবারেই ভালো লাগেনি। ঠ্যাঙ ধরে টানাটানি, এসব  আবার কী! না, এভাবে চলে না। এভাবে চলতে পারে না! একটা কিছু হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। হয় এসপার নয় ওসপার!

বনলতার জীবনে তারপর কতবার যে তার ঠ্যাঙ ধরে টানাটানি হলো! এই যেমন  মিডল স্কুলে পড়ার সময় বনলতা একবার স্কুলের স্পোর্টসে নাম দিয়েছিল। তা ভালোই দৌড়াচ্ছিল বনলতা। চারশ মিটারের রেস। ফার্স্ট সেকেন্ড বা থার্ড কিছু একটা অবধারিত ছিল। ফিনিশিং লাইনে দু’পাশে টানটান করে ধরে রাখা দড়িটায় একবার বুকটা ছুঁইয়ে দিতে পারলেই কেল্লা ফতে। কিন্তু তা হবে কী করে! জন্মমুহূর্তে তার যে ঠ্যাঙ ধরে অত টানাটানি হয়েছিল, সেই ঠ্যাঙেই মোক্ষম একটা ঠ্যাঙ ঢুকিয়ে তার সহপাঠী বান্ধবী অনুমিতা তাকে পটকে ফেলে দিয়েছিল দড়িতে বুক ঠেকাবার আগেই। লেঙ্গি খেয়ে ধরাশায়ী বনলতা প্রথমে হকচকিয়ে গেছিল। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে হাসতে হাসতে অনুমিতাকে বলেছিল, তুই এভাবে বারবার জিততে পারবি না অনু! এভাবে চলে না। এভাবে চলতে পারে না! চল্‌ তুই আমার সঙ্গে স্যারের কাছে। একটা কিছু হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। হয় এসপার নয় ওসপার!

পরের লেঙ্গিটা মেরেছিল তার আর এক সহপাঠী বান্ধবী জয়িতা। একই ক্লাসে একই  বেঞ্চিতে বসতো। একই দঙ্গলে হুটোপুটি করতোক্লাস ইলেভেনের বার্ষিক পরীক্ষায় জয়িতার সিট পড়েছিল বনলতার ঠিক পেছনেই। জয়িতা খুব উল্লসিত হয়েছিল। দিদির বিয়ের পর নতুন জামাইবাবুকে নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকায় তার পরীক্ষার প্রস্তুতি বিশেষ হয়নিবনলতা ক্লাসের ভালো মেয়ে। মানে পড়াশোনায় খুবই ভালো। ফার্স্ট সেকেন্ড কিছু একটা হয়তা বনলতা তেমন কিছু আপত্তিও করেনি। পেছনে বসে আমার  আন্সার টুকলি করবি কর, কিন্তু সাবধানে, ধরা পড়লে তুইই বিপদে পড়বি। না,  কোনো বিপদই ঘটছিল না। জয়িতা দক্ষ খেলোয়াড়। ভালোই টোকাটুকি করে পর পর পরীক্ষার আন্সার পেপার জমা দিচ্ছিল। কিন্তু শেষের আগের দিন হঠাৎই গন্ডগোল হয়ে গেল। নকল করা নয়, বরং নকল করতে সাহায্য করার অপরাধে পাকড়াও হলো বনলতা। পর্যবেক্ষক কিছুতেই বনলতার কথা শুনতে রাজী নন। কেননা তিনি জয়িতার গৃহশিক্ষিকা। বনলতা শেষ দিনের পরীক্ষাটা আর দিতে পারল না। আর সবাইকে চমকে দিয়ে এই প্রথম ক্লাসের পরীক্ষায় থার্ড হলো জয়িতা। বনলতা রেজাল্ট বের হবার পর হাসতে হাসতে জয়িতাকে বলেছিল, তুই এভাবে বারবার স্ট্যান্ড করতে পারবি না জয়ি! এভাবে চলে না। এভাবে চলতে পারে না! চল্‌ তুই আমার সঙ্গে প্রিন্সিপলের কাছে। একটা কিছু হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। হয় এসপার নয় ওসপার!

না, সেবার যেমন অনুমিতাকে নিয়ে স্যারের কাছে যাওয়া হয়নি, এবারও তেমনি জয়িতাকে নিয়ে প্রিন্সিপলের কাছে যাওয়া হয়নি। ঠ্যাঙ ধরে টানার বা লেঙ্গি মারার কোনো হেস্তনেস্তই হয়নি। কিন্ত সম্প্রতি ইলোরা যেভাবে তার ঠ্যাঙ টেনে ধরে তাকে লেঙ্গি মারলো, বনলতা তা কখনও ভাবতেও পারেনি। ইলোরা যে এমন কিছু করতে পারে, তাও তার ধারণায় ছিল না।  

ইলোরাও বনলতার ইউনিভার্সিটির সহপাঠী। তার অন্যতম প্রিয় বান্ধবীও। একসঙ্গে দুজনেই ইকনোমিক্সে স্নাতকোত্তর পড়ছে। একই অধ্যাপকের কাছে টিউশনও। পছন্দে অপছন্দে ভালো লাগায় না লাগায় তাদের আশ্চর্য মিল। এমনকি দিব্যজ্যোতিকে যেদিন বনলতা তার প্রণয়ী রূপে প্রথম আবিষ্কার করল, সেদিন ইলোরাই তাকে অনেক বুঝিয়েছিল, দিব্যজ্যোতি খুব ভালো ছেলে, অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য ছেলে। বনলতার সঙ্গে মানাবেও ভালো। তারপর বনলতা একটু একটু করে ঘনিষ্ঠ হয়েছিল দিব্যজ্যোতির। প্রতিদিন দেখা করা, চেনা লোকের চোখের বাইরে ঘুরে বেড়ানো, রেস্তোরায়ঁ খাওয়া দাওয়া, আড়ালে আবডালে চুমু খাওয়া, কখনও বা শরীর স্পর্ষ করে উষ্ণতা মাপা। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু তারপর কী যে হলো! বনলতা একদিন আবিষ্কার করল, দিব্যজ্যোতি এখন আর তার নয়, বরং ইলোরার প্রণয়ী। ইলোরা যে কখন তার ঠ্যাঙ টেনে ধরে তাকে লেঙ্গি মেরেছে, বনলতা তা খেয়ালও করেনি।

শোনা কথা, জন্মমুহূর্তে বনলতা নাকি কাঁদেনি, হেসেছিল। তার পরেও সে কখনও কোনো কারণে কান্নাকাটি করেনি। এবারও সে হেসে ইলোরাকে বলল, জানিস ইলোরা, আমি কিছুদিন থেকেই ভাবছিলাম, এভাবে চলে না। এভাবে চলতে পারে না! একটা কিছু হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। হয় এসপার নয় ওসপার! ইলোরা বনলতার মতোই কখনও মচকানোর মেয়ে নয়। কিছুটা শ্লেষ গলায় ঢেলে হিসহিস করে বলল, কী হেস্তনেস্ত করবি রে তুই বনলতা? কোন্‌ এসপার ওসপার তুই করবি? তুই জেনে রাখ, দিব্যজ্যোতি এখন আমার। শুধুই আমার। আমি দিব্যজ্যোতিকে বিয়ে করব তাড়াতাড়ি। আমাদের বাড়িতে কোনো অমত করেনি। বরং আমার মা বাবা যাবেন দিব্যজ্যোতির বাড়িতে বিয়ের কথাবার্তা বলতে।

এবার, এই প্রথম, বনলতা হাসতে গিয়েও ঠিক হাসতে পারল না যেনবরং একটা  অদ্ভুত বিষণ্নতা তার গলায় ভর করল। বলল, আসলে কী জানিস্‌ ইলোরা, আমি দিব্যজ্যোতিকে ভালোবেসেছিলাম, ঠিকই। এখনও ভালোবাসি। কিন্তু তার বেশি কিছু আর ভাবিনি। বরং ইদানীং ভাবছিলাম, কীভাবে দিব্যজ্যোতিকে বুঝিয়ে নিরস্ত করা যায়। এভাবে চলে না। এভাবে চলতে পারে না! একটা কিছু হেস্তনেস্ত হওয়া দরকার। হয় এসপার নয় ওসপার! ভালোই হলো, আমাকে শেষপর্যন্ত কিছু করতে হলো না। তুই দিব্যজ্যোতিকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করেই দিলি। তবে  ইলোরা, তোকে আর একটা কথাও জানাই, বিছানায় যদি প্রণয়ীর শরীরই সাড়া না  দেয়, তাহলে কোথায় প্রণয় আর কিসের পরিণয়! আমার সেই অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই হয়েছে। এবার না হয় তুই চেষ্টা করে দেখ্‌। বিছানাই তোকে জানিয়ে দেবে কে কার বিছানায় শোবে। 







0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন