সমকালীন ছোটগল্প |
চারুবাবু ফুল বেচছে
রাস্তা
দিয়ে যেতে যেতে থমকে দাঁড়ালাম। মাঝের দোকানটায় বসে থাকা মানুষটাকে কোথায় যেন দেখেছি! কেমন যেন চেনা চেনা!
দু’ দন্ড দাঁড়িয়ে মাথা চুলকাচ্ছি। মনে পড়লো, লোকটাকে দেখেছিলাম শিলিগুড়িতে। ফুলের দোকানের দিকে চোখ ঝুলে রইল।
শীর্ণ চেহারা, ছোটখাটো মানুষটা, গাল ভাঙ্গা, পরনে সাদা ধূতি-পাঞ্জাবী। আমার দু’ চোখে বিস্ময়! জিজ্ঞেস করলাম, “বলুন তো, আপনাকে আগেও কোথায় দেখেছি?”
লোকটা
ফুলে জল ছেটাচ্ছিল, মুখ তুললো, “আমাকে দেখেছেন? কোথায়?”
-“শিলিগুড়ির
রিক্সাস্ট্যান্ডে।”
-“আরে,
শিলিগুড়ি? না, না, ওখানে আমি কখনই যাইনি! অবিশ্যি বসিরহাটে এককালে আমার বসত ছিল।”
-
“মনে হচ্ছে, খবর কাগজের ছবিতে আপনাকে দেখেছি!”
- “আরে কয়েনটা কী? ধ্যাত! আমার মতো ধাক্কা-খাওয়া মানুষের
ছবি খবর কাগজে? এককালে ঢালাই কারখানার ঠিকা
শ্রমিক ছিলাম বটে, এখন ছাটনি হয়ে গেছি। বহুৎদিন এখানেই থাকি, ফুল বেচি, হরেক কিসিমের
ফুল, নানান নামের ফুল!”
-“না,
না। আপনাকেই দেখেছিলাম, শহর ও গ্রামের মধ্যে এদিকে ওদিকে তখন আপনি...!” মনে মনে ভাবছিলাম, বিপ্লব - তখন আগুন
জ্বলছিল, উনি চটি পায়ে সেই আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন, কখনো কখনো সোয়েটার গায়ে
দ্রুত আগুনের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছেন। শরীরে আগুনের ছ্যাঁকা...
ফুলবেচা মানুষটি আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
আমি কথা বাড়ালাম না। নিশ্চিত জানি এই লোকটার নাম চারুবাবু, ছবি কাগজে বেরিয়েছিল। একে ফিনিস করে দেয়া হয়েছিল! কেউ যাতে বুঝতে না পারে, কোন এক রাতে, রাস্তা অন্ধকার করে দিয়ে এই লোকটার মরদেহ নিয়ে গিয়েছিল শ্মশানে। সেখানে নিরিবিলি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল এর দেহ। লোকটা মরে গিয়ে আবার ফিরে এলো নাকি? বিস্ময় আমার চোখে, বললাম, “আমি কিছু ফুল নিতে এসেছিলাম।”
লোকটা
বলল, “কোন ফুল?”
-
“কয়েকটা গোলাপ দেবেন। বোঁটা শুদ্ধ - দশ পিস।”
-
“আরে গোলাপ নয়। আমার দোকানে এ ফুলটার নাম ‘প্রেম’। গ্রাম থেকে আজ সকালেই এসেছে।” ওর
কথাতে আমি ভ্রু কুঁচকালাম।
-
“আর ওই যে ঝুড়িতে রাখা জুঁই। সাদা সাদা। অল্প হলেই চলবে।”
-
“জুঁই নয়, ওই ফুলের নাম ‘শান্তি’। খুব মিষ্টি মিষ্টি গন্ধ।”
সূর্যমুখী
ফুলগুলোকে দেখিয়ে বললাম, “আপনার দোকানে ওটার নাম কী?”
লোকটা
হাসলো, “এই ফুলগুলোর নাম ‘জীবন’, কেননা এরা সূর্যের দিকে চেয়ে থাকে। এগুলোও আপনার চাই?”
লতাপাতা
ঘেরা কিছু বুনোফুলের তোড়া। কী নাম জানি না। বললাম, “ওই যে ফুলের গোছা – ওটা?”
“ওগুলোর
নাম ‘জনতা’! আগে লোকে একে বলতো পুটুসফুল। ঝোপে ঝাড়ে ফোটে।” লোকটা হাসলো।
‘জনতা’ শব্দটা শুনে আবার মনে পড়ল অনেক বছর আগের কথা। কলকাতার একটা গোপন শেলটারে লোকটা লুকিয়ে ছিল? চেপে গেলাম।
লাল
লাল ফুলগুলোর দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম, “জবাগুলোও দিন – এক ডজন।”
লোকটা বললো , “ও জবা! এই ঠেকে ওই ফুলটার নাম দিয়েছি ‘মুক্তি’, ঠিকঠাক নিবেদন করলেই একদম মুক্তি!” লোকটা গুনে গুনে বারোটা জবা একটা ঝুড়িতে রাখলো।
কিছু গ্লাডিওলাস-এর বাদামী বাদামী ফুল, ব্যাটনের মতো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনার দোকানে ওই ফুলগুলোর নাম কি রেখেছেন?”
লোকটা
উত্তর করলো, “এই ফুলের নাম সোনালী প্রতিরোধ। দেখছেন না এর লম্বা সবুজ ডাটগুলো এক্কেবারে
নিরেট বন্দুকের নল!”
ভেবে অবাক লাগলো। চারুবাবু এখন বেচছেন প্রেম, শান্তি, জীবন, জনতা, মুক্তি। নানান ফুল। আবার সেখানে রাখা আছে প্রতিরোধ মার্কা বন্দুকের নলের মতো লম্বা ডাঁটয়ালা ফুলও - গ্লাডিওলাস!
ফুল নিয়ে ফিরে যাচ্ছি। লোকটা বললো, “আবার আসবেন।” আমি শুনেছিলাম, আগুনের দিন, বারুদের দিন! অনেকগুলো বছর কেটে গেছে। আজকে আবার মনে হলো, দোকানে ধূতি পাঞ্জাবী পরে চারুবাবু এখনও ফুল বেচছে! শুধু ফুলগুলোর নাম পাল্টে গেছে, সময়ের হিসেবে, মানুষেরই জন্যে।
চমৎকার লিখেছেন সমরেন্দ্রবাবু।
উত্তরমুছুনঅভিনন্দন।
Fuler Moto galper surobhi chharak charidike. hardik Abhinandan
উত্তরমুছুনধন্যবাদ, গোপেশ রঞ্জন শীল দা!
উত্তরমুছুনকী সাঙ্ঘাতিক ভাবনা সমরদা। দুর্দান্ত গল্প।
উত্তরমুছুনবাঃ খুব ভালো গল্প।
উত্তরমুছুনখুব সুন্দর গল্প
উত্তরমুছুন