কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

রবিবার, ১৪ মার্চ, ২০২১

পারমিতা চক্রবর্ত্তী

 

আলোর পথে নারী




আজ আমি দুই অসাধারণ  নারীকে নিয়ে বলব। পঞ্চসতীর এক সতী সে৷তাঁর নাম আমরা সবাই প্রায় জানি। অহল্যা। অহল্যা এমনই এক স্বাধীনচেতা নারী  যার মূল্যায়ন অতীতেও হয়নি বর্তমানে ও না। অহল্যা অসাধারণ এক নারী। যার  জীবন বয়ে গেছে চরাই উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে ৷ জীবনে বহুবার হতাশা এসেছে কিন্তু সেই হতাশায় মনোবল নষ্ট হয়নি। রাজপ্রাসাদ থেকে আশ্রম, তারপর নির্বাসন সবটা মিলে অহল্যার জীবন৷ তিনি জানেন না হেরে যেতে। শিক্ষা ছিল তাঁর জীবনে ব্রত। কোন কিছুর বিনিময়ে তাঁকে ছাড়তে চাননি। সহস্র প্রতিবন্ধকতা এসেছে তাঁর জীবনে কিন্তু নিজের লক্ষ্য থেকে সরে আসেন নি। পিতা মাতার নয়নের মণি ছিলেন অহল্যা। তাঁর এক ভাই থাকা সত্ত্বেও নিজ মেধা, যোগ্যতায় সবার আকর্ষণ কেড়ে নিতেন। সৌন্দর্য যে  কারোর অহংকার হতে পারে না তার যথার্থ দৃষ্টান্ত অহল্যা। অহল্যা অপূর্ব সুন্দরী। তাঁর পিতা মাতা ভাই সবাই যখন তাঁর জন্য স্বয়ম্বরের ব্যবস্থা করেন তিনি কিন্তু সেই সিদ্ধান্তকে  মেনে নিতে পারেনি৷ পিতা মাতার অমতে বিবাহ করেন ঋষি গৌতমকে। তাঁদের ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। আসলে বেশির ভাগ  নারীরা মেনেই নেন তাঁরা দুর্বল, পরাধীন। অন্যের ইচ্ছাকে মর্যাদা দিতে নিজের ইচ্ছাকে গলা টিপে মারেন।  নারী মাত্রই ভোগ্যবস্তু। তাদের নির্বাচন কিংবা প্রত্যাখ্যান কোনটাই মানতে পারে না সমাজ। এই সমাজ নারীদের সব কিছু মানতে শিখিয়েছে, হার মানতে শিখেয়েছে।  কিন্তু একজন নারী যে কোন পুরুষকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে, স্বেচ্ছায় নির্বাসন নিতে পারে,  তার জলন্ত নিদর্শন অহল্যা। না পুরুষদের শাস্তি হয় না! শাস্তি পায় মূলত নারীরা। কেউ তা মাথা পেতে নেয় কেউ নেয় না। অহল্যা যখন একা আশ্রমে দিন কাটান, নিজের সন্তানদের চোখের দেখাও দেখতে পান না, তখন সারা পৃথিবী মেনে নেয় গৌতম অহল্যাকে প্রত্যাখ্যান করেছে্ন।  আসলে এই প্রত্যাখ্যান শব্দটা আমাদের সমাজ তুলে রেখেছে নারীদেরই জন্য। কিন্তু না! অহল্যা নিজে সব কিছু থেকে সরে আসেন। তিনি অবহেলা করেন মেকি পৃথিবীকে। দেবরাজ অহল্যাকে নষ্ট করেছে্ন না অহল্যা নিজে সেই আগুনে পুড়েছেন সেটা বিতর্কের বিষয়। কিন্তু গোটা পৃথিবী অহল্যাকেই নির্বাসনে পাঠায়। দেবরাজ ইন্দ্র পরবর্তীতে ক্ষমা পান সবার কাছ থেকে। কিন্তু ঋষি গৌতম কখনও কি বুঝেছিলেন অহল্যাকে? অহল্যা যখন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠছিলেন তখন কেন তাঁকে ঋষিকা রূপে স্বীকৃতি  দেননি? অহল্যার পরিচয় এক রাজকুমারী এবং ঋষিপত্নী রূপে স্থির হয়। যদিও পরিসংখ্যান দেখলে বোঝা যাবে অতীতেও অনেক নারীকে সংগ্রাম করতে হয়েছে স্ব অধিকারের জন্য। কিন্তু অহল্যার জীবনদর্শন সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি বুঝেছিলেন  শিক্ষাই হল নারীর অগ্রগতির সহায়ক! তাকে আত্মস্থ করতে না পারলে মুক্তি নেই৷ কিন্তু সেই শিক্ষা কি অহল্যার জীবনের সমস্ত দুঃখ, গ্লানি মুছে দিতে পারল! না পারে নি... তিনি অসাধারণ হয়েও তাঁরও পরিণতি খুব সাধারণ ভাবে হয়েছে।  জীবন সবার কাছেই খুব একান্ত। বাঁচার অধিকার সবার আছে৷ কিন্তু বেশীর ভাগ নারীকে নিজের জীবনের বড় দাম দিতে হয়৷ অহল্যাকে দিতে হয়েছিল৷ জীবনবোধ সবার এক হয় না। যে বা যারা এই সবকিছুর উপরে উঠতে পারে তারাই অসাধারণ হয়ে ওঠে৷ অহল্যাও অসাধারণ হতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাঁকে কেউ সে সুযোগ দেয়নি৷




দ্বিতীয় যে নারীকে নিয়ে বলব তিনি মন্দোদরী৷ ভালোবাসার অপর নাম বলা যায়৷ গোটা জীবন ধরে একটা মানুষকে ভালোবেসে গেলেন, তাঁকে শোধরানোর চেষ্টা করে গেলেন৷ নিজের প্রথম সন্তানকে ধরে রাখতে পারলেন না। রাবণ একের পর এক নারীর জীবনে প্রবেশ করেছেনI কোন দিন জানতেও চাননি মন্দোদরী কি চায়! নিজের প্রথম সন্তানকে বাঁচাতে পারেননি। জন্মাবার পর যখন তিনি দেখেন  তাঁর কন্যা সন্তানের জন্ম হয়েছে, আনন্দে ভালোবাসায় ভরে ওঠেন৷ সাথে ভয়ও পান৷ রাবণ যদি এই কন্যা সন্তানকে অস্বীকার করেন! গোটা পৃথিবীতে অনেক কন্যাভ্রূণ জন্মায়, মরেও যায় অবহেলায়, অনাদরে৷ কেউ তাদের খোঁজও রাখে না৷ কিন্তু মন্দোদরী সেই জায়গা থেকে নিজেকে অনেক দূর নিয়ে গিয়েছিলেন। রাবণের জীবনে এত নারী থাকা সত্ত্বেও রাবণকে শর্তহীন ভাবে ভালোবেসে গেছেন৷ এখানেই তাঁর চরিত্রের সার্থকতা৷ ভালোবাসার জন্য কোন কারণ লাগে  না৷ মন্দোদরী যখন ভালোবাসা কি  বুঝতে পারেন তখন থেকেই তাঁর জীবনে আসেন রাবণ৷ রাবণের জীবনে বারবার উত্থান পতন আসে। আর ততবারই তিনি ছুটে যান মন্দোদরীর কাছে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত মন্দোদরী ভালোবাসার সাথে আপোষ করেননি৷ দ্বিধা, দ্বন্দ্ব সব কাটিয়ে একজন পুরুষকে সৎ পথে আনার চেষ্টা করে গেছেন৷ মায়াময় সহিষ্ণু এক নারী মন্দোদরী। তাঁর জীবনে অনেক বিপর্যয় এসেছে৷ কিন্তু শেষ দিন পর্যন্ত নিজের আদর্শে স্থির ছিলেন। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও তিনি তাঁর স্বামীকে নিষেধ করতে পারেন নি রামের সাথে যুদ্ধ না করার জন্য। নিজের ভগিনীর অপমান এত বড় যুদ্ধের কারণ। শূর্পনখার সাথে মন্দোদরীর সম্পর্ক ছিল খুব ভালো৷ কিন্তু সেই সম্পর্ককে কেন্দ্র করে মন্দোদরী যুদ্ধটা আটকাতে পারেন নি৷ বারবার বোঝার চেষ্টা করে গেছেন মন্দোদরী, রাবণ কি চোখে দেখেন সীতাকে৷ সীতাকে নষ্ট করার উদ্দেশ্য তাঁর আছে কিনা... নিজের স্বামী সম্পর্কে অবগত ছিলেন মন্দোদরী৷ এই অপমান এক নারীর অপমান৷ আমাদের সমাজ শেষে সেই নারীকেই দোষারোপ করবে যে নিজের স্বামীকে আটকাতে পারেনি৷ মন্দোদরী শেষ দিন পর্যন্ত কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ করেন নি।

নারীর জীবনে যতই প্রতিবন্ধকতা আসুক না কেন তা তাঁকেই কাটিয়ে উঠতে হবে৷ ভালোবাসা, দুর্বলতা, সহনশীলতা নারীর ভূষণ হতে পারে না। নারী একটা ছায়া, নির্ভরতা। নারীকে যেদিন প্রকৃতি ভাবা হবে, সেদিন সকল অত্যাচার, লাঞ্ছনা, নিপীড়ন ঘুচে যাবে৷  

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন