সহিষ্ণুতা
সবার মুখে একই কথা, অসহিষ্ণুতা বাড়ছে। কিন্তু কেন আর কবে থেকে, সে
খেয়াল রেখেছে কেউ? একদিনে নিশ্চয়ই মানুষ
অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে নি।! অসহিষ্ণুতারও ইতিহাস
থাকে। যেমন থাকে সহিষ্ণুতার। মানুষ যত সামাজিক হয়েছে তত তার সহিষ্ণুতা বেড়েছে।
সামাজিক নিয়মের মধ্যে সে নিজেকে ক্রমশ অভ্যস্ত হতে শিখেছে। সহিষ্ণুতার আদি পর্বেও
অসহিষ্ণুতা ছিল। নিজস্ব স্বভাব গুণে মানুষ সেটা পেরিয়ে গেছে। এবং দীর্ঘ যুগ ধরে হাজার রকম বিভেদ সত্ত্বেও
পাশাপাশি থেকেছে। এরই মধ্যে যা কিছু হিংসার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো ছিল নিতান্তই
ব্যক্তিগত বা খাবার, নারী এবং এলাকা দখলের জন্য দলবদ্ধ লড়াই। এর মধ্যে অসহিষ্ণুতা
ছিল না। ছিল নিজেকে সেরা প্রমাণ করার প্রয়াস। যে বা যারা জিতে যেত, সে বা তারাই
শেষ কথা বলত, অন্যরা সেটা মানতে বাধ্য হতো। আনুগত্য
দেখাতে না পারলে মৃত্যুদন্ড ছিল অবধারিত।
ধর্মের নামে ইহুদি নিধনের ঘটনা যে ঘটে নি, তাও না। তারপর বহু অত্যাচার এবং হত্যার
মধ্যে দিয়ে যে খ্রীস্টের আবির্ভাব হতে দেখা গেল, সেই আবির্ভাবে ধর্মের চাকা কতদূর
নড়ল, তা বলতে পারবেন ধার্মিকরা। তবে এটুকু বলা যেতে পারে, একজন রক্তমাংসের মানুষকে
ঈশ্বর রূপে মেনে নিল বেশিরভাগ মানুষ। ধর্মের আফিমই হোক বা ব্যক্তির প্রভাব, যে
কোনো কারণেই সেই সময়ের অসহিষ্ণুতার প্রকাশ
কমে যেতে থাকল।
অসহিষ্ণুতা এর পরেও ছিল। চামড়ার রঙ নিয়ে, জাত নিয়ে, অর্থ নিয়ে, যশ প্রতিপত্তি
নিয়ে মানুষে মানুষে বিভেদ ছিল এবং থাকবেও। কিন্তু সেই বিভেদ যখন শাসন করতে আসে,
অসহিষ্ণুতা বাড়ে। আফ্রিকানরা দীর্ঘ যুগ দাসপ্রথার শিকার ছিল। যতদিন না তারা
অসহিষ্ণু হয়ে বিদ্রোহ করেছে, ততদিন তারা সহিষ্ণু ছিল, এমন বলা যাবে কি? বাধ্য হয়ে
সহ্য করার নাম নিশ্চই সহিষ্ণুতা না। আবার সহ্য করতে না পেরে বিদ্রোহ করাকেও
অসহিষ্ণুতা বলতে পারি না। বিদ্রোহ বা বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে দেশের পরিস্থিতি বদলায়,
সময় বদলায়। এও এক সুস্থতার লক্ষণ। পরিবর্তন কাম্য, যদি তা সার্বিক বিকাশ নিয়ে আসে।
পুরনো খোলনলচে বদলে ফেলতে হয়। সেটা পার্সোনাল কম্পিউটারেরই হোক বা নিজের পোশাকের।
এভাবেই খাদ্যাভাস বদলায়, বদলায় রুচি। শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা - কোন জিনিসটি তার
পুরনো ফর্মা ধরে রাখে? সবই এগিয়ে চলে আধুনিকতার দিকে।
এইবার যদি কেউ বলে পুরনো দিন অনেক সহিষ্ণু ছিল, আধুনিক যুগ বড্ড
অসহিষ্ণু, নিশ্চয়ই মেনে নেব না আমরা। পুরনো দিনে জাতপাত প্রথা নিয়ে চূড়ান্ত
অসহিষ্ণুতা ছিল। এখন তা অনেকটাই প্রশমিত।
আবার এখনও কয়েকটি প্রত্যন্ত এলাকায় জাতের নামে খুনোখুনি হচ্ছে। যদি বলি, সেটা
বিচ্ছিন্ন ঘটনা, মেনে নেওয়া যাবে? কোনো রকম খুন বা হত্যা মেনে নেওয়া যায় না। যে কোনো
রকম অপরাধই মেনে নেওয়া যায় না। অপরাধীর
শাস্তির জন্য আইনকানুন আছে, কিন্তু সেটা না মেনে যদি আইন নিজের হাতে তুলে নেয়
জনতা? তখন সেটাই হবে অসহিষ্ণুতা। চোর সন্দেহে রাস্তায় কাউকে পিটিয়ে মেরে দিল
আমজনতা, ডাইনী সন্দেহে কাউকে পুড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিল গাঁও বুড়ো, আর উন্মত্ত
গ্রামবাসী তা পালন করল চোখ বুজে। হিন্দু প্রধান গ্রামে কোনো মুসলমান স্রেফ গরু
খেয়েছে, এই সন্দেহে খুন হলো। আর
তার নির্দেশ দিল গ্রামের মন্দিরের পুরোহিত। এই
পশ্চিমবঙ্গেই একটি মুসলমান প্রধান গ্রামে এখনও দুর্গা পুজো নিষিদ্ধ। যে সরকার
গদিতে চড়ে, সেই সরকার তার স্বার্থ অনুযায়ী অ্যাজেন্ডা তৈরি করে। সত্যি বলতে কি,
ধর্মকে ব্যবহার করে ফায়দা তোলে এই রাজনৈতিক মস্তানেরাই। আর এদেরই চ্যালাচামুন্ডারা
আমজনতাকে উসকোয়।
কিছু অল্পশিক্ষিত বা সত্যিকারের শিক্ষা যাদের হয় নি, ধর্মের আফিম খেয়ে
ঘোরের বশে হিংসায় মাতে। শুভাশুভ জ্ঞান লোপ পায় তখন এদের। তখন আর মনে থাকে না,
পাশের বাড়ির লোকটা অসময়ে তাকে কত সাহায্য করেছিল, সেও সাহায্য নিয়ে তার প্রতিদানে
দিয়েছিল ভালোবাসা, বন্ধুত্ব। তখন মন আর মনে থাকে না। অসহিষ্ণুতার কোনো মলম নেই
বোধহয়। অসহিষ্ণুতাকে উল্টোপথে অর্থাৎ কিনা সহিষ্ণুতার দিকে নিয়ে যাওয়াই এক এবং একমাত্র
রাস্তা। আসলে ঠিক এতটা সরল নয় এই উপায়, আবার ততটা কঠিনও কিছু না। চিন্তার সুস্থতা,
বোধের প্রসারণ খুব জরুরী হয়ে পড়েছে এই সময়ে। আর তার জন্য চাই সঠিক শিক্ষা।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় জঙ্গি দলগুলো প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে
দরিদ্র, অল্প বয়সী, অল্প শিক্ষিত ছেলে মেয়েদের নিয়ে এসে তাদের মতবাদ এদের মাথায়
ঠুঁসে দিচ্ছে। আর এরাও নিজস্ব বিচার বুদ্ধির অভাবে, পরিবারে সামান্য কিছু অর্থের
যোগান হওয়ার খুশিতে নিজেরাই এক একজন জঙ্গি হয়ে উঠছে। কচি বয়সে যে ধ্যান ধারণা
মাথায় ঢুকে যায় একবার, তার থেকে আর
পরবর্তী জীবনে বের হয়ে আসতে পারে না। খুব মর্মান্তিক পরিণতি হয় এদের শেষ পর্যন্ত।
দলের লিডাররা এদের মৃত্যুখেলায় পাঠিয়ে দিয়ে নিজেরা ক্ষমতা আর অর্থ ভোগ করে। এদের
ভেতরে অসহিষ্ণুতার বীজ লিডাররাই পুঁতে দেয় এমন ভাবে যে, সেই বীজ থেকে খুব তাড়াতাড়ি
মহীরূহ জন্মে যায়।
আর শুধু কী ধর্ম বা রাজনীতি নিয়ে আমরা অসহিষ্ণু হচ্ছি? তা তো না। বরং
আমরা এখন আমাদের ছায়াকেও আর সহ্য করতে পারছি না যেন। নিজেদের ওপরেই আমরা বিরক্ত
হচ্ছি কথায় কথায়। খুব হতাশ হয়ে পড়ি এসব দেখেশুনে। আগামী প্রজন্ম কী শিখবে আর! ওরা
তো জ্ঞান হওয়া থেকেই অসহিষ্ণুতা দেখে ফেলছে, শিখেও নিচ্ছে। ওদের কী করে দোষ দিই! একটুতেই
ওরা মেজাজ হারাচ্ছে। ধৈর্য নিয়ে একে অপরের কথা শোনা বা বোঝা, এসব যেন ধাতে নেই
ওদের। যে কোনো কাজই যেন চটজলদি করে ফেলে
হাত গুটিয়ে নিচ্ছে ওরা। টু মিনিট নুডলসের মতো ইনস্ট্যান্ট রেজাল্ট পেতে চায় ওরা। আমরাও মেনে
নিচ্ছি। হয়তো এটা যুগের হাওয়া বদল। এভাবেই হয়তো একদিন সহিষ্ণুতা ধ্বংস হয়ে যাবে।
আমাদের দায়িত্ব কি কমে যাচ্ছে? আমরা কি গা
ছেড়ে এভাবেই বসে থাকব? রাজনীতি যারা করে, তারা ফায়দা তুলবে, ফায়দা তুলবে তাদের
চ্যালারাও। কে কী স্পীচ দিয়েছে, সেই নিয়ে আমরা বিতর্কে মেতে উঠছি। এদিকে আমাদের সহিষ্ণুতা তখন তলানিতে ঠেকে গেছে, সে খেয়াল থাকছে না।
‘মনরে একটু বুঝে সুজে চল্। নিজেকে বোঝা'। নিজেকে বলতে থাকি এসব
দেখেশুনে। মন আমার বড্ড অবুঝ হয়েছে আজকাল।
সেও আর বোঝালে বোঝে না। সেও কিছু হাসিমুখে মানতে চায় না। সবেতেই তর্ক জুড়ে দেয়।
শুধু তর্ক হলে না হয় বুঝতাম, সুস্থতার লক্ষণ এটা। কিন্তু এ হলো অহেতুক গোঁয়ারের
মতো, কেবলমাত্র বিরোধিতা করবে বলে তর্ক
জোড়ে। নিজেকেই চূড়ান্ত অসহিষ্ণু মনে হয় এখন। মহম্মদের মতো আগে নিজে মিষ্টি খাওয়ার অভ্যেস ত্যাগ করে, না হয়
তারপরে অন্যকে বেশি মিষ্টি খাওয়ার কুফল সম্বন্ধে বোঝাবো!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন