কালিমাটির ঝুরোগল্প ১২৯ |
জীবন-মৃত্যু
সবাই যেভাবে বেঁচে থাকে, তুমি সেভাবে বেঁচে থাকোনি। সবাই যেভাবে মরে যায়, তুমি সেভাবে মরে যাওনি। তোমার বেঁচে থাকা আর মরে যাওয়া, একেবারেই আলাদা। কারও সঙ্গে মেলাতে পারছি না। অথচ তুমি তো ছিলে এক সাধারণ মেয়ে। অসাধারণ কোনো গুণ বা প্রতিভা অথবা কৃতিত্ব কিছুই ছিল না। শুধু তোমার বেঁচে থাকাটা ছিল যেমন অসাধারণ, তেমনি তোমার মরে যাওয়াটাও অসাধারণ বলে মনে হয়েছে আমার।
না, তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় অনেকদিনের নয়। প্রথম যেদিন দেখা হয়েছিল, তুমি একটা পথের কুকুরের শুশ্রুষা করছিলে। কুকুরটার পায়ের ক্ষততে যত্ন করে ওষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছিলে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। কাছে গিয়ে বলেছিলাম, আপনি নিশ্চয়ই পশুপ্রেমিক! তাই আপনার এত মমতা তাদের প্রতি! আপনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, না, তা কেন, আমার তো সবাইকেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। তাদের জন্য যতটুকু সম্ভব, কিছু করার চেষ্টা করি। আমি একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে বলেছিলাম, সবাই মানে? আপনি মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, সবাই মানে সবাই, মানুষ-পশুপাখি-কীটপতঙ্গ-গাছপালা। সেদিন আর বেশি কথা হয়নি। তুমি আমাকে তোমার ফোননম্বর দিয়ে বলেছিলে, যোগাযোগ রাখবেন। খুশি হব। তা আমি যোগাযোগ রেখেছিলাম। দেখা করে অনেক গল্প করেছিলাম। তুমি একদিন আমাকে নিয়ে গেছিলে একটি নিষিদ্ধপল্লীতে। দেখলাম, তোমাকে অনেক মেয়েই চেনে। তুমি সেখানে একটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত আছ, যে সংগঠন সেই পল্লীর মেয়েদের কল্যাণে কাজ করে। তুমি একটি মেয়েকে দেখিয়ে বলেছিলে, ওর নাম মনিকা, মনিকার পায়ে এমন একটা ঘা হয়েছে, কিছুতেই সারছে না। ডাক্তারবাবু বলেছেন, ঘা’টা আরও ওপরে উঠলে পায়ে গ্যাংগ্রীন হতে পারে। সেদিন তুমি যে কুকুরটাকে দেখেছিলে তার পায়েও তাই হয়েছে। সত্যিই এখানকার সব মেয়েরা মানুষের মতো বাঁচে না, বরং কুকুরের মতো বেঁচে থাকে। তবুও তারা বাঁচে, কেননা মরে যেতে কেউ চায় না।
তুমি একদিন আলাপ করিয়ে দিয়েছিলে তোমার লিভ-ইন পার্টনারের সঙ্গে। আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, লিভ-ইন কেন, বিয়ে কর। তুমি বলেছিলে, বিবাহজনিত প্রতিষ্ঠানে আমরা দুজনেই অবিশ্বাসী। কেন, বিয়ে না করে আমরা দুজনে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারি না? বলেছিলাম, তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। কিছুদিন পরে যদি ভালো না লাগে, ভালোবাসায় টান পড়ে, তখন কী হবে! বিশেষত যদি সন্তানের আগমন ঘটে! উত্তরে তুমি আত্মবিশ্বাসী স্বরে বলেছিলে, আমাদের দুজনের মনের সমন্বয়ে কোনো খাদ নেই। শরীরী কামনাতেও কোনো অতৃপ্তি নেই। আর আমার ভালোবাসার জন্য তো রয়েছে সবাই, মানুষ-পশুপাখি-কীটপতঙ্গ-গাছপালা সবাই।
হ্যাঁ, তুমি যতদিন বেঁচেছিলে, এভাবেই বেঁচেছিলে। অসাধারণ তোমার বেঁচে থাকা। আমি মুগ্ধ হয়ে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আর ভাবতাম, এভাবে আমরাও বেঁচে থাকতে পারি না কেন! কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনলাম, তুমি মরে গেছ! সেকী! তোমার তো বেঁচে থাকার কথা! অনেক অনেকদিন! মরে যাবার বয়সও তো হয়নি তোমার! তাহলে! আসল খবরটা পেয়েছিলাম তারপর, তোমরা দুজনে নাকি একইসঙ্গে গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিলে!
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন