বেশ কয়েকদিন ধরে আবহাওয়া দপ্তরে খবর আসছে
মেঘ-বৃষ্টির, এই কলিকাতা পুস্তকমেলা ২০২০-র শুরুর দিকে। আসলে কোথাও আমাদের মনেও
আনাগোনা চলছিল মেঘের, ঝড়ের, বৃষ্টিপাতের। অর্থাৎ, মনখারাপের। লিটল ম্যাগাজিনের
পশ্চিমদিক, যেন অস্তাচলের আবছা এক নির্মাণ, সেখানে শুরুর দিনে খাই-খাওয়ার পরিসরে
ব্যাপক সাড়া, জোগাড় যন্তর। ফলে পেট কিছুতেই ক্লান্তি টের পাচ্ছিল না। ওদিকে আমরা,
লিটল ম্যাগাজিনের টেবিল সাপটাতে ব্যস্ত, তখনও লাইট টেস্ট, পজিশনের ভালোমন্দ বুঝে
নেয়া, এবার আচমকা কিছু কার্পেন্টার-এর আগমন—যাঁদের হাতে টেবিলের ছোটোলোকক্ত্ব
দূরীকরণ ইত্যাদি ব্যানার টাঙিয়ে দিলে ১০০ টাকা, খাবারের ময়দানে চেয়ে হাইনিশ্বাস।
একেবারে আমাদের হাতসমান দূরে ওইসব। তো তাতে দুঃখ পাবার কিছু নয়, শুধু দেখানোর যে,
বইমেলারও একখান বারদুয়োর রয়ে যায়। তারা বউনির প্রহরে বই না-কিনে ২০ টাকার চা, তা-ও
তিনগুণ দামে স্ন্যাক্স পেটানোর পর। খেতে পায় না নাকি! আমাদের বেলা ভাটিয়ে আসে,
পেটে কিচ্ছুটি না। সরকারি জল এনে দিলে বন্ধুরা তৃপ্তিসহকারে ওইই। গুমোট-গুমোট।
আরও এক বাইরে রয়ে গেছিল এবার। ময়দান জুড়ে নারীশক্তি।
তারা মিটিঙে, স্লোগানে, ঐক্যে, মুখরতায়, তাকিয়েও দেখেনি বইমেলা। তার একটা রেশ কি
রয়ে যায়নি আমাদের সব্বার মননে মরমে পরানে? ছিল। ফলে যা হয়। অশান্তি, বিধিনিষেধ,
ধরপাকড়। বইমেলায় এবার সে দিকটাও বুঝে নিতে হয়েছে। বলতে হয় বহুমাত্রিক হয়ে উঠেছিল
এইবার ২০২০-র পুস্তকমেলা। বহুমাত্রিকতা
কারও কারও কাছে ভীতির কারণ, যারা মনে করে স্থবির বটই, স্থির পানাপুকুরই, নিশ্চেতন
সমাজই সমস্ত, কোনো অঙ্কুরোদ্গমের মূল্য নেই, নেই শাখাবিস্তার —তারা ক্ষিপ্ত এই সময়। নিবারণ তাই অনিবার্য।
কিন্তু বইপার্বন বই বিকিকিনির। বইয়ের মহা সমারোহ।
পড়ুয়া আর পাঠকের মেলবন্ধন। বইয়ের পাঠকের সঙ্গে অবধারিত আড্ডা, আলাপ-পরিচয়, ফিরে
পাওয়া বন্ধুতা। এবার সেসব ঘটল। ভিন জেলা থেকে পাঠকের অনুসন্ধান। যে বইটির খোঁজে
তিনি অনেকদিনের আকাঙ্ক্ষা পুষে রেখেছিলেন সেটি হাতে নেবেন, আনন্দে মশগুল। এখনও আসেনি
টেবিলে শুনলেই ভয়ানক হতাশ। তেমন পাঠকের হাতে বই তুলে দেয়ার আহ্লাদও কম না। কারও হাতে দু-দণ্ড সময়, বসে পড়লেন পাশের
চেয়ারে। হয়তো বেলা গড়িয়ে এসেছে, হয়তো পা-দুটির বিশ্রাম দরকার, একই খাবারের টুকরো
তুলে দেয়া মুখে। লেখকের বই বেরিয়েছে বড়ো প্রকাশন থেকে, তাদের বড়ো স্টল, সেখানে
নানা ছাড়, প্রলোভন। সেসব ছেড়ে লিটল ম্যাগাজিনের টেবিল আগলে বসে থাকা সেই লেখকের
হাত থেকে বই, একচিলতে হাসিমুখের সঙ্গে বই, একটুকরো কালির আঁচড়ে লেখকের সাক্ষর— এসবের বুভুক্ষু অনেকেই। আজ যাই কাল
যাই করে যে লেখক বন্ধুটি হঠাৎ দেখতে পেয়ে আলগোছে আচমকা জড়িয়ে ধরল, তার মধ্যে মিশে
থাকা আবেগ এইবার সমস্ত এন আর সি, সি
এ এ, পি এন আর-এর দূরত্ব সরিয়ে দিতে পেরেছে তো! বইমেলার হৃদয় এখানেই, বাকি মেলার
চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে মনে হয়।
ও হ্যাঁ, হয়েছে পরিবর্তন। বই মানে যদি জ্ঞান ধরি,
তাহলে অজ্ঞানতার কেতাবের স্টল এবার বেড়েছে। এইসব মহাগ্রন্থের স্টলে ভিড় খুব। লাইন
দিয়ে অজ্ঞানতার খরিদ্দার এদেশেই জাত হয়। আর বহুদিন থেকেই এসব ফিরি ফিরি বিলানোরও
ব্যবস্থা বলবত । তাতে হয়েছে কী, যে মতবাদকে আমরা আগাম গেঁথে যাওয়া মগজে কিঞ্চিৎ ঘেন্নার
স্থান দিই, তার দুর্বলতার দিকটা তন্ন তন্ন করি। ভালোটা আর চোখে পড়ে না। শাকের
আঁটির মতো এবার ইত্যাকার পাঁচালি-টাইপ কেতাবও বিলি হল। ভবিষ্যতে হয়তো ভেষজ ধর্মও
বিলোনো হবে। জ্ঞানবান ও অজ্ঞানের লড়াই সেদিন ছিল, আরও কতদিন চলে তাই দেখার। আরও কত
কুৎসিত হতে পারে তাও দেখার।
সে যাক, শেষ পর্যন্ত জিতে গেল বৃষ্টি। বেশ কিছু
স্টলের সামনে জমে গেল জল, এমন যে, গেট খোলাই গেল না দিনভর। ফুটো নৌকোর পানি সেঁচতে
বেলা গেল। তবে খুশির খবর, কান
পাতলে শোনা গেল, এবার বিক্রিবাটা নাকি ভালোই। লাইন দিয়ে লেখকের উপস্থিততে বই কেনার
দোকানে নয় শুধু— ওদের তো
হবেই, করতেই হবে, কিন্তু জিতে গেল লিটল ম্যাগাজিন।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, অন্যবারের চেয়ে বই কিনেছেন ক্রেতারা বেশি পরিমাণে। আমাদের
বিজ্ঞাপনের বাড়বাড়ন্ত নেই। সামান্য এদিক-সেদিক ছিটেফোঁটা বেরোয়, কারও চোখে পড়ল কি
পড়ল না—তাতে ক্রেতাসাধারণের সুরাহা হয় না। এবার সেই প্রচারের কাজটা সেরেছে সোশাল
মিডিয়া। আত্মগর্বী প্রচারের ধুয়ো নয়, সঠিক বইএর উপযুক্ত প্রচার মোবাইল মারফত বহু
পাঠককে কেনার পথ যে সুগম করে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
লিটল ম্যাগাজিন মানে প্রতিবাদী এক স্বর, তা এই বারের
বইমেলাতে যেন আরও উচ্চকিত হয়ে উঠল। তার সামনে যেমন সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল গড়ে
তোলার দায়, এবার যুক্ত হল জনতার রাজনৈতিক দাবি ও চাহিদার কণ্ঠ। এ দাবি এক সুস্থ
মানবসমাজ তথা সুদৃঢ় ঐক্যে বাঁধা এক নতুন ভারতবর্ষের। ২০২০-র বইমেলা এ-সমস্ত
ইতিহাসের সাক্ষী থেকে নিজেকে গর্বিত মনে করতেই পারে।
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন