ফ্ল্যাশব্যাকে
থিয়েটার পাঁচালি
প্রতি,
থিয়েটার বা মঞ্চনাটকের যে ইতিহাসে জুড়ে
রয়েছে দেশ, পরাধীনতার দ্রোহকাল, স্বাধীনতা। নাটকের জন্যে তাই এককালের শাসক,
দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ব্রিটিশ – আইন তৈরি করে। যে আইনে নাটকের গতি নিয়ন্ত্রিত হয়।
আলোচনার বিষয় এ নিয়ে নয়। আলোচনার বিষয় হল – দেশের স্বাধীনতা ও ৭৫ বছরের সময়কাল।
বলা যায়, যে যে ধরনের থিয়েটার তখনকার বাংলায় চালু ছিল, তারমধ্যে দু-ভাগ করা যায় আলোচনার সুবিধার্থে। এক, থিয়েটার – যেখানে
সমাজের দিকটা ধরা পড়ত। উপন্যাস, গল্প থেকে নাট্য-রূপান্তর। দুই, থিয়েটার – যেখানে
সমাজের বৃহত্তর দিক, অর্থাৎ, স্বদেশ ধরা পড়ত। যে নাটকের মূল উদ্দেশ্যে দেশের
পরাধীনতার কথা বলা। আর তাই, নাট্য-নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হয়ে যায় ১৮৭৬ সালের পরাধীন
ভারতে। বাংলার স্বদেশ নিয়ে লেখা নাটকের নাম সবারই জানা। ‘নীলদর্পণ’ নাট্যকার
দীনবন্ধু মিত্র। রচনাকাল তাও জানা। তবুও লেখার সাল-তারিখ ১৮৫৮-৫৯। আর ১৮৭২ সালে
গিরিশচন্দ্র ঘোষ, নাটকটি মঞ্চস্থ করেন ন্যাশনাল থিয়েটারে। এইটিকে প্রথম নাটক ধরে
আলোচনা করার সুবিধে রয়েছে। কারণ, এক, সন-তারিখের হিসেবের জন্যে। কারণ, দুই, একটি
অত্যাচারিত প্রেক্ষাপট, যা নাটকের দ্বারা শুধুমাত্র নীলচাষীদের কেন্দ্র করে প্লট
গঠিত হলেও, এর মূল থেকে যাচ্ছে শাসকের অত্যাচার। ফলে, এটিকেই ধরা হল। এর আরেকটা
কারণও অগ্রাহ্য করার নয়। বিশেষত, যে নাটককে কেন্দ্র করে ‘নাট্য নিয়ন্ত্রণ আইন’ পাশ
হয়। সেই নাটকের নাম আন্দোলনকারী তালিকায় না থাকলেও, দেশ-পরাধীনতার শীর্ষকে মিলে
যায়। একদিকে ভূমিকা-স্তরে এই নাটকের কথা লেখা গেল। এবারে স্বাধীনতার নাট্য।
স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট এদেশে এমনি
আসেনি। এসেছিল উদ্বাস্তু মানুষের হাহাকার নিয়ে। একদিকে ভিটেমাটি ছেড়ে শাসকের নতুন
নিয়মে মানুষের দলে দলে অজানা ভূগোলে এসে পড়া। কখনও স্টেশনে, কখনও রাস্তার ধারে।
বাংলা হয়ে যায় পূর্ববঙ্গ এবং পশ্চিমবঙ্গ। এহেন অবস্থায় দুই-বাংলার ভূগোলের
বাস্তুহীনদের পাশাপাশি এক মন্দা বাজারের সম্মুখীন হয়ে যায় খণ্ডিত পশ্চিমবঙ্গের
নাটক। যেখানে ধারকর্জ করে টিকিয়ে রাখা রঙ্গমঞ্চ ব্যবস্থা। দর্শক না থাকলে নাটকের
কিছুই থাকে না – একথা এদ্দিনে বুঝে গিয়েছেন পাঠক। ফলে, দর্শকই সব। এহেন অবস্থায়, স্বাধীনতার
পর থেকে বেশ কয়েক বছর মন্দা চলে থিয়েটারের বাজার। এরমধ্যের নাটক অভিনয় নিয়ে বিশেষ
করে পেশাদার রঙ্গমঞ্চে কিছুই ঘটে না। অভিনয় চলে বহু-পরিচিত পুরনো নাটকেরই। যদিও
এরই মধ্যে গ্রুপ থিয়েটার তার অবস্থান সূচিত করেছে। কিন্তু নাটকের পেশাদার কাজ তা
নয়।
স্বাধীনতার পর একটি বিশেষ নাটক
‘বাংলার প্রতাপ’, নাট্যকার শচীন সেনগুপ্ত। নাট্য পরিচালক বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব
অহীন্দ্র চৌধুরী। উপস্থাপনার তারিখ ১৯৪৭ সাল ১৫ আগস্ট। মঞ্চস্থ হয় রঙমহল থিয়েটারে।
যে থিয়েটারের অস্তিত্ব এখন আর নেই। অথচ, স্বাধীনতার সময়ের দিক থেকে ধরলে উল্লেখ্য
মঞ্চ – না-পরাজয়ের ইতিহাস বহনকারী। বিশিষ্ট নাট্য-গবেষক দেবনারায়ণ গুপ্ত, উল্লেখ্য
নাটকটিকে দেশাত্মবোধক নাটক বলেই মনে করেন। এবং তাঁর মন্তব্যে নাট্য-প্রযোজনায় নতুন
কিছু ঘটেছিল আলোকসম্পাতে এবং দৃশ্যপট সজ্জায়। যেহেতু তিনি প্রত্যক্ষদর্শী, তাই
নাটকের উপস্থাপনা বিশেষভাবে বর্ণনা রেখেছেন। আমরা শুধু ফ্ল্যাশব্যাকে সেই ইতিহাস
পড়ি। এবং ‘কালিমাটি’ পত্রিকার সম্পাদক কাজল সেন–এর বহুমাত্রিক চিন্তনে – তা লেখার
সুযোগ পেয়ে থাকি। অর্থাৎ, পুনরায় মূল্যায়ন করার জন্যে ফিরে দেখা। ফিরে দেখার সেই
পর্বে – ‘দেশ’ একটা ফ্যাক্টর। তার সীমানা যতখানি, তারও বাইরের কোন দেশ পর্যন্ত এই
ইতিহাস নিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। এবং দেশের এক বিশেষ কাজ হয়ে থাকে থিয়েটার, অর্থাৎ
নাট্য-চর্চা। এক্ষেত্রে শচীন্দ্র সেনগুপ্ত নাটককার। যিনি অনেক বিষয়েই নাটকরচনা
করেছিলেন। তাঁর রচিত নাটকটি, আলোচ্য নাট্য-প্রযোজনা স্বাধীনতার উদযাপন পর্বের অতীত
ও নাট্য-ইতিহাসের এক বিশেষ চিত্র। যেখানে নাটককার তাঁর ‘দেশ’ বোধে নির্মাণ করছেন। স্বাধীনতার
বছরের সব নাটক যে একই বিষয়ের হয়েছিল তা নয়। নাটককারদের মধ্যে সমসাময়িক পরিস্থিতি
নিয়ে নাটক লেখার প্রবণতা ছিল। যেমন, কালোবাজারি একটি বিষয়। স্বাধীনতার আগে থেকেই
অবিভক্ত বাংলার যে অবস্থা ঘটেছিল – যার জন্যে সমগ্র ভারতবর্ষে তোলপাড় হয়ে যায়।
দেশের বিভিন্ন অংশ থেকে গান, নৃত্য ও নাটক পরিবেশন করে গণনাট্য সংঘের শিল্পীরা
অর্থ জোগাড় করে থাকেন। ঠিক তারই পরের ঘটনায় – স্বাধীনতা। যাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়
বাংলা। সেই বাংলার মানুষের তখন ইচ্ছে কোথায় যে, নাটক দেখতে আসবেন। আর দর্শক হল
নাটকের প্রাণ। সেই টালমালাল সময় চলেছিল। এরই মধ্যে কলকাতার পেশাদার রঙ্গালয় চলছিল।
রঙমহলের কথা উঠে আসে ইতিহাসের পাতা থেকে। আর রঙমহলের সঙ্গে থিয়েটারেরও। একদিকে তখন
প্রবণতা থাকে ইতিহাসের চরিত্রকেন্দ্রিক নাটক-উপস্থাপনার। কারণ, বোঝা খুবই সহজ।
বাংলার হল-মালিকদের সেই সামর্থ্য থাকে না যে তারা থিয়েটার চালাবেন। ফলে, একই নাটক
নামানো হতে থাকে, যা আগে থেকেই রিহার্সাল করে তোলা এবং জনমনরঞ্জনে সাফল্যের মুখ
দেখেছে। বাংলা থিয়েটারের জন্মলগ্ন থেকেই থিয়েটারের সঙ্গে পরাধীনতা শব্দটি ছিল।
সঙ্গে ছিল স্বাধীনতাবোধের এক চেতনা। যা থিয়েটারে এনেছিল একদল নব্য-চিন্তক। প্রত্যক্ষ
দেখার সুবাদে তথ্যকেন্দ্রিক উপাদান না থাকলেও, সামগ্রিকভাবে দেবনারায়ণ গুপ্ত এই
প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। যেখানে গুটিকতক দর্শকের উপর নির্ভর করে হলগুলো চালু
ছিল। এবং তারজন্যে স্বাধীনতার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে ‘রানাপ্রতাপ’ মঞ্চস্থ হয়।
তারিখ ১৪ আগস্ট ১৯৪৮। নাটককার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। পরের নাটক ১৯৪৯ সালে ‘আবুল
হাসান’ মঞ্চস্থ হয়। নাটককার শচীন সেনগুপ্ত। এরপরের নাটক একই সালে ‘রজনী’ মঞ্চস্থ
হয়। নতুন নাটক হিসেবে পরের নাটক ‘নিষ্কৃতি’। নাটকটির নাট্য-রূপান্তর করেছিলেন দেবনারায়ণ
গুপ্ত। তিনি অবশ্য আরও অনেক উপন্যাসের নাট্য-রূপান্তর করেছিলেন। তারিখ ১৯৫০ সালের
২ অক্টোবর। এই নাটক নামতেই (থিয়েটারে এই হল কথ্যভাষ) রঙমহলের আর্থিক অবস্থা ফেরে।
মন্দা বাজারে এমন একটি নাটকের প্রয়োজন ছিল। যেখানে জহর গাঙ্গুলি, প্রভা দেবী,
রানীবালা, হরিধন মুখোপাধ্যায়-এর মতন গুণী শিল্পী অভিনয় করেন। ১৯৫১ সালে আরেকটি নাটক জনপ্রিয় হয়। নাটকের নাম
‘চাঁদবিবি’। নাটককার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ।
পরের নাটক ‘জিজাবাঈ’। তারিখ ১৯৫২ সালে ১ জানুয়ারি।
নাটককার সুধীর বন্দ্যোপাধ্যায়। দুটি নাটকেই প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন প্রভা
দেবী। একসময় চলতে থাকা রঙমহলের অবস্থায় ছেদ ঘটে। সে পৃথক আলোচনার বিষয়। গল্প বা প্লটের
যে নাটকীয়তা, তার দ্বন্দ্ব – যার মধ্যেই নাট্যশালার ইতিহাসের ঘটনা। উত্তরণের পর যে
ইতিহাস জন্মায় – তার চর্চা বুঝিয়ে দেয় যে, বাংলা নাট্যশালা বিদেশিদের দেখাদেখি
শুরু হলেও, তার পেশাদারিত্ব ততটা হয়নি। সেই আর্থিক মন্দা থিয়েটারের ইতিহাস থেকে
দুচারটি থিয়েটার হলের নাম মুছে দিয়েছে। সংখ্যার নিরিখে দেখলে তার ক্ষতি চোখে পড়বে
না। কারণ, থিয়েটার হলগুলো যে ইতিহাসের বাহক – তাতে অনেক মঞ্চ আরও সৃষ্টি হয়ে যায়।
কিন্তু, সময়ের জরিপে যে মঞ্চ আর রইল না, তার খামতি তো মোছে না। যেমন, রঙমহলের
ইতিহাসে অন্যান্য অভিনেত্রীদের মধ্যে প্রভা দেবীর নামোল্লেখ রইল। আগামিতে
অভিনেত্রী না থাকলেও, মঞ্চ-থাকলে তার কাজের ছায়াপাত রয়ে যায়। কিন্তু অবলুপ্ত
থিয়েটার হলের তালিকায় ইতিহাস হয়ে রয়ে রইল, আর যে ইতিহাসের সংরক্ষণও রইল না। অথচ,
স্মরণ করতে গিয়ে তাত্ত্বিকরা বলছেন, এখানে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়-এর রচনা
নাট্যরূপ পেয়েছে। এবং পরবর্তীতে নাট্যকার মনোজ মিত্র-এর নাটকও। এখানে বিধায়ক
ভট্টাচার্যের নাটক অভিনীত হয়েছে। এতদসত্ত্বেও, টিকে রইল না। শুধু রইল স্মৃতি। আর
ফ্ল্যাশব্যাক-র উত্থানে সেই স্মৃতি থেকে লেখা হয়ে চলল। যেহেতু প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে
ছিলেন যাঁরা, শুধু তাঁরাই পারেন আমাদের নাটকের সম্পদ রক্ষা করতে। নাটক থিয়েটার রঙ্গমঞ্চ
পেরিয়ে যে ইতিহাস – যেখানে জ্যান্ত কিছু অভিজ্ঞ মানুষ আজও -- অন্তর থেকে থিয়েটার
ভালোবাসেন সেই স্পর্ধায় থিয়েটারে রয়েছেন। তাঁদের নিষ্ঠাকে স্যালুট। এবং রঙমহলের
ইতিহাসচারী অরুণিতা রায়চৌধুরীকে কুর্নিশ। তারপরের আরও ইতিহাস রইল ফ্ল্যাশব্যাকের আগামী
কিস্তির জন্যে।
_ ইতি
একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক
সত্ত্বাধিকারী … ০১ ১২
২০২২ শান্তিনিকেতন
সঙ্গে ছবি স্কেচ _ অংকনশিল্পী
অর্ঘ্য চক্রবর্তী
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন