কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

ময়ূরী মিত্র

 

কালিমাটির ঝুরোগল্প ১১৪


মহানন্দে পুতুল খতম

 

মিশনারি স্কুলে পড়তাম। পুজোয় টানা ছুটি পেতাম না। লক্ষীপূজোর পর একবার স্কুল খুলত। কদিন ক্লাস হয়ে আবার ঠিক কালীপুজোর সময় ছুটি।

মনে আছে, দুটো ছুটির মাঝের ওই সময়টায় স্কুল যেতে খুব বাঁদরামি করতাম।  কালো বুট পরা পা দুটোকে ঘষে ঘষে বেঢপ সব শব্দ বের করতাম। শরীরটাকেও মার গায়ে হেলিয়ে দিতাম। একটা হাত তুলে রাখতাম ডানার মত। এই বিটকেল শরীর নাচানো বোধহয় অনিচ্ছা ও প্রতিবাদ বোঝাতে! এসময়টায় আমাকে ভোলাতে মা বিডন স্ট্রিটের বিখ্যাত লিটটি কিনে দিতেন। রোজ রোজ। সবুজ চাটনিওয়ালা। হেব্বি মহব্বত লাগত লিটটি খেতে। কিন্তু ওই… একদিন আঙুলশুদ্ধ লিটটি গিলে আবার শুরু হত ভ্যানতাড়া, সবাই এখনো পুজো করছে। এখনো মেলায় নাগরদোলা ঘুরছে তার ইয়া চওড়া হাত পা ছড়িয়ে। যাব না স্কুলে…

প্যান্ডেলের প্রতিমা ছেড়ে কোথাও যেতে মন  চাইত  না এসময়টায়। তাদের  চলে যাবার সময় এগিয়ে আসত বলেই হয়ত বাড়তি একটা টান হত। দেবদেবী কখনো আমার কাছে ঈশ্বর নয় কিন্তু! দেবীমূর্তিগুলো ছিল আমার বন্ধু। আমার থেকে সামান্য বড় ও আমার থেকে সামান্য সুন্দর কয়েকটা জরি-শাড়ি পরা বন্ধু। বন্ধুগুলো যে আমার থেকে সামান্য নয়, অনেকটাখানিই সুন্দর, এ সত্য জমা  থাকত কেবল মনে। টের পেতাম নিজে নিজে। নিজে নিজে টের পাওয়ার ফুর্তিও নিতাম দেবীমূর্তির গলা জড়িয়ে। বিশেষত পাড়ার প্যান্ডেলের লক্ষী আর সরস্বতীর। আকারে ছোট হত তো! দশমীতে টুল ম্যানেজ করে ওটুকু অব্দি হাত পেতাম আরকি!

সন্ধে নামত অতি শীঘ্র। ট্রামের দ্বিতীয় শ্রেণিতে বসে লিটটির চাটনি চাটতে চাটতে দেখতাম, বিডন স্ট্রিট জুড়ে একটার পর একটা  প্যান্ডেল ভাঙা চলছে।   দুমদাম বাঁশের আওয়াজে ছোট্ট বুকে কেমন ব্যথা ধরত। কোথাও আবার দেবীরা   রেডি হতো লরিতে উঠবার জন্য। হারিয়ে  যাবে নাকি ওরা? কাঁদতাম। খুব কাঁদতাম। সুন্দর  হারাবার দুখে কাঁদতাম। খালি হয়ে যাবার ক্রোধে কাঁদতাম। ফেলে দিতে চাইতাম প্রিয় লিটটি। মা বলতেন, খেয়ে নে! দেখবি কদিন বাদে এই ভাঙা পান্ডেলেই বসবে নতুন প্রতিমা। কালো, কিন্তু ভারী সুন্দর দেখতে। সে হবে তোর নতুন বন্ধু। তার আরো  জমক।  

কালী চলে গেলে? আমার প্রশ্ন।

চলে গেলে যাবে। ওরে তাতেও কি থামে দেবীর আসা! আরো কত কত আসবে | ঋতুতে ঋতুতে -- প্রত্যেকটা আগেরটার থেকে সুন্দর।    

বোদ্ধার মত বলতাম, সেই তো! জরিপুতুল না এলে সব মানুষের ভালো হবে কী করে? সবাই লিটটি খেতে পাবে কী করে? না মা?  

সবাই লিটটি খাবে, এই ভেবে সুক সুক করে চাটনি টানতাম। সুন্দর ফিরে  পাবার সুখে বিভোর হয়ে খেতাম।  

জরি-শাড়ি পুতুল! চলেই  গেল। কতক ল্যাংটা দৌড়োয় রাস্তায়। রিক্ত স্বদেশ। আকাল। অকাল বোধন।  

Really?


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন