কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

অভিজিৎ মিত্র

 

সিনেমার পৃথিবী – ২৬    



   

আগের পর্বে আমরা ফিরে দেখেছি অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। এই পর্বে আরেকটু ওপরে উঠব। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশের ছবি নিয়ে আজ  কাটাছেঁড়া। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার ছবি মানেই প্রধানত ফিলিপিন্স, থাইল্যান্ড ও  ইন্দোনেশিয়ার ছবি। এর সঙ্গে আমরা জুড়ে নেব সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও মালয়েশিয়ার কিছু ছবিকেও, যাতে এই এক পর্বেই আমরা মোটামুটি পুরো দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াকেই আওতায় নিয়ে চলে আসতে পারি।  ব্রুনেই, লাওস আর টিমরের কোন সিনেমা আমি দেখিনি, ফলে এইসব দেশের ছবি আজ আমাদের আলোচনায় আসবে না।

তবে একটা কথা বলে রাখি। আজ কিন্তু অন্যান্য পর্বের মত এইসব দেশের ২০-২৫ টা সেরা ছবির কোন লিস্ট তুলে ধরব না। এইসব দেশের সিনেমা বিষয়ক স্বতন্ত্র কিছু গল্প করব আর একটা করে সিনেমা নিয়ে আলোচনা করব। আশা করব, আমার পাঠক-পাঠিকারা নিজেরা এইসব দেশের ছবি সম্বন্ধে একটু কষ্ট করে জেনে নেবেন।

আজকের আলোচনায় প্রথমেই তুলে আনব ফিলিপিন্সের ছবির কথা কারণ এ দেশের সিনেমার ইতিহাস বাকি দেশগুলোর তুলনায় সবচেয়ে পুরনো। ১৮৯৭ থেকে শুরু করে ১৯১৯ সালে প্রথম নির্বাক ছবি হয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সাময়িক কর্মবিরতি এবং তারপর পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক অব্ধি সিনেমার স্বর্ণযুগ – এই পুরোটাই ফিলিপিন্সের ছবির ইতিহাসে জ্বলজ্বল করছে। ভাবুন, ‘চেঙ্গিস খান’ (১৯৫০) যখন তৈরি হয়েছে এবং ভেনিস ও কান ফিল্ম  ফেস্টিভালে দেখানো হয়েছে, তখনো বিদেশী ছবি বিভাগে অস্কার পুরস্কার দেওয়া চালু হয়নি, নইলে হয়তো এই ছবি সেটা পেতেও পারত। আজ আমি ফিলিপিন্সের এক অদ্ভুত ছবি নিয়ে আলোচনা করব – ‘মিরাক্‌ল’ (১৯৮২) যা পরিচালক হিসেবে ইসমাইল বার্নাল-কে এবং অভিনেত্রী হিসেবে নোরা অনর-কে পৃথিবীজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছিল।

এক গ্রাম্য মেয়ে এলসা দাবী করে সে নাকি ভার্জিন মেরি-কে দেখেছে, তার আদেশ পেয়েছে। সে এক গ্রামে গিয়ে গ্রহণের সময় নিজের কথা প্রচার করে। প্রথমে তারা সন্দেহ করলেও যখন দেখে এলসা মুমূর্ষুকে সারিয়ে তুলতে পারছে,  তারা অন্ধভাবে এলসাকে বিশ্বাস করতে শুরু করে। সেই সময় গ্রামে কলেরা মহামারির আবির্ভাব হয়। তারা এলসাকে ধরে ওদের সারিয়ে তোলার জন্য, কিন্তু এলসা সেটা করতে পারে না। ফলে গ্রামবাসীরা এলসাকে ঘরবন্দী করে রাখে। এরপর একদিন এলসা সবার সামনে বলে যে মিরাক্‌ল বলে কিছু হয় না, সে মিথ্যে বলেছে, গ্রামবাসীরা নিজেদের বিশ্বাসের জন্যই সেরে উঠেছে, এতে তার কোন হাত নেই। এটা শুনেই এক আতঙ্কে গ্রামের লোকজন পালাতে গিয়ে কেউ কেউ চাপা পড়ে মারা যায়। শেষ দৃশ্যে দেখা যায় এলসা তার মায়ের কোলে মৃত্যুশয্যায়। এক সিনেমা পরিচালক, যে এলসার জীবনী শুটিং করতে এসেছিল, তখনো শুটিং করে চলেছে।

এই সিনেমা আমার ভাল লেগেছে বেশ কয়েকটা কারণে। এক, থিম। পরিচালক  খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে অন্ধ বিশ্বাস ও ধর্মান্ধতার খারাপ দিকগুলো ফুটিয়ে তুলেছেন, সাধারণ মানুষকে সাবধান করেছেন। আশির দশকে ধর্মান্ধ ফিলিপিন্সে  এই রকম সিনেমা সাহসী তো বটেই। দুই, নোরা অনরের অনবদ্য অভিনয়। শুধুমাত্র চোখের ভঙ্গি দিয়ে তিনি অর্ধেক অভিনয় ফুটিয়ে তুলেছেন। তিন,  ইসমাইল বার্নালের দারুন সিনেমাটোগ্রাফি। এক অখ্যাত অজ্ঞাত গ্রাম, কিন্তু ক্যামেরার কাজে সেই গ্রাম হয়ে উঠেছে নয়নাভিরাম। লং শট বা প্যানোরামিক শট, এগুলো মাটি থেকে বড়জোর আট-দশ ফুট ওপরে ক্যামেরা রেখে করা। ফলে প্রচুর লোকের ভীড় এবং আসা-যাওয়া বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ফুটে ওঠে। ডি-সিকার ‘বাইসাইকল থিভস্‌’ মনে পড়ে যায়। আরো এক কথা না বললেই নয়।  এই ছবি ছিল ‘এক্সপেরিমেন্টাল সিনেমা অব ফিলিপিন্স’-এর প্রথম প্রযোজনা।

ফিলিপিন্সের মত থাইল্যান্ডের সিনেমার ইতিহাসও দীর্ঘ। সেই তিরিশের দশক থেকে স্টুডিও পাড়ার অভিযান শুরু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আবার ১৬ মিলিমিটার ক্যামেরায় নতুন করে যাত্রা শুরু করে আজ থাইল্যান্ডের অ্যাকশন ছবি হলিউডের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উঠে এসেছে। এদেশের ছবির দুটো বৈশিষ্ট্য হল হাতি এবং মার্শাল আর্ট। হাতিকে এদেশে দেবতা হিসেবে পূজো করা হয়, তাই হাতি এদেশের ছবিতে বিশেষ স্থান দখল করেছে। প্রকৃতি ও গ্রাম্য জীবনের পাশাপাশি থাই মানুষদের মার্শাল আর্টে পারদর্শীতাও এখানকার সিনেমায়। আপনারা যারা টনি জা নামক এক থাই হিরোর ‘ওং ব্যাক’ সিনেমাগুলো দেখেছেন, বুঝতে পারবেন আমি কেন একথা বললাম। অবশ্য এখন অনেক তরুণ পরিচালকরা থাইল্যান্ডের শহুরে জীবনের জটিলতা ও মনস্তত্ব নিয়ে বেশ ভাল ভাল ছবি বানাচ্ছেন। এমনকি রোহিঙ্গা সমস্যাও ছবিতে উঠে আসছে। কিন্তু আমি এমন এক ছবি নিয়ে আজ আলোচনা করব, যার ভেতর প্রকৃতি থেকে শুরু করে সাহসিকতা, সবকিছুই আছে। ‘ট্রপিকাল ম্যালাডি’ (২০০৪)। আমার দেখা অন্যতম সেরা থাই ছবি।

কেং থাইল্যান্ডের এক প্রত্যন্ত গ্রামে্র সৈনিক। টং সেই গ্রামের এক যুবক। এদের  দুজনের ভেতর সমকামি এক প্রেম শুরু হয়। কিন্তু শুধু সেই নিয়ে এই ছবি নয়। গ্রামের বয়স্ক এক মহিলার থেকে তারা গল্প শোনে, বাইকে চেপে ঘুরে বেড়ায়, তারপর একদিন কেং তার সেনাবাহিনী নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। এদিকে আরেক সৈনিককে জঙ্গলে পাঠানো হয় এক দুষ্টু তান্ত্রিককে হত্যা করতে কিন্তু সেই সৈনিক আর ফেরে না। এর মাঝে সেই হারিয়ে যাওয়া সৈনিকের জবানিতে দেখা যায় সে জঙ্গলের মধ্যে সেই তান্ত্রিকের মুখোমুখি। তার সঙ্গে বন্দুক বা অন্য কোন আত্মরক্ষার অস্ত্র নেই। এক সময় সে বিড়বিড় করতে থাকে ‘I give you my spirit, my flesh, my memories’। ১২৫ মিনিটের এক টানটান সিনেমা।

আপিসাতপং উইরাসেতাকুল-এর এক মনে রাখার মত ছবি। প্রথম অর্ধে যেখানে প্রকৃতির মনভরা সৌন্দর্য, সমলিঙ্গ প্রেম, দ্বিতীয় অর্ধে সেই প্রকৃতির ভেতরই লুকিয়ে থাকা এক আশ্চর্য যাদু। গল্প বদলে যায়, গতি বদলে যায় এমনকি এই ছবির চরিত্রেরাও বদলে যায়। সেখানেই মজা। এবং অন্ধকারে জঙ্গলের দৃশ্যে উইরাসেতাকুলের ক্যামেরা যেন কথা বলেছে। রহস্যকে রোমাঞ্চে বদলে দিয়েছে।

ইন্দোনেশিয়ার ছবির জগতের যাত্রা শুরু ১৯৩১ সালে, জাকার্তায় এক থিয়েটার হলের সাথে। কিন্তু এখানে আশির দশক অব্ধি সিনেমা তেমনভাবে গুরুত্ব পায়নি যেহেতু লোকেরা হলিউডের ছবি দেখতেই উৎসাহ দেখাত। আশির দশক অব্ধি এখানকার সিনেমা তেমন উল্লেখযোগ্য কোন কাজ করতেও পারেনি, শুধুমাত্র কিশোর প্রেম, ভয় আর কিছু অ্যাডাল্ট ছবি তৈরি করা ছাড়া। কিন্তু ২০০০ সালের পর অনেক তরুণ পরিচালক এগিয়ে এসে এখানকার ছবির হাল  ধরেছেন। এখন ইন্দোনেশিয়ার ছবি দারুন এগোচ্ছে। এই তরুণ প্রজন্মের হাতে  সুররিয়েলিজমের পাশাপাশি এখানকার বিভিন্ন জ্বলন্ত সমস্যাও প্রতিফলিত হচ্ছে। এইরকম এক সমস্যা হল ইন্দোনেশিয়ার (এবং মালয়েশিয়ার) মুসলিম সমাজের বহুগামিতা। সেই নিয়ে বিখ্যাত পরিচালক নিয়া দিনাতার ছবি ‘লাভ ফর শেয়ার’ (২০০৬)।

এই ছবির তিনটে অংশ। প্রথমভাগে এক মহিলা ডাক্তার, তার স্বামীর বহুগামিতায় বিরক্ত, সেই নিয়ে তার প্রশ্ন ও ক্ষোভ। কিন্তু ধর্মীয় অনুশাসন  হিসেবে সে এটা মেনে নিয়েছে। দ্বিতীয়ভাগে এক সদ্যযৌবনা গ্রাম্য সরল মেয়ে, যাকে জাকার্তায় বিউটি কনটেস্টের নামে কোন এক বস্তিতে তার পরিচিত এক বহুগামী পুরুষের ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তৃতীয়ভাগে এক সুন্দরী ওয়েট্রেস যে হাতে প্রচুর টাকা চায়, সেজন্য এক বহুগামী পুরুষের সঙ্গী হয়ে বেরিয়ে পড়ে। এই সিনেমার তিন মহিলার সামাজিক, আর্থিক ও শিক্ষাগত আবহে প্রচুর ফারাক, কিন্তু তারা সবাই বহুগামিতার শিকার। এই ছবি কখনোই কিন্তু  বহুগামিতা ভাল বা খারাপ, এইসব মন্তব্য করে নি। বরং সেদেশের এক বিশেষ  শ্রেণীর পুরুষদের সামাজিক ও মনস্তাত্তিক অবস্থা দেখিয়েছে। ক্যামেরার কাজ মোটামুটি।    

ভিয়েতনাম সিনেমা সেই চল্লিশের দশক থেকে বেশ কিছু ভাল কাজ করে আসছে। পঞ্চাশ থেকে সত্তরের দশক অব্ধি অনেক ভাল সিনেমা তৈরি হয়েছে,  যার পেছনে ফ্রান্সের অবদান অনেকটা। এখানকার সরকার সিনেমার জন্য সাহায্য করে ঠিকই, কিন্তু সেটা নিজের ঢাক বাজানোর জন্য। ভিয়েতনামের এখনকার তরুণ পরিচালকরা তাই সরকারী সাহায্য না নিয়েই নিজের মত ছবি  বানাচ্ছেন। আজ ভিয়েতনামের যে ছবি আলোচনা করব, মনে হয় আপনারা অনেকেই সেই সিনেমার নাম শুনেছেন – ‘দ্য সেন্ট অব গ্রীন পাপায়া’ (১৯৯৩)।

এই সিনেমাও প্রযোজনা হয়েছে ফ্রান্স থেকে। এমনকি এর পরিচালক ট্রান আন হাং এখন ফ্রেঞ্চ নাগরিক হয়ে গেছেন। ফলে এই ছবিকে আধা ভিয়েতনাম, আধা ফ্রেঞ্চ বলাই ভাল। এই ছবির মূল চরিত্র মুই এক কিশোরী, এক ধনী পরিবারের কাজের মেয়ে হয়ে চলে যায়। সেই পরিবারের কর্তা মাঝে মাঝেই কোন মেয়ের সঙ্গে পালিয়ে যায়, কিছুদিন বাইরে কাটায়, আবার ফিরে আসে। পরিবারের কর্ত্রীর এক ছোট ব্যবসা থেকেই সংসার চলে। তাদের তিন ছেলে তিন রকম। শেষবার কর্তা বাড়ি ফিরে আসার পর কঠিন রোগে পড়ে, তার চিকিৎসার খরচ মেটাতে গিয়ে কর্ত্রী নিঃস্ব হয়ে পড়ে। কর্তা মারা যান। কয়েক বছর পর, মুইয়ের খরচ আর চালাতে না পেরে কর্ত্রী তাকে বিদায় দেন। মুই চলে আসে কর্ত্রীর বড় ছেলের এক বন্ধুর বাড়ি, যে অনেকদিন ধরে তাকে মনে মনে ভালবাসত এবং পিয়ানো বাজাত। এখন সে এক নামকরা পিয়ানোবাদক। তার সঙ্গে একটি মেয়ের বিয়ের কথা পাকা হয়ে গেছে। কিন্তু মুইকে তার জীবনে ফিরে পেয়ে সেই পিয়ানোবাদক আবার যুবতী মুইকে আকর্ষণ করে। মেয়েটির সঙ্গে তার বিয়ে  ভেঙ্গে যায়। বোঝা যায় সে বাকি জীবনটা মুইয়ের সঙ্গেই কাটাতে চায়।

মুইয়ের এক ১০ বছরের বালিকা থেকে ২০ বছরের যুবতী হয়ে ওঠার যে রূপান্তর, তা পরিচালক অদ্ভুত মুন্সিয়ানার সঙ্গে দেখিয়েছেন। বিশেষ করে ১০৪ মিনিট সিনেমার শেষ ১২ মিনিট যেন অসাধারণ। আবহে পিয়ানো থেকে শুরু করে চেলো, তিব্বতি গং, এমনকি ঝিঁঝিঁর ডাকও সঙ্গীত হয়ে উঠেছে। পেঁপে  নিয়ে কবিতা পড়া, পেঁপে কেটে তার স্যালাড বানানো, পেঁপের পেট থেকে একটা বীজ তুলে পাত্রে রাখা, একটু পরেই গর্ভবতী মুইয়ের ওপর ক্যামেরা একবার ফোকাস করেই অন্যদিকে, তারপর সব আলোর ডি-ফোকাসড হতে থাকা – সেলুলয়েডে আস্ত কবিতা। এটা দেখে আরেক ফ্রেঞ্চ ছবির কথা মনে পড়ে গেল – ‘দ্য লাভার’ (১৯৯২)। অনবদ্য ক্যামেরা।   

সিঙ্গাপুর স্বাধীন হয় ১৯৬৫ সালে। তার আগেই কিন্তু সিঙ্গাপুরে মালয় ও চিনা ফিল্ম রমরমিয়ে তৈরি হত এবং চলত। বরং স্বাধীনতার পর এখানে ছবি তৈরি খুব কমে যায়। নব্বইয়ের দশকের পর এখানে আবার নতুন করে প্রচুর সিনেমা তৈরি শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের এক সিনেমা ‘মানি নো এনাফ’ এখানকার ফিল্ম সংস্থাগুলোকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। তারপর সিঙ্গাপুরের সিনেমা আবার তরতরিয়ে এগিয়ে চলতে থাকে। বাইরের দেশের সঙ্গে অনেক টাই-আপ তৈরি হয়। ‘ক্রেজি রিচ এশিয়ানস্‌’-এর (২০১৮) মত বিখ্যাত ছবি তৈরি হয়।

আজ আমরা এই ‘মানি নো এনাফ’ নিয়েই আলোচনা করব। হাসির ছবি। তিন  বন্ধু কিয়ং, ওং এবং হুই, কিভাবে বারবার তাদের টাকা কম পড়ে এবং ধার করার অভ্যেস ছাড়তে পারে না। গল্প অনেক বড়, সেই দিকে যাব না। শুধু একটাই কথা - এই সিনেমা গোটা সিঙ্গাপুরবাসীকে হলে গিয়ে সিনেমা দেখতে বাধ্য করেছিল, তারা প্রাণ খুলে হেসেছিল, দেখেছিল কিভাবে স্থানীয় অচেনা কয়েকজন অভিনেতা দিয়েও হিট ছবি করা যায়। এবং এরপর সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি আবার অক্সিজেন পায়। যদিও এই ছবি মেলোড্রামায় ভর্তি, কিন্তু এই ছবিকে আজো কি বলা হয় জানেন? ‘An effective satire of…Singaporean culture’। 

কম্বোডিয়ার সিনেমার ইতিহাস বিশেষ কিছু উল্লেখযোগ্য নয়। পঞ্চাশের দশকে শুরু হয়ে ষাটের দশকে বেশ কিছু ভাল ছবি তৈরি হয়েছিল, খেমের রুজের সময়ে একদম অস্তমিত। এখন তরুণ পরিচালকদের সাহায্যে কম্বোডিয়ার  সিনেমা আবার জায়গা তৈরি করছে। এখানকার এক ছবি ‘দ্য মিসিং পিকচার (২০১৩) কয়েকবছর আগে বেশ হৈ-চৈ ফেলেছিল। খেমের রুজের সময়ে কিভাবে লোকেদের মেরে ফেলা হত, অন্যদের জানতেও দেওয়া হত না, সেই নিয়ে এক ডকু। দারুন স্টাইল। খানিক শুটিং, খানিক অ্যানিমেশন, কিছু মানুষ, কিছু কাঠের পুতুল। কিন্তু আমি এক অন্য ছবি আজ বেছেছি যা এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও পরাধীনতার শৃঙ্খল, দুটোই তুলে ধরেছে। ‘দ্য রাইস পিপ্‌ল’ (১৯৯৪)। অবশ্য এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্‍্য নিয়ে বিদেশী পরিচালকরাই বরং বেশি ছবি বানিয়ে গেছেন।

কম্বোডিয়ার রিফিউজি ক্যাম্পের বাচ্চারা জানে না ভাত কোথা থেকে আসে, কারণ তারা জীবনে কোনদিন সেইসব ক্যাম্পের বাইরে যায়নি। তাদের জিজ্ঞেস করলে তারা সরল উত্তর দেয়, ধান ইউনাইটেড নেশনের লরি থেকে আসে। কিন্তু বড় হয়ে একদিন এইসব বাচ্চাদের ধানচাষ শিখতে হবে। খাবার জন্য, জীবনধারনের জন্য তাদের পরিশ্রম করতেই হবে। কৃষক হিসেবে যে কঠিন জীবন তাদের সামনে এগিয়ে আসছে, সেই গল্প তাদের জানতে হবে। এই সিনেমায় মেকং নদীর তীরে সেইরকম এক কৃষক পরিবারের গল্প, কোন এক চাষের ঋতুতে ধানচাষ করতে করতে তাদের কত বেগ পেতে হচ্ছে, সেই দলিল। চাষ করতে গিয়ে বিষাক্ত কাঁটায় পা পড়ে চাষী মারা যায়। চাষীর বউ দুঃখে মদ খেতে শুরু করে, প্রায় পাগল হয়ে যায়। তাদের বড় মেয়ের ওপর সেই ধান বড় করে কাটার দায়িত্ব বর্তায়।

এই ছবিতে আমি অভিভূত হয়ে দেখেছি গ্রাম্য প্রকৃতি। পুকুরে ফাঁদ পেতে মাছ ধরা থেকে শুরু করে বর্ষায় সবুজ ক্ষেতে ধানচাষ এবং একসঙ্গে মেঝেতে বসে গোটা পরিবারের খাওয়া – এই ছবি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল যেন বাংলার কোন গ্রামের সিনেমা দেখছি।

মালয়েশিয়ায় ১৯৩৩ সালে প্রথম সিনেমা তৈরি করেছিল এক ভারতীয় কোম্পানি – ‘মোতিলাল কেমিক্যাল কোম্পানি অব বোম্বে’। কিন্তু জাপান এই  দেশ দখল করে নেওয়ার পর এখানে সিনেমা তৈরি বন্ধ হয়ে যায়। আবার পঞ্চাশের দশকে এখানে বেশ কিছু ভাল সিনেমা তৈরি হয়েছিল, যার নেপথ্যেও ছিলেন ভারতীয়রা। যেমন ‘হাং তুয়া’ (১৯৫৬) বানিয়েছিলেন বাঙালি পরিচালক  ফণী মজুমদার। অবশ্য এখানে বিভিন্ন রকম ভাষাভাষীর আধিক্যের কারণে বেশ  কিছু ভাষায় সিনেমা তৈরি হয় – মালয়, মান্দারিন, ক্যান্টোনিজ, তামিল ইত্যাদি। কিন্তু সেই অতীত আর নেই, এখন এখানে তেমন উল্লেখযোগ্য বা সিরিয়াস কাজ বিশেষ হচ্ছে না। একটা ছবির কথা আজ বলব – ‘দ্য বিগ ডুরিয়ান’  (২০০৩)। আমার মনে হয়েছে গতানুগতিক ছবির বাইরে একটু অন্যরকম।

ডুরিয়ান হল একরকম বড় কাঁটাওয়ালা ফল (কাঁঠালের মত) যা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এইসব বিভিন্ন দেশে হয়ে থাকে। অবশ্য কাঁঠালের থেকে এর বৈসাদৃশ্য হল যে এর মধ্যে কোন আঠা থাকে না। যাইহোক, সেই ডুরিয়ানের রূপক হিসেবে এই ছবির নাম ‘দ্য বিগ ডুরিয়ান’। ঘটনা ১৯৮৭ সালের রাত্রে, এক  সৈনিক তার M16 রাইফেল নিয়ে কুয়ালালামপুরের রাস্তায় এলোপাথারি গুলি চালিয়েছিল। গোটা শহর জুড়ে এক প্যানিক তৈরি হয়েছিল। লোকেরা ভেবেছিল হয়ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লেগেছে। সেই ঘটনাকে আধার করে এই ছবিতে পরিচালক খানিক ডকু, খানিক কল্পনা তৈরি করেছেন। কেন এমন হল? এরপর কি হল? সেই নিয়ে পরিচালক ২৩ জন বাসিন্দার ইন্টারভিউ নিয়েছেন। কেউ সত্যি, কেউ কল্পিত। মসৃণ মিশ্রণ। সেটাই আমির মহম্মদের এই সিনেমার  সাফল্য। অবশ্য এই ছবি স্পষ্ট করে এটাও দেখিয়েছে মালয়েশিয়ায় ধর্ম ও রাজনৈতিক বিছিন্নতা কতখানি।  

শেষ করার আগে তাইওয়ানের একটা ছবির কথা বলব, যেটা একইসঙ্গে সাহসী ও মজার। ‘ডিয়ার এক্স’ (২০২০)। যদিও তাইওয়ান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার কোন  দেশ নয় (এটা অফিসিয়ালি চিনের এক অংশ), ফিলিপিন্সের ওপরের এক ছোট্ট দ্বীপ, কিন্তু এই ছবির কথা এখানে উল্লেখ না করে থাকতে পারলাম না। এক ব্যক্তি মারা যাবার পর তার বৌ এবং তার সমকামী পার্টনারের ভেতর ঝামেলা শুরু হয় কারণ সেই মৃত লোকটির সমস্ত ইনস্যুরান্সের মালিক এখন সেই পার্টনার। ঝাঁঝালো ছবি, এবং অবশ্যই দমফাটা হাসির। ছবিটা দেখুন।

(ক্রমশ)

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন