কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

রাহুল দাশগুপ্ত

 

ধারাবাহিক উপন্যাস

 

একটি অপরিকল্পিত হত্যার কাহিনী

 


(২৪)  

 

আগ্নেয়ই প্রথম সমিধাকে বলে, তুই দেখেছিস বিশ্রুতর নিজের কোনও কথা নেই? হৃদয় যা বলে, ও ঠিক তাই বলে?

তাই কী? সমিধা একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়েই জানতে চেয়েছিল। পরে একদিন বিশ্রুতকেও সে বলেছিল, আচ্ছা হৃদয় যা বলে, তুই তাই বলিস কেন? তোর কি নিজের কোনও কথা নেই?

এই প্রশ্ন শুনে সবচেয়ে বেশী হেসে উঠেছিল দিশারী। তারপর বলেছিল, তোর কি ধারণা, আমাকে ও যেসব কথা বলে, আগে বলেছে সবই হৃদয়ের শিখিয়ে দেওয়া?

হকচকিয়ে গেছিল সমিধা। তারপর বলেছিল, না না, ওটা তো আলাদা ব্যাপার, আমি ফুলের বাগানের কথা বলছি...

বিশ্রুত এতক্ষণ ওদের কথাবার্তা শুনছিল। কিছুটা কৌতুক নিয়েই বোধহয়। তারপর বলেছিল, হৃদয়ের প্রতি আমার সমর্থনটা বোধহয় একটু বেশীই। ও যেভাবে ভাবে, পরিকল্পনা করে, সেগুলোকে কার্যকরী করার চেষ্টা করে, শুধু নিজেকে নিয়ে নয় সবাইকে জড়িয়ে সবার ভালোর কথা ভেবে আর কেউ তো সেভাবে করে না...

দিশারীও সকৌতুকে শুনছিল। তারপর বলল, আমিও তাই মনে করি। শুধু শুধু বিরোধিতা করতে যাবেই বা কেন? অন্য কথাই বা বলবে কেন? যেখানে ওর নিজের কথা আছে সেখানে ও ঠিকই বলে। যেমন আমার কাছে। ফুলের বাগান নিয়ে হৃদয় যা ভাবে বা করে, বিশ্রুতর তা নিয়ে কোনও আপত্তি নেই। শুধু শুধু নিজেকে ও আলাদা প্রমাণ করতে যাবে কেন? সেটা তারাই করবে হৃদয়কে নিয়ে যাদের ইগো সমস্যা আছে, হৃদয়ের ব্যক্তিত্বকে যারা নিজেদের পক্ষে বিপজ্জনক মনে করে এবং সেই ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের আলাদা করে চিহ্নিত করতে চায়...

সাঁঝ পরে শ্রমণকে বলেছিল আসলে বিশ্রুতর ব্যাপারটা ছিল আলাদা। ও ডান্স কলেজে চান্স পেয়ে গেছিল। ও জানত, ভবিষ্যতে ও কী হতে চলেছে। ওর জীবনে একটা নিশ্চয়তা ছিল। বাকি সবারই কিন্তু ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা অনিশ্চয়তা ছিল। নিজেদের পরিবারেও এই নিয়ে টানা পোড়েন ছিল। ফুলের বাগানটা থেকে ভবিষ্যতের জন্য কিছুটা সুবিধা করে নেওয়া, এটাই ছিল তাদের ভাবনায়। ওরা তাই হৃদয়ের প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছিল। বিশ্রুতর ক্ষেত্রে এরকম কোনও আশঙ্কা ছিল না। ও অন্য পথের পথিক। ফুলের বাগান থেকে ভবিষ্যতের পাথেয় জোগাড় করে নেওয়ার কোনও প্রয়োজন ওর ছিল না। ও ওখানে যেত নিছক বন্ধুত্বেরই তাড়নায়। তাই হৃদয়ের কাজকর্মকেও ও দেখতে পেত নিরপেক্ষভাবে। অন্যদের মতো ওর চোখ তাই ঝাপসা হয়ে যায় নি। হৃদয় শুধু বন্ধুত্বকেই গুরুত্ব দিত। ওটাই ছিল তার ফুলের বাগানের ভিত্তি। আর বিশ্রুতও আসত শুধু বন্ধুত্বেরই জন্য। ফলে ওদের মধ্যে সহজ একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। অন্যদের কাছে ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ ছিল না। হৃদয়ের সিদ্ধান্তগুলো তাদের অনেক লাভলোকসান হিসেব নিকেশের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল। ফলে কোনও সিদ্ধান্ত তাদের পছন্দ না হলেই তারা প্রবলভাবে প্রতিক্রিয়া জানাত। হৃদয় ফুলের বাগান নিয়ে অনেক কাজ করতে চাইত। ফুলের প্রতি ভালোবাসা থেকেই সে এসব চাইত। বন্ধুত্বই ছিল তার সে কাজের শক্তি। বিশ্রুত এই ব্যাপারটা বুঝত। হৃদয়ের পরিকল্পনাগুলোকে সফল করতে সাহায্য করত। অন্যরা এই সমর্থনের মধ্যে দেখতে পেত অন্ধত্ব ও মেরুদণ্ডহীনতা। ফুলের বাগানের ব্যাপারটা তারা ভাবত নিজেদের স্বার্থের সঙ্গে জড়িয়ে। হৃদয় বা বিশ্রুতর মতো নিঃস্বার্থভাবে তারা ফুলের প্রয়োজনের কথা ভাবত না। তারা ভাবত নিজেদের প্রয়োজনের কথা। দিশারী সবই বুঝতে পেরেছিল। ফুলের বাগানের ব্যাপারে বিশ্রুত হৃদয়ের প্রতিপক্ষ না বন্ধু একই ভালোবাসা দায়বদ্ধাওতা ও সহমর্মিতার অংশীদার নিজের ভেতরে এটা সে অনুভব করেছিল।

ওদের মধ্যে যৌনতা নিয়ে প্রথম খোলাখুলি কথা বলতে শুরু করেছিল আগ্নেয়। এই ব্যাপারটাই সাহসী করে তুলেছিল বিশ্রুতকে দিশারীর সঙ্গে ওর যৌন মুহূর্তগুলোর অকপট বর্ণনা দিত সে। বন্ধুরা খুব কৌতূহলী হয়ে শুনত সেসব। আগ্নেয়র সঙ্গে ওর তফাৎ ছিল। আগ্নেয় মেয়েটির শরীরের বর্ণনা দিত নিপুণভাবে। নিজেকে সে কখনওই সামনে আনত না। বন্ধুদের কাছে মেয়েটিকে একটি যৌনবস্তু হিসেবে উপস্থাপিত করতে চাইত। এতে ওর লোভী ও কামুক সত্বাটাই যেন প্রকাশ পেত। বিশ্রুতর কাছেমুখ্য ছিল ওর অকপটতা। বন্ধুদের কাছে একে অপরের জীবন হবে খোলা বইয়ের মতো। ও যেন বন্ধুদের সেই শর্তই পালন করত। যৌনতাকেও ব্যক্তিগত বলে ভাবত না। বন্ধুদের তার অংশী(দার করতে চাইত। তাদের কাছে জীবনের সবচেয়েব্যক্তিগত মুহূর্তগুলোকে প্রকাশ করাটাও বন্ধু হিসাবে ও নিজের কর্তব্য বলেই মনে করত।

সমিধার বাড়িতেই বিশ্রুতকে নতুন চোখে দেখতে শুরু করে মেহুলী। খুব ছোটবেলায় বিশ্রুতর সঙ্গে মেহুলী একই ক্লাসে পড়ত। মেহুলীর প্রতি অসম্ভব এক মুগ্ধতা ছিল বিশ্রুতর। মেহুলী এটা জানত। ক্লাস ফাইভে মেহুলীরা অন্য একটি দ্বীপে চলে যায়। এখানেই নির্মাল্য আর আগ্নেয়র সঙ্গে আলাপ হয় তার। ওরা তিনজনে একসাথে বড়ো হতে থাকে।

বিশ্রুতর কাছে মেহুলীর কোনও ঠিকানা ছিল না। অনেক চেষ্টা করেও কোনও খোঁজ পায়নি সে। মেহুলীকে হারানোর যন্ত্রণা অনেকদিন নিজের ভেতরে বয়ে বেরিয়েছে বিশ্রুত। সাহস করে কাউকে বলতেও পারেনি। প্রথম মুখ খুলেছিল হৃদয়ের কাছে। এর কিছুদিন পরই তার জীবনে আসে দিশারী। আগ্নেয় নির্মাল্যকে নিয়ে ফুলের বাগানে আসে। নির্মাল্য নিয়ে আসে মেহুলীকে। তাকে দেখে চমকে ওঠে বিশ্রুত। মেহুলী তখন আগ্নেয়কে নিয়ে নতুন খেলায় ব্যস্ত। আগ্নেয় যখন বন্ধুদের কাছে মেহুলীর শরীরের বর্ণনা দিত, তখন একটু বিচলিতই হয়ে পড়ত বিশ্রুত।

দিশারীর সঙ্গে বিশ্রুতকে দেখেই যেন ঘোর কাটে মেহুলীর। শৈশবে বিশ্রুত যখন মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত তখন মনে মনে একটু মজাই পেত মেহুলী। তারপর তো বহুদিন কোনও যোগাযোগ নেই। তেমন করে মনেও পড়েনি বিশ্রুতকে। কিন্তু কেন জানি বহুদিন পর বিশ্রুতকে দিশারীর সঙ্গে দেখে অসহ্য মনে হল তার। ছটফট করে উঠল। কেবলই মনে হতে লাগল বিশ্রুতর ওপর তার অধিকার অনেক বেশী। বিশ্রুতকে সে অনেক বেশী সুখী করতে পারত। আর নিজেও সুখী হতে পারত জীবনে।

বিশ্রুত ঠিক করেছিল মেহুলীর সাথে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখবে। পুরনো কথা তুলবে না। তাছাড়া তোলার মতো কথাই বা কী আছে! ব্যাপারটা তো পুরোপুরি একপেশে ছিল। মেহুলী তাকে তেমন করে গ্রাহ্য করেনি কোনও দিন। পাত্তাও দেয়নি। তার ভেতরে যা ছিল তা সম্পূর্ণ তার নিজেরই ব্যাপার। হৃদয় ছাড়া দুনিয়ায় কেউ সেকথা জানে না। সেই কথাটা আর মনে রাখারই দরকার নেই। এ এক সম্পূর্ণ নতুন সম্পর্ক। একে নতুনভাবে গড়ে নিলেই হল।

ইতিমধ্যে দিশারী একটা চাকরি পেয়ে গেল। নামকরা একটা সার্কাস কম্পানিতে একজন ড্যান্সার দরকার। ছমাসের কন্ট্রাক্ট। বিদেশে যেতে হবে। বাইরে বাইরেই থাকতে হবে। দিশারীর বাবা ছিলেন এই সার্কাস কম্পানির ট্রেনার। দিশারী নিজেও সার্কাস সম্পর্কে অনেক কিছুই জানে। চাকরিটা তার সহজেই হয়ে গেল। বিশ্রুতও বলল, এই অভিজ্ঞতা খুব কাজে আসবে। কম্পানির সার্টিফিকেটটাও একটা ব্যাপার। মেহুলী ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। খুব একা একা কাটছিল বিশ্রুতর। দিশারীর সঙ্গে ফোনে কথা হয় ঠিকই, কিন্তু খুবই ব্যস্ত থাকে সে। একদিন সমিধার সঙ্গে গল্প করে বিশ্রুত ফিরছিল। হঠাত রাস্তায় মেহুলীর সঙ্গে দেখা। সবে সে বিদেশ থেকে ফিরেছে। সমিধার কাছেই আসছিল। বিশ্রুতকে দেখে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সন্ধ্যার আলোয় তাকে দেখতে খুব সুন্দর লাগছিল। বিশ্রুতর মনেও পুরনো সেই মুগ্ধতার আবেশ যেন ছড়িয়ে পড়ছিল। মেহুলীর অনুরোধে কাছেই একটা পার্কে গেছিল ওরা। নিরিবিলি একটা বেঞ্চ দেখে দুজনে বসল। গাছপালার ফাঁক দিয়ে সমুদ্র উঁকি মারছিল। অবিরাম তার ঢেউয়ের শব্দ শোনা যাচ্ছিল।

(ক্রমশঃ) 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন