তৃতীয় নয়ন
“হ্যাঁ
রে নিরু... উঠলি বাবা?” সরবালা দেওয়াল ধরে ধরে নির্মাল্যর ঘরে এসে দাঁড়ালেন। সরবালা সত্তর ছুঁইছুঁই। স্বামী মারা গিয়েছেন অনেক কাল হল। চোখে ভালো
দেখেন না। একটা সময় চশমায় ভালো পাওয়ার ছিল, বয়স বাড়তে গ্লুকোমা, রেটিনায় ছোট একটা ফুটো,
আর এখন সুগারটা বেড়ে প্রায় অন্ধই বলা চলে।
“তুমি আবার
সেই হেঁটে হেঁটে এলে? মালতিদি কোথায়?” নির্মাল্য আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসল। “মালতি আছে
তো, জলখাবার করছে। চোখে ভালো দেখি না, কাজকম্ম করতে পারি না, এই এক জ্বালা!... আচ্ছা
নিরু, একটা কথা শুনবি বাবা? তোদের আপিসের কাছেই যে বুড়োশিব মন্দির, শুনেছি নাকি বড়
জাগ্রত। অনিমেষের মা সেদিন বললেন যে, ওইখানকার আশীব্বাদি জলে চোখ ধুলে চোখ নাকি ভালো
হয়ে যাবে, একেবারে অব্যত্থ। তা এই বোতলখানা আপিসের ব্যাগে ভরে নিবি বাবা... ওইখান থকে
এট্টু ছুঁইয়ে আনবি”...
ঠিক যাতায়াতের
পথে না পড়লেও, নির্মাল্যর অফিস থেকে অল্প দূরেই বহু পুরনো বুড়োশিব মন্দির। নির্মাল্য এসব খুব একটা মানে টানে না। তবে, সত্যি কথাই, সাধ্যমত
চেষ্টা সে অনেক করেছে, বুঝেছে এ পুরো সারার নয়। তার চেয়ে টোটকায় যদি ফল হয়... শোনাও তো যায় এমন অনেক ঘটনা!
নির্মাল্যর
অফিস থেকে বেরতে রাত হয়। বুড়ো শিবের থান থেকে জলের বোতল ছুঁইয়ে মা’কে দিতে সরবালা ভারি খুশী হন, ছেলেমানুষের মত আনন্দ পান। নির্মাল্যর ওইটুকুই শান্তি - “মা? কী বুঝছো? উন্নতি হচ্ছে কিছু? আগের থেকে একটু ভালো দেখতে পাচ্ছ?... যাই কর, ওষুধ ক’টা বন্ধ কোর না যেন!” সরবালা এক
গাল হাসেন, “এই তোদের এক দোষ, সব তাতে তাড়া। এদ্দিনকার অসুখ, সারতে একটু সময় দিতে হবে
না? তুই ভাবিস না রে নিরু, বাবার আশীব্বাদি জল, চোখ ঠিক না হয়ে উপায় আছে?”
সেই থেকে
এমনি চলতে থাকে। সরবালা নিয়ম করে এক বোতল জল ব্যাগে ভরে দেন। ছেলে অফিস ফেরত সেই জল
বুড়ো শিবতলা থেকে ছুঁইয়ে আনে। কোনো কোনোদিন মনে থাকে, কোনো কোনোদিন ভুলে যায়, কোনো
কোনোদিন সারাদিনের খাটাখাটনিতে আর ইচ্ছে করে না। বাড়ি ফিরে সেদিন মা’কে বোতলখানা ধরিয়ে
মিথ্যে বলতে মনটা খুঁতখুঁত করে... বেশীক্ষণ ঘরে দাঁড়ায় না আর।
দিন যায়...
মাস যায়... বছর ঘুরতে লাগে। ডাক্তার বলেছে উন্নতি নেই কিছু। সরবালা ঘরেই থাকেন এখন। সামনের খোলা বারান্দাটার দিকে তাকিয়ে থাকেন
প্রায় সময়... শূন্য ঘোলাটে দৃষ্টি... চোখের পাতা তিরতির করে কাঁপে... জল পড়ে গালে শুকিয়ে
যায়। জিজ্ঞেস করলে বলেন, ভালো আছেন! দূরের আকাশ, ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া পাখি, রামধনু,
ঝিকমিক করা তারা, ভেসে থাকা টুকরো টুকরো মেঘ, বারান্দার ভাঙ্গা চেয়ারখানায় বসে থাকা
নির্মাল্যর বাবা, সব কিছুই এখন স্পষ্ট দেখতে পান। শুধু কাছের জিনিসগুলোই কেন
কে জানে, বড্ড নাকি অন্ধকার
হয়ে আসে দিন দিন...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন