নন্দ চলে গেছে
বেরনোর আগে তপতী বাগানে টহল
দেওয়ার সময় পায়নি। চটি গলিয়ে গেট খুলে চেঁচিয়ে অম্লানকে বলল,
-আমার সাধের গাছগুলো রোদ্দুরে দফারফা।
নন্দকে বলবে যেন ভালো করে জল দেয়। দু’দিন ধরে পাত্তা নেই। খবরও দেয়নি।
স্বর্ণচাঁপার নিচের বেদীতে চা হাতে
আলসেমি করছিল অম্লান। বছর ঘুরেছে সে অবসরপ্রাপ্ত। তপতীর আরও মাসছয় টানতে
হবে। সামান্য স্বর উঁচিয়ে আলগা ছুঁড়ল,
-নন্দ ছেড়ে দিয়েছে। আর আসবে না।
এখানের মাতব্বরেরা অন্য পার্টির লোক, কাজে ঢুকতে দেবে না।
-কী?
তপতীর দাঁড়াবার সময় নেই মুহূর্তও। শাড়ি সামলে রিক্সায় উঠে স্টেশন, লোক্যাল ধরে শিয়ালদা।
ট্রেনের জানালার বাইরে থসথসে উত্তাপে
মফস্বলীয় আম, কাঁঠাল, কলা, পুটুস, আগাছার চেনা মাটি-মাটি গন্ধ। ভীড়, বিজবিজে ঘাম
অন্যান্য দিন এঁটে থাকে বিরক্তিতে। তপতীর সময় আনমনে বয়ে যাচ্ছিল। আসবে না নন্দ?
কদমছাঁট মাথা, খেটো ধুতি, বেঁটেমতো মাঝবয়সী লোক মাসপাঁচ আগে গেটে দাঁড়িয়েছিল।
-মালীর কাজ করি, রাখবেন বউদিমনি?
নরম গলা কচি দুব্বোঘাসের মতো। শীতকালটাও আলো ফোটার আগে এসেছে রোজ, সপ্তাহে চারদিন। মাটি-ভালোবাসা
মানুষ ঝারি করে জল দিয়েছে। কাকভোরের ঠাণ্ডায় উঠে সাগ্রহে এসেছে তপতীও।
-কী করছ নন্দ?
-এবেলা মুখ ধুইয়ে দিচ্চি
এগুলাকে।
-মুখ ধুইয়ে দিচ্ছ? শিশিরে ভিজেছে
না শেষরাত্তিরে?
-সেজন্যেই দিই বউদিমুনি। হিমের ঝাঁঝে
বাচ্ছা চারাগুলো জ্বলে যায়।
বুকের ভেতরে ঢবঢবে ফাঁপা বল
গড়িয়ে যাচ্ছে এধার ওধার। বাগানের হাসিটুকু তুলে নিয়ে গেছে লোকটা। রান্নাঘরের বাইরে
পেয়ারাগাছে টুনটুনির বাসা। উদাস পাখিটা ডেকে চলেছে। গাছের তলায় উই ধরে গিয়েছিল। পরিষ্কার
করেছে নন্দ। নরম ভোরে খুশিমুখে ঝিঙের মাচা, শশার মাচা, লালশাক। শেষ হয়ে শুকিয়ে
যাওয়া টম্যাটোর বেড। বলছিল, পরিষ্কার করে অন্য সবজি বসাবে। ছোট বাগানের চৌহদ্দির প্রত্যেক
কোণ যত্ন পেয়েছে ক’মাস। গ্যাস কমিয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে তপতী। বিষণ্ণতা চোখের
কোলে। কেন যে এরকম বিশ্রী লাগছে ওর! মনের বেহাল কিছুতেই সারাতে পারছে না। অম্লান পাত্তা দেয়নি। বলেছে,
-পয়সা দিলে লোক ঠিক লোক পেয়ে যাব।
-না, ওকেই খুঁজে আনো। আগে কতবার
কতজন এল গেল... দূর্।
-ও আর কাজ করতে পারবে না এপাড়ায়,
বললাম তো তোমায়।
চোখে জল নিয়ে চলে গেছে নন্দ!
তপতী জানে না। পার্টির ব্যাপারে তো কথাও বলেনি কখনও। শুধু গোড়াতে কাজে ঢুকে বলেছিল
একবার,
-আগে উইদিকের গেস্ট হাউসটোতে কাজ
করতাম আমি। তা আমি লালপাট্টির লোক কিনা, নতুন পাট্টি হওয়ার পরে উরা সব তাড়িয়ে
দিলে। বউদিমুনি, এদিককার কাউকে ভুলেও বলে ফেলবেন নি যেন...
ম্যাক্সির হাতায় চোখ মোছে তপতী,
এতবছর মাটি মেখে, পাতা ঘেঁটে পার্টির রঙ এখনো কি গায়ে লেগে থাকে?
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন