কালিমাটি অনলাইন

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

দ্বাদশ বর্ষ / পঞ্চম সংখ্যা / ১২৫

শুক্রবার, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

শর্মিষ্ঠা বিশ্বাস

 

সমকালীন ছোটগল্প


চাঁদলোচন সিপাহী

খুবই মৃদুভাবে এই চলাচল। চলাচলকারীর নাম চাঁদ। আকাশের তারাদের দুঃখ নিয়ে অর্ধেক শরীরের সর্বাংশে আলো আর অন্ধকারের আবছায়া মাটিমাখা সে এক চাঁদ! 

কত পথঘাট ঘুরেছে সে। দিনের পর দিন, কত পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে, নিজের দেহে আগুন জ্বালিয়ে শরীরকে ছাই করেছে সে। এক ছাই সরতে না সরতেই, আবারও একফালি চাঁদ পূর্ণ হয়ে, গোলাকার দেহ ধারণ করেছে। এভাবেই পুননির্মাণ আর পুনঃ-ভাঙন, চাঁদকে ঝলসানো গরমাগরম, সুন্দর থেকে সুন্দরতম লৌকিক খাদ্য করে তুলেছে।

এ হেন চাঁদ, লক্ষ লক্ষ মাইল পথ হেঁটে হঠাৎই দেখলো, সমতলে এক প্রবাহিণী এঁকেবেঁকে চলেছে। যেন, আগামীকালের এক রাসমিতা! এমন রাসের দিনেই তো রাই বিনোদিনী শ্রীমতী, কৃষ্ণকালো এক অনিন্দ্য সুন্দরের সাথে মিলে গিয়েছিলো!

বড় সাধ হলো চাঁদের, এমন শ্রীমতী নদীর সাথে আমিও মিলিত হবো। নদীর মুখে কথা আছে। সেই কথার নাম কলতান। কিন্তু, আমি যে বোবাকালা! আমারও শরীরে কলঙ্ক দাগ আছে। এই দাগ তো একদিন এঁকে দিয়েছিলো আমার গায়ে, পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও হিংসাত্মক নৈরাজ্যতা! 

এই দাগের চিহ্ন দেখে যদি শ্রীমতী চোখ ফিরিয়ে নেয়!

আচ্ছা, দেখাই যাক না, কী হয়! সান্ধ্যকালীন চাঁদ, এই ভেবে এসে বসলো নদীর ঘাটে। এক আঁজলা জল  তুলে নিয়ে মুখে ছিটিয়ে দিয়ে শীতল হবে ভেবেছিলো সে। কিন্তু তার বদলে এ-কী হলো?

জলের মধ্যেকার টান বড় টান। কেউ কেউ তাকে বলে ঘূর্ণি। কেউ বলে পাক। যে যেই নামই দিক না কেন, জলের নাম জল বা পানি। জল যারা বলে, তাদের কাছে জলের সচিত্র পরিচয়পত্র একটা আছে।

নাম, জল।

বয়স, আজ থেকে অনেকগুলো বছর আগে। পিতার নাম, মেঘ।

বাড়ি বা নিবাস, কেউ বলে হিন্দু ধর্মের মন্দিরে, কেউ বা তর্ক করে, তা কেন? অনেক হিন্দুই আছে, যারা জলকে পানি বলে, তাদের নিবাস তবে কি মসজিদ? অর্থাৎ পান বা ঢকঢক করে খাওয়া হয় যা, তা পানি। সেই হিসেবে পৃথিবীর মোসলমানরা সবাই এককাট্টা হয়ে জলকে পানি বলে ডাকে।

তাহলে দাঁড়ালো যা, তা বড় গোলমেলে। এগুলো তর্কের বিষয়। তর্ক যতই বাড়ানো যায়, বাড়তেই থাকে। ইলাস্টিক ঢিলা না হওয়া পর্যন্ত টানাটানি চলতেই থাকে।

চাঁদ দিয়ে শুরু হয়েছিলো যখন, তখন চাঁদের কাছেই ফিরতে হবে। একপাল কবুতরের ওড়ার মতো করে মাঠ ফেরতা পরিচিত বস্তির ছেলেরা পায়ে পায়ে ফুটবলের কেরামতি দেখিয়ে ভাদ্রের কড়া রোদের মধ্যে কুত্তা তাড়ানিয়া বৃষ্টির কাদায় কর্দমাক্ত শরীর ধুতে গিয়ে এক আশ্চর্যকে আবিষ্কার করে ফেললো।

১ম ছেলে -- আরে, এ যে চাঁদ!

২য় ছেলে -- না না, চাঁদের মতো লোচন!

১ম ছেলে -- তাহলে ওর নাম চাঁদলোচন!

৩য় ছেলে -- চাঁদ আর লোচন মিলিয়ে দিলি তোরা? পদবি তাহলে সিপাহী দিয়ে দে!

১ম ছেলেটি এতক্ষণে কানে কানে ২য়কে বললো, আজ স্কুলে সিপাহী বিদ্রোহে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সিপাহীদের খেপে যাওয়ার ঘটনা এমন ভাবেই স্যার পড়িয়েছেন যে, ওর মাথায় সিপাহী চেপে বসেছে।

সে যাইহোক, চাঁদলোচন সিপাহী, বিপ্লব চিরজীবীর মতো করে পড়ন্ত বর্ষার নদীজল হাত দিয়ে ঘোলা করে মুখে ছিটিয়ে, সেই জল মুখগহ্বরের ভিতরে দিয়ে দাঁত কচলাতে গেলে বিপত্তিটা ঘটলো। চাঁদ চিল চিৎকার করে উঠলো। সেই চিৎকারে ছিলো কেবল দুই গাল ধরে আ... আ.... শব্দ।

চিৎকারে স্বর বা ব্যাঞ্জন কোনো বর্ণ না পেয়ে ছেলের দল বুঝলো, এই লোকটা একটা বোবা। তিনজনের একজন, যাকে অন্যদের দ্বারা ডাকা নামে বোঝা গেল, তার নাম আমেরিকা। তা, আমেরিকা অনেকক্ষণ ধরে চাঁদকে খোঁচাখুঁচি করলো। বললো, তুমি কথা বলো। কী হলো, তুমি কি কথা বলতে পারো না? এই দেখো, আমি আমেরিকা। আর ওদেরই একজন রাশিয়া। আর অন্য জন হলো চায়না। যে চায়না, সে চাঁদের কানের কাছে খুব জোরে করতালি দিয়ে এসে জানালো, লোকটা খালি বোবা-ই নয়, সে কালা-ও!

এরই মধ্যে পৃথিবীর সব আলো কমে আসলে অপরাহ্ন যার নাম, সে এক মহাকাল! সেই মহাকাল মাঝে চাঁদের হাঁ করা হা-মুখ থেকে আ আ শব্দ কমে আসলে, সেই কমা চিহ্ন বরাবর একটা জলজ পোকা, যে কামড়টা দিয়েছিলো, চাঁদের মুখগহ্বরে, সেই পোকাটা মুখের বাইরে বেরিয়ে আসলো! আর ওমনি পোকার পিঠের চিত্র-বিচিত্র রহস্যে ভরা অনাবৃত অংশ থেকে নানা রং এক হয়ে আলোর রোশনাই মাখা চাঁদলোচন সিপাহী নদীর চর বরাবর দৌড়াতে শুরু করলো। ছেলেরা দাবড়ে ধরতে গিয়েও ধরতে পারলো না। তারা তখন একযোগে  বলতে শুরু করলো - শাবাশ সিপাহী, শাবাশ সিপাহী, শাবাশ!

চাঁদলোচন সিপাহীর সারা শরীর থেকে নানান রং-এর মাটি, জল, বাতাস, গাছপালা আর সর্বোপরি প্রাণের জোছনাচরের দুঃখী দুঃখী মুখগুলোর ওপরে দাঁড়িয়ে ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তলন করছে। ঠিক এই সময়ই ছেলের দল মুখ গোমড়া ভাব নিয়ে এ ওর কানে কানে ফিসফিস করে কি যেন বলাবলি করতেই বোবাকালা চাঁদলোচন সিপাহী হা হা করে হেসে উঠলো।

শ্রীমতী নদীর শান্ত জল বইতে বইতে বললো, আহা! আহা!

নদীতীরবর্তী বট পাকুড় গাছের ছত্রছায়ায় থাকা ভিখারি ভিখারিনীকে জড়িয়ে ধরলো আরো নিবিড় করে। ভিখারি ভিখারিনীর ভীক্ষাবৃত্তীয় জীবনের আঁচলে একমুঠ জোছনার আলো বেঁধে দিয়ে আরও গভীরভাবে সঙ্গমরত হলো। বোবাকালা চাঁদলোচন সিপাহী তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, তার শরীর মহাকাশের অমীমাংসিত সব রহস্যের যেন সমাধান করে দিয়ে গোল করে ঘুরতে ঘুরতে পশ্চিম আকাশে চলে যাচ্ছে।

এত বিচিত্র দৃশ্যের ঘটনা চাউর হতে সময় লাগলো না বিশেষ। এরই মধ্যে ছবি তোলার লোকজন, গ্রামের কানা মোড়ল, এমনকি পঞ্চায়েতের মেম্বাররাও জড়ো হলো নদীর চরে। আরও জড়ো হওয়া লোকজনের মধ্যে কেউ বা জমির ব্যবসায়ী, তো কেউ বা ভবিষ্যতের জন্য ভবিষ্যৎ ভাবুক। এরা সকলে মিলে বললো, চলো, আমরা ওর শরীর পরীক্ষা করে দেখি, ওই শরীরে মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা মেটায়, এমন কোনো কিছু আছে না কি! একজন বললো, আছে, আছে। আমি এই অদ্ভুত আলোর জীবের শরীর নেড়েচেড়ে  দেখছিলাম। একেবারে খাঁটি সোনার তরী!

রাতচরা পাখিরা গোল গোল চোখ দিয়ে সব দেখতে দেখতে, সব বুঝতে বুঝতে বাসায় ফিরে গেলে, আকাশের গায়ে ফ্যাকাসে এক কোণা কাটা বোবাকালা চাঁদলোচনের ওপর সূর্যের লাল আভা ছড়িয়ে পড়লে, আরও একটা নতুন দিন শুরু হলো। সেই দিন, সেই বার অথবা সেই মাসকে যে যে নামেই ডাকুক, চাঁদলোচনের শরীর থেকে বেরিয়ে আসা দিন, আসলেই একটা নতুন দিন।  

নদীর ঘাটে, চা-এর দোকানে, হাটবারে হাটের বেচাকেনায়, আলোচ্য বিষয়ের আলোকময় দরজা খুলে দিয়ে  চাঁদ ঢুকে গেলো এক্কেবারে সকলের অন্দরে। যেন, দেশগাঁয়ে কোনো দুঃখ নেই। যেন, গ্রামীণ জনপদে দাঁ মারা লোকজন আর দাঁ খাওয়া মানুষ বাঘ আর গরু হয়ে গিয়েছে। সন্ধ্যা নেমে আসলে, সকল কর্ম আর সকল অপকর্মকে ঢেকে দিতে চাঁদ উঠবে শ্রীমতী নদীর পূর্ণযৌবনা বুকের ওপর। আর, ওইখানেই বাঘে গরুতে একসাথে চাঁদ চুবানো জল খেয়ে নিজেদেরকে বিশুদ্ধ করে তুলবে।

সব শুরুর একটা শেষ থাকে। সব চলারই একটা থেমে যাওয়ার সময় হয়। ক্রমে ক্রমে চাঁদ বিষয়ক কথাবার্তাও হালকা হতে থাকলো।

কেউ কেউ আবেগকে সম্মান জানিয়ে সম্বরণের পথ ধরে। আবার, অতি উৎসাহী কেউ বা, প্রতিদিনের চাঁদের চলমানতা নিয়ে বড়োই তৎপর হয়ে থাকে।

বোবাকালা হলে কী হবে, আমাদের চাঁদলোচন সিপাহী মানুষের মনের এইসব আভ্যন্তরীণ কথার আভাস বুঝতে পেরে ভাদ্রের মেঘের সুরঙ্গের তলা দিয়ে দিয়ে জেলখানার মাথার ওপরে উঠে সুর সুর করে নেমে এলো এক্কেবারে জেলখানার প্রধান ফটকের পাহারাদার সিপাহীটার কাছে।

 আকাশের মেঘ এখন খুব গাঢ় হয়ে গেছে। এই সুযোগে ছেলের দলের দেওয়া নামের চাঁদলোচন, হঠাৎ তৈরি হওয়া সব বিতর্কিত বিমূর্ত কথাবার্তাকে ঢেকে দিতে এবং নবরূপে আর একটা পূর্ণ দিনের রোদের রং-এর ভীড়ে আড়াল হতে চেয়ে ধীরে ধীরে জেলখানার ফটকের পাহারাদার সিপাহীটার শরীরে মিশে গেলো। 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন