বর্ণমালার সাতকাহন (পর্ব
৫)
ব্লেড
স্থবির হয়ে যাচ্ছিলাম যত বইয়ের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম। আর এই স্থবিরতার মধ্যে জন্ম নিচ্ছিল অনেক জাল। অন্ধকার দিক। মা ব্যস্ত থাকতেন ছোটোভাইকে নিয়ে। মেয়েটির কৈশোরে পা। প্রথম মানসিক অস্থিরতা একাদশী বয়সে। হ্যারিকেনের আলো। বাইরে নিকষ রাত। মেশোমশাই এসেছিলেন। তখন মাসির নতুন শ্বশুরবাড়িতে গোলযোগ। কলকাতার নামী এক শিল্পী তথা সেলিব্রিটির ঘরে পর্দার আড়ালের গুপ্তরোগ। দিনের পর দিন শারীরিক নির্যাতন। সেই মাসিমণি যে কিনা আমার বন্ধু। যার সাথে তুই-তোকারি। পাশের ঘরে তর্ক বিতর্ক। বিষণ্ণ হয়ে যাচ্ছে মন। একটি বালিকা অস্হির, কিন্তু কী করতে পারে সে!
একটা ব্লেড। একদৃষ্টে তাকিয়ে আগুনের শিখার দিকে। খুব গভীর করে কেটে ফেলল মেয়েটি জঙ্ঘার ফর্সা নরম ত্বক। অবশেসনটা সেই শুরু। অল্প অল্প ব্যথা, লাল টুকটুকে রক্ত বেরিয়ে আসছে। কেন করেছিল? মনে পড়ে না। মাথার মধ্যে একটা ঘূর্ণাবর্ত। লুকোতে শিখে গেছে তখন মেয়েটি। রক্ত আর ব্যথা একটা নেশার মতো। তখন, একডজন বয়স। সেই গভীর দাগ আজও থেকে গেছে। আরো অনেক দাগ।
মানসিক কষ্ট অসহ্য হলে শারীরিক কষ্ট ধার করা শুরু। ভুলে যেতে তীব্র শারীরিক বেদনা আশ্রয় করার এক অভ্যাস। অনেক অনেক বছর পরে সেই অভ্যাস চলে যাবে, যখন সে মা। চান করতে গিয়ে জল ছুঁড়ে ছুঁড়ে নদী আর ঝর্নার দেশ খেলার সময়। অনেকদিন হাত ফালা করে ডুবিয়ে রাখত মেয়েটি বালতির জলে। ক্রমশ সাদা জল লাল। একদৃষ্টে দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক। পোর্সিলিনের প্লেট আর কাপ আছড়ে ভাঙতে ইচ্ছে করত শুধু ভাঙার জন্যই। অথচ সামান্য রক্ত দেখে অজ্ঞান হয়ে যেত মেয়েটি। কখনও কখনও এক জায়গায় স্থবির বসে থাকার অভ্যেস। আত্মমগ্ন। আজীবন থেকে গেছে যা।
এভাবেই পরিচয় হয়েছিল অন্য এক জগতের সঙ্গে। একটা ছোটো ইঁদুর রোজ এসে পাশে বসে থাকত। আমি দুপুরে অঙ্ক করতাম। একদিন মা আড়াল থেকে দেখে তো অবাক। কখনো পুকুরের পাশ থেকে সাপ, বাড়ির দাঁরাশটা হাতের পাশে এসে শুয়ে থাকত। কেউই আমাকে পাত্তা দিত না। সেই থেকে নীরবতা প্রিয়। বড়ো পিঁপড়েরা একটা চিনির ঢেলা মাথায় করে নিয়ে যেত সরু সরু হাত দিয়ে অবিকল মানুষের মতোই। এরকম গোপন সমান্তরাল একটি পৃথিবী আছে মানুষের পৃথিবীর সঙ্গেই। আমি উঁকি দিয়ে দেখেছি সেখানে।
ভাই-বোন কেউ শান্তশিষ্ট নয়। ছাগলছানা ধরে এনে তাকে ছোট্ট স্যাণ্ডো গেঞ্জি পরিয়ে দেওয়া, পাখির বাসায় উঁকি।
তবে বেড়ালটা বাচ্চা দিত আরামে আমার পড়ার টেবিলের নীচে। ছানাগুলো ওখানে নিরাপদ থাকত মা না দেখা অবধি।
মা পছন্দ করতেন না পশুপাখি। আমি বাবার বাড়ির স্বভাব পেয়েছিলাম। আগুন দেখার জন্য আমি ও ভাই একদিন প্রায় অগ্নিকাণ্ড করে ফেলেছিলাম ঘরে। আগুনের প্রতি ঝোঁক ছিল ভাইয়ের বেশি ছিল। তবে মায়ের নিজে হাতে এমব্রয়ডারি করা বিছানার চাদরটা যেদিন এভাবে পুড়ে গেল, সেদিন খুব অনুতপ্ত হয়েছিলাম। মা অনেকদিন ধরে অনেক যত্ন করে সেলাই করেছিলেন ফুলপাতা বাহারি রেশম সুতোয়।
আমাকেও তো এভাবেই তৈরি করছিলেন। কষ্ট তিনি পান আমার জন্য। আমিও পাই নষ্ট করে ফেলার জন্য। মার শিল্প। অতি যত্নে গড়ে তোলা এক জীবন্ত পোট্রেট। আত্ম নিপীড়নের অভ্যাস সেই থেকে। কাউকেই কিছু কখনো বলতে পারেনি মেয়েটি। বলার তেমন কিছু ছিলো না। তখন শ্রীকান্ত। তারপর বিষবৃক্ষ, বৌঠাকুরানির হাট, দস্টয়ভস্কি, গোগোল, কামু ক্রমশ বড়ো হবার সাথী। স্বপ্ন দেখার অভ্যাস থেকে স্বপ্ন দেখেই কেটে গেল একটি জীবন।
বিকেলের মরা আলো এসে পড়েছে একটা নদীর দিকে ঝুঁকে পড়া ভাঙা দুর্গর ওপর। নদীতে একটা নৌকো, একটি বালিকা ও আত্মীয়রা। ওপারে সবুজ সরলরেখা আর ছোটো ছোটো বাড়ি। মেয়েটির কান্না পাচ্ছে। ওই দুর্গের গায়ের লালচে মলিন আলোটা দেখে। কান্না পাওয়ার সঠিক কারণ অনেক সময় সে কাউকে বোঝাতে পারেনি। হঠাৎ রেগে যাওয়া তখন ছিলো না। জায়গাটার নাম চুনার। নৌকো ঘাটে আসে। সকলেই এগিয়ে যায়। এক একটা ছবি মনে চিরস্থায়ী গাঁথা হয়ে যায় সব শিশুমনেই। সারাজীবন সে বয়ে নিয়ে চলে সেই ছবি। কাউকে বলার মতো উল্লেখযোগ্য নয় যা, অথচ ভোলা যায় না। দুটো বাঁশের মাঝে কয়েকটা ছোটো বাঁশের টুকরো বেঁধে একটা স্ট্রেচার যেন। একটা দেহ বাঁধা। ছোট্ট শরীর। পায়ের কাছে একটা ধূপ একটা লোটা। উবু হয়ে বসে আসে দেহাতি লোকটি। আবছা আলোয় বোঝা যাচ্ছে না চোখ মুছছে কিনা। মেয়েটি ঠায় দাঁড়িয়ে। একটু পর মৃদু কথা হয়। অসমবয়সী আলাপ। লোকটি জানায় এটি তার মেয়ে। সিঁদুর মাখানো পনের বছরের মেয়েটি তার মারা গেছে। গ্রামের দু একটি লোক গেছে কাঠ আনতে। তবুও বলে, "বিটিয়া শাম হো গিয়া আকেলে মৎ রহো, ঘর যাও"! মেয়েটি আঙুল দিয়ে দেখায় দূরে তার পিতা সিগারেট কিনছে। মনে থেকে যায় কন্যাহারা বাপের অস্ফুট সেই ডাকটি, "বিটিয়া"।
শের শাহ তাঁর পত্নীর জন্য তৈরী করেছিলেন এই দুর্গ। বিধবা সেই মহিলাকে ভালোবেসে বিবাহ শের শাহ’র। দিনের বেলা অন্য ছবি। সারা দুর্গ জুড়ে ঐশ্বর্যের দাগ।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন