সুভাষচন্দ্র বসু, পরবর্তী
১৯৪৫
(৬)
গুমনামী বাবা সম্পর্কে এখন আমরা সকলেই কম বেশি অবগত, চন্দ্রচূড় ঘোষ ও অনুজ ধরের লেখা বইটি না পড়লেও সৃজিত মুখার্জির কৃপায় আপামর বাঙালি এই নামটির সঙ্গে এখন পরিচিত। হঠাৎ ১৯৮৫ সাল থেকে একটি ঘটনা লোকমুখে প্রচার হতে শুরু করে যে এলাহাবাদের ফইজাবাদের রাম ভবনে নেতাজি সাধুর বেশে আছেন। শোনা যায় ষাটের দশকে এই ব্যাক্তি ইন্দো চিন যুদ্ধের সময় উত্তরপ্রদেশের নিমসারে আসেন এবং তারপর এক এক সময়ে এক এক বাসা বদল করে শেষ পর্যায়ে ওঠেন রাম ভবনে। শোনা যায় এই ব্যক্তি সর্বদা পর্দার আড়ালে থাকতেন এবং কাউকে মুখ দেখাতেন না, কেউ তার নাম জিজ্ঞাসা করলে নিজেকে বহুদিন আগে মৃত বলে দাবি করতেন। সাধারণ মানুষজন তাকে ভগবানজী এবং গুমনামি বাবা বলেই সম্বোধন করতেন।
এবার আসি, কেন এই ব্যক্তিকে নেতাজির সঙ্গে তুলনা করা হয় বা নেতাজি বলে মনে করা হয়। চমকপ্রদ ব্যাপার হলো এই সাধুর থেকে এমন কিছু জিনিস, তার ব্যবহারিক সামগ্রী অথবা নথি পাওয়া যায় যা সাধারণ কোনো সাধুর কাছে থাকা সম্ভব নয়। শুধু প্রাপ্ত জিনিসের উপর ভিত্তি করে যে এই বিশ্বাস তাও নয় এমন অনেক ঘটনা, ব্যক্তি, সাক্ষ্য ও প্রমাণ এর সঙ্গে যুক্ত যে অনেক নেতাজি গবেষকই মনে করেন এই ব্যক্তিই আমাদের পরম পূজনীয় নেতাজি।প্রথমত, গুমনামি বাবার মৃত্যুর পর তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় সরযূ নদীর তীরে যেখানে মাত্র তেরোজন উপস্থিত ছিলেন যার মধ্যে ছিলেন ডক্টর প্রিয়ব্রত বন্দোপাধ্যায়, ডক্টর আর পি মিশ্র, সরস্বতী দেবী শুক্লা এবং রামকিশোর পান্ডা। চিতার আগুন যখন জ্বলছে হঠাৎ রামকিশোরজী ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন যার শেষকৃত্যে ১৩ লাখ লোক থাকার কথা সেখানে আজ মাত্র ১৩ জন। দিনটি ছিল ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ১৯৮৫ এবং ঠিক তার কিছুদিন পর ২৫শে অক্টোবরে নয়া লোগ নামে একটি সংবাদপত্রে হেডলাইন আসে - ফইজাবাদে অজ্ঞাতবাসে থাকা নেতাজি সুভষচন্দ্র বোস আর নেই? এই হেডলাইন প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যশনাল মিডিয়া ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং দাবানলের মত খবরটি ছড়িয়ে পরে চারদিকে। দ্বিতীয়ত, গুমনামি বাবার মৃত্যুর পর তার ঘর থেকে ৪২টি ট্রাংক পাওয়া যায় যেখান থেকে উদ্ধার করা হয় প্রচুর তথ্য, নথি এবং সামগ্রী যা এই জল্পনাকে আরও উস্কে দিয়েছিল। প্রাপ্ত জিনিসের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য বসু পরিবারের প্রচুর ছবি, ভাইপো ভাইজির নিয়ে নেতাজির ছবি, পিতা ও মাতার একটি বাঁধাই করা ছবি, এছাড়াও সমগ্র বিশ্বের প্রচুর ম্যাপ, নেতাজীকে নিয়ে ভারত সরকারের দুটো কমিশনের পূর্ণ রিপোর্ট এবং আজাদ হিন্দ সরকারের প্রচুর নথি তথা নোট, স্ট্যাম্প ইত্যাদি। এছাড়াও পাওয়া যায় বিদেশি একটি দূরবীণ, জার্মান টাইপ রাইটার, ৫৫৫ সিগারেট এবং বিদেশি পাত্র ও চা-কাপ। তিনটে ‘হাফ-বেন্ট ডাবলিন’ ধূমপানের পাইপ। জার্মানি ও ইতালির সিগার। গোল ফ্রেমের চশমা, বাইনোকুলার, রোলেক্স অয়েস্টার পার্পেচ্যুয়াল ঘড়ি, স্পুল ক্যাসেট টেপ রেকর্ডার, পোর্টেবল বেলজিয়ান টাইপরাইটার, একটি রেডিও। এছাড়াও ছিলো ভারতীয় রাজনীতির ওপরে লেখা অজস্র বই। সুভাষচন্দ্রের জীবনীমূলক বই। আর ছিলো স্বাধীনতার আগের ও পরের বহু সংবাদপত্র ও আনন্দবাজার পত্রিকার বিপুল সংগ্রহ। বাক্সগুলিতে পাওয়া গিয়েছিল, প্রচুর চিঠিপত্র ও নথি। নথির মধ্যে ছিলো, আজাদ হিন্দ ফৌজের পরিচিতদের তালিকা ও হাতে আঁকা সাইবেরিয়ার মানচিত্রও। এর মধ্যে বেশকিছু বই অজ্ঞাত কোনও ‘বোন’-এর কাছ থেকে উপহার পেয়েছিলেন গুমনামি বাবা। পাওয়া গেছিলো বেশ কয়েকটি টেলিগ্রাম। যেগুলো দুর্গাপুজো এবং ২৩ জানুয়ারি নেতাজির জন্মদিন উপলক্ষে গুমনামি বাবাকে পাঠিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রবীণ সেনানায়করা। সবথেকে আকর্ষণীয় ঘটনা হলো ১৯৭২ সালে লেখা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের প্রধান গোলওয়ালকরের লেখা চিঠি। এবার বিষয় হলো গুমনামী বাবা সাধারণ লোক হলে কেন তিনি কোনো সাধারণ সাধুকে চিঠি লিখবেন। চিঠিতে লেখা আছে "আপনার ২৫ শে আগস্ট থেকে ২রা সেপ্টেম্বর এর মধ্যে লেখা চিঠি আমি ৬ তারিখ পেয়েছি, আপনার কথা মত আমি তিনটি জায়গার বিষয়ে খোঁজ নিচ্ছি তবে আপনি জায়গাগুলো সম্পর্কে একটু বিস্তারিত বললে খুব সুবিধা হতো"।
এছাড়াও ১৯৮২ সালে একজন বাঙালি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এই সাধুর সঙ্গে দেখা করতে আসেন এবং রবীন্দ্র শুক্লা জানান যে তিনিই মোটর সাইকেল করে এই মন্ত্রীকে নিয়ে আসেন এবং পরবর্তী কালে টিভিতে দেখে বুঝতে পারেন যে তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং সেই মন্ত্রী আর কেউই নন প্রণব মুখার্জি (নামটি এখনো কোথাও প্রকাশিত নয়, সহায় কমিশনের রিপোর্ট থেকে শুক্লার বক্তব্য থেকে প্রামাণ্য)।
সুতরাং, পাঠক মহোদয় এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝেছেন রামভবনের এই সাধু কোনো সাধারণ মানুষ নন এবং তাকে নেতাজি ভাবার যথেষ্ট কারণও আছে। এই দ্বন্দ্বকে সামনে রেখেই ২০১৬ সালে অখিলেশ যাদবের সরকার সাড়ে ১১ কোটি টাকা বরাদ্দ করে জাস্টিস বিষ্ণু সহায়ের নেতৃত্বে সহায় কমিশন গঠন করেন গুমনামী বাবা আসল নেতাজি কিনা সেই বিষয়ে অনুসন্ধান করতে। কিন্তু সহায় কমিশন পরিষ্কার জানান যে নেতাজির সঙ্গে গুমনামী বাবার ডি এন এ রিপোর্টের কোনো মিল নেই এবং গুমনামী বাবার সঙ্গে নেতাজির পরিবারেরও ডি এন এ মিল পাওয়া যায়নি। কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তর ইলেকট্রো ফ্যারোগ্রামের রিপোর্ট শেয়ার করে্ননি তাই অনেক নেতাজি গবেষক এই ডি এন এ রিপোর্টকে মানতে চাননি।
নানা রকম মতভেদ থাকলেও আমার ব্যক্তিগত গবেষণা অনুযায়ী বলতে পারি গুমনামী বাবা আসলে নেতাজি নন কিন্তু এই কথাও সত্য নেতাজি গুমনামী বাবা অর্থাৎ নেতাজি তার বৃহৎ কর্মযজ্ঞের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন সাধুর ছদ্মবেশে তার পরিচিরদের সঙ্গে দেখা করতেন এবং গুমনামী বাবা ওরফে ভগবানজীও ছিলেন তেমনই একজন মানুষ। একটি ছোট উদাহরণ দিই, আপনারা গুমনামী বাবার স্মৃতি সৌধের কাছে গেলে দেখতে পাবেন তার মৃত্যুর সময় কালে ??? চিহ্ন দেওয়া, কিন্তু গুমনামী বাবার মৃত্যুর সময় তারিখ সবই তার ভক্তরা জানতেন।বলাই বাহুল্য এই সারদানন্দজী বা ভগবানজী নামের আড়ালে মূল যে ব্যক্তি বিদ্যমান তিনি আমাদের প্রিয় দেশনায়ক। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময়ে নেতাজীকে নিয়ে নানা গল্প ফেঁদেছে কারণ এখনো পর্যন্ত নেতাজির মত রাজনৈতিক ইমোশান সারা ভারতে নেই, তাই কেউ ওনাকে প্লেন ক্রাশে মৃত বলে দাগিয়ে দিয়ে মিথ্যা স্ত্রী বা কন্যার গল্প সাজায় আর কেউ বা ভগবানজীর মাধ্যমে নেতাজির মৃত্যু ঘোষণা করতে চায়। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অনুসন্ধানে আরও কিছু তথ্য আছে যেটা দেখলে অনুজ ধর বা চন্দ্রচুর ঘোষের এই তত্ত্বকে সম্পূর্ণ রূপে বিশ্বাস আপনারা করতে পারবেন না। আবার বলছি আমি একবারও বলছি না ভগবানজী বা গুমনামী বাবা নেতাজি নন, কিন্তু গুমনামী বাবার মৃত্যু কখনই এটা প্রমাণ করে না যে নেতাজি মৃত। নেতাজি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাধুর ছদ্মবেশ গ্রহণ করেছেন তাঁর কাজের খাতিরে, কিন্তু সেজন্য সেই সাধুর পরিচয়ই তাঁর একমাত্র পরিচয় এটা দাগিয়ে দেওয়া ভুল। আমার পরবর্তী ধারাবাহিকে আমি আলোচনা করবো নেতাজির সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সাধুদের সম্পর্কে এবং অবশ্যই গুমনামী বাবার মৃত্যুর পরেও নেতাজির জীবিত প্রামাণ্য দলিল নিয়ে।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন