বর্ণমালার সাতকাহন
(পর্ব ২৯)
জীবনের আনন্দঘন মুহূর্তগুলো খুব তাড়াতাড়ি নিঃশেষ হয়ে যায়। বন্ধুহীন আধো অন্ধকার কুয়াশাচ্ছন্ন পথে যে সংগ্রাম করে চলেছি বছরের পর বছর তা নিজেদেরই আনয়ন করা। জেনে বা অজান্তে। সরলতার কারণে ঠকে যেতে হয় কাঁচকে হীরে ভেবে। সমাজের চাপিয়ে দেয়া দস্তুর আর মানুষের তৈরি ধর্মের ভ্রুকুটিতে কত মানব জনম শেষ হয়ে যায় শুধু টিঁকে থাকার যুদ্ধে, যা দেশের দশের জন্য ঐতিহাসিক হতে পারতো। একসময় যখন তার প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয় জগতের বৈজ্ঞানিক নিয়মে জোয়ার আসে, ঋতু পরিবর্তন হয়, গ্রহের অবস্থান পাল্টায়, তখন সময় শেষ হয়ে আসে, ক্লান্তি এসে বাসা বাঁধে মস্তিষ্কে। যে দুঃখ কষ্টে আছে সে খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে। আমার জীবন নিম্নচাপের মতো ঘ্যানঘ্যান করা দিন। শাঁখের করাত। জীবন যা তাকে অস্বীকার করার মধ্যে কোনো করতালি নেই। দুঃখকে দুঃখ বলায় কোনো পরাজয় নেই। ক্ষতর ওপর ফুলেল চাদর বিছিয়ে আমি সুখি এই ভান করার মধ্যে কোনও যশ নেই। বলছিলাম মানুষ দুঃখের মাঝারে খড়কুটো পেলে আঁকড়ে ধরে। এই একা পথ চলা সহজ নয়। নারী শুধু জননী নয় কন্যা নয় সেও মানুষ, রিপুর দাস। সুমনের প্রথমদিকের কবিতাগুলো বর এবং কন্যাকেও পড়াতাম। সুমন দূরের অন্য রাজ্যে একটি গ্রামের ছেলে। সে কবিতায় ভাসিয়ে দিল আমাকে। নতুন নতুন তখন ফেসবুক খোলা হয়েছে পার্সোনাল কম্প্যুটারে, সেইসময় সকলের হাতে হাতে ল্যাপটপের প্রচলন হয়নি। এরপর যখন তখন ফোন করে কবিতা ও গান শুনতে চাইত। মনের ক্ষতে বেশ প্রলেপ পড়ল। দুচার মাস পরে যখন সে আসতে শুরু করল, ধার হিসেবে বিস্তর টাকা চাইতে লাগল দারিদ্রের অবর্ণণীয় বর্ণনা সহযোগে। ফেসবুকে তখন ঢাকার নিমর্লেন্দু গুণ, অসীমদা ও বহু প্রমিনেন্ট কবির সঙ্গে আলাপ হেতু প্রচুর কবিতা পড়া হতো।
কয়েকটি লাইন চেনা লাগল। তারপর দেখলাম কোনো কবিতার পেট কোনোটার মাথা কারো পা চুরি করে এতদিন গরিব সুমন কবিতা লেখে নিজের নামে। তার কাব্যপ্রীতি বা বন্ধু প্রীতির চেয়ে তারপর দেখা গেল টাকা চাওয়ার উৎসাহ বেশি। এভাবে কেটেছে ছ মাস। সে বার দুই এসেছিল এবং টাকা নিয়েছিল। তারপর টাকা বন্ধ, আসা বন্ধ হলো। হাসলাম কাঁদলাম, ব্লক ও ডিলিট করলাম তার নং। এই দুঃখটুকু বোঝার ওপর শাকের আঁটি তাই দুর্বলতা তেমন ছিল না। এমন ভালোবাসার ব্যাপারি আমার অদেখা নয় নিজ গৃহে। দুইজন দুটি দ্বীপের মতো বসবাস। আমার দ্বীপে আমার ছেলেমেয়ে।
একদিকে বাড়ির লোকের উপার্জনে অনীহা,
সন্দেহবাতিক, মদ্যপান এবং অত্যাচার জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল অন্যদিকে উচ্চশিক্ষার
পরীক্ষার জন্য আদা জল খেয়ে লেগে পড়া, এর মাঝে খোলা হাওয়া কফি হাউসে বিকেল, অল্প
আড্ডা, রামকৃষ্ণ মিশনের লাইব্রেরী। প্রথম স্নাতকোত্তর করার পরে শিক্ষকের চাকরি জোটা যেন মাধুকরী জীবনের পথে প্রাপ্তি একটি গোটা
চকচকে কয়েন। এই চাকরির উপার্জনে দুটি শিশু ভালো স্কুলে কলেজে পড়ে সাবলম্বী হওয়ার পথে, এই চাকরির
উপার্জনে একটা গোটা সংসার বেঁচে উঠল ফের। সন্দেহবাতিক একটি মনের অসুখ অনেক সময়ই ব্যর্থ
পুরুষের ঢাল, উপার্জনশীল স্ত্রীকে নিয়মিত মানসিক অত্যাচারের। এইসব আলোহীন অন্ধকার
পাতালবাসে কারো জীবনেই ফিল্মিমার্কা অলৌকিক কিছু ঘটে না। শুধু আবছা থেকে গাঢ় আবার
গাঢ় থেকে অস্পষ্ট ফ্যাকাশে কোনও দীপ্তি দেখা যায়। মৃত্যুর মতো একটা ট্রানজিশান। মনের
বাঁক বদল হতে থাকে। শৈশবের নির্মলতা চলে গিয়ে আসে জটিল কুটিল মন। মৃত্যুর কথা অনেকবার
ভাবনায় এসেছে। একটা গোটা অঙ্ক যদি বোঝা যায় ভুল আবার কেটে নতুন করে করার চেষ্টা স্বাভাবিক।
জীবন যদি আমার হয়, মৃত্যুকে বেছে নেবার অধিকার আছে সবার। কাওয়ার্ডরাই শুধু আত্মহত্যা
করে না।
জ্ঞানী এবং প্রজ্ঞাবান হলেই যদি
জীবনকে জেতা যেত তাহলে বিশ্বের ইতিহাসে এত শিল্পী এত সফল মানুষেরা আত্মহত্যা করত না।
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে থেকে সিলভিয়া প্লাথ, এন সেক্সটন থেকে মার্ক ফিসার, ভ্লাদিমির মায়োকভস্কি
থেকে মুনিরা চৌধুরী - সুদীর্ঘ তালিকা। এই সমাজ এই পৃথিবীর সঙ্গে তাঁরা খাপ খাওয়াতে
পারেননি। আমিও পারি না। ক্লান্ত অবসন্ন অমাবস্যার মতো বসে থাকি মৃত্যুর ওড়না গলায়
জড়িয়ে, ফিরে আসি ফের। গলায় পোঁচ বসে যায়।
স্বর বেরোয় না কতদিন। তবু সন্তানদের মাতৃহীন হতে দিতে পারি না।
ইন্দ্রনীল কোথায় তুই। কতবার খুঁজেছি
তোকে। ফর্সা একমাথা কোঁচকানো চুল কপালে পড়া এক বালক। নার্সারি। আমারই সহপাঠি। সে শুধু
আমার জন্যই আসত স্কুলে। একবার আড়ি করলেই চোখ দিয়ে জল, মুখটা লাল হয়ে যেত, ছোট্ট ছোট্ট হাতে আমার শৈশব
ধরেছিল তিন বছর বয়স থেকে চার। তারপর হারিয়ে গেছে বিরাট পৃথিবীর কোথাও। তবে পেলেও পেতাম না সেই
ইন্দ্রনীলকে। সে যে এখন আর বালক নয় পুরুষ। আর পাঁচটা পুরুষ যেমন হয় হিসেবী, চালাক,
আবেগহীন যৌনকাতর। সেই বালক, প্রেমান্ধ বালক আজ মৃত। আজ তাকে মনে হয় খুব যখন একটা ধূসর জীবনে
অবাঞ্ছিত আমি প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাই এক কাঁটাময় শ্বাপদশঙ্কুল পৃথিবীতে।
(ক্রমশ)
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন