ফ্ল্যাশব্যাকে থিয়েটার পাঁচালিঃ আমাদের আমাদের বিনোদিনী
প্রতি,
হে দর্শক...
শারদ উৎসব সদ্য শেষ হয়েছে। ঢাকের শব্দ, আলো, আরাধনার জাঁকজমক মিলিয়ে যাচ্ছে নাটকের প্রবাহে। কলকাতা শহর আর নাটকের জগত সমান্তরাল চলে। নাটকের নাম যাইহোক, নাটক বা থিয়েটার একটা আর্ট, একটা আশ্রয়, মুক্তির প্রতিবাদেরও। একদিকে, নাটক অনেককে নিয়ে চলা। এই একত্রে মিলিয়ে চলা তো একটা উৎসবের মতো। মিলিবে মেলাবে যাবে না ফিরে। 'একসঙ্গে চলা' থিয়েটারের নিজস্ব উৎসব। যা, বছরভর চলে, চলতেই থাকে। থিয়েটার মানে নাট্যচর্চা, নাট্যপ্রযোজনা, অভিনয়ের ভেতর দিয়ে বেঁচে থাকার উৎসব। যেখানে, থিয়েটার কেবল অভিনয়ের জন্য অভিনয় নয়। এটি এক শিল্পভাষা। এরমধ্যে দিব্যি পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে নাটকের বিষয় নিয়ে। যেটা প্রাথমিক কাজ। একটা বিষয় পেলে, সেটাকে ধরে এগিয়ে যাওয়া যায়। মঞ্চ তার বিষয় পায়। ততক্ষণে আলোর মধ্যে হেঁটে বেড়ায় সময়। আর অভিনেতা, কলা-কুশলীরাও। সে একটা অন্যরকম কাজ, যে কাজের কোনও ভাষা নেই, বা বলা যায় যে কাজের ভাষার কোনও বর্ণমালা নেই। কেমন করে একজন বিষয়টাকে ঢেলে সাজাবে নিজের শরীরে, মনে, কাজে, হাত-পা-চোখ-মুখে! সেসব শিখিয়ে পড়িয়ে হয় না। বা ইউনিভার্সিটির পাশের পড়াও হয় না।
এই ভাবের ভাষা অভিনেতার নিজস্ব
ভাষা। আর এই ভাষাটাই আমরা পাই বিনোদিনী নামের মধ্যে দিয়ে। তিনি ছিলেন মুখর, আবার মৌনও।
দাসীর ছোট্ট ভূমিকায় থেকে শুরু করে রাণীর চরিত্রে বিনোদিনীর অভিনয় আজও আলোচিত, উদাহরণস্বরূপ।
আজও বাঁচিয়ে রাখে বিতর্ক। কারণ, এই একুশ শতকে বিনোদিনী ভাব, শুধু ভাইবস নয়।
কালা পেড়ে শাড়ি পরা বিনোদিনীর ছবি ভেসে ওঠে কল্পলোকে। এক সাধিকার ছবি। এক সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা অভিনেত্রী। এক প্রতিবাদী। একা 'বিনোদিনী' মানে তো কত কিছু। বিনোদিনী নামের সঙ্গে ভেসে ওঠে এক শিল্পীর নিষ্ঠার যাপন। 'কেমন করিয়া বড় অভিনেত্রী' হতে হয় সেই নিষ্ঠা বিনোদিনীর অন্তঃস্থ। যেখানে থিয়েটার নামক একক ধরে বিনোদিনী স্টার। এইকথা আমাদের কে না জানেন! কিন্তু, আমরা বিনোদিনীর সময়কে দেখিনি। যতটুকু জানা সবই বইয়ের পাতায়। এবং তাত্ত্বিকদের লেখায়। এবং পত্রপত্রিকার আলোচনায়। এবং ইতিহাসের পাতা থেকে তুলে নেওয়া সেই আলোচনাতেই বিনোদিনীকে ফিরে দেখা। এই 'দেখা' একেকজনের একেকরকমের। তাই, আমার দেখা বিনোদিনীর সঙ্গে অন্যের দেখা বিনোদিনীর নাও মিলতে পারে। কিন্তু, বিনোদিনীর মূল কাঠামো তো থাকতে হবে! যেমন, দুর্গা-প্রতিমার মূল কাঠামো বা ভাব রেখে, বাকিসব পাল্টে পাল্টে যায়। হ্যাঁ, বিনোদিনীর সঙ্গেও তাই হোক।
বিনোদিনী। থিয়েটারে যুক্ত হয়েই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি অভিনেত্রী। তিনি সাবলীলভাবেই অভিনয় করতে পারতেন। এবং একসঙ্গে একাধিক চরিত্রে অভিনয় করতেন। দাসীর ছোট্ট ভূমিকায় থেকে শুরু করে রাণীর চরিত্রে। আর এখন বিনোদিনীর অভিনয় থেকে বিনোদিনী অভিনয়_ নানাভাবে চলছে। ‘বেণীসংহার’ নাটকে প্রথম ভূমিকা একজন দাসী। কাজ শুধু দ্রৌপদীকে খবর দেওয়া। কিন্তু স্টেজে দাঁড়ানো মানেই কাঁপুনি। ধর্মদাস সুর, গ্রেট ন্যাশনালের ম্যানেজার, পেছন থেকে ঠেলে দিলেন। দর্শকের দিকে তাকানো হল না। তবু সংলাপ শেষ হতেই করতালি।
ধর্মদাসবাবুর বুকের ভেতর টেনে নেওয়া,
পিঠ চাপড়ে বলা - “চমৎকার হয়েছে”। এই আশীর্বাদই ছিল তাঁর অভিনয় জীবনের প্রথম স্বীকৃতি।
পরে তিনি কত রাণী, কত মহিষী, কত চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কিন্তু সেই প্রথম দাসীর ভূমিকাই
আজও তাঁর কাছে সবচেয়ে আনন্দের স্মৃতি।
১৩৩১ সালে বিনোদিনী নিজের কথা মানে
অভিনেত্রী জীবন নিয়ে লিখতে শুরু করেন। ওইসময়ের ‘রূপ ও রঙ্গ’ সাপ্তাহিক পত্রিকায়। কলামের
নাম ‘আমার অভিনেত্রী জীবন’। এই লেখা ছিল স্মৃতিকথা। সেই থেকেই শুরু হয়ে গেছিল ফ্ল্যাশব্যাকে
থিয়েটার পাঁচালির। শুধু লেখিকা ছিলেন বিনোদিনী স্বয়ং। সেই স্মৃতিচারণ আমাদের কাছে আজও
এক অমূল্য সম্পদ। যে থিয়েটার করে, তার দেখার রকম হয় একরকম। আর যে করে না, কিন্তু দেখে,
তার দেখার রকমে পার্থক্য থাকবে। ছিলও। এই দুই দেখার মধ্যে দিয়ে থিয়েটারের মূল্যায়ন
চলে। আমাদের দেখা না-দেখা থিয়েটারের কথা আমাদের ফ্ল্যাশব্যাক।
মনে পড়ে, বিনোদিনী-কে কেন্দ্র-চরিত্র
করে অনেকগুলো নাটক চলছে। আবার, কোনও নাটকে বিনোদিনী একটা চরিত্র বিশেষ হয়েও থাকছেন।
এমনই এক বিনোদিনীকে দেখতে পাওয়া গেল, কল্যাণী
কলামণ্ডলমের 'রাধারামকৃষ্ণ' নাটকেhttps://www.facebook.com/KalyaniKalamandalam বা
http://kalamandalam.in/
এখানে বিনোদিনী টাইমফ্রেমে, আসে-যায়। তবুও, তাঁর উপস্থিতি একটু স্বতন্ত্র যে, টের পাওয়া যায়! নাট্যকার এবং নির্দেশক বিনোদিনীর চরিত্র নিয়ে ভেবেছেন। এবং বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে, বিনোদিনীকে এনেছেন নাটকে। গিরিশ মঞ্চে 'রাধারামকৃষ্ণ'র অভিনয়ের মধ্যে বিনোদিনীকে দিয়েই শুরু...।
নাটকের মধ্যে দর্শক হয়ে প্রবেশের আগেই, নাটকের বিষয় জানতাম। সেটা অবশ্যই নির্দেশকের সঙ্গে কথালাপের সূত্রে। নাটককারের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। আর সেটা মঞ্চে পর্দা উঠলেই হয়ে যায়, সরাসরি। এদিন দর্শকাসনে উপস্থিত ছিলেন নাটককারও। পরিশীলিত অভিনয়, চেনা নাট্যমুহুর্ত, চেনা আবেগের মোচড়, দৃশ্য শেষের হাততালিতে, জমজমাট।
গান-কোরাস, আবহের সঙ্গে সঙ্গে সুরের মাত্রাজ্ঞানে নাটকীয়তা ছিল। অভিনয়ের তুলনা নেই। সবাই রিহার্সাল দিয়ে নেমেছেন, সেটা বোঝা যাচ্ছে। অভিনয়ে... মোনালিসা, রঞ্জন, সমরেশ, অনন্যা, তৃষিত, সঞ্জীব, তন্ময়, মেহবুব, রুদ্রজ্যোতি, সাথী, সঞ্জু, মলি, মণীষা, বৃষ্টি, নাসিমা, তৃষিভ, শাহরুখ-সহ মোট একুশ-বাইশজনের টিমওয়ার্ক। থিয়েটারে এমনই তো হয়!
সঞ্জয় আর ইসরাফিল, মেকআপে তুখোড়। শুধু এইখানে থেমে গিয়ে পোশাক নিয়ে দু-কথা...। একটা জিজ্ঞাসা, ওই সময়ে কোন ধরনের শাড়ি, তাঁত ও সিল্কে চালু ছিল, সেটা আরও রিসার্চের দরকার ছিল। আশাকরি, পরে সেটা নিয়ে ভাববেন পোশাক পরিকল্পক...। কারণ, প্রতিদিনের সাধনা-ই নাটকের মার্গ।
হ্যাঁ, এই নাটকের থিম-থট বা মূল ভাবনার প্রসারও তাই...।
নাটকের মূল হল, “নিজেকে ভেঙে নতুন করে গড় বিনি। …বিনি, সময় নয়, ভক্তি আন্দোলন নয়, গিরিশ ঘোষ নয়, স্টার থিয়েটার নয়, আমি চাই ‘চৈতন্যলীলা’-কে মানুষ মনে রাখুক-বিনোদিনীর জন্য।” আর তাই দিনের পর দিন হাউসফুল ও কাগজে কাগজে প্রশংসার ছড়াছড়ি হওয়া সত্ত্বেও নাটক ‘চৈতন্যলীলা-র মহলা দিতে হয় বিনোদিনীকে। দক্ষিণেশ্বরের ভৈরবী ব্রাহ্মণী যোগেশ্বরীর কাছে শ্রীরামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক জীবনের সমস্ত সাধনা পর্বের কথা শোনায় গিরিশ ঘোষ। রাধা ভাবে সাধনায় নিজেকে নারী মনে করে ধীরে ধীরে অন্তর থেকে বহিরঙ্গে নারী হয়ে উঠেছিলেন রামকৃষ্ণদেব। যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণর এই রাধা ভাবের সাধনায় বদলে দেয় বিনোদিনীকে। অভিনয় শিল্পের সাধন চর্চায় সফল হয়ে ওঠে বিনোদিনী দাসী। বদলে যায় তাঁর অন্তরাত্মা ও বহিরঙ্গের ভঙ্গিমা। নাটকের অন্তিম লগ্নে দেখা যায় ‘চৈতন্যলীলা’র অভিনয় দেখতে স্টার থিয়েটারে পা রাখছেন ধর্মগুরু শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। শিল্পীর আত্মিক উন্নতি কামনায় আশীর্বাদ করেছেন ‘তোর চৈতন্য হোক’ বলে। এই চৈতন্য যেনো সমস্ত মানুষের চৈতন্যকে জাগিয়ে তোলার কথা বলে | জাতিভেদ-ঘৃণা-বিদ্বেষ-আইন দিয়ে নয়, সমাজ বদলাবে উচ্চ মার্গের সাধনা দিয়ে। এই বার্তার বাহকই যেনো নাটক ‘রাধারামকৃষ্ণ’। এটাই ... দেখতে আসতে হবে।
কল্যাণী কলামণ্ডলম্ ... এমন অনেক বিষয় নিয়ে আগেও নাটক নামিয়েছে, মানে মঞ্চস্থ করেছে। এবারের বিষয়ও সেরকমই, সাহসের না কল্পনার। শুধু এই যে বুঝে নেওয়ার__ এই বিষয়ের মধ্যে ইতিহাসের সত্যতা খুঁজলে হবে না। একটা গল্প বলে ধরে নিয়ে দেখলেই হবে...।
নাটকের বিষয় ইতিহাসকেন্দ্রিক হতেই হবে, সেটা দর্শক হিসেবে বাড়াবাড়ি রকমের চাহিদাই। এরচেয়ে ভাল, একটা গল্পকে গল্প ও কল্প-কাহিনি ভেবে, নাটক-উপস্থাপনার দিকটাই দেখা। যেখানে, বিষয় থেকে প্লট, প্লট থেকে নাটক, নাটক থেকে নাট্য-উপস্থাপনা পর্যন্ত একটা সম্পূর্ণ বৃত্ত। আর সেই নাট্যবৃত্তে দর্শক-ই তো সব...। হ্যাঁ, শারদ আবহে দর্শক ছিল। আনন্দের কথা!
আরও আনন্দের যে, বিষয় একপ্রকার
সংস্কৃতির আভাস দেয়, সেই আভাসে যেন ইতিহাসের অবমূল্যায়ন না ঘটে। দর্শক ইতিহাস না-জেনে
থিয়েটার দেখতে আসতেই পারেন, কিন্তু নাট্যকর্মীদের চর্চা ইতিহাস ব্যতিরেকে উত্তরণ ঘটাবে
না।
দর্শকের দিক থেকে এইসব লিখতে লিখতে
জানিয়ে রাখা... গিরিশ মঞ্চ, কলকাতার সেদিনের দর্শকদের মধ্যে ছিলেন, নাট্য-নির্দেশক,
অভিনেতা, এক কথায় অল রাউন্ডার কুন্তল মুখোপাধ্যায়। আর ছিলেন, আশীষ-দা, আমাদের নাট্যবেত্তা।
আরও অনেকেই ছিলেন... সবার নাম পরে লিখব। কিন্তু যাদের নাম না-লিখলেই নয়... এই নাটকের
কুশীলবদের নাম-
নাটককার: রাকেশ ঘোষ
রূপকল্প ও নির্দেশনা: শান্তনু দাস
সঙ্গীত পরিচালনা: সুরজিৎ নন্দী
নৃত্য আয়োজন: পঙ্কজ সিংহ রায়
আলো: আকাশ প্রসাদ
পোশাক: শোভন চক্রবর্তী
রূপসজ্জা: সঞ্জয় সামন্ত
নামাঙ্কন: নীলাভ চট্টোপাধ্যায়
অভিনয়ে:
মোনালিসা চট্টার্জি, রঞ্জন বসু,
সমরেশ বসু, সঞ্জীব মুখার্জি, ত্রিশিত মৈত্র, রুদ্রজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়, তন্ময় ভট্টাচার্য,
জয়িতা বসু, অনন্যা দাস, মালবিকা গুপ্ত, মহবুব বিশ্বাস, মনীষা বাপারি, নজরুল হক, নাসিমা
রহমান, শরুক মালিক, ত্রিস্তিভ শিকদার, সঞ্জীব দেবনাথ, স্বপন বসু, শীলা বসু, সঞ্জু বিশ্বাস,
স্বাতি প্রসাদ।
মনে রাখার যে, নাটকের মূল মন্ত্র ছিল সাধনা। দর্শকের সাধনা হল দর্শকের আসনে থাকা। আমরা যেন সেই স্থানে আগামীতে দর্শকাসনে উপচে পড়া দেখি।
হে পাঠক, আগামীর পথে আপনাদের চাই...
আসুন একসঙ্গে থিয়েটারে থাকি দর্শকের ভূমিকাটির কাস্টিং আপনারই হাতে!
ইতি__
একুশ শতকের ফ্ল্যাশব্যাক সত্তাধিকারী…
(ছবিঃ কল্যাণী কলামণ্ডলম দলের সৌজন্যে)
Thank you for your wonderful analysis. We encouraged by this review.....🙏
উত্তরমুছুনবিনোদিনীর আলোয় ভাসা আপনার লেখায় যেন থিয়েটারের প্রাণস্পন্দন ফিরে এলো।
উত্তরমুছুননাটকের গন্ধ, সুর আর চরিত্রেরা যেন পৃষ্ঠা পেরিয়ে এসে আমাদের চোখে জীবন্ত হয়ে উঠল।
শুভেচ্ছা রইলো — এমন লেখাই বাংলা নাট্যভুবনের আশ্রয়। 🎭
বিনোদিনীর আলোয় ভাসা আপনার লেখায় যেন থিয়েটারের প্রাণস্পন্দন ফিরে এলো।
উত্তরমুছুননাটকের গন্ধ, সুর আর চরিত্রেরা যেন পৃষ্ঠা পেরিয়ে এসে আমাদের চোখে জীবন্ত হয়ে উঠল।
শুভেচ্ছা রইলো — এমন লেখাই বাংলা নাট্যভুবনের আশ্রয়। 🎭