কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / অষ্টম সংখ্যা / ১৩৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / অষ্টম সংখ্যা / ১৩৫

মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

প্রশান্ত গুহমজুমদার

 

সমকালীন ছোটগল্প


একা মানুষ

অঝোরে বৃষ্টি। পার্সটা রাস্তায় পড়ে আছে।  একা। ভিজে যাচ্ছে।

দুটো এশিয়ান ওপেন বিল স্টর্ক। তিনটে বাচ্চা। উঁচু একটা ডালে। বাচ্চা তিনটে সরে সরে আসছে মায়ের দিকে। বাবার দিকে।

আরেকদিন দেখলো, চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। নি:ঝুম চারপাশ। হঠা একটা গুড়গুড় শব্দ। তাকিয়ে দ্যাখে, চারটি রাস্তাই ছুটে আসছে তার দিকে। গুটিয়ে যাচ্ছে। আবার আসছে। দৌড়ে দৌড়ে। ও পালাতে চাইল। খুব জোরে। কিছুতেই পারছে না। একটুও এগোতে পারছে না।

কয়েকটা ভুঁইচাঁপা। সাদাফুল মাথায় নিয়ে ভিজছে। একবার নিচু, আবার সোজা। যেন মজার স্নান। কেউ একজন ক্রমশ দূরে। অস্পষ্ট। সাদাকালো শাড়ি।

আলোক বাতাস খুঁজছে। তার ঘরে অনেক কিছু। শুধু বাতাস নেই। ও বাতাস পাচ্ছে না।

প্রবল কষ্টে একটা কাঁপুনি দিয়ে আলোকের ঘুমটা ভেঙে গেল। গলা শুকিয়ে কাঠ। চারপাশ অন্ধকার। এসি-র হালকা শব্দ। এদিক ওদিক হাত বাড়ালেন। একা মানুষ। হাতে আর কী পাবেন! হয় পাশবালিশ নতুবা মোবাইল। মোবাইলটাই আগে হাতে ঠেকলো। অন করলেন। কিছু আলো হল। এবার টর্চের বাটনটা টিপলেন। অনেকটা আলোবিড়াল। টম, সাদা পোষ্য। সোফার উপর গুটিসুটি মেরে ঘুমোচ্ছে। পাশবালিশ ওপাশে কেত্‌রে পড়ে একটু দূরে টেবিলের উপরে জলভর্তি গ্লাস। সাবধানে নামলেন। খাটটা সামান্য শব্দ করলো। তার বাবার আমলের কাঁঠাল কাঠের খাট তার জন্মের অনেক আগেরশব্দ তো একটু হবেই। পুরো গ্লাসের জল প্রায় এক নিঃশ্বাসে শেষ করার পর স্বস্তি।

তাকে কি কোনো অসুখে ধরলো! জল খেয়েই তো ও শুয়েছিল! তারপরেও এমন! জিভটা যেন আঠায় জড়িয়ে গিয়েছে তালুতে। আর কী বিচিত্র স্বপ্নসব! যার মাথামুন্ডু কিছুই নেই! একা বলেই কি এমন! কিন্তু তা কেন হবে! একা তো আজ হঠাৎ হয়নি। গত প্রায় চুয়াল্লিশ বছর ধরেই তো আলোক একা। আর স্বপ্ন কি আজ নতুন দেখছে ও! রোজই তো দ্যাখে। কোনটা সকালেও মনে থাকে, কোনটা নানান ঘটনার মতোই মনে পড়ে না আর। তা’হলে! এমন গলাটলা শুকিয়ে একেবারে নাজেহাল! এমন তো হয় না!

ঘড়ি দেখলো। তিনটে বেজে গ্যাছে। একটু একটু ঘুমও পাচ্ছে। কিন্তু এখন বিছানায় গেলে ভোরে আর হাঁটতে বেড়োতে পারবে না। এসি অফ্‌ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। পশ্চিমের ব্যালকনি। এই রাত্রেও রেলিং গরম হয়ে আছে। সামনে তাকালো। নারকেল গাছে হাওয়ার কোনো হেলদোল নেই। ভ্যাপসা গরম। ভাদ্র মাসের শেষ প্রায়। এখনো বৃষ্টির দেখা নেই। সব যেন জ্বলে যাচ্ছে। আলোক একটা সিগারেট ধরালো। তিন পাশের বহুতলগুলোর কোনো ফ্ল্যাটেই আলো জ্বলছে না। শুধু স্ট্রিট লাইটের আলোয় ভেসে যাচ্ছে চওড়া রাস্তা। শূন্য। দুটো ক্লান্ত কুকুর। ঘুমোচ্ছে বোধহয়।

স্বপ্নের কি কোনো মানে হয়! সে কোনো নিয়মে আসে! অবচেতনের কোনো কারুকাজ থাকে তাতে! কুলিক তো গিয়েছিল আজ থেকে চব্বিশ কি তারও কিছু বছর আগে। সেখানেই ওই পাখিরা। অনেক। স্থানীয়রা বলে, শামুকখোল। পার্সটা হারিয়েছে প্রথম ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার বাসে। ভুঁইচাঁপা দেখেছিলএকেবারে জঙ্গল হয়ে ছিলকোচবিহারেএই সবগুলোই তো ও ভুলে গিয়েছিল! তবু কী আশ্চর্য, এতদিন পর সেইসব! আর ঐ ছায়াছায়া শাড়ি! কে যেন চলে গেল। কিন্তু এসেছিল কি! যোগাযোগটা কোথায়! আলোক কিন্তু মা, মাসিকে দেখতে পায় না! ওঁদের নিয়ে অনেক সময়েই ভাবে।  তবু কই! ওঁদের তো দেখতে পায় না! নাকি সবটাই এই শেষ ভাদ্রের গরম আর গত রাতের অতিরিক্ত পানভোজন! সিগারেটের টুকরো ছাইদানিতে গুঁজে বিব্রত আলোক সামান্য জল খেয়ে সিগারেটের প্যাকেটের দিকে আবার হাত বাড়ালো। হাত লেগে টেবিলের উপরে রাখা টুকটুকে আপেলটা নড়ে উঠলো। রোজ টিফিনের পর ও একটা আপেল খায়। একা, তবু। তো আপেলটা একটু গড়ালো। তারপর আস্তে আস্তে চেয়ারের উপরনির্ভিক। নির্বিকার। চেয়ার থেকে মেঝেয়। গড়িয়ে গেল টেবিলের নিচে। একটা স্লো মোশন শর্ট ফিল্মের মতো সম্পূর্ণ ঘটনাটা আলোক দেখলো। সামান্যতম নড়াচড়া না করে।  বিড়ালটাই বরঞ্চ মাথা তুলে একটু। হাত বাড়ালেই আপেলটাকে ঠেকাতে পারতো। করলো না। কেমন যেন এক নিস্পৃহতা। আজ অবধি কোন পতন, কোনো বিরুদ্ধতা, কোনো বিচ্যুতিকেই ও ঠেকাতে চায়নি। অফিসে রতনের বাঁ হাতের খেলার অশ্লীলতা বা পুজোর প্যান্ডেলের ডি জে-র সঙ্গে রাতভোর টালমাটাল অসহ্য হুল্লোড়। এমন কি অনুরাধাকেও নয়। কোনটাকেই নয়। কেন, আজও আলোক বুঝতে পারে না। ওর কি কশেরুকাতে কোন গন্ডগোল! এমন নির্বিকার কেন! আলোক বাথরুমে ঢুকলো। কিছু বিরক্ত।

মাঠে বেশ কয়েকটি কিশোর ফুটবল খেলছে। একেবারে হৈ হুল্লোড়। হাঁটতে হাঁটতে পরিচিত কিছু মানুষের সঙ্গে চোখাচোখি। স্বাভাবিক। একটু হাসি। একটু হাত তোলা। সবই স্বাভাবিক। সবাই এই  ওয়াই এম সি-র সবুজ মাঠটার মতো সবুজ থাকতে চায়। ভয়ে ভয়েই চায়। কখন যে হালুম শব্দে কিংবা ট্রামের ঘন্টা বাজাতে বাজাতে সে ঝাঁপিয়ে পড়বে ঘাড়ে, কে জানে! তাই বুঝি মন্দির মসজিদ চার্চের এতো রমরমা! যতোই সে এই পৃথিবীতে একা হতে থাকে, বিশ্বাস করতে চায় না নশ্বরতাকে। সে পা দুটো দিয়ে আরও একটু শিকড় খুঁজতে থাকে। তা’হলে কোনটা স্বাভাবিক? এই মৃত্যু নাকি শিকড়ের জন্য আর্তি! মৃত্যু, তাও আবার স্বাভাবিক! স্বাভাবিক ব্যাপারটা ঠিক কী, আলোক বোঝে না। জীবনানন্দ গিয়েছিলেন বড়ো কষ্টে। হাসপাতালে। যতোই তিনি ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা কাগজে কলমে লিখুন না কেন, আলোক মনে করে, তিনি আরও কিছুদিন পৃথিবীর এই আলোবাতাসের মধ্যেই থাকতে চেয়েছিলেন। বিনয় মজুমদার! যেন লন্ঠন হাতে অন্ধকারে একা একাই। তবু গত তেষট্টি বছরের এক বিচিত্র বেঁচে থাকার পরেও আলোক মৃত্যুকে ঘৃণা করে। সে হাঁটে! কিন্তু কোন্‌ সত্যের দিকে!

গোটা কয়েক টিয়া ট্যাঁ ট্যাঁ শব্দ মুখে নিয়ে উড়ে গেল বড় বকুলগাছটার দিকে। আলোক নিজের মনেই একটু হাসলো। যাবে। যাবেই, তবু! আশেপাশে তাকালো। নাঃ! ধারেকাছে এই মুহূর্তে কেউ নেই। ওর ঠোঁটে ঝুলে থাকলো সামান্য হাসি। কাল তবে পানভোজন কিছু বেশি-ই হয়েছিল! ঘড়ি দেখলো। দেরি হয়ে যাচ্ছে। মানদা মাসী ফিরে গেলে কপালে কষ্ট আছে। আবার তা’হলে স্বপনের হোটেল। পা চালালো আলোক।

আজ শনিবার। ড্রেসিং টেব্‌লের আয়নায় দেখলো, চুলদাড়ি বেড়েছে না কাটলে আর বাজারেও যাওয়া যাবে না। একে এই বিতিকিচ্ছিরি গরম, তার মধ্যে চুল দাড়ি নিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থাতবু ও গিয়েছিল। বাজারে। দরকার ছিল না, তবু। দৈনন্দিন চায়ের আড্ডাতেইঐ চুলদাড়ি নিয়েই। বীরেন চা বানাতে বানাতে বলেই ফেললো, কি রে, চেহারাটাকে তো খাসা বানিয়েছিস! চলে যা হিমালয়ে। দু’একজন মৃদু হেসেছিল। একজন তো টিপ্পনি কাটলো, বেশ দেখাচ্ছে কিন্তু দাদা!

বাতাস নেই। তবু সন্ধ্যে হতে না হতেই মানুষ ঠেলে, পুজোর বাজার মাড়িয়ে ও হাজির সুনীলের সেলুনেএকজন চেয়ারে। আর একটা ফাঁকা। ওটা ব্যবহার হয় না, আলোক জানে। সুনীল ওকে দেখে ইশারায় খালি চেয়ারটায় বসতে বললো। ওর মুখভর্তি খইনি। আলোক একটু হাসলো। আজ প্রায় তেইশ বছর হয়ে গেল, সুনীল ওর একমাত্র উদ্ধার। হাত তুলে ওকে আশ্বস্ত করে বাইরেই দাঁড়ালো।

খুব ব্যস্ত রাস্তা। আর এই কয়েক বছরে জায়গাটার চেহারা এতোটাই বদলে গিয়েছে যে, আলোকেরও মাঝেমধ্যে কেমন যেন অপরিচিত মনে হয় অঞ্চলটা। পরিচিত মুখগুলোই বা কই! এক সময়ে সন্ধ্যায় ফাঁকা ফাঁকা রাস্তার ওপারের হরির আলুর চপ কিংবা চিংড়ি চপ ছিল ওদের মাস্ট। অনুরাধা ভালবাসতো। কতো রাগঅনুরাগ যে মিটেছে এই হরির কল্যাণে! অনুকে পড়াতো ওইংরেজি। সেই  সময়ে তো দিনরাত্রি টিউশ্যনি। তার মধ্যেই অনুরাধাকে সপ্তাহে দু’দিন। বাড়িতে গিয়ে। যথেষ্ট সচ্ছল পরিবার। বাবার সোনারূপোর ব্যবসা। সুকান্ত সরণীর উপর বিখ্যাত দোকান। মা একটা প্রাথমিক স্কুলে। ঐ দুদিন সন্ধ্যায় টিফিনটা কিন্তু বেশ জবরদস্ত হতো। আলোক তখন টিউশ্যনি আর কমপিটিটিভ পরীক্ষার প্রস্তুতিতে। অনুরাধা ক্লাশ নাইন। ইংরেজিতে একটু দুর্বলই ছিল ও। সেই মেয়ে তৈরি হয়ে মাধ্যমিকে ইংরাজিতে ছিয়াশি পার্সেন্ট। উচ্চমাধ্যমিকে প্রায় তার কাছাকাছি। ওর মা বাবা তো খুশিতে ডগোমগো! অনুরাধা ইংরেজিতেই অনার্স নিয়েছিল। আলোকও টিকে গেল। এর মধ্যে আলোক ইনকামট্যাক্স দপ্তরে ইন্সপেক্টর হিসেবে ঢুকলেও অনুরাধাকে পড়ানোটা ছাড়তে পারে নি। আসলে পড়ানো ছিল অজুহাত। এই ক’বছরে ওদের দুজনের মধ্যে যে কিছু একটা রসায়ন তৈরি হচ্ছিল, অনুরাধার বাড়িতে আন্দাজ করেছিলো বোধহয়। অনুরাধা বেশ সুন্দরী, আলোক কালো, দো’হারা চেহারা। কেবল ওর হাইটটা ছিল দেখার মতো। ছয় এক। অনুরাধার বাড়ি থেকে এক সন্ধ্যায় সরাসরি প্রস্তাব। আলোক ক্রমশ যেন নিরাবেগ, নির্লিপ্ত। ততদিনে মা-বাবা দুজনেই গত হয়েছেন। দাদা ঢুকে পড়েছে একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে। সেলস এক্সিকিউটিভ। কারোর মতামতের প্রশ্ন নেই। তবু প্রথামতো আলোক দাদাবৌদিকে জানিয়েছিল। অনুরাধার মা-বাবাও এসেছিলেন।

একটা ঝকঝকে বাইক হেলমেটসুদ্ধ বিকট শব্দ করে এমনভাবে রাস্তা থেকে বাঁক খেয়ে সামনে ব্রেক করে দাঁড়ালো, আলোক চমকে একটু পিছিয়ে এসেছিল হেলমেট তুললে বোঝা গেল, বাইশ-চব্বিশের টগবগে তরুণ।

-কী বে, এতক্ষণে সময় হ’ল শালা তোর আসার? এখানে তো গুরু আজ ফাটিয়ে দিচ্ছে!

তরুণটি হাসলো।

-কী গুরু, কার মুখ দেখে আজ এসেছিলে গো! নিশ্চয়ই আরতির।

লুডোর আড্ডা ততক্ষনে ঢুকে গ্যাছে আবার খোপের মধ্যে।

হ্যাঁ, কী নিয়ে যেন ভাবছিল! ইয়েস। অনুরাধার। এক মাঘে হয়েই গেল বিয়েটা। প্রথম কয়েকটা বছর যেন ছিল অন্য এক অলীক জীবনের। এক অজানা ঘোরেরনতুন কোন জীবন আসেনি এর মধ্যে তাদের জীবনে। আলোকের কোনো হেলদোল ছিল না। কিন্তু আস্তে আস্তে তাল কাটতে শুরু হয়েছিলঅনুরাধার অস্থিরতা, খিটিখিটে মেজাজ যে আলোকের চোখে পড়ছিল না, তা নয়। কিন্তু আলোক তেমন পাত্তা দেয়নি। একান্তে অনুরাধার সঙ্গে এসব নিয়ে কথা বলার-ও প্রয়োজন মনে করেনি। ডাক্তারের কাছেও গিয়েছিল অনুর কথামতো। তেমন কোনো আশার কথা শোনেনি অনুরাধা। আলোক অফিস নিয়ে ক্রমে বেশি বেশি জড়িয়ে পড়ছিল আর অনুরাধা বোধহয় ততোধিক একা। দিন গিয়েছে দিনের মতোই। আর এ’সবের মধ্যেই অনুরাধা যে কী পেয়েছিল, কী দেখেছিল অফিস কলিগ তপনের মধ্যে! এক সকালে ঘুম থেকে উঠে আলোক একটা চিরকুট পেয়েছিল সেন্টার টেবিলে। ও জেনেছিল, অনুরাধা তপনের সঙ্গে জামশেদপুরে চলে গ্যাছে। আর ফিরবে না। আলোক আর খোঁজখবর কিছু করেনি। কীই বা হবে! চুপচাপ মেনে নিয়েছিল এমন চলে যাওয়া। আবাসনে কিছু ফিসফাস, কিছু  কৌতূহল। আলোকের কোন বিকার ছিল না। যেন অনুরাধা নামে কেউ ছিলই না আলোকের জীবনে!  শুধু একটা মিসিং ডাইরী করে রেখেছিল। আর অফিসের কিছু কাগজপত্রে নমিনির কলমে কিছু বদল। পরিবর্ত কাকে করলো, সে প্রশ্ন এ কাহিনীতে অবান্তর। তারপর তো কেটে গেল এতগুলো বছর। চাকরিও শেষ হল নিয়মেই। অনুরাধা ফেরেনি। ফিরলে আগের মতোই হয়তো থাকতে পারতো। ফেরেনি। ঘরে এখনো আলোক একা।

চিরকুটটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিল আলোক‘চললাম। ক্রমশ অসহ্য হয়ে উঠছিল। তোমাকে, এই ঘরকে, সব কিছুকেই। তুমিও হয়তো স্বস্তি পেলে।- অনুরাধা

ও মাথা তুললো। হাতের সিগারেট হাতেইএখন লম্বা ছাই। সামনের হোটেলের আলো চারপাশটা কেমন যেন বিদেশি বিদেশি গন্ধ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেসেলুনের সামনে লুডোর আড্ডা। সে একেবারে হৈ হৈ ব্যাপার! রাস্তায় মানুষের ভিড়।

-ছয়। তিন।

হুল্লোড় উঠলো একটা।

-মার্‌ ওটাকে।

-শালা তুমি গুরুকে বাঁচিয়ে দিচ্ছো কিন্তু! গুটি না বের করে তোমার ওটাকে মেরে দেওয়া উচিৎ ছিল।

-আরতি আজ দেবে নাকি?

-আরে বো..., তুই কিন্তু ধান্দাবাজি করছিস। গুরু কি আজ তোকে বিরিয়ানি খাওয়াবে নাকি আরতির ঘরে ঢোকাবে?

এতো সবের মধ্যেই সুনীল এক মুখ খৈনি নিয়েই হাঁক দিল,

-স্যার, আসুন।

অন্যমনস্ক আলোক কিছুটা চমকে উঠেছিল। অনুরাধা, লুডো, এই ছেলেগুলো, পালটে যাওয়া এই জায়গাটা! আলোক অনেকদূরে চলে গিয়েছিল।

হঠাৎ একটা হাওয়া উঠলো। ঝড়ের মতো। আলোকের মনে হল, বাতাস যেন দক্ষিণ থেকে ছুটে গেল উত্তরে। দূরে আকাশ ফালাফালা করে আলো। বাজ পড়ার তীব্র শব্দ। সুনীলের সেলুনের সামনে বেঞ্চের ছেলেগুলো হতচকিতএকটু যেন ত্রস্ত। দর্শক দুটো ছেলে আর বছর পনেরোর এক বালক। বাল্য আর কৈশোরের সন্ধিক্ষণে। ব্যস্ত হয়ে উঠলো। খেলা দেখছিল। সরে এলো সেলুনের দিকে।

-স্যার, আসুন।

সুনীল তাড়া দিল

-বৃষ্টি আসতে পারে। আপনাকে আগে ছেড়ে দিই।

মুখের পিক ফেলে বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে সুনীল বললো, তুই একটু দাঁড়া। এক্ষুনি হয়ে যাবে।

আলোক আকাশের দিকে মুখ তুললো। কিচ্ছু বোঝা গেল না। কী মনে হল। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ওকে আগে যাওয়ার জন্য বললো।

সপ্রতিভ উত্তর ভেসে এলো।

-ওহ! নো নো। প্লিজ আপ যাইয়ে আঙ্কল্‌ম্যায় তো ইধারকাই আদমি। নো প্রবলেম। প্লিজ গো।

আলোক যত না অবাক, তার থেকে অনেক বেশি বোকা। ছেলেটি কি বাঙলা জানে না!

আলোক আরেকবার ভালোভাবে দেখলো। যেন নিজের সেই বোকাবোকা বয়সটার সঙ্গে এখন এই ছেলেটাকে মেলাতে চাইছিলো।

সুনীলের কাজ শেষ হওয়ার পর ওর জন্য বরাদ্দ এক কাপ দুধ চা আর একটা সিগারেট। আলোক অপেক্ষা করছিল। আয়নায় নিজেকে দেখলো। সুনীলের হাতে যাদু আছে। এই চেয়ারে বসলেই ঘুম পায় আলোকের। কেন যে পায়! সত্যি কথা বলতে কি, ঘুম ওর সবসময়েই পায়। ভিতরে যে কি এক পোকা। প্রতি মুহূর্তে ঝুরঝুরে করে দিচ্ছে আলোককে! আর ঘুম পায়। এখানে সুনীল ওর বুকে স্পেশাল একটা সাদা কাপড় জড়িয়ে দিলেই যেন বেশি পায়। আপাতত সেলুন ফাঁকা। সুনীল চা আনতে। ও আবার ছেলেটিকে দেখলো।

পথে নেমে আলোক আকাশ দেখলো। বৃষ্টি নামেনি। হয়তো দূরে কোথাও। হালকা ঠান্ডা বাতাস। হাতের সিগারেটের টুকরোটা পায়ের কাছে ফেলে পিষে দিল। একটু থেমে ঘাড় ঘোরালো। প্যানারোমিক ভিউয়ে আলোশব্দ পেরিয়ে চোখ এসে স্থির হ’ল ছেলেটার মুখের উপর। ক্লোজ শট! আশ্চর্য! ছেলেটা কিন্তু সেলুনে ঢোকেনি। ওই ক’জনের অবিরাম চ-কারান্ত ব-কারান্ত শব্দগুলো ও গিলে নিচ্ছে। চোখ মুখে তীব্র মনোযোগ মা জানেও না, একা একাই কতো কিছু শিখে যাচ্ছে ও! যেন জীবনশৈলীর এক অন্য পাঠে মগ্ন।

হাঁটতে হাঁটতে আলোক ভাবছে। তেমনই অন্যমনস্কতা ওর শরীরে। দু'পাশে মানুষ। হেঁটে যাচ্ছে। আকাশ ভালো নয়। এপাশ ওপাশ থেকে ঠেলেঠুলে চলে যাচ্ছে মানুষের স্রোত। বাইকে যাচ্ছে। টোটোতে যাচ্ছে। আসলে ফিরছে। রাত হয়ে গ্যাছে। তাই ফিরছে। মুখে সব বিজয়ী মানুষের হাসি। হাতে হাতে রঙিন কার্ডবোর্ডের বাক্স। উৎসবের জন্য। তৃপ্তির জন্য। হয়তো বা দায় মেটানোর জন্যেও। সবারই যেন ঘরে ফেরার তাড়া। ঘর! আলোকের আজও জানা হল না, ঘর কেমন, কোথায়।

কেবল সময় দ্রুত বদলে যাচ্ছে! বোধহয় সবার অজান্তেই। তাই বুঝি এরা সব কতো সাবলীল! যেন কোথাও কোনো টানাপোড়েন নেই, সঙ্কট নেই। ওর আকুরিয়ামে থাকা মাছগুলো মনে পড়লো। তেমন যত্ন আর ওদের নেওয়া হয় কৈ! তবু সব বিরুদ্ধতাতেও দৌড়ে বেড়াচ্ছে অবিরাম। এখানেও যেন তাই। চারপাশের দেয়ালগুলো যে ক্রমে ছোট হয়ে আসছে, টের পাচ্ছে না ওরা। মুহূর্তেই ওদের বেঁচে থাকা। ওদের আনন্দ। কিন্তু এরা কি টের পাচ্ছে না, ভয়ংকর এক গর্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সময়! সে সঙ্গে তারাও! আর কতো সংক্ষিপ্ত হবে! নাকি এ সবই তার দেখার ভুল! ভাবনার ভুল! একা থাকতে থাকতে সে নিজেই ক্রমশ বন্দী এক নিস্তরঙ্গ জলে! সেখানে জীবন নেই, আনন্দ নেই, কেবল ওই আপেলটার মতো গড়িয়ে যাওয়া এক অনিশ্চিত শূন্যের দিকে!

আলোক দেখতে পেলো, এমন একটা পরিবেশে ছেলেটি কৈশোরের পোষাক ছেড়ে ঢুকে যাচ্ছে এক আলো-অন্ধকারের টানেলে। কিছু বা ওই আপেলের মতো। নির্বিকার। মায়ের অজান্তে চারপাশের ঘিনঘিনে জেদি পোকাসব নিয়ে নেমে পড়েছে অজানার আবিস্কারে যেন এক অঙ্গীকার। আপাতত একা একাই।

.

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন