কালিমাটি অনলাইন

ত্রয়োদশ বর্ষ / অষ্টম সংখ্যা / ১৩৫

দশম বর্ষ / একাদশ সংখ্যা / ১১০

ত্রয়োদশ বর্ষ / অষ্টম সংখ্যা / ১৩৫

মঙ্গলবার, ১৪ অক্টোবর, ২০২৫

পি. শাশ্বতী

 

দেবতা শিবের উত্থান-রহস্য

 


পৃথিবীর ইতিহাসে সভ্যতার শুরু থেকেই মানবগোষ্ঠীর মধ্যে চলে আসছে এক অন্যের মধ্যে ক্ষমতার লড়াই, নিজের নিজের গোষ্ঠীর মধ্যে সেই গোষ্ঠীর অধিপতির মধ্যে অবধারিত ভাবেই জন্ম নিয়েছে একাধিপত্যের বাসনা, দখলদারি মনোভাব। আর অনিবার্য ভাবেই তৈরি হয়েছে এক প্রচ্ছন্ন রাজনীতির বাতাবরণ। সেই লগ্নে শাসনতন্ত্র চালিত হত গোষ্ঠীপতি ও পুরোহিত সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে। যদিও আদি কাল থেকেই মানুষের মধ্যে প্রধানতম ভাবনাটি ছিল এক। ইতিহাস বলছে, বিশ্ব জুড়ে প্রায় সব জনজাতির মনের প্রশ্ন ছিল এই বিশ্ব সৃষ্টি রহস্যটি আসলে কী? কিন্তু উল্লেখ করার বিষয়টি হল এইসব আদিম জাতির ভাবনা এক হলেও এ বিষয়ে কল্পনা ছিল ভিন্নতর। তবে একথা সত্যি যে, তাদের সৃষ্টিতত্ত্বে এক মৌলিক সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়— সে তিব্বতই হোক কিংবা পেরু, স্ক্যান্ডেনেভিয়ার জনগোষ্ঠীই হোক বা অস্ট্রেলিয়া-আফ্রিকার মানুষই হোক — সর্বত্র। কী কারণে ভৌগোলিকভাবে বিচ্ছিন্ন এইসব আদিবাসীদের মনে একই ধরনের ভাবনার উৎপত্তি হয়েছিল তার সঠিক ব্যাখ্যা আধুনিক সমাজতত্ত্ববিদরা সঠিকভাবে দিতে পারেননি। সে যাইহোক না কেন, সৃষ্টিতত্ত্বের এই ভাবনা থেকেই যে প্রাচীন মানবগোষ্ঠীর মধ্যে আধিলৌকিক দেবদেবী সম্পর্কে ধারণা গড়ে উঠতে শুরু করেছিল, এ বিষয়ে যথেষ্ট ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে। এবং সেটিই প্রতিষ্ঠিত। ভারতের বৈদিক ও অবৈদিক দেবদেবী সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠার ক্ষেত্রেও এই একই ইতিহাস প্রবাহিত।

প্রকৃতপক্ষে ভারতের লিখিত ইতিহাস শুরুই হয়েছে বৈদিক যুগ থেকে। সেই ইতিহাসও আবিষ্কৃত হয়েছে বলতে গেলে একেবারেই সাম্প্রতিক সময়ে। মাত্র একশো বছর আগে আমরা জানতে পেরেছি যে, সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাস প্রায় পাঁচহাজার বছরের পুরনো। দেশভাগের ফলে সিন্ধু সভ্যতার মূলকেন্দ্র পাকিস্তানের অংশে চলে গেলেও আমরা ক্রমাগত সেই ইতিহাসের আরও গভীরে যাবার অভিপ্রায়ে ভারতের পাঞ্জাব-হরিয়ানা-গুজরাতে খননকাজ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আবিষ্কৃত হচ্ছে সিন্ধুসভ্যতার নানা প্রাচীন নিদর্শন। আর তাই অতি প্রাচীন যুগের ইতিহাসের পাতাগুলি ভরে উঠছে নতুন নতুন তথ্যের সংযোজনে। অথচ আমরা ভারতের অতীতের ইতিহাস বলতে গেলে শুরু করি বৈদিকযুগের মানুষদের কথা টেনেই। প্রকৃতপক্ষে মাত্র চোদ্দ-পনেরো হাজার বছর আগে  প্রাক-সিন্ধু সভ্যতার প্রাচীন মানুষদের যাযাবর জীবন ছেড়ে স্থায়ী বসতি তৈরির প্রবণতার মধ্যে দিয়েই শুরু হয়েছে ভারতের ইতিহাস। এবং সেটি বর্তমান বালুচিস্তান প্রদেশে বসবাসকারী যাযাবর শ্রেণির মানুষদের মাধ্যমেই গড়ে উঠেছিল। যদিও তার অনেক আগে থেকেই মানুষের আনাগোনা ছিল এই উপ-মহাদেশে। নিগ্ৰোরাও প্রব্রজনের তাগিদে এদেশে এসে পরবর্তী প্রজন্মের কিছু মানুষের মধ্যে এদের কিছু বিচ্ছিন্ন শারীরিক ছাপ রেখে গিয়েছিল। এসেছিল অস্ট্রিকরাও। যার ছাপ রয়েছে এদেশের মানুষের শারীরিক গঠনের মধ্যে। কিছু গোষ্ঠী মাইগ্রেশনের পথে পূর্ব এশিয়ার দিকে চলে গেলেও স্থায়ী বসতি হিসেবে বেশি সংখ্যায় তারা নির্বাচন করেছিল এই দেশকেই। এদের বিবর্তনের ইতিহাস — যা তাদের লোকায়ত সমাজের প্রতিটি ধূলিকণায় বিবৃত হয়েছে এবং পরবর্তী আর্য-দ্রাবিড় কৃষ্টিকে বিধৃত করেছে প্রাক-আর্য ভারতের  অলিখিত কাহিনিতে। 

এই সূত্র যদি সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের ছেড়ে যাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনকে হাতিয়ার করে ইতিহাসের পথে এগিয়ে যাওয়া, তাহলে আবার একথা মানতেও মন খুঁত খুঁত করে যে, এই বিস্তৃত প্রান্তরে মাত্র একটিই জাতি বসবাস করত। হাজার হাজার বছর ধরে এবং তারাই কেবল সভ্য ছিল। কিন্তু মন চাইলেই তো আর হয় না, বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাসচর্চার মূলে যে অনুবদ্ধ রয়েছে, সেই তথ্য এবং প্রমাণ ছাড়া শুধু অনুমান নির্ভর হয়ে চলতে পারে না ইতিহাসের চাকা। অথচ নিরক্ষর, মৌখিক আদান-প্রদানে অভ্যস্ত জনগোষ্ঠীর চারপাশে যে-সব নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, তার বিভিন্ন লোকাচার ও জীবনশৈলীর ছাপও তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

বৈদিক সমাজের বিদ্বানরা কিন্তু এগিয়ে ছিলেন এই বিষয়ে; তাঁরা লোকায়ত সমাজেই খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁদের সাহিত্য-সৃষ্টির উপাদান। তাই গড়ে উঠেছিল পুরাণের মতো এক অনুপম, বিন্যাসবহুল সাহিত্য!

সিন্ধু সভ্যতার ক্রমবিকাশ নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রবহমান ছিল আট থেকে দশ হাজার বছর যা প্রথমে শুরু হয়েছিল সেই বালুচিস্তান থেকেই। প্রাকৃতিক কারণে যা ক্রমেই পূর্বদিকে এগিয়ে এসে পাঞ্জাব-হরিয়ানা অঞ্চলে চূড়ান্ত বিকাশ লাভ করে। পরবর্তীতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সভ্যতার নিদর্শন ছড়িয়ে দেয় বিস্তীর্ণ ভারতভূমিতে। যার নিদর্শন পাওয়া যাচ্ছে বর্তমানে বাংলা থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত হরপ্পার সমসাময়িক সভ্যতার নিদর্শনের প্রত্নতত্ত্ব আবিষ্কারের মাধ্যমে।

সিন্ধুসভ্যতা আবিষ্কার হওয়ার পরে এদের সম্পর্কে, আবিষ্কৃত বিভিন্ন লিঙ্গ আর সালঙ্কারা মহিলাদের মূর্তি দেখে একটা ধারণা করা হয়েছিল যে, হয়তো এরা লিঙ্গ আর মাতৃকা পূজায় বিশ্বাসী ছিল।  কয়েক দশক পর্যন্ত এদের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে তথ্য ও তত্ত্বগত ভাবে কোনো নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে আসা সম্ভবও হয়নি। বর্তমানেও যে সেই অবস্থার বিশেষ পরিবর্তন হয়েছে, তা নয়। একই সঙ্গে এদের রাজনৈতিক অবস্থান ও সামাজিক পটভূমি থেকেও এটা পরিষ্কার নয় যে, সিন্ধুসভ্যতার অধিবাসীরা একই জাতিসত্তার অংশীদার ছিল কি না। এ পর্যন্ত যে-সব লিপি পাওয়া গেছে তার বেশিরভাগেরই পাঠোদ্ধার করা  যায়নি। ফলে পারিপার্শ্বিক প্রত্নসামগ্রী ও ভৌগোলিক, প্রাকৃতিক এবং অন্যান্য প্রাপ্ত সূত্রের উপর নির্ভর করেই যা কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তবে সেগুলি সবই বিজ্ঞানসম্মত ভাবেই নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করা হয়েছে। কী বলতে চেয়েছে তাও পরিষ্কার নয়।

কৃষিকাজ এবং যাতায়াতে সুবিধার কারণে মানুষ আবহমান কাল থেকে নদীতীরবর্তী উর্বরভূমিকে নির্বাচন করেছে নিজেদের বাসস্থান হিসেবে। যে তাগিদে আর্যরা সরস্বতী অববাহিকা থেকে শুরু করে ক্রমে গঙ্গা-যমুনার ধারে বসতি স্থাপন করে; তেমনি নদী শুকিয়ে যাওয়ায় এবং ক্রমাগত বন্যার কারণে চাষের জমিতে কৃষিকাজ এবং বাণিজ্যে ব্যাঘাত ঘটায় সিন্ধু তীরবর্তী মানুষরাও ক্রমে পূর্বদিকে এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়।

প্রায় প্রতি বছর সিন্ধু নদীর জল বৃদ্ধির ফলে বন্যা কবলিত বসতি ও কৃষিকাজের ক্ষতি হওয়ার ফলে যে সিন্ধুসভ্যতার ধ্বংসের প্রাথমিক কারণ, সেটা প্রমাণিত। এও জানা গেছে, কৃষি আর বাণিজ্য সিন্ধু তীরবর্তী মানুষদের সমাজে প্রধান অর্থকরী উৎস হওয়ায় নদী এদের জীবনে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে ছিল। তাই বন্যার প্রকোপ ও প্রাকৃতিক কারণে নদীর প্রবাহ-খাত পরিবর্তন প্রভাবিত করেছিল এদের জীবনযাত্রায়। ইতিহাসে একই ধরনের বাস্তুচ্যুতির উদাহরণ দেখতে পাওয়া যায় মধ্য এশিয়ার অন্য উন্নত সভ্যতাতেও। সেখানেও মানুষ প্রকৃতির অভিঘাতে স্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে বা সংখ্যাধিক্যের কারণে খাদ্যাভাব দেখা দেওয়ায় নতুন স্থান নির্বাচন করে সেই অঞ্চল ও জনজাতি থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। 

আজকের মতোই সে যুগে অসংখ্য গোষ্ঠীতে বিভক্ত সমাজ প্রয়োজন অনুযায়ী বাসস্থান-পেশা-কৃষ্টি নির্বাচন করত, মাইগ্রেশন ছিল তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অঙ্গ। আজকেও সেই প্রব্রজনের আবেগতাড়িত বা আরোপিত পরকাষ্ঠায় কোনো ছেদ পড়েনি।

ভারতীয় সভ্যতায় দেবদেবী সম্পর্কে ধারণা জন্মানোর যৌক্তিক এবং ঐতিহাসিক সূত্র খুঁজতে গেলে হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর সামাজিক এবং গোষ্ঠীগত রাজনৈতিক আবহের দিকে অবশ্যই নজর রাখতে হবে। যদিও সেখানে রাজা বা রাজত্বের কোনো ভাবনা ছিল কিনা সেটি স্পষ্ট নয়, তবুও পারিপার্শ্বিক ইতিহাস অনুযায়ী এটা স্পষ্ট যে, রাজনৈতিক কেন্দ্রিকতা ছিল এবং সেই কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ছিল গোষ্ঠীপতি আর ধর্মীয় ব্যক্তিত্বের হেফাজতে। না হলে এরকম সংঘবদ্ধ নগরকেন্দ্রিক উন্নত সমাজব্যবস্থা গড়ে ওঠা সম্ভব ছিল না। গোষ্ঠীপতির দায়িত্ব ছিল সকলকে সংগঠিত রাখা, শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করা, এমনকি সাধারণ পেশা নির্ধারণ করা। পাশাপাশি, ধর্মীয়ভাবে স্বীকৃত ব্যক্তিদের ওপরে দায়িত্ব ছিল সাধারণ মানুষকে নানা রকম রোগভোগের হাত থেকে বাঁচানো, ভবিষ্যত গণনা করে অনাগত বিপদের আগাম সতর্কবার্তা জানানো এবং প্রয়োজন অনুযায়ী ঝাড়ফুঁক, মন্ত্রবলে আধি-ব্যাধির কবল থেকে মানুষকে উদ্ধার করা। এই দুই শ্রেণির বিশেষ ব্যক্তিত্ব  কখনোই এক ব্যক্তি হত না। এরা ছিল স্বতন্ত্র, আবার প্রয়োজনে অনুযায়ী এক হয়ে যেতেও কোনো বাধা ছিল না। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, সিন্ধুসভ্যতায় রাজরাজড়া সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে না পারলেও রাজনৈতিক দিক থেকে যে সমাজে একটা গোষ্ঠীগত গঠনতন্ত্র ছিল, সেটা বোঝা যায়। এবং সেই গোষ্ঠীর যে এক-একজন করে নেতা থাকত, এটাও স্পষ্ট হয়ে যায়। কারণ কোনো নেতা না থাকলে, সেই সমাজের সাংগঠনিক দৃঢ়তা আসতে পারে না। যদিও এগুলি সবই প্রক্রিয়াগত ধারণা।

বিশ্বজুড়ে আদিবাসী জনজাতিদের গোষ্ঠীপতির আচার-আচরণে বা পোশাকে সর্বদাই কিছু অপার্থিব বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়, যা বুঝিয়ে দেয় একজন নেতা বা গোষ্ঠিপতি সাধারণ মানুষের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য তাঁর কর্তৃত্বের পরিচায়ক। ভারতে এখনো আদিবাসী সম্প্রদায়ের মধ্যে গাঁওবুড়োরা সেই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রতীক তাদের শরীরে ধারণ করে। ঐতিহাসিক নিদর্শন থেকে দেখা যায়, প্রাচীনকালে প্রায় প্রত্যেকটি  জনগোষ্ঠী টোটেম ধারণ করত আর সেই টোটেমের পরিচায়ক-প্রতীক শোভা পেত সেই জনজাতির নেতার মাথায়। যে-কোনো দেশের রাজাদের মাথার মুকুটও সেই কর্তৃত্বেরই একটি ধ্বজা স্বরূপ বিরাজ করেছে। গোষ্ঠীপতি সচেতনভাবে পোশাক-আশাকে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে চলতেন যাতে সাধারণ মানুষের কোনো অধিকার ছিল না। তারা সাধারণ মানুষ হয়েও যে অন্যদের থেকে পৃথক এবং তারা যে স্বর্গের দেবতাদের অনেক কাছাকাছি বিচরণ করে — এই পোশাক বা শিরস্ত্রাণ যেন সেটাই নির্দেশ করত। মাথায় মহিষের শিং লাগানো শিরস্ত্রাণ, তাতে বন্য পাখির পালক গোঁজা, পরনে হিংস্র জন্তুর চামড়ায় তৈরি পোশাক, হাতে ধারাল অস্ত্র আর ডমরুর মতো বাদ্য — সব মিলিয়ে গোষ্ঠীপতির বেশভূষা আলাদাভাবে তাকে চিনিয়ে দিত। ডমরুর শব্দ তার অনুসারীদের প্রতি দিক-নির্দেশিকা। তাদের বিচিত্র ভঙ্গিমা, নাচের তাল সবকিছুই যেন ঘোষণা করত জয়ঘোষ এবং সাধারণ মানুষের মনে তৈরি করত এক অবিমৃষ্য আনুগত্য!

যুগ-যুগান্তরের ইতিহাস এই কথাই বলে এসেছে। সেই সূত্রেই মহেঞ্জোদারো-হরপ্পার সমাজে নেতার পাশাপাশি প্রাচীন আদিবাসী গোষ্ঠীতে পুরোহিত সম্প্রদায়ের প্রভাবও বাড়তে থাকে— মধ্য-হরপ্পার যুগে এর প্রকাশ দেখা গিয়েছে। এরা একাধারে ওঝা, অলৌকিক ক্ষমতার আধিকারী; অন্যদিকে রোগের প্রতিকার এবং ভবিষ্যতের আগাম বার্তা জানার আধিকারী বলে সাধারণের খুব কাছের মানুষ ছিল। যা আগেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। এদের ছিল অনেক গুণ: এরা ভূত-প্রেতদের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখত; তীব্র গরম বা শীতের সঙ্গে যুঝতে এরা ছিল অত্যন্ত পারদর্শী। ভয়ংকর ঠান্ডার মধ্যেও এরা অবলীলায় খোলা শরীরে অনায়াসে চলাফেরা করার ক্ষমতা ধরতে পারত। বলা হয়, এরা নাকি যে-কোনো পশুর ভাষাও বুঝতে পারত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শ্বাস বন্ধ করে থাকার মতো অধিকারী ছিল। যেমন দীর্ঘ সময় ধরে এরা জলের নীচে কিংবা গর্ত খুঁড়ে সেই গর্তে মাথা ঢুকিয়ে মাটি চাপা দিয়ে শীর্ষাসনের ভঙ্গিতে থাকতে পারত। শরীরকে দুমড়ে-মুচড়ে বিভিন্ন অবস্থায় রেখে আর শরীরের ভিতর বায়ুর আগমন-নির্গমনকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের আয়ু বৃদ্ধির চেষ্টা করত— যা থেকেই প্রাচীন হঠযোগের সূত্রপাত। সাধারণ মানুষের কাছে এ সবই এতই অদ্ভুত, অলৌকিক এবং দৈবিক বলে মনে হত যে,  তারা এদেরকেই সর্ব শক্তিমান মনে করে প্রণিপাত করত। এর পেছনে বড় কারণটি ছিল, এরা এইসব ক্ষমতা প্রদর্শন করে দাবি করত যে, তারা আকাশমার্গের দেবতার প্রতিনিধি, দেবতার কৃপা এবং নির্দেশেই তারা এইসব ক্ষমতার অধিকারী হতে পেরেছে।

'শ্যামন' বলে যে শব্দটি প্রচলিত, তার অবশ্য বাংলা প্রতিশব্দ পাওয়া কঠিন। 'শ্যামন’ একশ্রেণির সম্প্রদায়, এরা প্রত্যেকেই নানা ধরনের ক্ষমতার অধিকারী ছিল। যারা একাধারে তান্ত্রিক, চিকিৎসক, জাদুকর, যোগী এবং পুরোহিতের ভূমিকা পালন করত। যেমন— তান্ত্রিকরা কাম উত্তেজনা প্রশমন ও নিয়ন্ত্রণ করে এবং বীর্যের ধারণ ক্ষমতা বাড়িয়ে শরীরে বিশেষ শক্তি কেন্দ্রীভূত করতে পারে।  জাদুকররা পর্বত-অরণ্যের প্রেতশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে আধিদৈবিক এবং আধিভৌতিক ঘটনা বশে আনতে পারত। চিকিৎসকরা প্রাকৃতিক জড়িবুটি ব্যবহার করে রোগের উপশম করত। যোগীরা ব্যায়ামের মাধ্যমে শরীরকে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় নিজের আয়ত্বে এনে নিজেদের নীরোগ রাখত। সেই সঙ্গে অন্যকেও সাহায্য করত। এরা ক্রমে মনকে ঊর্ধ্বগামী করে আশেপাশের প্রাকৃতিক পরিমণ্ডলকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। এবং পুরোহিতরা মৃতের আত্মার সদগতির রাস্তা সুগম করত বলে জানা যায়।

পৃথিবীর ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে, নব্যপ্রস্তর যুগ থেকেই আমেরিকা (মায়া এবং ইনকা সমাজ), স্ক্যান্ডেনিভিয়া, মধ্য এশিয়া এবং তিব্বতে এদের উপস্থিতি-প্রতিপত্তি লক্ষ করা গিয়েছে।

শ্যামনদের উদ্ভব তিব্বতের উত্তরে, সাইবেরিয়ায়। এদের প্রভাব মঙ্গোলিয়া ছাড়িয়ে তিব্বতে প্রসারিত হয়েছিল, সেখান থেকে ভারত ভূখণ্ডের বিভিন্ন অঞ্চলে। খ্রিস্টীয় নবম শতক পর্যন্ত তিব্বতে এদের একাধিপত্য পুরামাত্রায় বজায় ছিল। পরে অবশ্য বৌদ্ধধর্মের প্রসারে শ্যামনদের কার্যকলাপ স্তিমিত হয়ে পড়ে।

প্রায় নগ্ন এই শ্যামনরা যখন প্রচণ্ড তাপে খাড়া পর্বতগাত্রে বসে তপস্যা করত, শরীর থেকে ঘাম নীচের উত্তপ্ত পাথরে প্রবাহিত হয়ে বাষ্পের সৃষ্টি করত, শ্যামন সেই তাপ আবার নিজের শরীরে ধারণ করে কৃত্রিমভাবে শরীরের তাপমাত্রা বাড়িয়ে নিত। প্রখর রৌদ্রতাপে বা হিমশীতল রাতে খাড়া পাথরের ওপরে সোজা একপায়ে দাঁড়িয়ে তপস্যা করত। লোহা যেমন আগুনের তাপে নিজের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে, এরাও অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশে নিজেদের শরীর এবং মনকে কঠিন তপস্যায় পবিত্র করে নিজের মনে স্বর্গের দেব এবং পাহাড়ের দানবদের নিয়ন্ত্রণের অধিকারী হতে পারত; যেগুলি জাগতিক কল্যাণে তারা ব্যবহার করতে পারত।

ভারতীয় হিন্দু শাস্ত্রে তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর উল্লেখ পাওয়া যায় বহু যুগ ধরেই। তবে আদিতে কিন্তু মোটেও তেত্রিশ কোটি দেবদেবীর কোনো অভিব্যক্তি ছিল না। যদিও বর্তমান কালেও আর সাধারণ হিন্দু সম্প্রদায় এই বহু দেবতার ধারণা থেকে সরে এসেছে।  অনেক দেবতাই আজ সাধারণ মন থেকে নির্বাসিত। প্রকৃতপক্ষে বেদের আদিপর্বে বহু দেবতা বর্তমানে নির্বাসিত— বরুণ,  মিত্র, ভব, অর্যমার কথা থাকলেও পরবর্তী বেদের যুগে বা প্রাথমিক যুগের পুরাণে ছিলেন কেবল তেত্রিশজন দেবতা— এদের মধ্যে একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্টবসু, ইন্দ্র এবং ব্রহ্মণস্পতি ছিলেন অগ্রগণ্য। অগ্নি ছিলেন একাধারে দেবতা এবং পুরোহিত, যিনি যজমানের নিবেদিত হবি দেবতাদের কাছে পৌঁছে দিতেন। বৈদিক যুগের অনেক পরবর্তী সময়ে মহাদেব বলে খ্যাত হয়েছেন মহেশ্বর শিব। তাই তাঁকে অবৈদিক দেবতা হিসাবে ধরা হয় থাকে। বেদে শিবের কোনো নাম না থাকলেও সেখানে গোষ্ঠী হিসেবে একাদশ রুদ্রের কথা বলা হয়েছে। আবার আমরা জানি, শিবের আর-এক নাম রুদ্র। বৈদিক মতে রুদ্ররা যেমন ধ্বংসের প্রতীক, তেমনই সাধারণ মানুষকে জাগতিক নানা প্রতিকূলতা থেকে উদ্ধার করতেন। যা পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠা শিব দেবতার ধারণারই একটি অনুসারী বলা যেতে পারে। ফলে প্রচ্ছন্ন ভাবেই বৈদিক যুগেও শিবের একটি রূপ আমরা দেখতে পাই অন্য গল্পের আড়ালে।

আবার অগ্নিও কখনো এই রুদ্র গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে গিয়েছিলেন।একাদশ রুদ্রের কোনো স্পষ্ট রূপ পাওয়া যায় না। পরিষ্কার অবয়বের এই অপূর্ণতার কারণে একাদশ রুদ্র তাই কখনো অগ্নির মতো আর্য চেহারা সম্পন্ন, আবার কখনো সূর্যের মতো দীপ্ত বা মেঘের মতো ঘনঘোর কৃষ্ণবর্ণ।

রুদ্র আপাত বর্ণনায় ভয়ংকর। কারণ তাঁরা ঝড় ও বিদ্যুত উৎপন্ন ও নিয়ন্ত্রণ করতেন। ফলে ইনি পশুপালক যাযাবর প্রাচীন বৈদিক সমাজের কাছে অত্যন্ত ভীতিজনক ছিলেন। ঝড়ের প্রকোপে পশুদের যেমন মৃত্যু ঘটে, তেমনই পশুরা দিকভ্রান্ত দলছুট হয়ে পড়ায় প্রায়শই অর্থনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনতো পশুপালকদের জীবনে। আবার রুদ্র রোগবিনাশের ক্ষমতারও অধীশ্বর। তিনি ভীতিপ্রদ হলেও আধিদৈবিক এবং আধিভৌতিক ঘটনা নিয়ন্ত্রণের কর্তা হয়ে প্রাচীন আর্যদের মনে সম্ভ্রমও তৈরি করে নিতেন। আসলে সেই প্রাচীনকালে ভারতবর্ষে বৈদিক সমাজের মানুষদের ধর্মীয় ভাবনা ছিল অতি সরল এবং অন্ধ বিশ্বাসে আবৃত। তাঁদের কাছে যা কিছু উদ্বেগের, বিপদের বলে মনে হত, তার জন্য বিভিন্ন দেব কিংবা দেবীরূপ কল্পনা করে আর্যরা তাঁদের ভজনা করত, যজ্ঞ করত, নিজেদের কাছে যে-সমস্ত খাদ্যসামগ্রী সুস্বাদু বলে মনে হত, সেগুলি তাঁদের উদ্দেশে হবি হিসাবে নিবেদন করে প্রার্থনা করত দেবদেবীরা যেন সব সমস্যা থেকে তাদের রক্ষা করেন। বাকি পৃথিবীর জনজাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে এদেশের বিভিন্ন প্রাচীন জনজাতি গোষ্ঠীর ভাবনার তাই মৌলিক কোনো প্রভেদ খুব একটা ছিল না; আদিবাসী মানুষেরাও দেবকল্পনায় গাছের গুঁড়িতে বা পাথরের ঢিবির সামনে পশুবলি দিত তাদের দেবতাদের তুষ্টির জন্য। তারা মনে করত দেবতারা সেই বলির রক্ত পানে সন্তুষ্ট হয়ে তাদের আসন্ন সমূহ বিপদ থেকে রক্ষা করে সব রকম ইচ্ছা পূরণ করবেন।

গোটা বিশ্বজুড়ে দেবতাদের বিবর্তনের যে যোগ-বিয়োগের ধারা, সেটা কোথাও কোথাও যেন একসঙ্গে এসে মিলিত হয়েছিল। শুধুমাত্র কোথাও কখনো দেবতাদের বিভাগ হয়তো আলাদা ছিল, কখনো আবার মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ফলে দেখা যাচ্ছে যে, জাগতিক প্রয়োজনই মানুষকে বাধ্য করে তথাকথিত স্বর্গের দেববেদীদের মধ্যে  অপ্রয়োজনীয়দের ত্যাগ করে নতুন কোনো দেবদেবীকে আহ্বান করতে। সেই অর্থে ভারতে মাত্র তেত্রিশজন  দেবতা থেকে তেত্রিশ কোটি দেবতার আগমন কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। কিন্তু সেই কয়েক কোটি দেবতার তো এখন কোনো অস্তিত্বই পাওয়া যায় না। বরঞ্চ অনেক দেবতার আগমন মাত্র কয়েক শতাব্দী প্রাচীন; তারা ক্রমশ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে নতুন রূপ পেয়েছেন কিংবা পেতে চলেছেন। চলতি জীবনে মানুষের বাস্তব সমস্যা সামলাতে তাঁরা ভক্তদের হৃদয়ে সংগত কারণেই জায়গা করে নিচ্ছেন। যেমন এই সময়ের একটি বড় উদাহরণ হিসাবে দেশ ব্যাপী গনেশপুজোর ব্যাপক প্রচলন। শুধুমাত্র এই বঙ্গের কথাই যদি বলতে হয়, তাহলে গত এক দশকে গণেশ চতুর্থিতে শ্রীশ্রীসিদ্ধিদাতা গণেশের পুজো একটি সার্বজনীন রূপ ধারণ করেছে। এর পেছনে হয়তো বর্তমান আর্থিক সংকট একটি অপরিহার্য উত্তরণের প্রার্থনা হয়ে সামাজিক প্রচলনের রূপ সংগঠিত করছে। ফলে এইসব দেবতারা বাস্তবের মাটিতে সংকটাপন্ন অবস্থার থেকে মুক্তি পেতে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে নিজেদের অপরিহার্যতা প্রমাণ করে চলেছেন।  

কৃষিভিত্তিক স্থায়ী উপনিবেশ তৈরি করার আগে মানুষ ছিল এক স্বাভাবিক যুথবদ্ধ পরিভ্রমণশীল প্রাণী, যার খাবার জুটত জঙ্গলে পশু শিকার করে আর ফলমূল সংগ্রহ করে। প্রতি মুহূর্তে তাঁদের জীবনে প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করে চলতে হত। একদিকে তাদের বন্য পশুদের থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখা, অন্যদিকে সেই পশু শিকার করেই নিজেদের জীবিকা ও জীবন বাঁচিয়ে রাখার অনুশীলন। আর এর জন্যই এক নেতার প্রয়োজন ছিল তাদের জীবনে। প্রথম দিকে গোষ্ঠীর সদস্যরা নেতা নির্বাচন করত, পরে নেতা নিজগুণেই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে নিত। সেই নেতার অধীনে সাধারণ জনগণ অপরিচিত এবং শত্রুভাবাপন্ন অন্য দলকে আক্রমণ করে জঙ্গলের দখল নিত। সেই সংঘর্ষে জয়ী হলে নেতার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত, নতুবা অন্য নেতা নির্বাচনের প্রয়োজন হয়ে পড়ত। নেতা যেমন দলের সাধারণ সদস্যের প্রতি উদাসীন আর নির্মম হতে পারত, কোনো যুদ্ধে পরাজিত হলে গোষ্ঠীও নেতার প্রতি চূড়ান্ত নির্মমতার নিদর্শন হিসাবে তাঁকে দল থেকে বিতাড়িত করত, এমনকি হত্যাও করত। এমন চূড়ান্ত বিপরীত পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা পেতে নেতার তাই দরকার ছিল এমন একজনের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা, যিনি সরাসরি স্বর্গের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারেন; নেতাকে জানাতে পারেন স্বর্গের নির্দেশ আর ঘোষণা করতে পারেন নেতাই স্বর্গের আদেশে গোষ্ঠীর দায়িত্ব পেয়েছে। ফলে সেই থেকে সূচনা হল পুরোহিত সম্প্রদায়ের।

এই ভাবেই যুগের পর যুগ কেটে যায়। গোষ্ঠীও ভাঙতে থাকে, নূতন সম্প্রদায়ের ঘোষণা হতে থাকে। আগের যুগের কোনো জনপ্রিয় নেতা বা পুরোহিতের অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা ভেঙে যাওয়া প্রতিটি কৌমের মানুষের মধ্যে ইতোমধ্যে চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছে, অনুরাগীরা তাদের দেবস্থানীয় আসনে বসিয়ে দিয়েছে। আজকের আফগানদের মহাভারতীয় কালের পূর্বপুরুষ 'অফস্বান' হিন্দুকুশ পর্বতমালার উত্তরে এমনই এক ব্যক্তিত্বকে শ্রদ্ধা করত; নীল চেহারার এই পুরুষ বাঘের চামড়া পরিধান করতেন, মাথার চুলে জটা, হাতে ডমরু এবং ত্রিশূল। এমন কোনো দৈবিক চরিত্রই হয়তো চিরস্থায়ী রূপ পেয়েছিল মহেঞ্জোদারোর যোগী মূর্তিতে; যোগাসনে আসীন, বিচিত্র শিরোধান পরিহিত এবং বহু পশু পরিবৃত সেই চরিত্রকে জন মার্শাল (১৯১৮-২০ সালে মহেঞ্জোদারো-হরপ্পায় প্রথম খননকার্যের সময় ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিকর্তা) যে শিবের আদিমরূপ বলে ভুল করবেন এতে আর কি আশ্চর্যের আছে।

প্রথম যুগের বৈদিক সাহিত্য বাদ দিলে পরবর্তীকালের ব্রাহ্মণ-আরণ্যক-উপনিষদে আর্যদের যে ভাবনা প্রকাশ পেয়েছিল সেখানে যুক্তি দিয়ে বিচার করার প্রবণতা বেশ প্রকট। প্রাকৃতিক ঘটনার পিছনে যে কেন্দ্রীয় কোনো শক্তি আছে তা বুঝতে তাদের বেশি সময় লাগেনি। পাশাপাশি সাংখ্য-ন্যায়-যোগ-বৈশেষিকা-পূর্ব মীমাংসার মতো দর্শন-তত্ত্ব দিয়ে তারা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সেই কেন্দ্রীয় শক্তিকে বিশ্লেষণের চেষ্টাও করেছিল। তাদের চিন্তাভাবনা হয়তো বিভিন্ন খাতে বয়েছিল, কিন্তু উদ্দেশ্য ছিল এক- সৃষ্টি এবং তার পিছনে যে শক্তি আছে, তাঁকে খুঁজে পাওয়া। দেবতাদের রূপকে পাশ কাটিয়ে তারা চালিকা-শক্তিকে আবিষ্কার করতে চেয়েছিল। ন্যায়, কর্ম, জন্ম-মৃত্যুর আবর্তন, জাগতিক দুঃখ, ত্যাগের শক্তি, জগৎ-সংসারের খুঁটিনাটি- সব কিছুতেই তাদের দৃষ্টি নিবিষ্ট ছিল, চেষ্টা ছিল কিভাবে এগুলির উর্ধ্বে উঠে মানুষের জীবনকে আরও সুন্দর করা যায়।

এদের পাশাপাশি আরও অনেক মতবাদ চালু ছিল সেই আমলে। প্রবক্তারা আর্য সমাজের হলেও মূলস্রোতের ভাবনাতে নিজেদের গা না ভাসিয়ে নিজেদের মতো করে বিশ্বকে দেখতে চেয়েছিলেন। অজীবক, অজ্ঞান, চার্বাক (লোকায়ত), এমনকি, বৌদ্ধ-জৈন পুরোধা-পুরুষরাও নিজেদের মতো করে বিশ্বকে দেখতে চেয়েছিলেন। হয়তো তাদের সব ভাবনা মানুষের মন জয় করতে পারেনি, কালান্তরে অনেক মতবাদই হারিয়ে গিয়েছে মানুষের কৌতূহলী মন থেকে। কিন্তু চিন্তাভাবনার মৌলিকত্ব তো হারিয়ে যায়নি!

প্রায় সব মতবাদেই তিনটি বিষয় প্রাধান্য পেয়েছে: বিশ্বসৃষ্টি এবং জীবজগতের উৎপত্তি; কর্ম ও তার ফল; এবং জাগতিক দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তির উপায়। লোকায়ত ভাবনায় অবশ্য গভীর তত্ত্বজ্ঞানের দিকে দৃষ্টিপাত না করে সরাসরি ভোগবাদের মাধ্যমেই জীবনে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

এবার একটু মহাভারতের দিকে ফিরে দেখা যাক। এই সব যুগের অনেক শতাব্দী পরে লেখা মহাভারত, যা ধর্মীয় কাহিনির থেকে বেশি ইতিহাস বলে এখন প্রতীয়মান— আর তাই বলা হয়— ‘যা নেই (মহা)ভারতে, তা নেই ভারতে’, সেখানে অনেক গোষ্ঠীর নাম, পেশা, জীবনধারণ ইত্যাদির বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। এই সমাজগুলির মানুষরা আর্যদের আচার-সংস্কার থেকে এতই ভিন্ন মেরুর যে সভাপর্বে এদের নিয়ে তামাশাও করা হয়েছে। আচার ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু অনেক গোষ্ঠীর যুদ্ধ, ঘোড়া চালনা, বৈদেশিক বাণিজ্য ইত্যাদি বিষয়ে এতই উন্নত ছিল যে তারা আর্যদের কাছেও প্রশংসিত হয়েছিল। যুগে যুগে এই গোষ্ঠীগুলির পরিচয় বদলেছে; হয়তো পুরোনো জনজাতির স্থান নিয়েছে সদ্য আগত নতুন চেহারার এবং আকৃতি ও প্রকৃতি মানুষের কোনো গোষ্ঠী। কিন্তু এদের নিজের সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক বৈশিষ্ট্য আর্যদের দৃষ্টির অগোচরে ছিল না। এদের সঙ্গে আর্যদের শুধু বন্ধুত্বই হয়নি, শত্রুতার কারণে হয়তো যুদ্ধবিগ্ৰহও হয়েছিল। কিন্তু সেই সংঘর্ষের কাহিনি রূপকার্থে বর্ণিত হয়েছে। ইন্দ্র বা শিবের ত্রিপুর জয়ের কাহিনি মনে হয় এমনই কোনো জনজাতির বিরুদ্ধে আর্যদের বিজয়ের ঘটনা ঘিরে রচিত হয়েছিল।

ঋকবেদের যুগের পাকথ, ভলান, অলীনের মতো জাতির জায়গায় মহাভারতের যুগে দখল করেছে কম্বোজ, বাহ্নিক, অশ্বিনের মতো উত্তর পশ্চিমের উন্নত জাতিগোষ্ঠী। এরাও ভারতের সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক মানচিত্রে বিভিন্ন সময় ছাপ ফেলে গিয়েছে। কম্বোজরা পূর্ব ভারত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল এক সময়।

মনে রাখতে হবে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কিন্তু দু-পক্ষের হয়ে গোটা দেশের প্রতিটি রাজপরিবার এবং জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করেছিল; হয় কৌরবদের পক্ষে না হয় পাণ্ডবদের পক্ষে। ঐতিহাসিক দিক থেকে যদি এটি আমরা মেনে নিই, তাহলে এটা স্বীকার করতেই হয় যে, বহু আগে থেকেই রাজনৈতিক বা সাংস্কৃতিক সূত্রে এঁদের মধ্যে পরিচয় ছিল। তা নাহলে হঠাৎ এমন একটি মরণপণ বিরাট যুদ্ধে অস্ত্রশস্ত্র, লোকবল ও যুদ্ধ-পশু নিয়ে যোগদান কোনো মতেই সম্ভব হত না।

একটা বিষয় এখানে গভীর ভাবে উপলব্ধি করা যেতে পারে যে, সভাপর্বের আগে পর্যন্ত কিন্তু কোনো ঐশ্বরিক আগমন কিংবা ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির আভাস দেখা যায়নি। সভাপর্বের পর থেকে ঐশ্বরিক শক্তির পরিচয় পাওয়া গেছে, কিন্তু ভক্তির আভাস খুব একটা দেখা যায়নি। যেটি প্রথম প্রত্যক্ষ করা যায়, পাশা খেলায় যুধিষ্ঠিরের পরাজয়ের পর দ্রৌপদীর লাঞ্ছনার সময় থেকে। যার মূল কেন্দ্রে আবির্ভূত হলেন শ্রীকৃষ্ণ। তিনি সেখান থেকেই মনুষ্য চরিত্রের আড়ালে ক্রমশ 'ভগবান স্বয়ম্' রূপ ধারণ করতে শুরু করেন। এই বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে,  তাঁর কাছে কেবল আত্ম-সমর্পণ করতে পারলেই সব বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করা সম্ভব। আর এই ভাবেই রাজসভায় দ্রৌপদী বা যুদ্ধশেষে ভীষ্ম জাগতিক প্রতিবন্ধকতা পার হতে চেয়েছেন। যদিও এই ভক্তি আন্দোলন দানা বাঁধতে কয়েক শতাব্দী কেটে গিয়েছিল— যতদিন না দেবতা সরাসরি পাথর কিংবা মৃন্ময়ী মূর্তিতে বিগ্রহরূপ ধারণ করতে পেরেছিলেন।

বৈদিক যুগে হিন্দু সমাজে বেঁচে থাকার মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজ জীবনের ,প্রতিটি ঘাত-প্রতিঘাত থেকে মুক্ত থেকে জীবনের চলার পথকে সহজ করে তোলা। অর্থাৎ জীবনকে সর্বতো ভাবে একটা উন্নত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। বেদের আদি যুগে যাগ-যজ্ঞের মধ্য দিয়ে দেবতাদের উদ্দেশে হবি নিবেদন করা হত ঘি, দুধ, সোমরস, বলি প্রদত্ত পশুর রক্ত, যবের দানা ইত্যাদি। আগেই বলা হয়েছে, মানুষ তার প্রিয় জিনিসটিই দেবতার উদ্দেশে নিবেদন করত, কারণ তাদের ধারণা ছিল, দেবতারাও এগুলিকে হৃষ্টচিত্তে গ্রহণ করবেন। স্বাভাবিক কারণেই এর বিনিময়ে দেবতাদের কাছ থেকে উদ্দিষ্ট জাগতিক বস্তুলাভ এবং বিপরীত শক্তির হাত থেকে নিজেদের এবং নিকটজন-সহ তাদের জীবিকার আধার পশুপক্ষী রক্ষা করাই ছিল এই যজ্ঞের উদ্দেশ্য। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে সরাসরি তো দেবতাদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব নয়, তাই হবি প্রদানকারী অগ্নির সাহায্য নিতে হত, দক্ষিণা হিসেবে অগ্নিকেও হবি নিবেদন করা হত। এই ছিল প্রাচীন বৈদিক সমাজের মূল পরমার্থিক ভাবনা।

সমান্তরালভাবে সমাজে জায়গা করে নিয়েছিল বিবিধ পন্থা এবং প্রথা, যাদের প্রেক্ষাপট নিহিত ছিল পারিপার্শিক অবৈদিক সমাজে। উত্তরোত্তর আর্য-অনার্য মেলামেশায় এমন সব প্রথা প্রবেশ করেছিল বৈদিক মানুষদের মনে, যা এ-দেশের আদিবাসী সমাজে অনেক আগে থেকেই প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার রূপরেখা ছিল সরল, আচার নির্ভর এবং সেই আচারে দেবতাদের উদ্দেশে বলিপ্রদান ছিল অন্যতম প্রধান আচার। পাশাপাশি তাদের আধিকারিক কিছু মানুষের মধ্যে অতীন্দ্রিয় ভাবনারও উদয় হয়েছিল, যা ছিল শৈবকেন্দ্রিক এবং অজীবিক— এক্ষেত্রে এমন কিছু দর্শনের জন্ম দিয়েছিল যা কালের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অনেকটাই হারিয়ে গেছে।

পাশাপাশি তৎকালীন অবৈদিক সমাজে আদিবাসী এবং প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে একধরনের অতীন্দ্রিয় ভাবনা বিস্তার লাভ করে ছিল। এবং এই ভাবনা অনেক ক্ষেত্রেই আর্যদের ভাবনা থেকে উন্নততর ছিল। ঈশ্বরমুখী চিন্তাভাবনা ও আধ্যাত্মিক সাধনার পদ্ধতিও ছিল বিজ্ঞানসম্মত। এই ভাবেই হিন্দু শাস্ত্রের প্রথম তিনটি দর্শন সাংখ্য, ন্যায় এবং যোগ সম্পূর্ণভাবে অবৈদিক জনগোষ্ঠীদের নিজস্ব বিজ্ঞানসম্মত জগতের গূঢ় তত্ত্ব কল্পনা। পুরুষ-প্রকৃতির মিলনেই যে এই জগত গড়ে উঠেছে, এই ধারণাই পরবর্তী সময়ে আর্যদের হাতে পরিশীলিত হয়ে আজকের রূপ নিয়েছে। যোগ-সাধনা পতঞ্জলির আবিষ্কার নয়, তিনি শুধু এর সূত্র রচনা করেছিলেন; যার সাহায্যে মানুষ যোগের গূঢ় ব্যাখ্যা পেতে পারে। এদেশে আর্যদের বিস্তৃত বসতি এবং প্রভাব বিস্তারের ঢের আগেই যোগের জনপ্রিয়তা যে চাক্ষুষ করা গিয়েছে অথর্ববেদ তার প্রমাণ। মধ্য এশিয়া-তিব্বতে এর প্রভাব দীর্ঘায়ত ছিল, এই তথ্য আজ সকলেরই জানা। পাশাপাশি প্রাচীন জনগোষ্ঠিতে ছিল কালা-জাদু এবং অপরসায়নের প্রভাব। এর একটিই মাত্র লক্ষ্য হল মানুষের প্রকৃতির ওপরে প্রভাব বিস্তার বা তাকে নিয়ন্ত্রণ এবং নিজেদের আয়ু বৃদ্ধি করে চিরযৌবন লাভ করা। এর মধ্যে কোনো ঐশ্বরিক ভাবনা বা অতীন্দ্রিয় দর্শন ছিল না, যেমন ছিল না যোগ-প্রাণায়ামের ক্ষেত্রে ঈশ্বরীয় ভাবনা। যোগ-প্রাণায়ামে সিদ্ধ হয়ে অনুশীলনকারী শারীরিক দিক থেকে বলিষ্ঠ হত আর মনের দিক থেকে স্বচ্ছ-দৃঢ় হয়ে অন্যদের ওপরে আধিপত্য বিস্তার করত।

হিন্দুধর্মের আর একটি প্রাচীন ধারা প্রবাহিত হয়েছে সিদ্ধদের নিয়ে।  কৈলাস অঞ্চলের আশেপাশেই ছিল এইসব সিদ্ধদের বসবাস। এদের জীবনযাপনকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল মহাদেবের ঐশ্বরিক অবয়ব। মহেশ্বর শিবের অবদান এদের সিদ্ধ যোগের অন্যতম পাথেয় হিসাবে পরিগণিত হয়ে এসেছে। সিদ্ধযোগের কেন্দ্রেও রয়েছেন শিব-পার্বতী। এই কারণেই অপরসায়নবিদ্যার এত খ্যাতি। শোনা যায় এই অপরসায়নবিদ্যার সূত্রেই যে-কোনো ধাতু নাকি সোনায় পরিণত হয়। আসলে এই বিদ্যার মুখ্য উদ্দেশ্য হল সাধকদের শরীর এবং মনকে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া যা সাধকদের সময়ের ঊর্ধ্বে নিয়ে গিয়ে শারীরিক ক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে। আর এটাই হল সোনায় পরিণত হওয়ার একটি রূপকল্প।

বৌদ্ধ এবং শৈব তত্ত্বে শিবের বীর্যকে পারদের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, আর অভ্র রূপ নিয়েছে পার্বতীর গর্ভ হিসাবে। শাস্ত্রমতে দীর্ঘায়িত যোগ সাধনা এবং আহৃত মিলনের মধ্য দিয়ে জন্ম নেয় রসসিদ্ধ। অপরসায়নিক বিদ্যায় ব্যুৎপত্তি তাই রসসিদ্ধকে দেয় জাগতিক সুখভোগ এবং বয়সের সঙ্গে শারীরিক অবক্ষয়ের হাত থেকে মুক্তি। এই বিদ্যায় যে সিদ্ধ হতে পারে, সে হয় চিরযৌবনের অধিকারী। রসসিদ্ধরা তাই মনে করেন কুমার বা কার্তিকের অনির্বচনীয় জন্মকথাতেই নিহিত আছে সিদ্ধের সাধনার মূলসূত্র এবং তা লাভ করা যায় শিবের প্রতীক পারদের চিরস্থায়ীকরণে।

সব সাধনার উৎসই শিব; কারণ শিব থেকেই এই জগতের উৎপত্তি এবং এই জগৎ ধারণের বিভিন্ন কলা শিবের থেকেই উৎপন্ন। শিব তাই আদি গুরু, যিনি সতত মানব কল্যাণে নিত্যনতুন জ্ঞানের পরিধি খুলে দিয়েছেন মানব-জগতে। মন্দির ভাস্কর্যে এবং গুহা-স্থাপত্যে দক্ষিণামূর্তির উপস্থিতি রয়েছে ভারত জুড়ে।

এক দশনামী সন্ন্যাসী শুনিয়েছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের অমৃত-তত্ত্বের কথা:

শিবকে জানলেই জগৎকে জানা যায়; আদিতেও তিনি, প্রলয়েও তিনি। তিনি ছাড়া এই ধরাধাম অন্তঃসারশূন্য। তাঁর বিভিন্ন প্রকাশের কারণে দেবতাদের সৃষ্টি, আবার যুগাবসানে সেই দেবতারা মিলিয়ে যান শিবের অন্তর্জালে। ধ্বংসের দেবতা হিসেবে বহুল পরিচিতি সত্ত্বেও তিনি ব্রহ্মাকে নিয়োজন করেন সৃষ্টির আয়োজনে, আবার দেবতা বিষ্ণুর সহায়ক হিসেবে এই সংসার চালনাও করেন তিনি।

সমাজ মাধ্যমের একটি প্রকাশ থেকে জানা যায় যে: নর্মদার উৎসের কাছাকাছি একটি গ্রামে এক আদিবাসী উৎসব হয়। চৈত্রের শুক্লা অষ্টমীর রাতে সেই গ্রামে নাকি এক বিচিত্র অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।  এক শুকনো দুপুরে ঝরা পাতার রাস্তা দিয়ে  মেঠো আধ-ভাঙা রাস্তায় সেই পথ পার হয়ে সন্ধের আগেই সেই আদিবাসী গ্রামে গিয়ে জানা গেল অনুষ্ঠান শুরু হতে রাত হবে। এরপর তো রাতের প্রথম প্রহর শেষ হল। আশেপাশের এলাকা ঘুরে উপস্থিত হওয়া গেল রাত ন-টা নাগাদ গ্রামের মাঝামাঝি এক বড় উঠোনে। লোক ততক্ষণে সেখানে আসতে শুরু করেছে, মাঝের জায়গাটা সুন্দর গোবর-নিকানো, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে প্রায় বিশ হাত । এর ঠিক কেন্দ্রে আঁকা বেশ বড় এক আলপনা— চালের গুঁড়ো আর আবির দিয়ে আঁকা এক বিচিত্র নকশা, যার গূঢ় অর্থ কিছু থাকলেও  জানা যায়নি।

আধঘণ্টার মধ্যে সেখানে উপস্থিত হলেন লাল আদিবাসী পোশাকে এক বৃদ্ধ এবং তাঁর সাথে ছয়জন আদিবাসী মহিলা। সেই বৃদ্ধ আলপনার মাঝে দুটো জলভর্তি মাটির কলসি সাজিয়ে রাখলেন— দুটোর মধ্যেই অজানা গাছের শাখা আর তাদের ওপরে খোসা ছাড়ানয় দুটো নারকেল— একটি ঘটে নারকেল শুইয়ে রাখা, অন্যটায় খাড়া করে রাখা। কিছু শস্যদানা চারপাশে ছড়িয়ে দিলেন আর এলোমেলোভাবে বসালেন কয়েকটি মাটির পুতুল।

বৃদ্ধ এবার নিজস্ব ভাষায় মন্ত্র উচ্চারণ করতে শুরু করলেন— প্রথমে মৃদুভাবে এবং ধীর গতিতে; স্তবপাঠের সেই বেগ ক্রমশ বাড়তে থাকল। মুখের সাথে তাল রেখে এবার তিনি দুটো কলসিকে প্রদক্ষিণ করতে করতে তীব্রবেগে আলপনার ভিতর ঘুরতে লাগলেন। তাঁর সাথি ছয় আদিবাসী মহিলাও তাঁর সঙ্গে নাচতে লাগলেন— কিন্তু আলপনার বাইরে। কিছুক্ষণ চলার পরে সেই বৃদ্ধ এবং এক মহিলা নাচ থামালেন আর আলপনার কেন্দ্রে প্রবেশ করলেন, কলসির দু-পাশে দাঁড়ালেন; অন্যদের নাচ আগের মতোই চলল বৃত্তের বাইরে। ভিতরের সার্কেলে বৃদ্ধ-মহিলা প্রথমে বারবার কলসি দুটোকে টপকে দিক বদল করতে লাগলেন, কিন্তু নিজেদের গা-ঘেঁষাঘেঁষি বা কলসিদের স্পর্শ করা— কোনাটাই করতে দেখলাম না। পনেরো মিনিট এরকম চলার পরে দুজনেই ডান হাতের তালু দিয়ে নিজের দিকের কলসিকে এমনভাবে আঘাত করলেন যে ভেঙে ছড়িয়ে না পড়ে কলসি দুটো আধভাঙা অবস্থায় প্রায় সেঁটে গেল। কলসি-ভাঙা জল মাটি ভিজিয়ে দিল। নারকেল দুটো ভেঙে তার জল সকলের ওপরে ছড়িয়ে দিলেন সেই বৃদ্ধ। উপস্থিত জনতা আনন্দে বিহ্বল হয়ে উঠল।

প্রতিবেদক বলছেন: শেষে ভালো করে দেখে চেহারায় আর কথার ধরনে মনে হল ওই বৃদ্ধ স্থানীয় ওঝা-গোছের ব্যক্তি। অনুষ্ঠান দেখতে বেশ ভালো লেগেছে, কিন্তু মর্মার্থ কিছুই বোঝা যায়নি। ওঁর সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যই ছিল সেই অনুষ্ঠানের প্রেক্ষাপট জানা আর মানে বোঝা। অনেক কথার মাঝে যে সৃষ্টিতত্ত্ব উনি বোঝালেন সেটা এরকম:

আদিতে এই পৃথিবীতে কোনো প্রাণ ছিল না। আকাশে ছিলেন সূর্য আর চাঁদ, কিন্তু তাঁদের কখনোই মিলন হত না। মাঝে মাঝে, যখন রাহু চাঁদকে বা সূর্যকে গ্রাস করতে অগ্রসর হত, তখন অন্যেরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন, কিন্তু সে তো আনন্দের সময় নয়। এদিকে যুগ কেটে যায়, কিন্তু মেদিনীতে প্রাণের সঞ্চার আর হয় না। সূর্য-চন্দ্র নিজেদের অপারগতা বুঝতে পারলেন। তাই প্রথমে তৈরি করলেন জল আর বাতাস। দুজনে ঠাঁই নিলেন দুই ঘড়ায়, জলের অন্তরালে বায়ু তৈরি করেছিল ব্যবধান। একদিন তাঁদের এক হওয়ার ইচ্ছে জাগল, তাঁরা রূপ নিলেন মহাদেব আর দেবীর। তাঁদের সম্মিলিত ভাবনাই এই পৃথ্বীতে প্রাণের সঞ্চার করেছিল।

বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রেও দেখা যায় গৃহত্যাগী রাজকুমার সিদ্ধার্থ বেরিয়ে পড়েছিলেন মানুষের জরা, ব্যাধি, দুঃখ-কষ্ট থেকে কোন মন্ত্রে মুক্তি ও শান্তি পাওয়া যায়— এই পথের দিশা খুঁজতে। যিনি পরবর্তীতে গৌতম বুদ্ধ নামে এক নূতন দর্শনের জন্ম দিয়েছিলেন। সিদ্ধার্থ প্রথম দিকে অজীবিক এবং শৈব চিন্তায় মন দিয়েছিলেন। ফলে তাঁর তপস্যাও দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। প্রথমে তিনি শৈব-পদ্ধতিতেই সাধনা করেছিলেন বলে অনেক গবেষক মনে করে থাকেন। জাগতিক শোক, জ্বালা, যন্ত্রণা জৈবিক তাড়নাকে তিনি  'মাড়' নামে দস্যুর অত্যাচার বলে মনে করতেন। বৌদ্ধ ইতিহাসে এমনই বলা হয়ে থাকে। সিদ্ধার্থ শৈব পদ্ধিতে সিদ্ধিলাভ না হওয়ায়, সুজাতার হাতে পরমান্ন গ্রহণ করে নতুন করে তপস্যায় বসলেন এবং তাতেই তিনি বোধিলাভ করেন। যদিও বুদ্ধদেবের এই সিদ্ধিলাভ ঠিক কোন পদ্ধতিতে হয়েছিল— অজীবিক না অন্য কোনো উপায়ে, সেটা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ আছে।

শিবের আরাধনার একটি নিজস্ব ঘরানা আছে বাঙালিদের মধ্যে। যেটি এক সময় রীতিমত উৎসব হিসাবে পালিত হত। দেশ ভাগের পর বর্তমানে সেই প্রথা বা উৎসব অনেকটাই ম্লান হয়ে পড়েছে। সারা চৈত্র মাস ধরে রাস্তায় শিব-পার্বতীর বেশে সঙের আনাগোনা দেখা যেত। আর-এক শ্রেণির মানুষ গোটা মাস ধরে সারাদিন উপবাসে থেকে শিবের ব্রত ধারণ করতেন। গৃহস্থের আঙিনায় ব্রতধারী সন্ন্যাসীদের ছিল আপ্যায়ন। মূলত, পূর্ব-বাংলার নমশূদ্রদের মধ্যেই এক-মাসব্যাপী পাটের পূজা ও পাটের গান গেয়ে এই উৎসবের চল ছিল বেশি। এই পাটের ঠাকুর হল একটি লম্বা কাষ্ঠখণ্ড।

লোকায়ত পাট-ঠাকুর আদতে বাবা ভোলানাথ, যার নামে মাসভর ব্রতরক্ষাকারীরা দুয়ারে দুয়ারে ঘুরে সিধে আদায় করে। সারাদিন উপবাসের পরে সেই ভিক্ষান্ন রান্না করে বাবা ভোলানাথকে প্রথমে নিবেদন করে তারপরে নিজেরা ব্রত ভাঙে। রাতেও নাট-মন্দিরে মাঝে পাট ঠাকুরকে শয়ান দিয়ে সন্ন্যাসীরা সেখানেই মেঝেতেই ঘুমিয়ে পড়ে। সুন্দর করে সিঁদুর মাখানো হয় এই পাট-ঠাকুরের কাঠের মুর্তিটি। শালের মতো শক্ত কাঠের মোটা তক্তাকে কাছি-নৌকার আকার দেওয়া হয়। লম্বায় এক থেকে দেড় হাত আর চওড়ায়  প্রায় এক ফুট। এর মাঝে পাশ-ফিরে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন পেট-মোটা, মাথায় জটা কাঠের শিব, মাথার নিচে বাম বাহু; পরনে বাঘের ছাল (কাঠ-খোদাই) বা কিছুই নেই, ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। মূর্তির মাথার ওপরে ত্রিশূল গাঁথা, সর্বাঙ্গে তেল আর সিঁদুরের প্রলেপ। প্রতি গৃহস্থ বাড়িতে গৃহকর্ত্রী পাট-ঠাকুরের ওপরে তেল আর সিঁদুর লেপে দেওয়ায় প্রলেপ ক্রমাগত পুরু হতে থাকে এক মাস ধরে।

গ্রামে বা শহরের পাড়ায় সন্ন্যাসীদের দেওয়া জয়ধ্বনি আর ঢাকের শব্দে গৃহবাসীরা সচেতন হয়ে আঙিনায় গোবর জল দিয়ে ভালো করে নিকিয়ে দেয়। মাটিতেই স্থাপন করা হয় পাটের কাঠামো আর চারদিক ঘিরে উদ্দাম ঢাকের শব্দ এবং জয়ধ্বনির সঙ্গে নৃত্য করতে থাকে ব্রতধারীরা। সাথে থাকে গৃহস্থের উলুধ্বনি। গৃহকর্ত্রী ঘটিতে করে দুধ নিয়ে পাটমূর্তিকে অভিষেক করেন আর শিবের শরীরে তেল-সিঁদুরের প্রলেপ লাগিয়ে দেন। সন্ন্যাসীদের ঝুলি ভরে দেন চাল-ডাল-আনাজে। এইভাবেই কাটে সারা চৈত্র মাস।

চৈত্র সংক্রান্তিতে নীল পূজার দিন সকালে শিবের পূজা হয় গ্রামের মাঝে বড় বটগাছের প্রাঙ্গণে আর রাতে অনুষ্ঠিত হয় 'হাজরা-খেল'- যা এক বিশেষ আঙ্গিক বহন করছে। সন্ধের পরে সন্ন্যাসীরা স্নান করে গ্রামের বেলগাছের তলায় জড়ো হয়। ‘বালা’ নামের প্রধান ভক্ত্যার নেতৃত্বে সারারাত ধরে শ্মশানে হাজরা-খেলার অনুষ্ঠান হয়। বেল গাছের নিচে বালা শিবের পূজা শুরু করেন। পাট-মূর্তির পাশে রুদ্রাক্ষের মালা জড়ানো ত্রিশূল আর সামনে থাকে জলভর্তি একটি কলসী। এছাড়াও নিবেদন হিসেবে সামনে সাজানো থাকে ফল-মিষ্টি-আতপ চাল আর শাল-শোলের ভোগ। গ্রাম বাংলায় জনপ্রিয়  শোল মাছ পোড়া এই পূজার বিশেষ উপকরণ। ভোগ নিবেদনের মুহূর্তে বালা নিজের বীজমন্ত্র আওড়ানোর সঙ্গে জোরে জোরে নিজের মাথা ঘোরাতে থাকেন। মন্ত্র এবং মুদ্রা বালার নিজস্ব, ভক্ত্যারাও এর তাৎপর্য অবগত নয়। নিবেদনের পরে শাল-শোলের ভোগের কিছু অংশ মুখ্য ভক্ত্যাদের কোমরে বেঁধে দেওয়া হয়। সব ভক্ত্যাদের পরনে গেরুয়া নেংটি আর কপালে বাঁধা ফেট্টি ও রুদ্রাক্ষের মালা, পায়ে বাঁধা ঘুঙুর; অনাবৃত শরীরে ঘন পিটুলি-গোলার প্রলেপ। পাট-মূর্তিকে মাঝে রেখে ভক্ত্যারা তখন প্রবল ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে উদ্দাম নৃত্যে মেতে ওঠে, ক্রমে এক উন্মাদনায় ছেয়ে যায় তাদের শরীর-মন।

মধ্যরাতের আগে বালার নেতৃত্বে অর্ধ-চেতন ভক্ত্যারা পৌঁছোয় কাছের কোনো শ্মশানে। আগে থেকেই সেই জায়গা পরিষ্কার করে চারটি কলাগাছ ও পাশে জলের ঘট পুঁতে রাখা হয়, যা রাতের হাজরা খেলার মূল মণ্ডপ। প্রায় অচেতন মূল ভক্ত্যারা শ্মশানে পৌঁছে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। অনুষ্ঠানের শুরুতে ভক্ত্যাদের মাথার চুল টেনে ধরে মুখ ওপরে করে বালা তাদের আরতি করেন। সম্বিত পেয়ে তারা এবার নাচতে শুরু করে ঢাকের তালে। বালা আগের মতো অবোধ্য মন্ত্র আওড়াতে থাকেন আর শিবের জয়ধ্বনি দিয়ে ভক্ত্যাদের মাথায় জল ছিটিয়ে দেন। এই নাচ ভোর হওয়ার আগে পর্যন্ত চলতে থাকে।

পুব আকাশ রঙিন হওয়ার আগে, শ্মশান থেকে নিজেদের গাদং-এ (চৈত্রমাসব্যাপী সন্ন্যাসীদের থাকার অস্থায়ী নিবাস) পৌঁছে ভক্ত্যারা সামনের খোলা জায়গায় গোল হয়ে উন্মত্ত অবস্থায় নাচ চালিয়ে যায়। এবার তাদের হাতে ধারাল অস্ত্র। বালা মাঝখানে দাঁড়িয়ে শিবের মন্ত্র জপ করেন বা স্থানীয় কবির গান গাইতে থাকেন। এই নাচের তাল এবং ভঙ্গিমা একেবারেই বাংলার নিজস্ব ঘরানার।

ভারতের মতো বিশাল জনজাতির দেশে শিবের মতো একজন অবৈদিক দেবতা দেবাদিদেব হলেন কিভাবে, এই প্রশ্ন উঠতেই পারে। অর্থাৎ শিব কে? কোথায় তাঁর আদি বাসস্থান; কিভাবে তিনি সারা ভারতে প্রভাব বিস্তার করে দেশ-কাল-সমাজকে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আজ এক বিশালকায় চেহারা নিয়েছেন— প্রশ্নগুলি আজ দেশবিদেশের সমাজতাত্ত্বিকদের আলোচনার বিষয়; তেমনি আন্দোলিত করে দেশের মানুষের চিন্তনকেও। একটি বিষয় পরিষ্কার— জনজাতির প্রত্যেকটি সমাজে শিবের আগমন হয়েছে তাদের নিজস্ব পথ ধরে। হয়তো আদিতে তাদের কাছে অন্য কোনো দেবতা-ভাবনা ছিল। কিন্তু ক্রমেই শিবের ছায়ায় সেই ভাবনাগুলি একটি নির্দিষ্ট ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, আদি দেবতা নিজের স্বরূপ বিলিয়ে দিয়েছেন শিবের বিরাট মূর্তিতে। তাই শিবের রূপেও দেখা যায় বহু বর্ণ এবং চেতনার মিশ্রণ।

হিন্দুদের ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী শিবের অবস্থান এবং, ক্ষমতার সমান্তরাল শক্তি স্বর্গের কোনো দেবতার মধ্যেই দেখা যায় না। দানবদের অত্যাচারে যখনই ত্রিভুবনে ত্রাসের সঞ্চার হয়েছে, শিব দেখা দিয়েছেন ত্রাণকর্তা হিসেবে। সব পুরাণেই শিবের এই রূপের বর্ণনা আছে। যখনই অসুর-দানবদের অত্যাচারে বা অনাগত কোনো বিপজ্জনক ভবিষ্যতে নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে, কিংবা হতে পারে এমন আশঙ্কায় দেবতারা প্রথমেই শরণাপন্ন হতেন পিতামহ ব্রহ্মার কাছে। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সমস্যার মূলে থাকতেন উদার মনের ব্রহ্মা নিজে। যদিও ব্রহ্মার পক্ষে সেইসব সমস্যার সমাধান কখনোই সম্ভব হত না। দেবতারাও সে-কথা জানতেন। কিন্তু তিনি পথ বাতলে দিতে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ফলে প্রথমেই তিনি দেবতাদের নিয়ে দেখা করতেন বিষ্ণুর  এই ত্রিভুবনের স্থিতির পালক বিষ্ণুর সঙ্গে। বিষ্ণুর ক্ষমতা অসীম থাকলেও নিজের নৈতিক বিচারের কাছে ছিলেন তিনি অত্যন্ত সংবেদনশীল পুরুষ। তাই তিনি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজের অপারগতার কথা জানিয়ে দেবতাদের পরামর্শ দিতেন শিবের কাছে যেতে; শিবই একমাত্র দেবতাদের আসন্ন বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন বলে তিনি নিজের দায়িত্ব থেকে নিষ্কৃতি পেতে চাইতেন। যদিও তিনি তাঁর বক্তব্য পেশ করেই পিঠটান দিতেন না। কারণ তিনি তো ত্রিভুবনের পালনকর্তা। ফলে  এবার দেবতারা ব্রহ্মাকে সঙ্গে করে দেবতাদের নিয়ে বিষ্ণুর নেতৃত্বেই কৈলাসে  যেতেন। তাঁদের কাছ থেকে তাঁদের সেই করুণ-কাহিনি সবিস্তারে বর্ণনা দিয়ে শিবের কাছে প্রার্থনা করতেন যাতে তিনি তাঁদের বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। ক্রমাগত দিনের পর দিন এই ভাবেই শিব ত্রিভুবনের ত্রাণকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হতে একদিন 'দেবাদিদেব মহাদেব' হয়ে উঠেছিলেন।

মনে রাখা প্রয়োজন, আদিতে তিনি অবৈদিক দেবতা হিসাবেই স্বর্গীয় অনেক বিষয়েই অপাংক্তেয় থেকে গেছেন। সতীর দেহত্যাগ তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ। কিন্তু যতই তিনি নিজেকে প্রকট করে তুলেছেন, ততই দেবকুল তথ্য তিন ভুবনে তাঁর প্রাধান্য বেড়েছে। এই পৃথিবীতে শুধু হিমালয়ের কন্দর নয়, সর্বত্র, সর্বজীবে ও সর্বপ্রাণে তাঁর অবস্থান। কথায় আছে অল্পে তুষ্ট মহাদেব মাত্র একটি বেলপাতাতেই তৃপ্ত হয়ে তাঁর বরাভয় ও আশীর্বাদের ডালি উপুড় করে দেন সাধারণের মস্তকে। মানবের মাঝে সদা বিচরণ করে মানবের সুখ-দুঃখে, বিপদে-আপদে সদা দৃষ্টি রেখে ছিলেন বলেই আজও এই ধরা অটুট রয়েছে বলে হিন্দু জাতির স্থির বিশ্বাস। আর তাই শ্লোগান, 'হর হর মহাদেব'-এ ('হর' অর্থে মানুষ) উদাত্ত রবে শিবভক্ত কোটি কোটি নারীপুরুষ অচল ভক্তি নিয়ে আছেন। তাই শিবের সর্বত্র অবস্থান যেন এক অনন্য মাত্রা পেয়েছে, কারণ সর্বত্র রয়েছেন মহাদেব।

শিবের এই সর্বশক্তিমান প্রাধান্য যত বেড়েছে, ততই তিনি দেবতাদের মধ্যে সর্বদর্শী চরিত্রের পুরুষ হয়ে উঠেছেন। প্রাধান্য পেয়েছেন পুরাণে; পুরাণই তাঁকে দেবকুলে সর্বোচ্চ শিখরের আসন পেতে দিয়েছে। পুরাণের সৌজন্যেই শিব একদিন বৈদিক দেবতাদের জগতে প্রবেশাধিকার পেয়েছেন, ধীরে ধীরে দেবতাদের স্বর্গীয় স্থান দখল করেছেন এবং দেবকুলের শক্তি পেয়ে নিজের ক্ষমতা বাড়িয়েছেন। সৃষ্টি ও ধ্বংসের প্রতীক হয়ে উঠেছেন সর্বকুলে।

উল্টোদিকে তাঁর এই উত্থানের সঙ্গে মর্যাদা হারিয়েছেন  জগতের স্রষ্টা ব্রহ্মা। তিনি নিজের পুরনো আসন হারিয়ে এক আনুষ্ঠানিক দেবত্বে পর্যবসিত হয়েছেন। তিনি ক্রমশ হারিয়েছেন স্রষ্টার মর্যাদা। এই সূত্রের দিশা পাওয়া যায় পুরাণে বর্ণিত হয়েছে সেই কাহিনি, যেখানে বলা হয়েছে জগতের সৃষ্টির জন্যই ব্রহ্মাকে সৃষ্টি করেছিলেন দেবাদিদেব মহাদেব ভোলা মহেশ্বর। বেদ ও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের ভাণ্ডার তাঁর হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্বয়ং শিব। কিন্তু ব্রহ্মা নিজের প্রারব্ধ কাজ যথানিয়মে সম্পন্ন করতে পারেননি। আর তাই শিবকেই আবার অনুরোধ করেছিলেন তাঁর সন্তান হয়ে জন্ম নিতে। ক্রুদ্ধ শিব ব্রহ্মাকে তিরস্কার করে বলেছিলেন, তাই যদি হবে, তাহলে শিব ব্রহ্মার পঞ্চম মুখ কেটে নিজের মাথার ওপরে লাগিয়ে নেবেন। একদিন নিয়েওছিলেন, পাঁচ-মাথার ব্রহ্মার জায়গায় দেখা দিয়েছিল পাঁচ মাথার শিব।  মহাদেবের 'ঈশান' মুখ তারই সংযোজন।

শিবের সমান মর্যাদা পুরাণে বিষ্ণুর জন্যও নির্ধারিত হয়নি। ভাগবতে বিষ্ণুর দশাবতারের কথা বলা হয়েছে। আমরা জানি, সৃষ্টির আদিকল্প থেকেই বিষ্ণু জগতের কল্যাণের উদ্দেশে ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পালন করতে দশবার অবতার হিসেবে মর্ত্যে আবির্ভূত হয়েছেন এবং কাজ শেষ করে আবার বৈকুণ্ঠে ফিরে গেছেন।

বিষ্ণুর মতো শিব অবতারবাদে বিশ্বাস করেন না, তবুও নানা সময় এবং কারণে ঊনচল্লিশ ভূমিকায় তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সেই ঘটনাগুলিও নিয়েছে পুরাণে বর্ণিত; আগমশাস্ত্রের পৃষ্ঠপোষকতায় মন্দির গাত্রে জায়গা করে নিয়েছে তিনি। এছাড়াও শিব অজস্ররূপে ধরা দিয়েছেন, জনপ্রিয় পুরাণের পাতায় সেইসব রূপের ঠাঁই না হলেও লোকায়ত সমাজে আজও সেগুলি মুখেমুখে ফেরে। কখনো তা উপকথা বলে গৃহীত হয়েছে, বাকি সব কালের স্রোতের ঘূর্ণিপাকে এক বৃত্ত থেকে অন্য বৃত্তে জায়গা পরিবর্তন করেছে।

যখনই শিব-বিষ্ণু একসঙ্গে কোনো ঘটনার পটভূমিতে অবতীর্ণ হয়েছেন, শিবের তুলনায় বিষ্ণুর ভূমিকা গৌণরূপে আখ্যায়িত হতে দেখা গেছে। দেবদারু বনের ঘটনায় যেমন মোহিনীরূপে বিষ্ণু উপস্থিত ছিলেন, কিন্তু কোনো সদর্থক ভূমিকা তাঁর ছিল না; সমুদ্র-মন্থনেও বিষ্ণু দেবতাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করে মোহিনী-মায়াতে অসুরদের বিভ্রান্ত করে অমৃতভাণ্ড দেবতাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু উত্থিত গরল ধ্বংসাত্মক ক্রিয়া প্রশমন তিনি কিছুই করতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত সেই গরল পান করে 'নীলকণ্ঠ' হয়ে শিবই নায়কের সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন। এ সবই তো পুরাণ বর্ণিত আখ্যান। শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে রুদ্র-শিবকে সরাসরি পরব্রহ্মের আসনে বসিয়ে এই বৃত্ত সম্পূর্ণ করা হয়েছে। ভক্তদের বিষ্ণুও এমন কাঙ্ক্ষিত বস্তু প্রদান করতে পারেননি। ভাগবতের ভক্তিমার্গে বলা হয়েছে, ভক্তরা তাঁর প্রতি নিঃশর্ত চূড়ান্ত আনুগত্য প্রকাশ করলে মৃত্যুর পরে বৈকুণ্ঠ লাভ করতে পারে ঠিকই, কিন্তু বৈকুণ্ঠে মেয়াদ পার হলে ভক্তকে আবার সেই পৃথিবীতেই  কোনো-না কোনো রূপে জন্ম নিয়ে জাগতিক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়। আরাধ্য শিবই কেবল মানুষকে চিরমুক্তি দিতে পারেন। প্রাচীনকালে শৈবরাও ব্যতিক্রম ছিল না পারলৌকিক সুখ-ভোগের ইচ্ছে থেকে। পাশুপতরা— যে গোষ্ঠীগুলি হল কালামুখ-কাপালিক-অঘোরী— তাঁদের নিজস্ব আচার-পন্থায় এই কামনা করতেন যে শিবের কৃপায় পাশবিক বন্ধন ছিন্ন হয়ে যেন তাঁদের শিব-লোক প্রাপ্তি হয়, যেখানে শিব-পার্বতীর সাহচর্যে তাঁরা এক অসীম সুখভোগ করতে পারেন।

শিবের যে লিঙ্গরূপ আজও পূজিত হয়ে থাকে, সেই শিশ্নরূপ কিন্তু পুরাকালেই শিব নিজেই পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ দৈবিক রূপ ধারণ করেছেন। কিন্তু দেবতাদের মতো কখনোই সালাঙ্করা হননি। প্রাচীন বেশভূষা তিনি কখনোই ত্যাগ না করে তাঁর জীবনে একবার যা এসেছে, যা তিনি নিজের সঙ্গে যুক্ত করেছেন, তাই তিনি শরীরে ধারণ করে আজকের পরিপূর্ণ চেহারা নিয়েছেন। যতই তাঁর চেহারায় বৈচিত্র্য এসেছে, পুরাণের গল্প ততই উৎসারিত হয়েছে সেই সংযোজনের প্রামাণ্য হিসাবে।

শিবের বিভিন্ন কল্পে নানা কার্যকলাপ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও শিবের রুদ্ররূপ সর্বদাই বিশেষ জল্পনার কেন্দ্রবিন্দু। এমন প্রচণ্ডরূপ তাঁর শান্ত ও সুন্দর শিবরূপের সঙ্গে ঠিক মানানসই নয়। এর অন্য কারণ রয়েছে। আসলে শিবের জীবনবৃত্তে দুটি পৃথক অধ্যায় আছে। কখনো এই দুই অধ্যায় একে ওপরকে আচ্ছন্ন করে, কখনো বা দূরে সরে যায়। একটি অধ্যায়ে শিব বৈদিক রুদ্র, পরের অধ্যায়ে তিনি পরিপূর্ণ শিবত্বে রূপান্তরিত। এর মাঝে তাঁর চেহারাটা একরকম ঘোলাটে চিত্রের মতো ফুটে থাকে; আলাদা করে কাউকেই যেন বোঝা যায় না। পুরাণের গল্পগুলিতে এই দ্বন্দ্ব সর্বত্র লক্ষ করা যায়।

শিবের যে যুদ্ধের ছবি দেখানো হয়েছে তাতে নামভূমিকায় রয়েছেন রুদ্র। পরবর্তী কাহিনি এবং আগমশাস্ত্রের বর্ণনায় রুদ্রের কাজকেই শিবের নামে চালানো হয়েছে। ত্রিপুর-বধ, ব্রহ্মার পঞ্চম মুখ ছিনিয়ে নেওয়া, দক্ষ-যজ্ঞের কাহিনি— এসবই রুদ্রের ছায়ায় সংগঠিত হয়েছে। সেখানে শিবের শান্ত সমাহিত রূপের সঙ্গে কোনো মিলই নেই। শিব যখন কৈলাসবাসী, তখনও ছোটখাটো দানব-নিধনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু শিবের আক্রমক আগ্রাসীরূপ সেখানেও খুব একটা দেখা যায়নি। অভাব দেখা দিয়েছে। এর রূপান্তর ঘটেছে খুব ধীরে ধীরে।

শিবের রুদ্ররূপ আদতে বৈদিক রুদ্রের পরবর্তী চিত্রায়ণ; ত্রিপুর জয়ের কাহিনি ঋকবেদে কল্পনা করা হয়েছিল দেবরাজ ইন্দ্রের এক বিজয় কাহিনিকে কেন্দ্র করে। পরবর্তীতে সেই কৃতিত্ব রুদ্রে অর্পিত হয় আর শেষে প্রক্ষিপ্ত হয় শিবের চরিত্রে। যমের সঙ্গে শিবের বিরোধ সংগঠিত হয় এমন সময়, যখন শিব লিঙ্গরূপ ত্যাগ করেননি। তাই তাঁকে লিঙ্গভেদ করে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল। শিবের অন্যান ধ্বংসাত্মক রূপ— কাম ভস্ম করার কাহিনি, গজাসুর বধ, জলন্ধর সংহার, মল্লারি, অঘোরা, সব চরিত্রই প্রাক-শিব যুগের। পুরাণে সেগুলিই  শিবের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

জগতের সৃষ্টি নিয়ে শিব এবং ব্রহ্মার মধ্যে বিবাদ একটি প্রাচীন কাহিনি। এই জগতে কে শ্রেষ্ঠ, জগৎ তৈরি হয়ে যাওয়ার পরেও এই বিবাদ মেটেনি। ব্রহ্মার সঙ্গে এ নিয়ে বিষ্ণুর বিবাদও বহুচর্চিত। বিশাল জ্যোতিস্তম্ভরূপে শিবের আবির্ভাবের পর ব্রহ্মা-বিষ্ণুর বিবাদের ক্ষণিক বিরতি ঘটে। কিন্তু ব্রহ্মার সঙ্গে শিবের বিবাদ চলেছে দীর্ঘ মেয়াদে। শিব যে সবসময় এগিয়ে ছিলেন এমনও নয়; কূর্মপুরাণের একটি গল্পে শিবের কোণঠাসা হয়ে পড়ার কাহিনিও পাওয়া যায়।

জ্যোতিস্তম্ভ গল্পটি এখানে বলা যেতে পারে। একদা বিশ্বের তাবড় মুনি-ঋষিরা গভীর আগ্রহে জানতে চাইলেন এই বিশ্বের আসল স্রষ্টা কে? এই প্রশ্ন নিয়ে তাঁরা মেরু পর্বতে পৌঁছোলেন পিতামহ ব্রহ্মার কাছে। তখন ব্রহ্মা সেখানেই অবস্থান করছিলেন। নিজের অহঙ্কারীগুণে ব্রহ্মা একবাক্যে ঘোষণা করলেন যে, বিশ্ব সৃষ্টি তিনি একা হাতেই করেছেন।

তৎক্ষণাৎ সেখানে শিব আবির্ভূত হয়ে ব্রহ্মার দাবি নস্যাৎ করে দিলেন। উপস্থিত চার বেদ এবং নাদ-ব্রহ্মও একবাক্য শিবের কথায় সায় দিলেন। আচমকা সকলকে সচকিত করে উপস্থিত হল এক বিশালকায় এক জ্যোতিস্তম্ভ  শিবের পক্ষে প্রমাণ দিতে। ব্রহ্মা তবুও অনড় নিজ কৃতিত্বে, কিছুতেই শিবের কথায় সায় দিচ্ছেন না। ক্রোধে শিব তৈরি করলেন ভৈরবকে, আদেশ দিলেন ব্রহ্মার পঞ্চম শির কেটে ফেলতে। 'যথা আজ্ঞা' বলে ভৈরব আদেশ পালন করলেন; ব্রহ্মা মৃত্যুমুখে পতিত হলেন। দীর্ঘদিনের তপস্যা এবং কৃচ্ছসাধনের গুণে ব্রহ্মা জীবন ফিরে পেলেন। অগত্যা মেনেও নিলেন শিবের আধিপত্য।

এদিকে শিব পড়লেন এক বিপদে। ভৈরব, যা শিবেরই অংশ, ব্রহ্মহত্যা করায় সেই পাপ এসে পড়ল শিবের ওপরে। পাপের হাত থেকে উদ্ধার পেতে ভৈরব ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করতে লাগলেন, সঠিক সংস্কারের দিশা দেখাতে অনুরোধ করলেন। ব্রহ্মাই পথ দেখালেন এই বলে যে, যে মুণ্ড ছিন্ন করেছেন ভৈরব, তা নিয়ে দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করতে হবে যতদিন না বিষ্ণুর সঙ্গে দেখা হয়, তিনিই বাকি পথের সন্ধান দেবেন।

ভৈরব ভিক্ষার্থে পথে বের হলেন, সঙ্গে ভূত-প্রেত। দ্বারে দ্বারে চাইতে লাগলেন অন্ন; বাড়ির স্ত্রী-কন্যারা ভৈরবকে নাগালের মধ্যে পেয়ে তাঁর সঙ্গে নাচতে নাচতে গাইতে গাইতে পথে বেরিয়ে পড়ল। এইভাবে একদিন ভৈরবের দল পৌঁছোল বিষ্ণুর প্রাসাদের বাইরে। দ্বাররক্ষী বিশ্বকসেনা তাদের গতিরোধ করলে ভৈরব সেই রক্ষীকে হত্যা করে আবার ব্রহ্মহত্যা করলেন। ত্রিশূলের মাথায় দ্বাররক্ষীর মৃতদেহ গেঁথে এবার ভৈরব সরাসরি প্রাসাদের ভিতরে; বিষ্ণুর সামনে উপস্থিত হয়ে ভিক্ষা প্রার্থনা করলেন। আগের ঘটনা তো বিষ্ণু সবই জানেন, তিনি ভৈরবের কপালের শিরা কেটে দিলে শিরা থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হয়ে ব্রহ্মার সেই করোটি ভরিয়ে দিল। ভৈরবকে তিনি বললেন, এই তাঁর ভিক্ষা।

আনন্দে এবার ভৈরব জানতে চাইলেন ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে পরিত্রাণের উপায়। বিষ্ণু স্বর্গের দেবীদের অনুরোধ করলেন ভৈরবের ব্রহ্মহত্যা থেকে মুক্তি দিতে, কিন্তু দেবীরা ভৈরবকে সহজে ছেড়ে দিতে গররাজি। শেষে বিষ্ণুর কথামতো ভৈরব রওনা দিলেন বারাণসীর দিকে। পৃথিবীতে বারাণসীই একমাত্র জায়গা যেখানে ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। ভৈরব বারাণসীতে পৌঁছোনো মাত্র তাঁর হাত থেকে ব্রহ্মার করোটী আর দ্বাররক্ষীর দেহ খসে পড়ল; তাঁর এতদিনের পাপ থেকে তিনি পরিত্রাণ পেলেন। শিব নিজদেহ ধারণ করে কৈলাসের দিকে রওনা দিলেন, পিছনে রেখে গেলেন ভৈরবকে বারাণসীর দ্বারপাল হিসেবে।

 


0 কমেন্টস্:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন