![]() |
সমকালীন ছোটগল্প |
অগ্নিপরীক্ষা
ঝুপসি আম গাছটার পাতার অল্পসল্প ফাঁক দিয়ে শেষ বিকেলের আলো। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে উঠোনময়। কিই এক নকশা এঁকেছে যেন বিধাতার হাতের ভাগ্য গননার ছক। অন্তত মাস ছয়েক বাদে বিজ্ঞাপনের অফিস থেকে দিন পাঁচেকের ছুটি নিয়ে মুম্বাই থেকে কলকাতায় ফিরেছে অনুপম। ছেলেবেলার বন্ধু সৌরভের সঙ্গে প্রায়ই ফোনে কথা হয়। সৌরভ বর্ধমানের একটি গ্রামের হায়ারসেকেন্ডারি স্কুলের শিক্ষক। এখনো মনে পড়ে, উচ্চমাধ্যমিকে রাজ্যে তেত্রিশ র্যাংক করার পরেও ভবিষ্যতে শিক্ষক হবার আদর্শটা বুকে জড়িয়ে রেখেছিল সৌরভ। স্কুলশিক্ষা কমিশনের ষোলো সালের প্যানেলে তার চাকরি হয়। গেল সাতবছর সে ছাত্র গড়ানোর কাজেই ব্রতী ছিল। ইতিমধ্যে এক সহশিক্ষিকাকে বিয়েও করে। এখন তাদের একমাত্র মেয়েরর বয়েস এগারো মাস। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল শুধু কিছু মানুষের লাগামছাড়া লোভ আর নীতিহীনতর ফলে আজ তাদের দুজনেরই ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অনুপম মুম্বাইতে বসে টিভিতে দেখেছিল কীভাবে সংসদীয় গণতন্ত্রের ধ্বজাধারীদের ঘর থেকে থরে থরে বের হচ্ছে শিক্ষকপদ বিক্রির টাকা। সাদাখাতা জমা দিয়েও কেবল ঘুষ দিয়ে কিছু অশিক্ষিত মানুষ শিক্ষকতার চাকরি জোগাড় করে নিয়েছে। এরা নাকি হবে মানুষ গড়ার কারিগর?
দেখতে দেখতে অনুপমের মনে হচ্ছিল
সে যেন টাকা নয় মানুষের হাড় আর কংকাল বেরিয়ে আসতে দেখছে। এর সঙ্গে মিশে রয়েছে রাজ্যের
খেটে খাওয়া মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকার অংশভাগ। এ টাকায় তাদের রক্ত লেগে আছে।
হায় রে একেই বোধহয় বলে, 'যার ধন তার ধন নয়। নেপোয় মারে দই।' এইসব সংবিধান-সুরক্ষিত
নেপোর হাতেই আছে আমাদের অসুরক্ষিত ভবিষ্যৎ। ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
দরজা খোলাই ছিল। বাইরের ঘরের তক্তপোষের
ওপর খবরের কাগজে চোখ রেখে বসেছে সৌরভ। দিন শেষের ফ্যাকাশে আলোয় মুখখানা থমথম করছে।
অনুপম এসে দাঁড়াতে মুখ তুললো। ম্লান হেসে বললো, 'কবে ফিরলি? শুনেছিস তো? অগ্নিপরীক্ষা
দিতে হবে আমাদের?'
অনুপম মাথা নাড়ল। সৌরভের পাশে গিয়ে
বসল। সৌরভ যেন খানিকটা নিজের মনেই বললো, 'এতোগুলো বছর পরে আবার কি সম্ভব নতুন করে চাকরির
পরীক্ষায় বসা? তুইই বল আর সেই টেনাসিটি আছে? সত্যি বলতে কি মোটিভেশনও ল্যাক করছে।'
অনুপম কিছুক্ষণ সৌরভের মুখের দিকে
চেয়ে থেকে পিঠে হাত রেখে বলে, 'কী চেহারা হয়েছে তোর? কেন এতো চাপ নিচ্ছিস? আমি মানছি
ব্যাপারটা সত্যিই টাফ কিন্তু যেটা করতে হবে সেটা তো করতেই হবে। মনের জোর হারালে চলবে
না।'
ডুবন্ত মানুষের মত হাঁসফাস করে উঠে সৌরভ বললো, 'আমি যদি আর পাস করতে না পারি অনুপম? তাহলে কী হবে?' সেই দৃষ্টির দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারল না অনুপম। তার মনে পড়ে গেল ছোটোবেলায় বরাবর ক্লাসে ফার্সট সেকেন্ড হওয়া সৌরভের সেই প্রত্যয়ী মুখ। সে বললো, 'তুই মাথা ঠান্ডা রাখ। সব ঠিক হবে।' বললো বটে কিন্তু মনেমনে সেও ভাবল বিষয়টা এতোটাও সহজ নয়।সৌরভ আবার বলতে শুরু করল,'তুই একবার ভাব অনু, আজ যদি রঞ্জন কুমার আর ভঞ্জন কুমারের ডিভিশন বেঞ্চ না হতো তাহলে খুব সহজেই কিন্তু দুধ কা দুধ পানি কা পানি করা যেত। দু হাজার ষোলোতেও প্যানেলে আমার আগে একুশটা ম্যানিপুলেটেড ওএমআর শিট ছিল। তারপরেও আমি ইন্টারভিউতে পাস করে জয়নিং লেটার পাই। আজকে যারা টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছিল তারা কাদেরকে টাকা দিয়েছিল?তাদেরকে কেন খুঁজে বার করে শাস্তি দিচ্ছে না সিবিআই? অন্তত যারা টাকা দিয়েছে তারা তো জানে! বলে দিক না তাদের নাম? আসলে তারা এখনো ভাবছে ঘোলাজলে মাছ ধরবে। বাস্তবিক হলোও তাই। সব ঘুলিয়েই দেওয়া হলো।' কথাগুলো এক নিশ্বাসে বলে গেল সৌরভ।
অনুপম বললো, 'শুনছিলাম এক্সপিরিয়েন্সের
জন্যে নাকি দশ নম্বর রেখেছ?'
'হ্যাঁ তাই নিয়ে তো ফ্রেশ ক্যান্ডিডেটদের
আবার বেজায় ঝাল। স্বাভাবিক। তারা তো আমাদেরকে প্রতিদ্বন্দী ভাবছে! সব থেকে দুখের বিষয়
এদের অনেকেই আবার আমাদেরই ছাত্রছাত্রী।' একরাশ বেদনা ঝরে পড়ল সৌরভের কন্ঠস্বরে।
অনুপম একটু থেমে বলল, 'রিভিউ না
হওয়া অবধি নতুন করে পরীক্ষা নেবার সিদ্ধান্তটাই তো ভুল বলে মনে করি। আসলে সাধারণ মানুষ
খেয়োখেয়ি করে মরুক আর রাষ্ট্রীয় নেপোরা দই খেয়ে যাক। এই তো উদ্দেশ্য।'
'আজ সাত বছর সপ্তাহে পাঁচ দিন রোজ
নব্বই কিলোমিটার জার্নি করে স্কুল করছি। ট্রেন থেকে নেবে ট্রেকার। ট্রেকার থেকে নেবে
সাইকেল। কেতুডিহির সাইকেল স্ট্যান্ডে আমার সাইকেল পড়ে আছে আজও। কোর্টের রায়ে বাড়িতে
বসে গেলাম। বাড়িতে আমার বৃদ্ধ বাবা মা। তাঁদের রোগ ব্যাধি। ওষুধ বিষুধ। আমার মেয়ের বয়েস
এগারো মাস। কয়েক বছর পর তারও লেখাপড়া ইস্কুল শুরু হবে। কুমকুম আর আমার দুজনেরই চাকরি
গেল! দুজনেই আবার পরীক্ষায় বসব। দুজনেই যদি আর পাশ করতেই না পারি? কী হবে? আমাদের সংসারটা
তো একেবারে ভেসে যাবে রে অনু?'
অনুপম মনে মনে সহমত হল। প্যানেল
মানে তো কেবল কতগুলো নাম নয়? কতগুলো আস্ত জীবন।তাদের মা বাবা, সন্তান সন্ততি, স্বামী স্ত্রী,
আত্মীয় পরিজন। তাদের রোগভোগ, শোক সুখ, লেখাপড়া!জীবনের আগায় এক্কাগাড়ির ঘোড়ার মত ছুটছে
মানুষ। চাকরি পাওয়ার পর একটা ছেলে অথবা মেয়ে জীবনের মাটিতে কত গভীরে শিকড় ছড়িয়ে ফেলে
তা কি জানে না অনুপম? কথায় কথায় সময় গড়িয়ে যায়। বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়।
অনুপমের মোবাইল সারা রাতই খোলা থাকে। এডভারটাইজিং এজেন্সিতে কাজ করা লোকেদের সেভাবে নিরুপদ্রব ছুটি বলে কিছু হয় না। রাত বারোটাতেও ঊর্ধ্বতনের থেকে নির্দেশ আসতে পারে অথবা অধস্তনকে নির্দেশ দিতে হতে পারে। তাই ফোন সুইচ্ডঅফ করার রেয়াজ নেই। তাছাড়া মুম্বাইয়ের মত মায়া নগরীতে কিবা রাত আর দিন! মানুষ ইচ্ছে হলে রাত দুটোতেও কফি খেতে বেরিয়ে পড়তে পারে নির্দ্বিধায়। এখানে জীবন সদাবহমান। সকলেই ছুটছে। পড়ে গেলে নিজেই উঠে পড়ছে। আবার ছুটছে। গেল দশ বছর মুম্বাইতে আছে অনুপম। এই শহর ছেড়ে একেবারে চলে যাবার কথা সে ভাবতেও পারে না। কটা দিন মা বাবা আর ছোটো বোনের সঙ্গে সময় কাটিয়ে সে ফিরে যাবে মুম্বাই। এ বাড়িতে এখনো কেউ জানে না সাত মাস হয়ে গেল অফিস কলিগ শেহনাজের সঙ্গে মুম্বাইতে লিভইন করছে সে। দুজনে সমান কন্ট্রিবিউট করে রেন্ট-এ। শেহনাজের সঙ্গে লেটনাইট পর্যন্ত ভিডিওকলে কথা বলে সবে ঘুমটা ধরেছে। ভোর রাতে টেবিলের ওপর মোবাইলটা বেজে উঠল। অভ্যাসবশত ঘুমের ঘোরেই ফোনটা ধরল অনুপম। সুশান্তর কান্নার ভিতর থেকে যে কটা শব্দ সে উদ্ধার করতে পারলো তাতে তার সারা শরীর অবশ হয়ে এলো। সে স্পষ্ট দেখতে পেল, উঠোনের ঝুপসি আমগাছটায় অন্ধকার মেখে চিরকালের মত ঘুমিয়ে পড়েছে সৌরভ। তার ঝুলন্ত পায়ের নিচে ছড়িয়ে আছে বাতিল ওএমআর শিটের মত অজস্র শুকনো পাতা...
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন