কলকাতার কুটিরশিল্প
গ্রাম শহরের মেলবন্ধন মূলত বাণিজ্যকেন্দ্রিক ছিল না, বরং ছিল কিছুটা বিলাসিতাও। একসময় গ্রাম থেকে শহরে আসতে মানুষ চাইত না। শহুরে আদব কায়দাকে এক শ্রেণীর মানুষ ঘৃণা করত। কিন্তু তা সত্ত্বেও শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল বহু কুটিরশিল্প। তেমনই এক গুরুত্বপূর্ণ শহর হল কলকাতা। এই শহরের গোড়াপত্তনের সময় থেকেই বেশ কিছু কুটিরশিল্প গড়ে উঠেছিল, যেমন কাঠ-খোদাইশিল্প, মৃৎশিল্প, পটচিত্রশিল্প ইত্যাদি।
সাহেবদের কলকাতা তখন বসবাস করার যোগ্য ছিল না। চারিদিকে ঘন বন জঙ্গল, জলা বনভূমি, অর্ধনগ্ন মানুষজন, উভয়ে উভয়ের ভাষা জানে না। তাদের রোগে ধরলে চিকিৎসার ভাষা বোঝার কেউ নেই। এমন পরিস্থিতিতে সাহেবরা নিজেদের স্বার্থে কলকাতার গোটা বনজঙ্গল সাফ করে গড়ে তুলল শহর। আর এই শহরকে ঘিরে বেড়ে চলল ব্যবসা ও বিলাস। কিছু মানুষ আবার ব্যবসা করতে করতেই নেটিভদের শিক্ষিত করে তোলার তাগিদ বোধ করে ঘর বানিয়ে শিক্ষালয় গড়ে তুলল। স্বভাবতই প্রয়োজনীয়তা দেখা গেল অনেক কিছু। সভ্যতা চায় অগ্রগতি। এইভাবে সুতানুটি ছাড়িয়ে কলকাতা বিস্তৃত হয়ে গোবিন্দপুর হল। মুঘল শাসনের সময় এত সবকিছু কারো মাথায় ছিল না। সাহেবরা একদিকে নীলকুঠি চালায়, যুদ্ধ করে, আবার নেটিভদের ভালোমন্দ চিন্তাও করে। কাঁচা ছাউনিবাড়ি বাঁচাবার জন্য আনন্দ উৎসবে বাজি পোড়ানো নিষিদ্ধ করেছিল।
সাহেব শিল্পীদের দিয়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা শহরের ছবি আঁকা তাগিদ বোধ করলেন এই নতুন শহুরে প্রভুরা। আবার কেউ কেউ নিজে থেকেই কৌতুহলী হলেন এই বৈপরীত্য ভরা শহরটার বিবরণ লেখা ও অঙ্কনে ধরে রাখার জন্য। এর থেকেই ধীরে ধীরে কলকাতার মানুষদের মধ্যে উৎসাহ বাড়ল পটচিত্র আঁকার। দৈনন্দিন জীবনে তারা যা দেখতো এঁকে রাখতো খুব সুন্দরভাবে পটের মধ্যে। কলকাতায় সাহেব এবং স্থানীয় মানুষদের নিয়ে গড়ে উঠল এক মিশ্র সংস্কৃতি। তখন সবথেকে উল্লেখযোগ্য শিল্প পটশিল্প।
পটশিল্প
মুঘল শাসনের সময় থেকে মিনিয়েচার ছবির যে বিস্তার তখন ছিল, তার প্রভাব শিল্পীদের মধ্যেও লক্ষ্য করা গেছিল। কিন্তু এই বঙ্গের নিজস্ব জলবায়ু ও মানসিক গঠনে যে শিল্প এসেছিল স্বতস্ফুর্তভাবে, তা আলপনা এবং পটচিত্র থেকে। স্বভাবতই যারা এই সমস্ত শিল্পের রচয়িতা তাদের মনের মধ্যে ছিল ধর্মীয় ভক্তি বা মহাজাগতিক বর্ণনা। রামায়ণ-মহাভারত এইসব শিল্পের জন্য আদর্শ বিষয়বস্তু ছিল। বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে এসেছিল নদীয়ার নিমাই-এর আগমনে। বৈষ্ণব, শাক্ত বিভাজনে সবাই মেতেছিল।
গ্রাম থেকে পটুয়ারা পটে এঁকে কলকাতার গ্রামে কালীঘাটে এনে বিক্রি করত। গ্রামের পট তখন ছিল আখ্যানধর্মী। এদের রেখা রঙ সবই ছিল দেশীয়। একজন পটুয়াশিল্পী অল্প সময়ের মধ্যে অনেক পট এঁকে দিতে পারত এবং সে পারার মধ্যে ছিল অসম্ভব পেশাদারিত্ব ও সৌন্দর্য্যবোধ। একজন শিল্পী দ্রুত তুলির টানে যেসব পট তৈরি করত তার মধ্যে ছিল সম্পূর্ণ স্বকীয়তা। এরা অল্পস্বল্প হলেও মিনিয়েচার ছবির সাথে পরিচিত ছিল, কিন্তু ইউরোপিয়ান ছবির সঙ্গে একেবারেই পরিচিত ছিল না। এমনকি ড্যানিয়েল, সলভিনস বা ডয়লিদের করা কাজ দেখার সুযোগ এরা পায়নি। কিন্তু এদের করা পটচিত্র আঁকা দেখলে কতটা প্রভাব পড়ত তাদের শিল্পের মধ্যে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এইসব পটুয়াদের কারিগরি দক্ষতা সবটাই ছিল সহজাত। ওরা ছবিতে যে তুলির টান ফুটিয়ে তুলত এবং ছবির যা বিষয়বস্তু ছিল, তা অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক।
একদিকে শিক্ষিত বিদেশী শিল্পীদের হাতে কলকাতার অক্ষয় হতে থাকলো অন্যদিকে গ্রামীণ মানুষের সহজাত দক্ষতা কলকাতা প্রত্যক্ষ করতে থাকলো 'কালীঘাট পট'। কলকাতার ঘরে ঘরে কদর পেল এইসব পট। সাহেবরা দেখল তারা কোনভাবেই এই শিল্পের মধ্যে প্রবেশ করতে পারবে না। ওদের এরমধ্যে প্রবেশ করতে আরো কয়েকটা দশক লেগে যাবে। কলকাতায় পটশিল্পের সাথে সাথে আর এক শিল্পের বিস্তার দেখা দিয়েছিল, তা হল মৃৎশিল্প ও গয়নাশিল্প।
মৃৎশিল্প ও গয়নাশিল্প
এই সময় সাহেবদের আনুকূল্যে নব্যধনী কলকাতাবাসীরা সাহেব স্থাপত্যবিদদের ধরে ঘরবাড়ি বানাচ্ছেন এবং ঘরে-বাইরে বিদেশী মূর্তি, ছবি, আসবাবপত্র দিয়ে সাজাচ্ছেন। জাহাজভর্তি শিল্পসামগ্রী আসছে শুধুমাত্র সাহেব ও নব্যধনী কলকাতাবাসীদের জন্য। কলকাতা গ্রামের নেটিভদের শিল্পভাবনা প্রকাশ পাওয়ার সুযোগ সেভাবে পাওয়া যেত না তখন। কুমোরটুলিতে ছোট ছোট বসতি গড়ে তুলল ব্ল্যাক জমিদারেরা। তাদের বাড়ির পুজোর মূর্তি গড়ার জন্য এই নেটিভ শিল্পীরা ছাড়া আর কেউ করতে পারত না। আবার মাঝে মাঝে এই শিল্পীদের ডাক পড়ত সাহেব শিল্পীদের কাজে হাত লাগানোর জন্য। কলকাতার ধনীদের ঘরে ছোট-খাটো মূর্তি, ছবি যা মূলত ধর্মীয় তা গড়ে দেওয়ার জন্য ডাকা হত। দেবদেবীদের সাথে তো সাহেবদের কখনো এক আসনে বসানো যায় না, তাই সে ক্ষেত্রে এই নেটিভ শিল্পীদেরকেই এই কাজে লাগানো হত। ম্লেচ্ছোরা ছুঁয়ে দিলে সবকিছু রসাতলে যাবে, এই ভাবনা কাজ করত কলকাতাবাসীদের মনে। ধর্মের রাস্তা দিয়েই এইসব শিল্পীদের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়তে শুরু করল এবং একই সঙ্গে গড়ে উঠল মৃৎশিল্প।
নতুন করে গড়ে ওঠা শহুরে শিল্পী শব্দটার সঙ্গে কলকাতাবাসীর পরিচয় সামান্যই ছিল ধরে নেওয়া যায়। কাপড়ে নকশা তোলা, কাপড়ে কাঠের ব্লকে ছাপা, সুতি কাপড়ে নকশা তোলা, কাপড়ে রঙ করা, এসব তো ছিলই অনেকদিন ধরে। সুতানুটি বাজারের দৌলতে সারা বাংলা জুড়ে তখন ছিল এই সব শিল্পীদের কদর। আর গরান গাছের দৌলতে গরানহাটার সঙ্গে কুমোরটুলি একটা শিল্পের আভাস উঁকি দিচ্ছিল।
অলংকার তৈরীর জন্য কারিগর বা শিল্পী যোগানে কলকাতায় বাঙালিদের সাথে সাথে অবাঙালি কারিগর শিল্পীদের একটা প্রচেষ্টা তখন দেখা যায়। সাহেবরা বিদেশ থেকে সেজন্য অনেক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আনতে সেসময় কার্পণ্য করেনি। সেসময় একশ্রেণীর হাতে এত অর্থ ছিল যে তা কীভাবে শেষ করবে বুঝতে পারত নাl আর এক শ্রেণী বেঁচে থাকার জন্য শুধু ছুটে বেড়াত দিনরাত। এই বৈষম্য খুব প্রকট ছিল। তবে বৈষম্য শুধু কলকাতায় নয়, বরং ভারতবর্ষে আবহমানকাল ধরে চলে আসছিল।
খোদাইশিল্প
আর একটি শিল্প বৃহৎ আকারে কলকাতায় দেখা যায় তা হচ্ছে খোদাই শিল্প। সলভিনস সাহেব বা মাদাম বেলেনোস-এর আঁকাতে অনেকের পেশা রূপ পেয়েছে। কিন্তু নেটিভ শিল্পীদের পেশা নিয়ে বিশেষ কোনো উল্লেখ নেই। বিশেষ করে খোদাইশিল্পী বা কারিগরদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানাই যায়নি। এমনও হতে পারে এসব শিল্পী ও কারিগরদের সংখ্যা এতটাই কম ছিল যে তাদের খুঁজে পাওয়া হয়তো কষ্টসাধ্য ছিল। বাংলা বইয়ে ছবি ছেপে গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিলেন ১৮১৬ সালে। মাত্র ৬টি ছবি কাঠ ও ধাতুতে খোদাই করে রামচাঁদ রায় বিখ্যাত হয়েছিলেন। বাংলায় অন্নদামঙ্গলকে প্রথম সচিত্র বাংলা বই হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও কিছু কিছু খোদাই শিল্পীরা সাহেবদের কাছে তালিম নিয়ে অন্যান্য বইয়ের জন্য কাজ করে গেছেন। Mildred Archer কলকাতার কয়েকজন বিদেশী খোদাই শিল্পীর কথা বলেছেন, Cabel Garlend, John Alefounder, Richard Brittridge, John Brown, Aron Upjohn ও James Moffat (Archer Mildred, ৷ndian popular painting (London 1977) p- 159) এঁদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে কলকাতা ছাপাখানা শুরুর গোড়ার দিকের খোদাইশিল্পী হিসেবে। অর্থাৎ ছাপাখানার বাড়বাড়ন্তর সঙ্গে এই শিল্পীদের ও কারিগরদের একটা চাহিদা ছিল। সাহেবরা গল্পের আখ্যান ভাবে কল্পনায় বাস্তব চেহারা দিয়েছিলেন। সেই দক্ষতা তাঁরা দেশ থেকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু আমাদের স্থানীয় শিল্পীরা কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেয়ার ক্ষমতা তখনো অনুসরণ করতে পারেননি। কোম্পানি আমলের শিল্পীদের অনুকরণে কিছু তেলরঙে আঁকা দেবদেবীর ছবির চল শুরু হয়েছিল ১৮শতক থেকে। ঐ সমস্ত দেবদেবীর মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছিল তাঁদের শোনা কাহিনী থেকেই। এর মধ্যে বাঙালি ঘরানার পোশাক-আশাকও চরিত্র বর্ণনা হয়েছে বেশি, আর ইউরোপিয়ান ঘরানার ব্যাকগ্রাউন্ড ভরাট হয়েছে। পুঁথির ছবি ও মিনিয়েচারের ছবি এইসব শিল্পীদের কল্পনাকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করেছে। যে সময় কোম্পানি প্রভাবিত ছবি হচ্ছে, সে সময় রামচাঁদ রায়ের ৬টি ছবি কিছুটা বেমানান মনে হতেই পারে। কালীঘাটের পটুয়ারা ডৌল গঠন প্রকৃতির পট আঁকা শুরু করে দিয়েছিল। কব্জি থেকে কনুই ঘুরিয়ে রেখা আর তার ধারে ধারে রঙের টানে চেহারার ডৌল ফুটিয়ে ওদের ওস্তাদি মানুষের মন কেড়ে নিতে পেরেছিল। রামচন্দ্র রায় চেষ্টা করেছিলেন কিছু কিছু আলো ছায়া দিয়ে একটা ত্রৈমাত্রিক চেহারা আনতে। তুলি ও রং সে কাজটা সফল ভাবে করতে পেরেছে। এই সময় যে সমস্ত কাঠখোদাই শিল্পীর আবির্ভাব ঘটেছিল, তাঁরা হলেন কাশীনাথ মিস্ত্রি (তিনি তামার পাতে এনগ্রেভ করতেন), জোড়াসাঁকোর হরিহর বন্দ্যোপাধ্যায়চ (যাঁর এক একটা খোদাই প্লেটের দাম পড়ত এক মোহর)। এই ভাবে কেউ কেউ এই মাধ্যমটিকে উৎসাহ দিয়েছিলেন।
এই শহরের ভাগ্যে সরস্বতী আসার সুযোগ করে দেন এইসব ধর্মীয় যাজকরা। তাঁদের প্রচেষ্টাতেই অনবরত প্রেস, পত্রিকা, বই হতে থাকে কলকাতায়। হলুদ পাতায় মোড়া পুঁথির যুগকে বিদায় জানিয়ে লোহার যন্ত্রের মধ্যে দিয়ে ছাপার অক্ষর সহ বই ছবি ঘরে ঘরে পৌঁছানোর জন্য ওদের চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিল না ৷ এর সাথে সাথে গড়ে উঠেছিল ছাপাশিল্প বা মুদ্রণশিল্প।
কাঁসা ও পিতলশিল্প
এই শিল্প গড়ে ওঠে কাঁসা ও পিতলের থালাবাসন, কলসী, চামচ, ঘটিবাটি, ফুলদানি ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে। এই কাঁসা, পিতল বাসনের ব্যবহার যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এই শিল্পের সাথে যুক্ত বহু মানুষ। মূলত গ্রামের মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে এই শিল্পকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু এখন আর কাঁসা ও পিতলের সামগ্রীর তেমন ব্যবহার নেই। ফলে এই শিল্প ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে যেতে বসেছে।
বাঁশ ও বেতশিল্প
একসময় শহুরে মানুষ রকমারি বেতের সোফাসেট, ঝুড়ি, কুলা, মোড়া, পাটি, দোলনা, মাছ ধরার বিভিন্ন সামগ্রী ইত্যাদি জিনিস ব্যবহার করতে শুরু করে। গ্রামের মেয়েরা বাঁশ ও বেতের জিনিস তৈরি করে হাটে এনে বিক্রি করত। পরবর্তীকালে সেই সমস্ত জিনিস শোভা পেতে থাকে কলকাতার নব্যপরিচিত জমিদার বাড়িগুলোতে। গ্রামের জিনিস ধীরে ধীরে শহরে আসতে শুরু করে। এই বাঁশ, বেতের জিনিসগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক শিল্প।
এছাড়াও শঙ্খ, ঝিনুক, হাতির দাঁত ও হাড় থেকে মালা, বোতাম, শাখা, চিরুনি, খেলনা ইত্যাদি জিনিসকে কেন্দ্র করে গ্রাম বাংলার কুটিরশিল্প গড়ে ওঠে ক্রমশঃ৷ মূলত এই কুটির শিল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছিল মহিলারা। তারা জীবন, জীবিকার প্রয়োজনে এই শিল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
ঋণ স্বীকারঃ
ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায় (Art
Manufacture of india p - 29)
পরিকথা পত্রিকা
0 কমেন্টস্:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন